গৃহদাহ – ৩১-৩৫

একত্রিংশ পরিচ্ছেদ

শীতের সূর্য অপরাহ্নবেলায় ঢলিয়া পড়িবার উপক্রম করিতেছিল, এবং তাহারই ঈষত্তপ্ত কিরণে শোন নদের পার্শ্ববর্তী সুদূর বিস্তীর্ণ বালু-মরু ধু-ধু করিতেছিল। এমনি সময়ে একটা বাঙলোবাটীর বারান্দায় রেলিং ধরিয়া অচলা সেইদিকে চাহিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। তাহার নিজের জীবনের সঙ্গে ওই দগ্ধ মরুখণ্ডের কোন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল কি না, সে অন্য কথা, কিন্তু ঐ দুটি অপলক চক্ষুর প্রতি পলকমাত্র দৃষ্টিপাত করিলেই বুঝা যাইতে পারিত যে, তেমন করিয়া চাহিয়া থাকিলে দেখা কিছুই যায় না, কেবল সমস্ত সংসার একটা বিচিত্র ও বিরাট ছায়াবাজীর মত প্রতীয়মান হয়।

দিদি?

অচলা চমকিয়া ফিরিয়া চাহিল। যে মেয়েটি একদিন ‘রাক্ষুসী’ বলিয়া নিজের পরিচয় দিয়া আরা স্টেশনে নামিয়া গিয়াছিল, এ সেই। কাছে আসিয়া অচলার উদ্‌ভ্রান্ত ও একান্ত শ্রীহীন মুখের প্রতি মুহূর্তকাল দৃষ্টি রাখিয়া অভিমানের সুরে কহিল, আচ্ছা দিদি, সবাই দেখচে সুরেশবাবু ভাল হয়ে গেছেন; ডাক্তার বলচেন, আর একবিন্দু ভয় নেই, তবু যে দিবারাত্রি তোমার ভাবনা ঘোচে না, মুখে হাসি ফুটে না, এটা কি তোমার বাড়াবাড়ি নয়? আমাদের কর্তারা আছেন, তাঁদের অসুখ-বিসুখেও আমরা ভেবে সারা হই, কিন্তু মাইরি বলচি ভাই, তোমার সঙ্গে তার তুলনাই হয় না।

অচলা মুখ ফিরাইয়া লইয়া শুধু একটা নিশ্বাস ফেলিল, কোন উত্তর দিল না।

মেয়েটি রাগ করিয়া বলিল, ইস্‌! ফোঁস করে যে কেবল দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে বড়! বলিয়া কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করিয়া যখন অচলার নিকট হইতে কোনপ্রকার জবাব পাইল না, তখন তাহার একখানি হাত নিজের মুঠার মধ্যে টানিয়া লইয়া অত্যন্ত করুণকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা সুরমাদিদি, সত্যি কথা বলো ভাই, আমাদের বাড়িতে তোমার একদণ্ডও মন টিকছে না, না? বোধ হয় খুব অসুবিধে আর কষ্ট হচ্ছে, সত্যি না?

অচলা নদীর দিকে যেমন চাহিয়াছিল, তেমনি চাহিয়া রহিল; কিন্তু এবার উত্তর দিল, কহিল, তোমার শ্বশুর আমার যে উপকার করেছেন সে কি এ-জন্মে কখনো ভুলতে পারবো ভাই!

মেয়েটি হাসিল; কহিল, ভোলবার জন্যই যেন তোমাকে আমি সাধাসাধি করে বেড়াচ্চি! এবং পরক্ষণেই কৃত্রিম অনু্যোগের কণ্ঠে বলিল, আর সেজন্যই বুঝি তখন বাবার অত ডাকাডাকিতেও সাড়া দিলে না? তুমি ভাবলে, বুড়ো যখন তখন—

অচলা একান্ত বিস্ময়ে মুখ ফিরাইয়া বলিয়া উঠিল, না, এমন কখ্‌খনো হতে পারে না।

রাক্ষুসী জবাব দিল, পারে না বৈ কি! তবু যদি না আমি নিজে সাক্ষী থাকতুম! ঠাকুরঘর থেকে আমার কানে গেল,—সুরমা! ও-মা সুরমা! এমন চার-পাঁচবার শুনলুম, বাবা ডাকছেন তোমাকে! পূজোর সাজ করছিলুম, একপাশে ঠেলে রেখে ছুটে এসে দেখি তিনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছেন। সত্যি বলছি দিদি, তামাশা করছি নে!

অচলাই শুধু মনে মনে বুঝিল, কেন বৃদ্ধের ‘সুরমা’ আহ্বান তাহার বিমনাচিত্তের দ্বার খুঁজিয়া পায় নাই। তথাপি সে লজ্জায় অনুতাপে চঞ্চল হইয়া উঠিল। কহিল, বোধ হয় তাই ঘরের মধ্যে—
রাক্ষুসী বলিল, কোথায় ঘরের মধ্যে। যাঁর জন্যে ঘর, তিনি যে তখন বাইরে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। উঠান থেকে স্পষ্ট দেখতে পেলুম, ঠিক এমনি রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে। বলিয়া একটু থামিয়া হাসিমুখে বলিল, কিন্তু তুমি ত আর তোমাতে ছিলে না ভাই, যে বুড়ো-সুড়োর ডাক শুনতে পাবে! যা ভেবেছিলে, তা যদি বলি ত—

অচলা নীরবে পুনরায় নদীর পরপারে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিল, এই-সকল ব্যঙ্গোক্তির উত্তর দিবার চেষ্টামাত্র করিল না। কিন্তু এইখানে বলিয়া রাখা প্রয়োজন যে, রাক্ষুসী নামের সহিত তাহার স্বভাবের বিন্দুমাত্র সাদৃশ্য ছিল না; এবং নামও তাহার রাক্ষুসী নয়, বীণাপাণি। জন্মকালে মা মরিয়াছিল বলিয়া পিতামহী রাগ করিয়া এই অপবাদ দিয়াছিলেন, এবং প্রতিবেশী ও শ্বশুর-শাশুড়ির নিকট হইতে এ দুর্নাম সে গোপন রাখিতে পারে নাই।

অচলাকে অকস্মাৎ মুখ ফিরাইয়া নির্বাক হইতে দেখিয়া সে মনে মনে লজ্জা পাইল, অনুতপ্ত-স্বরে বলিল, আচ্ছা সুরমাদিদি, তোমাকে কি একটা ঠাট্টাও করবার জো নেই ভাই? আমি কি জানিনে, বাবাকে তুমি কত ভক্তি-শ্রদ্ধা কর? তাঁর কাছে ত আমরা সমস্ত শুনেচি।

তিনি সকালে বেড়িয়ে আসছিলেন, আর তুমি এই অজানা জায়গায় কাঁদতে কাঁদতে ডাক্তার খুঁজতে ছুটেছিলে। তারপরে তিনি তোমার সঙ্গে গিয়েই সরাই থেকে তোমার স্বামীকে বাড়ি নিয়ে এলেন। এ সবই ভগবানের কাজ দিদি, নইলে এ বাড়িতে যে তোমাদের পায়ের ধুলো পড়বে, সেদিন গাড়িতে এ কথা কে ভেবেছিল? কিন্তু আমার প্রশ্নের ত জবাব হলো না। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলুম, আমাদের এখানে যে তোমার একদণ্ডও ভাল লাগচে না, সে আমি টের পেয়েচি। কিন্তু কেন? কি কষ্ট, কি অসুবিধে এখানে তোমাদের হচ্ছে ভাই, তাই কেবল জানতে চাইচি; বলিয়া পূর্বের মত এবারও ক্ষণকাল অপেক্ষা করিয়া হঠাৎ এই মেয়েটির মনে হইল, যে-কোন কারণেই হোক, সে উত্তরের জন্য মিথ্যা প্রতীক্ষা করিয়া আছে। তখন যাহাকে তাহার শ্বশুর সসম্মানে আশ্রয় দিয়াছেন এবং সে নিজে সুরমাদিদি বলিয়া ভালবাসিয়াছে, তাহার মুখখানা জোর করিয়া টানিয়া ফিরাইবামাত্রই দেখিতে পাইল, তাহার দুই চক্ষের কোণ বাহিয়া নিঃশব্দে অশ্রুর ধারা বহিয়া যাইতেছে; বীণাপাণি স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল এবং অঞ্চলে অশ্রু মুছিয়া শূন্যদৃষ্টি অন্যত্র সঞ্চারিত করিল।

পরদিন অপরাহ্নবেলায় সদ্যপ্রাপ্ত একখানা মাসিকপত্র হইতে একটা ছোটগল্প বীণাপাণি অচলাকে পড়িয়া শুনাইতেছিল। একখানা বেতের চৌকির উপর অর্ধশায়িতভাবে বসিয়া অচলা কতক-বা শুনিতেছিল, কতক-বা তাহার কানের মধ্যে একেবারেই পৌঁছিতেছিল না, এমনি সময়ে বীণাপাণির শ্বশুর রামচরণ লাহিড়ী মহাশয় সিঁড়ি হইতে ‘মা রাক্ষুসী’ বলিয়া উপস্থিত হইলেন। উভয়েই শশব্যস্ত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, বীণাপাণি একখানি চৌকি টানিয়া বৃদ্ধের সন্নিকটে স্থাপিত করিয়া উৎসুক হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন বাবা?
এই বৃদ্ধ অত্যন্ত নিষ্ঠাবান্‌ হিন্দু। তিনি ধীরে-সুস্থে আসন গ্রহণ করিয়া অচলার মুখের প্রতি সস্নেহ প্রশান্ত দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, একটা কথা আছে মা। ভট্‌চায্যিমশাই এইমাত্র এসেছিলেন, তিনি তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর নামে সঙ্কল্প করে নারায়ণকে তুলসী দিচ্ছিলেন, তা কাল শেষ হবে। তবে কাল তোমাকে মা, কষ্ট স্বীকার করে একটু বেলা পর্যন্ত অভুক্ত থাকতে হবে। তিনি আমাদের বাড়িতেই নারায়ণ এনে কাজ সমাপ্ত করে যাবেন, আর কোথাও তোমাকে যেতে হবে না। কথা শুনিয়া অচলার সমস্ত মুখ একেবারে কালিবর্ণ হইয়া উঠিল। ম্লান আলোকে বৃদ্ধের তাহা নজরে পড়িল না, কিন্তু বীণাপাণির পড়িল। সে হিন্দুঘরের মেয়ে, জন্মকাল হইতে এই সংস্কারের মধ্যেই মানুষ হইয়াছে এবং পীড়িত স্বামীর কল্যাণে ইহা যে কত উৎসাহ ও আনন্দের ব্যাপার, তাহা সে সংস্কারের মতই বুঝে, কিন্তু অচলার মুখের চেহারার এই উৎকট পরিবর্তনে তাহার বিস্ময়ের অবধি রহিল না। তথাপি সখীর হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা বাবা, নারায়ণকে তুলসী দেওয়ালে ত তুমি সুরেশবাবুর জন্যে, তবে উনি উপোস না করে দিদিকে করতে হবে কেন?

বৃদ্ধ সহাস্যে কহিলেন, তিনি আর তোমার এই দিদিটি কি আলাদা মা? সুরেশবাবু ত তাঁর এ অবস্থায় উপবাস করতে পারবেন না, তাই তোমার সুরমাদিদিকেই করতে হবে। শাস্ত্রে বিধি আছে মা, কোন চিন্তা নাই।

অচলা ইহারও প্রত্যুত্তরে যখন হাঁ-না কোন কথাই কহিল না, তখন তাহার এই নিরুদ্যম নীরবতা অকস্মাৎ এই শুভানুধ্যায়ী বৃদ্ধেরও যেন চোখে পড়িয়া গেল। তিনি সোজা অচলার মুখের প্রতি চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন, এতে কি তোমার কোন আপত্তি আছে সুরমা? বলিয়া একান্ত ও পুনঃ পুনঃ প্রতিবাদের প্রত্যাশায় চাহিয়া রহিলেন।

অচলা সহসা ইহারও কোন প্রত্যুত্তর দিতে পারিল না। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে কহিল, তাঁকে বললে তিনিই করবেন বোধ হয়।

তাহার পরে সকলেই নীরব হইয়া রহিল। কথাটা যে কিরূপ বিসদৃশ, কত কটু ও নিষ্ঠুর শুনাইল, তাহা যে ব্যক্তি উচ্চারণ করিল, তাহার অপেক্ষা বোধ করি কেহই অনুভব করিল না, কিন্তু শুধু অন্তর্যামী ভিন্ন সে কথা আর কেহ জানিতে পারিল না।

বৃদ্ধ উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, তবে তাই হবে, বলিয়া ধীরে ধীরে নীচে নামিয়া গেলেন। ভৃত্য আলো দিয়া গেল, কিন্তু দুজনেই সঙ্কুচিত ও কুণ্ঠিত হইয়া তেমনি নিঃশব্দে বসিয়া রহিল। মাসিকপত্রে সেই অত বড় উত্তেজক ও বলশালী গল্পের বাকিটুকু শেষ করিবার মত জোরও কাহারও মধ্যে রহিল না।

বাহিরের অন্ধকার গাঢ় হইয়া উঠিতে লাগিল এবং তাহাই ভেদ করিয়া পরপারের ধূসর সৈকতভূমি এক হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত এই দুইটি ক্ষুব্ধ মৌন লজ্জিত নারীর চক্ষের উপর স্বপ্নের মত ভাসিতে লাগিল।

এইভাবেই হয়ত আরও বহুক্ষণ কাটিতে পারিত, কিন্তু কি ভাবিয়া বীণাপাণি সহসা তাহার চৌকিটা অচলার পাশে টানিয়া আনিল এবং নিজের ডান হাতখানি সখীর কোলের উপর ধীরে ধীরে রাখিয়া চুপি চুপি কহিল, ও-পারের ওই চরটার পানে চেয়ে চেয়ে আমার কি মনে হচ্ছিল জান দিদি? মনে হচ্ছিল যেন ঠিক তুমি। যেন অমনি অন্ধকার দিয়ে ঘেরা একটুখানি—ও কি, এমন শিউরে উঠলে কেন ভাই?
অচলা মুহূর্তকাল নির্বাক থাকিয়া অস্ফুটস্বরে বলিল, হঠাৎ কেমন যেন শীত ক’রে উঠল ভাই।

বীণাপাণি উঠিয়া গিয়া ঘরের ভিতর হইতে একখানা গরম কাপড় আনিয়া অচলার সর্বাঙ্গ সযত্নে ঢাকিয়া দিয়া স্বস্থানে বসিল, কহিল, একটা কথা তোমাকে ভারী জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় দিদি, কিন্তু কেমন যেন লজ্জা করে। যদি রাগ না কর ত—

অজানা আশঙ্কায় অচলার বুকের ভিতরটা দুলিতে লাগিল। পাছে বেশি কথা বলিতে গেলে গলা কাঁপিয়া যায়, এই ভয়ে সে শুধু কেবল একটা ‘না’ বলিয়াই স্থির হইল।

বীণাপাণি আদর করিয়া তাহার হাতের উপর একটুখানি চাপ দিয়া বলিতে লাগিল, এখন যেন তুমি আমার দিদি, আমি তোমার ছোটবোন। কিন্তু সেদিন গাড়িতে ত আমি তোমার কেউ ছিলাম না, তবে কেন নিজের পরিচয় আমার কাছ থেকে অমন করে লুকোতে চেয়েছিলে? যিনি স্বামী, তাঁকে বললে কেউ নয়—বললে, পীড়িত স্বামী অন্য কামরায়, তাঁকে নিয়ে জব্বলপুরে যাচ্ছো, কিন্তু আমাকে ঠকাতে পারনি। আমি ঠিক চিনেছিলাম, উনি তোমার কে। আবার বললে তোমরা ব্রাহ্ম, বলিয়া একবার সে একটু মুচকিয়া হাসিয়া কহিল, কিন্তু এখন দেখছি, তোমার কর্তাটির পৈতের গোছা দেখলে, বিষ্ণুপুরের পাচক ঠাকুরের দল পর্যন্ত লজ্জা পেতে পারে। আচ্ছা ভাই, কেন এত মিথ্যা কথা বলেছিলে বল ত?

অচলা জোর করিয়া একটু শুষ্ক হাসি হাসিয়া কহিল, যদি না বলি?

বীণাপাণি কহিল, তা হলে আমিই বলব! কিন্তু আগে বল, যদি ঠিক কথাটি বলতে পারি, কি আমাকে দেবে?

অচলার বুকের মধ্যে রক্ত-চলাচল যেন বন্ধ হইয়া যাইবার মত হইল। তাহার মুখের উপরে যে মৃত্যু-পাণ্ডুরতা ঘনাইয়া আসিল, বাতির ক্ষীণ আলোকে বীণাপাণির তাহা চোখে পড়িল কিনা বলা কঠিন, কিন্তু সে মুখ টিপিয়া আবার একটুখানি হাসিয়া বলিল, আচ্ছা, কিছু দাও আর না দাও, যদি সত্যি কথাটি বলতে পারি, আমাকে কি খাওয়াবে বল অচলাদিদি।

অচলার নিজের নামটা নিজের কানে জ্বলন্ত অগ্নিশিখার ন্যায় প্রবেশ করিল, এবং পরক্ষণ হইতেই সে একপ্রকার অর্ধচেতনে অর্ধ-অচেতনের মত শক্ত হইয়া বসিয়া রহিল।

বীণাপাণি কহিতে লাগিল, আমাদের দুই বোনের কিন্তু তত দোষ নেই ভাই, দোষ যত আমাদের কর্তা দুটির। একজন জ্বরের ঘোরে তোমার সত্যি নামটি প্রকাশ করে দিলেন, আর অপরটি তাই থেকে তোমার সত্যি পরিচয়টি ভেবে বার করে আনলেন।

অচলা প্রাণপণ-বলে তাহার বিক্ষুব্ধ বক্ষকে সংযত করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, সত্যি পরিচয়টি কি শুনি?

বীনাপাণি বলিল, সত্যি হোক আর নাই হোক ভাই, বুদ্ধি যে তার আছে, সে কিন্তু তোমাকে মানতেই হবে। তিনি একদিন রাত্রে হঠাৎ এসে বললেন, তোমার অচলাদিদির কাণ্ডটা কি জানো গো? তিনি ঘর থেকে পালিয়ে এসেছেন। আমি রাগ করে বললুম, যাও, চালাকি করতে হবে না। এ কথা দিদির কানে গেলে ইহজন্মে আর তিনি তোমার মুখ দেখবেন না।

অচলা চেয়ারের হাতায় দুই মুঠা কঠিন করিয়া বসিয়া রহিল।
বীণাপাণি কহিতে লাগিল, তিনি বললেন, মুখ আমার তিনি দেখুন, আর নাই দেখুন, এ কথা যে সত্য, আমি দিব্য করে বলতে পারি। জা-ননদের সঙ্গে ঝগড়া করেই হোক, আর শ্বশুর-শাশুড়ীর সঙ্গে বনিবনাও না হওয়াতেই হোক, স্বামী নিয়ে তিনি বিবাগী হয়ে বেরিয়ে এসেছেন। সুরেশবাবুর ত ভাব-গতিক দেখে মনে হয়, তোমার দিদি তাঁকে সমুদ্রে ডুবতে হুকুম করলেও তাঁর না বলার শক্তি নাই। তার পরে যেখানে হোক একটা ছদ্মনামে অজ্ঞাতবাসে দুটিতে থাকবেন, যতদিন না বুড়ো-বুড়িস পৃথিবী খুঁজে সেধে-কেঁদে তাঁদের বৌ-বেটাকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যান। এই যদি না আসল ঘটনা হয় ত তুমি আমাকে—

আমি বললুম, আচ্ছা, তাই যেন হলো, কিন্তু গাড়িতে আমার মত একটা অপরিচিত মুখ্যু মেয়েমানুষের কাছে মিথ্যে বলবার দিদির কি এমন গরজ হয়েছিল? কর্তা তাতে হেসে জবাব দিলেন, তোমার দিদিটি যদি তোমার মত বুদ্ধিমতী হতেন, তা হলে হয়ত কোন গরজই হ’ত না। কিন্তু তা তিনি মোটেই নয়। যাই শুনলেন, তোমার বাড়ি ডিহরীতে, তুমি দুদিন পরে ডিহরীতেই যাবে, তখনই তিনি অচলার বদলে সুরমা, ডিহরীর বদলে জব্বলপুরযাত্রী এবং হিন্দুর বদলে ব্রাহ্ম-মহিলা হয়ে উঠলেন। এটা তোমার মাথায় ঢুকল না রাক্ষুসী, যাঁরা টিকিট কিনে জব্বলপুর যাত্রা করে বেরিয়েছেন, তাঁরা হঠাৎ গাড়ি বদল করে এদিকেই বা ফিরবেন কেন, আর পীড়িত স্বামী নিয়ে কোন বাঙালীর বাড়িতে না উঠে ওই অতদূর হিন্দুস্থানী পল্লীতে, একটা ভাঙ্গা সরাইয়ের মধ্যে গিয়েই বা হাজির হবেন কেন? বলিতে বলিতেই বীণাপাণি অকস্মাৎ পার্শ্বে হেলিয়া অচলার গলা জড়াইয়া ধরিল এবং স্নেহে প্রেমে বিগলিত হইয়া তাহার কানের কাছে মুখ আনিয়া অস্ফুটকণ্ঠে কহিল, বল না দিদি, কি হয়েছিল? আমি কোনদিন কাউকে কোন কথা বলব না—এই তোমাকে ছুঁয়ে আজ আমি দিব্যি করচি।

বীণাপাণির মুখে তাহাদের সম্বন্ধে এই সত্য আবিষ্কারের মিথ্যা ইতিহাস শুনিয়া অচলার সমস্ত দেহটা যেন একখণ্ড অচেতন পদার্থের মত সখীর আলিঙ্গনের মধ্যে ঢলিয়া পড়িল। ইহজীবনের চরম লজ্জা মূর্তি ধরিয়া এক-পা এক-পা করিয়া যে কোথায় অগ্রসর হইয়া আসিয়াছে, তাহা সে চাহিয়া দেখিতেছিল, কিন্তু সে যখন অত্যন্ত অকস্মাৎ অচিন্তনীয়রূপে মুখ ফিরাইয়া আর-এক পথে চলিয়া গেল, তাহাকে স্পর্শমাত্র করিল না, তখন এই বিপুল সৌভাগ্যকে বহন করিবার মত শক্তি আর তাহাতে ছিল না। শুধু দুই চক্ষের অবিশ্রান্ত অশ্রুপ্রবাহ ব্যতীত বহুক্ষণ পর্যন্ত কোথাও জীবনের কোন লক্ষণ আর তাহার মধ্যে অনুভূত হইল না।

এমন কতক্ষণ কাটিল। বীণাপাণি আপন অঞ্চলে বার বার করিয়া অচলার চোখের জল মুছাইয়া দিয়া সস্নেহে করুণস্বরে কহিল, সুরমাদিদি, তুমি বয়সে বড় হলেও ছোটবোনের কথাটা রাখো ভাই, এইবার বাড়ি ফিরে যাও। আমি বলচি, এ যাত্রা তোমাদের সুযাত্রা নয়। অনেক দুঃখে হাতের নোয়াটা যদি বজায় রয়েই গেছে দিদি, তখন অভিমান করে আর গুরুজনদের দুঃখ দিয়ো না, আর তাঁদের ভাবিয়ো না। হেঁট হয়ে শ্বশুর-ঘরে ফিরে যেতে কোন লজ্জা, কোন অগৌরব নেই দিদি।

ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া সে পুনরায় কহিল, চুপ করে রইলে যে ভাই। যাবে না? মা-বাপের ওপর রাগ করে বাড়ি ছেড়ে সুরেশবাবু কখনো ভাল নেই। তোমার মুখ থেকে এ কথা শুনলে তিনি খুশিই হবেন, এ তোমাকে আমি নিশ্চয় বলচি।
অচলা চোখ মুছিয়া এইবার সোজা হইয়া বসিল। চাহিয়া দেখিল, বীণাপাণি তেমনি উৎসুক-মুখে তাহার প্রতি চাহিয়া আছে। প্রথমটা উত্তর দিতে তাহার অতিশয় লজ্জা করিতে লাগিল, কিন্তু শুদ্ধমাত্র নির্বাক্‌ রহিয়াই যে ওই মেয়েটির কাছে মুক্তি পাওয়া যাইবে না, তাহাতে যখন আর কোন সংশয় রহিল না, তখন সমস্ত সংকোচ জোর করিয়া পরিত্যাগ করিয়া ধীরে ধীরে কহিল, আমাদের বাড়ি ফিরে যাবার কোন পথ নাই বীণা।

বীণাপাণি বিশ্বাস করিল না। কহিল, কোন পথ নেই? তোমাকে আমি বেশীদিন জানিনে সত্যি, কিন্তু যতটুকু জানি, তাতে সমস্ত পৃথিবীর সামনে দাঁড়িয়ে দিব্যি করে বলতে পারি, তুমি এমন কাজ কখনো করতে পারো না দিদি, যার জন্যে কেউ তোমার কোনদিকের পথ বন্ধ করতে পারে। আচ্ছা, তোমার শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা বলে দাও, আমরা ত পরশু সকালের গাড়িতে বাড়ি যাচ্ছি, বাবাকে সঙ্গে নিয়ে আমি নিজে তোমাদের বাড়ি গিয়ে হাজির হব, দেখি বুড়ো-বুড়ি আমাকে কি জবাব দেন। তোমার যাঁরা শ্বশুর-শাশুড়ি, তাঁরা আমারও তাই—তাঁদের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে আমার কোন লজ্জা নেই।

অচলা চকিত হইয়া কহিল, তোমরা পরশু দেশে যাবে, এ কথা ত শুনিনি? এখানে কে কে থাকবেন?

বীণাপাণি কহিল, কেউ না, শুধু চাকর-দরোয়ান বাড়ি পাহারা দেবে। আমার জাঠ-শাশুড়ি অনেকদিন থেকেই শয্যাগত, তাঁর প্রাণের আশা আর নেই—তিনি সকলকেই একবার দেখতে চেয়েছেন।

অচলা জিজ্ঞাসা করিল, তোমার শ্বশুরবাড়িটি কোথায়?

বীণাপাণি বলিল, কলকাতার পটলডাঙ্গায়।

পটলডাঙ্গা নাম শুনিয়া অচলার মুখ শুষ্ক হইয়া উঠিল। ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে কহিল, বীণা, তা হলে আমাদেরও এ-বাড়ি ছেড়ে কালই যেতে হয়। এখানে থাকা ত আর চলে না।

বীণাপাণি হাসিয়া উঠিল। বলিল, তাই বুঝি তোমাদের বাড়ি ফেরবার জন্য এত সাধাসাধি করচি? এতক্ষণে বুঝি আমার কথার তুমি এই অর্থ করলে! না দিদি, আমার ঘাট হয়েছে, তোমাকে কোথাও যেতে আর কখনো আমি বলব না; যতদিন ইচ্ছে এই কুঁড়েঘরে তোমরা বাস কর, আমাদের কারও আপত্তি নেই।

কিন্তু এই সদয় নিমন্ত্রণের অচলা কোন উত্তরই দিতে পারিল না। মুহূর্তকাল মৌন থাকিয়া বিবর্ণমুখে জিজ্ঞাসা করিল, তোমাদের যাওয়া কি সত্যই স্থির হয়ে গেছে?

বীণাপাণি কহিল, স্থির বৈ কি। আজ আমাদের গাড়ি পর্যন্ত রিজার্ভ করা হয়েচে। বাবার ঘরে যদি একবার উঁকি মারো ত দেখতে পাবে বোধ হয়, পনের-আনা জিনিসপত্রই বাঁধাছাঁদা ঠিকঠাক।

দাসী আসিয়া দ্বার-প্রান্তে দাঁড়াইয়া কহিল, বৌমা, মা একবার তোমাকে রান্নাঘরে ডাকচেন।

যাই, বলিয়া সে একটু হাসিয়া সহসা আর একবার দুই বাহু দিয়া অচলার গ্রীবা বেষ্টন করিয়া কানে কানে কহিল, এতদিন লোকের ভিড়ে অনেক মুশকিলেই তোমাদের দিন কেটেচে। এবার খালি বাড়ি—কেউ কোথাও নেই—আপদ-বালাই আমিও দূর হয়ে যাবো—এবার বুঝলে না ভাই দিদিমণিটি? বলিয়া সখীর কপোলের উপর দুটি আঙুলের একটু চাপ দিয়াই দ্রুতবেগে দাসীর অনুসরণ করিয়া চলিয়া গেল।

এক টুকরা আনন্দ, খানিকটা দক্ষিণা হাওয়ার মত এই সৌভাগ্যবতী তরুণী লঘুপদে দৃষ্টির বাহিরে অপসৃত হইয়া গেল, কিন্তু তাহার কানে কানে বলা শেষ কথা-দুটি অচলা দুই কানের মধ্যে লইয়া সেইখানে পাষাণ-মূর্তির মত স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। আজিকার রাত্রি এবং কল্যকার দিনটা মাত্র বাকী । তাহার পরে আর কোন বাধা, কোন বিঘ্ন নাই—এই নির্জন নীরব পুরীর মধ্যে—কাছে এবং দূরে, তাহার যতদূর দৃষ্টি যায়—ভবিষ্যতের মধ্যে চোখ মেলিয়া দেখিল—কেবল একাকী এবং কেবলমাত্র সুরেশ ব্যতীত আর কিছুই তাহার দৃষ্টিগোচর হইল না।

দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ

এই জনহীন পুরীর মধ্যে কেবলমাত্র সুরেশকে লইয়া জীবনযাপন করিতে হইবে এবং সেই দুর্দিন প্রতি মুহূর্তে আসন্ন হইয়া আসিতেছে। বাধা নাই, ব্যবধান নাই, লজ্জা নাই—আজ নয় কাল বলিয়া একটা উপলক্ষ সৃষ্টি করিবার পর্যন্ত সুযোগ মিলিবে না।

বীণাপাণি বলিয়াছিল, সুরমাদিদি, শ্বশুর-ঘর আপনার ঘর, সেখানে হেঁট হয়ে যেতে মেয়েমানুষের কোন শরম নেই।

হায় রে, হায়! তাহার কে আছে, আর কি নাই, সে জমাখরচের হিসাব তাহার অন্তর্যামী ভিন্ন আর কে রাখিয়াছে! তথাপি আজও তাহার আপনার স্বামী আছে এবং আপনার বলিতে সেই তাহাদের পোড়া ভিটাটা এখনও পৃথিবীর অঙ্ক হইতে লুপ্ত হইয়া যায় নাই। আজিও সে একটা নিমিষের তরেও তাহার মাঝখানে গিয়া দাঁড়াইতে পারে।

আবদ্ধ পশুর চোখের উপর হইতে যতক্ষণ না এই বাহিরের ফাঁকটা একেবারে আবৃত হইয়া যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত যেমন সে একই স্থানে বারংবার মাথা কুটিয়া মরিতে থাকে, ঠিক তেমনি করিয়াই তাহার অবাধ্য মনের প্রচণ্ড কামনা তাহার বক্ষের মধ্যে হাহাকার করিয়া বাহিরের জন্য পথ খুঁজিয়া মরিতে লাগিল। পার্শ্বের ঘরে সুরেশ নিরুদ্বেগে নিদ্রিত, মধ্যের দরজাটা ঈষৎ উন্মুক্ত এবং তাহারই এ-ধারে মেঝের উপর মাদুর পাতিয়া আপনার আপাদমস্তক কম্বলে ঢাকিয়া হিন্দুস্থানী দাসী অকাতরে ঘুমাইতেছে। সমস্ত বাটীর মধ্যে কেহ যে জাগিয়া আছে, তাহার আভাসমাত্র নাই—শুধু সেই যেন অগ্নিশয্যার উপরে দগ্ধ হইয়া যাইতে লাগিল। অনেক দিন এই পালঙ্কের উপরেই তাহার পার্শ্বে বীণাপাণি শয়ন করিয়াছে, কিন্তু আজ তাহার স্বামী উপস্থিত, সে তাহার নিজের ঘরে শুইতে গিয়াছে, এবং পাছে এই চিন্তার সূত্র ধরিয়া নিজের বিক্ষিপ্ত পীড়িত চিত্ত অকস্মাৎ তাহাদেরই অবরূদ্ধ কক্ষের সুষুপ্ত পর্যঙ্কের প্রতি দৃষ্টি হানিয়া হিংসায়, অপমানে, লজ্জার অণু-পরমাণুতে বিদীর্ণ হইয়া মরে, এই ভয়ে সে যেন আপনাকে আপনি প্রচণ্ড শক্তিতে টানিয়া ফিরাইল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত দেহটা তার তীব্র তড়িৎস্পৃষ্টের ন্যায় থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল।

পার্শ্বের কোন একটা ঘরের ঘড়িতে দুইটা বাজিল। গায়ের গরম কাপড়খানা ফেলিয়া দিয়া উঠিয়া বসিতেই অনুভব করিল, এই শীতের রাত্রেও তাহার কপালে-মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম দিয়াছে। তখন শয্যা ছাড়িয়া মাথার দিকের জানালাটা খুলিয়া দিতেই দেখিতে পাইল, কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমীর খণ্ড-চন্দ্র ঠিক সম্মুখেই দেখা দিয়াছে, এবং তাহারই স্নিগ্ধ মৃদু কিরণে শোনের নীল জল বহুদূর পর্যন্ত উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে। গভীর রাত্রির ঠাণ্ডা বাতাস তাহার তপ্ত ললাটের উপর স্নেহের হাত বুলাইয়া দিল এবং সেইখানে সেই জানালার উপরে সে তাহার অদৃষ্টের শেষ সমস্যা লইয়া বসিয়া পড়িল।
এই কথাটা অচলা নিশ্চয় বুঝিয়াছিল যে, তাহার এই অভিশপ্ত, হতভাগ্য জীবনের যাহা কিছু সত্য, সমস্তটাই লোকের কাছে শুধু কেবল একটা অদ্ভুত উপন্যাসের মত শুনাইবে এবং যেদিন হইতে এই কাহিনীর প্রথম সূত্রপাত হইয়াছিল, সেইদিন হইতে যত মিথ্যা এ জীবনে সত্যের মুখোশ পরিয়া দেখা দিয়া গিয়াছে, তাহাদের একটি একটি করিয়া মনে করিয়া ক্রোধে, ক্ষোভে, অভিমানে তাহার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল এবং যে ভাগ্যবিধাতা তাহার যৌবনের প্রথম আনন্দটিকে মিথ্যা দিয়া এমন বিকৃত, এমন উপহাসের বস্তু করিয়া জগতের সম্মুখে উদ্ঘাটিত করিতে লেশমাত্র মমতা বোধ করিল না, সেই নির্মম নিষ্ঠুরকে সে যদি শিশুকাল হইতে ভগবান বলিয়া ভাবিতে শিক্ষা পাইয়া থাকে ত সে শিক্ষা তাহার একেবারে ব্যর্থ, একেবারে নিরর্থক হইয়াছে। সে চোখ মুছিতে মুছিতে বার বার করিয়া বলিতে লাগিল, হে ঈশ্বর! তোমার এত বড় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এই দুর্ভাগিনীর জীবনটা ভিন্ন কৌতুক করিয়া আমোদ করিবার আর কি ছাই কিছুই ছিল না!

মনে মনে কহিল, কোথায় ছিলাম আমি এবং কোথায় ছিল সুরেশ। ব্রাহ্ম-পরিবারের ছায়া মাড়াইতেও যাহার ঘৃণা ও বিদ্বেষের অবধি ছিল না, ভাগ্যের পরিহাসে আজ সেই লোকেরই কি আসক্তির আর আদি-অন্ত রহিল না! যাহাকে সে কোনদিন ভালবাসে নাই, সে-ই তাহার প্রাণাধিক, শুধু এই মিথ্যাটাই কি সবাই জানিয়া রাখিল? আর যাহা সত্য, সে কি কোথাও কাহারো কাছেই আশ্রয় পাইল না? আবার সে মিথ্যাটা কি তাহার নিজের মুখ দিয়াই প্রচার হওয়ার এত প্রয়োজন ছিল? অদৃষ্টের এত বড় বিড়ম্বনা কাহার ভাগ্যে কবে ঘটিয়াছে? স্বামীকে সে অনেক দুঃখেই পাইয়াছিল, কিন্তু সে সহিল না—তাহার চরম দুর্দশার বোঝা বহিয়া অকস্মাৎ একদিন সুরেশ গিয়া অভিসম্পাতের মত তাহাদের দেশের বাটীতে উপস্থিত হইল। তাহার সুখের নীড় দগ্ধ হইয়া গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে তাহার ভাগ্যটাও যে পুড়িয়া ভস্মসাৎ হইয়া গিয়াছে, এ কথা বুঝিতে আর যখন বাকি রহিল না, তখন আবার কেন তাহার পীড়িত স্বামীকে তাহারই ক্রোড়ের উপরে আনিয়া দেওয়া হইল! যাহাকে সে একেবারে হারাইতে বসিয়াছিল, সেবার ভিতর দিয়া আবার তাহাকে সম্পূর্ণরূপে ফিরাইয়া দেওয়াই যদি বিধাতার সঙ্কল্প ছিল, তবে আজ কেন তাহার দুঃখ-দুর্দশা, লাঞ্ছনা-অপমানের আর কূলকিনারা নাই?

অচলা দুই হাত জোড় করিয়া রুদ্ধস্বরে বলিতে লাগিল, জগদীশ্বর! রোগমুক্ত স্বামীর স্নেহাশীর্বাদে সকল অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত নিঃশেষ হইয়াছে বলিয়াই যদি একদিন আমাকে বিশ্বাস করিতে দিয়াছিলে, তবে এতবড় দুর্গতির মধ্যে আবার ঠেলিয়া দিলে কিসের জন্য? সে যে সঙ্কোচ মানে নাই, এত কাণ্ডের পরেও সুরেশকে সঙ্গে আসিতে নিমন্ত্রণ করিয়াছিল, জগতে এ অপরাধের আর ক্ষালন হইবে না, কলঙ্কের এ দাগ আর মুছিবে না—কিন্তু অন্তর্যামী, আমার অদৃষ্টে তুমিও কি ভুল বুঝিলে? এই বুকের ভিতরটায় চিরদিন কি রহিয়াছে, সে কি তোমার চোখেও ধরা পড়িল না?
পিতার চিন্তা, স্বামীর চিন্তা সে যেন প্রাণপণ-বলে দুই হাত দিয়া ঠেলিয়া রাখিয়া দিত, আজও সকল ভাবনাকে সে কাছে ঘেঁষিতে দিল না; কিন্তু তাহার মৃণালের কথাগুলা মনে পড়িল, আর মনে পড়িল পিসীমাকে। আসিবার কালে স্নেহার্দ্র করুণ-কণ্ঠে সতী-সাধ্বী বলিয়া তিনি যত আশীর্বাদ করিয়াছিলেন, সেই-সব। তাহার সম্বন্ধে আজ তাঁহাদের মনোভাব কল্পনা করিতে গিয়া অকস্মাৎ মর্মান্তিক আঘাতে কিছুক্ষণের জন্য সমস্ত বোধশক্তি তাহার যেন আচ্ছন্ন হইয়া গেল এবং দেহ-মনের সেই অশক্ত অভিভূত অবস্থায় জানালার গায়ের উপর মাথা রাখিয়া বোধ হয় অজ্ঞাতসারে চোখ দিয়া জল পড়িতেছিল, এমন সময় পিছনে মৃদু পদশব্দে চমকিয়া ফিরিয়া দেখিল, খালি-গায়ে খালি-পায়ে সুরেশ দাঁড়াইয়া আছে। মুহূর্তের উত্তেজনায় হয়ত সে কিছু বলিতে গিয়াছিল, কিন্তু বাষ্পোচ্ছ্বাসে তাহার কণ্ঠরোধ করিয়া দিল। ইহাকে দমন করিয়া কথা কহিতে বোধ হয় আর তাহার প্রবৃত্তি হইল না, তাই পরক্ষণেই মুখ ফিরাইয়া সে তেমনি করিয়াই গরাদের উপর মাথা রাখিল; কিন্তু যে অশ্রু এতক্ষণ তাহার চোখ দিয়া বিন্দুতে বিন্দুতে পড়িতেছিল, সে যেন অকস্মাৎ কূল ভাঙিয়া উন্মত্ত-ধারায় ছুটিয়া বাহির হইয়া পড়িল।

কোথাও কোন শব্দ নাই, রাত্রির গভীর নীরবতা গৃহের ভিতরে-বাহিরে বিরাজ করিতে লাগিল। পিছনে দাঁড়াইয়া সুরেশ পাষাণ-মূর্তির মত স্তব্ধ—সহসা তাহার সমস্ত দেহটা বাতাসে বাঁশপাতার কত কাঁপিতে লাগিল, এবং চক্ষের পলক না ফেলিতেই সে দুই হাত বাড়াইয়া অচলার মাথাটা টানিয়া আনিয়া বুকের উপর চাপিয়া ধরিল।

অচলা আপনাকে মুক্ত করিয়া লইয়া আঁচলে চোখ মুছিল, কিন্তু অতি বড় বিস্ময় এই যে, যে লোকটা তাহার এতবড় দুঃখের মূল, তাহার এই ব্যবহারে আজ অচলার উৎকট ঘৃণা বোধ হইল না, বরঞ্চ মৃদু-কণ্ঠে কহিল, তুমি এ ঘরে এসেচ কেন?

সুরেশ চুপ করিয়া রহিল। বোধ করি কণ্ঠস্বরের অভাবেই সে জবাব দিতে পারিল না।

অচলা ধীরে ধীরে জানালাটা বন্ধ করিয়া দিয়া বলিল, শীতে তোমার হাত কাঁপচে, যাও, খালি-গায়ে আর দাঁড়িয়ে থেকো না—ঘরে গিয়ে শুয়ে পড় গে।

সুরেশের চোখ জ্বলিয়া উঠিল, কিন্তু তাহার গলা কাঁপিতে লাগিল—অচলার হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া অস্ফুটস্বরে বলিল, তা হলে তুমিও আমার ঘরে এসো।

অচলা মুহূর্তকাল নির্বাক বিস্ময়ে তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া থাকিয়া শুধু কহিল, না, আজ নয়। এই বলিয়া ধীরে ধীরে নিজের হাত ছাড়াইয়া লইল।

এই শান্ত সংযত প্রত্যাখ্যানের মধ্যে ঠিক কি ছিল, তাহা নিশ্চয় বুঝিতে না পারিয়া সুরেশ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

অচলা তাহার প্রতি না চাহিয়াই পুনশ্চ কহিল, আমি জেগে আছি জানতে পেরে কি তুমি এ ঘরে ঢুকেছিলে?

সুরেশ আহত হইয়া বলিল, নইলে কি তোমাকে ঘুমন্ত জেনেই ঢুকেছি, এই তুমি আশা কর?

আশা! অচলা মুখ ফিরাইয়া একটুখানি হাসিল। এই তীক্ষ্ণ কঠিন হাসি দীপের অত্যন্ত ক্ষীণ আলোকেও সুরেশের চক্ষু এড়াইল না। সে হাসি যেন স্পষ্ট কথা কহিয়া বলিল, ওরে কাপুরুষ! নিদ্রিত রমণীর কক্ষে যে চোরের মত প্রবেশ করিতে নাই, পুরুষের এ মহত্ত্ব কি তুমি আজও দাবী কর? কিন্তু মুখে কোন কথাই কহিল না। ক্ষণেক পরে গবাক্ষ ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া আস্তে আস্তে বলিল, তোমার শরীর ভাল নেই, আর জেগো না—যাও, শোও গে। বলিয়া সে ধীরে ধীরে বিছানায় আসিয়া গায়ের কম্বলটা আগাগোড়া মুড়ি দিয়া শুইয়া পড়িল।

কিছুক্ষণ পর্যন্ত আড়ষ্টভাবে সুরেশ সেইখানেই দাঁড়াইয়া রহিল, তার পরে নিঃশব্দ পদক্ষেপে নিজের ঘরে চলিয়া গেল।

ত্রয়স্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

দুই-একজন দাস-দাসী ব্যতীত দিন পাঁচ-ছয় হইল, বাটীর সকলেই কলিকাতায় চলিয়া গিয়াছেন। কেবল যাওয়া ঘটে নাই কর্তার। কি একটা জরুরী কাজের অজুহাতে তিনি শেষ-সময়ে পিছাইয়া গিয়াছিলেন। এ-কয়দিন রামচরণবাবু নিজের কাজ লইয়াই ব্যস্ত ছিলেন, বড়-একটা তাঁহাকে দেখিতে পাওয়া যাইত না। হঠাৎ আজ প্রত্যুষেই তিনি সাড়া দিয়া উপরের বারান্দায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং সুরমার নাম ধরিয়া ডাকিতে লাগিলেন।

শীতের দিনের এমন প্রভাতে তখন পর্যন্ত কেহ শয্যাত্যাগ করিয়া উঠে নাই, আহ্বান শুনিয়া অচলা শশব্যস্তে দ্বার খুলিয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল এবং ক্ষণেক পরেই সুরেশও আর একটা দরজা খুলিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে বাহির হইয়া আসিল। এই সদ্যনিদ্রোত্থিত দম্পতিকে বিভিন্ন কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইতে দেখিয়া এই বৃদ্ধের প্রসন্ন দৃষ্টি যে সহসা বিস্ময়ে সন্দিগ্ধ হইয়া উঠিল, তাহা সুরেশ দেখিতে পাইল না বটে, কিন্তু অচলার চক্ষে প্রচ্ছন্ন রহিল না।

রামবাবু সুরেশের দিকে চাহিয়া একটু অনুতাপের সহিত কহিলেন, তাই ত সুরেশবাবু, হাঁকাহাঁকি করে অসময়ে আপনার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলুম, বড় অন্যায় হয়ে গেল।

সুরেশ হাসিয়া বলিল, অন্যায় কিছুই নয়। তার কারণ আমি জেগেই ছিলুম, বাইরে থেকে ডেকে কেন, ঢাক পিটেও আমার ঘরের শান্তিভঙ্গ করতে পারতেন না। কিন্তু এত ভোরেই যে?

বৃদ্ধ অচলাকে উদ্দেশ করিয়া কহিলেন, আজ আমার সুরমা-মায়ের ওপর একটু উপদ্রব করবার আবশ্যক হয়ে পড়েছে, বলিয়া একবার তাহার দিকে ফিরিয়া চাহিয়া হাসিমুখে বলিলেন, আমার পালকি প্রস্তুত, এখুনি বার হতে হবে, বোধ করি দুটো-তিনটের আগে আর ফিরতে পারবো না; এই বুড়োটার জন্যে আজ চারটি ডাল-ভাত ফুটিয়ে রেখো মা, অত বেলায় এসে যেন না আর আগুন-তাতে যেতে হয়।

এই পরম নিষ্ঠাবান্‌ নিরামিষাহারী ব্রাহ্মণ স্ত্রী এবং পুত্রবধূ ভিন্ন আর কাহারও হাতে কখনও আহার করেন না। তাঁহার রান্নাঘরটিও একেবারে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।

এমন কি, সকলের সে ঘরে যাওয়ার পর্যন্ত অধিকার ছিল না; এবং স্বপাক আহার তাঁহার মাঝে মাঝে অভ্যাস ছিল বলিয়াই মেয়েরা বাড়ি ছাড়িয়া দেশে যাইতে পারিয়াছিল। এ-কয়দিন তাঁহার সেই ব্যবস্থাই চলিয়াছিল, কিন্তু আজ অকস্মাৎ এই অজ্ঞাত অপরিচিত মেয়েটির উপর ভার দেওয়ার প্রস্তাবে সে বিস্ময়ে, এবং সকলের চেয়ে বেশী ভয়ে অভিভূত হইয়া পড়িল।

রামবাবু সেই ম্লান মুখের দিকে চাহিয়া সস্নেহে কহিলেন, তুমি ভাবছ মা, এ বুড়ো আজ বলে কি! রান্না-খাওয়া নিয়ে যার এও বাছবিচার, অত হাঙ্গামা, তার আজ হলো কি? তা হোক। রাক্ষুসীর হাতে খেতে যখন আপত্তি হয় না, তখন তুমিই বা দুটো ডাল-ভাত ফুটিয়ে দিলে অপ্রবৃত্তি হবে কেন? আর হোক ভাল, না হোক ভাল, মা, অতখানি বেলায় ফিরে এসে হাঁড়ি ঠেলতে যেতে পারব না। বলিয়া অচলার নিরুত্তর মুখের প্রতি ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া পুনশ্চ সহাস্যে কহিলেন, তুমি নিশ্চয় মনে মনে ভাবচ, এ বুড়োটার মধ্যে হঠাৎ যদি এতবড় ঔদার্যই জন্মে থাকে তবে আমাকে কষ্ট না দিয়ে হিন্দুস্থানী বামুনঠাকুরের হাতে খেলেই ত হতো। না গো মা, তা হতো না।
আজও এ বুড়োর তেমনি গোঁড়ামি, তেমনি কুসংস্কার আছে—মরে গেলেও ঐ সন্ধ্যা-গায়ত্রীহীন হিন্দুস্থানী ‘মহারাজে’র অন্ন আমার গলা দিয়ে গলবে না। আর আমার রাক্ষুসী মাকে আর তোমাকে এরই মধ্যে একবার এক করে নিতে পেরেচি, সেও সত্য নয়, কিন্তু যতই দেখচি, আমার মনে হচ্চে, এই মা-জননীটিও যদি একদিন রেঁধে দেন, সে যে আমার অন্নপূর্ণার অন্ন হবে না, এ আমি কোনমতেই মানব না। কিন্তু আর ত দেরি করতে পারিনে মা, বাকি যেটুকু বলবার রইল, সেটুকু খেতে খেতেই বলব আর সেই বলাই তখন সবচেয়ে সত্যিকার বলা হবে। বলিয়া বৃদ্ধ চলিবার উপক্রম করিতেই অচলা ব্যস্ত হইয়া উঠিল। কি বলিবে, তাহা স্থির করিতে না করিতে যে কথাটা সকলের পূর্বে মুখে আসিয়া পড়িল, তাহাই বলিয়া ফেলিল, কহিল, কিন্তু আমি ত ভাল রাঁধতে জানিনে। আমার রান্না আপনার ত পছন্দ হবে না।

বৃদ্ধ রামবাবু ফিরিয়া দাঁড়াইয়া একটু হাসিলেন। বলিলেন, এই কথাটা আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে বল মা?

অচলা কহিল, সকলেই কি রাঁধতে জানে?

বৃদ্ধ জবাব দিলেন, সকলেই জানে, তাই কি আমি বলচি?

অচলা এ কথার হঠাৎ কোন প্রত্যুত্তর করিতে না পারিয়া মৌন হইয়া রহিল। কিন্তু সুরেশের পক্ষে সেখানে দাঁড়াইয়া থাকা একপ্রকার অসম্ভব হইয়া উঠিল। অচলার বিবর্ণ মুখের প্রতি কটাক্ষে চাহিয়া সে তাহার বেদনা বুঝিল। এই বৃদ্ধের সংস্কার, তাঁহার হিন্দু আচার ভাল হউক, মন্দ হউক, সত্য হউক, মিথ্যা হউক, তাঁহাকে রাঁধিয়া খাওয়ানোর মধ্যে যে কদর্য প্রতারণা লুক্কায়িত রহিয়াছে, সে কথা যে অচলার অগোচর নাই এবং এই ভদ্রনারীর হৃদয়ের বিবেক যে কিছুতেই এই গোপন কথার গভীর দুষ্কৃতি হইতে আপনাকে অব্যাহতি দিতেছে না, ইহা তাহার শ্রীহীন পাণ্ডুর মুখের উপর স্পষ্ট দেখিতে পাইয়া সে আর কোনদিকে দৃষ্টিপাত না করিয়া মুখহাত ধোয়ার অছিলায় দ্রুতবেগে সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিয়া গেল।

তা হলে আমি চললুম, বলিয়া সঙ্গে সঙ্গে রামচরণবাবুও সুরেশের অনুসরণ করিলেন। মুহূর্তকাল অচলা হতবুদ্ধি হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তার পরেই নিজেকে জোর করিয়া সচেতন করিয়া তুলিয়া ডাকিল, একবার শুনুন—

বৃদ্ধ ফিরিয়া দেখিলেন, সুরমা কি যেন বলিতে চাহিয়াও নীরবে নতনেত্রে দাঁড়াইয়া আছে। তখন কয়েক পদ অগ্রসর হইয়া আসিয়া কহিলেন, আর একটা কথা তোমাকে জানাবার আছে মা। তোমার সঙ্কোচ যখন কোনমতেই কাটতে চাইচে না, তখন—কি জান সুরমা, ছেলেবেলায় আমি ছিলাম পাড়ার মেজদা। তোমার বাপের চেয়ে হয়ত বয়সে ছোটও হব না। তা হলে আমাকে কেন মেজ-জ্যাঠামশাই বলে ডেকো না মা!

এই বৃদ্ধ যে তাহাকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন, অচলা তাহা জানিত। ভালবাসার এই প্রকাশ্যতায় তাহার চোখের কোণে যেন জল আসিয়া পড়িল। তাই সে শুধু নিঃশব্দে ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইল।

বৃদ্ধ প্রশ্ন করিলেন, আর কিছু বলবে?

অচলা তেমনি নীরবে ক্ষণকাল মাটির দিকে চাহিয়া থাকিয়া এইবার বোধ হয় সে নিজের সমস্ত শক্তিই এক করিয়া শুধু অস্ফুটে বলিল, কিন্তু আমার বাবা ব্রাহ্ম ছিলেন।
রামচরণবাবু হঠাৎ চমকিয়া গেলেন। কহিলেন, সত্যিকারের, না পাঁচজন কলকাতায় এসে দু’দিন শখ করে যেমন হয়, তেমনি? তারা ব্রাহ্মদের দলে বসে হিঁদুদের কোসে গালাগালি দেয়—তেমন গাল সত্যিকারের ব্রাহ্মরা কখনো মুখে আনতেও পারে না—তার পরে ঘরে ফিরে সমাজে দাঁড়িয়ে সে ব্রাহ্মদের নাম করে আবার এমনি গালিগালাজ করে যে, তেমন মধুর বচন হিঁদুদের চৌদ্দপুরুষও কখনো উচ্চারণ করতে পারে না। বলি, তেমনি তা মা? তা হয় ত আমার এতটুকু আপত্তি নেই।

অচলার চোখমুখ লজ্জায় রাঙ্গা হইয়া উঠিল, কেবলমাত্র কহিল, না তিনি সত্যিকার ব্রাহ্ম।

উত্তর শুনিয়া বৃদ্ধ একটু যেন দমিয়া গেলেন। কিন্তু একটু পরেই প্রফুল্লমুখে বলিলেন, তা হলেনই বা বাবা ব্রাহ্ম, মেয়ে ত আর তাঁর খাতক নয় যে, এখন ভয় করতে হবে। বরঞ্চ যাঁর সঙ্গে তুমি ধর্ম ভাগ করে নিয়েচ মা, তিনি যখন হিন্দু, তাঁর গলায় যখন যজ্ঞোপবীত শোভা পাচ্চে, তিনি যখন ওই সুতো ক’গাছার এখনো অপমান করেন নি, তখন বাপের কর্ম ত তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না! কিন্তু তুমি যত ফন্দিই কর না, সুরমা, জ্যাঠামশাইকে আজ আর ফাঁকি দিতে পারচ না। আজ তোমাকে রেঁধে ভাত দিতেই হবে। তাই বাপের শিক্ষার গুণে সেদিন উপোস করতে চাওনি বটে! আজ তার সুদসুদ্ধ উসুল করে তবে ছাড়বো। বলিয়া তিনি পুনরায় চলিয়া যান দেখিয়া অচলা এতক্ষণ পরে তাহার অভিভূত ভাবটাকে একনিমিষে অতিক্রম করিয়া গেল। সুস্পষ্টকণ্ঠে বলিল, আচ্ছা জ্যাঠামশাই, আমি ব্রাহ্মমহিলা হলে আপনি আমার হাতে খাবেন না?

বৃদ্ধ বলিলেন, না। কিন্তু সে ত তুমি নও। সে ত তুমি হতে পার না।

অচলা প্রশ্ন করিল, কিন্তু তাও যদি হতো, তা হলে কি শুধু আমার ধর্মমতটা আলাদা বলেই আমি আপনার কাছে অস্পৃশ্য হয়ে যেতুম?

বৃদ্ধ বলিলেন, অস্পৃশ্য হবে কেন মা, অস্পৃশ্য নয়। কিন্তু তোমার হাতে খেতে পারতাম না।

এ সম্বন্ধে আজ তাহার অনেক কথাই জানা প্রয়োজন! তাই সে চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না। কহিল, কেন পারতেন না, সে কি ঘৃণায়?

বৃদ্ধ সহসা কোন উত্তর দিতে পারিলেন না, কেবল একদৃষ্টে মেয়েটির মুখের প্রতি চাহিয়া রহিলেন।

অচলা সমস্ত সঙ্কোচ ত্যাগ করিয়াছিল, বলিল, জ্যাঠামশাই, আপনার মায়া-দয়া যে কত বড়, তার অনেক সাক্ষী এ পৃথিবীতে আছে জানি, কিন্তু আমাদের চেয়ে বড় সাক্ষী আর কেউ নেই। তবে আপনার মত মানুষের মন যে কেমন করে এত অনুদার হতে পারে, তাই আমি ভেবে পাইনে। আপনি কি করে মানুষকে এমন ঘৃণা করতে পারেন?
বৃদ্ধ অকস্মাৎ ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিলেন, আমি ঘৃণা করি? কাকে মা? কখন মা?

অচলা বলিল, যার হাতের ছোঁয়া আপনার অস্পৃশ্য, সে আপনার ঘৃণার পাত্র—তাকেই আপনি মনে মনে ঘৃণা করেন। আর ঘৃণা যে করেন, তাও দীর্ঘদিনের অভ্যাসে ভুলে গেছেন। আমাদের ওই হিন্দুস্থানী চাকরটার কথা ছেড়ে দিন, পাচকটার হাতের রান্নাও যে কোনমতেই আপনার গলা দিয়ে গলবে না, সেও আপনি নিজের মুখেই প্রকাশ করেছেন। এতে দেশের কত ক্ষতি, কত অবনতি হয়েচে সে ত—

বৃদ্ধ চুপ করিয়া শুনিতেছিলেন, অচলার উত্তেজনাও লক্ষ্য করিতেছিলেন। তাহার কথা হঠাৎ শেষ হইলে একটু হাসিয়া বলিলেন, মা, ঘৃণা আমরা কোন মানুষকেই করিনে। যে নালিশ তুমি করলে, সে নালিশ সাহেবেরা করে—তাদের কাছে তোমার বাবার শেখা—আর তাঁর কাছে তুমি শিখেচ। নইলে মানুষ যে ভগবান, এ জ্ঞান কেবল তাদের নয়, আমাদেরও ছিল, আজও আছে।

এই সময় নীচে হইতে একটা অস্পষ্ট কোলাহল শুনা যাইতেছিল, বৃদ্ধ সেদিকে একমুহূর্ত কান পাতিয়া কহিলেন, সুরমা খাওয়া জিনিসটা যাদের মধ্যে মস্ত বড় জিনিস, মস্ত ঘটা-পটার ব্যাপার, তাদের সঙ্গে আমাদের মিল হবে না। আমাদের ভাতে-ভাত খাওয়াটা তুচ্ছ বস্তু, সেটুকুর আজ একটু যোগাড় করে রেখো—মুখে দিতে দিতে তখন আলোচনা করা যাবে, ঘৃণাটা আমরা কাকে কত করি এবং দেশের অবনতি তাতে কতখানি হচ্চে—কিন্তু গোলমাল বাড়চে—আর নয় মা, আমি চললুম। বলিয়া তিনি একটু দ্রুতবেগে নামিয়া গেলেন।

চতুস্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

প্রায় অপরাহ্নবেলায় ভোজন সমাধা করিয়া রামবাবু তৃপ্তি ও প্রাচুর্যের একটা সশব্দ উদ্গার ছাড়িয়া যখন গাত্রোত্থান করিতে গেলেন, তখন অচলা অনেক কষ্টে একটুখানি হাসিয়া বলিল, কিন্তু জ্যাঠামশাই, যেদিন জানতে পারবেন, আজ আপনার জাত গেছে, সেদিন কিন্তু রাগ করতে পারবেন না, তা বলে দিচ্চি।

বৃদ্ধ সস্নেহে মৃদুহাস্যে ঘাড়টা একটু নাড়িয়া কহিলেন, আচ্ছা মা, তাই হবে, বলিয়া আচমন করিয়া বহির্বাটীতে চলিয়া গেলেন। তাঁহার খড়মের খট্‌খট্‌ শব্দ যতক্ষণ পর্যন্ত শোনা গেল, ততক্ষণ পর্যন্ত অচলা সমস্ত দৃষ্টি দিয়া যেন ওই আওয়াজটাকেই অনুসরণ করিতে লাগিল, তার পর কখন যে সে শব্দ মিলাইল, কখন যে বাহিরের সংসার তাহার চেতনা হইতে বিলুপ্ত হইয়া তাহাকে পাথর করিয়া দিল, সে টেরও পাইল না।

অনেকদিনের হিন্দুস্থানী দাসীটি বাংলা কথার সঙ্গে বাঙালীর আচার-ব্যবহার কায়দা-কানুনও কতকটা আয়ত্ত করিয়াছিল, সে কি একটা কাজে এদিকে আসিয়া বহু-মার বসিয়া থাকার ভঙ্গী দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল এবং বয়োজ্যেষ্ঠার অধিকারে তাহার শেখা-বাংলা তর্জন-শব্দে বেলার দিকে অচলার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া প্রশ্ন করিল, আজ খাওয়া-দাওয়ার কোন প্রয়োজন আছে, না এমনভাবে চুপচাপ বসিয়া থাকিলেই চলিবে?

অচলা চমকিয়া চোখ মেলিয়া দেখিল, বেলা আর নাই, শীতের সন্ধ্যা সমাগতপ্রায়। একটা দীপ্তিহীন নিষ্প্রভতা শ্রান্তির মত আকাশের সর্বাঙ্গে ভরিয়া আসিয়াছে, লজ্জা পাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল এবং হাসিয়া কহিল, আমি যে একেবারে সন্ধ্যার পরেই খাব বলে ঠিক করেছি লালুর মা। আজ ক্ষিদে-তেষ্টা এতটুকু নেই।

লালুর মা বিস্মিত হইয়া কহিল, বড়বাবুর খাওয়া হয়ে গেলেই তুমি খাবে, একটু আগেই যে বললে বহু-মা?

নাঃ—একেবারে রাত্রিতেই খাবো, বলিয়া আর বেশি বাদানুবাদের অবসর না দিয়াই অচলা ত্বরিতপদে উপরে চলিয়া গেল।

একটু সময় পাইলেই সে উপরের বারান্দায় রেলিং-এর পার্শ্বে চৌকি টানিয়া লইয়া নদীর দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া বসিত। আজিকার রাত্রেও সেইরূপ বসিয়াছিল, হঠাৎ রামবাবুর চটিজুতার শব্দ পাইয়া অচলা ফিরিয়া দেখিল, বৃদ্ধ একেবারে মাঝখানে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন এবং কিছু বলিবার পূর্বেই তিনি হাতের হুঁকাটা এককোণে ঠেস দিয়া রাখিয়া আর একখানা চেয়ার কাছে টানিয়া লইয়া বসিলেন। ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, সেই কথাটার একটা মীমাংসা করতে এলাম সুরমা, তোমার ব্রহ্মজ্ঞানী বাবাটি ঠিক, না এই বুড়ো জ্যাঠামশায়ের কথাটি ঠিক, তর্কটার যা হোক একটা নিষ্পত্তি না করে আজ আর নীচে যাচ্চিনে।

অচলা বুঝিল, এ সেই জাতিভেদের প্রশ্ন, শ্রান্তস্বরে বলিল, আমি তর্কের কি জানি জ্যাঠামশাই!

রামবাবু মাথা নাড়িয়া কহিলেন, ওরে বাস্‌ রে, তুমি কি সোজা লোকের বেটি নাকি মা! তবে কথাটা নাকি একেবারে মিথ্যে, তাই যা রক্ষা, নইলে ও-বেলায় ত হেরে গিয়েছিলাম আর কি!

অচলার কোন বিষয় লইয়াই আলোচনা করিবার মত মনের অবস্থা নয়; সেই এই তর্কযুদ্ধ হইতে আত্মরক্ষার একটুখানি ফাঁক দেখিতে পাইয়া কহিল, তা হলে আর তর্ক কি জ্যাঠামশাই! আপনারই ত জিত হয়েছে! একটুকু থামিয়া বলিল, যে হেরে গেছে, তাকে আবার দু’বার করে হারিয়ে লাভ কি আপনার?
রামবাবু তৎক্ষণাৎ কোন প্রত্যুত্তর দিলেন না। তাঁহার বয়স অনেক হইয়াছে, সংসারে তিনি অনেক জিনিস দেখিয়াছেন; সুতরাং, এই অবসন্ন কণ্ঠস্বরও যেমন তাঁহার অগোচর রহিল না, এই মেয়েটি যে সুখে নাই, ইহার মনের মধ্যে কি যে একটা ভয়ানক বেদনা পাঁজার আগুনের মত অহর্নিশি জ্বলিতেছে, ইহাও তেমনি এই শ্রান্ত-পাণ্ডুর মুখের উপরে আর একবার স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন। মুহূর্তকাল মৌন থাকিয়া হঠাৎ একটা হাসিবার চেষ্টা করিয়া অত্যন্ত স্নেহের সহিত বলিলেন, নাঃ—ছুতো খাটল না মা! বুড়ো মানুষ, বকতে ভালবাসি—সন্ধ্যাবেলা একলাটি প্রাণটা হাঁপিয়ে ওঠে; তাই ভাবলুম, মিথ্যে-টিথ্যে বলে মাকে একটু রাগিয়ে দিয়ে দুটো গল্প করি গে, কিন্তু ছল ধরা পড়ে গেল। বলিয়া তিনি ঝুঁকিয়া পড়িয়া হুঁকাটার জন্য একবার হাতটা বাড়াইয়া দিলেন।

তিনি যে যাইবার জন্য এটি সংগ্রহ করিতেছেন, অচলা তাহা বুঝিল এবং নীচে গিয়া একাকী এই বৃদ্ধের যে অনেক দুঃখেই সময় কাটিবে, তাহা উপলব্ধি করিয়া তাহার চিত্ত ব্যথিত হইয়া উঠিল। তাই সে চকিতের ন্যায় চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া নিজেই তাহা তুলিয়া লইয়া বৃদ্ধের প্রসারিত হস্তে দিতে দিতে বলিল, আপনি যত খুশি তামাক খেতে চান, এইখানে বসে খান, কিন্তু এখন উঠে যেতে আপনাকে আমি কিছুতে দেব না।

বৃদ্ধ হুঁকা হাতে লইয়া হাসিয়া বলিলেন, ওরে বাপ্‌ রে, একদম অতখানি রাশ ঢিল দিও না মা, আখের সামলাতে পারবে না। আমার মুখ-বুজে তামাক খাওয়া যে কি ব্যাপার, তা ত দেখনি! তার চেয়ে বরঞ্চ একটু-আধটু বলতে দাও যে—

মানুষের দম আটকে না যেতে পায়, না জ্যাঠামশাই? আচ্ছা, তাই ভাল। কিন্তু কি নিয়ে বকুনি শুরু করবেন বলুন ত?

রামবাবু মুখ হইতে একগাল ধূঁয়া-উপরের দিকে মুক্ত করিয়া দিয়া কহিলেন, তবেই মুশকিলে ফেললে মা। মহা-বক্তার লোককেও এ প্রশ্ন করলে তার মুখ বন্ধ হয়ে আসে যে!

আচ্ছা জ্যাঠামশায়, কোনদিন যদি জানতে পারেন, জোর করে যার হাতে আজ ভাত খেয়েচেন, তার চেয়ে নীচ, তার চেয়ে ঘৃণিত পৃথিবীতে আর কেউ নেই, তখন কি করবেন? প্রায়শ্চিত্ত? আর শাস্ত্রে যদি তার বিধি পর্যন্ত না থাকে, তা হলে?

বৃদ্ধ বলিলেন, তা হলে ত ল্যাঠা চুকেই গেল মা, প্রায়শ্চিত্ত আর করতে হবে না।

কিন্তু আমার উপর তখন কি-রকম ঘৃণাই না আপনার হবে!

কখন মা?

যখন টের পাবেন, আমার একটা জাত পর্যন্ত নেই।

রামবাবু হুঁকাটা মুখ হইতে সরাইয়া লইয়া সেই অস্পষ্ট আলোকেই ক্ষণকাল তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, তোমাদের এই কথাটা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনে মা। আর ‘তোমাদের’ বলি কেন, জানো সুরমা, আমার নিজের ছেলের মুখ থেকেও এ নালিশ শুনেচি। সে ত স্পষ্টই বলে, এই খাওয়া-ছোঁয়ার বাচ-বিচার থেকেই সমস্ত দেশটা ক্রমাগত সর্বনাশের দিকে তলিয়ে যাচ্চে। কারণ, এর মূলে আছে ঘৃণা, এবং ঘৃণার ভিতর দিয়ে কোন বড় ফল পাওয়া যায় না।

অচলা মনে মনে অতিশয় বিস্মিত হইল। এ বাড়িতেও যে এ-সকল আলোচনা কোন্‌ অবকাশ দিয়া পথ পাইতে পারে, এ তাহার ধারণাই ছিল না। কহিল, কথাটা কি তবে মিথ্যে?
রামবাবু একটু হাসিয়া বলিলেন, মিথ্যে কি না, সে জবাব নাই দিলাম মা। কিন্তু সত্যি নয়। শাস্ত্রের বিধিনিয়ম মেনে চলি, এইমাত্র। যারা আরও একটু বেশি যায়—এই যেমন আমার গুরুদেব, তিনি নিজে রেঁধে খান, মেয়েকে পর্যন্ত হাত দিতে দেন না। তাই থেকে কি এই স্থির করা যায়, তিনি তাঁর একমাত্র সন্তানকে ঘৃণা করেন!

অচলা জবাব দিতে না পারিয়া মৌন হইয়া রহিল।

বৃদ্ধ হুঁকাটায় আর গোটা-কতক টান দিয়া বলিলেন, মা, যৌবনে আমি অনেক দেশ ঘুরে বেড়িয়েচি। কত বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, আর কতরকমের লোক, কতরকমের আচার-ব্যবহার, সে-সব নাম হয়ত তোমরা জান না—কোথাও খাওয়া-ছোঁয়ার বিচার আছে, কোথাও বা তার আভাস পর্যন্ত শোনেনি, তবু ত মা, তারা চিরদিন তেমনি অসভ্য, তেমনি ছোট। বলিয়া দগ্ধ হুঁকাটায় পুনরায় গোটা-দুই নিষ্ফল টান দিয়া বৃদ্ধ শেষবারের মত সেটাকে থামের কোণে ঠেস দিয়া রাখিলেন। অচলা যেমন নিঃশব্দে বসিয়াছিল, তেমনি নীরবেই বসিয়া রহিল।

রামবাবু নিজেও খানিকক্ষণ স্তব্ধভাবে থাকিয়া সোজা হইয়া বসিয়া বলিলেন, আসল কথা জান সুরমা, তোমরা সাহেবদের কাছে পাঠ নিয়েছ। তারা উন্নত, তারা রাজা, তারা ধনী। তাদের মধ্যে যদি পা উঁচু করে হাতে চলার ব্যবস্থা থাকত, তোমরা বলতে, ঠিক অমনি করে চলতে না শিখলে আর উন্নতির কোন আশা-ভরসাই নেই।

এই সকল তর্ক-যুক্তি অচলা বাংলা দৈনিক কাগজে অনেক পড়িয়াছে, তাই কোন কথা না বলিয়া শুধু একটু হাসিল। হাসিটুকু বৃদ্ধ দেখিলেন, কিন্তু যেন দেখিতে পান নাই, এই ভাবে নিজের পুনরাবৃত্তিস্বরূপ কহিতে লাগিলেন, শ্রীধাম শ্রীক্ষেত্রে যখন যাই, তখন জানা-অজানা কত লোকের মধ্যে গিয়েই না পড়ি। ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার সেখানে নেই, করবার কথাও কখনো মনে হয় না; কিন্তু ঘৃণার মধ্যে এর জন্ম হলে কি এত সহজে সে কাজ পেরে উঠতাম! এই ত আমি কারও হাতেই প্রায় খাইনি, কিন্তু পথের অতিবড় দীন-দুঃখীকেও যে কখনো মনে মনে ঘৃণা করেচি—

অচলা ব্যগ্র-ব্যাকুলকণ্ঠে বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, আমি কি আপনাকে জানিনে জ্যাঠামশাই? এত দয়া সংসারে আর কার আছে?

দয়া নয় মা, দয়া নয়,—ভালবাসা। তাদেরই আমি যেন বেশী ভালবাসি। কিন্তু আসল কথা কি জানো মা, একটা জাতই বা কি, আর একটা মানুষই বা কি, ধীরে ধীরে যখন সে হীন হয়ে যাবে, তখন সবচেয়ে তুচ্ছ জিনিসটার ঘাড়েই সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে সে সান্ত্বনা লাভ করে। মনে করে, এই সহজ বাধাটুকু সামলে নিয়েই সে রাতারাতি বড় হয়ে উঠবে। আমাদেরও ঠিক সেই ভাব। কিন্তু যেটা কঠিন, সেটা মূল শিকড়—

কথাটা শেষ করিবার আর সময় পাইলেন না। সিঁড়িতে জুতার শব্দ শুনিয়া মুখ ফিরাতেই সুরেশকে দেখিতে পাইয়া একেবারেই প্রশ্ন করিয়া বসিলেন, আচ্ছা সুরেশবাবু, আপনি ত হিন্দু, আপনি ত আমাদের জাতিভেদ মানেন?

সুরেশ থতমত খাইয়া গেল—এ আবার কি প্রশ্ন? যে চোরাবালির উপর দিয়া তাহারা পথ চলিয়াছে, তাহাকে প্রতি হাত যাচাই না করিয়া হঠাৎ পা বাড়াইলে যে কোন্‌ অতলের মধ্যে তলাইয়া যাইবে, তাহার ত স্থিরতাই নাই। এখানে সত্যটাই সত্য কি না সাবধানে হিসাব করিতে হয়। তাই সে ভয়ে ভয়ে কাছে আসিয়া একবার অচলার মুখের প্রতি চাহিয়া তাৎপর্য বুঝিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু মুখ দেখিতে পাইল না। তখন শুষ্ক একটু হাসিয়া দ্বিধাজড়িতস্বরে কহিল, আমরা কি, সে ত আপনি বেশ জানেন রামবাবু।
রামবাবু কহিলেন, বেশ জানি বলেই ত জানতাম। কিন্তু আপনার গৃহিণীটি যে একেবারে আগাগোড়া ওলট-পালট করে দিতে চাচ্ছেন। বলছেন, জাতি-ভেদের মত এত বড় অন্যায়, এত বড় সর্বনাশকে তিনি কিছুতেই স্বীকার করতে পারেন না, ম্লেচ্ছর অন্ন আহার করতেও তাঁর আপত্তি নেই এবং এ শিক্ষা জন্মকাল থেকে তাঁর ব্রাহ্ম বাবার কাছেই পেয়েছেন। ওঁর হাতে খেয়ে আজ আমার জাত গেছে কি না এবং একটা প্রায়শ্চিত্ত করা প্রয়োজন কি না, এতক্ষণ সেই কথাই হচ্ছিল। আপনি কি বলেন?

সুরেশ নির্বাক্‌। অচলার মেজাজ তাহার অবিদিতও নয় এবং সেখানে বিদ্রোহের অগ্নি যে অহরহ জ্বলিয়াই আছে, এ খবরও তাহার নূতন নয়। কিন্তু সেই আগুন আজ অকস্মাৎ যে কিজন্য এবং কোথা পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত হইয়াছে, ইহাই অনুমান করিতে না পারিয়া সে আশঙ্কায় ও উদ্বেগে শুষ্ক হইয়া উঠিল; কিন্তু ক্ষণেক পরেই আত্মসংবরণ করিয়া পূর্বের মত আবার একটু হাসিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু এবার চেষ্টাটা শুধু হাসিকে আচ্ছন্ন করিয়া মুখখানাকে বিকৃত করিল মাত্র।

সুরেশ বলিল, উনি আপনাকে তামাশা করচেন।

রামবাবু গম্ভীর হইয়া মাথা নাড়িলেন, বলিলেন, উচিত না হলেও এ কথা ভাবতে আমার আপত্তি ছিল না, কিন্তু স্বামীর কল্যাণেও যখন হিন্দুঘরের মেয়ে তাঁর কর্তব্য পালন করতে চাইলেন না—তুলসী দেওয়ার দিনটাতেও কিছুতে উপবাস করলেন না—ভাল, এ যদি তামাশা হয় ত কিছু কঠিন তামাশা বটে। আচ্ছা সুরেশবাবু, বিবাহ ত আপনার হিন্দু মতেই হয়েছিল?

সুরেশ কহিল, হ্যাঁ।

বৃদ্ধ মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন, কহিলেন, তা আমি জানি। অচলার প্রতি চাহিয়া বলিলেন, যদিচ তোমাকে আমার অনেক কথা বলবার আছে মা, কিন্তু তোমার বাবার ব্রাহ্ম হওয়ায় আর কোন দুঃখ নাই। এমন ব্রাহ্ম আমি অনেক জানি, যাঁরা সমাজে গিয়েও চোখ বোজেন, অল্প-স্বল্প অনাচারও করেন; কিন্তু মেয়ের বিয়ের বেলা আর হিসাবের গোল করেন না। যাক, আমার একটা ভাবনা দূর হল।

কিন্তু তাঁহার অপেক্ষাও অনেক বেশি ভাবনা দূর হইয়া গেল সুরেশের। সে তৎক্ষণাৎ বৃদ্ধের সুরে সুর মিলাইয়া বলিয়া উঠিল, আপনি ঠিক বলেছেন রামবাবু, আজকাল এই দলের লোকই বেশি। তাঁরা—

হঠাৎ উভয়েই চমকিয়া উঠিল। কথার মাঝখানেই অচলার তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ঠিক যেন গর্জন করিয়া উঠিল। সে সুরেশের মুখের উপর দুই চক্ষুর তীব্র দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া বলিল, এত অপরাধের পরেও তোমার অপরাধ বাড়াতে লজ্জা হয় না? আবার তা আমারই মুখের উপরে? তুমি জানো, এ-সব মিথ্যে? তুমি জানো, বাবা ঠক নন, তিনি মনে-জ্ঞানে যথার্থই ব্রাহ্ম-সমাজের। তুমি জানো, তিনি—, বলিতে বলিতেই সে চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

সুরেশ প্রথমটা থতমত খাইল, কিন্তু ঘাড় ফিরাইয়া বৃদ্ধের বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখের প্রতি চাহিয়া অকস্মাৎ সেও যেন জ্বলিয়া উঠিল। বলিল, মিছে কথা কিসের? তোমার বাবা কি হিন্দুঘরে তাঁর মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না? তুমিও সত্যি কথা বলো!
অচলা আর প্রত্যুত্তর দিল না। বোধ হয় মুহূর্তকাল নিঃশব্দে থাকিয়া আপনাকে সামলাইয়া লইল, তারপর ধীরে ধীরে বলিল, সে কথা আজ আমাকে জিজ্ঞাসা করচ কেন? তার হেতু কি সংসারে সকলের চেয়ে বেশী তুমি নিজেই জানো না? তুমি ঠিক জানো আমি কি, আমার বাবা কি, কিন্তু এই নিয়ে তোমার সঙ্গে বচসা করতে আমার শুধু যে প্রবৃত্তি হয় না তাই নয়, আমার লজ্জা করে। তোমার যা ইচ্ছে হয়, ওঁকে বানিয়ে বল, কিন্তু আমি শুনতে চাইনে। বল—আমি চললুম। বলিয়া সে একরকম দ্রুতপদেই পাশের ঘরে গিয়া প্রবেশ করিল।

সে চলিয়া গেল, কিন্তু কিছুক্ষণের নিমিত্ত উভয়েই যেন নিশ্চল পাথরের মত হইয়া গেল।

বৃদ্ধ বোধ করি নিতান্তই মনের ভুলে একবার তাঁর হুঁকাটার জন্য হাত বাড়াইলেন, কিন্তু তখনই হাতটা টানিয়া লইয়া একটুখানি নড়িয়া-চড়িয়া বসিয়া, একবার কাসিয়া গলাটা পরিষ্কার করিয়া কহিলেন, আজকাল শরীরটা কেমন আছে সুরেশবাবু?

সুরেশ অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছিল, চকিত হইয়া বলিল, আজ্ঞে, বেশ আছে; বলিয়াই বোধ হয় সত্য কথাটা স্মরণ হইল, কহিল, বুকে এইখানটায় একটুখানি ব্যথা—কি জানি কাল থেকে আবার বাড়লো না—

রামবাবু বলিলেন, তবেই দেখুন দেখি সুরেশবাবু, এই ঠাণ্ডায় এত রাত্রি পর্যন্ত কি আপনার বাইরে ঘুরে বেড়ান ভাল?

ঠিক ঘুরে বেড়াই নি রামবাবু! সেই বাড়িটার জন্যে আজ দু’হাজার টাকা বায়না দিয়ে এলুম।

রামবাবু বিস্ময় প্রকাশ করিয়া শেষে বলিলেন, নদীর উপর বাড়িটি ভালই। কিন্তু আমাকে যদি জিজ্ঞেস করতেন, আমি হয়ত নিষেধ করতাম। সেদিন কথায় কথায় যেন বুঝেছিলাম, সুরমার এখানে বাস করার একান্ত অনিচ্ছা। হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তাঁর মত নিয়েছেন, না কেবল নিজের ইচ্ছেতেই কিনে বসলেন?

সুরেশ এ প্রশ্নের জবাব না দিয়া শুধু কহিল, অনিচ্ছার বিশেষ কোন হেতু দেখিনে। তা ছাড়া বাস করবার মত কিছু কিছু আসবাবপত্রও কলকাতা থেকে আনতে দিয়েছি, খুব সম্ভব কাল-পরশুর মধ্যেই এসে পড়বে।

রামবাবু কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া সহসা কি ভাবিয়া ডাক দিয়া উঠিলেন, সুরমা!

অচলা সাড়া দিল না, কিন্তু ঘরের ভিতর হইতে নীরবে বাহির হইয়া ধীরে ধীরে তাহার চৌকিতে আসিয়া বসিল।

বৃদ্ধ স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিলেন, মা, তোমার স্বামী যে আমাদের দেশে মস্তবড় বাড়ি কিনে ফেললেন। এই বুড়ো জ্যাঠামশাইকে আর ত ফেলে চলে যেতে তুমি পারবে না মা।

অচলা চুপ করিয়া রহিল।
বৃদ্ধ পুনশ্চ কহিলেন, শুধু বাড়ি আর আসবাবপত্র নয়, আমি জানি, গাড়িঘোড়াও আসচে। আর তার চেয়েও বেশি জানি, সমস্তই কেবল তোমারি জন্যে। বলিয়া তিনি সহাস্যে একবার সুরেশ ও একবার অচলার মুখের প্রতি চাহিলেন। কিন্তু সেই গম্ভীর বিষণ্ণ মুখ হইতে আনন্দের এতটুকু চিহ্ন প্রকাশ পাইল না। এই অস্পষ্ট আলোকে হয়ত ইহা অপরের ঠিক লক্ষ্য না পাইতে পারিত, কিন্তু তীক্ষ্ণদৃষ্টি বৃদ্ধের চক্ষু তাহা এড়াইল না। তথাপি তিনি প্রশ্ন করিলেন, কিন্তু মা, তোমার মতটা—

অচলা এইবার কথা কহিল, বলিল, আমার মতের ত আবশ্যক নেই জ্যাঠামশাই।

বৃদ্ধ তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন, সে কি একটা কথা মা! তুমিই ত সব, তোমার ইচ্ছেতেই ত—

অচলা উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, না জ্যাঠামশাই না, আমার ইচ্ছায় কিছুই আসে-যায় না। আপনি সব কথা বুঝবেন না, আপনাকে বোঝাতেও আমি পারব না—কিন্তু আর আমাকে দরকার না থাকে ত আমি যাই—

বৃদ্ধের মুখ দিয়া আর কথা বাহির হইল না এবং তাহার আবশ্যকও হইল না; সহসা হিন্দুস্থানী দাসী একটা কড়ায় এক কড়া আগুন লইয়া উপস্থিত হইবামাত্র সকলের দৃষ্টি তাহারই উপর গিয়া পড়িল। রামবাবু আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিতে যাইতেছিলেন; সুরেশ অপ্রতিভ হইয়া বলিল, আমি বেহারাটাকে আনতে হুকুম দিয়েছিলুম, সে আবার আর একজনকে হুকুম দিয়েছে দেখচি। আমার এই ব্যথাটায় একটু—

অগ্নির প্রয়োজনের আর বিশদ ব্যাখ্যা করিতে হইল না, কিন্তু তাহার জন্য ত আর একজন চাই। রামবাবু অচলার মুখের দিকে চাহিলেন, কিন্তু সে নিমিষে মুখ ফিরাইয়া লইয়া শ্রান্তকণ্ঠে বলিল, আমার ভারী ঘুম পেয়েছে, জ্যাঠামশাই, আমি চললুম। বলিয়া উত্তরের অপেক্ষামাত্র না করিয়া চলিয়া গেল এবং পরক্ষণেই তাহার কপাট রুদ্ধ হওয়ার শব্দ আসিয়া পৌঁছিল।

বৃদ্ধ ধীরে ধীরে চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন, এবং দাসীর হাত হইতে আগুনের মালসাটা নিজের হাতে লইয়া বলিলেন, তা হলে চলুন সুরেশবাবু—

আপনি?

হ্যাঁ, আমিই। এ নতুন নয়, এ কাজ এ জীবনে অনেক হয়ে গেছে; বলিয়া একপ্রকার জোর করিয়াই তাহাকে ঘরে টানিয়া লইয়া গেলেন এবং মালসাটা ঘরের মেঝের উপর রাখিয়া দিয়া তাহার শুষ্ক ম্লান মুখের প্রতি ক্ষণকাল একদৃষ্টে চাহিয়া থাকিয়া তাহার একটা হাত চাপিয়া ধরিয়া আর্দ্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, না সুরেশবাবু, না, এ কোনমতেই চলতে পারে না—কোনমতেই না। আমি নিশ্চয় জানচি, কি একটা হয়েচে—আমি একবার আপনার—; কিন্তু থাক সে কথা—যদি প্রয়োজন হয় ত এ বুড়ো আর একবার—, বলিয়া তিনি সহসা নীরব হইলেন।

সুরেশ একটি কথাও কহিতে পারিল না। কিন্তু ছেলেমানুষের মত প্রথমটা তাহার ওষ্ঠাধর বারংবার কাঁপিয়া উঠিল, তারপর চোখের জল গোপন করিতে মুখ ফিরাইল।

পঞ্চত্রিংশ পরিচ্ছেদ

একটা কোচের উপর সুরেশ চক্ষু মুদিয়া শুইয়াছিল এবং সন্নিকটে একখানা চৌকি টানিয়া বৃদ্ধ রামবাবু তাহার পীড়িত বক্ষে অগ্নির উত্তাপ দিতেছিলেন, এমন সময়ে উভয়েই দ্বার খোলার শব্দে চাহিয়া দেখিলেন, অচলা প্রবেশ করিতেছে। সে বিনা আড়ম্বরে কহিল, রাত অনেক হয়েছে, জ্যাঠামশাই, আপনি শুতে যান।

সেইজন্যেই ত অপেক্ষা করে আছি মা, বলিয়া বৃদ্ধ চট্‌ করিয়া উঠিয়া পড়িলেন, এবং সুরেশকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, এতক্ষণ দু’জনেরই শুধু কেবল বিড়ম্বনা ভোগ হল বৈ ত নয়! এ-সব কাজ কি আমরা পারি? অচলার প্রতি চেয়ারটা ঈষৎ অগ্রসর করিয়া দিয়া বলিলেন, যার কর্ম তাকেই সাজে মা, এই নাও, বসো—আমি একটু হাত-পা ছড়িয়ে বাঁচি। বলিয়া বৃদ্ধ বিপুল শ্রান্তির ভারে মস্ত একটা হাই তুলিয়া গোটা-দুই তুড়ি দিয়া হুঁকাটা তুলিয়া লইলেন, এবং ঘরের বাহির হইয়া সাবধানে দরজা বন্ধ করিতে করিতে সহাস্যে কহিলেন, ঢুলতে ঢুলতে যে হাত-পা পুড়িয়ে বসিনি সেই ভাগ্য, কি বলেন সুরেশবাবু?

সুরেশ কোন কথা কহিল না, শুধু নিমীলিত নেত্রের উপর দুই হাত যুক্ত করিয়া একটা নমস্কার করিল।

অচলা নীরবে তাঁহার পরিত্যক্ত আসনটি অধিকার করিয়া বসিল এবং সেক দিবার ফ্লানেলটা উত্তপ্ত করিতে করিতে ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিল, আবার ব্যথা হলো কেন? কোন্‌খানটায় বোধ হচ্চে?

সুরেশ চোখ মেলিল না, উত্তর দিল না, শুধু হাত তুলিয়া বক্ষের বাম দিকটা নির্দেশ করিয়া দেখাইল। আবার সমস্ত নিস্তব্ধ। সে এমনি যে, মনে হইতে লাগিল, বুঝিবা এই নির্বাক অভিনয়ের শেষ অঙ্ক পর্যন্ত এমনি নীরবেই সমাপ্ত হইবে। কিন্তু সেরূপ ঘটিল না। সহসা অচলার ফ্লানেলসুদ্ধ হাতখানা সুরেশ তাহার বুকের উপর চাপিয়া ধরিল। অচলার মুখের উপর উদ্বেগের কোন চিহ্ন প্রকাশ পাইল না; সে ইহাই যেন প্রত্যাশা করিতেছিল, কেবল কহিল, ছাড়ো, আরও একটু সেক দিয়ে দিই।

সুরেশ হাত ছাড়িয়া দিল, কিন্তু চক্ষের পলকে উঠিয়া বসিয়া দুই ব্যগ্র বাহু বাড়াইয়া অচলাকে তাহার আসন হইতে টানিয়া আনিয়া নিজের বুকের উপর সজোরে চাপিয়া ধরিয়া অজস্র চুম্বনে একেবারে আচ্ছন্ন অভিভূত করিয়া ফেলিল। একমুহূর্ত পূর্বে যেমন মনে হইয়াছিল, এই আবেগ-উচ্ছ্বাসহীন নাটকের পরিসমাপ্তি হয়ত এমনি নিস্পন্দ মৌনতার ভিতর দিয়াই ঘটিবে, কিন্তু নিমেষ না গত হইতেই আবার বোধ হইতে লাগিল, এই উন্মত্ত নির্লজ্জতার বুঝি সীমা নাই, শেষ নাই, সর্বদিক সর্বকাল ব্যাপিয়াই এই মত্ততা চিরদিন বুঝি এমনি অনন্ত ও অক্ষয় হইয়া রহিবে—কোনদিন কোন যুগেও ইহার আর বিরাম মিলিবে না, বিচ্ছেদ ঘটিবে না।

অচলা বাধা দিল না, জোর করিল না; মনে হইল, ইহার জন্যও সে প্রস্তুত হইয়াই ছিল, শুধু কেবল তাহার শান্ত মুখখানা একেবারে পাথরের মত শীতল ও কঠোর হইয়া উঠিল। সুরেশের চৈতন্য ছিল না—বোধ হয় সৃষ্টির কঠিনতম তমিস্রায় তাহার দুই চক্ষু একেবারে অন্ধ হইয়া গিয়াছিল, না হইলে এ মুখ-চুম্বন করার লজ্জা ও অপমান আজ তাহার কাছে ধরা পড়িতেও পারিত। ধরা পড়িল না সত্য, কিন্তু সুদ্ধমাত্র শান্তিতেই বোধ করি এই উন্মাদনা যখন স্থির হইয়া আসিল, তখন অচলা ধীরে ধীরে নিজেকে মুক্ত করিয়া লইয়া আপনার জায়গায় ফিরিয়া আসিয়া বসিল।
আরও ক্ষণকাল দু’জনেরই যখন চুপ করিয়া কাটিল, তখন সুরেশ অকস্মাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিয়া উঠিল, অচলা, এমন করে আর আমাদের কতদিন কাটবে? বলিয়া উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই কহিতে লাগিল, তোমার কষ্ট আমি জানি, কিন্তু আমার দুঃখটাও একবার ভেবে দেখ। আমি যে গেলুম।

এ প্রশ্নের জবাব না দিয়াই অচলা জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কি এখানে বাড়ি কিনেচ?

সুরেশ বিপুল আগ্রহে বলিয়া উঠিল, সে ত তোমারই জন্য অচলা!

অচলা ইহার কোন প্রত্যুত্তর না দিয়া পুনশ্চ প্রশ্ন করিল, আসবাবপত্র, গাড়ি-ঘোড়াও কি কিনতে পাঠিয়েচ?

সুরেশ তেমন করিয়াই উত্তর দিল, কিন্তু সমস্তই ত তোমারই জন্যে।

অচলা নীরব হইয়া রহিল। এ-সকলে তাহার কি প্রয়োজন, এ-সকল সে চায় কি না—ওই লোকটার কাছে এ প্রশ্ন করার মত নিজের প্রতি বিদ্রূপ আর কি আছে? তাই এ-সম্বন্ধে আর কোন কথা না কহিয়া মৌন হইয়া রহিল। মুহূর্ত-কয়েক পরে জিজ্ঞাসা করিল, রামবাবুর কাছে কি তুমি আমার বাবার নাম করেচ? বাড়ি কোথায় বলেচ?

সুরেশ বলিল, না।

আর কি সেক দেবার দরকার আছে?

না।

তা হলে এখন আমি চললুম। আমার বড় ঘুম পাচ্চে। বলিয়া অচলা চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল এবং আগুনের পাত্রটা সরাইয়া রাখিয়া ঘরের বাহির হইয়া কবাট বন্ধ করিবার উপক্রম করিতেই সুরেশ ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া কহিল, আজ আর একটা কথা বলে যাও অচলা। তুমি কি আর কোথাও যেতে চাও? সত্যি বলো?

অচলা কহিল, সে কোথায়?

সুরেশ বলিল, যেখানে হোক। যেখানে আমাদের কেউ চেনে না, কেউ জানে না—তেমন কোন দেশে। সে দেশ যত—

আগ্রহে আবেশে সুরেশের কণ্ঠস্বর কাঁপিতে লাগিল, অচলা তাহা লক্ষ্য করিল, কিন্তু নিজে সে একান্ত স্বাভাবিক ও সরল গলায় আস্তে আস্তে জবাব দিল, এদেশেও ত আমাদের কেউ চিনত না। আজও ত আমাদের কেউ চেনে না।

সুরেশ উৎসাহ পাইয়া বলিতে গেল, কিন্তু ক্রমশঃ—

অচলা বাধা দিয়া কহিল, ক্রমশঃ জানতে পারবে? খুব সম্ভব পারবে, কিন্তু সে সম্ভাবনা ত অন্য দেশেও আছে?

সুরেশ উল্লাসে চঞ্চল হইয়া বলিতে লাগিল, তা হলে এখানেই স্থির। এখানেই তোমার সম্মতি আছে, বল অচলা? একেবারে স্পষ্ট করে বলে দাও—, বলিতে বলিতে কিসে যেন তাহাকে ঠেলিয়া তুলিয়া দিল। কিন্তু ব্যগ্র পদ মেঝের উপর দিয়াই সে সহসা স্তব্ধ হইয়া চাহিয়া দেখিল, দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিয়া অচলা অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছে।

কয়েকদিন হইতে আকাশে মেঘের আনাগোনা শুরু হইয়া এক ঝড়-বৃষ্টির সূচনা করিতেছিল। সুরেশের নূতন বাটীতে অপর্যাপ্ত আসবাব ও সাজসরঞ্জাম কলিকাতা হইতে আসিয়া গাদা হইয়া পড়িয়া আছে; তাহাদিগকে সাজাইয়া গুছাইয়া লইবার দিকে কোন পক্ষেরই কোন গা নাই। একজোড়া বড় ঘোড়া ও একখানা অতিশয় দামী গাড়ি পরশু আসিয়া পর্যন্ত কোন্‌ একটা আস্তাবলে সহিস-কোচম্যানের জিম্মায় রহিয়াছে, কেহই খোঁজ লয় না। দিনগুলা যেমন-তেমন করিয়া কাটিয়া চলিয়াছে, এমন সময় একদিন দুপুরবেলায় বৃদ্ধ রামবাবু এক হাতে হুঁকা এবং অপর হাতে একখানি নীলরঙের চিঠি লইয়া উপস্থিত হইলেন।
অচলা রেলিং-এর পার্শ্বে বেতের সোফার উপর অর্ধশায়িতভাবে পড়িয়া একখানা বাংলা মাসিকের বিজ্ঞাপন পড়িতেছিল, জ্যাঠামশাইকে দেখিয়া উঠিয়া বসিল। রামবাবু চিঠিখানা অগ্রসর করিয়া দিয়া বলিলেন, এই নাও সুরমা, তোমার রাক্ষুসীর পত্র। সে এতদিন তোমাকে লিখতে পারেনি ব’লে আমার চিঠির মধ্যেই যেমন অসংখ্য মাপ চেয়েছে, তেমনি অসংখ্য প্রণামও করেচে। তাকে তুমি মার্জনা কর। বলিয়া তিনি হাসিমুখে কাগজটুকু তাহার হাতে দিয়া অদূরে একখানি চৌকি টানিয়া লইয়া উপবেশন করিলেন এবং নদীর দিকে চাহিয়া একমনে হুঁকা টানিয়া টানিয়া ধূঁয়ায় অন্ধকার করিয়া তুলিলেন।

অচলা পত্রখানি আদ্যোপান্ত বার-দুই পাঠ করিয়া মুখ তুলিয়া চাহিল, কহিল, এঁরা সকলেই তা হলে পরশু সকালের গাড়িতে এসে পড়বেন? পিসীমা কে, জ্যাঠামশাই? আর তাঁর রাজপুত্রবধূ, রাজপুত্র, গার্‌জেন টিউটার—

রামবাবু হাসিয়া কহিলেন, রাক্ষুসী বেটী তামাশা করার একটা সুযোগ পেলে ত আর ছাড়বে না। পিসীমা হলেন আমার বিধবা ছোট ভগিনী আর রাজপুত্রবধূ হলেন তাঁর মেয়ে—ভাঁড়ারপুরের ভবানী চৌধুরীর স্ত্রী—তা সে যাই বলুক, রাজা-রাজড়ার ঘরই সে বটে। রাজপুত্র হলো তার বছর-দশেকের ছেলে—আর শেষ ব্যক্তিটি যে কি, তা ত চোখে না দেখলে বলতে পারিনে মা। হবেন কোন বেশি মাইনের চাকর-বাকর। বড়লোকের ছেলের সঙ্গে ঘুরে বেড়ান, এটা-ওটা-সেটা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে যুগিয়ে দিয়ে সাবালক-নাবালক উভয় পক্ষের মান রাখেন—এমনি কিছু একটা হবেন বোধ করি। কিন্তু সেজন্যে ত ভাবচিনে সুরমা, আসুন, খান-দান, পশ্চিমের জল-হাওয়ায় গলাজ্বালা, বুকজ্বালা, দু’দিন স্থগিত হয় ত খুব খুশীই হবো; কিন্তু চিন্তা এই যে, বাড়িটি ত আমার ছোট, রাজা-রাজড়ার কথা ভেবে তৈরিও করিনি, ঘরদোরের বন্দোবস্তও তার উপযোগী নয়। সঙ্গে দাস-দাসীও আসবে হয়ত প্রয়োজনের তিনগুণ বেশি। আমি তাই মনে করচি, তোমার বাড়িটাকে যদি—

অচলা ব্যগ্র হইয়া বলিল, কিন্তু তার ত আর সময় নেই জ্যাঠামশাই, তা ছাড়া একলা অত দূরে থাকি কি তাঁদের সুবিধে হবে?

রামবাবু কহিলেন, সময় আছে, যদি এখন থেকেই লাগা যায়। আর জায়গা প্রস্তুত থাকলে কোথায় কার সুবিধে হবে, সে মীমাংসা সহজেই হতে পারবে। সুরেশবাবু ত শোনামাত্রই টমটম ভাড়া করে চলে গেছেন—তোমার গাড়িও তৈরি হয়ে এলো বলে; তুমি নিজে যদি একটু শীঘ্র প্রস্তুত হয়ে নিতে পারো মা, আমিও তা হলে সে ফুরসতে জুতোজোড়াটা বদলে একখানা উড়ুনি কাঁধে ফেলে নিই। তোমার ঘর-সংসারের বিলিব্যবস্থা ত সত্যি সত্যি আমরা পেরে উঠবো না।

অচলা ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল; কহিল, আচ্ছা, আমি কাপড়টা বদলে নিচ্ছি, বলিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।
রামবাবুর প্রস্তাব অসঙ্গত নয়, অস্পষ্টও নয়। আত্মীয় রাজকুমার ও রাজমাতার স্থান-সঙ্কুলান করিতে এ আশ্রয় ত্যাগ করিয়া যে এবার তাহাকে স্থানান্তরে যাইতে হইবে, এ কথা অচলা সহজেই বুঝিল; কিন্তু বুঝা সহজ হইলেই কিছু তাহার ভার লঘু হইয়া ওঠে না। মনের মধ্যে সেটা যতদূর গেল, ততদূর গুরুভার স্টিল রোলারের ন্যায় যেন পিষিয়া দিয়া গেল।

এতদিনের মধ্যে একটা দিনের জন্যেও কেহ তাহাকে বাটীর বাহির করিতে সম্মত করিতে পারে নাই। মিনিট-পনেরো পরে আজ প্রথম যখন সে নিজের অভ্যস্ত সাজে প্রস্তুত হইয়া শুধু এইজন্যই নামিয়া আসিল, তখন চারিদিকের সমস্তই তাহার চক্ষে নূতন এবং আশ্চর্য বলিয়া ঠেকিল, এমন কি আপনাকে আপনিই যেন আর-একরকম বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। ফটকের বাহিরে দাঁড়াইয়া প্রকাণ্ড জুড়ি; নব-পরিচ্ছেদে সজ্জিত কোচম্যান মনিব জানিয়া উপর হইতে সেলাম করিল; সহিস দ্বার খুলিয়া সসম্মানে সরিয়া দাঁড়াইল, এবং তাহাকেই অনুসরণ করিয়া বৃদ্ধ রামবাবু যখন সম্মুখের আসন গ্রহণ করিয়া বসিলেন তখন সমস্তটাই অদ্ভুত স্বপ্নের মত মনে হইতে লাগিল। তাহার আচ্ছন্ন দৃষ্টি গাড়ির যে অংশটার প্রতিই দৃষ্টিপাত করিল, তাহাই বোধ হইল, এ কেবল বহুমূল্য নয়, এ শুধু ধনবানের অর্থের দম্ভ নয়, ইহার প্রতি বিন্দুটি যেন কাহার সীমাহীন প্রেম দিয়া গড়া।

কঠিন পাথরের রাস্তার উপর চারজোড়া খুরের প্রতিধ্বনি তুলিয়া জুড়ি ছুটিল, কিন্তু অচলার কানের মধ্যে তাহা শুধু অস্পষ্ট হইয়া প্রবেশ করিল। তাহার সমস্ত অন্তর ও বহিরিন্দ্রিয় হয়ত শেষ পর্যন্ত এমন অভিভূত হইয়াই থাকিত, কিন্তু সহসা রামবাবুর কণ্ঠস্বরে সে চকিত হইয়া উঠিল। তিনি সম্মুখের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলিলেন, মা, ওই তোমার বাড়ি দেখা যায়। লোকজন দাসদাসী সবই নিযুক্ত করা হয়ে গেছে, মোটামুটি সাজানো-গোছানোর কাজও বোধ করি এতক্ষণে অনেক এগিয়ে এলো, শুধু তোমাদের শোবার ঘরটিতে মা, আমি কাউকে হাত দিতে মানা করে দিয়েছি। তাঁর যাবার সময় বলে দিলাম, সুরেশবাবু, বাড়ির আর যেখানে যা খুশি করুন গে, আমি গ্রাহ্য করিনে, শুধু মায়ের ঘরটিতে কাজ করে মায়ের আমার কাজ বাড়িয়ে দেবেন না। এই বলিয়া বৃদ্ধ একখানি সলজ্জ হাসিমুখের আশায় চোখ তুলিয়াই একেবারে চুপ করিয়া গেলেন।

তিনি কেন যে এমন করিয়া থামিয়া গেলেন, অচলা তাহা সেই মুহূর্তেই বুঝিল, তাই যতক্ষণ না গাড়ি নূতন বাংলোর দরজায় আসিয়া পৌঁছিল, ততক্ষণ সে তাহার শুষ্ক বিবর্ণ মুখখানা বাহিরের দিকে ফিরাইয়া এই বৃদ্ধের বিস্মিত দৃষ্টি হইতে গোপন করিয়া রাখিল।

গাড়ির শব্দে সুরেশ বাহিরে আসিল, দাসদাসীরাও কাজ ফেলিয়া অন্তরাল হইতে সভয়ে তাহাদের নূতন গৃহিণীকে দেখিতে আসিল; কিন্তু সে মুখের প্রতি চাহিয়া কেহই কোন উৎসাহ পাইল না।

রামবাবুর সঙ্গে সঙ্গে অচলা নীরবে নামিয়া আসিল, সুরেশের প্রতি একবার সে মুখ তুলিয়া চাহিয়াও দেখিল না; তার পরে তিনজনেই নিঃশব্দে ধীরে ধীরে এই নূতন বাড়িটার মধ্যে প্রবেশ করিল। তাহার ভিতরে-বাহিরে উপরে-নীচে কোথাও যে আনন্দের লেশমাত্র আভাস আছে, তাহা ক্ষণকালের নিমিত্ত কোনদিকে চাহিয়া কাহারো চক্ষে পড়িল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *