বিজয়া – ৩.৩

তৃতীয় দৃশ্য

বিজয়ার অট্টালিকা-সংলগ্ন উদ্যানের একাংশ

[গৃহের কিছু কিছু গাছের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায়। পরেশ কোঁচড়ে মুড়ি-মুড়কি লইয়া আপন মনে চিবাইতে চিবাইতে চলিয়াছিল, পিছনে দ্রুতবেগে রাসবিহারী প্রবেশ করিলেন]

রাস। এই হারামজাদা ব্যাটা! দাঁড়া,—দাঁড়া বলচি।

পরেশ। (থমকিয়া দাঁড়াইয়া চাহিল) এজ্ঞে?

রাস। এজ্ঞে! হারামজাদা শূয়ার! কেন সেই নরেনটাকে তুই বাড়িতে ডেকে এনেছিলি?

পরেশ। মা-ঠাকরুন বললে যে।

রাস। মা-ঠাকরুন বললে যে! কত রাত্তিরে সে ব্যাটা বাড়ি থেকে গেল বল।

পরেশ। আমি ত জানিনে বড়বাবু!

রাস। জানিস নে হারামজাদা! বল তোর মা-ঠাকরুন নরেনকে কি কি কথা বললে?

পরেশ। আমি ছিনু না বড়বাবু! মা-ঠান বললে, এই নে পরেশ একটা টাকা, ভাল দেখে ঘুড়ি-নাটাই কিন গে। আমি ছুট্টে চলে গেনু।

রাস। এখনো সত্যি কথা বল, নইলে পেয়াদা দিয়ে চাবকে তোর পিঠের চামড়া তুলে দেব।

পরেশ। (কাঁদ-কাঁদ হইয়া) সত্যি বলচি জানিনে বড়বাবু। নতুন দরোয়ান তোমাকে মিছে কথা বলেচে! তুমি বরঞ্চ আমার মাকে জিজ্ঞেসা করো গে।

রাস। তোর মা? সে বেটী যত নষ্টের গোড়া। তোকেও দূর করব, তাকেও দূর করব পেয়াদা দিয়ে গলায় ধাক্কা দিতে দিতে। আর ঐ বেটা কালীপদ,—তাকেও তাড়িয়ে তবে আমার কাজ।

পরেশ। আমি কিচ্ছু জানিনে বড়বাবু।

রাস। খবরদার। এ-সব কথা কাউকে বলবি নে। যদি শুনি তোর মা-ঠাকরুনকে একটা কথা বলচিস ত পিছমোড়া করে বেঁধে দরোয়ানকে দিয়ে জলবিছুটি লাগাব। খবরদার বলচি একটা কথা কাউকে বলবি নে। যা—

[রাসবিহারী ও দরোয়ান প্রস্থান করিল। আর একদিকে বিজয়া
প্রবেশ করিয়া পরেশকে ইঙ্গিতে কাছে আহ্বান করিল]

বিজয়া। হাঁ রে পরেশ, বড়বাবু তোরে লাঠি দেখাচ্ছিল কেন রে? কি করেছিস তুই?

পরেশ। বলতে মানা করে দেছে যে। বলে, খবরদার বলচি হারামজাদা শূয়ার, একটা কথা তোর মা-ঠানকে বলবি ত তোরে সেপাই দিয়ে বেঁধে জলবিছুটি লাগাব।

[বলিতে বলিতে সে কাঁদিয়া ফেলিল। বিজয়া সস্নেহে

তাহার পিঠে হাত বুলাইয়া দিয়া বলিল]

বিজয়া। তোর কিচ্ছু ভয় নেই পরেশ, তুই আমার কাছে কাছে থাকবি। কার সাধ্যি তোকে মারে।

পরেশ। (চোখ মুছিয়া) বড়বাবু বলে হারামজাদা শূয়ার, নরেনকে কেন ডেকে এনেছিলি বল। সে ব্যাটা কত রাত্তিরে বাড়ি থেকে গেল বল। তোর মা-ঠাকরুন তারে কি কি কথা বললে বল। তুমি ডাক্তারবাবুরে কি কি বললে আমি কি জানি মা-ঠান? তুমি টাকা দিলে আমি ছুট্টে ঘুড়ি-নাটাই কিনতে গেনু না?

বিজয়া। তাই ত গেলি।

পরেশ। তবে? নতুন দরোয়ানজী কেন বলে আমি সব জানি। বড়বাবু বলে, তোকে আর তোর মাকে গলাধাক্কা দিয়ে দূর করে দেব। আর ঐ কালীপদটাকে,—তাকেও তাড়াব।

বিজয়া। তুই যা পরেশ তোর ভয় নেই। বড়বাবু ডেকে পাঠালে তুই যাসনে।

পরেশ। আচ্ছা মা-ঠান, আমি কখখনো যাব না। দরোয়ান ডাকতে এলে ছুট্টে পালাবো—না?

বিজয়া। হাঁ, তুই ছুটে আমার কাছে পালিয়ে আসিস।

[পরেশ প্রস্থান করিল

[রাসবিহারীর প্রবেশ]

রাস। তুমি মা এখানে। সকালেই বেরিয়েছে? আমি বাড়িতে ঘরে ঘরে খুঁজে দেখি কোথাও বিজয়া নেই।

বিজয়া। আপনি আজ এত সকালেই যে?

রাস। মাথার ওপর যে নানা ভার মা। একটা দুশ্চিন্তায় কাল ভালো করে ঘুমুতেই পারিনি। কিন্তু তোমারও চোখ-দুটি যে রাঙ্গা দেখাচ্ছে। ভাল ঘুম হয়নি বুঝি?

বিজয়া। ঘুম ভালোই হয়েছে।

রাস। তবে ঠাণ্ডা লেগেছে বোধ হয়?

বিজয়া। না, ভালোই আছি।

রাস। সে বললে শুনব কেন মা? একটা কিছু নিশ্চয় হয়েছে। সাবধান হওয়া ভালো, আজ আর স্নান করো না যেন। একবার উপরে যেতে হবে যে। তোমার শোবার ঘরের লোহার সিন্দুকে যে দলিলগুলো আছে একবার ভালো করে পড়ে দেখতে হবে। শুনচি নাকি চৌধুরীরা ঘোষপাড়ার সীমানা নিয়ে একটা মামলা রুজু করবে।

বিজয়া। তাঁরা মামলা করবেন কে বললে?

রাস। (অল্প হাস্য করিয়া) কেউ বলেনি মা, আমি বাতাসে খবর পাই। তা না হলে কি এতবড় জমিদারিটা এতদিন চালাতে পারতাম!

বিজয়া। তাঁরা কতটা জমি দাবী করচেন?

রাস। তা, হবে বৈ কি—খুব কম হলেও সেটা বিঘে-দুই হবে।

বিজয়া। এই? তা হলে তাঁরাই নিন। এ নিয়ে মামলা-মকদ্দমার দরকার নেই।

রাস। (ক্ষোভের সহিত) এরকম কথা তোমার মত মেয়ের মুখে আমি আশা করিনি মা। আজ বিনা বাধায় যদি দু-বিঘে ছেড়ে দিই, কাল যে আবার দুশো বিঘে ছেড়ে দেতে হবে না তাই বা কে বললে!

বিজয়া। সত্যিই ত তা আর হচ্চে না; আমি বলি সামান্য কারণে মামলা-মকদ্দমার দরকার নেই।

রাস। (বারংবার মাথা নাড়িয়া) না মা, কিছুতেই সে হতে পারে না। তোমার বাবা যখন আমার উপর সমস্ত নির্ভর করে গেছেন এবং কতক্ষণ বেঁচে আছি বিনা আপত্তিতে দু-বিঘে কেন দু-আঙুল জায়গা ছেড়ে দিলেও ঘোর অধর্ম হবে। তা ছাড়া আরও অনেক কারণ আছে, যে-জন্যে পুরনো দলিলগুলো ভাল করে একবার দেখা দরকার। একটু কষ্ট করে ওপরে চল মা,—দেরি হলে ক্ষতি হবে।

বিজয়া। কি ক্ষতি হবে?

রাস। সে অনেক। মুখে মুখে তার কি কৈফিয়ত দেবো বলো ত!

[সরকার মহাশয়ের প্রবেশ]

সরকার। বাইরের ঘর থেকে খাতাগুলো কি নিয়ে যাব মা?

বিজয়া। (লজ্জিত হইয়া) একটুও দেখতে পারিনি সরকারমশাই। আজকের দিনটা থাক, কাল সকালেই আমি নিশ্চয় পাঠিয়ে দেব।

সরকার। যে আজ্ঞে।

[সরকার চলিয়া যাইতেছিল, বিজয়া ফিরিয়া ডাকিল]

বিজয়া। শুনুন সরকারমশাই! কাছারির ঐ নতুন দরোয়ান কতদিন বহাল হয়েছে?

সরকার। মাস-তিনেক হবে বোধ হয়।

বিজয়া। ওকে আর দরকার নেই। এক মাসের মাইনে বেশী দিয়ে আজই ওকে জবাব দেবেন। (একটু থামিয়া) না না, দোষের জন্য নয়, লোকটাকে আমার ভালো লাগে না—তাই।

রাস। বিনাদোষে কারো অন্ন মারাটা কি ভালো মা?

সরকার। তা হলে তাকে কি—

বিজয়া। আমার আদেশ ত শুনলেন সরকারমশাই | আজই বিদায় দেবেন।

রাস। (নিজেকে সামলাইয়া লইয়া) এবার কষ্ট করে একটু চল। পুরনো দলিলগুলো বেশ করে একবার পড়া চাই-ই।

বিজয়া। কেন?

রাস। বললাম কারণ আছে। তবুও বার বার এক কথা বলবার ত আমার সময় নেই বিজয়া!

বিজয়া। কারণ আছে বলেছেন, কিন্তু কারণ ত একটাও দেখান নি!

রাস। না দেখালে তুমি যাবে না? (একটু থামিয়া) তার মানে আমাকে তুমি বিশ্বাস করো না।

[বিজয়া নিরুত্তর]

রাস। (লাঠিটা মাটিতে ঠুকিয়া) কিসের জন্যে আমাকে তুমি এত বড় অপমান করতে সাহস করো? কিসের জন্যে আমাকে তুমি অবিশ্বাস করো শুনি?

বিজয়া। (শান্তস্বরে) আমাকেও ত আপনি বিশ্বাস করেন না আমারি টাকায় আমারি ওপর গোয়েন্দা নিযুক্ত করলে মনের ভাব কি হয় আপনি বুঝতে পারেন না? এবং তারপরে আমার সম্পত্তির মূল দলিলপত্র হস্তগত করার তাৎপর্য যদি আমি আর কিছু বলে সন্দেহ করি সে কি অস্বাভাবিক? না, সে আপনাকে অপমান করা?

[রাসবিহারী নির্বাক স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। তাঁহার এত বড় পাকা চাল একটা বালিকার কাছে ধরা পড়িবে এ সংশয় তাঁহার পাকা মাথায় স্থান পায় নাই। এবং ইহাই সে অসঙ্কোচে মুখের উপর নালিশ করিবে সে ত স্বপ্নের অগোচর। কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মত স্তব্ধ থাকিয়া এই প্রকৃতির লোকেরা যাহা চরম অস্ত্র তাহাই তূণীর হইতে বাহির করিয়া প্রয়োগ করিলেন]

রাস। বনমালীর মুখ রাখবার জন্যেই এ কাজ করতে হয়েছে। বন্ধুর কর্তব্য বলেই করতে হয়েছে। একটা অজানা-অচেনা হতভাগাকে পথ থেকে শোবার ঘরে ডেকে এনে রাত-দুপুর পর্যন্ত হাসি-তামাশায় কাটালে এর অর্থ কি বুঝতে পারিনে? এতে তোমার লজ্জা হয় না বটে, কিন্তু আমাদের যে ঘরে-বাইরে মুখ পুড়ে গেল। সমাজে কারো সামনে মাথা তোলবার জো রইল না! (রাসবিহারী আড়চোখে চাহিয়া তাঁহার মহামন্ত্রের মহিমা নিরীক্ষণ করিলেন) বলি এগুলো ভালো না, নিবারণ করার চেষ্টা করা আমার কাজ নয়? (বিজয়া নিরুত্তর) (লাঠি ঠুকিয়া) না, চুপ করে থাকলে চলবে না, এ-সব গুরুতর ব্যাপার। তোমাকে জবাব দিতে হবে।

বিজয়া। ব্যাপার যত গুরুতর হোক, মিথ্যে কথার আমি কি উত্তর দিতে পারি!

রাস। মিথ্যে কথা বলে একে উড়োতে চাও নাকি?

বিজয়া। আমি উড়োতে কিছু চাইনে কাকাবাবু। শুধু এ যে মিথ্যে তাই আপনাকে বলতে চাই। এবং মিথ্যে বলে একে আপনি নিজেই সকলের চেয়ে বেশী জানেন তাও এই সঙ্গে আপনাকে জানাতে চাই।

রাস। মিথ্যে বলে আমি নিজেই জানি?

বিজয়া। হাঁ জানেন। কিন্তু আপনি গুরুজন,—এ নিয়ে তর্কবিতর্ক করতে আমার প্রবৃত্তি হয় না। দলিলপত্র দেখা এখন থাক, মামলা-মকদ্দমারা আবশ্যক বুঝলে আপনাকে ডেকে পাঠাব।

[বিজয়া চলিয়া গেল। রাসবিহারী অভিভূতের মত দাঁড়াইয়া রহিলেন]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *