বিজয়া – ৩.২

দ্বিতীয় দৃশ্য

বিজয়ার শয়ন-কক্ষ

[বিজয়া ও নরেন প্রবেশ করিল। একটা টেবিলের উপর বহুবিধ ভোজ্যবস্তু বিজয়া হাত দিয়া দেখাইয়া]

বিজয়া। খেতে বসুন।

নরেন। (বসিতে বসিতে) এইখানে আপনারও কেন খাবার এনে দিক না। সারাদিন ত খাননি?

বিজয়া। খাইনি বলে এইখানে এনে দেবে? আপনি কে যে আপনার সুমুখে এক টেবিলে বসে আমি খাব! বেশ প্রস্তাব!

নরেন। আমার সব কথাতেই দোষ ধরা যেন আপনার স্বভাব। তা ছাড়া এমনি রূঢ়ভাষী যে আপনার কথাগুলো গায়ে ফোটে। এত শক্ত কথা বলেন কেন?

বিজয়া। শক্ত কথা বুঝি আর কেউ আপনাকে বলে না?

নরেন। না, কেউ না। শুধু আপনি। ভেবে পাইনে কেন এত রাগ?

বিজয়া। সেই ভাঙ্গা মাইক্রোস্‌কোপটা আমাকে ঠকিয়ে বিক্রি করা পর্যন্ত আমার রাগ আর যায় না—আপনাকে দেখলেই মনে পড়ে।

নরেন। মিছে কথা, সম্পূর্ণ মিছে কথা। বেশ জানেন আপনি জিতেছেন।

বিজয়া। বেশ জানি জিতিনি, সম্পূর্ণ ঠকেচি। সে হোক গে—কিন্তু আপনি খেতে বসুন ত। সাতটার ট্রেন ত গেলই ন’টার গাড়িটাও কি ফেল করবেন?

নরেন। না না, ফেল করব না, ঠিক ধরব।

[নরেন আহারে মন দিল। কালীপদ উঁকি মারিল]

কালীপদ। মা, আপনার খাবার জায়গা কি—

বিজয়া। না, এখন না।

[কালীপদ সরিয়া গেল

নরেন। আপনার বাড়িতে চাকরদের মুখের এই ‘মা’ সম্বোধনটি আমার ভারী ভালো লাগে।

বিজয়া। তাদের মুখের আর কোন সম্বোধন আছে নাকি?

নরেন। আছে বৈ কি। মেমসাহেব বলা—

বিজয়া। আপনি ভারী নিন্দুক। কেবল পরচর্চা।

নরেন। যা দেখতে পাই তা বলব না?

বিজয়া। না। আপনার কাজ শুধু মুখ বুজে খাওয়া। কিচ্ছুটি যেন পড়ে থাকতে না পায়।

নরেন। তা হলে মারা যাব। এর মধ্যেই আমার পেট ভরে এসেছে।

বিজয়া। না আসেনি। বরঞ্চ এক কাজ করুন, পরের নিন্দে করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে খান। সমস্ত না খেলে কোনমতে ছুটি পাবেন না।

নরেন। আপনি এতেই বলচেন খাওয়া হলো না,—কিন্তু কলকাতায় আমার রোজকার খাওয়া যদি দেখেন ত অবাক হয়ে যাবেন। দেখছেন না এই ক’মাসের মধ্যেই কি রকম রোগা হয়ে গেছি। আমার বাসায় বামুন ব্যাটা হয়েছে যেমন পাজী, তেমনি বদমাইশ জুটেছে চাকরটা। সাত সকালে রেঁধে রেখে কোথায় যায় তার ঠিকানা নেই। আমার কোনদিন ফিরতে হয় দুটো,—কোনদিন বা চারটে বেজে যায়। সেই ঠাণ্ডা কড়কড়ে ভাত—দুধ কোনদিন বা বেড়ালে খেয়ে যায়, কোনদিন বা জানালা দিয়ে কাক ঢুকে সমস্ত ছড়াছড়ি করে রাখে,—সে দেখলেই ঘৃণা হয়। অর্ধেক দিন ত একেবারেই খাওয়া হয় না।

বিজয়া। এমন সব চাকর-বাকরদের দূর করে দিতে পারেন না? নিজের বাসায় এত টাকা খরচ করেও যদি এত কষ্ট, তবে চাকরি করাই বা কেন?

নরেন। এক হিসাবে আপনার কথা সত্যি। একদিন বাক্স থেকে কে দুশো টাকা চুরি করে নিলে, একদিন নিজেই কোথায় একশো টাকা হারিয়ে ফেললুম, অন্যমনস্ক লোকের পদে পদেই বিপদ কিনা। (একটু থামিয়া) তবে নাকি দুঃখকষ্ট আমার অনেকদিন থেকেই সয়ে গেছে, তাই তেমন গায়ে লাগে না। শুধু অত্যন্ত ক্ষিদের ওপর খাওয়ার কষ্টটা এক-একদিন অসহ্য বোধ হয়।

[বিজয়া আনতমুখে নীরবে শুনিতেছিল]

নরেন। বাস্তবিক, চাকরি আমার ভালোও লাগে না, পারিও নে। অভাব আমার খুবই সামান্য—আপনার মত কোনো বড়লোক দুবেলা দুটি-দুটি খেতে দিত, আর নিজের কাজ নিয়ে থাকতে পারতুম ত আর আমি কিছুই চাইতুম না। কিন্তু সেরকম বড়লোক কি আর আছে! (হঠাৎ হাসিয়া) তারা ভারী সেয়ানা, এক পয়সা বাজে খরচ করতে চায় না।

[এই বলিয়া পুনরায় সে হাসিয়া উঠিল। বিজয়া তেমনি নিরুত্তরে বসিয়া রহিল]

নরেন। কিন্তু আপনার বাবা বেঁচে থাকলে হয়ত এ-সময়ে আমার অনেক উপকার হতে পারত—তিনি নিশ্চয় এই উঞ্ছবৃত্তি থেকে আমাকে রক্ষা করতেন।

বিজয়া। কি করে জানলেন? তাঁকে ত আপনি চিনতেন না।

নরেন। না, আমিও তাঁকে কখনো দেখিনি, তিনিও বোধ হয় কখনো দেখেন নি। কিন্তু তবুও আমাকে খুব ভালবাসতেন। কে আমাকে টাকা দিয়ে বিলেত পাঠিয়েছিল জানেন? তিনিই। আচ্ছা আমাদের ঋণের সম্বন্ধে আপনাকে কি কখনো কিছু তিনি বলে যাননি?

বিজয়া। বলাই ত সম্ভব, কিন্তু আপনি ঠিক কি ইঙ্গিত করছেন তা না বুঝলে ত জবাব দিতে পারিনে।

নরেন। (ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া) থাক গে। এখন এ আলোচনা একেবারে নিষ্প্রয়োজন।

বিজয়া। (ব্যগ্র হইয়া) না, বলুন—বলতেই হবে।—আমি শুনবোই।

নরেন। কিন্তু যা চুকেবুকে শেষ হয়ে গেছে তা আর শুনে কি হবে বলুন?

বিজয়া। না সে হবে না, আপনাকে বলতেই হবে।

নরেন। (হাসিয়া) বলা যে শুধু নিরর্থক তাই নয়—বলতে আমার নিজেরও লজ্জা করে। হয়ত আপনার মনে হবে আমি কৌশলে আপনার সেন্টিমেন্টে ঘা দিয়ে—

বিজয়া। (অধীরভাবে) আমি আর খোশামোদ করতে পারিনে আপনাকে—আপনার পায়ে পড়ি বলুন।

নরেন। খাওয়া-দাওয়ার পরে?

বিজয়া। না এখুনি।

নরেন। আচ্ছা, বলচি বলচি। কিন্তু তার পূর্বে একটা কথা জিজ্ঞেসা করি, আমার বাড়িটার ব্যাপারে সত্যিই কি তিনি কোনদিন কোন কথা আপনাকে বলেন নি? (বিজয়া অধিকতর অসহিষ্ণু হইয়া উঠিল।) আচ্ছা, রাগ করে কাজ নেই, আমি বলচি। যখন বিলেত যাই তখন বাবার মুখে শুনেছিলুম, আপনার বাবাই আমাকে পাঠাচ্চেন। আজ দিন-চারেক আগে দয়ালবাবু আমাকে একতাড়া চিঠি দেন। নীচের যে ঘরটায় ভাঙ্গাচোরা কতকগুলো আসবাব পড়ে আছে তারই একটা ভাঙ্গা দেরাজের মধ্যে চিঠিগুলো ছিল—বাবার জিনিস বলে দয়ালবাবু আমার হাতেই দেন। পড়ে দেখলুম খান-দুই চিঠি আপনার বাবার লেখা। শুনেছেন বোধ হয় শেষ বয়সে বাবা দেনার জ্বালায় জুয়া খেলতে শুরু করেন। বোধ করি সেই ইঙ্গিত একটা চিঠির গোড়ায় ছিল। তারপরে নীচের দিকে এক জায়গায় তিনি উপদেশের ছলে সান্ত্বনা দিয়ে বাবাকে লিখেছেন, বাড়িটার জন্যে ভাবনা নেই—নরেন আমারও ত ছেলে, বাড়িটা তাকেই যৌতুক দিলুম।

বিজয়া। (মুখ তুলিয়া) তারপরে?

নরেন। তারপরে সব অন্যান্য কথা। তবে, এ পত্র বহুদিন পূর্বের লেখা। খুব সম্ভব, তাঁর এ অভিপ্রায় পরে বদলে গিয়েছিল বলেই কোন কথা আপনাকে বলে যাওয়া তিনি আবশ্যক মনে করেন নি।

বিজয়া। (কয়েক মুহূর্ত স্থির থাকিয়া) তাহলে বাড়িটা দাবী করবেন বলুন? (হাসিল)

নরেন। (হাসিয়া) করলে আপনাকেই সাক্ষী মানব। আশা করি সত্যি কথাই বলবেন।

বিজয়া। (ঘাড় নাড়িয়া) নিশ্চয়। কিন্তু সাক্ষী মানবেন কেন?

নরেন। নইলে প্রমাণ হবে কিসে? বাড়িটা যে সত্যই আমার সে কথা ত আদালতে প্রতিষ্ঠিত করা চাই।

বিজয়া। অন্য আদালতে দরকার নেই,—বাবার আদেশ আমার আদালত। ও-বাড়ি আপনাকে আমি ফিরিয়ে দেব।

নরেন। (পরিহাসের ভঙ্গীতে) চিঠিটা চোখে না দেখেই বোধ হয় ফিরিয়ে দেবেন!

বিজয়া। না, চিঠি আমি দেখতে চাই। কিন্তু এই এ কথাই যদি থাকে—বাবার হুকুম আমি কোনমতেই অমান্য করব না।

নরেন। তাঁর অভিপ্রায় যে শেষ পর্যন্ত এই ছিল তারই বা প্রমাণ কোথায়?

বিজয়া। ছিল না তারও ত প্রমাণ চাই।

নরেন। কিন্তু আমি যদি না নিই? দাবী না করি?

বিজয়া। সে আপনার ইচ্ছে। কিন্তু সে-ক্ষেত্রে আপনার পিসীর ছেলেরা আছেন। আমার বিশ্বাস অনুরোধ করলে তাঁরা দাবী করতে অসম্মত হবেন না।

নরেন। (সহাস্যে) তাঁদের ওপর এ বিশ্বাস আমারও আছে। এমন কি হলফ নিয়ে বলতেও রাজী আছি। (বিজয়া এ হাসিতে যোগ দিল না। চুপ করিয়া রহিল) অর্থাৎ, আমি নিই-না-নিই আপনি দেবেনই।

বিজয়া। অর্থাৎ, বাবার দান-করা জিনিস আমি আত্মসাৎ করব না এই আমার পণ।

নরেন। (শান্তস্বরে) ও-বাড়ি যখন সৎকাজে দান করেছেন তখন আমি না নিলেও আপনার আত্মসাৎ করায় অধর্ম হবে না। তা ছাড়া ফিরিয়ে নিয়ে কি করব বলুন? আপনার জন কেউ নেই যে তারা বাস করবে। বাইরে কোথাও কাজ না করলে আমার চলবে না, তার চেয়ে যে ব্যবস্থা হয়েছে সেই ত সবচেয়ে ভালো। আরও এক কথা এই যে, বিলাসবাবুকে কিছুতেই রাজী করাতে পারবেন না।

বিজয়া। নিজের জিনিসে অপরকে রাজী করানোর চেষ্টা করার মত অপর্যাপ্ত সময় আমার নেই। কিন্তু আপনি ত আর এক কাজ করতে পারেন। বাড়ি যখন আপনার দরকার নেই, তখন তার উচিত মূল্য আমার কাছে নিন। তা হলে চাকরিও করতে হবে না, এবং নিজের কাজও স্বচ্ছন্দে করতে পারবেন। আপনি সম্মত হোন নরেনবাবু।

[এই মিনতিপূর্ণ কণ্ঠস্বর নরেনকে মুগ্ধ করিল, চঞ্চল করিল]

নরেন। আপনার কথা শুনলে রাজী হতেই ইচ্ছে করে, কিন্তু সে হয় না। কি জানি কেন আমার বহুবার মনে হয়েছে, বাবার ঋণের দায়ে বাড়িটা নিয়ে মনের মধ্যে আপনি সুখী হতে পারেন নি, তাই কোন একটা উপলক্ষ সৃষ্টি করে ফিরিয়ে দিতে চান। এ দয়া আমি চিরদিন মনে রাখব, কিন্তু যা আমার প্রাপ্য নয় গরীব বলেই তা ভিক্ষের মত নেব কি করে?

বিজয়া। এ কথায় আমি কত কষ্ট পাই জানেন?

নরেন। মানুষের কথায় মানুষ কষ্ট পায় এ কি কখনো হতে পারে? কেউ বিশ্বাস করবে?

বিজয়া। দেখুন, আপনি খোঁচা দেবার চেষ্টা করবেন না। আপনি কষ্ট পান এমনধারা কথা আমি কোনদিন বলিনি।

নরেন। কিন্তু এই যে বলছিলেন ঠকিয়ে মাইক্রস্‌কোপ বেচে গেছি! অতি শ্রুতিমধুর বাক্য—না?

বিজয়া। (হাসিয়া ফেলিয়া) কিন্তু সেটা যে সত্যি।

নরেন। হাঁ, সত্যি বৈ কি!

বিজয়া। আপনি গরীব হোন, বড়লোক হোন, আমার কি? আমি কেবল বাবার আদেশ পালন করার জন্যেই বাড়িটা আপনাকে ফিরিয়ে দিতে চাচ্চি।

নরেন। এর মধ্যেও একটু মিথ্যে রয়ে গেল—তা থাক। খুব বড় বড় পণ ত করলেন, কিন্তু বাবার হুকুমমত দিতে হলে কত জিনিস দিতে হয় তা জানেন? শুধু ওই বাড়িটাই নয়।

বিজয়া। বেশ, নিন আপনার সম্পত্তি ফিরে।

নরেন। (হাসিয়া মাথা নাড়িতে নাড়িতে) খুব বড় গলায় দাবী করতে আমাকে বলচেন, আমি না করলে আমার পিসীমার ছেলেদের দাবী করতে বলবেন ভয় দেখাচ্চেন, কিন্তু তাঁর আদেশ মত দাবী আমার পর্যন্ত পৌঁছতে পারে জানেন? শুধু কেবল ওই বাড়িটা আর কয়েক বিঘে জমি নয়—তার ঢের ঢের বেশী।

বিজয়া। বাবা আর কি আপনাকে দিয়েছেন?

নরেন। তাঁর সে চিঠিও আমার কাছে আছে। তাতে যৌতুক শুধু ঐটুকু দিয়েই আমাকে তিনি বিদায় করেন নি। যেখানে যা-কিছু দেখচেন সমস্তই তার মধ্যে। আমি দাবী শুধু ওই বাড়িটা করতে পারি তাই নয়। এ বাড়ি, এই ঘর, ওই সমস্ত টেবিল-চেয়ার-আয়না-দেয়ালগিরি-খাট-পালঙ্ক, বাড়ির দাস-দাসী-আমলা-কর্মচারী, মায় তাদের মনিবটিকে পর্যন্ত দাবী করতে পারি তা জানেন কি? বাবার হুকুম, বাবার হুকুম,—দেবেন এই-সব? (বিজয়া পাথরের মূর্তির মত নীরবে নতমুখে বসিয়া রহিল) কেমন, দিতে পারবেন বলে মনে হয়? বরঞ্চ একবার না হয় বিলাসবাবুর সঙ্গে নিরিবিলি পরামর্শ করবেন। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ— (বিজয়া মুখ তুলিতেই তাহার পাংশু মুখের প্রতি চাহিয়া নরেনের বিকট হাস্য থামিল) (সভয়ে) আপনি পাগল হলেন নাকি? আমি কি সত্যিই এই-সব দাবী করতে যাচ্ছি, না, করলেই পাব? বরঞ্চ, আমাকেই ত ধরে নিয়ে পাগলা-গারদে পুরে দেবে।

বিজয়া। (গম্ভীর মুখে) কৈ, দেখি বাবার চিঠি?

নরেন। কি হবে দেখে?

বিজয়া। না দিন, আমি দেখব।

নরেন। চিঠির তাড়াটা সেদিন থেকে এই কোটের পকেটেই রয়ে গেছে। এই নিন। কিন্তু আত্মসাৎ করবেন না যেন। পড়ে ফেরত দেবেন।

[পকেট হইতে এক বাণ্ডিল চিঠি সে বিজয়ার সম্মুখে ফেলিয়া দিল। বিজয়া দ্রুতহস্তে বাঁধন খুলিয়া একটার পর একটা উলটাইতে উলটাইতে দু’খানা চিঠি বাছিয়া লইয়া]

বিজয়া। এই ত আমার বাবার হাতের লেখা। বাবা! বাবা!

[চিটি দুটা সে মাথায় রাখিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। নরেন অন্য চিঠিগুলি তুলিয়া লইয়া নিঃশব্দে চলিয়া গেল]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *