বিজয়া – ২.৪

চতুর্থ দৃশ্য

বাটীর একাংশের ঢাকা বারান্দা

[নরেন প্রবেশ করিল। পরনে সাহেবী পোশাক, টুপি খুলিয়া সেটা বগলে চাপিয়া হাতের লাঠিটা একধারে ঠেস দিয়া রাখিল]

নরেন। (এদিকে-ওদিকে চাহিয়া) উঃ—কোথাও একফোঁটা হাওয়া নেই। আর এই বিজাতীয় পোশাকে যেন আরও ব্যাকুল করে তুলেছে। এদিকে কি কেউ নেই নাকি? এই যে কালীপদ—

[কালীপদ প্রবেশ করিল]

নরেন। কালীপদ, তোমার মা-ঠাকরুনকে একটা খবর দিতে পার?

কালীপদ। দিতে হবে না, মা নিজেই নেমে আসচেন। ভেতরে গিয়ে বসবেন না বাবু?

নরেন। না বাপু, ঘরে ঢুকে আর দম আটকাতে চাইনে,—এখান থেকেই কাজ সেরে পালাব। বারোটার ট্রেনেই ফিরতে হবে।

কালীপদ। হাঁ বাবু, আজ বড় গরম, কোথাও বাতাস নেই। তবে এখানেই একটা চেয়ার এনে দিই বসুন।

[কালীপদ চেয়ার আনিয়া দিল, নরেন বসিয়া টুপিটা
পায়ের কাছে রাখিয়া মুখ তুলিয়া কহিল]

নরেন। আর সুমুখের ঐ জানালাটা একবার খুলে দাও, নিশ্বেস ফেলে বাঁচি।

কালীপদ। ওটা খোলা যায় না। এখন মিস্ত্রী কোথায় পাব বাবু?

নরেন। মিস্ত্রী কি হে? দোর-জানালা কি তোমরা মিস্ত্রী দিয়ে খোলাও, আর রাত্তিরে পেরেক ঠুকে বন্ধ করো?

কালীপদ। আজ্ঞে না, কেবল এইটেই কিছুতে খোলা যায় না। মা ক’দিন ধরে মিস্ত্রী ডাকতে বলছিলেন।

নরেন। এমন কথাও ত শুনিনি। কৈ দেখি, (নিকটে গিয়া টানিয়া খুলিয়া ফেলিয়া) একটুখানি চেপে বসেছিল। তোমার মা-ঠাকরুনকে একবার ডাক।

কালীপদ। এই যে আসচেন।

[বিজয়া প্রবেশ করিতেই নরেন সঙ্গে সঙ্গে ফিরিয়া চাহিল]

নরেন। নমস্কার। বাঃ—কি চমৎকার দেখাচ্ছে আপনাকে। যে কেউ ছবি আঁকতে জানে—আপনাকে দেখে তারই আজ লোভ হবে।

বিজয়া। কালীপদ, আমাকে বসবার একটা জায়গা এনে দাও। আর বল গে বাবুর জন্যে চা করতে। এখনও চা খাওয়া হয়নি বোধ হয়?

নরেন। না, কলকাতা থেকে সকালেই বেরিয়ে পড়েছিলুম। স্টেশন থেকে সোজা আসচি।

[কালীপদ চলিয়া গেল

বিজয়া। আপনাকে কি আমার ছবি আঁকবার বায়না নিতে ডেকেছি যে আমাকে ও-রকম অপদস্থ করলেন?

নরেন। অপদস্থ করলুম কোথায়?

বিজয়া। চাকরদের সামনে কি ঐরকম বলে? কাণ্ডজ্ঞান কি একেবারে নেই?

নরেন। (লজ্জিতমুখে) হাঁ, তা বটে। দোষ হয়ে গেচে সত্যি।

বিজয়া। আর যেন কখনো না হয়।

[কালীপদ চেয়ার লইয়া প্রবেশ করিল]

কালীপদ। বলে এলুম মা। অমনি কিছু খাবার করতেও বলে আসব?

বিজয়া। হাঁ, বলগে। (জানালার প্রতি চোখ পড়ায়) এই যে তবু একটা কথা শুনেছিস কালীপদ। কাকে দিয়ে জানালাটা খোলালি?

কালীপদ। (ইঙ্গিতে দেখাইয়া) উনি খুলে দিলেন।

[এই বলিয়া সে বাহিরে গিয়া একটা ছোট টিপয় আনিয়া নরেনের পাশে রাখিয়া চলিয়া গেল]

বিজয়া। আপনি? কি করে খুললেন?

নরেন। হাত দিয়ে টেনে।

বিজয়া। শুধু হাতে টেনে খুলেছেন? অথচ ওরা সবাই বলে মিস্ত্রী ছাড়া খুলবে না। আপনার হাতটা কি লোহার নাকি?

নরেন। (সহাস্যে) হাঁ, আমার আঙুলগুলো একটু শক্ত।

বিজয়া। (হাসি চাপিয়া) আপনার মাথাটাই কি কম শক্ত? ঢুঁ মারলে যে-কোন লোকের মাথাটা ফেটে যায়।

নরেন। (উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল, তারপরে পকেট হইতে নোট বাহির করিয়া টেবিলের উপর রাখিয়া দিয়া) এই নিন আপনার দুশো টাকা। দিন, আমার সেই ভাঙ্গা যন্ত্রটা। (একটু হাসিয়া) আমি জোচ্চোর, ঠক, আরও কত কি গালাগালি ওই ক’টা টাকার জন্যে আমাকে বলে পাঠিয়েছিলেন। নিন, আপনার টাকা,—দিন আমার জিনিস।

বিজয়া। ঠক, জোচ্চোর কাকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছিলুম?

নরেন। যাকে দিয়ে টাকা পাঠিয়েছিলেন সেই ত ও-সব বলেছিল।

বিজয়া। তাকে দিয়ে আর কি বলে পাঠিয়েছিলুম মনে আছে?

নরেন। না, আমার মনে নেই। কিন্তু সেটা আনতে বলে দিন, আমি দুপুরের ট্রেনেই কলকাতা ফিরে যাব। ভালো কথা, আমি কলকাতাতেই একটা চাকরি পেয়ে গেছি। বেশী দূরে আর যেতে হয়নি।

বিজয়া। (মুখ উজ্জ্বল করিয়া) আপনার ভাগ্য ভালো। টাকা কি তারাই দিলে?

নরেন। হাঁ, কিন্তু microscope-টা আমার আনতে বলে দিন। আমার বেশী সময় নেই।

বিজয়া। কিন্তু এই শর্ত কি আপনার সঙ্গে হয়েছিল যে, দয়া করে আপনি টাকা এনেছেন বলেই তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দিতে হবে?

নরেন। (সলজ্জে) না, না—তা ঠিক নয়। তবে কিনা ওটা ত আপনার কাজে লাগল না, তাই ভেবেছিলুম টাকা দিলেই আপনি ফিরিয়ে দিতে রাজী হবেন।

বিজয়া। না, আমি রাজী নই, যাচাই করে দেখিয়েচি ওটা অনায়াসে চারশো টাকায় বিক্রি করতে পারি। দুশো টাকায় দেব কেন?

নরেন। (সোজা হইয়া উঠিয়া বসিয়া) বেশ, তবে তাই করুন গে। আমার দরকার নেই। যে দু’শো টাকায় দু’দিন পরেই চারশো টাকা চায় তাকে আমি কিছুই বলতে চাইনে।

[বিজয়া মুখ নিচু করিয়া অতিকষ্টে হাসি দমন করিল]

নরেন। আপনি যে একটি ‘সাইলক’ তা জানলে আসতুম না।

বিজয়া। সাইলক? কিন্তু দেনার দায়ে যখন আপনার বাড়িঘর, আপনার যথাসর্বস্ব আত্মসাৎ করে নিয়েছিলুম, তখন কি ভাবেন নি আমি সাইলক?

নরেন। না ভাবিনি, কেননা তাতে আপনার হাত ছিল না। সে কাজ আপনার বাবা এবং আমার বাবা দু’জনে করে গিয়েছিলেন। আমরা কেউ তার জন্যে অপরাধী নই। আচ্ছা আমি চললুম।

বিজয়া। যাবেন কি রকম? আপনার জন্যে চা করতে গেছে না?

নরেন। চা খেতে আমি আসিনি।

বিজয়া। কিন্তু যেজন্যে এসেছিলেন সে ত আর সত্যিই হতে পারে না। চারশো টাকার জিনিস আপনাকে দুশো টাকায় দেবে কে? আপনার লজ্জাবোধ করা উচিত।

নরেন। আমার লজ্জাবোধ করা উচিত? উঃ—আচ্ছা মানুষ ত আপনি?

বিজয়া। হাঁ, চিনে রাখুন। ভবিষ্যতে আর কখনো ঠকাবার চেষ্টা করবেন না।

নরেন। ঠকানো আমার পেশা নয়।

বিজয়া। তবে কি পেশা? ডাক্তারি? হাত দেখতে জানেন? (এই বলিয়া হঠাৎ হাসিয়া ফেলিল)

নরেন। আমি কি আপনার উপহাসের পাত্র? টাকা আপনার ঢের থাকতে পারে—কিন্তু সে জোরে ও-অধিকার জন্মায় না তা জানবেন। আপনি একটু হিসেব করে কথা কইবেন।

[নরেন উঠিয়া দাঁড়াইয়া হাতে লাঠি তুলিয়া লইল]

বিজয়া। নইলে কি বলুন না? আপনার গায়ে জোর আছে এবং হাতে লাঠি আছে এই ত?

নরেন। (লাঠিটা ফেলিয়া হতাশভাবে বসিয়া) ছিঃ ছিঃ—আপনি মুখে যা আসে তাই বলেন। আপনার সঙ্গে আর পারি না।

বিজয়া। এ কথা মনে থাকে যেন। কিন্তু আপনার জন্যেই যখন আমার দেরি হয়ে গেল, বেরোনো হলো না— তখন আপনারও চলে যাওয়া হবে না। কিন্তু আপনি নিশ্চয় হাত দেখতে জানেন!

নরেন। জানি। কিন্তু কার দেখতে হবে? আপনার?

বিজয়া। (সহসা নিজের হাত বাড়াইয়া দিয়া) দেখুন ত, আমার জ্বর হয়েছে কিনা।

নরেন। (হাত ধরিয়া) সত্যিই ত আপনার জ্বর! ব্যাপার কি?

বিজয়া। কাল রাত্তিরে একটু জ্বর হয়েছিল। কিন্তু ও কিছুই নয়। আমার জন্যে বলিনে, কিন্তু সেই পরেশ ছেলেটাকে ত আপনি জানেন—তিন দিন থেকে তার খুব জ্বর। এখানে ভাল ডাক্তার নেই। কালীপদ!

[কালীপদর প্রবেশ]

পরেশের মাকে বল ত পরেশকে এখানে নিয়ে আসুক।

নরেন। না, আনবার দরকার নেই। কালীপদ, চল ত পরেশ কোথায় শুয়ে আছে আমাকে নিয়ে যাবে।

কালীপদ। চলুন।

[নরেন ও কালীপদ প্রস্থান করিলে নলিনী প্রবেশ করিল]

নলিনী। নমস্কার! আমার নাম নলিনী। দয়ালবাবু আমার মামা হন।

বিজয়া। ও আপনি? বসুন, সেদিন মন্দির-প্রতিষ্ঠার দিন আপনি অসুস্থ ছিলেন, তাই পরিচয় করার জন্যে আপনাকে আর বিরক্ত করিনি। তারপরেই শুনলুম আপনি চলে গেছেন আপনার মামীমা পীড়িত বলে। কিন্তু মনে হচ্ছে কোথায় যেন এর আগে আপনাকে দেখছি,—আচ্ছা আপনি কি বেথুনে পড়তেন?

নলিনী। হাঁ, কিন্তু আমার ত মনে পড়ছে না!

বিজয়া। না পড়লেও দোষ নেই, কেবলি কামাই করতুম, শেষে সব সাবজেক্ট ফেল করে পড়া ছেড়ে দিলুম, আই. এ. দেওয়া আর হলো না—আপনি এবার B. Sc. দিচ্ছেন শুনলুম।

নলিনী। হাঁ, আমার মনে পড়েছে। আপনি মস্ত একটা গাড়ি করে কলেজে আসতেন।

বিজয়া। চোখে পড়বার মত ত আর কিছু নেই, তাই গাড়ি দিয়ে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতুম। ওটা মার্জনা করা উচিত।

নলিনী। ও কথা বলবেন না। দৃষ্টি পড়বার মত আপনারও যদি কিছু না থাকে তবে জগতের অল্প লোকেরই আছে। কিন্তু Dr. Mukherjee গেলেন কোথায়?

বিজয়া। গেছেন রোগী দেখতে, এলেন বলে। কিন্তু তিনি এসেছেন আপনি জানলেন কেমন করে মিস দাস?

[নরেন প্রবেশ করিল]

নলিনী। এই যে Dr. Mukherjee (বিজয়ার প্রতি) আমরা এক গাড়িতেই যে কলকাতা থেকে এলুম। স্টেশনে এসে দেখি Dr. Mukherjee দাঁড়িয়ে—সেদিন রাত্রে মন্দিরে ওঁর সঙ্গে দৈবাৎ আলাপ।কি কয়েকটা তাঁর জিনিস পড়েছিল তাই নিতে এসেছিলেন। আজ আবার হাওড়া স্টেশনেও দৈবাৎ ওঁর দেখা পেয়ে গেলুম। উনিও বললেন, থাকবার জো নেই, এই বারোটার গাড়িতেই ফিরতে হবে। আমারও তাই—ফিরতেই হবে কলকাতায়।

বিজয়া। (সহাস্যে) আপনাদের শুধু দৈবাৎ আলাপ এবং দৈবাৎ এক গাড়িতে আসাই নয়, আবার দৈবাৎ এক গাড়িতেই ফিরতে হবে। এমন দৈবাতের সমাবেশ একসঙ্গে সংসারে দেখা যায় না।

নরেন। এর মানে?

বিজয়া। (নলিনীর প্রতি) এর মানে দেবেন ত ওঁকে গাড়িতে বুঝিয়ে, মিস দাস।

নলিনী। (নরেনকে) আপনার এখানকার কাজ সারা হলো?

বিজয়া। না, সারতে পারেন নি। গৃহস্থ এখানে সজাগ ছিল। কিন্তু তার বদলে একটি রুগী পেয়েছেন—ভরাডুবির মুষ্টিলাভ!

নরেন। (রাগিয়া) আপনার যত ইচ্ছে আমাকে উপহাস করুন, কিন্তু সজাগ গৃহস্থকেও একদিন ঠকতে হয় এও জেনে রাখবেন। আপনাকে চারশো টাকাই এনে দেব, কিন্তু এ অন্যায় একদিন আপনাকে বিঁধবে। কিন্তু আর না—দেরি হয়ে যাচ্ছে, মিস দাস চলুন এবার আমরা যাই।

বিজয়া। পরেশকে কেমন দেখলেন, বললেন না?

নরেন। বিশেষ ভাল না। ওর খুব বেশী জ্বর, পিঠে গলায় বেদনা, এদিকে বসন্ত হচ্ছে, মনে হয় পরেশেরও বসন্ত হতে পারে।

বিজয়া। (সভয়ে) বসন্ত হবে কেন?

নরেন। হবে কেন সে অনেক কথা। কিন্তু ওর লক্ষণ দেখলে ওই মনে হয়। যাই হোক, ওর মাকে একটু সাবধান হতে বলবেন, আমি কাল কিংবা পরশু টাকা নিয়ে আসব, অবশ্য যদি পাই। তখন ওকে দেখে যাব।

বিজয়া। (ব্যাকুল বিবর্ণমুখে) নইলে আসবেন না? আমারও নিশ্চয় বসন্ত হবে নরেনবাবু। কাল রাত্তিরে আমারও খুব জ্বর—আমারও গায়ে ভয়ানক ব্যথা।

নরেন। (হাসিয়া) ব্যথা ভয়ানক নয়। ভয়ানক হয়েছে সে আপনার ভয়। বেশ ত জ্বরই যদি একটু হয়ে থাকে তাতেই বা কি? এদিকে বসন্ত দেখা দিয়েছে বলেই যে গ্রামসুদ্ধ সকলেরই হবে তার মানে নেই।

বিজয়া। হলেই বা আমার কে আছে? আমাকে দেখবে কে?

নরেন। দেখবার লোক অনেক পাবেন সে ভাবনা নেই, কিন্তু কিছু হবে না আপনার।

বিজয়া। না হলেই ভালো, কিন্তু সত্যিই আমি বড় অসুস্থ। তবু সকালে উঠে সব জোর করে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে একটু বাইরে যাচ্ছিলুম।

নরেন। না, আজ কোথাও যাওয়া চলবে না, চুপ করে শুয়ে থাকুন গে। কাল আবার আসব।

বিজয়া। টাকা না পেলেও আসবেন ত?

নরেন। না পেলেও আসবো।

বিজয়া। ভুলে যাবেন না?

নরেন। না। আমি অন্যমনস্ক প্রকৃতির লোক হলেও আপনার অসুখের কথাটা ভুলব না নিশ্চয়।

[কালীপদ প্রবেশ করিল]

কালীপদ। মা, খাবার দেওয়া হয়েছে।

বিজয়া। (নলিনীকে দেখাইয়া) এঁরও দেওয়া হয়েছে?

কালীপদ। হাঁ, মা, দু’জনেরই।

বিজয়া। আমি দেখি গে কি দিলে। আর যদি কখনো সময় না পাই আজ কাছে বসে আপনাদের দু’জনের আমি খাওয়া দেখব।

নলিনী। মিস রায়, এ কি বলছেন? ভয় কিসের?

বিজয়া। কি জানি আজ আমার কেবলি ভয় করচে। মনে হচ্ছে অসুখ আমার খুব বেশী বেড়ে উঠবে। নরেনবাবু, আজকের দিনটা থাকুন না আপনি?

নরেন। বেশ, আমি রাত্রের ট্রেনেই যাব, কিন্তু আমার কথা শুনতে হবে। নড়াচড়া করতে পাবেন না, এখুনি গিয়ে শুয়ে পড়া চাই।

বিজয়া। না সে আমি শুনব না। আপনাদের খাওয়া আজ আমি দেখবই। তারপরে গিয়ে শোবো।

[প্রস্থান। সঙ্গে সঙ্গে কালীপদও চলিয়া গেল

নলিনী। কি ব্যাকুল মিনতি! ডক্টর মুখার্জী, আমি যাব, কিন্তু আপনি আজ থাকুন। যাবেন না।

নরেন। এবেলা আছি। মামার বাড়ি থেকে যাবার আগে সন্ধ্যাবেলায় আর একবার দেখে যাব। জ্বরটা বেশী, ভয় হয় ভোগাবে।

নলিনী। ভোগাবে? তবে তো বড় মুশকিল?

নরেন। তাই ত মনে হচ্চে।

নলিনী। চমৎকার মেয়েটি। আপনার প্রতি ওর কি বিশ্বাস! মনে হয় না যে এ আপনাকে ঘরছাড়া করতে পারে।

নরেন। (হাসিয়া) পেরেছে ত দেখা গেল। বড়লোকের মেয়ে, গরীবের কথা বড় ভাবে না। বাড়ি ত গেলই, শেষ সম্বল microscope-টি যখন দায়ে পড়ে বেচতে হলো তখন সিকি দামে দুশো টাকা মাত্র দিয়ে স্বচ্ছন্দে কিনে নিলেন—সঙ্গে উপরি বকশিশ দিলেন ঠক জোচ্চোর প্রভৃতি বিশেষণ। আজ সেইটেই যখন দুশো টাকা দিয়ে ফিরিয়ে নিতে চাইলুম, অনায়াসে বললেন অত কমে হবে না—যাচাই করিয়ে দেখেছেন দাম চারশো টাকার কম নয়—সুতরাং আরও দুশো চাই। দয়া-মায়া আছে তা মানতেই হবে।

নলিনী। বিশ্বাস হয় না ডক্টর মুখার্জী—কোথাও হয়ত মস্ত ভুল আছে।

নরেন। ভুল আছে? না, কোথাও নেই মিস নলিনী—সমস্ত জলের মত পরিষ্কার।

নলিনী। (মাথা নাড়িয়া) এমন কিন্তু হতেই পারে না ডক্টর মুখার্জী। মেয়েরা এত বড় মিনতি তাকে করতেই পারে না—এমন করে তার পানে যে তারা চাইতেই পারে না।

নরেন। তা হবে। মেয়েদের কথা আপনিই ভাল জানেন, কিন্তু আমি যেটুকু জানতে পেলুম তা ভারী কঠোর, ভারী কঠিন।

[কালীপদ প্রবেশ করিল]

কালীপদ। চলুন। মা ডেকে পাঠালেন, আপনাদের খাবার দেওয়া হয়েছে।

নরেন। চলো যাই।

[সকলের প্রস্থান

[দয়াল ও রাসবিহারীর কথা কহিতে কহিতে প্রবেশ]

রাস। হাঁ, এই মন্দির-প্রতিষ্ঠা নিয়ে, অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করে, বিলাস যে এতটা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল তা কেউ বুঝতে পারেনি। সেদিন তার চেহারা দেখে ভয় পেয়ে বললুম, বিলাস হয়েছে কি? এমন করচ কেন? ও বললে, বাবা, আজ আমি অন্যায় করেছি—দয়ালবাবুকে কঠিন কথা বলেছি। বিজয়াকেও বলেছি।—সেও আমাকে বলেছে—কিন্তু সেজন্যে নয়, দয়ালবাবুকে আমি কি বলতে কি বলে ফেলেছি, হয়ত রাগ করে তিনি আর আমাদের আচার্যের কাজ করবেন না। এই বলে তার দু’চোখ বেয়ে দরদর করে জল পড়তে লাগল। আমি বললুম ভয় নেই বাবা, অপরাধ যদি হয়েই থাকে তবে এই অনুতাপের অশ্রুতেই সমস্ত ধুয়ে গেল। (এই বলিয়া তিনি ক্ষণকাল মুদিতনেত্রে অধোমুখে থাকিয়া) আর তাই ত হলো দয়ালবাবু, আপনার উদারতার কথা বুঝতে পেরে বিলাস আজ আমায় বললে, বাবা, সেদিন তুমি সত্যিই বলেছিলে দয়ালবাবুর সমস্ত চিত্ত ভগবৎপ্রেমে পরিপূর্ণ, হৃদয় করুণায় মমতায় বিশ্বাসে ভরা, সেখানে আমাদের মত ছেলেমানুষের কথা প্রবেশ করতে পারে না।

দয়াল। সেদিনের কথা আমি সত্যিই কিছু মনে রাখিনি আপনি বলবেন বিলাসবাবুকে।

রাস। বাবু নয়। বাবু নয়। আপনার কাছে শুধু সে বিলাস—বিলাসবিহারী। কে যায় ওখানে? কালীপদ?

[কালীপদ প্রবেশ করিল]

রাস। মা বিজয়া এখন কি তাঁর লাইব্রেরি-ঘরে?

কালীপদ। না, তিনি শোবার ঘরে শুয়ে পড়েছেন—তাঁর জ্বর।

রাস। জ্বর? জ্বর বললে কে?

কালীপদ। ডাক্তারবাবু।

রাস। কে ডাক্তারবাবু?

কালীপদ। নরেনবাবু এসেছিলেন, তিনিই হাত দেখে বললেন জ্বর—বললেন চুপ করে শুয়ে থাকতে।

রাস। নরেন? সে কি জন্যে এসেছিল? কখন এসেছিল? কালীপদ, মাকে একবার খবর দাও যে আমি একবার দেখতে যাব।

দয়াল। আমিও যে মাকে একবার দেখতে চাই কালীপদ। জ্বর শুনে যে বড় ভাবনা হলো।

কালীপদ। কিন্তু মা আমাকে বারণ করে দিয়েছেন তিনি নিজে না ডাকলে কেউ যেন না তাঁকে ডাকে। আমি গেলে হয়ত রাগ করবেন।

রাস। রাগ করবে? সে কি কথা? জ্বর যে! সমস্ত ভার, সমস্ত দায়িত্ব যে আমার মাথায়! বিলাসকে কেউ ছুটে গিয়ে খবর দিয়ে আসুক। আজ তারও শরীর ভাল নয়, বাড়িতেই আছে। কিন্তু সে বললে কি হবে—শিগগির এসে একটা ব্যবস্থা করুক। শহরে গাড়ি পাঠিয়ে আমাদের অকিঞ্চনবাবুকে একটা কল্‌ দিক। না হয় কলকাতায়—আমাদের প্রেমাঙ্কুর ডাক্তার—চলুন চলুন দয়ালবাবু, যাই আমরা, সময় যেন না নষ্ট হয়।

দয়াল। ব্যস্ত হবেন না রাসবিহারীবাবু, জগদীশ্বরের কৃপায় ভয় কিছু নেই। নরেন নিজে যখন দেখে গেছে—ভাবনার বিষয় হলে সে নিশ্চয়ই আপনাকে একটা সংবাদ দিতে বলে দিত।

রাস। নরেন দেখে গেছে? কি জানে সেটা?

[বলিতে বলিতে তিনি দ্রুতবেগে প্রস্থান করিলেন।
পিছনে পিছনে গেলেন দয়াল এবং কালীপদ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *