বিজয়া – ১.২

দ্বিতীয় দৃশ্য

গ্রাম্যপথ

[পূর্ণ গাঙ্গুলী ও দুই-তিনজন গ্রামবাসীর প্রবেশ]

১ম ব্রাহ্মণ। হাঁ পূর্ণখুড়ো, শুনচি নাকি পূজো করবার হুকুম পাওয়া গেছে?

পূর্ণ। হাঁ বাবা, জগদম্বা মুখ তুলে চেয়েছেন। জমিদারবাড়ি থেকে হুকুম পাওয়া গেছে, পূজোয় তাঁর আপত্তি নেই।

১ম ব্রাহ্মণ। শুনে পর্যন্ত দুশ্চিন্তার অবধি ছিল না খুড়ো। সবাই ভাবছিল তোমাদের এতকালের পূজোটা বুঝি এবার বন্ধ হয়ে যায়। হুকুম দিলে কে?

পূর্ণ। জমিদারকন্যা স্বয়ং। এ-সব ব্যাপারের তিনি নিজে কিছুই জানতেন না। আমাদের নরেন গিয়ে বলতেই আশ্চর্য হয়ে বললেন, সে কি কথা। আপনার মামাকে জানাবেন তিনি যথারীতি মায়ের পূজো করুন, আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। এ-সমস্তই ওই দু ব্যাটা বজ্জাত বাপ-ব্যাটার কারসাজি! আমার ওপর ওদের জাতক্রোধ।

১ম ব্রাহ্মণ। মেয়েটি ত তা হলে ভাল?

২য় ব্রাহ্মণ। হুঁ ভাল! ম্লেচ্ছ, বিধর্মী, বলি খোঁজ রেখেছ কিছু?

পূর্ণ। হোক ম্লেচ্ছ। বাবা, তবুও রায়বংশের মেয়ে-হরি রায়ের নাতনী! শুনলুম ঐ বিলেস ছোঁড়াটা অনেক চেষ্টা করেছিল বন্ধ করতে, কিন্তু তিনি কোন কথায় কান দেননি। স্পষ্ট বলে দিলেন, হাজার অসুবিধে হলেও আমি পরের ধর্মকর্মে হাত দিতে পারব না। এ কি সহজ কথা!

১ম ব্রাহ্মণ। বল কি খুড়ো? প্রথম যেদিন জুতোমোজা পরে ফেটিং চড়ে ও দেশেতে এলো লোক ত ভয়ে মরে। গুজব রটে গেল এরই সঙ্গে হবে নাকি বিলাসবাবুর বিয়ে, তাই এসেছে দেশে। সবাই ভাবলে, একা রামে রক্ষে নেই সুগ্রীব দোসর-আর কাউকে বাঁচাতে হবে না, দেড়েল ব্যাটা এবার গ্রামসুদ্ধ সবাইকে ধরে ধরে ফাঁসি দেবে। কিন্তু তোমার ব্যাপারটা দেখলে যেন মনে ভরসা হয়। না খুড়ো?

পূর্ণ। হাঁ বাবা, হয়। আমি বলছি তোমরা পরে দেখো, এই মেয়েটির দয়াধর্ম আছে। কাউকে সহজে দুঃখ দেবে না।

২য় ব্রাহ্মণ। বাজে-বাজে-সব বাজে কথা। আরে বিধর্মী যে! শাস্তরে বলেচে ম্লেচ্ছ; তার আবার দয়া! তার আবার ধর্ম!
১ম ব্রাহ্মণ। তা বটে, শাস্তর-বাক্য সহজে মিথ্যে হয় না সত্যি, কিন্তু খুড়োর পূজোটি ত মা-লক্ষ্মী নিজের জোরে চালিয়ে দিলেন! বাপ-ব্যাটায় হাজার চেষ্টা করেও ত বন্ধ করতে পারলে না।

২য় ব্রাহ্মণ। (মাথা নাড়িয়া) কিন্তু তোমরা পরে দেখো ঐ জুতোমোজা-পরা মেলেচ্ছ মেয়ে গাঁ জ্বালিয়ে খাক করে ছাড়বে। আমি চেয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

পূর্ণ। কি জানি বাবা, আমাদের নরেন ত সাহস দিয়ে বললে, ভয় নেই, উনি কাউকে কষ্ট দেবেন না। মহামায়া কপালে যা লিখেছেন তা হবেই। কিন্তু এইটি দেখো বাবা, তোমরা সকলে মিলে যেন আমার কাজটি উদ্ধার করে দিতে পার।

২য় ব্রাহ্মণ। দেবো খুড়ো, দেবো, আমরা সবাই মিলে তোমার কাজে গিয়ে লাগব—কোনদিকে তোমার চাইতে হবে না।

১ম ব্রাহ্মণ। মায়ের পূজোটি ভালয় ভালয় চুকে যাক, কিন্তু বাবা তোমাকেও আমাদের একটু সাহায্য করতে হবে। তোমাকে আর নরেনকে সঙ্গে নিয়ে সময় বুঝে একদিন আমরা দল বেঁধে গিয়ে পড়ব। বলব—মা, গ্রাম্যদেবতা সিদ্ধেশ্বরীর পুকুরটি আপনি খালাস দিন। বুড়ো ব্যাটা ভয় দেখিয়ে জোর করে খাস করে নিলে; কিন্তু বছর অন্তর যে একশ টাকার মাছ বিক্রি হয়, তার ক’টা টাকা সরকারী তবিলে জমা পড়ে একবার খোঁজ করে দেখুন। আমি খবর রাখি বাবা, যে এই ছ-সাত বছর একটা পয়সাও জমা পড়েনি। তখন দেখব বুড়ো তার কি কৈফিয়ত দেয়।

২য় ব্রাহ্মণ। বুড়ো তখন বলবে, ও-কথা মিথ্যে। মাছ বিক্রি হয় না।

১ম ব্রাহ্মণ। তাই বলুক একবার। গরিটীর ঝোড়ো-জেলেকে আমি চিনি, তার পুরুতের সঙ্গে আমার খুব ভাব। তাকে দিয়ে প্রমাণ করিয়ে দেব আমাদের কথা মিথ্যে নয়। ঐ ঝোড়ো-জেলেই বুড়োর হাতে একশ’ টাকা জমা দিয়ে বছর-বছর কলকাতায় মাছ চালান দেয়।

পূর্ণ। আমায় কিন্তু টেনো না বাবা, ঘরের পাশে ঘর, গরীব মানুষ—আমি তা হলে মারা যাব।

১ম ব্রাহ্মণ। কিন্তু তোমার ভাগনে নরেন্দ্র কখনো ভয় পাবে না বলতে পারি। তাকে পাঠাব, সঙ্গে থাকব আমরা। দিঘ্‌ড়ার এত লোকের সে এত কাজ করে, আর আমাদের এই উপকারটি করে দেবে না ভাবো? নিশ্চয় দেবে।

২য় ব্রাহ্মণ। তা হলে অমনি আমার বড় জামাইয়ের বাবলার মাঠের খবরটাও তাকে শুনিয়ে দিও না ভাই—কম নয় সাড়ে-তিন বিঘে জায়গা। জামাই মারা গেল, দেখবার শোনবার কেউ নেই, মেয়েটি আমার কাছে এসে পড়ল, তিন-চার বছরের খাজনা বাকী পড়ে গেল, তারপর কবে যে ক্রোক দিলে, কবে যে নিলেম হলো, তা কেউ জানলে না। তারপর যখন জানা গেল তখন কত গিয়ে ধরাধরি করলুম, কিন্তু এত বড় বজ্জাত—কিছুতেই ছাড়লে না।

পূর্ণ। বাবুর বাড়ির উত্তর দিকের সেই নতুন কলমের বাগানটা নয়?

২য় ব্রাহ্মণ। হাঁ বাবা সেইটে। এখন হয়েছে বুড়োর শখের আমবাগান।

পূর্ণ। কিন্তু নীলেম-খরিদ জায়গা, এ ত আর কেউ ছেড়ে দিতে পারবে না বাবা।

২য় ব্রাহ্মণ। না পারুক সে আশা আমি করিনে, কিন্তু বুড়ো ব্যাটা দুদিন বাদে শ্বশুর হবে কিনা—তাই বলি সময় থাকতে শ্বশুরের গুণাগুণ মা-লক্ষ্মী একটু শুনে রাখুন।

১ম ব্রাহ্মণ। জগদীশ মুখুয্যের বাড়িটাও নাকি বুড়ো দখল করে নিতে চায়।

পূর্ণ। কানাঘুষা তাই ত শুনছি বাবা।

২য় ব্রাহ্মণ। এমন কেউ থাকে বুড়ো বজ্জাতের দাড়িটা চড়চড় করে একটানে ছিঁড়ে নিতে পারে তবে গায়ের জ্বালা মেটে।

পূর্ণ। থাক থাক বাবা। পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ও-সব কথায় কাজ নেই। কে কোথায় শুনতে পাবে,, কে কোথায় বলে দেবে। তা হলে আর রক্ষে থাকবে না।

২য় ব্রাহ্মণ। না খুড়ো, শুনবে আর কে? এই ত আমরা তিনজন। থাক গে ও-সব কথা, বেলা হলো। চল ঘরে যাওয়া যাক।

পূর্ণ। তাই চল বাবা। সুধীর, সন্ধ্যার পর আমার ওখানে একবার এসো। আর সময় নেই—তোমাদের সঙ্গে একটা পরামর্শ করতে হবে।

১ম ব্রাহ্মণ। সন্ধ্যার পরেই যাব খুড়ো। চল, এখন বাড়ি যাওয়া যাক।

[সকলের প্রস্থান

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *