বিজয়া – ১.১

বিজয়া

নাট্যোল্লিখিত ব্যক্তিগণ

পুরুষ

রাসবিহারী : মৃত বনমালীর বন্ধু ও বিজয়ার অভিভাবক
বিলাসবিহারী : রাসবিহারীর পুত্র
নরেন : বনমালী ও রাসবিহারীর বন্ধু মৃত জগদীশের পুত্র
দয়াল : বিজয়ার মন্দিরের আচার্য
পূর্ণ গাঙ্গুলী : নরেনের মাতুল
কালীপদ : বিজয়ার ভৃত্য
পরেশ : ঐ বালক-ভৃত্য
কানাই সিং: ঐ দরোয়ান

গ্রামবাসিগণ, নিমন্ত্রিত ভদ্রলোকগণ, কর্মচারিগণ ইত্যাদি।

স্ত্রী

বিজয়া : বনমালীর কন্যা
নলিনী : দয়ালের ভাগিনেয়ী
পরেশের মা : বিজয়ার দাসী

দয়ালের স্ত্রী, নিমন্ত্রিতা মহিলাগণ, গ্রামবাসিনীগণ ইত্যাদি।

প্রথম অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

বিজয়ার বসিবার ঘর

বিজয়া। জগদীশ মুখুয্যে কি সত্যিই ছাদ থেকে পড়ে মারা গিয়েছিলেন?

বিলাস। তাতে সন্দেহ আছে নাকি? মদমত্ত অবস্থায় উড়তে গিয়েছিলেন।

বিজয়া। কি দুঃখের ব্যাপার!

বিলাস। দুঃখের কেন? অপঘাত-মৃত্যু ওর হবে না ত হবে কার? জগদীশবাবু শুধু আপনার স্বর্গীয় পিতা বনমালীবাবুরই সহপাঠী বন্ধু নয়, আমার বাবারও ছেলেবেলার বন্ধু। কিন্তু বাবা তার মুখও দেখতেন না। টাকা ধার করতে দু’বার এসেছিল—বাবা চাকর দিয়ে বার করে দিয়েছিলেন। বাবা সর্বদাই বলেন, এই-সব অসচ্চরিত্র লোকগুলোকে প্রশ্রয় দিলে মঙ্গলময় ভগবানের কাছে অপরাধ করা হয়।

বিজয়া। এ কথা সত্যি।

বিলাস। বন্ধুই হন আর যেই হন। দুর্বলতাবশতঃ কোনমতেই সমাজের চরম আদর্শকে ক্ষুণ্ণ করা উচিত নয়। জগদীশের সমস্ত সম্পত্তি এখন ন্যায়তঃ আমাদের। তা ছেলে পিতৃঋণ শোধ করতে পারে, ভাল, না পারে আমাদের এই দণ্ডেই সমস্ত হাতে নেওয়া উচিত। বস্তুতঃ ছেড়ে দেবার আমাদের অধিকার নেই। কারণ, এই টাকায় আমরা অনেক সৎকার্য করতে পারি, সমাজের কোন ছেলেকে বিলেত পর্যন্ত পাঠাতে পারি—ধর্মপ্রচারে ব্যয় করতে পারি—কত কি করতে পারি—কেন তা না করব বলুন? আপনার সম্মতি পেলেই বাবা সব ঠিক করে ফেলবেন।

[বিজয়া একটু ইতস্ততঃ করিতে লাগিল]

বিলাস। না, না, আপনাকে ইতস্ততঃ করতে আমি কিছুতেই দেব না। দ্বিধা দুর্বলতা পাপ, শুধু পাপ কেন মহাপাপ। আমি মনে মনে সঙ্কল্প করেছি, আপনার নাম করে—যা কোথাও নেই, কোথাও হয়নি—আমি তাই করব। এই পাড়াগাঁয়ের মধ্যে ব্রহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করে, দেশের হতভাগ্য মূর্খ লোকগুলোকে ধর্মশিক্ষা দেব। আপনি একবার ভেবে দেখুন দেখি, এদের অজ্ঞতার জ্বালায় বিপন্ন হয়ে আপনার পিতৃদেব দেশ ছেড়েছিলেন কি না? তাঁর কন্যা হয়ে আপনার কি উচিত নয়, এই নোব্‌ল প্রতিশোধ নিয়ে তাদের এই চরম উপকার করা? বলুন, আপনিই এ কথার উত্তর দিন। (বিজয়া নিরুত্তর) সমস্ত দেশের মধ্যে একটা কত বড় নাম, কত বড় সাড়া পড়ে যাবে ভাবুন দেখি? সর্বসাধারণকে স্বীকার করতেই হবে—সে ভার আমার—সে আমাদের সমাজে মানুষ আছে, হৃদয় আছে, স্বার্থত্যাগ আছে। যাকে তারা নির্যাতন করে দেশছাড়া করেছিল, সেই মহাত্মার মহীয়সী কন্যা, শুধু তাদের জন্যই এই বিপুল স্বার্থত্যাগ করেছেন। সমস্ত ভারতময় কি moral effect হবে ভাবুন দেখি?

বিজয়া। তা বটে, কিন্তু মনে হয় বাবার ঠিক এই ইচ্ছা ছিল না। জগদীশবাবুকে তিনি চিরদিন মনে মনে ভালবাসতেন।

বিলাস। এমন হতেই পারে না। সেই দুষ্ক্রিয়াসক্ত মাতালটাকে তিনি ভালবাসতেন এ বিশ্বাস আমি করতে পারি না।

বিজয়া। বাবার সঙ্গে এ নিয়ে আমিও তর্ক করেছি। তাঁর কাছেই শুনেছি, তিনি, আপনার বাবা ও জগদীশবাবু এই তিনজনে—শুধু সতীর্থ নয়, পরস্পরের পরম বন্ধু ছিলেন। জগদীশবাবুই ছিলেন সবার চেয়ে মেধাবী ছাত্র, কিন্তু যেমন দুর্বল, তেমনি দরিদ্র। বড় হয়ে বাবা ও আপনার বাবা ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলেন, কিন্তু জগদীশবাবু পারলেন না। গ্রামের মধ্যে নির্যাতন শুরু হল। আপনার বাবা অত্যাচার সয়ে গ্রামেই রইলেন, কিন্তু বাবা পারলেন না, সমস্ত বিষয়-সম্পত্তির ভার আপনার বাবার উপর দিয়ে, মাকে নিয়ে কলকাতায় চলে এলেন, আর জগদীশবাবু স্ত্রী নিয়ে ওকালতি করতে পশ্চিমে চলে গেলেন।

বিলাস। এ-সব আমিও জানি।

বিজয়া। জানবার কথাই ত। পশ্চিমে তিনি বড় উকিল হয়েছিলেন। কোন দোষই ছিল না, শুধু স্ত্রী মারা যাবার পর থেকেই তাঁর দুর্গতি শুরু হ’ল।

বিলাস। অমার্জনীয় অপরাধ।

বিজয়া। তা বটে, কিন্তু এর অনেক পরে আমার নিজের মা মারা গেলে বাবা একদিন কথায় কথায় হঠাৎ বলেছিলেন, কেন যে জগদীশ মদ ধরেছিল সে যেন বুঝতে পারি বিজয়া।

বিলাস। বলেন কি? তাঁর মুখে মদ খাবার justification?

বিজয়া। আপনি কি যে বলেন বিলাসবাবু! justification নয়—বাল্যবন্ধুর ব্যথার পরিমাণটাই বাবা ইঙ্গিত করেছিলেন। সম্ভ্রম গেল, স্বাস্থ্য গেল, উপার্জন গেল, সমস্ত নষ্ট করে তিনি দেশে ফিরে এলেন।

বিলাস। বড় কীর্তিই করেছিলেন!

বিজয়া। সব গেল, শুধু গেল না বোধ হয় আমার বাবার বন্ধু-স্নেহ। তাই যখনই জগদীশবাবু টাকা চেয়েছেন তিনি না বলতে পারেন নি।

বিলাস। তা হলে ঋণ না দিয়ে দান করলেই ত পারতেন।

বিজয়া। তা জানিনে বিলাসবাবু। হয়ত দান করে বন্ধুর শেষ আত্মসম্মানবোধটুকু বাবা নিঃশেষ করতে চাননি।

বিলাস। দেখুন, এ-সব আপনার কবিরে কথা, নইলে ঋণ ছেড়ে দেবার উপদেশ তিনি আপনাকেও দিয়ে যেতে পারতেন। কিসের জন্য তা করেন নি?

বিজয়া। তা জানিনে। কোন আদেশ দিয়েই তিনি আমাকে আবদ্ধ করে যাননি। বরঞ্চ, কথা উঠলে বাবা এই কথা বলতেন, মা, তোমার ধর্মবুদ্ধি দিয়েই তোমার কর্তব্য নিরূপণ করো। আমার ইচ্ছের শাসনে তোমাকে আমি বেঁধে রেখে যাব না। কিন্তু পিতৃঋণের দায়ে পুত্রকে গৃহহীন করার সঙ্কল্প বোধ হয় তাঁর ছিল না। তাঁর ছেলের নাম শুনেছি নরেন্দ্র! তিনি কোথায় আছেন জানেন?

বিলাস। জানি। মাতাল বাপের শ্রাদ্ধ শেষ করে সে নাকি বাড়িতেই আছে। পিতৃঋণ যে শোধ করে না সে কুপুত্র। তাকে দয়া করা অপরাধ।

বিজয়া। আপনার সঙ্গে বোধ হয় তাঁর আলাপ আছে?

বিলাস। আলাপ! ছিঃ—আপনি আমায় কি মনে করেন বলুন ত? আমি ত ভাবতেই পারিনে যে, জগদীশ মুখুয্যের ছেলের সঙ্গে আমি আলাপ করেছি| তবে সেদিন রাস্তায় হঠাৎ পাগলের মত একটা নতুন লোক দেখে আশ্চর্য হয়েছিলুম—শুনলাম সেই-ই নাকি নরেন মুখুয্যে।

বিজয়া। পাগলের মত? কিন্তু শুনেছি নাকি ডাক্তার?

বিলাস। ডাক্তার! আমি বিশ্বাস করিনে। যেমন আকৃতি তেমনি প্রকৃতি; একটা অপদার্থ লোফার!

বিজয়া। আচ্ছা বিলাসবাবু, জগদীশবাবুর বাড়িটা যদি সত্যিই আমরা দখল করে নিই, গ্রামের মধ্যে কি একটা বিশ্রী গোলমাল উঠবে না?

বিলাস। একেবারে না। আপনি পাঁচ-সাতখানা গ্রামের মধ্যে একজনও পাবেন না এই মাতালটার ওপর যার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি ছিল। আহা বলে এমন লোক এ অঞ্চলে নেই। তাও যদি না হত আমি বেঁচে থাকা পর্যন্ত সে চিন্তা আপনার মনে আনা উচিত নয়।

[ভৃত্য আসিয়া চা দিয়া গেল। ক্ষণেক পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল]

কালীপদ (ভৃত্য)। একজন ভদ্রলোক দেখা করতে চান।

বিজয়া। এইখানে নিয়ে এস।

[ভৃত্যের প্রস্থান]

বিজয়া। আর পারিনে। লোকের আসা-যাওয়ার আর বিরাম নেই। এর চেয়ে বরং কলকাতায় ছিলুম ভাল।

[নরেনের প্রবেশ]

নরেন। আমার মামা পূর্ণ গাঙ্গুলীমশাই আপনার প্রতিবেশী—ওই পাশের বাড়িটা তাঁর। আমি শুনে অবাক হয়ে গেছি যে, তাঁর পিতৃপিতামহ-কালের দুর্গাপূজা নাকি আপনি এবার বন্ধ করে দিতে চান? একি সত্যি? (এই বলিয়া একটা চেয়ার টানিয়া উপবেশন করিল)

বিলাস। আপনি তাই মামার হয়ে ঝগড়া করতে এসেছেন নাকি? কিন্তু কার সঙ্গে কথা কচ্ছেন ভুলে যাবেন না।

নরেন। না সে আমি ভুলিনি, আর ঝগড়া করতেও আমি আসিনি। বরঞ্চ, কথাটা বিশ্বাস হয়নি বলেই জেনে যেতে এসেছি।

বিলাস। বিশ্বাস না হবার কারণ?

নরেন। কেমন করে হবে? নিরর্থক নিজের প্রতিবেশীর ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করবেন, এ বিশ্বাস না হওয়াই ত স্বাভাবিক।

বিলাস। আপনার কাছে নিরর্থক বোধ হলেই যে কারো কাছে তার অর্থ থাকবে না, কিংবা আপনি ধর্ম বললেই যে অপরে তা শিরোধার্য করে নেবে এর কোনো হেতু নেই। পুতুলপূজো আমাদের কাছে ধর্ম নয় এবং তার নিষেধ করাটাও আমরা অন্যায় মনে করিনে।

নরেন। (বিজয়ার প্রতি) আপনিও কি তাই বলেন?

বিজয়া। আমি? আমার কাছে কি আপনি এর বিরুদ্ধে-মন্তব্য শোনবার আশা করে এসেছেন?

বিলাস। কিন্তু উনি ত বিদেশী লোক। খুব সম্ভব আমাদের কিছুই জানেন না।

নরেন। (বিজয়ার প্রতি) আমি বিদেশী না হলেও গ্রামের লোক নয়, সে কথা ঠিক। তবুও আমি সত্যিই আপনার কাছে এ আশা করিনি। পুতুলপূজো কথাটা আপনার মুখ থেকে বার না হলেও সাকার-নিরাকারের পুরোনো ঝগড়া আমি এখানে তুলব না। আপনারা যে অন্য সমাজের তাও আমি জানি, কিন্তু এ ত সে কথা নয়। গ্রামের মধ্যে মাত্র এই একটি পূজো। সমস্ত লোক সারা বৎসর এই তিনটি দিনের আশায় পথ চেয়ে আছে। আপনার প্রজারা আপনার ছেলেমেয়ের মত। আপনার আসার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের আনন্দ-উৎসব শতগুণে বেড়ে যাবে এই আশাই ত সকলে করে। কিন্তু তা না হয়ে এত বড় দুঃখ, এত বড় নিরানন্দ আপনার দুঃখী প্রজাদের মাথায় নিজে তুলে দেবেন এ বিশ্বাস করা কি সহজ? আমি ত কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনি।

বিলাস। আপনি অনেক কথাই বলছেন। সাকার-নিরাকারের তর্ক আপনার সঙ্গে করব এত অপর্যাপ্ত সময় আমাদের নেই। তা সে চুলোয় যাক। আপনার মামা একটা কেন, একশোটা পুতুল গড়িয়ে ঘরে বসে পূজো করতে পারেন তাতে কোন আপত্তি নেই, শুধু কতকগুলো ঢাক, ঢোল, কাঁসি অহোরাত্র ওঁর কানের কাছে পিটে ওঁকে অসুস্থ করে তোলাতেই আমাদের আপত্তি।

নরেন। অহোরাত্র ত বাজে না। তা সকল উৎসবেই একটু হৈচৈ গণ্ডগোল হয়। অসুবিধে কিছু না হয় হলই। আপনারা মায়ের জাত, এদের আনন্দের অত্যাচার আপনি সইবেন না ত কে সইবে?

বিলাস। আপনি ত কাজ আদায়ের ফন্দিতে মা ও ছেলের উপমা দিলেন, শুনতেও মন্দ লাগল না। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, আপনার মামার কানের কাছে মহরমের বাজনা শুরু করে দিলে, তাঁর সেটা ভাল বোধ হত কি? তা সে যাই হোক, বকাবকি করবার সময় নেই আমাদের। বাবা যে হুকুম দিয়েছেন তাই হবে।

নরেন। আপনার বাবা কে, আর তাঁর নিষেধ করবার কি অধিকার তা আমার জানা নেই। কিন্তু আপনি মহরমের যে অদ্ভুত উপমা দিলেন, কিন্তু এটা রোশনচৌকি না হয়ে কাড়া-নাকড়ার বাদ্য হলে কি করতেন শুনি, এ ত শুধু নিরীহ স্বজাতির প্রতি অত্যাচার বৈ ত নয়!

বিলাস। বাবার সম্বন্ধে তুমি সাবধান হয়ে কথা কও বলে দিচ্ছি, নইলে এখুনি অন্য উপায়ে শিখিয়ে দেব তিনি কে এবং তাঁর নিষেধ করার কি অধিকার।

নরেন। (বিলাসকে উপেক্ষা করিয়া বিজয়ার প্রতি) আমার মামা বড়লোক নন। তাঁর পূজোর আয়োজন সামান্যই। তবুও এইটেই একমাত্র আপনার দরিদ্র প্রজাদের সমস্ত বছরের আনন্দোৎসব। হয়ত আপনার কিছু অসুবিধে হবে, কিন্তু তাদের মুখ চেয়ে কি আপনি এইটুকু সহ্য করতে পারবেন না?

বিলাস। (টেবিলের উপর প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাত করিয়া) না পারবেন না, একশোবার পারবেন না। কতকগুলো মূর্খ লোকের পাগলামি সহ্য করবার জন্য কেউ জমিদারি করে না। তোমার আর কিছু বলবার না থাকে তুমি যাও, মিথ্যে আমাদের সময় নষ্ট করো না।

বিজয়া। (বিলাসের প্রতি) আপনার বাবা আমাকে মেয়ের মত ভালবাসেন বলেই এঁদের পূজো নিষেধ করেছেন, কিন্তু আমি বলি হলোই বা তিন-চারদিন একটু গোলমাল।

বিলাস। ওঃ—সে অসহ্য গোলমাল। আপনি জানেন না বলেই—

বিজয়া। জানি বৈ কি। তা হোক গে গোলমাল—তিনদিন বৈ ত নয়। আর আপনি আমার অসুবিধের কথা ভাবছেন, কিন্তু কলকাতা হলে কি করতেন বলুন ত? সেখানে অষ্টপ্রহর কেউ কানের কাছে তোপ দাগতে থাকলেও ত চুপ করে সইতে হতো? (নরেনের প্রতি) আপনার মামাকে জানাবেন, তিনি প্রতি বৎসর যেমন করেন, এবারেও তেমনি করুন, আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। আপনি তবে এখন আসুন, নমস্কার।

নরেন। ধন্যবাদ—নমস্কার।

[উভয়কে নমস্কার করিয়া প্রস্থান

বিজয়া। আমাদের কথাটাই ত শেষ হতে পেলে না। তা হলে তালুকটা নেওয়াই কি আপনার বাবার মত?

বিলাস। হুঁ।

বিজয়া। কিন্তু এর মধ্যে কোনরকম গোলমাল নেই ত?

বিলাস। না।

বিজয়া। আজ কি তিনি ওবেলা এদিকে আসবেন?

বিলাস। বলতে পারি না।

বিজয়া। আপনি রাগ করলেন নাকি?

বিলাস। রাগ না করলেও পিতার অপমানে পুত্রের ক্ষুণ্ণ হওয়া বোধ করি অসঙ্গত নয়।

বিজয়া। কিন্তু এতে তাঁর অপমান হয়েছে এ ভুল ধারণা আপনার কোত্থেকে জন্মালো? তিনি স্নেহবশে মনে করেছেন আমার কষ্ট হবে। কিন্তু কষ্ট হবে না এইটাই শুধু ভদ্রলোককে জানিয়ে দিলুম। এতে মান-অপমানের ত কিছুই নেই বিলাসবাবু!

বিলাস। ওটা কথাই নয়! বেশ, আপনার স্টেটের দায়িত্ব নিজে নিতে চান নিন। কিন্তু এর পরে বাবাকে আমার সাবধান করে দিতেই হবে। নইলে পুত্রের কর্তব্যে আমার ত্রুটি হবে।

বিজয়া। এই সামান্য বিষয়টাকে যে আপনি এমন করে নিয়ে এ রকম গুরুতর করে তুলবেন এ আমি মনেও করিনি। ভাল, আমার বোঝবার ভুলে যদি অন্যায়ই হয়ে গিয়ে থাকে আমি অপরাধ স্বীকার করছি। ভবিষ্যতে আর হবে না।

বিলাস। তা হলে পূর্ণ গাঙ্গুলীকে জানিয়ে পাঠান যে, রাসবিহারীবাবু যে হুকুম দিয়েছেন তা অন্যথা করা আপনার সাধ্য নয়।

বিজয়া। সেটা কি ঢের বেশী অন্যায় হবে না? আচ্ছা আমি নিজেই চিঠি লিখে আপনার বাবার অনুমতি নিচ্ছি।

বিলাস। এখন অনুমতি নেওয়া না-নেওয়া দুই-ই সমান। আপনি যদি বাবাকে সমস্ত দেশের কাছে উপহাসের পাত্র করে তুলতে চান, আমাকেও তা হলে অত্যন্ত অপ্রিয় কর্তব্য পালন করতে হবে।

বিজয়া। (আত্মসংযম করিয়া) এই অপ্রিয় কর্তব্যটা কি শুনি?

বিলাস। আপনার জমিদারি শাসনের মধ্যে তিনি যেন আর হাত না দেন।

বিজয়া। আপনার নিষেধ তিনি শুনবেন মনে করেন?

বিলাস। অন্ততঃ, সেই চেষ্টাই আমাকে করতে হবে।

বিজয়া। (ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া) বেশ! আপনি যা পারেন করবেন, কিন্তু অপরের ধর্মেকর্মে আমি বাধা দিতে পারব না।

বিলাস। আপনার বাবা কিন্তু এ কথা বলতে সাহস পেতেন না।

বিজয়া। (ঈষৎ রুক্ষস্বরে) বাবার কথা আপনার চেয়ে আমি ঢের বেশী জানি বিলাসবাবু। কিন্তু সে নিয়ে তর্ক করে ফল নেই—আমার স্নানের বেলা হলো, আমি উঠলুম। (গমনোদ্যত)

বিলাস। মেয়েমানুষ জাতটা এমনই নেমকহারাম।

[বিজয়া পা বাড়াইয়াছিল। বিদ্যুৎবেগে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া পলকমাত্র বিলাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া নিঃশব্দে ঘর হইতে চলিয়া গেল। এমনি সময় বৃদ্ধ রাসবিহারী ধীরে ধীরে প্রবেশ করিতেই পুত্র বিলাসবিহারী লাফাইয়া উঠিল]

বিলাস। বাবা, শুনেছ এইমাত্র কি ব্যাপার ঘটলো? পূর্ণ গাঙ্গুলী এবারও ঢাক ঢোল কাঁসি বাজিয়ে দুর্গাপূজা করবে, বারণ করা চলবে না। এইমাত্র তার কে একজন ভাগনে এসেছিল প্রতিবাদ করতে, বিজয়া তাকে হুকুম দিলেন পূজো হোক।

রাসবিহারী। তা তুমি এত অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলে কেন?

বিলাস। হব না? তোমার হুকুমের বিরুদ্ধে হুকুম দেবে বিজয়া? এবং আমার আপত্তি করা সত্ত্বেও?

রাস। কিন্তু এই নিয়ে তার সঙ্গে রাগারাগি করলে নাকি?

বিলাস। কিন্তু উপায় কি? আত্মসম্মান বজায় রাখতে—

রাস। দেখ বাপু, তোমার এই আত্মসম্মানবোধটা দিনকতক খাটো কর, নইলে আমি ত আর পেরে উঠিনে। বিয়েটা হয়ে যাক, বিষয়টা হাতে আসুক, তখন ইচ্ছে মত আত্মসম্মান বাড়িয়ে দিও, আমি নিষেধ করব না।

[বিজয়ার প্রবেশ]

রাসবিহারী। এই যে মা বিজয়া!

বিজয়া। আপনাকে আসতে দেখে আমি ফিরে এলুম কাকাবাবু। শুনে হয়ত আপনি রাগ করবেন, কিন্তু মোটে তিনদিন বৈ ত নয়, হোক গে গোলমাল—আমি অনায়াসে সইতে পারব, কিন্তু গাঙ্গুলীমশায়ের দুর্গাপূজায় বাধা দিয়ে কাজ নেই। আমি অনুমতি দিয়েছি।

রাস। সে কথাই বিলাস আমাকে বোঝাচ্ছিলেন! বুড়োমানুষ, শুনে হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠেছিলুম যে ভবিষ্যতে এ রকম পুনর্বার ঘটলে ত চলবে না। তখন আত্মসম্মান বজায় রাখতে তোমার বিষয় থেকে নিজেকে তফাত করতেই হবে। কিন্তু বিলাসের কথায় রাগ গেছে মা; বুঝেচি, অজ্ঞান ওরা—করুক পূজো। বরং পরের জন্য দুঃখ সওয়াটাই মহত্ত্ব! আশ্চর্য প্রকৃতি এই বিলাসের। ওর বাক্য ও কর্মের দৃঢ়তা দেখলে হঠাৎ বোঝা যায় না যে হৃদয় ওর এত কোমল। তা সে যাক, কিন্তু জগদীশের দরুন বাড়িটা যখন তুমি সমাজকেই দান করলে মা, তখন আর বিলম্ব না করে, এই ছুটির মধ্যেই এর সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ করে ফেলতে হবে। কি বল?

বিজয়া। আপনি যা ভাল বুঝবেন তাই হবে। টাকা পরিশোধের মেয়াদ ত তাদের শেষ হয়ে গেছে?

রাস। অনেকদিন। শর্ত ছিল, আট বৎসরের, কিন্তু এটা নয় বৎসর চলছে।

বিজয়া। শুনতে পাই তাঁর ছেলে নাকি এখানে আছেন। তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে আরও কিছুদিনের সময় দিলে হয় না? যদি কোন উপায় করতে পারেন?

রাস। (মাথা নাড়িতে নাড়িতে) পারবে না—পারবে না—পারলে—

বিলাস। পারলেই বা আমরা দেব কেন? টাকা নেবার সময় সে মাতালটার হুঁশ ছিল না কি শর্ত করেছি? এ শোধ দেব কি করে?

বিজয়া। (বিলাসের প্রতি মাত্র একবার দৃষ্টিপাত করিল। রাসবিহারীর মুখের দিকে চাহিয়া শান্ত-দৃঢ়কণ্ঠে কহিল) তিনি বাবার বন্ধু ছিলেন, তাঁর সম্বন্ধে সসম্মানে কথা কইতে বাবা আমাকে আদেশ করে গেছেন।

বিলাস। (সগর্জনে) হাজার আদেশ করলেও সে যে একটা—

রাস। আহা চুপ কর না বিলাস। পাপের প্রতি তোমার আন্তরিক ঘৃণা যেন না পাপীর ওপর গিয়ে পড়ে। এইখানেই যে আত্মসংযমের সবচেয়ে প্রয়োজন বাবা।

বিলাস। না বাবা, এই-সব বাজে sentiment আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারিনে তা সে কেউ রাগই করুক আর যাই করুক। আমি সত্য কথা কইতে ভয় পাইনে, সত্য কাজ করতে পেছিয়ে দাঁড়াই নে।

রাস। তা বটে, তা বটে। তোমাকেই বা দোষ দেব কি। আমাদের বংশের এই স্বভাবটা যে বুড়ো বয়স পর্যন্ত আমারই গেল না! অন্যায় অধর্ম দেখলেই যেন জ্বলে উঠি। বুঝলে না মা বিজয়া, আমি আর তোমার বাবা এই জন্যই সমস্ত দেশের বিরুদ্ধে সত্যধর্ম গ্রহণ করতে ভয় পাইনি। জগদীশ্বর তুমিই সত্য। (এই বলিয়া দুই হাত কপালে ঠেকাইয়া উদ্দেশে নমস্কার করিলেন)

রাস। কিন্তু দেখো মা, আমি যাই হই তবু তৃতীয় ব্যক্তি। তোমাদের উভয়ের মতভেদের মধ্যে আমার কথা কওয়া উচিত নয়। কারণ, কিসে তোমাদের ভাল সে আজ নয় কাল তোমরাই স্থির করে নিতে পারবে। এ বুড়োর মতামতের আবশ্যক হবে না। কিন্তু কথা যদি বলতেই হয় ত বলতেই হবে যে, এক্ষেত্রে তোমারই ভুল হচ্চে। জমিদারি চালাবার কাজে আমাকেও বিলাসের কাছে হার মানতে হয়, এ আমি বহুবার দেখেছি। আচ্ছা তুমিই বল দেখি কার গরজ বেশি? আমাদের না জগদীশের ছেলের? ঋণ পরিশোধের সাধ্যই যদি থাকত, একবার নিজে এসে কি চেষ্টা করে দেখত না? সে ত জানে তুমি এসেছ? এখন আমরাই যদি উপযাচক হয়ে ডাকিয়ে পাঠাই, সে নিশ্চয়ই একটা বড়রকমের সময় নেবে। তাতে ফল শুধু এই হবে যে, দেনাও শোধ হবে না, আর তোমাদের সমাজ-প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্পও চিরদিনের মত ডুবে যাবে। বেশ করে ভেবে দেখ দিকি মা, এই কি ঠিক নয়? আর তার অগোচরেও ত কিছু হতে পারবে না। তখন নিজে যদি সে সময় চায় তখন না হয় বিবেচনা করে দেখা যাবে। কি বল মা?

বিজয়া। (অপ্রসন্ন-মুখে) আচ্ছা। কাকাবাবু, আমার বড় দেরি হয়ে গেল, এখন কি যেতে পারি?

রাস। যাও মা যাও, আমিও চললাম।

[বিজয়ার প্রস্থান]

বিলাস। (সক্রোধে) সে যদি দশ বছরের সময় চায় ত বিবেচনা করতে হবে নাকি?

রাস। (ক্রুদ্ধ চাপাকণ্ঠে) হবে না ত কি সমস্ত খোয়াতে হবে? মন্দির-প্রতিষ্ঠা! দেখ বিলাস, এই মেয়েটির বয়স বেশি নয়, কিন্তু সে বেশ জানে যে সেই তার বাপের সমস্ত সম্পত্তির মালিক, আর কেউ নয়। মন্দির-স্থাপনা না হলেও চলবে, কিন্তু আমার কথাটা ভুললে চলবে না।

[প্রস্থান]

[কালীপদর প্রবেশ]

কালী। মা জিজ্ঞাসা করলেন আপনাকে কি আর চা পাঠিয়ে দেবেন?

বিলাস। না।

কালী। শরবত কিংবা—

বিলাস। না দরকার নেই।

কালী। ফল কিংবা কিছু মিষ্টি?

বিলাস। আঃ দরকার নেই বলচি না? তাকে বলে দিও আমি বাড়ি চললুম।

[প্রস্থান]

কালী। বলতে হবে না, তিনি গেলেই জানতে পারবেন।

[প্রস্থান]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *