২.০২ গুরু-শিষ্য সংবাদ

গুরু-শিষ্য সংবাদ

শিষ্য। প্রভু, আত্মা কি? ঈশ্বরই বা কি, এবং কি করিয়াই বা তাহা জানা যায়?

গুরু। বৎস, এ বড় কঠিন প্রশ্ন। সকলে জানে না, কিন্তু আমি জানি। বিস্তর সাধনায় তবেই তাঁকে পাওয়া যায়, যেমন আমি পাইয়াছি।
অবধান কর, আমার মুখ হইতে শুনিলেই তুমি জলের মত বুঝিতে পারিবে। (শিষ্যের হাঁ করিয়া থাকা)

গুরু। (গম্ভীর হইয়া) বৎস, শাস্ত্র বলিয়াছেন, “রসো বৈ সঃ” অর্থাৎ কিনা তিনি—রস। এই রসের দ্বারাই তিনি এক এবং বহু। এই বহুকে পূত রসের দ্বারা উদ্বোধন করিয়া, একের মধ্যে বহু ও ঐক্যের মধ্যে অনৈক্যকে উপলব্ধি করিবে। ভারতবর্ষের ইহাই চিরন্তন সাধনা। আচ্ছা, তাহা হইলে তোমার কি হইবে, না, ভূমানন্দ লাভ হইবে— যেমন আমার হইয়াছে। তখন সেই ভূমানন্দকে, একের দ্বারা, বহুর দ্বারা, ঐক্যের দ্বারা এবং অনৈক্যের দ্বারা, ত্যাগের ভিতর দিয়া পাইলেই তোমার ত্যাগানন্দ লাভ হইবে। বৎস, সেই ত্যাগানন্দের চিত্রকে বিচিত্র করিয়া হৃদয়ে উপলব্ধি করিতে পারিলেই তোমার ঈশ্বর পাওয়া হইল। এ বোঝা আর শক্ত কি বৎস?

শিষ্য। আজ্ঞা,—আজ্ঞা না। তেমন শক্ত নয়। আচ্ছা গুরুদেব, ভূমানন্দই বা কি, আর ত্যাগানন্দই বা কি?

গুরু। বুঝাইয়া বলিতেছি, শ্রবণ কর। পরব্রহ্মই ভূমা। তাঁর আনন্দের নামই ভূমানন্দ। এ আনন্দের তুলনা নাই, কিন্তু বড় কঠোর সাধনার আবশ্যক। ভূমা অন্ত-বিশিষ্ট অনন্ত, আকার-বিশিষ্ট নিরাকার—অর্থাৎ নিরাকার কিন্তু সাকার, যেমন কালো কিন্তু সাদা,—বুঝিলে?

শিষ্য। আজ্ঞা হাঁ—যেমন কালো কিন্তু সাদা।

গুরু। ঠিক তাই। চোখ বুজিয়া অনুভব করিয়া লও, যেন কালো কিন্তু সাদা। এই যে, এই যে তাঁর পূর্ণরূপ। এই যে তাঁর সত্যরূপ, এই সত্যরূপকে হৃদয়ে সম্পূর্ণ উপলব্ধি করিয়া, একাগ্র চিত্তে বিশ্ববাণীর পবিত্র অর্ঘ্য দিয়া শতদল পদ্মের উপর প্রতিষ্ঠিত করিয়া লইবে। বৎস, এমন হাঁ করিয়া চাহিয়া থাকিও না—সাধনা করিলেই পারিবে।

শিষ্য। আজ্ঞা!

গুরু। হাঁ, না হইলে আমিই বা ভূমানন্দে এমন বিভোর হইয়া থাকিতে পারিতাম কি করিয়া? আচ্ছা, এখন সেই সৎস্বরূপকেই শ্রদ্ধায় নিষ্ঠায় একীভূত করিয়া, সত্যের দ্বারা আবাহন করিয়া লইলেই তোমার হৃদয়ে বিশ্বমানবতার যে বিপুল স্পন্দন জাগ্রত হইয়া উঠিবে, সেই অনুভূতির নামই ভূমানন্দ, বৎস।

শিষ্য। বুঝিয়াছি গুরুদেব, এমন কঠিন বস্তু আপনি কত সহজে এবং কি সুন্দর ভাবে বুঝাইয়া দিলেন! ভূমানন্দ সম্বন্ধে আর আমার বিন্দুমাত্র সংশয় নাই।

গুরু। (মৃদু মৃদু হাস্য। তদনন্তর চক্ষু বুজিয়া) বৎস, সমস্তই ভগবৎ প্রসাদাৎ। নিজে বুঝিয়াছি, তাঁহার সত্যরূপ এই হৃদয়ে সম্যক্‌ অনুভব করিয়া ধন্য হইয়াছি বলিয়াই এত শীঘ্র তোমাকে এমন জলের মত বুঝাইয়া দিলাম। এখন তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতেছি, অবহিত হও। কি প্রশ্ন করিয়াছিলে? ত্যাগানন্দ কি? এটিও আনন্দ-স্বরূপ বৎস। পাইলেই আমাদের আনন্দ হয়, ইহা স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু সেই পাওয়া যেমন-তেমন করিয়া পাইলেই ত চলিবে না। সে পাওয়া নিষ্ফল পাওয়া, সে পাওয়া পাওয়াই নয়,—অতএব ত্যাগের দ্বারা পাইবার চেষ্টা করিবে।

শিষ্য। প্রভু, ঠিক হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিলাম না। ত্যাগের দ্বারা কি করিয়া পাইব? ত্যাগ করিলেই ত হাতছাড়া হইয়া যাইবে।

গুরু। বৎস, ভুল বুঝিতেছ। তোমাকে ত্যাগ করিতে বলিতেছি না, ত্যাগের দ্বারা পাইতে বলিতেছি। অর্থাৎ পাঁচ জনে ত্যাগ করিতে থাকিলে সম্ভবতঃ তোমার যে প্রাপ্তি ঘটিবে, সেই যে ত্যাগের পাওয়া, সেই যে বড় দুঃখের পাওয়া, তাহাকে বিশ্বপতির দান বলিয়া হৃদয়ে সাত্ত্বিকভাবে বরণ করিয়া লইলেই তোমার ত্যাগানন্দ জন্মিবে। আহা, সে কি আনন্দ রে! (ক্ষণকাল মুদিত চক্ষে মৌন থাকিয়া পুনরায়) বৎস, আমার এই যে ‘আমি’টা,—শাস্ত্র যাকে ‘অহং’ বলে, ‘অহমিকা’ বলে, ত্যাগ করতঃ পরিবর্জন করিতে আদেশ দিয়াছেন, আমার সেই ‘আমি’টার মত সর্বনেশে বস্তু সংসারে নাই। এই ‘আমি’টাকে পাঁচ জনের মধ্যে, বিশ্বমানবের মধ্যে ডুবাইয়া দিবে।

তখন, তোমার আর আত্ম-পর ভেদ থাকিবে না, পাঁচ জনকে আর আলাদা করিয়া দেখিবে না। তখন, তাহাদের দানকেই নিজের দান বলিয়া উপলব্ধি করিয়া হৃদয়ে যে অতুল আনন্দ উপভোগ করিবে, বৎস, ভগবানের সেই আনন্দরূপকে অন্তরে ধারণ করিয়া আমি চিরদিনের মত ধন্য হইয়া গিয়াছি। আহা!

শিষ্য। বুঝিলাম গুরুদেব। এইবার আশীর্বাদ করুন, বর দিন, যেন, কঠোর সাধনার দ্বারা আপনার শিষ্য হইবার যোগ্য হইতে পারি।

গুরু। তথাস্তু। ( যমুনা, ১৩২০ ফাল্গুন, ৫ম বর্ষ, ১১শ সংখ্যা হইতে গৃহীত। )

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *