ষোড়শী – ৪.১

চতুর্থ অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

শান্তিকুঞ্জ

[জমিদারের ‘শান্তিকুঞ্জ’ তিন-চারিদিন হইল ভস্মীভূত হইয়াছে। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের বহু চিহ্ন তখনও বিদ্যমান। সবই পুড়িয়াছে, মাত্র ভৃত্যদের খান-দুই ঘর রক্ষা পাইয়াছে। ইহার মধ্যেই জীবানন্দ আশ্রয় লইয়াছেন। সম্মুখের খোলা জানালা দিয়া বারুই নদীর জল দেখা যাইতেছে; প্রভাতবেলায় সেইদিকে চোখ মেলিয়া জীবানন্দ নিঃশব্দে বসিয়াছিলেন। মুখে চাঞ্চল্য বা উত্তেজনার কোন প্রকাশ নাই, শুধু সারারাত্রি ধরিয়া উৎকট রোগ-ভোগের একটা অবসন্ন ম্লান ছায়া তাঁহার সর্বদেহে পরিব্যাপ্ত হইয়া আছে]

[প্রফুল্ল প্রবেশ করিল]

প্রফুল্ল। এখন কেমন আছেন দাদা?

জীবানন্দ। ভালো আছি।

প্রফুল্ল। বহুকালের অভ্যাস, ওষুধ বলেও যদি এক-আধ আউন্স—

জীবানন্দ। (সহাস্যে) ওষুধই বটে। না প্রফুল্ল, মদ আমি খাব না।

প্রফুল্ল। রাত্রিটা কাল কি উৎকণ্ঠাতেই আমাদের কেটেছে। যন্ত্রণায় হাত-পা পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল।

জীবানন্দ। তাই এই গরম করার প্রস্তাব?

প্রফুল্ল। বল্লভ ডাক্তারের ভয়, হয়ত হঠাৎ হার্টফেল করতে পারে।

জীবানন্দ। হার্ট ত হঠাৎই ফেল করে প্রফুল্ল।

প্রফুল্ল। কিন্তু সেজন্যে ত একটা—

জীবানন্দ। (নিজের হার্ট হাত দিয়া দেখাইয়া) ভায়া, এ বেচারা বহু উপদ্রবেও সমানে চলতে কোনদিন ফেল করেনি। দৈবাৎ একদিন একটা অকাজ যদি করেই বসে ত মাপ করা উচিত।

প্রফুল্ল। কি একগুঁয়ে মানুষ আপনি দাদা। ভাবি, এতবড় জিদ এতকাল কোথায় লুকানো ছিল!

জীবানন্দ। ভালো কথা, তোমার ডালভাতের যোগাড়ে বার হবার যে একটা সাধু প্রস্তাব ছিল তার কতদূর?

প্রফুল্ল। ঘাট হয়েছে দাদা। আপনি ভালো হয়ে উঠুন, ডালভাতের চিন্তা তার পরেই করব।

জীবানন্দ। আমার ভালো হবার পরে ত? যাক তা হলে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।

[তারাদাস ও পূজারীর প্রবেশ]

তারাদাস। মন্দিরের খানকয়েক থালা-ঘটি-বাটি পাওয়া যাচ্ছে না।

জীবানন্দ। না গেলে সেগুলো আবার কিনে নিতে হবে।

[ব্যস্ত হইয়া এককড়ির প্রবেশ]

এককড়ি। (ডাক ছাড়িয়া) এ কাজ সাগর সর্দারের। আজ খবর পাওয়া গেল, তাকে আর তার দু’জন সঙ্গীকে সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত এদিকে ঘুরে বেড়াতে লোক দেখেচে। থানায় সংবাদ পাঠিয়েচি, পুলিশ এল বলে। সমস্ত ভূমিজ গুষ্টিকে যদি না আমি এই ব্যাপারে আন্দামানে পাঠাতে পারি ত আমার নামই এককড়ি নন্দী নয়—বৃথাই আমি এতকাল হুজুরের সরকারে গোলামি করে মরচি।

জীবানন্দ। (একটু হাসিয়া) তা হলে তোমাকেও ত এদের সঙ্গে যেতে হয় এককড়ি। জমিদারের গোমস্তাগিরি কাজে তুমি যাদের ঘর জ্বালিয়েছ সে ত আমি জানি। এদের আগুন দিতে কেউ চোখে দেখেনি, কেবল সন্দেহের উপর যদি তাদের শাস্তি ভোগ করতে হয়, জানা-অপরাধের জন্য তোমাকেও ত তার ভাগ নিতে হয়।

এককড়ি। (প্রথমে হতবুদ্ধি হইয়া, পরে শুষ্ক হাস্যের সহিত) হুজুর মা-বাপ। আমাদের সাত-পুরুষ হুজুরের গোলাম। হুজুরের আদেশে শুধু জেল কেন, ফাঁসি যাওয়ায় আমাদের অহঙ্কার।

জীবানন্দ। যা পুড়েছে, সে আর ফিরবে না; কিন্তু এর পর যদি পুলিশের সঙ্গে জুটে নতুন হাঙ্গামা বাধিয়ে দু’পয়সা উপরি রোজগারের চেষ্টা কর, তা হলে হুজুরের লোকসানের মাত্রা ঢের বেড়ে যাবে এককড়ি।

পূজারী। মিস্ত্রী এসেছে হুজুরের কাছে নালিশ জানাতে।

জীবানন্দ। কিসের নালিশ?

পূজারী। মন্দিরের মেরামতি-কাজে ঘটনাচক্রে তার বিশেষ লোকসান হয়ে যায়। মা বলেছিলেন, কাজ শেষ হলে তার ক্ষতিপূরণ করে দেবেন। আমি তখন উপস্থিত ছিলাম হুজুর।

জীবানন্দ। তবে দেওয়া হয় না কেন?

পূজারী। (তারাদাসকে ইঙ্গিত করিয়া) উনি বলেন, যে বলেছিল তার কাছে গিয়ে আদায় করতে।

[জীবানন্দ ক্রুদ্ধ-চক্ষে তারাদাসের প্রতি চাহিতে]

তারাদাস। অনেকগুলো টাকা—

জীবানন্দ। অনেকগুলো টাকাই দেবে ঠাকুর।

তারাদাস। কিন্তু খরচটা ন্যায্য কিনা—

জীবানন্দ। দেখ তারাদাস, ও-সব শয়তানি মতলব তুমি ছাড়ো। ষোড়শীর ন্যায়-অন্যায় বিচারের ভার তোমার ওপরে নেই। যা বলে গেছেন তাই কর গে। (পূজারীর প্রতি) মিস্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে?

পূজারী। আছে হুজুর।

জীবানন্দ। চল, আমি নিজে গিয়ে সমস্ত মিটিয়ে দিচ্ছি।

[জীবানন্দ, প্রফুল্ল, তারাদাস ও পূজারীর প্রস্থান। রহিল শুধু এককড়ি]

[শিরোমণি ও জনার্দন রায়ের প্রবেশ]

জনার্দন। বাবু গেলেন কোথা?

এককড়ি। (তিক্তকণ্ঠে) কে জানে!

জনার্দন। কে জানে কি হে? পুলিশে খবর দেবার কথাটা তাঁকে বলেছিলে?

এককড়ি। পারেন, আপনিই বলুন না।

জনার্দন। ব্যাপার কি এককড়ি?

এককড়ি। কে জানে কি ব্যাপার। না আছে মেজাজের ঠিক, না পাই কোন কথার ঠিকানা। তারা ঠাকুরকে তেড়ে মারতে গেলেন, আমাকে পাঠাতে চাইলেন জেলে—

শিরোমণি। অত্যধিক মদ্যপানের ফল। হুজুর কি এখনি ফিরে আসবেন মনে হয়?

এককড়ি। বুঝলেন রায়মশায়, মিথ্যে সন্দেহ করে সাগর সর্দারের নাম পুলিশে জানানো চলবে না।

জনার্দন। মিথ্যে সন্দেহ কি হে? এ যে একরকম স্পষ্ট চোখে দেখা।

শিরোমণি। একেবারে প্রত্যক্ষ বললেই হয়।

এককড়ি। বেশ, তাই একবার বলে দেখুন না?

জনার্দন। বলবই ত হে। নইলে কি গুষ্টিবর্গ মিলে পুড়ে কয়লা হবো! ষোড়শীকে তাড়ানোর কাজে আমিও ত একজন উদ্যোগী।

শিরোমণি। আমার কথাই না কোন্‌ তারা শুনেছে!

জনার্দন। যারা এতবড় জমিদারের বাড়িতে আগুন দিতে পারে, তারা পারে না কি?

এককড়ি। আমিও তাই ভাবি।

জনার্দন। ভেবো পরে। এখন শীঘ্র কিছু একটা করো। এখানে যদি প্রশ্রয় পায় ত আমাকে ঘরে শিকল দিয়ে মানকচুর মত সেদ্ধ করে ছাড়বে।

শিরোমণি। ব্যাটারা গুরুর দোহাই মানবে না। ডাকাত কিনা! হয়ত বা ব্রহ্মহত্যাই করে বসবে। (শিহরিয়া উঠিলেন)

জনার্দন। আর শুধু কি কেবল বাড়ি? আমার কত ধানের গোলা, কত খড়ের মাড়, সবসুদ্ধ যদি—

শিরোমণি। দেখ ভায়া, আমি বরঞ্চ দিন-কতক শিষ্যবাড়ি থেকে ঘুরে আসি গে।

জনার্দন। কিন্তু আমার ত শিষ্যবাড়ি নেই? আর থাকলেও ত ধানের গোলা, খড়ের মাড় নিয়ে শিষ্যবাড়ি ওঠা যায় না?

শিরোমণি। না। গেলেও ও সকল ফিরিয়ে আনা কঠিন। আজকালকার শিষ্য-সেবকদের মতিগতিও হয়েছে অন্য প্রকার।

এককড়ি। চারিদিকে কড়া পাহারা মোতায়েন করে রাখুন।

জনার্দন। তা ত রেখেচি, কিন্তু পাহারা কি তোমাদেরই কম ছিল এককড়ি!

এককড়ি। আর একটা কথা শুনেছেন? ভূমিজ প্রজারা গিয়ে কাল আদালতে নালিশ করে এসেছে। শুনচি কান্নাকাটি শুনে স্বয়ং হাকিম আসবেন সরজমিন তদারকে।

জনার্দন। বল কি হে! চণ্ডীগড়ে বাস করে জমিদার আর আমার নামে নালিশ?

শিরোমণি। শিষ্যগণের আহ্বান উপেক্ষা করা আমার কর্তব্য নয় জনার্দন।

এককড়ি। দেখুন আস্পর্ধা! জীবনে বেশীদিন যারা পেটভরে খেতে পায় না, শীতের রাতে যারা বসে কাটায়, মড়কের দিনে যারা কুকুর-বেড়ালের মত মরে—

জনার্দন। আবার আবাদের দিনে একমুঠা বীজের জন্যে আমারই দরজার বাইরে পড়ে হত্যা দেয়—

এককড়ি। সেই নিমকহারাম ব্যাটারা আদালতে দাঁড়াবার টাকা পেলেই বা কোথা? এ দুর্মতি দিলেই বা তাদের কে?

জনার্দন। এই সোজা কথাটা ব্যাটারা বোঝে না যে, কেবল জেলে আদালতেই নয় হাইকোর্ট বলেও একটা-কিছু আছে যেখানে জীবানন্দ চৌধুরী, জনার্দন রায়কে ডিঙিয়ে সাগর সর্দার যেতে পারে না।

এককড়ি। নিশ্চয়। টাকা যার মোকদ্দমা তার। আপনার অর্থ আছে, সামর্থ্য আছে, ব্যারিস্টার জামাই আছে, কত উকিল-মোক্তার আছে; নালিশ যদি করেই, আপনার ভাবনা কিসের?

জনার্দন। (চিন্তিতভাবে) না এককড়ি, কেবল জমি বিক্রিই ত নয় (ইঙ্গিত করিয়া) আরো যে-সব কাজ করা গেছে, ফৌজদারী দণ্ডবিধি কেতাবের পাতায় পাতায় তার ফলশ্রুতি ত সহজ নয়!

এককড়ি। তা জানি। কিন্তু এই ছোটলোক চাষার দল হাকিমের কাছে আমল পেলে ত!

জনার্দন। বলা যায় না; এই কথাই আজ তোমার মনিবের কাছে পাড়ো গে। এখন চললাম।

এককড়ি। আসুন। আমিও ইতিমধ্যে একটা কাজ সেরে রাখি গে।

[শিরোমণি, এককড়ি ও জনার্দনের প্রস্থান

[কথা কহিতে কহিতে জীবানন্দ ও প্রফুল্ল প্রবেশ করিলেন]

জীবানন্দ। না প্রফুল্ল, সে হয় না। মাঠের জল-নিকাশী সাঁকো তৈরির পয়সা যদি নায়েবমশায়ের তবিলে না থাকে ত এখানকার বাড়ি মেরামতও বন্ধ থাক।

প্রফুল্ল। বেশ থাক। কিন্তু দেশে ফিরে চলুন।

জীবানন্দ। না।

প্রফুল্ল। না কিরকম? এ বাড়িতে আপনি থাকবেন কি করে?

জীবানন্দ। যেমন করে আছি। এ সহ্য হয়ে যাবে। মানুষের অনেক কিছুই সয় প্রফুল্ল।

প্রফুল্ল। সয় না দাদা, তারও সীমা আছে। শরীরটা যে হঠাৎ ভয়ানক ভেঙ্গে গেল। বর্ষা সুমুখে। এই ভাঙ্গা মন্দিরে কি এই ভাঙ্গা দেহে সে দুর্যোগ সইবে? রক্ষে করুন, এবার বাড়ি চলুন।

জীবানন্দ। (হাসিয়া) এই ভাঙ্গা দেহের দেহ-তত্ত্বের আলোচনা আর একদিন করা যাবে ভায়া, এখন কিন্তু নায়েবকে চিঠি লিখে দাও এ টাকা আমার চাই-ই। প্রজারা বছর বছর টাকা যোগাচ্ছে আর মরচে, এবার তাদের মরণ আটকাতে যদি জমিদারিটা মরে ত মরুক না।

[দ্রুতপদে জনার্দনের প্রবেশ]

জনার্দন। হুজুর কি নিজে—স্বয়ং হুকুম দিয়ে আমার—

জীবানন্দ। কি হুকুম রায়মশায়?

জনার্দন। আমার পুকুরধারের জায়গায় বেড়া ভেঙ্গে মন্দিরের জমির সঙ্গে এক করিয়ে দিয়েছেন?

জীবানন্দ। কোন্‌ জায়গাটা বলছেন? যেখানে বছর-কুড়ি পূর্বে মন্দিরের গোশালা ছিল?

জনার্দন। আমি ত জানিনে কবে আবার—

জীবানন্দ। অনেকদিন হয়ে গেল কিনা! বোধ হয় নানা কাজের ঝঞ্ঝাটে কথাটা ভুলে গেছেন।

জনার্দন। (দুঃসহ ক্রোধ দমন করিয়া) কিন্তু এ-সব করার আগে হুজুর ত আমার কাছে একটা খবর পাঠাতে পারতেন।

জীবানন্দ। খবর পৌঁছোবেই জানি। দু’দণ্ড আগে আর পরে। কিছু মনে করবেন না।

জনার্দন। কিন্তু আগে জানলে মামলা-মকদ্দমা হয়ত বাধত না।

জীবানন্দ। এতেও বাধা দেওয়া উচিত নয় রায়মশায়। ভৈরবীদের হাতে দেবীর বহু সম্পত্তিই বেহাত হয়ে গেছে। এখন সেগুলো হাত-বদল হওয়া দরকার।

জনার্দন। (শুষ্ক হাস্য করিয়া) তার চেয়ে আর ভালো কথা কি আছে হুজুর। শুনতে পাই সমস্ত গ্রামখানাই একদিন মা-চণ্ডীর ছিল। এখন কিন্তু—

জীবানন্দ। জমিদারের গর্ভে গেছে? তা গেছে। তারও ত্রুটি হবে না রায়মশায়! মন্দিরের দলিল, নকশা, ম্যাপ প্রভৃতি যা-কিছু আছে কলকাতায় এটর্নির বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমার একলার সাধ্য কি? আপনারা এ-কাজে আমার সহায় থাকবেন।

জনার্দন। থাকব বৈ কি হুজুর। আমরা চিরকাল হুজুর সরকারের চাকর বৈ ত নয়।

[জনার্দন প্রস্থান করিল। জীবানন্দ সকৌতুক হাসিমুখে তাহার প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া ক্ষণকাল নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলেন]

প্রফুল্ল। দাদা কি শেষে একটা লঙ্কাকাণ্ড বাধাবেন নাকি?

জীবানন্দ। যদি বাধে সে ভাগ্যের কথা প্রফুল্ল। তার জন্যে দেবতাদের একদিন তপস্যা করতে হয়েছিল।

প্রফুল্ল। দেবতারা পারেন। লঙ্কার বাইরে বসে তপস্যা করায় পুণ্যও আছে, দুশ্চিন্তাও কম। কিন্তু লঙ্কার ভিতরে যারা বাস করে, লঙ্কাকাণ্ডের ব্যাপারে তাদের ভাগ্যকে ঠিক সৌভাগ্য বলা চলে না। এসে পর্যন্ত গ্রামসুদ্ধ লোকের সঙ্গে বিবাদ করে বেড়ানো আপনার গৌরবেরও নয়, প্রয়োজনও নয়। ইতিমধ্যে নানাপ্রকার কার্যই ত করা গেল, এখন ক্ষান্ত দিয়ে চলুন বাড়ি ফিরে যাওয়া যাক।

জীবানন্দ। সময় হলেই যাব।

প্রফুল্ল। তাই যাবেন। যাই হোক দাদা, আপনার যাবার সময়ের তবু একটা আন্দাজ পাওয়া গেল, কিন্তু আমার যাবার সময় যে কবে আসবে তার কূল-কিনারাও চোখে পড়ে না।

[এককড়ির প্রবেশ]

এককড়ি। মিস্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। পুলের কাজটা কোথা থেকে আরম্ভ হবে জানতে চায়।

জীবানন্দ। চল না প্রফুল্ল, একবার মাঠে গিয়ে তাদের কাজটা দেখিয়ে আসি গে।

প্রফুল্ল। চলুন।

[জীবানন্দ প্রফুল্লকে লইয়া বাহির হইয়া গেলেন। অন্যদিক দিয়া শিরোমণি ও জনার্দন রায় প্রবেশ করিলেন]

জনার্দন। বাবু গেলেন কোথায় এককড়ি?

এককড়ি। মিস্ত্রীকে দেখাতে গেলেন। মাঠে সাঁকো তৈরি হবে।

জনার্দন। পাগলের খেয়াল।

শিরোমণি। মদ্যপান-জনিত বুদ্ধি-বিকৃতি।

এককড়ি। এই শনিবারে হাকিম সরজমিন-তদন্তে আসবেন। ছোটলোক ব্যাটাদের বুদ্ধি এবং টাকা কে যোগাচ্চে ঠিক জানতে পারলাম না, কিন্তু এইটুকু জানতে পারলাম তারা সাক্ষী মানলে হুজুর গোপন কিছুই করবেন না। দলিল তৈরির কথা পর্যন্ত না।

জনার্দন। (সহাস্যে) আমার বয়সটা কত হয়েচে ঠাওরাও এককড়ি? চণ্ডীগড়ের জনার্দন রায়কে ও-ধাপ্পায় কাত করা যাবে না, বাপু, আর কোন মতলব ভেঁজে এসো গো। (একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া) তবে, এ কথা মানি তোমার হাতে গিয়ে একটু পড়েচি। মোচড় দিয়ে দু’পয়সা উপরি রোজগারের সময় এই বটে। কিন্তু তাই বলে যা রয় সয় কর।

এককড়ি। সত্যি বলচি আপনাকে রায়মশায়—

জনার্দন। আহা, সত্যিই ত বলচ! এককড়ি নন্দী আবার মিথ্যে কবে বলেন? সে কথা নয় ভায়া, আমার না হয় শ’খানেক বিঘের টান ধরবে, কিন্তু তাঁর নিজের যাবে কত? সেটা কি তোমার মনিব খতিয়ে দেখেন নি? না দেখে থাকেন ত দেখাও গে চোখে আঙুল দিয়ে। তারপরে না হয় আমাকে প্যাঁচ ক’ষো।

এককড়ি। জায়গা-জমির কথাই হচ্চে না রায়মশাই, কথা হচ্চে দলিলপত্র তৈরি করার। জিজ্ঞাসা করলে সমস্তই বলবেন, কিছুই গোপন করবেন না।

জনার্দন। তার হেতু? শ্রীঘরে যাবার বাসনা ত? কিন্তু একা জনার্দন যাবে না এককড়ি, মহারানী হুজুর বলে রেয়াত করবে না, কথাটা তাঁকে ব’লো।

এককড়ি। (অভিমান-সুরে) বলতে হয় আপনি নিজেই বলবেন।

জনার্দন। বলব বৈ কি হে। ভালো করেই বলব। হাকিমের কাছে কবুল জবাব দিয়ে সাধু সাজা ঠাট্টা-তামাশা নয়। (ইঙ্গিতে দেখাইয়া) হাতকড়ি পড়বে।

এককড়ি। সে-আপনি বুঝবেন আর তিনি বুঝবেন।

জনার্দন। আর তুমি? শ্রীমান এককড়ি নন্দী? বাড়ি যখনি পুড়েছে তখনি জানি কি-একটা ভেতরে হচ্চে। কিন্তু জনার্দনকে অত নরম মাটি ঠাউরো না ভায়া, পস্তাবে। নির্মলকে আটকে রেখেচি, সে-ই তোমাদের বুঝিয়ে দেবে। এককড়ি। আমার ওপরে মিথ্যে রাগ করচেন রায়মশায়, যা জানি তাই শুধু জানিয়েচি। বিশ্বাস না হয়, হুজুর ত এই সামনের মাঠেই আছেন, একটু ঘুরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেই যান না।

জনার্দন। তাই যাব। শিরোমণিমশায়, আসুন ত?

শিরোমণি। চল না ভায়া, ভয় কিসের?

[দুই-এক পা অগ্রসর হইয়া সহসা পিছন ফিরিয়া]

শিরোমণি। (এককড়ির প্রতি) বলি, অত্যধিক মদ্যপান করে নেই ত? তা হলে না হয়—

এককড়ি। মদ তিনি খান না! (হঠাৎ কণ্ঠস্বর সংযত করিয়া) কিন্তু যেতেও আর হবে না। হুজুর নিজেই আসছেন।

[জীবানন্দ ও প্রফুল্ল তর্ক করিতে করিতে প্রবেশ করিলেন]

জনার্দন। (কাছে গিয়া স্বাভাবিক ব্যাকুলতার সহিত) হুজুর, সমস্ত ব্যাপার একবার মনে করে দেখুন।

জীবানন্দ। কিসের রায়মশায়?

জনার্দন। জমি-বিক্রির ব্যাপারে হাকিম নিজে আসছেন তদন্ত করতে। হয়ত ভারী মকদ্দমাই বাধবে। কিন্তু আপনি নাকি—

জীবানন্দ। ওঃ! কিন্তু উপায় কি রায়মশায়? সাহেব জমি ছাড়তে চায় না, সে সস্তায় কিনেচে। মকদ্দমা ত বাধবেই। সুতরাং মামলা জেতা ছাড়া প্রজাদের আর ত পথ দেখিনে।

জনার্দন। (আকুল হইয়া) কিন্তু আমাদের পথ?

জীবানন্দ। (ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া) সে ঠিক, আমাদের পথও খুব দুর্গম মনে হয়।

জনার্দন। (মরিয়া হইয়া) এককড়ি তা হলে সত্যই বলেছে! কিন্তু হুজুর, পথ শুধু দুর্গম নয়—জেল খাটতে হবে, এবং আমরা একা নয়, আপনিও বাদ যাবেন না।

জীবানন্দ। (একটুখানি হাসিয়া) তাই বা কি করা যাবে রায়মশায়! শখ করে যখন গাছ পোঁতা গেছে, ফল তার খেতে হবে বৈ কি!

জনার্দন। (চীৎকার করিয়া) এ আমাদের সর্বনাশ করবে এককড়ি।

[পাগলের মত ঝড়ের বেগে জনার্দন বাহির হইয়া গেল, তাহার পিছনে এককড়ি নিঃশব্দে প্রস্থান করিল, নেপথ্যে কোলাহল]

জীবানন্দ।(ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া) কারা যায় প্রফুল্ল?

প্রফুল্ল। বোধ হয় আপনার মাটি-কাটা ধাঙড়-কুলীর দল।

জীবানন্দ। একবার ডাক ত, ডাক ত হে। শুনি আজ বাঁধের কাজ কতখানি করলে।

প্রফুল্ল। (ঈষৎ অগ্রসর হইয়া) ওহে, ও সর্দার? শোন শোন, একবার শুনে যাও।

[স্ত্রী ও পুরুষ কুলীদের প্রবেশ]

সর্দার। কি রে, ডাকচিস্ কেনে?

জীবানন্দ। বাবারা, কোথায় চলেচিস বল্ ত?

সর্দার। ভাত খাবার লাগি রে।

জীবানন্দ। দেখিস বাবারা, আমার বাঁধের কাজ যেন বর্ষার আগেই শেষ হয়।

সকলে। (সমস্বরে) সব হোয়ে যাবে রে, সব হোয়ে যাবে। তুই কিছু ভাবিস্‌ না। চল্।

[কুলীদের প্রস্থান

[নির্মল প্রবেশ করিল]

জীবানন্দ। (সাদরে) আসুন, আসুন, নির্মলবাবু।

নির্মল। (নমস্কার করিয়া) আপনার সঙ্গে আমার একটু কাজ আছে।

জীবানন্দ। আর একদিন হলে হয় না?

নির্মল। না, আমার বিশেষ প্রয়োজন।

জীবানন্দ। তা বটে। অকাজের বোঝা টানতে যাঁকে আটক থাকতে হয় তাঁর সময় নষ্ট করা চলে না।

নির্মল। অকাজ মানুষে করে বলেই ত সংসারে আমাদের প্রয়োজন চৌধুরীমশাই।

জীবানন্দ। কিন্তু কাজের ধারণা ত সকলের এক নয় নির্মলবাবু। রায়মশায়ের আমি অকল্যাণ কামনা করিনে, এবং আপনার উদ্দেশ্য সফল হলে আমি বাস্তবিকই খুশী হব, কিন্তু আমার কর্তব্যও আমি স্থির করে ফেলেছি, এ থেকে নড়চড় করা আর সম্ভব হবে না।

নির্মল। এ কথা কি সত্য যে আপনি সমস্তই স্বীকার করবেন?

জীবানন্দ। সত্য বৈ কি।

নির্মল। এমন ত হতে পারে আপনার কবুল জবাবে আপনিই শুধু শাস্তি পাবেন, কিন্তু আর সকলে বেঁচে যাবেন।

জীবানন্দ। খুব সম্ভব বটে। কিন্তু সেজন্যে আমার কোন অভিযোগ নেই নির্মলবাবু। নিজের কৃতকর্মের ফল আমি একা ভোগ করলেই যথেষ্ট। নইলে রায়মশায় নিস্তার লাভ করে সুস্থদেহে সংসার-যাত্রা নির্বাহ করতে থাকুন এবং আমার এককড়ি নন্দীমশায়ও আর কোথাও গোমস্তাগিরি-কর্মে উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি লাভ করতে থাকুন, কারও প্রতি আমার আক্রোশ নেই।

নির্মল। আত্মরক্ষায় সকলেরই ত অধিকার আছে, অতএব শ্বশুরমশায়কেও করতে হবে। আপনি নিজে জমিদার, আপনার কাছে মামলা-মকদ্দমার বিবরণ দিতে যাওয়া বাহুল্য—শেষ পর্যন্ত হয়ত বা বিষ দিয়ে বিষের চিকিৎসা করতে হবে।

জীবানন্দ। চিকিৎসক কি জাল-করার বিষে খুন করার ব্যবস্থা দেবেন?

নির্মল। (রাগ সংবরণ করিয়া) এমন ত হতে পারে কারও কোন শাস্তিভোগ করারই আবশ্যক হবে না, অথচ ক্ষতিও কাউকে স্বীকার করতে হবে না।

জীবানন্দ। (তৎক্ষণাৎ সম্মত হইয়া) বেশ ত পারেন ভালোই। কিন্তু আমি অনেক চিন্তা করে দেখেচি সে হবার নয়। কৃষকেরা তাদের জমি ছাড়বে না। কারণ এ শুধু অন্নবস্ত্রের কথা নয়, তাদের সাত-পুরুষের চাষ-আবাদের মাঠ, এর সঙ্গে তাদের নাড়ীর সম্পর্ক। এ তাদের নিতেই হবে। (একটু চুপ করিয়া) আপনি ভালোই জানেন, অন্য পক্ষ অত্যন্ত প্রবল, তার উপর জোর-জুলুম চলবে না। চলতে পারে কেবল চাষাদের উপর, কিন্তু চিরদিন তাদের প্রতিই অত্যাচার হয়ে আসছে, আর হতে আমি দেব না।

নির্মল। আপনার বিস্তীর্ণ জমিদারি; এই ক’টা চাষার কি আর তাতে স্থান হবে না? কোথাও না কোথাও—

জীবানন্দ। না না, আর কোথাও না—এই চণ্ডীগড়ে। এইখানে আমি জোর করে সেদিন তাদের কাছে অনেক টাকা আদায় করেছি—আর সে টাকা যুগিয়েছেন জনার্দন রায়। এ ঋণ পরিশোধ করতে আমাকে হবেই, এবং আরও যে কতবড় একটা শূল তাদের বিদ্ধ করেছি, সে কথা শুধু আমিই জানি। কিন্তু যাক। অপ্রীতিকর আলোচনায় আর আমার প্রবৃত্তি নেই নির্মলবাবু, আমি মনস্থির করেছি।

[জীবানন্দ প্রস্থান করিলেন।

[সেই দিকে চাহিয়া নির্মল অভিভূতের ন্যায় স্থির হইয়া রহিল। এমনি সময়ে ফকিরসাহেব প্রবেশ করিলেন]

ফকির। জামাইবাবু, সেলাম। বাবু কৈ?

নির্মল। (অভিবাদন করিয়া) জানিনে। ফকিরসাহেব, ষোড়শীকে আমাদের বড় প্রয়োজন। তিনি যেখানেই থাকুন একবার আমাকে দেখা করতেই হবে। বলুন, কোথায় আছেন।

ফকির। আপনাকে জানাতে আমার বাধা নেই। কারণ, একদিন যখন সবাই তাঁর সর্বনাশে উদ্যত হয়েছিল, তখন আপনিই শুধু তাঁকে রক্ষা করতে দাঁড়িয়েছিলেন।

নির্মল। আজ আবার ঠিক সেইটি উলটে দাঁড়িয়েচে ফকিরসাহেব। এখন, কেউ যদি তাঁদের বাঁচাতে পারে ত শুধু তিনিই। কোথায় আছেন এখন?

ফকির। শৈবালদীঘির কুষ্ঠাশ্রমে।

নির্মল। কুষ্ঠাশ্রমে? সেখানে কি সুখে আছেন?

ফকির। (মৃদু হাসিয়া) এই নিন! মেয়েমানুষের সুখে থাকার খবর দেবতারা জানেন না, আমি ত আবার সন্ন্যাসীমানুষ। তবে, মা আমার শান্তিতে আছেন এইটুকুই অনুমান করতে পারি।

নির্মল। (ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া) এখানে আপনি কোথায় এসেছিলেন?

ফকির। জমিদার জীবানন্দের এই চিঠি পেয়ে তাঁরই সঙ্গে একবার দেখা করতে। এই চিঠি আপনাদের পড়া প্রয়োজন। নিন পড়ুন। (চিঠিখানি দিতে গেলেন)

নির্মল। (সসঙ্কোচে) জীবানন্দের লেখা? ও আমি ছোঁব না। প্রয়োজন থাকে আপনিই পড়ুন।

ফকির। প্রয়োজন আছে। নইলে বলতাম না। পত্র আমাকেই লেখা।

[ফকির ধীরে ধীরে চিঠিখানি পড়িতে লাগিলেন এবং নির্মলের মুখের ভাব সংশয় ও বিস্ময়ে কঠিন হইয়া উঠিতে লাগিল]

ফকির। (পত্র পাঠ—)

“ফকির সাহেব,—

ষোড়শীর আসল নাম অলকা। সে আমার স্ত্রী। আপনার কুষ্ঠাশ্রমের কল্যাণ কামনা করি, কিন্তু তাহাকে দিয়া কোন ছোট কাজ করাইবেন না। আশ্রম যেখানে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন সে আমার নয়, কিন্তু তাহার সংলগ্ন শৈবালদীঘি আমার। এই গ্রামের মুনাফা প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার টাকা। আপনাকে জানি। কিন্তু আপনার অবর্তমানে পাছে কেহ তাহাকে নিরুপায় মনে করিয়া অমর্যাদা করে, এই ভয়ে আশ্রমের জন্যই গ্রামখানি তাহাকে দিলাম। আপনি নিজে একদিন আইন-ব্যবসায়ী ছিলেন, এই দান পাকা করিয়া লইতে যাহা কিছু প্রয়োজন, করিবেন, সে খরচ আমিই দিব। কাগজপত্র প্রস্তুত করিয়া পাঠাইলে আমি সহি করিয়া রেজেস্টারি করিয়া দিব।

শ্রীজীবানন্দ চৌধুরী”

ফকির। (নির্মলের মুখের ভাব লক্ষ্য করিয়া) সংসারে কত বিস্ময়ই না আছে!

নির্মল। (দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া, ঘাড় নাড়িয়া) হাঁ। কিন্তু এ যে সত্য তার প্রমাণ কি?

ফকির। সত্য না হলে এ দান নেবার জন্যে ষোড়শীকে কিছুতেই আনতে পারতাম না।

নির্মল। (ব্যগ্রকণ্ঠে) কিন্তু তিনি কি এসেচেন? কোথায় আছেন?

ফকির। আছেন আমার কুটীরে, নদীর পরপারে।

নির্মল। আমার যে এখনি একবার যাওয়া চাই ফকিরসাহেব।

ফকির। চলুন। (হাসিয়া) কিন্তু বেলা পড়ে এল, আবার না তাঁকে হাত ধরে রেখে যেতে হয়।

[উভয়ের প্রস্থান

[সহসা অন্তরাল হইতে কয়েকজনের সতর্ক, চাপা কোলাহলের মধ্য হইতে প্রফুল্লর কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শোনা গেল—“সাবধানে! সাবধানে! দেখো যেন ধাক্কা না লাগে!” এবং পরক্ষণেই তাহারা ধরাধরি করিয়া জীবানন্দকে বহিয়া আনিয়া বিছানায় শোয়াইয়া দিল। তাঁহার চক্ষু মুদ্রিত। সঙ্গে প্রফুল্ল]

প্রফুল্ল। এখন কেমন মনে হচ্চে দাদা?

জীবানন্দ। ভালো না। আমি অজ্ঞান হয়ে সাঁকো থেকে পড়ে গিয়েছিলাম প্রফুল্ল?

প্রফুল্ল। না দাদা, আমরা ধরে ফেলেছিলাম। কতবার বলছি এ রুগ্নদেহে এত পরিশ্রম সইবে না, কিছুতে কান দিলেন না। কি সর্বনাশ করলেন বলুন ত?

জীবানন্দ। (চক্ষু মেলিয়া) সর্বনাশ কোথায় প্রফুল্ল, এই ত আমার পার হবার পাথেয়। এ ছাড়া এ জীবনে আর সম্বল ছিল কৈ?

[দ্রুতবেগে এককড়ি প্রবেশ করিল, তাহার হাতে একটা কাঁচের শিশি]

এককড়ি। (প্রফুল্লের প্রতি) এখ্‌খুনি হুজুরকে এটা খাইয়ে দিন। বল্লভ ডাক্তার দৌড়ে আসছে এলো বলে।

প্রফুল্ল। (শিশি হাতে লইয়া জীবানন্দের কাছে গিয়া) দাদা! এই ওষুধটুকু যে খেতে হবে।

জীবানন্দ। (চক্ষু মুদ্রিত) খেতে হবে? দাও। (ঔষধ পান করিয়া) কোথায় যেন ভয়ানক ব্যথা প্রফুল্ল, যেন এ ব্যথার আর সীমা নেই। উঃ—

প্রফুল্ল। (ব্যকুল-কণ্ঠে) এককড়ি, দেখ না একবার ডাক্তার কত দূরে—যাও না আর একবার ছুটে।

এককড়ি। ছুটেই যাচ্চি বাবু—

[দ্রুতপদে প্রস্থান

জীবানন্দ। ছুটোছুটিতে আর কি হবে প্রফুল্ল? মনে হচ্চে যেন আজ আর তোমরা ছুটে আমার নাগাল পাবে না।

প্রফুল্ল। (নিকটে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া) এমন ত কতবার হয়েছে, কতবার সেরে গেছে দাদা। আজ কেন এ-রকম ভাবছেন?

জীবানন্দ। ভাবছি? না প্রফুল্ল, ভাবিনি। (ঈষৎ হাসিয়া) অসুখ বহুবার হয়েছে এবং বহুবার সেরেছে সে ঠিক। কিন্তু এবার যে আর কিছুতেই সারবে না সেও ত এমনিই ঠিক প্রফুল্ল।

[এককড়ি ও বল্লভ ডাক্তারের প্রবেশ]

প্রফুল্ল। (উঠিয়া দাঁড়াইয়া) আসুন ডাক্তারবাবু।

বল্লভ। হুজুরের অসুখ—ছুটতে ছুটতে আসচি। ওষুধটা খাওয়ানো হয়েছে ত?

এককড়ি। হয়েচে ডাক্তারবাবু, তখ্‌খুনি হয়েছে। ওষুধের শিশি হাতে উঠি ত পড়ি করে ছুটে এসেছি।

[বল্লভ কাছে আসিয়া বসিল। কিছুক্ষণ ধরিয়া নাড়ী পরীক্ষা করিয়া মুখ বিকৃত করিল। মাথা নাড়িয়া প্রফুল্লকে ইঙ্গিতে জানাইল যে অবস্থা ভালো ঠেকিতেছে না]

এককড়ি। (আকুল-কণ্ঠে) কি হবে ডাক্তারবাবু! খুব ভাল জোরালো একটা ওষুধ দিন—আমরা ডবল ভিজিট দেব—যা চাইবেন দেব—

প্রফুল্ল। যা চাইবেন দেব? শুধু এই? সে আর কতটুকু এককড়ি? আমরা তারও অনেক, অনেক বেশি দেব। আমার নিজের প্রাণের দাম বেশি নয়, কিন্তু সে দেওয়াও ত আজ অতি তুচ্ছ মনে হয় ডাক্তারবাবু।

বল্লভ। (উপরের দিকে মুখ তুলিয়া) সমস্তই ওঁর হাতে প্রফুল্লবাবু, নইলে আমার আর কি! নিমিত্তমাত্র। লোকে শুধু মিথ্যে ভাবে বৈ ত না যে, চণ্ডীগড়ের বল্লভ ডাক্তার মরা বাঁচাতে পারে! ওষুধের বাক্স সঙ্গেই এনেছি, এ-সব ভুল আমার হয় না। চলুন নন্দীমশাই, শিগ্‌গির একটা মিক্‌চার তৈরি করে দিই।

[এককড়ি ও বল্লভের প্রস্থান

জীবানন্দ। চোখ বুজে শুয়ে কত কি মনে হচ্ছিল প্রফুল্ল। মনে হচ্ছিল, আশ্চর্য এই পৃথিবী। নইলে আমার জন্যে চোখের জল ফেলতে তোমাকে পেয়েছিলাম কি করে?

প্রফুল্ল। আপনি ত জানেন—

জীবানন্দ। জানি বৈ কি প্রফুল্ল! কিন্তু এককড়ি তার কি জানে? সে জানে তারই মত তুমিও শুধু একজন কর্মচারী, এক পাষণ্ড জমিদারের তেমনি অসাধু সঙ্গী। কত যে করেছ, নীরবে কত যে সয়েছ, বাইরের লোকে তার কি খবর রাখে। মাঝে মাঝে যখন অসহ্য হয়েচে দুটো ভাতডাল যোগাড়ের ছল করে ত্যাগ করে যেতে চেয়েছ, কিন্তু যেতে আমি দিইনি। আজ ভাবি ভালোই করেচি। সত্যই ছেড়ে চলে যদি যেতে প্রফুল্ল, আজকের দুঃখ রাখবার জায়গা পেতে কোথায়?

প্রফুল্ল। দাদা—

জীবানন্দ। একটুখানি কাগজ-কলম আনো না প্রফুল্ল, তোমার দাদার স্নেহের দান—

প্রফুল্ল। (পদতলে নতজানু হইয়া বসিয়া) স্নেহ আপনার অনেক পেয়েছি দাদা, সেই শুধু আমার সম্বল হয়ে থাক। আপনি কেবল আমাকে এই আশীর্বাদ করুন, নিজের পরিশ্রমে যা-কিছু পাই এ জীবনে তার বেশি না লোভ করি।

জীবানন্দ। (ক্ষণকাল নিস্তব্ধ থাকিয়া) বেশ, তাই হোক প্রফুল্ল। দান করে তোমাকে আমি খাটো করে যাব না। কিন্তু লোভী তুমি ত কোনদিনই নও!

[বল্লভ নিঃশব্দে প্রবেশ করিয়া ঔষধের পাত্র প্রফুল্লের হাতে দিয়া তেমনি নিঃশব্দে প্রস্থান করিল]

প্রফুল্ল। দাদা! এই ওষুধটুকু খান।

[প্রফুল্ল কাছে আসিয়া ঔষধ জীবানন্দের মুখে ঢালিয়া দিয়া নিজের কোঁচার খুঁট দিয়া তাঁহার ওষ্ঠপ্রান্ত মুছাইয়া দিল]

জীবানন্দ। কি ভয়ানক অন্ধকার প্রফুল্ল! রাত্রি কত হলো ভাই?

প্রফুল্ল। রাত্রি ত এখনো হয়নি দাদা।

জীবানন্দ। হয়নি? তবে আমার দু’চক্ষে এ নিবিড় আঁধার কিসের প্রফুল্ল?

প্রফুল্ল। অন্ধকার ত নেই দাদা! এখনো যে সূর্যাস্তও হয়নি।

জীবানন্দ। হয়নি? যায়নি সূর্য এখনো ডুবে? তবে খোল, খোল,—আমার সুমুখের জানালা খুলে দাও প্রফুল্ল, একবার দেখি তাঁকে। যাবার আগে আমার শেষ নমস্কার তাঁকে জানিয়ে যাই।

[প্রফুল্ল সম্মুখের বাতায়ন খুলিয়া দিল এবং কাছে আসিয়া জীবানন্দের ইঙ্গিত-মত তাঁহার মাথাটি সযত্নে উঁচু করিয়া দিল। অদূরে বারুইয়ের শীর্ণ জলধারা মন্দবেগে বহিতেছে। পরপারে সূর্য অস্তগমনোম্মুখ। দূরে নীল বনানী আরক্ত আভায় রঞ্জিত। তটে ধূসর বালুকারাশি উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে]

জীবানন্দ। (চোখ মেলিয়া কম্পিত দুই হস্ত যুক্ত করিয়া ললাটে স্পর্শ করাইলেন। ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া) বিশ্বদেব! কে বলে তুমি অচেনা? তুমি চির-রহস্যে ঢাকা?

জন্মান্তরের সহস্র পরিচয় যে আজ যাবার দিনে তোমার মুখে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। (একমুহূর্ত নীরব থাকিয়া) ভেবেছিলাম, হয়ত তোমাকে দেখে ভয় হবে—হয়ত এ জীবনের শতেক গ্লানি দীর্ঘ কালো ছায়া মেলে আজ মুখ তোমার ঢেকে দেবে, কিন্তু সে ত হতে দাওনি! বন্ধু, এ-জন্মের শেষ নমস্কার তুমি গ্রহণ কর। (শ্রান্তিতে ঢলিয়া পড়িয়া) উঃ— কি ব্যথা!

প্রফুল্ল। (ব্যাকুল কণ্ঠে) ব্যথা কোথায় দাদা?

জীবানন্দ। কোথায়? মাথায়, বুকে, আমার সর্বাঙ্গে, প্রফুল্ল—উঃ—

[দ্রুতপদে ষোড়শী প্রবেশ করিল। তাহার পশ্চাতে এককড়ি ও বল্লভ ডাক্তার]

ষোড়শী। এ কি কথা এরা সব বলে প্রফুল্ল! (জীবানন্দের পদতলে বসিয়া পড়িল) তোমাকে নিয়ে যাবার জন্যে যে আজ সমস্ত ছেড়ে চলে এসেচি! কিন্তু নিষ্ঠুর—অভিমানে এ কি করলে তুমি!

প্রফুল্ল। দাদা, চেয়ে দেখুন অলকা এসেছেন।

জীবানন্দ। অলকা? এলে তুমি? (ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া) কিন্তু, সময় নেই আর।

ষোড়শী। কিন্তু, এই যে সেদিন বললে, তুমি সংসারে বাঁচতে চাও—মানুষের মাঝখানে মানুষের মত হয়ে। তুমি বাড়ি চাও, ঘর চাও, স্ত্রী চাও, সন্তান চাও—

জীবানন্দ। (মাথা নাড়িয়া) না। আজ ফাঁকি দিয়ে আর কিছুই চাইনে অলকা। চিরদিন কেবল ফাঁকি দিয়ে পেয়ে পেয়েই স্পর্ধা বেড়ে গিয়েছিল, ভেবেছিলাম, এমনিই বুঝি। কিন্তু আজ! তার কৈফিয়ত দেবার দিন এসেছে। সৌভাগ্য এ-জীবনে অর্জন করিনি অলকা, সেই ত ঋণ—সে বোঝা আর যেন আমার না বাড়ে।

[ষোড়শী জীবানন্দের বুকের উপরে মাথা রাখিতে তিনি ধীরে ধীরে তাঁহার অক্ষম হাতখানি ষোড়শীর মাথার পরে রাখিলেন]

জীবানন্দ। অভিমান ছিল বৈ কি একটু। তবু যাবার আগে এই ত তোমাকে পেলাম। এর অধিক পাওয়া সংসারের নিত্য কাজে হয়ত বা কখনো ক্ষুণ্ণ, কখনো বা ম্লান হতো, কিন্তু সে ভয় আর রইল না। এ মিলনের আর বিচ্ছেদ নেই, অলকা, এই ভালো। এই ভালো।

[ষোড়শী কথা কহিতে পারিল না, দুঃসহ রোদনের বেগে তাহার সমস্ত বক্ষ ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল]

জীবানন্দ। উঃ! পৃথিবীতে কি আর হাওয়া নেই প্রফুল্ল?

প্রফুল্ল। কষ্ট কি খুব বেশি হচ্চে দাদা? ডাক্তারকে কি একবার ডাকব?

জীবানন্দ। না না, আর ডাক্তার-বদ্যি নয় প্রফুল্ল, শুধু তুমি আর অলকা। উঃ—কি অন্ধকার! সূর্য কি অস্ত গেল ভাই?

প্রফুল্ল। এইমাত্র গেল দাদা।

জীবানন্দ। তাই। হাওয়া নেই, আলো নেই, বিশ্বদেব! এ-জীবনের শেষ দান কি তবে নিঃশেষ করেই নিলে! উঃ—

ষোড়শী। স্বামী!

প্রফুল্ল। প্রফুল্লকে কি আজ সত্যিই ছুটি দিলে দাদা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *