ষোড়শী – ২.৩

তৃতীয় দৃশ্য

ষোড়শীর কুটীর

[নির্মলের প্রবেশ]

ষোড়শী। এ কি, এই রাত্রে শেষে অকস্মাৎ আপনি যে নিমর্লবাবু?

[নির্মল নিরুত্তর]

(হাসিয়া) ওঃ—বুঝেচি। যাবার পূর্বে লুকিয়ে বুঝি একবার দেখে যেতে এলেন?

নির্মল। আপনি কি অন্তর্যামী?

ষোড়শী। তা নইলে কি ভৈরবীগিরি করা যায় নির্মলবাবু? কিন্তু এখানটায় তেমন আলো নেই, আসুন, আমার ঘরের মধ্যে গিয়ে বসবেন চলুন।

নির্মল। রাত্রে একাকী আমাকে ঘরের মধ্যে নিয়ে যেতে চান, আপনার সাহস ত কম নয়?

ষোড়শী। আর সে-রাত্রে অন্ধকারে যখন হাত ধরে নদী পার করে এনেছিলাম তখনি কি ভয়ের লক্ষণ দেখতে পেয়েছিলেন নাকি? সেদিনও ত এমনি একাকী।

নির্মল। সত্যই আপনার সাহসের অবধি নেই।

ষোড়শী। অবধি থাকবে কি করে নির্মলবাবু, ভৈরবী যে! আসুন ঘরে।

নির্মল। না, ঘরে আর যাব না, আমাকে এখনি ফিরতে হবে।

ষোড়শী। তবে এইখানেই বসুন।

[উভয়ের উপবেশন]

ষোড়শী। আজ তা হলে চলে যাওয়াই স্থির?

নির্মল। না, আজ যাওয়া স্থগিত রইল। রাত্রে ফিরে গিয়ে শুনতে পেলাম আজ সন্ধ্যাবেলায় মন্দিরের মধ্যে আপনার বিচার হবে। সে সভায় আমি উপস্থিত থাকতে চাই।

ষোড়শী। কিসের জন্যে? নিছক কৌতূহল, না আমাকে রক্ষে করতে চান?

নির্মল। প্রাণপণে চেষ্টা করব বটে।

ষোড়শী। যদি ক্ষতি হয়, কষ্ট হয়, শ্বশুরের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়, তবুও?

নির্মল। হাঁ, তবুও।

[ষোড়শী হাসিয়া ফেলিল]

(হাসিমুখে) আপনি হাসলেন যে বড়? বিশ্বাস হয় না?

ষোড়শী। হয়। কিন্তু হাসচি আর একটা কথা ভেবে। শুনি, আগেকার দিনে ভৈরবীরা নাকি বিদেশী মানুষদের ভেড়া বানিয়ে রাখত, আচ্ছা, ভেড়া নিয়ে তারা কি করত নির্মলবাবু? চরিয়ে বেড়াত, না লড়াই বাধিয়ে দিয়ে তামাশা দেখত? (বলিতে বলিতে ছেলেমানুষের মত উচ্ছ্বসিত হইয়া হাসিতে লাগিল)

নির্মল। (পরিহাসে যোগ দিয়া, নিজেও হাসিয়া) হয়ত বা মাঝে মাঝে মায়ের স্থানে বলি দিয়ে খেতো।

ষোড়শী। সে ত ভয়ের কথা নির্মলবাবু।

নির্মল। (সহাস্যে মাথা নাড়িয়া) ভয় একটু আছে বৈ কি!

ষোড়শী। একটু থাকা ভালো। হৈমকে সাবধান করে দেওয়া উচিত।

নির্মল। তার মানে?

ষোড়শী। মানে কি সব কথারই থাকে নাকি? (হাসিয়া) কুটুমের অভ্যর্থনা ত হলো। অবশ্য হাসি-খুশী দিয়ে যতটুকু পারি ততটুকু, —তার বেশী ত সম্বল নেই ভাই—এখন আসুন দুটো কাজের কথা কওয়া যাক।

নির্মল। বলুন।

ষোড়শী। (গম্ভীর হইয়া) দুটি লোক দেবতাকে বঞ্চিত করতে চায়। একটি রায়মশায় আর একটি জমিদার—

নির্মল। আর একটি আপনার বাবা।

ষোড়শী। বাবা? হাঁ, তিনিও বটে!

নির্মল। আমার শ্বশুরের কথা বুঝি, আপনার বাবার কথাও কতক বুঝতে পারি, কিন্তু পারিনে এই জমিদার প্রভুটিকে বুঝতে। তিনি কিসের জন্য আপনার শত্রুতা করচেন?

ষোড়শী। দেবীর অনেকখানি জমি তিনি নিজের বলে বিক্রি করে ফেলতে চান। কিন্তু আমি থাকতে ত কোনমতেই হবার জো নেই।

নির্মল। (সহাস্যে) সে আমি সামলাতে পারব।

ষোড়শী। কিন্তু আরও অনেক জিনিস আছে, যা আপনিও হয়ত সামলাতে পারবেন না।

নির্মল। কি সে-সব? একটা ত আপনার মিথ্যে দুর্নাম?

ষোড়শী। (শান্তস্বরে) সে আমি ভাবিনে। দুর্নাম সত্য হোক মিথ্যে হোক, তাই নিয়েই ত ভৈরবীর জীবন নির্মলবাবু। আমি এই কথাটাই তাঁদের বলতে চাই।

নির্মল। (সবিস্ময়ে) নিজের মুখ দিয়ে এ কথা যে স্বীকার করার সমান!

ষোড়শী। তা হবে।

নির্মল। কিন্তু ওরা যে বলে—অনেকেই বলে সে সময়ে, অর্থাৎ ম্যাজিস্ট্রেটের আসার রাত্রে আপনার কোলের উপরেই নাকি—

ষোড়শী। তারা কি দেখেছিল নাকি? তা হবে, আমার ঠিক মনে নেই; যদি দেখে থাকে সে সত্যি। তাঁর সেদিন ভারী অসুখ, আমার কোলে মাথা রেখেই তিনি শুয়েছিলেন।

নির্মল। (ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া) তার পরে?

ষোড়শী। কোনমতে দিন কেটে যাচ্ছে, কিন্তু সেদিন থেকেই কিছুতে আর মন বসাতে পারিনে, সবই যেন মিথ্যে বলে ঠেকেছে।

নির্মল। কি মিথ্যে?

ষোড়শী। সব। ধর্ম, কর্ম, ব্রত, উপবাস, দেবসেবা, এতদিনের যা-কিছু সমস্তই—

নির্মল। তবে কিসের জন্যে ভৈরবীর আসন রাখতে চান?

ষোড়শী। এমনিই। আর আপনি যদি বলেন এতে কাজ নেই—

নির্মল। না না, আমি কিছুই বলিনে। কিন্তু এখন আমি উঠলাম। আপনার হয়ত কত কাজ নষ্ট করলাম।

ষোড়শী। কুটুম্বের অভ্যর্থনা, বন্ধুর মর্যাদা রক্ষা করা, এ কি কাজ নয় নির্মলবাবু?

নির্মল। সকাল হলো, এখন আসি?

ষোড়শী। আসুন। আমারও স্নানের সময় উত্তীর্ণ হয়ে যায়, আমিও চললাম।

[উভয়ের প্রস্থান

[সাগর সর্দার ও ফকিরসাহেবের প্রবেশ]

সাগর। না, এ চলবে না—কোনমতেই চলবে না ফকিরসাহেব। মা নাকি বলেচেন সমস্ত ত্যাগ করে যাবেন। আপনাকে বলচি এ চলবে না।

ফকির। কেন চলবে না সাগর?

সাগর। তা জানিনে। কিন্তু যাওয়া চলবে না। গেলে আমরা তাঁর দীন-দুঃখী প্রজারা সব থাকব কোথায়? বাঁচব কি করে?

ফকির। কিন্তু তোমরা কি শোননি ষোড়শী কত বড় লজ্জা এবং ঘৃণায় সমস্ত ত্যাগ করে যাচ্ছেন?

সাগর। শুনেচি। তাই আরও দশজনের মত আমরাও ভেবে পাইনি কিসের জন্য মা সাহেবের হাত থেকে সে রাত্রে জমিদারকে বাঁচাতে গেলেন। (ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া) ভেবে নাই পেলাম ফকিরসাহেব, কিন্তু এটুকু ত ভেবে পেয়েছি, যাঁকে মা বলে ডেকেছি সন্তান হয়ে আমরা তাঁর বিচার করতে যাব না।

ফকির। তোমরা জন-কতক বিচার না করলেই কি চণ্ডীগড়ে তার বিচার করবার মানুষের অভাব হবে সাগর?

সাগর। কিন্তু তারাই কি মানুষ? আমরা তাঁর ছেলে—আমাদের অন্তরের বিশ্বাসের চেয়ে কি তাদের বাইরের বিচারটাই বড় হবে ফকিরসাহেব? তাদের কি আমরা চিনিনে? একদিন যখন আমাদের সর্বস্ব কেড়ে নিলে তারা, সেও যেমন সত্যি-পাওনার দাবীতে, আবার জেলে যখন দিলে সেও তেমনি সত্যি-সাক্ষীর জোরে।

ফকির। সে আমি জানি।

সাগর। কিন্তু সব কথা ত জানো না। খুড়ো-ভাইপোয় জেল খেটে ফিরে এসে দাঁড়ালাম। বললাম, মা, আমরা যে মরি। মা রাগ করে বললেন, তোরা ডাকাত, তোদের মরাই ভালো। অভিমানে ঘরে ফিরে গেলাম। খুড়ো বললে, ভগবান! গরীবকে বিশ্বাস করতে কেউ নেই। পরের দিন সকালবেলা মা আমাদের ডেকে পাঠিয়ে বললেন, তোদের কাছে আমি মস্ত অপরাধ করেছি বাবা, আমাকে তোরা ক্ষমা কর্‌। তোদের কেউ বিশ্বাস না করুক আমি বিশ্বাস করব। এখনো বিঘে-কুড়ি জমি আমার আছে, তাই তোরা ভাগ করে নে। চণ্ডীর খাজনা তোরা যা ইচ্ছে দিস, কিন্তু অসৎ পথে কখনো পা দিবিনে, এই আমার শর্ত।

ফকির। কিন্তু লোকে যে বলে—

সাগর। বলুক। কিন্তু মা জানলেই হলো সে বিশ্বাস আমরা কখনো ভাঙ্গিনি। জানো ফকিরসাহেব, আমাদের জন্যেই এককড়ি তাঁর শত্রু, আমাদের জন্যেই রায়মশায় তাঁর দুশমন। অথচ, তারা জানেও না কার দয়ায় আজও তারা বেঁচে আছে।

ফকির। কিন্তু আমাকে তোরা ধরে আনলি কেন?

সাগর। কেন? শুনেছি, মুসলমান হয়েও তুমি তাঁর গুরুর চেয়ে বড়, তোমার নিষেধ ছাড়া মাকে কেউ আটকাতে পারবে না।

ফকির। কিন্তু এতবড় অন্যায় নিষেধ আমি কিসের জন্যে করব সাগর?

সাগর। করবে মানুষের ভালর জন্যে।

ফকির। কিন্তু ষোড়শী ঘরে নেই। বেলা যায়, আমিও ত আর অপেক্ষা করতে পারি নে। এখন আমি চললুম।

সাগর। পারবে না থাকতে? করবে না নিষেধ? কিন্তু ফল তার ভাল হবে না।

ফকির। এ-সব কথা মুখেও এনো না সাগর।

সাগর। মা-ও বলেন ও-কথা মুখে আনিস নে সাগর। বেশ মুখে আর আনব না—আমাদের মনের মধ্যেই থাক।

[ফকিরের প্রস্থান

সাগর। সন্ন্যাসী ফকির তুমি, জানো না ডাকাতের বুকের জ্বালা। আমাদের সব গেছে, এর ওপর মা-ও যদি ছেড়ে যায় আমরা বাকী কিছুই রাখব না।

[প্রস্থান
[নির্মল ও ষোড়শীর প্রবেশ]

ষোড়শী। ডেকে নিয়ে এলাম সাধে! ছি, ছি, কি দাঁড়িয়ে যা তা শুনছিলেন বলুন ত! দেবীর মন্দিরে, তার উঠানের মাঝখানে জটলা করে কতকগুলো কাপুরুষ মিলে বিচারের ছলনায় দুজন অসহায় স্ত্রীলোকের কুৎসা রটনা করচে, —তাও আবার একজন মৃত, আর একজন অনুপস্থিত। আসুন আমার ঘরে।

[দুয়ারে আসন পাতা ছিল, নির্মলকে সমাদর করিয়া তাহাতে বসাইয়া ষোড়শী নিজে অদূরে উপবেশন করিল]

ষোড়শী। আপনি নাকি বলেছেন আমার মামলা-মকদ্দমার সমস্ত ভার নেবেন। এ কি সত্যি?

নির্মল। হাঁ, সত্যি।

ষোড়শী। কিন্তু কেন নেবেন?

নির্মল। বোধ হয় আপনার প্রতি অত্যাচার হচ্চে বলে।

ষোড়শী। কিন্তু আর কিছু বোধ করেন না ত? (এই বলিয়া সে মুচকিয়া হাসিল) থাক, সব কথার যে জবাব দিতেই হবে এমন কিছু শাস্ত্রের অনুশাসন নেই। বিশেষ করে এই কূট-কচালে শাস্ত্রের, না? আচ্ছা সে যাক। মকদ্দমার ভার যেন নিলেন, কিন্তু যদি হারি তখন ভার কে নেবে? তখন পেছোবেন না ত?

নির্মল। না, তখনও না।

ষোড়শী। ইস! পরোপকারের কি ঘটা! (হাসিয়া) আমি কিন্তু হৈম হলে এইসব পরোপকার-বৃত্তি ঘুচিয়ে দিতাম। অত ভালমানুষই নই—আমার কাছে ফাঁকি চলত না। রাত্রি-দিন চোখে চোখে রেখে দিতাম।

নির্মল। (বিস্ময়ে, ভয়ে, আনন্দে) চোখে চোখে রাখলেই কি রাখা যায় ষোড়শী? এর বাঁধন যেখানে শুরু হয় চোখের দৃষ্টি যে সেখানে পৌঁছায় না, এ কথা কি আজও জানতে পারনি তুমি।

ষোড়শী। পেরেছি বৈ কি। (হাসিল; বাহিরের শব্দ শুনিয়া গলা বাড়াইয়া চাহিয়া) এই যে ইনি এসেছেন।

নির্মল। কে? ফকিরসাহেব?

ষোড়শী। না, জমিদারবাবু। বলেছিলাম সভা ভাঙলে যাবার পথে আমার কুঁড়েতে একবার একটু পদধূলি দিতে। তাই দিতেই বোধ হয় আসচেন।

নির্মল। (বিরক্তি ও সঙ্কোচে আড়ষ্ট হইয়া) তা হলে আপনি আমাকে এ কথা বলেন নি কেন?

ষোড়শী। বেশ! একবার ‘তুমি’ একবার ‘আপনি’! (হাসিয়া) ভয় নেই, উনি ভারী ভদ্রলোক; লড়াই করেন না। তা ছাড়া আপনাদের পরিচয় নেই; সেটাও একটা লাভ। (দ্বারের নিকটে অগ্রসর হইয়া অভ্যর্থনা করিয়া) আসুন।

জীবানন্দ। (প্রবেশ করিয়াই থমকিয়া দাঁড়াইয়া) ইনি? নির্মলবাবু বোধ হয়।

ষোড়শী। হাঁ, আপনার বন্ধু বলে পরিচয় দিলে খুব সম্ভব অতিশয়োক্তি হবে না।

জীবানন্দ। (হাসিয়া) বিলক্ষণ! বন্ধু নয় ত কি? ওঁদের কৃপাতেই ত টিকে আছি, নইলে মামার জমিদারি পাওয়া পর্যন্ত যে-সব কীর্তি করা গেছে তাতে চণ্ডীগড়ের শান্তিকুঞ্জের বদলে ত এতদিন আন্দামানের শ্রীঘরে গিয়ে বসবাস করতে হতো।

ষোড়শী। চৌধুরীমশাই, উকিল-ব্যারিস্টার বড়লোক বলে বাহবাটা কি একা ওঁরাই পাবেন। আন্দামান প্রভৃতি বড় ব্যাপারে না হোক, কিন্তু ছোটো বলে এদেশের শ্রীঘরগুলোও ত মনোরম স্থান নয়—দুঃখী বলে ভৈরবীরা কি একটু ধন্যবাদ পেতেও পারে না?

জীবানন্দ। (অপ্রস্তুত হইয়া) ধন্যবাদ পাবার সময় হলেই পাবে।

ষোড়শী। (হাসিয়া) এই যেমন সভায় দাঁড়িয়ে এইমাত্র এক দফা দিয়ে এলেন?

[জীবানন্দ স্তব্ধ হইয়া রহিল]

ষোড়শী। নির্মলবাবু না থাকলে আজ আপনার সঙ্গে আমি ভারী ঝগড়া করতাম। ছি—এ কি কোন পুরুষের পক্ষেই সাজে? তা ছাড়া কি প্রয়োজন ছিল বলুন ত? সেদিন এই ঘরে বসেই ত আপনাকে বলেছিলাম, আপনি আমাকে যা আদেশ করবেন আমি পালন করব। আপনিও আপনার হুকুম স্পষ্ট করেই জানিয়েছিলেন। এই নিন সিন্দুকের চাবি এবং নিন হিসাবের খাতা। (অঞ্চল হইতে সিন্দুকের চাবি খুলিয়া এবং তাকের উপর হইতে একখানা খেরো-বাঁধানো মোটা খাতা পাড়িয়া জীবানন্দের পায়ের কাছে রাখিয়া দিল) মায়ের যা-কিছু অলঙ্কার, যত-কিছু দলিলপত্র সিন্দুকের ভিতরেই পাবেন, এবং আর একখানা কাগজ ঐ খাতার মধ্যে পাবেন, যাতে ভৈরবীর সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য ত্যাগ করে আমি সই করে দিয়েছি।

জীবানন্দ। (অবিশ্বাস করিয়া) বল কি! কিন্তু ত্যাগ করলে কার কাছে?

ষোড়শী। তাতেই লেখা আছে দেখতে পাবেন।

জীবানন্দ। তাই যদি হয় ত এই চাবিগুলো তাঁকেই দিলে না কেন?

ষোড়শী। তাঁকেই যে দিলাম।

জীবানন্দ। (মলিন-মুখে ও সন্দিগ্ধ-কণ্ঠে) কিন্তু এ ত আমি নিতে পারিনে ষোড়শী। খাতায় লেখা নামগুলোর সঙ্গে সিন্দুকে রাখা জিনিসগুলোও যে এক হবে, সে আমি কি করে বিশ্বাস করব? তোমার আবশ্যক থাকে তুমি পাঁচজনের কাছে বুঝিয়ে দিয়ো।

ষোড়শী। (ঘাড় নাড়িয়া) আমার সে আবশ্যক নেই। কিন্তু চৌধুরীমশায়, আপনার এ অজুহাতও অচল। চোখ বুজে যার হাত থেকে বিষ নিয়ে খাবার ভরসা হয়েছিল, তার হাত থেকে আজ চাবিটুকু নেবার সাহস নেই, এ আমি মানিনে। নিন, ধরুন। (খাতা ও চাবি তুলিয়া জীবানন্দের হাতের মধ্যে একরকম জোর করিয়া গুঁজিয়া দিল) আজ আমি বাঁচলাম। (কোমল কণ্ঠস্বরে) আর একটিমাত্র ভার আপনাকে দিয়ে যাব, সে আমার গরীব-দুঃখী প্রজাদের ভবিষ্যৎ। আমি শত ইচ্ছে করেও তাদের ভাল করতে পারিনি—আপনি অনায়াসে পারবেন। (নির্মলের প্রতি) আমার কথাবার্তা শুনে আপনি আশ্চর্য হয়ে গেছেন, না নির্মলবাবু?

নির্মল। (মাথা নাড়িয়া) শুধু আশ্চর্য নয়, আমি প্রায় অভিভূত হয়ে পড়েছি। ভৈরবীর আসন ত্যাগ করে যে আপনি ইতিমধ্যে ছাড়পত্র পর্যন্ত সই করে রেখেছেন, এ খবর ত আমাকে ঘুণাগ্রে জানান নি?

ষোড়শী। আমার অনেক কথাই আপনাকে জানানো হয়নি, কিন্তু একদিন হয়ত সমস্তই জানতে পারবেন। কেবল একটিমাত্র মানুষ সংসারে আছেন যাঁকে সকল কথাই জানিয়েছি, সে আমার ফকিরসাহেব।

নির্মল। এ-সকল পরামর্শ বোধ হয় তিনিই দিয়েছেন?

ষোড়শী। না, তিনি এখন পর্যন্ত কিছুই জানেন নি, এবং ওই যাকে ছাড়পত্র বলচেন সে আমার একটু আগের রচনা। যিনি এ কাজে আমাকে প্রবৃত্তি দিয়েছেন, শুধু তাঁর নামটিই আমি সংসারে সকলের কাছে গোপন রাখব।

জীবানন্দ। মনে হচ্ছে যেন ডেকে এনে আমার সঙ্গে কি একটা প্রকাণ্ড তামাশা করচ ষোড়শী। এ বিশ্বাস করা যেন সেই ‘মরফিয়া’ খাওয়ার চেয়েও শক্ত ঠেকচে।

নির্মল। (হাসিয়া জীবানন্দের প্রতি চাহিয়া) আপনি তবু এই কয়েক পা মাত্র হেঁটে এসে তামাশা দেখচেন, কিন্তু আমাকে কাজকর্ম, বাড়ি-ঘর ফেলে রেখে এই তামাশা দেখতে হচ্ছে।

আর এ যদি সত্য হয় ত আপনি যা চেয়েছিলেন সেটা অন্ততঃ পেয়ে গেলেন কিন্তু আমার ভাগ্যে ষোল আনাই লোকসান। (ষোড়শীকে) বাস্তবিক এ সকল ত আপনার পরিহাস নয়?

ষোড়শী। না নির্মলবাবু, আমার এবং আমার মায়ের কুৎসায় দেশ ছেয়ে গেল, এই কি আমার হাসি-তামাশার সময়? আমি সত্য সত্যই অবসর নিলাম।

নির্মল। তা হলে বড় দুঃখে পড়েই এ কাজ আপনাকে করতে হলো। আমি আপনাকে বাঁচাতেও হয়ত পারতাম, কিন্তু কেন যে তা হতে দিলেন না তা আমি বুঝেছি। বিষয় রক্ষা হতো, কিন্তু কুৎসার ঢেউ তাতে উত্তাল হয়ে উঠত। সে থামাবার সাধ্য আমার ছিল না। (এই বলিয়া সে কটাক্ষে জীবানন্দের প্রতি চাহিল)

নির্মল। এখন তা হলে কি করবেন স্থির করেছেন?

ষোড়শী। সে আপনাকে আমি পরে জানাব।

নির্মল। কোথায় থাকবেন?

ষোড়শী। এ খবরও আপনাকে আমি পরে দেব।

নির্মল। (হাতঘড়ি দেখিয়া) রাত প্রায় দশটা। আচ্ছা, এখন আমি তা হলে, —আমাকে আর বোধ হয় কোন আবশ্যক নেই?

ষোড়শী। এতবড় অহঙ্কারের কথা কি বলতে পারি নির্মলবাবু? তবে মন্দির নিয়ে আর বোধ হয় আমার কখনো আপনাকে দুঃখ দেবার প্রয়োজন হবে না।

নির্মল। আমাদের শীঘ্র ভুলে যাবেন না আশা করি?

ষোড়শী। (মাথা নাড়িয়া) না।

নির্মল। হৈম আপনাকে বড় ভালবাসে। যদি অবকাশ পান মাঝে মাঝে একটা খবর দেবেন।

[নির্মল প্রস্থান করিল

জীবানন্দ। ভদ্রলোকটিকে ঠিক বুঝতে পারলাম না।

ষোড়শী। না পারলেও আপনার ক্ষতি হবে না।

জীবানন্দ। আমার না হোক তোমার ত হতে পারে। মনে রাখবার জন্যে কি ব্যাকুল প্রার্থনাই জানিয়ে গেলেন।

ষোড়শী। সে শুনেছি। কিন্তু আমি তাঁকে যতখানি জানি তার অর্ধেকও আমাকে জানলে আজ এতবড় বাহুল্য আবেদন তাঁর করতে হতো না।

জীবানন্দ। অর্থাৎ?

ষোড়শী। অর্থাৎ এই যে চণ্ডীগড়ের ভৈরবী-পদ অনায়াসে জীর্ণবস্ত্রের মত ত্যাগ করে যাচ্ছি সে শিক্ষা কোথায় পেলাম জানেন? ওঁদের কাছে। মেয়েমানুষের কাছে এ যে কত ফাঁকি, কত মিথ্যে, সে বুঝেছি কেবল হৈমকে দেখে। অথচ এর বাষ্পও কোনদিন তাঁরা জানতে পারবেন না।

জীবানন্দ। তথাপি এ হেঁয়ালি হেঁয়ালিই রয়ে গেল অলকা। একটা কথা স্পষ্ট করে জিজ্ঞাসা করতে আমার ভারী লজ্জা করে; কিন্তু যদি পারতাম, তুমি কি তার সত্য জবাব দিতে পারতে?

ষোড়শী। (সহাস্যে) আপনি যদি কোন একটা আশ্চর্য কাজ করতে পারতেন, তখন আমিও তেমনি কোন একটা অদ্ভুত কাজ করতে পারতাম কিনা, এ আমি জানিনে—কিন্তু আশ্চর্য কাজ করবার আপনার প্রয়োজন নেই—আমি বুঝেছি। অপবাদ সকলে মিলে দিয়েছে বলেই তাকে সত্য করে তুলতে হবে তার অর্থ নেই। আমি কিছুর জন্যেই কখনো কারও আশ্রয় গ্রহণ করব না। আমার স্বামী আছেন, কোন লোভেই সে কথা আমি ভুলতে পারব না। এই ভয়ানক প্রশ্নটাই না আপনাকে লজ্জা দিচ্ছিল চৌধুরীমশাই?

জীবানন্দ। তুমি আমাকে চৌধুরীমশাই বল কেন?

ষোড়শী। তবে কি বলব? হুজুর?

জীবানন্দ। না। অনেকে যা বলে ডাকে—জীবানন্দবাবু।

ষোড়শী। বেশ, ভবিষ্যতে হবে। কিন্তু রাত্রি হয়ে যাচ্চে আপনি বাড়ি গেলেন না? আপনার লোকজন কৈ?

জীবানন্দ। আমি তাদের পাঠিয়ে দিয়েচি।

ষোড়শী। একলা বাড়ি যেতে আপনার ভয় করবে না?

জীবানন্দ। না, আমার পিস্তল আছে।

ষোড়শী। তবে তাই নিয়ে বাড়ি যান, আমার ঢের কাজ আছে।

জীবানন্দ। তোমার থাকতে পারে, কিন্তু আমার নেই। আমি এখন যাব না।

ষোড়শী। (প্রখর চোখে, অথচ শান্তস্বরে) আমি লোক ডেকে আপনার সঙ্গে দিচ্চি, তারা বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবে।

জীবানন্দ। (অপ্রতিভ হইয়া) ডাকতে কাউকে হবে না, আমি আপনিই যাচ্ছি। যেতে আমার ইচ্ছে হয় না। তাই শুধু আমি বলছিলাম। তুমি কি সত্যই চণ্ডীগড় ছেড়ে চলে যাবে অলকা?

ষোড়শী। (ঘাড় নাড়িয়া) হাঁ।

জীবানন্দ। কবে যাবে?

ষোড়শী। কি জানি, হয়ত কালই যেতে পারি।

জীবানন্দ। কাল? কালই যেতে পার? (একান্ত স্তব্ধ রহিয়া) আশ্চর্য! মানুষের নিজের মন বুঝতেই কি ভুল হয়! যাতে তুমি যাও সেই চেষ্টাই প্রাণপণে করেছি—অথচ, তুমি চলে যাবে শুনে চোখের সামনে সমস্ত দুনিয়াটা যেন শুকনো হয়ে গেল। তোমাকে তাড়াতে পারলে, ওই যে জমিটা দেনার দায়ে বিক্রি করেছি সে নিয়ে আর গোলমাল হবে না—কতকগুলো নগদ টাকাও হাতে এসে পড়বে, আর, —আর তোমাকে যা হুকুম করব তাই তুমি করতে বাধ্য হবে, এই দিকটাই কেবল দেখতে পেয়েছি। কিন্তু আরও যে একটা দিক আছে, স্বেচ্ছায় তুমি সমস্ত ত্যাগ করে আমার মাথাতেই বোঝা চাপিয়ে দিলে সে ভার বইতে পারব কিনা, এ কথা আমার স্বপ্নেও মনে হয়নি। আচ্ছা অলকা, এমন ত হতে পারে আমার মত তোমারও ভুল হচ্ছে, —তুমিও নিজের মনের ঠিক খবরটি পাওনি! জবাব দাও না যে?

ষোড়শী। জবাব খুঁজে পাইনে। হঠাৎ বিস্ময় লাগে এ কি আপনার কথা!

জীবানন্দ। তবে এই কথাটা বল, সেখানে তোমার চলবে কি করে?

ষোড়শী। অত্যন্ত অনাবশ্যক কৌতূহল চৌধুরীমশায়।

জীবানন্দ। তাই বটে, অলকা তাই বটে। আজ আমার আবশ্যক-অনাবশ্যক তোমাকে বোঝাব আমি কি দিয়ে!

[বাহিরে পূজারীর কাশি ও পায়ের শব্দ শুনা গেল। অতঃপর তিনি প্রবেশ করিলেন]

পূজারী। মা, সকলের সম্মুখে মন্দিরের চাবিটা আমি তারাদাস ঠাকুরের হাতেই দিলাম। রায়মশায়, শিরোমণি—এঁরা উপস্থিত ছিলেন।

ষোড়শী। ঠিকই হয়েছে। তুমি একটু দাঁড়াও, আমি সাগরের ওখানে একবার যাব।

জীবানন্দ। এগুলোও তা হলে তুমি রায়মশায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়ো।

ষোড়শী। না, সিন্দুকের চাবি আর কারও হাতে দিয়ে আমার বিশ্বাস হবে না।

জীবানন্দ। তবে কি বিশ্বাস হবে শুধু আমাকেই?

[ষোড়শী কোন উত্তর না দিয়া জীবানন্দের পায়ের কাছে গড় হইয়া প্রণাম করিল। উঠিয়া দাঁড়াইয়া বিস্ময়ে অভিভূত পূজারীকে কহিল]

ষোড়শী। চল বাবা, আর দেরি করো না।

পূজারী। চল, মা চল।

[পূজারী ও ষোড়শী প্রস্থান করিলে একাকী জীবানন্দ সেই জনহীন কুটীর-অঙ্গনে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *