রমা – ৪.৫

পঞ্চম দৃশ্য

রমার কক্ষ

[রমেশ প্রবেশ করিয়া রমাকে দেখিয়া চমকিয়া গেল]

রমেশ। তোমার এত অসুখ করেচে তা ত আমি ভাবিনি!

[রমা শয্যা হইতে কোনমতে উঠিয়া রমেশের পায়ের কাছে প্রণাম করিল ]

রমেশ। এখন কেমন আছ রানী?

রমা। আমাকে আপনি রমা বলেই ডাকবেন।

রমেশ। বেশ তাই। শুনেছিলাম তুমি অসুস্থ ছিলে। এখন কেমন আছ এই খবরটাই জানতে চাচ্ছিলাম। নইলে, নাম তোমার যাই হোক, সে ধরে ডাকবার আমার ইচ্ছেও নেই, আবশ্যকও নেই।

রমা। এখন আমি ভাল আছি। আমি ডেকে পাঠিয়েচি বলে আপনি হয়ত খুব আশ্চর্য হয়েচেন, কিন্তু—

রমেশ। না, হইনি। তোমার কোন কাজে আশ্চর্য হবার দিন আমার কেটে গেছে। কিন্তু ডেকে পাঠিয়েচ কেন শুনি?

রমা। (ক্ষণকাল অধোমুখে নিরুত্তর হইয়া থাকিয়া) রমেশদা, আজ দুটি কাজের জন্যে তোমাকে কষ্ট দিয়ে ডেকে এনেচি। কত যে অপরাধ করেচি সে ত জানি, তবুও আমি নিশ্চয় জানতাম তুমি আসবেই। আর আমার এই শেষ অনুরোধ-দুটিও অস্বীকার করবে না।

[বলিতে বলিতে অশ্রুভারে গলা তাহার ভাঙ্গিয়া আসিল]

রমেশ। কি তোমার অনুরোধ?

রমা। (চকিতের ন্যায় মুখ তুলিয়াই পুনরায় আনত করিল) পীরপুরের যে বিষয়টা বড়দা তোমার সাহায্যে দখল করতে চাচ্ছেন সেটা আমার নিজের। বাবা বিশেষ করে আমাকেই সেটা দিয়ে গেছেন। তার পোনর-আনা আমার, এক আনা তোমাদের। সেইটেই তোমাকে আমি দিয়ে যেতে চাই।

রমেশ। তোমার ভয় নেই, বড়দা যাই কেন না আমাকে বলুন, আমি চুরি করতে পূর্বেও কখনো কাউকে সাহায্য করিনি, এখনো করব না। আর যদি দান করতেই চাও, তার জন্যে অন্য লোক আছে। আমি দান গ্রহণ করিনে।

রমা। আমি জানি রমেশদা, তুমি চুরি করতে সাহায্য করবে না। আর নিলেও যে তুমি নিজের জন্যে নেবে না সেও আমি জানি। কিন্তু তা ত নয়। দোষ করলে শাস্তি হয়। আমি যত অপরাধ করেচি, এটা তারই দণ্ড বলে কেন গ্রহণ কর না?

রমেশ। তোমার দ্বিতীয় অনুরোধ?

রমা। আমার যতীনকে আমি তোমার হাতে দিয়ে গেলাম—

রমেশ। দিয়ে গেলাম মানে?

রমা। (রমেশের মুখের প্রতি চাহিয়া) একদিন কোন মানেই তোমার কাছে গোপন থাকবে না রমেশদা,—তাই, আমার যতীনকে আমি তোমাকেই দিয়ে যাব। তাকে তোমার মত করেই মানুষ কোরো। বড় হয়ে সে যেন তোমারি মত স্বার্থত্যাগ করতে পারে। (আঁচলে চোখ মুছিয়া) এ আমার চোখে দেখে যাবার সময় হবে না। কিন্তু শেখালে হয়ত সেও একদিন তোমারি মত মাথা উঁচু কোরে দাঁড়াবে।

[রমেশ চুপ করিয়া রহিল]

রমা। চুপ কোরে থাকলে ত আজ তোমাকে ছাড়ব না রমেশদা।

রমেশ। দেখ, এ-সকলের মধ্যে আর আমাকে টেনো না। আমি অনেক দুঃখের পরে একটুখানি আলোর শিখা জ্বালতে পেরেচি, তাই কেবলই ভয় হয়, পাছে একটুতেই তা নিবে যায়।

রমা। তোমার ভয় নেই রমেশদা, এ আলো আর নিববে না। জ্যাঠাইমা বলছিলেন, তুমি দূর থেকে এসে বড় উঁচুতে বসে কাজ করতে চেয়েছিলে বলেই এত বাধা পেয়েচ।তখন পরের মত তুমি গ্রাম্য-সমাজের অতীত ছিলে, এখন হয়েচ তাদেরই একজন। তখন তোমার দেওয়া ছিল বিদেশীর দান, আজ হয়েচে তা আত্মীয়ের স্নেহের উপহার। দুঃখ পেয়ে দুঃখ সয়ে সে তুমি আর নেই। তাই এ আলো আর ম্লান হবে না,—এখন প্রতিদিনই উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

রমেশ। ঠিক জান রমা, আমার এই দীপের শিখাটুকু আর নিববে না?

রমা। ঠিক জানি। যিনি সব জানেন, এ সেই জ্যাঠাইমার কথা। এ কাজ তোমারি। আমার যতীনকে তুমি হাতে তুলে নিয়ে, আমার সকল অপরাধ ক্ষমা কোরে, আজ আশীর্বাদ কর যেন নিশ্চিন্ত হয়ে আমি যেতে পারি।

রমেশ। কিন্তু যাবার কথাই বা তুমি কেন ভাবচ রমা,—আমি বলচি তুমি আবার ভাল হয়ে যাবে।

রমা। ভাল হবার কথা ত ভাবচি নে রমেশদা, শুধু ভাবচি আমার যাবার কথা। কিন্তু আরও একটি অনুরোধ তোমাকে রাখতে হবে। আমার কথা নিয়ে বড়দার সঙ্গে তুমি কোনদিন বিবাদ করো না।

রমেশ। এ কথার মানে?

রমা। মানে যদি কখনো শুনতে পাও, সেদিন কেবল এই কথাটি মনে কোরো, আমি কেমন কোরে নিঃশব্দে সহ্য করে চলে গেছি—একটি কথারও প্রতিবাদ করিনি। একদিন যখন অসহ্য মনে হয়েছিল, সেদিন জ্যাঠাইমা এসে বলেছিলেন,—মা, মিথ্যেকে ঘাঁটাঘাঁটি করে জাগিয়ে তুললেই তার পরমায়ু বেড়ে ওঠে। নিজের অসহিষ্ণুতায় তার আয়ু বাড়িয়ে তোলার মত পাপ আর নেই। তাঁর এই উপদেশটি তুমিও কখনো ভুলো না রমেশদা।

[রমেশ নীরবে তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল]

রমা। আজ আমাকে তুমি ক্ষমা করতে পারচ না ভেবে দুঃখ পেয়ো না রমেশদা। আমি ঠিক জানি আজ যা কঠিন মনে হচ্ছে, একদিন তাই সোজা হয়ে যাবে। সেদিন আমার সকল অপরাধ তুমি সহজেই ক্ষমা করবে জেনে মনের মধ্যে আর আমার ক্লেশ নেই।—কাল সকালেই আমি যাচ্চি।

রমেশ। কাল সকালেই? কোথায় যাবে কাল?

রমা। জ্যাঠাইমা যেখানে নিয়ে যাবেন আমি সেইখানেই যাব।

রমেশ। কিন্তু তিনি ত আর আসবেন না শুনচি।

রমা। আমিও না। আমিও তোমার পায়ে আজ জন্মের মতই বিদায় নিলাম।

[এই বলিয়া রমা মাটিতে মাথা ঠেকাইয়া প্রণাম করিল]

রমেশ। আচ্ছা যাও। কিন্তু অকস্মাৎ কেন বিদায় নিলে তাও কি জানতে পারব না?

[রমা মৌন হইয়া রহিল]

রমেশ। কেন যে তোমার সমস্ত কথাই লুকিয়ে রেখে চলে গেলে সে তুমিই জান। কিন্তু আমিও কায়মনে প্রার্থনা করি, একদিন যেন তোমাকে সর্বান্তঃকরণে ক্ষমা করতে পারি। তোমাকে ক্ষমা করতে না পারায় যে আমার কি ব্যথা, সে শুধু আমিই জানি।

[এই সময়ে বিশ্বেশ্বরী প্রবেশ করিয়া ডাকিলেন—]

বিশ্বেশ্বরী। রমা!

রমেশ। জ্যাঠাইমা! কি অপরাধে আমাদের এত শীঘ্র ত্যাগ করে চললে?

বিশ্বেশ্বরী। অপরাধ? অপরাধের কথা বলতে গেলে ত শেষ হবে না বাবা। তাতে কাজ নেই। কিন্তু আমার নিজের কথাটা তুই জেনে রাখ্‌। এখানে যদি মরি রমেশ, বেণী আমার মুখে আগুন দেবে। সে হলে ত মুক্তি পাব না বাবা। ইহকালটা ত জ্বলে-জ্বলেই গেল, পাছে পরকালটাও এমনি জ্বলে-পুড়ে মরি, আমি সেই ভয়েই পালাচ্চি রমেশ।

রমেশ। জ্যাঠাইমা, ছেলের অপরাধ যে তোমার বুকে এমন কোরে বেজেছিল সে ত কোনদিন জানতে দাওনি? কিন্তু সমস্ত ছেড়ে রমা কেন বিদায় নিতে চায়? তাকে তুমি কোথায় নিয়ে যাবে?

রমা। আমি আসচি জ্যাঠাইমা।

[প্রস্থান]

বিশ্বেশ্বরী। জিজ্ঞেসা করছিলি রমা কেন বিদায় নিতে চায়? কোথায় তাকে আমি নিয়ে যেতে চাই? সংসারে আর তার স্থান হোল না রমেশ, তাই তাকে এবার ভগবানের পায়ের নীচে নিয়ে যাব। সেখানে গিয়েও সে বাঁচে কিনা জানিনে, কিন্তু যদি বাঁচে, বাকি জীবনটা এই অতি-কঠিন প্রশ্নের মীমাংসা করতে বলব, কেন ভগবান তাকে এত রূপ, এত গুণ, এতবড় একটা মহাপ্রাণ দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন, আর কেনই বা বিনা দোষে দুঃখের বোঝা মাথায় দিয়ে আবার সংসারের বাইরে ফেলে দিলেন। এ কি তাঁরই অভিপ্রায়, না এ শুধু আমাদের সমাজের খেয়ালের খেলা! ওরে রমেশ, তার মত দুঃখিনী বুঝি আর পৃথিবীতে নেই।

[বলিতে বলিতে তাঁহার গলা ভাঙ্গিয়া পড়িল। রমেশ নীরবে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল]

বিশ্বেশ্বরী। কিন্তু তোর ওপর আমার এই আদেশ রইল রমেশ, তাকে যেন তুই ভুল বুঝিস নে। যাবার সময় আমি কারও বিরুদ্ধে কোন নালিশ করে যেতে চাইনে, শুধু এই কথাটা আমার তুই ভুলেও কখনো অবিশ্বাস করিস নে যে, তার বড় মঙ্গলাকাঙ্ক্ষিনী তোর আর নেই।

রমেশ। কিন্তু জ্যাঠাইমা

বিশ্বেশ্বরী। এর মধ্যে কোন ‘কিন্তু’ নেই রমেশ। তুই যা শুনেচিস সব মিথ্যে, যা জেনেচিস সব ভুল, কিন্তু এ অভিযোগের এইখানেই যেন শেষ হয়। তোর কল্যাণের কাজ যেন বন্যার মত সমস্ত দ্বেষ-হিংসা ভাসিয়ে নিয়ে বয়ে যেতে পারে, তোর ওপর এই তার শেষ প্রার্থনা। এই জন্যেই সে মুখ বুজে সমস্ত সহ্য করেছে। প্রাণ দিতে বসেচে রমেশ, তবু কথা কয়নি।

রমেশ। তাকে বোলো জ্যাঠাইমা—

বিশ্বেশ্বরী। পারিস ত নিজেই তাকে বলিস রমেশ, আমার আর সময় নেই।

[প্রস্থান]

[যতীনকে সঙ্গে লইয়া রমা প্রবেশ করিল। তাহার পরিধানে
দূরে বাহিরে যাইবার পরিচ্ছদ]

রমেশ। (সবিস্ময়ে) এ কি! এত রাত্রে এ বেশ কেন?

রমা। যাত্রা করে বেরিয়ে এলাম রমেশদা, রাত আর নেই। যাবার আগে দুটি কাজ বাকী ছিল। এক তোমার শেষ পায়ের ধুলো নেওয়া, আর যতীনকে তোমার হাতে তুলে দেওয়া।

রমেশ। এ ভার আমাকেই দিয়ে যাবে রমা?

রমা। রমা ত নয়,—রানী। তার সবচেয়ে আদরের ধন এই ছোট ভাইটি। তাকে তুমি ছাড়া আর কে নিতে পারে রমেশদা?

রমেশ। কিন্তু এর কতবড় দায়িত্ব—এ অনুরোধ রমা—

রমা। এখনো রমা—? কিন্তু এ ত অনুরোধ নয়, এ তার দাবী! এই দাবী নিয়েই সে সংসারে একদিন এসেছিল, এই দাবী নিয়েই সে সংসার থেকে যাবে। এ দাবীর ত অন্ত নেই রমেশদা,—একে তুমি ফাঁকি দেবে কি কোরে? এই নাও।

[এই বলিয়া সে যতীনকে তাহার হাতে দিয়া
পায়ের নীচে গড় হইয়া প্রণাম করিল]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *