রমা – ৩.৩

তৃতীয় দৃশ্য

বনাকীর্ণ নির্জন গ্রাম্যপথ

[রমেশ দ্রুতপদে প্রবেশ করিল। রমা অন্তরাল হইতে ডাকিল—রমেশদা? এবং পরক্ষণেই সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল]

রমেশ। রমা! এত দূরে এই নির্জন পথে তুমি?

রমা। আমি জানি পীরপুরের ইস্কুলের কাজ সেরে এই পথে আপনি নিত্য যান।

রমেশ। তা যাই। কিন্তু তুমি কেন?

রমা। শুনেছিলাম এখানে আর আপনার শরীর ভাল থাকচে না। এখন কেমন আছেন?

রমেশ। ভালো নয়। মনে হয় রোজ রাত্রেই যেন জ্বর হয়।

রমা। তা হলে কিছুদিন বাইরে ঘুরে এলে ত ভাল হয়!

রমেশ। (হাসিয়া) ভাল ত হয় জানি, কিন্তু যাই কি কোরে?

রমা। হাসলেন যে বড়? আপনি বলবেন আপনার অনেক কাজ, কিন্তু এমন কাজ কি আছে যা নিজের শরীরের চেয়েও বড়?

রমেশ। নিজের শরীরটা যে ছোট জিনিস তা আমি বলিনে। কিন্তু এমন কাজ মানুষের আছে যা এই দেহটার চেয়েও বড়। কিন্তু সে ত তুমি বুঝবে না রমা।

রমা। আমি বুঝতেও চাইনে। কিন্তু আপনাকে আর কোথাও যেতেই হবে। সরকারমশায়কে বলে দিয়ে যান আমি তাঁর কাজকর্ম দেখবো।

রমেশ। তুমি দেখবে আমার কাজকর্ম?

রমা। কেন, পারবো না?

রমেশ। পারবে। হয়ত আমার নিজের চেয়েও ভাল পারবে, কিন্তু পেরে কাজ নেই। আমি তোমাকে বিশ্বাস করবো কি করে?

রমা। রমেশদা, ইতরে বিশ্বাস করতে পারে না। কিন্তু আপনি পারবেন। না পারলে সংসারে বিশ্বাস করার কথাটা উঠে যাবে। আমাকে এই ভারটুকু আপনি দিয়ে যান।

রমেশ। (ক্ষণকাল নীরবে তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া) আচ্ছা, ভেবে দেখি।

রমা। কিন্তু ভাববার ত সময় নেই। আজই আপনাকে আর কোথাও যেতে হবে। না গেলে

রমেশ। (পুনশ্চ তাহার মুখের প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া) তোমার কথার ভাবে মনে হয়, না গেলে আমার বিপদের সম্ভাবনা। ভালো, যাই-ই যদি তাতে তোমার লাভ কি? আমাকে বিপদে ফেলতে তুমি নিজেও ত কম চেষ্টা করোনি যে, আজ আর একটা বিপদে সতর্ক করতে এসেচো। সে-সব কাণ্ড এত পুরোনো হয়নি যে তোমার মনে নেই। বরঞ্চ খুলে বলো আমি চলে গেলে তোমার নিজের কি সুবিধে হয়,—হয়ত তোমার জন্যে আমি রাজী হতেও পারি।

রমা। (এই কঠিন আঘাতে রমার মুখ বিবর্ণ হইয়া উঠিল, কিন্তু আপনাকে সে সামলাইয়া লইল) আচ্ছা, খুলেই বলচি। আপনি গেলে আমার লাভ কিছুই নেই, কিন্তু না গেলে অনেক ক্ষতি। আমাকে সাক্ষী দিতে হবে।

রমেশ। এই? মাত্র এইটুকু? কিন্তু সাক্ষী না দিলে?

রমা। না দিলে আমার মহামায়ার পূজোয় কেউ আসবে না, আমার যতীনের উপনয়নে কেউ খাবে না, আমার বারব্রত, ধর্মকর্ম,—না রমেশদা, আপনি যান আমি মিনতি করচি। থেকে, সব দিক দিয়ে আমাকে নষ্ট করবেন না।

রমেশ। (একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া) বেশ, আমি যাবো। আমার আরব্ধ কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই যাবো,—কিন্তু নিজের কাছে নিজেকে কি জবাব দেব?

রমা। জবাব নেই। আর কেউ হলে জবাবের অভাব ছিল না, কিন্তু এক অতি ক্ষুদ্র নারীর অখণ্ড স্বার্থপরতার উত্তর আপনি কোথায় খুঁজে পাবেন রমেশদা! আপনাকে নিরুত্তরেই যেতে হবে।

রমেশ। বেশ, তাই হবে। কিন্তু আজ আমার সাধ্য নেই।

রমা। সত্যিই সাধ্য নেই?

রমেশ। না। তোমার সঙ্গে কে আছে তাকে ডাকো।

রমা। সঙ্গে আমার কেউ নেই। আমি একাই এসেচি।

রমেশ। একা এসেছো? সে কি কথা রানী,—একলা এলে কোন্‌ সাহসে?

রমা। সাহস এই ছিল যে, আমি নিশ্চয় জানতাম এই পথে আপনার দেখা পাবো। তার পরে আর আমার ভয় কিসের?

রমেশ। ভালো করোনি রমা, সঙ্গে অন্ততঃ তোমার দাসীকেও আনা উচিত ছিল। এই নিস্তব্ধ জনহীন পথে আমাকেও ত তোমার ভয় করা কর্তব্য।

রমা। তোমাকে? ভয় করবো আমি তোমাকে?

রমেশ। নয় কেন?

রমা। (মাথা নাড়িয়া) না, কোনমতেই না। আর যা খুশি উপদেশ দাও রমেশদা, সে আমি শুনবো। কিন্তু তোমাকে ভয় করবার ভয় আমাকে দেখিয়ো না।

রমেশ। আমাকে তোমার এতই অবহেলা?

রমা। হাঁ, এতই অবহেলা। বলছিলে, দাসীকে সঙ্গে না এনে ভালো করিনি। কিন্তু কিসের জন্যে শুনি? ভেবেচো তোমার হাত থেকে বাঁচবার জন্যে দাসীর শরণাপন্ন হবো? রমার চেয়ে তোমার কাছে সে-ই হবে বড়? (রমেশ নিঃশব্দে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল) মনে নেই সকালের কথা? সেখানে লোকের অভাব ছিল না। তবু সেই মূর্তি দেখে সবাই যখন পালিয়ে গেল, তখন কে রক্ষে করেছিল ভৈরব আচায্যিকে? সে রমা। দাসী-চাকরের তখন প্রয়োজন হয়নি, এখনও হবে না। বরঞ্চ আজ থেকে তুমিই রমাকে ভয় কোরো। আর এই কথাটাই বলবার জন্যে আজ এসেছিলাম।

রমেশ। তা হলে নিরর্থক এসেচো রমা। ভেবেছিলাম তোমার নিজের কল্যাণের জন্যই আমাকে চলে যেতে বলচো। কিন্তু তা যখন নয়, তখন আমাকে সতর্ক করবার প্রয়োজন দেখতে পাইনে।

রমা। সমস্ত প্রয়োজনই কি সংসারের চোখে দেখা যায় রমেশদা!

রমেশ। যা যায় না তা আমি স্বীকার করিনে। চললাম।

[প্রস্থান]

রমা। (অকস্মাৎ কাঁদিয়া ফেলিয়া) যে অন্ধ তাকে আমি দেখাবো কি দিয়ে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *