রমা – ২.২

দ্বিতীয় দৃশ্য

[তারকেশ্বরের বাসাবাটী। সামান্য রকমের একটা বিছানা পাতা, তাহাতে বসিয়া রমেশ। রমা ব্যস্ত হইয়া প্রবেশ করিল]

রমা। বেশ আপনি! রান্নাঘরে যেই গেছি আর একটু তরকারি আনতে, অমনি উঠে হাত-মুখ ধুয়ে
দিব্যি ভালমানুষটির মত বিছানায় এসে বসেচেন! কেন উঠলেন বলুন ত?

রমেশ। ভয়ে।

রমা। ভয়ে! কার ভয়ে! আমার?

[এই বলিয়া সে অদূরে উপবেশন করিল]

রমেশ। সে ভয় ছিলই, তা ছাড়া আর একটা আছে। আজ জ্বরের গত ঠেকচে।

রমা। জ্বরের মত ঠেকচে? এ কথা আগে বললেন না কেন? স্নান করে ভাত খেতে বসলেনই বা কোন্‌ বুদ্ধিতে?

রমেশ। খুব সহজ বুদ্ধিতে। যে আয়োজন, এবং যে যত্ন করে খেতে দিলে তাকে না বলে ফেরাবোই বা কোন্‌ সুবিবেচনায়? ভাবলাম, হোক গে জ্বর,—ওষুধ খেলেই সারবে। কিন্তু এ অন্ন না খেয়ে যদি ফাঁকে পড়ি, এ ফাঁক এ জীবনে আর ভরবে না।

রমা। যান এই বিদেশে সত্যিই যদি জ্বর হয়ে পড়ে, বলুন ত সে কত বড় অন্যায়?

রমেশ। অন্যায় ত আছেই। কিন্তু যে-রানীকে এতটুকু দেখে গেছি, তার স্বহস্তের রান্না ত্যাগ করাটাই কি কম অন্যায় হতো?

রমা। তবু ঐ কথা! এ বিদেশে ত কোন আয়োজনই করতে পারিনি।

রমেশ। আয়োজনের কথা কে ভাবচে? ভাবচি শুধু যত্নের কথাটুকু। এ আমি কোথায় পেতাম?

রমা। (সলজ্জে) কেন, আপনাকে যত্ন করবার লোকের কি অভাব আছে নাকি?

রমেশ। কোথায় পাব বল ত? ছেলেবেলায় মা মারা গেলেন, তার পরে জ্যাঠাইমার হাত থেকে গিয়ে পড়লাম বহু দূরে মামার বাড়িতে। মামীমা বেঁচে নেই, সমস্ত বাড়িটাই যেন হোটেল। সেখান থেকে পড়তে গেলাম এলাহাবাদে—সেও হোটেল। তার পরে গেলাম ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে। সেখানে বহুকাল কাটল, কিন্তু ছেলেবেলার সেই হোটেলবাসের দুঃখ আর ঘুচল না। খেতে হয় খাও,—বাধা দেবারও শত্রু নেই, এগিয়ে দেবারও মিত্র নেই।

[রমা নীরব]

রমেশ। শরীর অসুস্থ, সাধ মিটিয়ে আজ খেতে পারলাম না, তবু মনে হচ্চে যেন জীবনের এই প্রথম সুপ্রভাত, এ জীবনের সমস্ত ধারাটা যেন একটা বেলার মধ্যেই একেবারে বদলে গেল।

রমা। (অধোমুখে) কি সমস্ত বাড়িয়ে বলচেন বলুন ত?

রমেশ। বাড়ানোর শক্তি থাকলে বাড়াতাম, কিন্তু সে সাধ্য নেই।

রমা। ভাগ্যে নেই, নইলে এর বেশি শক্তি থাকলে আমাকে ছুটে পালাতে হতো। আমারও ভাগ্য ভাল যে, ঘরে ফিরে গিয়ে নিন্দে করবেন না, বলে বেড়াবেন না যে ওদের রমা এমনি যে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে পেটভরে দুটো খেতেও দেয়নি।

রমেশ। না রানী, নিন্দে করব না, সুখ্যাতি করেও বেড়াব না। আজকের দিনটা আমার নিন্দে-সুখ্যাতির বাইরে। বাস্তবিক, খাওয়া জিনিসটার মধ্যে যে পেট-ভরানোর অতিরিক্ত আরও কিছু আছে, আজকের পূর্বে এ কথা যেন আমি জানতামই না।

রমা। আজই বুঝি প্রথম জানলেন?

রমেশ। তাই ত জানলাম।

রমা। কিন্তু এরও ঢের বেশি জানবার আছে। সেদিনটায় আমাকে কিন্তু একটা খবর পাঠিয়ে দেবেন।

রমেশ। এ কথার মানে?

রমা। সব কথার মানে যে জানতেই হবে, তারই বা কি মানে আছে রমেশদা? আচ্ছা, সত্যি বলুন ত, আমাকে কি তখন একেবারে চিনতেই পারেন নি?

রমেশ। কি করেই বা পারব বল ত? সেই ছেলেবেলায় দেখা। ফিরে এসে ত তোমার মুখ দেখতে পাইনি। যখনি চেষ্টা করেচি তখনি হয়ত মুখ ফিরিয়ে নিয়েচ, না হয় ত অন্যদিকে চেয়ে আছ। তাই ত আজ হঠাৎ মনে হয়েছিল, এ মুখ বোধ হয় কখনো স্বপ্নে দেখে থাকব। এমন স্বপ্ন ত—

রমা। আচ্ছা, আপনি রাত্রে কি খান?

রমেশ। যা জোটে তাই।

রমা। আচ্ছা, আপনি এত অগোছালো কেন বলুন ত? শুনি জিনিসপত্র কোথায় থাকে কোথায় যায়, কোন ঠিকানা নেই। কিছুর ওপরেই যেন একটা মায়া-মমতা নেই। সমস্তই যেন শূন্যে ভেসে বেড়ায়।

রমেশ। এত নিন্দে কার কাছে শুনলে?

রমা। সে শুনেই বা আপনার হবে কি? ফিরে গিয়ে তার সঙ্গে ঝগড়া করবেন নাকি?

রমেশ। আমি কি কেবল ঝগড়া করেই বেড়াই?

রমা। তাই ত করেন। এসে পর্যন্ত আমার সঙ্গে ত কেবল ঝগড়া করেই বেড়াচ্চেন।

মাসীই কি বাড়ির মালিক নাকি, না আমি তাঁকে শিখিয়ে দিই যে, তিনি বারণ করেচেন বলেই আমাদের মুখ-দেখা পর্যন্ত বন্ধ করেচেন? পুকুরের মাছ কি আমি চুরি করেছিলাম যে, আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন তার কৈফিয়ত চাইতে?

রমেশ। কৈফিয়ত ত নয়, একটা জবাব। কিন্তু সে জবাবের ত কোন অমর্যাদা হয়নি রানী!

রমা। হয়নি। কিন্তু, হয়নি বলেই ত তার সমস্ত অমর্যাদার বোঝা গিয়ে চেপেচে আজ আমার মাথায়। এর ভার কি আমি জানিনে, না এ শাস্তি আমি বুঝিনে? গ্রামে যে যা করবে আপনার বিরুদ্ধে, আমিই কি হব তার দায়ী? আপনার সমস্ত বিতৃষ্ণা কি গিয়ে পড়বে শুধু আমারই ওপরে? এই ন্যায় বুঝি শিখে এসেচেন বিদেশ থেকে?

[দাসীর প্রবেশ]

দাসী। দিদি, নটবর কি জিনিসপত্র সব বাঁধবে? নইলে ছ’টার গাড়ি ত ধরা যাবে না।

রমা। তার তাড়াতাড়ি কি কুমুদা?

দাসী। যে মেঘ করেচে দিদি, রাত্তিরে হয়ত ভয়ানক জল হবে।

রমা। হলই বা। মাঠে বসে ত আর তোরা নেই।

দাসী। না, তাই বলচি।

[দাসীর প্রস্থান]

রমেশ। তোমাদের বুঝি সন্ধ্যার গাড়িতে যাবার কথা?

রমা। হাঁ। আর আপনার?

রমেশ। আমার? আমার ত কোনমতে আজকের দিনটা এখানে থাকতেই হবে।

রমা। একে শরীর ভাল নয়, তাতে বর্ষাকাল, থাকবেন কোথায়?

রমেশ। যেখানে হোক। যারা সব পূজো দিতে আসে তারা থাকে কোথায়?

রমা। তাদের জায়গা আছে। আপনি ত পূজো দেবেন না, আপনাকে থাকতে দেবে কেন?

রমেশ। (হাসিয়া) তাদের গায়ে কি নাম লেখা থাকে নাকি?

রমা। (হাসিয়া) থাকে। ভক্ত-লোকেরা বাবার কৃপায় পড়তে পারে। অভক্তদের তারা দূর করে দেয়। বিছানা-টিছানা কিছুই সঙ্গে আনেন নি ত?

রমেশ। না। বিছানা তাঁদের আনবার কথা।

রমা। খাসা ব্যবস্থা। দেহ অসুস্থ, আকাশে জল এলো বলে, সঙ্গে চাকর নেই, একটা বিছানা নেই, খাবার বন্দোবস্ত নেই, অথচ চিন্তার বালাইটুকু পর্যন্ত নেই। কারা কোথা থেকে কবে আসবেন, তার প্রতি নির্ভর। একেবারে পরমহংস অবস্থা। এমন হোল কি করে?

রমেশ। যাদের কেউ কোথাও নেই, তাদের আপনিই হয়।

রমা। তাই ত দেখচি। না হয় আজ এই বাড়িতেই থাকুন।

রমেশ। কিন্তু যাঁর বাড়ি—

রমা। তাঁর আপত্তি নেই। অপদার্থ মানুষগুলোকে তিনি দয়া করেন। থাকতেও দেন।

রমেশ। তোমাকে কিন্তু এই বিছানাটা রেখে যেতে হবে রমা।

রমা। তা যাব। কিন্তু ফিরিয়ে দেবেন,—হারিয়ে ফেলবেন না যেন।

রমেশ। বিছানা হারাব কি রকম? আমাকে তুমি কি যে ভাব তার ঠিকানা নেই। কে আমার সম্বন্ধে তোমার মন একেবারে বিগড়ে দিয়েচে।

রমা। (হাসিয়া) কে আর দেবে, হয়ত মাসীই দিয়েচে। কিন্তু তিনি এখানে নেই, আপনি নির্ভয়ে বিশ্রাম করুন। আমি ততক্ষণ কাজকর্ম একটু সেরে নিই।

[এই বলিয়া সে যাইবার জন্য উঠিয়া দাঁড়াইল]

রমেশ। যাঁর বাড়ি তাঁর সঙ্গে একটা পরিচয় না হলে—

রমা। তাঁর সঙ্গে আপনার এই এতটুকু বয়স থেকে পরিচয় আছে। ভাবনার কারণ নেই, ছেলেবেলায় যাকে রানী বলে ডাকতেন—এ তারই বাড়ি।

রমেশ। বাড়ি তোমার? এখানে বাড়ি কিসের জন্যে?

রমা। বললাম ত। জায়গাটা আমার বড় ভাল লাগে, প্রায় আসি,—তাই।

রমেশ। ঠাকুর-দেবতার প্রতি তোমার খুব ভক্তি, না?

রমা। একে আর ভক্তি বলে না। তবু যতদিন বেঁচে আছি চেষ্টা করতে হবে ত?

[দাসীর প্রবেশ]

দাসী। টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হলো দিদি, যেতে আজ কষ্ট হবে।

রমা। তবে না-ই গেলি আজ। নটবরকে বলে দে, কাল যাওয়া হবে।

দাসী। বাঁচি তা হলে। কিন্তু যাবার কথা, বাড়িতে যে তাঁরা ভাববেন?

রমা। মাঝে মাঝে একটু ভাবা ভাল কুমুদা। তুই যা, আমি যাচ্চি।

[দাসীর প্রস্থান]

রমেশ। কেবল আমার জন্যেই তোমাদের যাওয়া হোল না।

রমা। আপনার জন্যে নয়, আপনার অসুখের জন্যে। মুখ দেখে বেশ বোঝা যাচ্চে, হয়ত জ্বর হবে। এ অবস্থায় ফেলেই বা যাই কি করে?

রমেশ। আমি ত তোমার কেউ নই রমা, বরঞ্চ পথের কাঁটা। তবু এক গ্রামের লোক বলে যে যত্ন আজ তোমার কাছে পেলাম তা মুখে বলবার নয়।

রমা। তা হলে না-ই বা বললেন। আর দু’দিন বাদে ভুলে গেলেও অভিযোগ করব না।

[এই বলিয়া সে চলিয়া যাইতে উদ্যত হইল]

রমেশ। তোমাকে আশীর্বাদ করি রমা, তুমি সুখী হও, দীর্ঘজীবী হও—

রমা। (সহসা ফিরিয়া দাঁড়াইয়া) এইবার কিন্তু সত্যিই রাগ করব রমেশদা। আমি বিধবা,—আমাকে দীর্ঘজীবী হতে বলা শুধু অভিশাপ দেওয়া। কোন শুভাকাঙ্ক্ষীই কোনদিন এ আশীর্বাদ আমাদের করে না। এখন আমি চললাম।

[দ্রুতপদে প্রস্থান]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *