বিরাজবৌ – ১৩

তের

পনের মাস গত হইয়াছে। আগামী শারদীয়া পূজার আনন্দ-আভাস জলে-স্থলে, আকাশে-বাতাসে ভাসিয়া বেড়াইতেছে। অপরাহ্নবেলায় নীলাম্বর একখানা কম্বলের আসনের উপর স্থির হইয়া বসিয়া আছে। দেহ অত্যন্ত কৃশ, মুখ ঈষৎ পান্ডুর, মাথায় ছোট ছোট জটা, চোখে বৈরাগ্য ও বিশ্বব্যাপী করুণা। মহাভারতখানি বন্ধ করিয়া বিধবা ভ্রাতৃজায়াকে সম্বোধন করিয়া বলিল, মা, পুঁটিদের বোধ করি আজ আর আসা হ’ল না।

শুভ্রবস্ত্রপরিহিতা নিরাভরণা ছোটবৌ অনতিদূরে বসিয়া এতক্ষণ মহাভারত শুনিতেছিল, বেলার দিকে চাহিয়া বলিল, না বাবা, এখনও সময় আছে—আসতেও পারে। দুর্দান্ত শ্বশুরের মৃত্যুতে পুঁটি এখন স্বাধীন। সে স্বামীপুত্র ও দাসদাসী সঙ্গে করিয়া আজ বাপের বাড়ি আসিতেছে এবং পূজার কয়দিন এখানেই থাকিবে বলিয়া খবর পাঠাইয়াছে। আজিও সে কোন সংবাদই জানে না। তাহার মাতৃসমা বৌদিদি নাই—ছয়মাস পূর্বে সর্পাঘাতে ছোটদাদা মরিয়াছে, কোন কথাই সে জানে না।

নীলাম্বর একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, না এলেই বোধ করি ছিল ভাল, একসঙ্গে এতগুলো সে কি সইতে পারবে মা!

প্রিয়তমা ছোটভগিনীকে স্মরণ করিয়া বহুদিন পরে আজ তাহার শুষ্ক চক্ষে জল দেখা দিল। যে রাত্রে পীতাম্বর সর্পদষ্ট হইয়া তাহার দুই পা জড়াইয়া ধরিয়া বলিয়াছিল, আমার কোন ওষুধপত্র চাই না দাদা, শুধু তোমার পায়ের ধূলা আমার মাথায় মুখে দাও, এতে যদি না বাঁচি ত আর বাঁচতেও চাইনে, বলিয়া সর্বপ্রকার ঝড়-ফুঁক সজোরে প্রত্যাখ্যান করিয়া ক্রমাগত তাহার পায়ের নীচে মাথা ঘষিয়াছিল এবং বিষের যাতনায় অব্যাহতি পাইবার আশায় শেষমুহূর্ত পর্যন্ত পা ছাড়ে নাই, সেইদিন নীলাম্বর তাহার শেষ কান্না কাঁদিয়া চুপ করিয়াছিল, আজ আবার সেই চোখে জল আসিয়াছে। পতিব্রতা সাধ্বী ছোটবধূ নিজের চোখের জল গোপনে মুছিয়া নীরব হইয়া রহিল।

নীলাম্বর ধীরে ধীরে বলিতে লাগিল, সেজন্যেও তত দুঃখ করিনি মা; আমার পীতাম্বরের মত বিরাজকেও যদি ভগবান নিতেন ত আজ আমার সুখের দিন। সে ত হ’ল না। পুঁটি এখন বড় হয়েচে, তার জ্ঞান-বুদ্ধি হয়েচে, তাই মায়ের মতন বৌদির এ কলঙ্ক শুনলে বল ত মা, তার বুকের ভিতর কি করতে থাকবে! আর ত সে মুখ তুলে চাইতেও পারবে না!

সুন্দরী আত্মগ্লানি আর সহ্য করিতে না পারিয়া মাস-দুই পূর্বে নীলাম্বরের কাছে কবুল করিয়া ফেলিয়াছিল, সে রাত্রে বিরাজ মরে নাই, জমিদার রাজেন্দ্রর সহিত গৃহত্যাগ করিয়া গিয়াছে। সে নীলাম্বরের মনোকষ্ট আর দেখিতে পারিতেছিল না। মনে করিয়াছিল, এ কথায় সে ক্রোধের বশে হয়ত দুঃখ ভুলিতে পারিবে। ঘরে আসিয়া নীলাম্বর এ কথা বলিয়াছিল।

সেই কথা মনে করিয়া ছোটবৌ খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া মৃদুস্বরে বলিল, ঠাকুরঝিকে জানিয়ে কাজ নেই।

কি করে লুকাবে মা? যখন জিজ্ঞেস করবে, বৌদির কি হয়েছিল, তখন কি জবাব দেবে?

ছোটবৌ বলিল, যে কথা সকলে জানে, দিদি নদীতে প্রাণ দিয়েচেন—তাই।

নীলাম্বর মাথা নাড়িয়া কহিল, তা হয় না মা। শুনেচি, পাপ গোপন করলেই বাড়ে; আমরা তার আপনার লোক, আমরা তার পাপের ভার আর বাড়িয়ে দেব না। বলিয়া সে একটুখানি হাসিল। সেটুকু হাসিতে কত ব্যথা, কত ক্ষমা, তাহা ছোটবৌ বুঝিল। খানিক পরে ছোটবৌ অতিশয় সঙ্কুচিতভাবে মৃদুস্বরে বলিল, এ-সব কথা হয়ত সত্যি নয়, বাবা!
কোন্‌ সব কথা মা? তোমার দিদির কথা?

ছোটবৌ নতমুখে মৌন হইয়া রহিল।

নীলাম্বর বলিল, সত্যি বৈ কি মা—সব সত্যি। জান ত মা, রেগে গেলে সে পাগ্‌লীর জ্ঞান থাকত না। যখন এতটুকুটি ছিল, তখনও তাই, যখন বড় হ’ল তখনও তাই। তাতে যে অত্যাচার, যে অপমান আমি করেছিলাম, সে সহ্য কর্‌তে বোধ করি স্বয়ং নারায়ণও পারতেন না—সে ত মানুষ। নীলাম্বর হাত দিয়া একফোঁটা অশ্রু মুছিয়া বলিল, মনে হ’লে বুক ফেটে যায় মা, হতভাগী তিন দিন খায় নি, জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে আমার জন্যে দুটি চাল ভিক্ষে করতে গিয়েছিল, সেই অপরাধে আমি—আর যেন বলিতে পারিল না, কোঁচার খুঁট মুখে গুঁজিয়া দিয়া উচ্ছ্বসিত ক্রন্দন সবলে নিরোধ করিয়া ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল।

ছোটবৌ নিজেও তেমনই করিয়া কাঁদিতেছিল, সেও কথা কহিল না। বহুক্ষণ কাটিল।

বহুক্ষণে নীলাম্বর কতকটা প্রকৃতিস্থ হইয়া চোখমুখ মুছিয়া ফেলিয়া বলিল, অনেক কথাই তুমি জান, তবু শোন মা। কি ক’রে জানিনে, সেই রাতেই সে অজ্ঞান উন্মত্ত হয়ে সুন্দরীর বাড়িতে গিয়ে উঠে, তারপরে—উঃ—টাকার লোভে সুন্দরী পাগলীকে আমার সেই রাতেই রাজেনবাবুর বজরায় তুলে দিয়ে আসে—

তাহার কথা শেষ হইতে না হইতেই মোহিনী নিজেকে ভুলিয়া, লজ্জা-শরম ভুলিয়া উচ্চকন্ঠে বলিয়া উঠিল, কক্ষণ সত্যি নয় বাবা, কক্ষণ সত্যি নয়। দিদির দেহে প্রাণ থাকতে এমন কাজ তাঁকে কেউ করাতে পারবে না। তিনি যে সুন্দরীর মুখ পর্যন্ত দেখ্‌তেন না।

নীলাম্বর শান্তভাবে বলিল, তাও শুনেচি। হয়ত, তোমার কথাই সত্যি মা, দেহে তার প্রাণ ছিল না। ভাল ক’রে জ্ঞানবুদ্ধি হ’বার পূর্বেই সেটা সে আমাকে দিয়েছিল, সে ত নিয়ে যায়নি, আজও ত আমার কাছে আছে, —বলিয়া সে চোখ বুজিয়া তাহার হৃদয়ের অন্তস্তম স্থান পর্যন্ত তলাইয়া দেখিতে লাগিল।

ছোটবৌ মুগ্ধ হইয়া সেই শান্ত পাণ্ডুর নিমীলিত মুখের পানে চাহিয়া রহিল। সে মুখে ক্রোধ বা হিংসা-দ্বেষের এতটুকু ছায়া নাই—আছে শুধু অপরিসীম ব্যথা ও অনন্ত ক্ষমার অনির্বচনীয় মহিমা। সে গলায় আঁচল দিয়া প্রণাম করিয়া মনে মনে তাঁহার পদধূলি মাথায় লইয়া নিঃশব্দে উঠিয়া গেল। সন্ধ্যাদীপ জ্বালিতে জ্বালিতে মনে মনে বলিল, দিদি চিনেছিল, তাহাতেই একটি দিনও ছেড়ে থাকতে চাইত না।

দীর্ঘ চার বৎসর পরে পুঁটি বাপের বাড়ি আসিয়াছে এবং বড়মানুষের মতই আসিয়াছে। তাহার স্বামী, ছয় মাসের শিশুপুত্র পাঁচ-ছয়জন দাসদাসী এবং অগণিত জিনিসপত্রে সমস্ত বাটী পরিপূর্ণ হইয়া গেল। স্টেশনে নামিয়াই যদু চাকরের কাছে খবর শুনিয়া সে সেইখান হইতে কাঁদিতে শুরু করিয়াছিল। উচ্চরোলে কাঁদিতে কাঁদিতে সমস্ত পাড়া সচকিত করিয়া রাত্রি এক প্রহরের পর বাড়ি ঢুকিয়া দাদার ক্রোড়ে মুখ গুঁজিয়া উপুড় হইয়া পড়িল। সে রাত্রে নিজে জলস্পর্শ করিল না, দাদাকেও ছাড়িল না; এবং মুখ ঢাকিয়া রাখিয়াই সে একটু একটু করিয়া সমস্ত কথা শুনিল। আগে বৌদিকে বরঞ্চ সে ভয় করিত, সঙ্কোচ করিত, কিন্তু দাদাকে ঠিক পুরুষমানুষও মনে করিত না, সঙ্কোচও করিত না, সমস্ত আবদার উপদ্রব তাহার দাদার উপরেই ছিল। শ্বশুরবাড়ি যাইবার পূর্বের দিনও সে বৌদির কাছে তাড়া খাইয়া আসিয়া দাদার গলা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া ভাসাইয়া দিয়াছিল। তাহার সেই দাদাকে যাহারা এতদিন ধরিয়া এত দুঃখ দিয়াছে, এমন জীর্ণ শীর্ণ এমন পাগলের মত করিয়া দিয়াছে, তাহাদের প্রতি ক্রোধ ও দ্বেষের পরিসীমা রহিল না।
তাহার দাদার এত বড় দুঃখের কাছে পুঁটি আপনার সমস্ত দুঃখকেই একেবারে তুচ্ছ করিয়া দিল। তাহার শ্বশুরকুলের উপর ঘৃণা জন্মিল, ছোটদার সর্পাঘাত তাহাকে বিঁধিল না এবং তাহার দুঃখিনী বিধবার দিক হইতে সে একেবারে মুখ ফিরাইয়া বসিল।

দু’দিন পরে সে তাহার স্বামীকে ডাকাইয়া আনিয়া বলিল, আমি দাদাকে নিয়ে পশ্চিমে বেড়াতে যাব, তুমি এইসব লটবহর নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও। আর যদি ইচ্ছে হয়, না হয় তুমিও সঙ্গে চল।

যতীন অনেক যুক্তি-তর্কের পর শেষ কাজটাই সহজসাধ্য বিবেচনা করিয়া আর একবার জিনিসপত্র বাঁধাবাঁধির উদ্যোগে প্রস্থান করিল। যাত্রার আয়োজন চলিতে লাগিল। পুঁটি সুন্দরীকে একবার গোপনে ডাকাইয়া পাঠাইয়াছিল। কিন্তু সে আসিল না। যে ডাকিতে গিয়াছিল তাহাকে বলিয়া দিল, এ মুখ দেখাইতে পারিব না এবং যাহা বলিবার ছিল বলিয়াছি। আর কিছু বলিবার নাই। পুঁটি ক্রোধে অধর দংশন করিয়া মৌন হইয়া রহিল। পুঁটির নিদারুণ উপেক্ষা ও ততোধিক নিষ্ঠুর ব্যবহার ছোটবৌকে যে কিরূপ বিঁধিল, তাহা অন্তর্যামী ভিন্ন আর কেহ জানিল না। সে হাতজোড় করিয়া মনে মনে বড়জাকে স্মরণ করিয়া বলিল, দিদি, তুমি ছাড়া আমাকে আর কে বুঝবে! যেখানেই থাক, তুমি যদি আমাকে ক্ষমা করে থাক, সেই আমার সর্বস্ব। চিরদিনই সে নিস্তব্ধ-প্রকৃতির, আজিও নীরবে সকলের সেবা করিতে লাগিল। কাহাকেও কোন কথাটি বলিল না। ভাশুরকে খাওয়াইবার ভার পুঁটি লইয়াছিল। এ-কয়দিন সেখানেও বসিবার তাহার আবশ্যক হইল না।

যাইবার দিন নীলাম্বর অত্যন্ত আশ্চর্য হইয়া বলিল, তুমি যাবে না মা?

ছোটবৌ নীরবে ঘাড় নাড়িল।

পুঁটি ছেলে কোলে করিয়া দাদার পাশে আসিয়া শুনিতে লাগিল।

নীলাম্বর বলিল, সে হয় না মা। তুমি একলাটি কেমন করেই বা থাকবে, আর থেকেই বা কি হবে মা? চল।

ছোটবৌ তেমনই হেঁটমুখে মাথা নাড়িয়া বলিল, না বাবা। আমি কোথাও যেতে পারব না।

ছোটবৌর বাপের বাড়ির অবস্থা খুব ভাল। বিধবা মেয়েকে তারা অনেকবার লইয়া যাইবার চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু সে কিছুতেই যায় নাই।

নীলাম্বর তখন মনে করিত, সে শুধু তাহারই জন্য যাইতে পারে না, কিন্তু এখন শূন্য বাটীতে কি হেতু একা পড়িয়া থাকিতে চাহে, কিছুতেই বুঝিতে পারিল না। জিজ্ঞাসা করিল, কেন কোথাও যেতে পারবে না মা?

ছোটবৌ চুপ করিয়া রহিল।

না বললে ত আমার যাওয়া হবে না মা!

ছোটবৌ মৃদুকন্ঠে বলিল, আপনি যান, আমি থাকি।

কেন?

ছোটবৌ আবার কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া মনে মনে একটা সঙ্কোচের জড়তা যেন প্রাণপণে কাটাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। তারপর ঢোক গিলিয়া অতি মৃদুকন্ঠে বলিল, কখনও দিদি যদি আসেন—তাই আমি কোথাও যেতে পারব না বাবা।
নীলাম্বর চমকিয়া উঠিল। খর বিদ্যুৎ চোখমুখ ধাঁধিয়া দিলে যেমন হয়, তেমনিই চারিদিকে সে অন্ধকার দেখিল। কিন্তু মুহূর্তের জন্য। মুহূর্তেই নিজেকে সংবরণ করিয়া লইয়া অতি ক্ষীণ একটুখানি হাসিয়া কহিল, ছি মা, তুমিও যদি এমন ক্ষ্যাপার মত কথা বল, এমন অবুঝ হয়ে যাও, তাহলে আমার উপায় কি হবে? ছোটবৌ চোখের পলকে চোখ বুজিয়া নিজের বুকের মধ্যে চাহিয়া দেখিল, পরক্ষণেই সংশয়লেশহীন স্থির মৃদুস্বরে বলিল, অবুঝ হইনি বাবা। আপনাদের যা ইচ্ছে হয় বলুন, কিন্তু যতদিন চন্দ্রসূর্য উঠতে দেখব, ততদিন কারো কোন কথা আমি বিশ্বাস করব না।

ভাইবোন পাশাপাশি দাঁড়াইয়া নির্বাক হইয়া তাহার দিকে চাহিয়া রহিল। সে তেমনই সুদৃঢ়কন্ঠে বলিতে লাগিল, স্বামীর পায়ে মাথা রেখে মরণের বর দিদি আপনার কাছে চেয়ে নিয়েছিলেন, সে বর কোন মতেই নিষ্ফল হতে পারে না। সতীলক্ষ্মী দিদি আমার নিশ্চয় ফিরে আসবেন—যতদিন বাঁচব, এই আশায় পথ চেয়ে থাকব—আমাকে কোথাও যেতে বলবেন না বাবা।—বলিয়া এক নিশ্বাসে অনেক কথা কহার জন্য মুখ হেঁট করিয়া হাঁপাইতে লাগিল।

নীলাম্বর আর সহিতে পারিল না; যে কান্না তাহার গলা পর্যন্ত ঠেলিয়া উঠিল, কোথাও একটু আড়ালে গিয়া তাহাকে মুক্তি দিবার জন্য সে ছুটিয়া পলাইয়া গেল।

পুঁটি একবার চারিদিকে চাহিয়া দেখিল, তার পর কাছে আসিয়া তাহার ছেলেকে পায়ের নীচে বসাইয়া দিয়া আজ প্রথম সে এই বিধবা ভ্রাতৃজায়ার গলা জড়াইয়া ধরিয়া অস্ফুটস্বরে কাঁদিয়া উঠিল—বৌদি! কখনো তোমাকে চিন্‌তে পারিনি, বৌদি—আমাকে মাপ কর।

ছোটবৌ হেঁট হইয়া ছেলেকে বুকে তুলিয়া লইয়া তাহার মুখে মুখ দিয়া অশ্রু গোপন করিয়া রান্নাঘরে চলিয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *