বিপ্রদাস – ১৩

তের

সন্ধ্যা-বন্দনা সারিয়া বিপ্রদাস সেইমাত্র নিজের লাইব্রেরিঘরে আসিয়া বসিয়াছে; সকালের ডাকে যে-সকল দলিলপত্র বাড়ি হইতে আসিয়াছে সেগুলা দেখা প্রয়োজন, এমনি সময়ে মা আসিয়া প্রবেশ করিলেন,—হাঁ রে বিপিন, তুই কি বাড়িয়েই বলতে পারিস!

বিপ্রদাস চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল,—কিসের মা?

অক্ষয়বাবুর মেয়ে মৈত্রেয়ীকে আমরা যে দেখে এলুম।

মেয়েটি কি মন্দ?

দয়াময়ী একটু ইতস্ততঃ করিয়া কহিলেন, না মন্দ বলিনে,—সচরাচর এমন মেয়ে চোখে পড়ে না সে সত্যি,—কিন্তু তাই বলে আমার বৌমার সঙ্গে তার তুলনা করলি? বৌমার কথা যাক, কিন্তু রূপে বন্দনার কাছেই কি সে দাঁড়াতে পারে?

বিপ্রদাস বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিল, তবে বুঝি তোমরা আর কাউকে দেখে এসেচ। সে মৈত্রেয়ী নয়।

দয়াময়ী হাসিয়া বলিলেন, তাই বটে। আমাদের সঙ্গে তার কত কথা হলো, কি যত্ন করেই না সে বৌমাদের খাওয়ালে—তার পরে কত বই, কত লেখাপড়ার কথাবার্তা বন্দনার সঙ্গে তার হলো, আর তুই বলিস আমরা আর কাকে দেখে এসেচি!

বিপ্রদাস বলিল, বন্দনার সব প্রশ্নের সে হয়ত জবাব দিতে পারেনি, কিন্তু মা, লেখাপড়ায় বন্দনা ইস্কুল-কলেজে কত বই পড়ে কতগুলো পরীক্ষা পাস করেচে, আর তার শুধু বাপের কাছে ঘরে বসে শেখা। এই যেমন আমার সঙ্গে তোমার ছোটছেলের তফাত।

শুনিয়া দয়াময়ীর দুই চোখ কৌতুকে নাচিয়া উঠিল,—চুপ কর বিপিন, চুপ কর। দ্বিজ ও-ঘরে আছে, শুনতে পেলে লজ্জায় বাড়ি ছেড়ে পালাবে। একটু থামিয়া বলিলেন, তোর মা মুখ্যু বলে কি এতই মুখ্যু যে কলেজের পাস করাকেই চতুর্বগ্য ভাববে? তা নয় রে, বরঞ্চ ছোট্ট ছোট্ট কথায় মিষ্টি করে সে বন্দনার সকল কথারই জবাব দিয়েছে। গাড়িতে আসতে মেয়েটির কত প্রশংসাই বন্দনা করলে। কিন্তু আমি বলি আমাদের গেরস্ত-ঘরে দরকার কি বাপু অত লেখাপড়ায়? আমার একটি বৌ যেমন হয়েছে আর একটি তেমনি হলেই আমার চলে যাবে। নইলে বিদ্যের গুমরে সে যে মনে মনে গুরুজনদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে সে হবে না।

বিপ্রদাস বুঝিল জেরার জবাবটা মায়ের এলোমেলো হইয়া যাইতেছে, হাসিয়া কহিল, সে ভয় করো না মা। বিদ্যে যাদের কম, গুমর হয় তাদেরই বেশি। ও বাপের কাছে যদি সত্যি সত্যিই কিছু শিখে থাকে আচার-আচরণে সকলের নীচু হয়েই থাকবে তুমি দেখ।

যুক্তিটা মা অস্বীকার করিতে পারিলেন না, বলিলেন, এ কথা তোর সত্যি, কিন্তু আগে থেকে জানব কি করে বল? তা ছাড়া, আমাদের পাড়াগাঁয়ে বিদ্যের কমবেশি কেউ যাচাই করতে আসে না, কিন্তু বৌ দেখতে এসে সকলে যে নাক তুলে বলবে বুড়ো-মাগীর কি চোখ ছিল না যে অমন বৌয়ের পাশে এই বৌ এনে দাঁড় করালে! এ আমার সইবে না বাবা।

বিপ্রদাস ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিল, কিন্তু অক্ষয়বাবুকে ত একটা জবাব দিতে হবে মা। সেদিন তাঁকে ভরসা দিয়েছিলুম, আমার মায়ের বোধ হয় অমত হবে না।

শুনিয়া দয়াময়ী ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, ও-কথা না বললেই ভাল হত বিপিন। তা সে যাই হোক, বৌমার কি ইচ্ছে আগে শুনি, তার পরে তাঁকে বললেই হবে।

বিপ্রদাস কহিল, অক্ষয়বাবু আমাদের নিতান্ত পর নয়। এতদিন পরিচয় ছিল না বলেই তা প্রকাশ পায়নি। কিন্তু আত্মীয়তার জন্যেও বলিনে, কিন্তু তোমার আর-এক ছেলের যখন বিয়ে দিয়েছিলে, নিজের ইচ্ছাতেই দিয়েছিলে, অন্য কাউকে জিজ্ঞেসা করতে যাওনি। আর এর বেলাতেই কি যত মত-জানাজানির দরকার হল মা?

তর্কে হারিয়া হাসিমুখে বলিলেন, কিন্তু এখন যে বুড়ো হয়েছি বাবা, আর কতকাল বাঁচব বল ত? কিন্তু চিরকাল যাকে নিয়ে ঘর করতে হবে তার মত না নিয়ে কি বিয়ে দিতে পারি? না না, দুদিন আমাদের তুই ভাবতে সময় দে। এই বলিয়া তিনি বাহির হইয়া গেলেন। বাহিরে আসিয়া দয়াময়ী নিজের ঘরের দিকে না গিয়া বেহাইয়ের ঘরের উদ্দেশে চলিলেন। এই কয় দিনের ঘনিষ্ঠতায় বন্দনার পিতার কাছে তাঁহার অনেকটা সঙ্কোচ কাটিয়া গিয়াছিল,—প্রায়ই নিজে আসিয়া তাঁহার তত্ত্ব লইয়া যাইতেন—এদিকে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়াছে, আহ্নিকে বসিলে শীঘ্র উঠিতে পারিবেন না ভাবিয়া তাঁহার ঘরে আসিয়া ঢুকিলেন,—কেমন আছেন—

কথাটা সম্পূর্ণ হইতে পারিল না। ঘরের অপর প্রান্তে বসিয়া একটি সুদর্শন যুবক বন্দনার সহিত মৃদুকণ্ঠে গল্প করিতেছিল, নিখুঁত সাহেবি পোশাকের এই অপরিচিত লোকটির সম্মুখে হঠাৎ আসিয়া পড়ায় দয়াময়ী সলজ্জে পিছাইয়া যাইবার উপক্রমেই রায়সাহেব বলিয়া উঠিলেন, কোথায় পালাচ্চেন বেয়ান, ও যে আমাদের সুধীর। ওকে লজ্জা কিসের? ও ত বিপ্রদাস দ্বিজদাসের মতই আপনার ছেলে। আমার অসুখের খবর পেয়ে মাদ্রাজ থেকে দেখতে এসেচে। সুধীর, ইনি বন্দনার দিদির শাশুড়ী—বিপ্রদাসের মা, এঁকে প্রণাম কর।

সুধীরের প্রণাম করার হয়ত অভ্যাস নাই, ও-পোশাকে করাও কঠিন, সে কাছে আসিয়া মাথা নোয়াইয়া কোনমতে আদেশ পালন করিল।

এই ছেলেটির সহিত দয়াময়ীর সন্তান-সম্বন্ধ যে কি সূত্রে হইল ইহাই বুঝাইবার জন্য রায়সাহেব বলিতে লাগিলেন, ওর বাপ আর আমি একসঙ্গে বিলেতে পড়েছিলুম বেয়ান, তখন থেকেই আমরা পরম বন্ধু। সুধীর নিজেও বিলেতে অনেকগুলো পাস করে মাদ্রাজের শিক্ষাবিভাগে ভাল চাকরি পেয়েছে। কথা আছে ওদের বিয়ের পরে কিছুদিনের ছুটি নিয়ে ও বন্দনাকে সঙ্গে নিয়ে আবার বিলেতে যাবে, সেখানে ইচ্ছে হয় বন্দনা কলেজে ভর্তি হবে, না হয় শুধু দেশ দেখেই দুজনে ফিরে আসবে। দ্যাখো সুধীর, তোমরা যদি এই আগস্ট সেপ্টেম্বরেই যাওয়া স্থির করতে পার আমিও না হয় মাস-তিনেকের ছুটি নিয়ে একবার ঘুরে আসি। কি বলিস রে বুড়ি, ভাল হয় না?

বন্দনা সেখান হইতেই আস্তে আস্তে বলিল, কেন হবে না বাবা, তুমি সঙ্গে থাকলে ত ভালই হয়।

রায়সাহেব উৎসাহ-ভরে কহিলেন, তাতে আরও একটা সুবিধে এই হবে যে, তোদের বিয়ের পরেও মাস-খানেক সময় পাওয়া যাবে, কোনরকম তাড়াহুড়ো করতে হবে না।
বুঝলে না সুধীর, সুবিধেটা?

ইহাতে সুধীর ও বন্দনা উভয়েই মাথা নাড়িয়া সায় দিল। দয়াময়ী এতক্ষণে বুঝিলেন এই ছেলেটি রায়সাহেবের ভাবী জামাতা। অতএব, তাঁহারও পুত্র-স্থানীয়। বুকের ভিতরটায় হঠাৎ একবার তোলপাড় করিয়া উঠিল, কিন্তু তিনি বিপ্রদাসের মা, বলরামপুরের বহুখ্যাত মুখুয্যে-পরিবারের কর্ত্রী, মুহূর্তে নিজেকে সংবরণ করিয়া লইয়া ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, সুধীর, তোমাদের বাড়ি কোথায় বাবা?

সুধীর কহিল, এখন বোম্বায়ে। কিন্তু বাবার মুখে শুনেচি আগে ছিল দুর্গাপুরে, কিন্তু বর্তমানে সেখানে বোধ করি আমাদের আর কিছু নেই।

কোন্‌ দুর্গাপুর সুধীর? বর্ধমান জেলার?

সুধীর বলিল, হাঁ, বাবার মুখে তাই শুনেচি। কালনার কাছে কোন্‌ একটি ছোট্ট গ্রাম, এখন নাকি সে দেশ ম্যালেরিয়ায় ধ্বংস হয়ে গেছে।

দয়াময়ী ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া প্রশ্ন করিলেন, তোমার বাবার নামটি কি?

সুধীর বলিল, আমার বাবার নাম শ্রীরামচন্দ্র বসু।

দয়াময়ী চমকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমার পিতামহের নাম কি ছিল হরিহর বসু?

প্রশ্ন শুনিয়া রায়সাহেব পর্যন্ত বিস্ময়াপন্ন হইলেন, বলিলেন, আপনি কি ওদের জানেন নাকি?

হাঁ, জানি। দুর্গাপুরে আমার মামার বাড়ি। ছেলেবেলায় দিদিমার কাছে মানুষ হয়েছি বলে ও-গ্রামের প্রায় সকলকেই চিনি। ওঁদের বাড়ি ছিল আমাদের পাড়ায়। কিন্তু এখন আর কথা কইবার সময় নেই সুধীর, আমার আহ্নিকের দেরি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু না খেয়েও যেন তুমি চলে যেও না,—আমি এখনি সমস্ত ঠিক করে দিতে বলচি।

সুধীর সহাস্যে কহিল, তার আর বাকি নেই,—বিপ্রদাসবাবু আগেই সে কাজ সমাধা করে দিয়েছেন।

দিয়েছে? আচ্ছা, তা হলে এখন আমি আসি, এই বলিয়া দয়াময়ী বাহির হইয়া গেলেন। বন্দনার প্রতি একবারও চাহিলেন না, একটা কথাও বলিলেন না।

পরদিন সকালে স্নান-আহ্নিক সারিয়া বিপ্রদাস প্রতিদিনের অভ্যাসমত মায়ের পদধূলির জন্য আজও তাঁহার ঘরে প্রবেশ করিয়া ভয়ানক আশ্চর্য হইয়া দেখিল তাঁহার জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা হইতেছে।

এ কি মা, কোথাও যাবে নাকি?

দয়াময়ী বলিলেন, তোকে খুঁজে পেলুম না, তাই দত্তমশায়কে জিজ্ঞেসা করে জানলুম সাড়ে-নটার গাড়িতে বার হতে পারলে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি পৌঁছতে পারব। কিন্তু পরশু তোর মকদ্দমার দিন, তুই ত সঙ্গে যেতে পারবি নে, দ্বিজুকে বলে দে, ও আমাদের পৌঁছে দিয়ে আসুক।

বিপ্রদাস চাহিয়া দেখিল মায়ের দুই চোখ রাঙ্গা, মুখ শুষ্ক, দেখিলে মনে হয় সারারাত্রি তাঁহার উপর দিয়া যেন একটা ঝড় বহিয়া গেছে।

বিপ্রদাস সভয়ে প্রশ্ন করিল, হঠাৎ কি কোন দরকার পড়েচে মা?

মা বলিলেন, দুদিনের জন্যে এসে আট-দশদিন কেটে গেল, ওদিকে ঠাকুর-সেবার কি হচ্চে জানিনে, পাঁচ-ছটি গরুর প্রসব সময় হয়েচে দেখে এসেচি, তাদের কি হল খবর পাইনি; বাসুর পাঠশালা কামাই হচ্চে—আর ত দেরি করা চলে না বিপিন।

এ-সকল ব্যাপার দয়াময়ীর কাছে তুচ্ছ নয় সত্য, কিন্তু আসল কারণটা যে তিনি প্রকাশ করিলেন না বিপ্রদাস তাহা বুঝিয়াই বলিল, তবু কি আজই না গেলে নয় মা?

না বাবা, তুই আমাকে বাধা দিসনে। দ্বিজুকে সঙ্গে যেতে বলে দে, না হয় আর কেউ আমাদের পৌঁছে দিয়ে আসুক।

তাই হবে মা, বলিয়া বিপ্রদাস পায়ের ধূলা লইয়া বাহির হইয়া গেল। নিজের শোবার ঘরে আসিয়া দেখিল, সতী অত্যন্ত ব্যস্ত এবং কাছে বসিয়া অন্নদা সন্দেশের হাঁড়ি, ফলমূল ও ছেলের দুধের ঘটি গুছাইয়া ঝুড়িতে তুলিতেছে।

সতী মাথায় আঁচল টানিয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। বিপ্রদাস বলিল, অন্নদাদিদি, ব্যাপার কি জান?

না দাদা, কিছুই জানিনে। সকালেই মা আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বলে দিলেন ছেলে-বৌয়ের গাড়িতে খাবার কষ্ট না হয়, তিনি ন’টার ট্রেনে বাড়ি যাবেন।

বিপ্রদাস সতীকে কারণ জিজ্ঞাসা করায় সেও মাথা নাড়িয়া জানাইল, সে কিছুই জানে না।

শুনিয়া বিপ্রদাস স্তব্ধ হইয়া রহিল। অন্নদা না জানিতেও পারে, কিন্তু বৌ জানে না শাশুড়ীর কথা এমন বিস্ময় কি আছে? কয়েক মুহূর্ত নীরবে দাঁড়াইয়া সে নীচে চলিয়া গেল, উদ্বেগের সহিত ইহাই ভাবিতে ভাবিতে গেল, এ-সকল মায়ের একান্ত স্বভাব-বিরুদ্ধ। কি জানি কোন্‌ গভীর দুঃখ তাঁহার এই বিপর্যস্ত আচরণের অন্তরালে প্রচ্ছন্ন রহিল যাহা কাহারো কাছেই তিনি প্রকাশ করিলেন না।

দয়াময়ী যাত্রা করিয়া যখন নীচে নামিলেন, তখনও ট্রেনের অনেক সময় বাকী, কিন্তু কিছুতেই আজ তাঁহার বিলম্ব সহে না, কোনমতে বাহির হইতে পারিলেই বাঁচেন। সম্মুখে মোটর প্রস্তুত, আর একটায় জিনিসপত্র চাপাইয়া চাকরেরা উঠিয়া বসিয়াছে, ব্যাগ-হাতে বিপ্রদাসকে আসিতে দেখিয়া তিনি বিস্ময়ের কণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন, দ্বিজু কৈ?

বিপ্রদাস কহিল, সে যাবে না মা, আমিই তোমাদের পৌঁছে দিয়ে আসব।

কেন, যেতে রাজী হল না বুঝি?

বিপ্রদাস সবিনয়ে কহিল, তাকে এমন কথা তোমার বলা উচিত নয় মা। তুমি হুকুম করলে সে সত্যিই কবে অবাধ্য হয়েছে বল ত?

তবে হল কি? গেল না কেন?

আমিই যেতে বলিনি মা, এই বলিয়া বিপ্রদাস একটু হাসিয়া কহিল, যে জন্যে তুমি এত ব্যস্ত হয়ে পড়েচ তোমার সেই ঠাকুর, তোমার গরুর পাল,—তাদের সত্যিই কি অবস্থা ঘটল নিজের চোখে দেখব বলেই সঙ্গে যাচ্চি। অন্য কিছুই নয় মা।

আর কোন সময়ে দয়াময়ী নিজেও হাসিয়া হয়ত কত কথাই ছেলেকে বলিতেন, কিন্তু এখন চুপ করিয়া রহিলেন।

অন্নদা বন্দনাকে ডাকিতে গিয়াছিল, সে এইমাত্র স্নান করিয়া পিতার ঘরে যাইতেছিল, অন্নদার আহ্বানে দ্রুতপদে নীচে আসিয়া ব্যাপার দেখিয়া হতবুদ্ধি হইয়া রহিল। দয়াময়ী কহিলেন, আজ আমরা বাড়ি যাচ্চি বন্দনা!

বাড়ি? সেখানে কি হয়েচে মা?

না, হয়নি কিছু। কিন্তু দুদিনের জন্যে এসে দশ-বারো দিন দেরি হয়ে গেল, আর বাড়ি ছেড়ে থাকা চলে না। তোমার বাবার সঙ্গে দেখা হলো না—তখনো তিনি ওঠেন নি—আমার ত্রুটি যেন বেহাই মার্জনা করেন। দ্বিজু রইল, অন্নদা রইল, তুমিও দেখো যেন তাঁর অযত্ন না হয়। এসো বৌমা, আর দেরি করো না, এই বলিয়া তিনি গাড়িতে গিয়া উঠিলেন।

সতী পিছনে ছিল, সে কাছে আসিয়া বোনের হাত ধরিয়াই কাঁদিয়া ফেলিল,—আমরা চললুম ভাই—আর কিছু তাহার মুখ দিয়া বাহির হইল না, চোখ মুছিতে মুছিতে গাড়িতে তাহার শাশুড়ীর পাশে গিয়া বসিল।

বন্দনা স্তব্ধ-বিস্ময়ে নির্বাক দাঁড়াইয়া,—যেন পাথরের মূর্তি, অকস্মাৎ এ কি হইল!

বাসু আসিয়া যখন তাহার পায়ের কাছে প্রণাম করিয়া বলিল, আমি যাচ্চি মাসীমা,—তখনই তাহার চৈতন্য হইল, তাহারও এখনো কাহাকেও প্রণাম করা হয় নাই। তাড়াতাড়ি বাসুর কপালে একটা চুমা দিয়া সে গাড়ির দরজার কাছে আসিয়া হাত বাড়াইয়া দয়াময়ী ও মেজদির পায়ের ধূলা লইল। সতী নীরবে তাহার চিবুক স্পর্শ করিল, মা অস্ফুটে আশীর্বাদ করিলেন, কিন্তু কি বলিলেন, বুঝা গেল না। মোটর ছাড়িয়া দিল।

অন্নদা কহিল, চল দিদি, আমরা ওপরে যাই।

তাহার স্নেহের কণ্ঠস্বরে বন্দনা লজ্জা পাইল, ক্ষণকালের বিহ্বলতা সজোরে ঝাড়িয়া ফেলিয়া বলিল, তুমি যাও অন্নদা, আমি রান্নাঘরের কাজগুলো সেরে নিয়ে যাচ্চি। এই বলিয়া সেই দিকে চালিয়া গেল।

কাল বিকালেও কথা হইয়াছিল রায়সাহেব বোম্বাই রওনা হইলে সকলে একত্রে বলরামপুর যাত্রা করিবেন। কিন্তু আজ তাহার উল্লেখ পর্যন্ত নয়, সুদূর ভবিষ্যতে কোন একদিনের মৌখিক আহ্বান পর্যন্ত নয়।

ঘণ্টা-খানেক পরে নিজের হাতে চায়ের সরঞ্জাম লইয়া বন্দনা পিতার ঘরে গেলে তিনি অত্যন্ত আক্ষেপ-সহকারে বলিয়া উঠিলেন, বেহানরা চলে গেলেন, সকালে উঠতে পারিনি মা, ছি ছি, কি না-জানি আমাকে তাঁরা মনে করে গেলেন!

বন্দনা বলিল, বাবা, আমরা কবে বোম্বায়ে যাব?

বাবা বলিলেন, তোমার যে বলরামপুরে যাবার কথা ছিল মা, গেলে না কেন?

মেয়ে বলিল, তোমাকে একলা ফেলে রেখে কি করে যাব বাবা, তুমি যে আজও ভাল হতে পারনি।

ভাল ত হয়েছি মা। বেহানকে কথা দেওয়া হয়েছে তুমি যাবে, না হয়, যাবার পথে আমি তোমাকে বলরামপুরে নাবিয়ে দিয়ে যাব। কি বল মা?

না বাবা, সে হবে না। তোমাকে এতটা পথ একলা যেতে আমি দিতে পারব না।

কন্যার কথা শুনিয়া পিতা পুলকিতচিত্তে তিরস্কার করিয়া বলিলেন, দূর বুড়ি! দেখা হলে বেয়ান তোরে ঠাট্টা করে বলবে, বুড়ো বাপটাকে মেয়েটা চোখের আড়াল করতে পারে না। ছি—ছি—

তুমি খাও বাবা, আমি আসচি, এই বলিয়া বন্দনা বাহির হইয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *