বিপ্রদাস – ০৪

চার

নিখুঁত সাহেবী-পরিচ্ছদে ভূষিত একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক চেয়ারে বসিয়াছিলেন এবং একটি কুড়ি-একুশ বছরের মেয়ে তাঁহারই পাশে দাঁড়াইয়া দেয়ালে টাঙানো মস্ত একখানি জগদ্ধাত্রী দেবীর ছবি অত্যন্ত মনোযোগের সহিত নিরীক্ষণ করিতেছিল। তাহারও পরনে যাহা ছিল তাহা নিছক মেমসাহেবের মত না হউক, বাঙালীর মেয়ে বলিয়াও হঠাৎ মনে হয় না। বিশেষতঃ গায়ের রঙটা যেন সাদার ধার ঘেঁষিয়া আছে—এমনি ফরসা। দেহের গঠন ও মুখের শ্রী অনিন্দ্যসুন্দর। দেবরের কাছে সতী এইমাত্র যে গর্ব করিয়া বলিতেছিল তার রূপটা ত শাশুড়ীর চোখে পড়িবে,—চোখ বুজিয়া ত এটা তিনি অস্বীকার করিতে পারিবেন না, বস্তুতঃ, এ কথা সত্য। ভগিনীর হইয়া এ রূপ লইয়া অহঙ্কার করা চলে।

ঘরে ঢুকিয়া সতী গড় হইয়া প্রণাম করিল, বলিল, সেজকাকা, মেয়ের বাড়িতে এতকাল পরে পায়ের ধুলো পড়ল?

ভদ্রলোক উঠিয়া দাঁড়াইয়া সতীর মাথায় হাত দিলেন, সহাস্যে কহিলেন, হ্যাঁ রে বুড়ি, পড়ল! কবে, কোন্‌ কালে কাকাকে নেমন্তন্ন করে খবর পাঠিয়েছিলি যে অস্বীকার করেছিলাম? কখনো বলেচিস আসতে? নিজে যখন যেচে এলাম তখন মস্ত ভণিতা করে বলা হচ্ছে পায়ের ধুলো পড়ল? দ্বিজদাসের প্রতি চোখ পড়িতে জিজ্ঞাসা করিলেন, এটি কে?

সতী পিছনে চাহিয়া দেখিয়া কহিল, উটি আমার দেওর—দ্বিজু।

দ্বিজদাস দূর হইতে নমস্কার করিল। বন্দনা দিদিকে প্রণাম করিয়া হাসিয়া বলিল, ওঃ—ইনিই সেই? যাঁর জ্বালায় জমিদারি বুঝি যায়-যায়। আমাকে চিঠিতে লিখেছিলে। বংশছাড়া, গোত্র-ছাড়া, ভয়ঙ্কর স্বদেশী?

অমন কথা তোকে আবার কবে লিখলুম?

এই ত সেদিন। এরই মধ্যে ভুলে গেলে?

সতী ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না, ও-সব লিখিনি, তোর মনে নেই।

দ্বিজদাস এতক্ষণ পর্যন্ত কি একপ্রকার সঙ্কোচের বশে যেন আড়ষ্ট হইয়াছিল। অনাত্মীয়, অপরিচিত যুবতী স্ত্রীলোকের সম্মুখে কি করা উচিত, কি বলিলে ভাল দেখায়, কিছুই স্থির করিতে পারিতেছিল না। ইতিপূর্বে কখনো সুযোগও ঘটে নাই, প্রয়োজনও হয় নাই,—কিন্তু এই নবাগত তরুণীর আশ্চর্য স্বচ্ছন্দতায় সে যেন একটা নূতন শিক্ষা লাভ করিল। তাহার অহেতুক ও অশোভন জড়তা একমুহূর্তে কাটিয়া গিয়া সে এক অনাবিল আনন্দের স্বাদ গ্রহণ করিল। মেয়েদেরও যে শিক্ষা ও স্বাধীনতার প্রয়োজন এ কথা সে বুদ্ধি দিয়া চিরদিনই স্বীকার করিত এবং মা ও দাদার সহিত তর্ক বাধিলে সে এই যুক্তিই দিত যে, স্ত্রীলোক হইলেও তাহারা মানুষ, সুতরাং শিক্ষা ও স্বাধীনতায় তাহাদের দাবী আছে। মূর্খ করিয়া তাহাদের ঘরে বন্ধ করিয়া রাখা অন্যায়। কিন্তু আজ এই অতিথি মেয়েটির আকস্মিক পরিচয়ে সে চক্ষের পলকে প্রথম উপলব্ধি করিল যে, ঐ-সব মামুলী দাবী-দাওয়ার যুক্তির চেয়েও ঢের বড় কথা এই যে, পুরুষের চরম ও পরম প্রয়োজনেই রমণীর শিক্ষা ও স্বাধীনতার প্রয়োজন।
তাহাকে বঞ্চিত করিয়া পুরুষে কতখানি যে নিজেকে বঞ্চিত করিতেছে এ সত্য এতবড় স্পষ্ট করিয়া ইতিপূর্বে সে কখনো দেখে নাই। মেয়েটিকে উদ্দেশ করিয়া হাসিমুখে কহিল, আপনার কথাই ঠিক, বৌদি ভুলে গেছেন। কিন্তু এ নিয়ে বাদানুবাদ করে লাভ নেই। এই বলিয়াই সে ছদ্মগাম্ভীর্যে মুখ গম্ভীর করিয়া বলিল, বৌদি, তোমার জোরেই আমার সমস্ত জোর, আর তোমারই চিঠিতেই এই কথা? বেশ, আমাকে তোমরা ত্যাগ কর, আর আমিও আমার সমস্ত অধিকার পরিত্যাগ করচি। তোমাদের জমিদারি অক্ষয় হয়ে থাক, তুমি একটিবার মুখ ফুটে আদেশ কর, আজই উকিল ডেকে সমস্ত লেখাপড়া করে দিচ্ছি। ইনিই সাক্ষী থাকুন, দেখ আমি পারি কি না?

সাহেব মুখ তুলিয়া চাহিয়া বলিলেন, তোর দেওর ভয়ঙ্কর স্বদেশী নাকি সতী?

সতী বলিল, হাঁ, ভয়ঙ্কর।

তুই বললেই লেখাপড়া করে জমিদারির অংশ ছেড়ে দিতে চায়?

সতী ঘাড় নাড়িয়া জবাব দিল, ও স্বচ্ছন্দে পারে। ওর অসাধ্য কাজ নেই।

বন্দনা কৌতূহল দমন করিতে পারিল না, জিজ্ঞাসা করিল, সত্যি বলচেন? চিরকালের জন্য বাস্তবিক সমস্ত ত্যাগ করতে পারেন?

দ্বিজদাস তাহার মুখের প্রতি ক্ষণকাল দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, সত্যিই পারি। ওতে আমার একতিল লোভ নেই। দেশের পনের-আনা লোক একবেলা পেট ভরে খেতে পায় না—উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও না—আর বিনা পরিশ্রমে আমার বরাদ্দ পোলাও-কালিয়া—ও পাপের অন্ন আমার মুখে রোচে না, গলায় আটকাতে চায়। ও বিষয় আমার গেলেই ভাল। তখন দেশের পাঁচজনের মত খেটে খেয়ে বাঁচি। জোটে মঙ্গল, না জোটে তাদের সঙ্গে উপোস করে মরতে পারলে বরঞ্চ একদিন হয়ত স্বর্গে যেতেও পারব, কিন্তু এ পথে কোন কালে সে আশা নেই।

বন্দনা নিষ্পলকচক্ষে চাহিয়া শুনিতেছিল, কথা শেষ হইলে আর কোন কথা কহিল না,—শুধু মুখ দিয়া তাহার একটা নিশ্বাস পড়িল।

সতীর হঠাৎ যেন চমক ভাঙ্গিল। ঠাকুরপোর এ-ছাড়া যেন আর কথা নেই। বলে বলে এমনি মুখস্থ হয়ে গেছে। কহিল, পুরনো বক্তৃতা পরে দিও ঠাকুরপো, ঢের সময় পাবে। সেজকাকাবাবুর হয়ত এখনও হাতমুখ ধোয়াও সারা হয়নি। বন্দনা, চল্‌ ভাই, ওপরে গিয়ে কাপড়-চোপড় ছাড়বি।

সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, জামাই-বাবাজীকে দেখচি নে ত?

সতী কহিল, তিনি সকালেই কি একটা জরুরী কাজে বেরিয়েচেন, ফিরতে বোধ করি দেরি হবে।

বন্দনা জিজ্ঞাসা করিল, মেজদি, তোমার শাশুড়ীকে ত দেখতে পেলুম না? বাড়িতেই আছেন?

সতী কহিল, এখনো আছেন, কিন্তু শীঘ্রই কৈলাস মানস-সরোবরে তীর্থযাত্রা করবেন। সমস্ত সকালটা পূজো-আহ্নিক নিয়েই থাকেন। আর একটু বেলা হলেই তাঁকে দেখতে পাবে।

বন্দনা প্রশ্ন করিল, তিনি খুব বেশী ধর্মকর্ম নিয়েই থাকেন, না?

সতী বলিল, হাঁ।
বিধবা হবার পরে শুনেচি ঘর-সংসার কিছুই দেখেন না, সত্যি?

সত্যি বৈ কি। সব আমাকেই দেখতে শুনতে হয়।

বন্দনা উৎসুক হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, উনি তোমার সৎশাশুড়ী না মেজদি?

সতী হাসিয়া কহিল, চোখে ত দেখিনি বোন, লোকে হয়ত মিথ্যে কথা বলে।

দ্বিজদাস উত্তর দিয়া বলিল, মিথ্যেই বলে। কারণ, সৎশাশুড়ী মানে দাদার সৎমা ত? মিছে কথা। সৎমা বটে, দাদার নয়, আমার। সে যাক, স্নানাদি সেরে নিয়ে সে আলোচনা পরে হবে,—এখন ওপরে চলুন। আচ্ছা, আমি দেখি গে—বৌদি, আর দেরি করো না, এঁদের নিয়ে এস। এই বলিয়া সে আয়োজনের তত্ত্বাবধান করিতে চলিয়া যাইতেছিল, এমনি সময় মাকে দেখিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল।

খুব সম্ভব দয়াময়ী খবর পাইয়া আহ্নিকের মাঝখানেই পূজার ঘর ছাড়িয়া চলিয়া আসিয়াছিলেন। বয়স বেশী নয় বলিয়া তিনি বৈধব্যের পরেও সচরাচর অনাত্মীয় পুরুষদের সম্মুখে বাহির হইতেন না, অন্তরালে থাকিয়াই কথা কহিতেন, কিন্তু আজ একেবারে ঘরের মাঝখানে আসিয়া দাঁড়াইলেন। মাথার কাপড় কপালের উপর পর্যন্ত টানিয়া দেওয়া,—কিন্তু মুখের সবখানিই দেখা যাইতেছে।

আমার সেজকাকাবাবু, মা। আর এইটি আমার বোন বন্দনা। এই বলিয়া সতী কাছে আসিয়া হঠাৎ শাশুড়ীকে প্রণাম করিল। এমন অকারণে প্রণাম করা প্রথাও নয়, কেহ করেও না। দয়াময়ী মনে মনে হয়তো একটু আশ্চর্য হইলেন, কিন্তু সে উঠিয়া দাঁড়াইতে সস্নেহে সযত্নে তাহার চিবুক স্পর্শ করিয়া অঙ্গুলির প্রান্তভাগ চুম্বন করিয়া আশীর্বাদ করিলেন, কিন্তু বন্দনার প্রতি চোখ পড়িতেই তাঁহার চোখের দৃষ্টি রুক্ষ হইয়া উঠিল। দিদির দেখাদেখি সেও কাছে আসিয়া প্রণাম করিল, কিন্তু তিনি স্পর্শ করিলেন না, বরঞ্চ বোধ হয় স্পর্শ বাঁচাইতেই এক-পা পিছাইয়া গিয়া শুধু অস্ফুটে বলিলেন, বেঁচে থাক।

কহিলেন, বেইমশাই, নমস্কার। ছেলেমেয়ের ভাগ্য যে হঠাৎ আপনার পায়ের ধূলো পড়ল।

ভদ্রলোক প্রতি-নমস্কার করিয়া কহিলেন, নানা কারণে সময় পাইনে বেন্‌ঠাকরুন, কিন্তু না বলে কয়ে এমন হঠাৎ এসে পড়ার দোষ মার্জনা করবেন। এবারে যখন আসব যথাসময়ে একটা খবর দিয়েই আসব।

দয়াময়ী এ-সব কথার উত্তর দিলেন না, শুধু বলিলেন, পূজো-আহ্নিক এখনো সারা হয়নি বেইমশাই, আবার দেখা হবে। বৌমা, এদের ওপরে নিয়ে যাও, খাওয়া-দাওয়ার যেন কষ্ট না হয়। বিপিন এলে আমার কাছে একবার পাঠিয়ে দিয়ো। এই বলিয়া তিনি আর কোন দিকে না চাহিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। বাহ্যতঃ, প্রচলিত সৌজন্যের বিশেষ কিছু যে ত্রুটি হইল তাহা নয়, কিন্তু ভিতরের দিক দিয়া সকলেরই মনে হইল জ্যোৎস্নার মাঝামাঝি একখণ্ড কালো মেঘ নির্মল আকাশের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ভাসিয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *