বিজয়া – ৩.১

তৃতীয় অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

বিজয়ার বসিবার ঘর

[বিজয়া সুস্থ হইয়াছে, তবে শরীর এখনও দুর্বল। কালীপদর প্রবেশ]

কালী। (অশ্রুবিকৃত-স্বরে) মা, এতদিন তোমার অসুখের জন্যেই বলতে পারিনি, কিন্তু এখন আর না বললেই নয়। ছোটবাবু আমাকে জবাব দিয়েছেন।

বিজয়া। কেন?

কালী। কর্তাবাবু স্বর্গে গেছেন—তাঁর কাছে কখনো মন্দ শুনিনি, কিন্তু ছোটবাবু আমাকে দু’চক্ষে দেখতে পারেন না—দিনরাত গালাগালি করেন। কোন দোষ করিনে তবু—(চোখ মুছিয়া ফেলিয়া) সেদিন কেন তাঁকে জানাই নি, কেন নরেনবাবুকে তোমার ঘরে ডেকে এনেছিলুম,—তাই জবাব দিয়েছেন।

বিজয়া। (কঠিনস্বরে) তিনি কোথায়?

কালী। কাছারিঘরে বসে কাগজ দেখছেন।

বিজয়া। হুঁ। আচ্ছা দরকার নেই—এখন তুই কাজ করগে যা।

[কালীপদর প্রস্থান

[দয়াল প্রবেশ করিলেন]

দয়াল। তোমার কাছেই আসছিলাম মা!

বিজয়া। আসুন দয়ালবাবু, আপনার স্ত্রী ভাল আছেন ত?

দয়াল। আজ ভাল আছেন। নরেনবাবুকে চিঠি লিখতে, কাল বিকেলে এসে তিনি ওষুধ দিয়ে গেছেন। কি অদ্ভুত চিকিৎসা মা, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই পীড়া যেন বারো আনা আরোগ্য হয়ে গেছে।

বিজয়া। ভাল হবে না! আপনাদের সকলের কি সোজা বিশ্বাস ওঁর উপর!

দয়াল। সে কথা সত্যি। কিন্তু বিশ্বাস ত শুধু শুধু হয় না মা! আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি কিনা, মনে হয় ঘরে পা দিলেই সমস্ত ভাল হয়ে যাবে।

বিজয়া। তা হবে!

দয়াল। একটা কথা বলব মা—রাগ করতে পাবে না কিন্তু। তিনি ছেলেমানুষ সত্যি, কিন্তু যে-সব নামজাদা বিজ্ঞ চিকিৎসকের দল তোমার মিথ্যে চিকিৎসা করে টাকা আর সময় নষ্ট করলে, তাদের চেয়ে তিনি ঢের বেশী বিজ্ঞ—এ আমি শপথ করে বলতে পারি। আর একটা কথা মা, নরেনবাবু শুধু ওঁরই চিকিৎসা করে যাননি—আরও একজনের ব্যবস্থা করে গেছেন। (টেবিলের উপর একটুকরা কাগজ মেলিয়া) তোমাকে কিন্তু উপেক্ষা করতে দেব না, ওষুধটা একবার পরীক্ষা করে দেখতেই হবে বলে দিচ্চি।

বিজয়া। কিন্তু এ যে অন্ধকারে ঢিল ফেলা দয়ালবাবু—রুগী না দেখে prescription লেখা।

দয়াল। ইস, তাই বুঝি! কাল যখন তুমি তোমাদের বাগানের রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিলে—তখন ঠিক তোমার সুমুখের পথ দিয়েই যে তিনি হেঁটে গেছেন। তোমাকে ভাল করেই দেখে গেছেন—বোধ হয় অন্যমনস্ক ছিলে বলেই—

বিজয়া। তাঁর কি পরনে সাহেবী-পোশাক ছিল?

দয়াল। ঠিক তাই। দূর থেকে দেখলে ভুল হয়, বাঙালী বলে হঠাৎ চেনাই যায় না।

বিজয়া। (হাসিয়া) ওটা আপনার অত্যুক্তি দয়ালবাবু—স্নেহের বাড়াবাড়ি।

দয়াল। স্নেহ করি—খুবই করি সত্যি। তবু কথাটা আমার বাড়াবাড়ি নয় মা। অতবড় পণ্ডিত লোক, কিন্তু কথাগুলি যেমন মিষ্টি তেমনি শিশুর মত সরল। কিছুতে যেতে দিতে ইচ্ছে করে না, মনে হয় আরও কিছুক্ষণ ধরে রেখে দিই।

বিজয়া। ধরে রেখে দেন না কেন?

দয়াল। (হাসিয়া) সে কি হয় মা, তাঁর কত কাজ, কত পরিশ্রম তাঁকে করতে হয়। তবু গরীব বলে আমাদের ওপর কত দয়া। স্ত্রী রুগ্ন, তাঁকে দেখতে প্রায় ওঁকে আসতে হয়।

[বিলাস প্রবেশ করিল]

বিলাস। (বিজয়ার প্রতি) কেমন আছ আজ?

বিজয়া। ভালো আছি।

বিলাস। ভালো ত তেমন দেখায় না। (দয়ালের প্রতি) আপনি এখানে করছেন কি?

দয়াল। মাকে একবার দেখতে এলাম।

বিলাস। (টেবিলের উপর prescription-টার প্রতি দৃষ্টি পড়ায় হাতে তুলিয়ে লইয়া) prescription দেখচি যে। কার? (পরীক্ষা করিয়া) নরেনের নাম দেখচি যে! স্বয়ং ডাক্তারসাহেবের। কিন্তু এটা এল কি করে? (বিজয়া ও দয়াল উভয়েই নীরব)

বিলাস। শুনি না এল কি করে? ডাকে নাকি? হুঁ। ডাক্তার ত নরেন ডাক্তার? তাই বুঝি এদের ওষুধ খাওয়া হয় না; শিশির ওষুধ শিশিতেই পচে, তারপর ফেলে দেওয়া হয়? তা না হয় হলো—কিন্তু এই কলির ধন্বন্তরীটি কাগজখানি পাঠালেন কি করে? কার মারফতে? কথাটা আমার শোনা দরকার। (দয়ালের প্রতি) আপনি ত এতক্ষণ খুব lecture দিচ্ছিলেন—সিঁড়ি থেকেই গলা শোনা যাচ্ছিল—বলি, আপনি কিছু জানেন? একেবারে যে ভিজে বেড়ালটি হয়ে গেলেন। বলি জানেন কিছু?

দয়াল। আজ্ঞে হাঁ।

বিলাস। ওঃ—তাই বটে! কোথায় পেলেন সেটাকে?

দয়াল। আজ্ঞে তিনি আমার স্ত্রীকে দেখতে আসেন কিনা—আর বেশ সুন্দর চিকিৎসা করেন—তাই আমি বলেছিলুম, মা বিজয়ার জন্যে যদি একটা—

বিলাস। তাই বুঝি এই ব্যবস্থাপত্র? আপনি দাঁড়িয়েছেন মুরুব্বি? হুঁ। (একমুহূর্ত পরে) আপনাকে গেল বছরের হিসাবটা সারতে বলেছিলুম,—সেটা সারা হয়েছে?

দয়াল। আজ্ঞে, দু’দিনের মধ্যেই সেরে ফেলব।

বিলাস। হয়নি কেন?

দয়াল। বাড়িতে ভারী বিপদ যাচ্ছিল—নিজ হাতে রাঁধতে হতো—আসতেই পারিনি।

বিলাস। (বিদ্রূপ করিয়া) আসতেই পারিনি! তবে আর কি—আমাকে রাজা করেছেন। আমি তখনই বাবাকে বলেছিলুম—এ-সব বুড়ো-হাবড়া নিয়ে আমার কাজ চলবে না। এদের আমি চাইনে।

বিজয়া। (অনুচ্চ কঠিন-স্বরে) দয়ালবাবুকে এখানে কে এনেছে জানেন? আপনার বাবা নন—এনেচি আমি।

বিলাস। যেই আনুক, আমার জানবার দরকার নেই। আমি কাজ চাই—কাজের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ।

বিজয়া। যাঁর বাড়িতে বিপদ, তিনি কি করে কাজ করতে আসবেন?

বিলাস। অমন সবাই বিপদের দোহাই পাড়ে, কিন্তু সে শুনতে গেলে আমার চলে না। আমি দরকারী কাজ সেরে রাখতে হুকুম দিয়েছিলুম, হয়নি কেন, সেই কৈফিয়ত চাই। বিপদের খবর জানতে চাইনে।

বিজয়া। দয়ালবাবু, আপনি তা হলে এখন আসুন। নমস্কার।

[দয়ালের প্রস্থান

দয়ালবাবু গেছেন, এখন বলুন কি বলছিলেন?

বিলাস। বলছিলুম, আমি দরকারী কাজ সেরে রাখবার হুকুম দিয়েছিলুম, হয়নি কেন তার কৈফিয়ত চাই; বিপদের খবর জানতে চাইনে।

বিজয়া। দেখুন বিলাসবাবু, জগতের সবাই মিথ্যাবাদী নয়। সবাই মিথ্যা বিপদের দোহাই দেয় না, অন্ততঃ মন্দিরের আচার্য দেন না। সে যাক, কিন্তু আপনাকে জিজ্ঞাসা করি আমি, যখন জানেন দরকারী কাজ হওয়া চাই-ই তখন নিজে কেন সেরে রাখেন নি? আপনি কেন চারদিন কাজ কামাই করলেন? কি বিপদ আপনার হয়েছিল শুনি?

বিলাস। (হতবুদ্ধি হইয়া) আমি নিজে খাতা সেরে রাখব! আমি কামাই করলুম কেন?

বিজয়া। হাঁ আমি তাই জানতে চাই। মাসে মাসে দুশো টাকা মাইনে আপনি নেন। সে টাকা ত আমি শুধু শুধু আপনাকে দিইনে,—কাজ করবার জন্যই দিই।

বিলাস। আমি চাকর? আমি তোমার আমলা?

বিজয়া। কাজ করবার জন্যে যাকে মাইনে দিতে হয়, তাকে ও ছাড়া আর কি বলে? আপনার অসংখ্য অত্যাচার আমি নিঃশব্দে সয়ে এসেছি। কিন্তু যত সহ্য করেচি, অন্যায়-উপদ্রব ততই বেড়ে গেছে। যান, নীচে যান। প্রভু-ভৃত্যের সম্বন্ধ ছাড়া আজ থেকে আপনার সঙ্গে আর আমার কোন সম্বন্ধ থাকবে না। যে নিয়মে আমার অপর কর্মচারীরা কাজ করে, ঠিক সেই নিয়মে কাজ করতে পারেন করবেন, নইলে আপনাকে আমি জবাব দিলুম, আমার কাছারিতে আর ঢোকবার চেষ্টা করবেন না।

বিলাস। (লাফাইয়া উঠিয়া—দক্ষিণ হস্তের তর্জনী কম্পিত করিতে করিতে) তোমার এত দুঃসাহস?

বিজয়া। দুঃসাহস আমার নয়, আপনার। আমার এস্টেটেই চাকরি করবেন, আর আমার উপরেই জুলুম করবেন! আমাকে ‘তুমি’ বলবার অধিকার কে আপনাকে দিয়েছে? আমার চাকরকে আমারই বাড়িতে জবাব দেবার—আমার অতিথিকে আমারই চোখের সামনে অপমান করবার—এ-সকল স্পর্ধা আপনার কোথা থেকে জন্মাল?

বিলাস। (ক্রোধে উন্মত্তপ্রায় হইয়া) অতিথির বাপের পুণ্য যে সেদিন তার একটা হাত ভেঙ্গে দিইনি! নচ্ছার, বদমাইশ, জোচ্চোর, লোফার কোথাকার! আর কখনো যদি তার দেখা পাই—

[চিৎকার-শব্দে ভীত হইয়া কানাই সিং প্রভৃতি দরজায় আসিয়া উঁকি মারিয়া
দেখিতে লাগিল—বিজয়া লজ্জিত হইয়া কণ্ঠস্বর সংযত এবং স্বাভাবিক
করিয়া লইল]

বিজয়া। আপনি জানেন না, কিন্তু আমি জানি, সেটা আপনারই কত বড় সৌভাগ্য যে, তাঁর গায়ে হাত দেবার অতি-সাহস আপনার হয়নি। তিনি উচ্চশিক্ষিত ভদ্রলোক। সেদিন তাঁর গায়ে হাত দিলেও হয়ত তিনি একজন পীড়িত স্ত্রীলোকের ঘরের মধ্যে বিবাদ না করে সহ্য করেই চলে যেতেন। কিন্তু এই উপদেশটা আমার ভুলবেন না যে, ভবিষ্যতে তাঁর গায়ে হাত দেবার ইচ্ছা যদি আপনার থাকে ত পিছন থেকে দেবেন, সুমুখে এসে দেবার দুঃসাহস করবেন না। কিন্তু অনেক চেঁচামেচি হয়ে গেছে—আর না। নীচে থেকে চাকর-বাকর, দরোয়ান পর্যন্ত ভয় পেয়ে উপরে উঠে এসেছে—যান নীচে যান।

[বিলাস ক্রোধে বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া রহিল। তাহার অনলবর্ষী দৃষ্টি বিজয়ার গমনপথের
দিকে দৃঢ়-নিবদ্ধ রহিল। ব্যস্ত হইয়া রাসবিহারী প্রবেশ করিলেন]

রাস। ব্যাপার কি বিলাস? এত চেঁচামেচি কিসের? বিজয়া কোথায়?

বিলাস। জানো বাবা, বিজয়া আমায় বললে আমি তার মাইনের চাকর। অন্য চাকরের মত মনিবের মন যুগিয়ে না চললে আমাকে ডিসমিস করবে।

রাস। কেন? কেন? হঠাৎ এ কথা কেন? কি বলেছিলে তাকে?

বিলাস। বলব আবার কি? কালীপদকে জবাব দিয়েছিলুম—এই হলো প্রথম অপরাধ।

রাস। বল কি? তা এত শীঘ্র তাকে জবাব দিতেই বা গেলে কেন? এই ত সেদিন নরেনকে খামকা অপমান করলে—জানো ত তার প্রতি বিজয়ার—

বিলাস। ওই ত হচ্ছে আসল রোগ। সেই জোচ্চোর লোফারটার জন্যেই ত এত কাণ্ড। জানো বাবা, বিজয়া বলে কিনা, চাকর হয়ে আমি তার অতিথিকে—সেই নরেনটাকে—অপমান করি কোন্‌ সাহসে—

রাস। অ্যাঁ, আর কি সে বললে? নাঃ, আমি যতই গুছিয়ে-গাছিয়ে আনি—তুমি কি ততই একটা -না-একটা বিভ্রাট বাধিয়ে তুলবে!

বিলাস। বিভ্রাট কিসের? ঐ ব্যাটা কালীপদকে তাড়াব না ত কি তাকে বাড়িতে রাখতে হবে? বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ সেই একটা অসভ্য জানোয়ারকে নিয়ে এসে বিজয়ার ঘরে বিছানার ওপরই বসালে—আর ঐ বুড়ো দয়ালটাও জুটেছে তেমনি!

রাস। আবার তাঁকেও কিছু বলেছ নাকি? সর্বনাশ বাধালে দেখছি!

বিলাস। বলব না? একশো বার বলব। নরেন ডাক্তারের ওপর তাঁর বড় টান। সেটাকে দিলাম সেদিন ঘর থেকে বার করে—আর উনি কিনা লুকিয়ে এসেছেন তারই দালালি করতে, একটা prescription পর্যন্ত এনে হাজির—বিজয়ার চিকিৎসা হবে। এদিকে স্ত্রীর অসুখের ছুতো করে বুড়ো চারদিন ডুব মেরে রইল, একবার কাছারিতে পর্যন্ত এল না; worthless, old fool!

[রাসবিহারী ক্রোধে ও ক্ষোভে নির্বাক স্তব্ধভাবে চাহিয়া রহিলেন]

বিলাস। বিজয়া আজ তোমাকে পর্যন্ত অপমান করতে ছাড়লে না।

রাস। তাতে তোমার কি?

বিলাস। আমার কি? আমার মুখের ওপর বলবে দয়ালবাবুকে রাসবিহারীবাবু আনেন নি, এনেছি আমি! বলবে, দয়াল কাজ করুন না করুন তাকে কেউ কিছু বলতে পারবে না! ও আমাকে বলে আমলা! বলে, যে নিয়মে আমার অপর কর্মচারীরা কাজ করে সেই নিয়মে কাজ করুন, নইলে চলে যান!

রাস। সে ত শুধু তোমাকে চলে যেতে বলেছে, আমার ইচ্ছে হচ্চে তোমার গলায় ধাক্কা মেরে বার করে দিই!

বিলাস। অ্যাঁ!

রাস। ছোট জাত ত আর মিছে কথা নয়! হাজার হোক সেই চাষার ছেলে ত! বামুন-কায়েতের ছেলে হলে ভদ্রতাও শিখতিস, নিজের ভাল-মন্দও বুঝতিস, হিতাহিত কাণ্ডজ্ঞানও জন্মাত। যাও, এখন মাঠে মাঠে হাল-গরু নিয়ে কুলকর্ম করে বেড়াও গে! উঠতে-বসতে তোকে পাখিপড়া করে শেখালাম যে, ভালোয় ভালোয় কাজটা একবার হয়ে যাক, তারপরে যা ইচ্ছে হয় করিস; তোর সবুর সইল না, তুই গেলি তাকে ঘাঁটাতে! সে হলো রায়-বংশের মেয়ে। ডাকসাইটে হরি রায়ের নাতনী। তুই হাত বাড়িয়ে গেছিস তার নাকে দড়ি পরাতে—মুখ্য কোথাকার! মান-ইজ্জত সব গেল, এত বড় জমিদারির আশা-ভরসা গেল, মাসে মাসে দু-দুশো টাকা মাইনে বলে আদায় হচ্ছিল সে গেল—যাও এখন চাষার ছেলে লাঙ্গল ধর গে। আবার আমার কাছে এসেছেন—চোখ রাঙ্গিয়ে তার নামে নালিশ করতে! দূর হঃ!—তোর আর মুখদর্শন করব না!

[বলিয়া রাসবিহারী নিজেই দ্রুতবেগে চলিয়া গেলেন, পিছনে পিছনে বিলাসও বিহ্বলের
ন্যায় ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। ধীরে ধীরে বিজয়া প্রবেশ
করিয়া টেবিলে মাথা নত করিয়া বসিল। দয়ালের প্রবেশ]

দয়াল। এ কি কাণ্ড করে বসলে মা! আর তা-ও আমার মত একটা হতভাগ্যের জন্যে! আমি যে লজ্জায়, সঙ্কোচে, অনুতাপে মরে যাচ্চি।

বিজয়া। (মুখ তুলিয়া চোখ মুছিয়া) আপনি কি বাড়ি চলে যাননি?

দয়াল। যেতে পারলাম না মা। পা থরথর করে কাঁপতে লাগল, বারান্দার ওধারে একটা টুলের ওপর বসে পড়লাম। অনেক কথাই কানে এল।

বিজয়া। না এলেই ভাল হতো, কিন্তু আমি অন্যায় কিছু করিনি। আপনাকে অপমান করার তাঁর কোন অধিকার ছিল না।

দয়াল। ছিল বৈ কি মা। যে কাজ আমার করা উচিত ছিল করিনি, একটা চিঠি লিখে তাঁর কাছে ছুটি পর্যন্ত নিইনি—এ-সব কি আমার অপরাধ নয়? রাগ কি এতে মনিবের হয় না?

বিজয়া। কে মনিব, বিলাসবাবু? নিজেকে কর্ত্রী বলতে আমার লজ্জা করে দয়ালবাবু, কিন্তু ও দাবী যদি কারো থাকে সে আমারই। আর কারো নয়।

দয়াল। ও কথা বলতে নেই মা, রাগ করেও না। আমাদের মনিব যেমন তুমি তেমনি বিলাসবাবু। এই ত আমরা সবাই জানি।

বিজয়া। সে জানা ভুল। আমি ছাড়া এ বাড়িতে আর কেউ মনিব নেই।

দয়াল। শান্ত হও মা, শান্ত হও। বিলাসবাবু একটু ক্রোধী, অল্পেই চঞ্চল হয়ে পড়েন এই তাঁর দোষ, কিন্তু মানুষ ত সর্বগুণান্বিত হয় না, কোথাও একটু ত্রুটি থাকেই। এইখানে নলিনীর সঙ্গে আমার মেলে না। সেদিন রোগে তুমি শয্যাগত, তোমার ঘরের মধ্যে নরেনকে অপমান করার কথা শুনে নলিনী রাগে জ্বলতে লাগল। বললে, এর আসল কারণ বিলাসবাবুর বিদ্বেষ। নিছক হিংসা আর বিদ্বেষ।

বিজয়া। বিদ্বেষ কিসের জন্যে দয়ালবাবু?

দয়াল। কি জানি, কেমন করে যেন নলিনীর মনে হয়েছে নরেনকে তুমি মনে মনে—করুণা—করো। এইটেই বিলাসবাবু কিছুতে সইতে পারচেন না।

বিজয়া। কিন্তু করুণা ত তাঁকে আমি করিনি। আমার একটা কাজেও ত তাঁর প্রতি করুণা প্রকাশ পায়নি দয়ালবাবু।

দয়াল। আমিও ত তাই বলি। বলি, তেমন করুণা ত বিজয়া সকলকেই করেন। আমাকেই কি তিনি কম দয়া করছেন!

বিজয়া। দয়ার কথা ইচ্ছে হলে আপনারা বলতেও পারেন, কিন্তু নরেনবাবু পারেন না। বরঞ্চ, বার বার যা পেয়েছেন সে আমার নিষ্ঠুরতারই পরিচয়। সত্যি কিনা বলুন?

দয়াল। (সলজ্জে) না না, সত্যি নয়—সত্যি নয়—তবে নরেন নিজে কতকটা তাই ভাবে বটে। সেদিন কালীপদকে দিয়ে তুমি আমার ওখানে তার microscope-টা পাঠিয়ে দিলে, নরেন জিজ্ঞাসা করলে, কত টাকা দিতে বলেচেন? কালীপদ বললে, টাকার কথা বলে দেননি—এমনি। এমনি কি রে? কালীপদ বললে, হাঁ, এমনি নিয়ে যান, টাকা বোধহয় দিতে হবে না। সত্যি ত আর এ বিশ্বাস করা যায় না—নিশ্চয় কালীপদর ভুল হয়েছে—এতেই নরেন রেগে উঠে বললে, তাঁকে বল্‌ গে যা, আমাকে দান করার দরকার নেই, ঠাট্টা করবারও দরকার নেই। যা, ফিরিয়ে নিয়ে যা।

বিজয়া। শুনেছি আমি কালীপদর মুখে।

দয়াল। কিন্তু নলিনী তাঁকে বারণ করেছিল। ওর ধারণা নরেনের হয়ত কাজ আটকাচ্চে ভেবেই বিজয়া পাঠিয়ে দিয়েছেন, নইলে উপহার বলেও নয়, বিদ্রূপ করার জন্যেও নয়। ভেবেচেন হাতে হাতে টাকা না নিয়ে যেদিন হোক পরে নিলেই হবে। আমারও তাই মনে হয়। বল ত মা সত্যি নয় কি?

বিজয়া। জানিনে দয়ালবাবু। অসুখের মধ্যে পাঠিয়েছিলুম, ঠিক মনে করতে পারিনে তখন কি ভেবেছিলুম।

দয়াল। কিন্তু নলিনী বলে নিশ্চয় এই। বললে, নরেনের মত ভদ্র, আত্মভোলা, নিঃস্বার্থপর মানুষকে কেউ কখনো অপমান করতে পারে না এক বিলাসবাবু ছাড়া। কিন্তু নরেন নিজে কোনমতেই এ কথা বিশ্বাস করতে পারলে না, বললে, যে লোক আমার পরম দুর্গতির দিনে ওটা দুশো টাকা দিয়ে কিনে দুদিন পরেই নিজের মুখে চারশো টাকা চায় তার কিছুই অসম্ভব নয়। ওরা বড়লোক, ওদের অনেক ঐশ্বর্য—তাই আমাদের মত নিঃস্বদের উপহাস করতেই ওরা আনন্দ পায়। কিন্তু যাক গে এ-সব কথা মা! তোমাদের উভয়কেই ভালবাসি, ভাবলে আমার ক্লেশ বোধ হয়। (একটুখানি মৌন থাকিয়া) নরেন কিন্তু তোমার বিলাসকে অকপটে ক্ষমা করেছে। এমনি অন্যমনস্ক, নিঃসঙ্গ লোক ও, যে সবাই যখন শুনেচে তোমাদের বিবাহ স্থির হয়ে গেছে, তখনো শোনেনি কেবল ও-ই! তোমার ঘর থেকে বার করে এনে রাসবিহারীবাবু যখন খবরটা তাকে দিলেন তখন শুনে যেন ও চমকে গেল। বিলাসবাবুর রাগের কারণটা বুঝতে পেরে তাঁকে তখনি ক্ষমা করলে। শুধু এইটুকুই সে আজো ভেবে পায় না যে, তার মত দরিদ্র গৃহহীন দুর্ভাগাকে বিলাসবাবু সন্দেহের চোখে দেখলেন কি ভেবে। এত বড় ভ্রম তাঁর হলো কি করে? আমিও ঠিক তাই ভাবি, শুধু নলিনীই ঘাড় নাড়ে—সমস্ত কথাই সে শুনেচে।

বিজয়া। শুনেচেন? শুনে কি বলেন নলিনী?

দয়াল। বলে না কিছুই, শুধু মুখ টিপে হাসে।

বিজয়া। তিনি কি চলে গেছেন?

দয়াল। না, আজ যাবে। বলেছিল যাবার পথে তোমার সঙ্গে একবার দেখা করে যাবে। কিন্তু তিনটে বাজল বোধ হয়, এল বলে। কিংবা হয়ত নরেনের জন্যে অপেক্ষা করে আছে।

বিজয়া। কলকাতা থেকে আজ বুঝি তাঁর আসার কথা আছে?

দয়াল। হাঁ। আমার স্ত্রীকে দেখতে আসবেন। কিন্তু আমারই হবে সবচেয়ে মুশকিল মা, নরেন যদি কলকাতা থেকে চলে যায়।

বিজয়া। যাবার কথা আছে নাকি?

দয়াল। আছে বৈ কি। পরশুই ত বলছিল এখানে থাকার আর ইচ্ছে নেই, South Africa-র কোথায় নাকি কাজের সম্ভাবনা আছে—খবর পেলেই রওনা হবে।

বিজয়া। অত দূরে?

দয়াল। আমরাও তাই বলছিলাম। কিন্তু ও বলে, আমার দূরই বা কি, আর কাছেই বা কি? দেশই বা কি, আর বিদেশই বা কি? সবই ত সমান। শুনে ভাবলাম, সত্যিই ত। কি-ই বা আছে এখানে যা ওকে টেনে রাখবে। কিন্তু ভাবলেও চোখে যেন জল এসে পড়ে। কিন্তু আর না মা, আমি উঠি, একটু কাজ আছে সেরে নিই গে।

বিজয়া। কিন্তু বাড়ি যাবার আগে আর একবার দেখা করে যাবেন। এমনি চলে যাবেন না।

[ কালীপদ প্রবেশ করিল ]

কালীপদ। (দয়ালের প্রতি) ডাক্তারসাহেব একবার দেখা করতে চান।

দয়াল। কে ডাক্তার, আমাদের নরেন? আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়? এখানে এসে?

কালীপদ। নীচের ঘরে বসাব, না চলে যেতে বলে দেব?

বিজয়া। চলে যেতে বলবি? কেন? যা আমার এই ঘরে তাঁকে ডেকে নিয়ে আয়।

[মাথা নাড়িয়া কালীপদ প্রস্থান করিল

দয়াল। এখানে ডেকে আনা কি ভালো হবে মা?

বিজয়া। আমার বাড়িতে ভাল-মন্দ বিচারের ভার আমার উপরেই থাক দয়ালবাবু।

দয়াল। না না, তা আমি বলিনি, কিন্তু বিলাসবাবু শুনতে পেলে কি—

বিজয়া। শুনতে পাওয়াই তাঁর দরকার মনে করি। নিজের যথাযোগ্য স্থানটার সম্বন্ধে ধারণা তাতে পাকা হয়।

[কালীপদ প্রবেশ করিল]

কালীপদ। ডাক্তারসাহেব এলেন না, চলে গেলেন।

দয়াল। চলে গেলেন? কেন?

কালীপদ। জিজ্ঞেসা করলেন, মিস দাস আছেন। বললুম, না। বললেন, তাহলে আবশ্যক নেই, ও-বাড়িতেই দেখা হবে। এই বলেই চলে গেলেন।

দয়াল। মা ডেকেছিলেন, বলেছিলে তাঁকে?

কালীপদ। বলেছিলুম বৈ কি। বললেন, আজ সময় নেই, ছ’টার গাড়িতে ফিরে যেতে হবে। যদি সময় পান আর একদিন এসে দেখা করে যাবেন।

দয়াল। (সলজ্জে) কি জানি এ রকম ত তার প্রকৃতি নয় মা। বোধ হয় সত্যিই খুব তাড়াতাড়ি।

বিজয়ী। (কালীপদর প্রতি) আচ্ছা তুই যা এখান থেকে।

[যাওয়ার মুখে কালীপদ হঠাৎ ব্যস্ত হইয়া উঠিল, বলিল, কর্তাবাবু
আসছেন এবং সসঙ্কোচে অন্য দ্বার দিয়া বাহির হইয়া গেল।
মন্থরপদে রাসবিহারীবাবু প্রবেশ করিলেন]

রাস। এই যে মা বিজয়া। দয়ালবাবুও রয়েছেন দেখছি। বসো মা বসো বসো।

[দয়াল সসম্ভ্রমে নমস্কার করিলেন, বিজয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। রাসবিহারী
আসন গ্রহণ করিলে বিজয়া পুনরায় উপবেশন করিল]

রাস। এ ভালোই হলো যে দুজনের সঙ্গে একত্রেই দেখা হলো। আরও আগেই আসতে পারতাম কিন্তু বিলাসের হঠাৎ সর্দিগর্মির মত হয়ে—মাথায়-মুখে জল দিয়ে, বাতাস করে সে একটু সুস্থ হলে তবে আসতে পারলাম—তার মুখে সবই শুনতে পেলাম দয়ালবাবু। (দয়াল কি একটা বলিবার চেষ্টা করিতেই হাত নাড়িয়া তাঁহাকে বাধা দিয়া) না না না—তার দোষ-স্খালনের চেষ্টা করবেন না দয়ালবাবু। যে আপনার মত সাধু ভগবৎ-প্রাণ ব্যক্তিকেও অসম্মান করতে পারে তার সপক্ষে কিছুই বলবার নেই। আপনার কর্মে শৈথিল্য প্রকাশ পেয়েছে,—কিন্তু তাতে কি? সাহেবরা বিলাসের কর্তব্যনিষ্ঠা, তার কর্মময় জীবনের শত প্রশংসা করুক, কিন্তু আমরা ত সাহেব নয়, কর্মই ত আমাদের জীবনের সবখানি অধিকার করে নেই! কিন্তু ও শাস্তি পেলে কার কাছে? দেখেছেন দয়ালবাবু করুণাময়ের করুণা—ও শাস্তি পেলে তারই কাছে যে তার ধর্মসঙ্গিনী, আত্মা যাদের পৃথক নয়! দীর্ঘজীবী হও মা, এই ত চাই! এই ত তোমার কাছে আশা করি! (ক্ষণকাল পরে) কিন্তু এই কথাটা আমি কোনমতে ভেবে পাইনে বিজয়া, বিলাস আমার মত খোলাভোলা সংসার-উদাসী লোকের ছেলে হয়ে এতবড় কর্মপটু পাকা বিষয়ী হয়ে উঠল কি করে? কি যে তাঁর খেলা, কি যে সংসারের রহস্য কিছুই বোঝবার জো নেই মা!

দয়াল। তাঁর দোষ নেই রাসবিহারীবাবু, আমারই ভারী অন্যায় হয়ে গেছে। এই তরুণ বয়সেই কি যে তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা, কি যে তাঁর চিত্তের দৃঢ়তা তা বলতে পারিনে। আমাকে তিনি উচিত কথাই বলেছেন।

রাস। উচিত কথা? এবার আমি সত্যিই দুঃখ পাব দয়ালবাবু। আপনি ভক্তিমান, জ্ঞানবান, কিন্তু বয়সে আমি বড়। এ আমি জানি, সংসারে অত্যন্ত বস্তুটা কিছুরই ভালো নয়। এও জানি, বিলাসের কর্ম-অন্ত প্রাণ, এখানে সে অন্ধ, কিন্তু তাই বলে কি মানীর মান রাখতেও হবে না? না না, আমি বুড়োমানুষ, সে তেজও নেই, জোরও নেই—এ আমি ভালো বলতে পারব না। নিজের ছেলে বলে ত এ-মুখ দিয়ে মিথ্যে বার হবে না দয়ালবাবু!

দয়াল। সাধু! সাধু!

রাস। এ ভালই হয়েছে মা। আমি অপার আনন্দ লাভ করেচি যে, বিলাস তার সর্বোত্তম শিক্ষাটি আজ তোমার হাত থেকেই পাবার সুযোগ পেলে। কিন্তু কি ভ্রম দেখেছেন দয়ালবাবু, আনন্দে এমনি আত্মহারা হয়েছি যে, আমার মাকেই বোঝাতে যাচ্চি। যেন আমার চেয়ে তিনি তার কম মঙ্গলাকাঙ্ক্ষিণী। আজ এত আনন্দ ত শুধু এইজন্যেই যে তোমার কাজ তুমি নিজের হাতে করেচ। তার সমস্ত শুভ যে শুধু তোমার হাতেই নির্ভর করচে। তার শক্তি, তোমার বুদ্ধি। সে ভার বহন করে চলবে, তুমি পথ দেখাবে। জগদীশ্বর! (চোখ তুলিয়া) ইস! চারটে বাজে যে! অনেক কাজ এখনো বাকী, আসি মা বিজয়া! আসি দয়ালবাবু। (প্রস্থানোদ্যম)

দয়াল। চলুন আমিও যাই।

রাস। কিন্তু আসল কথাটাই যে এখনো বলা হয়নি। (ফিরিয়া আসিয়া উপবেশন করিলেন) তোমার এই বুড়ো কাকাবাবুর একটি অনুরোধ তোমাকে রাখতে হবে। বলো রাখবে?

বিজয়া। বলুন, কি?

রাস। লজ্জায়, ব্যথায়, অনুতাপে সে দগ্ধ হয়ে যাচ্চে। কিন্তু এক্ষেত্রে তোমাকে একটু কঠিন হতে হবে। সে এসে ক্ষমা চাইলেই যে ভুলে যাবে সে হবে না। শাস্তি তার পূর্ণ হওয়া চাই। অন্ততঃ একটা দিনও এই দুঃখ সে ভোগ করুক এই আমার অনুরোধ।

বিজয়া। বিলাসবাবু কি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন?

রাস। না, সে আমি বলব না,—সে কিছু নয়—ও-কথা শুনে তোমার কাজ নেই।

বিজয়া। কালীপদ?

[কালীপদ প্রবেশ করিল]

কালীপদ। আজ্ঞে—

বিজয়া। বিলাসবাবু আফিসঘরে আছেন, একবার তাঁকে ডেকে আনো।

কালীপদ। সে আজ্ঞে—

[কালীপদ চলিয়া গেল

রাস। (সস্নেহ মৃদু ভর্ৎসনার সুরে) ছি মা! শুনে পারলে না থাকতে? এখুনি ডেকে পাঠালে? (হাসিয়া দয়ালের প্রতি) ঠিক এই ভয়টিই করেছিলুম দয়ালবাবু। সে ব্যথা পাচ্চে শুনলে বিজয়া সইতে পারবে না—তাই বলতে চাইনি—কি করে হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল—কিন্তু আমি বাধা দেব কি করে? মা যে আমার করুণাময়ী! এ যে সংসারে সবাই জেনেছে। আসুন দয়ালবাবু—

দয়াল। চলুন যাই।

[কালীপদ প্রবেশ করিল]

কালীপদ। ছোটবাবু বাড়ি চলে গেছেন, তাঁকে ডেকে আনতে লোক গেল।

রাস। লোক গেল? আজ তাকে না ডাকলেই ভালো হতো মা। কিন্তু—ওঃ! গোলেমালে একটা মস্ত কাজ যে আমরা ভুলে যাচ্ছি। দয়ালবাবু, আজ যে বছরের প্রথম দিন! আমাদের যে অনেক দিনের কল্পনা আজকের শুভদিনে বিশেষ করে মাকে আমরা আশীর্বাদ করব! তবে, ভালোই হয়েছে, আমরা না চাইতেই বিলাসকে ডেকে আনতে লোক গেছে। এ-ও সেই করুণাময়ের নির্দেশ। আসুন দয়ালবাবু, আর বিলম্ব করব না—সামান্য আয়োজন সম্পূর্ণ করে নিই—বিলাস এসে পড়লেই আমরা ফিরে এসে বিজয়াকে আমাদের সমস্ত কল্যাণ-কামনা উজাড় করে ঢেলে দিয়ে যাব। আসুন।

[উভয়ের প্রস্থান। বিজয়া যাইবার পূর্বে টেবিলের চিঠিপত্রগুলা গুছাইয়া
রাখিতেছিল, কালীপদ মুখ বাড়াইয়া বলিল]

কালীপদ। মা, ডাক্তারসাহেব—
[বলিয়াই অদৃশ্য হইল। নরেন প্রবেশ করিয়া
hat ও ছড়িটা একপাশে রাখিতে রাখিতে]

নরেন। নমস্কার! পথ থেকে ফিরে এলুম, ভাবলুম, যে বদ্‌রাগী লোক আপনি, না এলে হয়ত ভয়ানক রাগ করবেন।

বিজয়া। ভয়ানক রেগে আপনার করতে পারি কি?

নরেন। কি করতে পারেন সেটা ত প্রশ্ন নয়, কি না করতে পারেন সেটাই আসল কথা। কিন্তু বাঃ! আমার ওষুধে দেখছি চমৎকার ফল হয়েছে।

বিজয়া। আপনার ওষুধে কি করে জানলেন? আমাকে দেখে, না কারো কাছে শুনে!

নরেন। শুনে। কেন, আপনি কি দয়ালবাবুর কাছে শোনেন নি যে আমার ওষুধ খেতে পর্যন্ত হয় না, শুধু প্রেস্‌ক্রিপশনটার ওপর চোখ বুলিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিলেও অর্ধেক কাজ হয়! হাঃ—হাঃ—হাঃ—

বিজয়া। (হাসিয়া ফেলিয়া) তাই বুঝি বাকী অর্ধেকটা সারাবার জন্যে পথ থেকে ফিরে এলেন? কিন্তু ওদিকে নলিনী বেচারা যে আপনার অপেক্ষা করে পথ চেয়ে রইল?

নরেন। তা বটে। দয়ালবাবুর স্ত্রীকে গিয়ে একবার দেখে আসতে হবে। কিন্তু আমাকে নিয়ে আচ্ছা কাণ্ড করলেন ত বিলাসবাবুর সঙ্গে! ছি ছি ছি ছি—হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ—

বিজয়া। এর মধ্যে বললে কে আপনাকে?

নরেন। দয়ালবাবু। এইমাত্র নীচে তাঁর সঙ্গে দেখা—ছি ছি ছি—আপনার ভারী অন্যায়! ভারী অন্যায়! হাঃ হাঃ হাঃ—

বিজয়া। অন্যায় আমার, কিন্তু আপনি এত খুশী হয়ে উঠলেন কেন?

নরেন। (গম্ভীর হইয়া) খুশী হয়ে উঠলুম? একেবারে না। অবশ্য এ কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে পারিনে যে শুনেই প্রথমে একটু আমোদ বোধ করেছিলুম, কিন্তু তারপরে বাস্তবিক দুঃখিত হয়েছি। আপনার মত বিলাসবাবুর মেজাজটাও তেমন ভাল নয়—ভবিষ্যতে আপনারা যে দিনরাত লাঠালাঠি করবেন!

বিজয়া। আপনি ত তাই চান।

নরেন। (জিভ কাটিয়া সলজ্জে) না না না না—ছি ছি, ও-কথা বলবেন না। সত্যিই আমি শুনে বড় ক্ষুণ্ণ হয়েছি। তাঁর মেজাজটা ভালো নয় বটে, কিন্তু আপনি নিজেও যে অসহিষ্ণু হয়ে কতকগুলো অপমানের কথা বলে ফেলবেন সে-ও ভারী অন্যায়। ভেবে দেখুন দিকি কথাটা প্রকাশ পেলে ভবিষ্যতে কি রকম লজ্জার কারণ হবে? বিশেষ করে আমার জন্যে আপনাদের মধ্যে এরূপ একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটায়—

বিজয়া। তাই আহ্লাদে হাসি চাপতে পাচ্চেন না?

নরেন। (গম্ভীরমুখে) ছি ছি, কেন আপনি বার বার এ-রকম মনে করচেন? বিশ্বাস করুন যথার্থ-ই আমি বড় দুঃখিত হয়েছি। কিন্তু তখন আমি আপনাদের সম্বন্ধে কিছুই জানতুম না। জ্বরের ঘোরে কি সামান্য একটা কথা আপনি বললেন তাতেই এত! প্রথমে আমি ত হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলুম বিলাসবাবুর উগ্রতা দেখে, তারপরে বাইরে এনে রাসবিহারীবাবু আমাকে যা বুঝিয়ে বললেন তারও সঙ্কেত ঐ ঈর্ষা, এবং মিস নলিনীও স্পষ্ট বললেন ঈর্ষা, আর দয়ালবাবুও তাতেই যেন সায় দিলেন। শুনে লজ্জায় মরে যাই, অথচ সত্যি বলচি আপনাকে, এত লোকের মধ্যে আমার মত একটা নগণ্য লোককে বিলাসবাবুর ঈর্ষা করার কি আছে আমি ত আজও ভেবে পেলুম না। (ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া) আপনারা ত আবশ্যক হলে সকলের সঙ্গে কথা কন, এতে এমনি কি দোষ তিনি দেখতে পেলেন? যাই হোক, আপনারা আমাকে মাপ করবেন—আর ঐ বাংলায় কি যে বলে—অভি—অভিনন্দন—আমিও আপনাকে তাই জানিয়ে যাচ্ছি, আপনারা সুখী হোন।

বিজয়া। (মুখ ফিরাইয়া) অভিনন্দন আজ না জানিয়ে বরঞ্চ সেইদিনই আশীর্বাদ করবেন।

নরেন। সেদিন? কিন্তু ততদিন পারব থাকতে?

বিজয়া। না, সে হবে না। রাসবিহারীবাবুকে কথা দিয়েছেন, আপনাকে থাকতেই হবে।

নরেন। কথা দিইনি বটে, কিন্তু দিতেই ইচ্ছে করে। যদি থাকি আসবই। (বিজয়া অলক্ষ্যে চোখ মুছিয়া ফেলিল) ভাল কথা। আমার আর একটা ক্ষমা চাইবার আছে। সেদিন কালীপদকে দিয়ে হঠাৎ microscope-টা পাঠিয়েছিলেন কেন?

বিজয়া। আপনার জিনিস আপনি নিজেই ত ফিরে চেয়েছিলেন।

নরেন। তা বটে, কিন্তু দামের কথাটা ত বলে পাঠান নি? তা হলে ত—

বিজয়া। আমার ভুল হয়েছিল। কিন্তু সেই ভুলের শাস্তি আপনি ত আমাকে কম দেননি!

নরেন। কিন্তু কালীপদ যে বললে—

বিজয়া। যাই বলুক সে, কিন্তু আপনাকে উপহার দেবার স্পর্ধা আমার থাকতে পারে এমন কথা কেমন করে বিশ্বাস করলেন? আর সত্যিই তাই যদি করে থাকি, কেন নিজের হাতে শাস্তি দিলেন না? কেন চাকরকে দিয়ে আমার অপমান করলেন? আপনার কি করেছিলুম আমি?

[শেষের দিকে তাহার গলা ভাঙ্গিয়া আসিল, সে উঠিয়া গিয়া
জানালার বাহিরে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল]

নরেন। কাজটা আমার যে ভাল হয়নি তা তখনি টের পেয়েছিলুম। তারপরে অনেক ভেবে দেখচি—আর ঐ দেখুন—ঐ ঈর্ষা জিনিসটা যে কত মন্দ তার সীমা নেই। ও যে শুধু নিজের ঝোঁকে বেড়ে চলে তাই নয়, সংক্রামকব্যাধির মত অপরকে আক্রমণ করতেও ছাড়ে না। আজ ত নিশ্চয় জানি আমাকে ঈর্ষা করার মত ভুল বিলাসবাবুর আর নেই, কিন্তু সেদিন নলিনীর মুখের ঐ ঈর্ষা শব্দটা আমার কানের মধ্যে গিয়ে বিঁধে রইল, কিছুতেই যেন আর ভুলতে পারিনে।

বিজয়া। (মুখ না ফিরাইয়া) তারপরে? ভুললেন কি করে?

নরেন। (হাসিয়া) অনেক চেষ্টায়। অনেক দুঃখে। কেবলি মনে হতে লাগল—নিশ্চয়ই কিছু কারণ আছে, নইলে মিছেমিছি কেউ কারুকে হিংসে করে না। আপনাকে আজ আমি সত্যি বলচি তার পরের ক’দিন চব্বিশ ঘণ্টাই শুধু আপনাকে ভাবতুম, আর মনে পড়ত আপনার জ্বরের ঘোরের সেই কথাগুলি। তাই ত বলেছিলুম এ কি ভয়ানক ছোঁয়াচে রোগ। কাজকর্ম চুলোয় গেল—দিবারাত্রি আপনার কথাই শুধু মনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। এর কি আবশ্যক ছিল বলুন ত! আর শুধু কি এই? আপনাকে দেখার জন্যেই কেবল দু-তিনদিন এই পথে হেঁটে গেছি। দিনকতক সে এক আচ্ছা পাগলা ভূত আমার কাঁধে চেপেছিল।

[এই বলিয়া সে হাসিতে লাগিল। বিজয়া কোন কথা না বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল]

নরেন। (সেইদিকে সবিস্ময়ে চাহিয়া) এ আবার কি হলো! রাগ করবার কথা কি বললুম!

[কালীপদ প্রবেশ করিল]

কালীপদ। আপনি চলে যাবেন না যেন। মা বলে দিলেন আপনি চা খেয়ে যাবেন।

নরেন। না না, তাঁকে বারণ করে দাও গে—আমি দয়ালবাবুর ওখানে চা খাব।

কালীপদ। কিন্তু মা দুঃখ করবেন যে!

নরেন। না, দুঃখ করবেন না। তাঁকে বলো গে আজ আমার সময় নেই।

কালীপদ। বলচি, কিন্তু তিনি কখখনো শুনবেন না।

[কালীপদ প্রস্থান করিল

[অন্য দ্বার দিয়া বিজয়া প্রবেশ করিল]

নরেন। অমন করে হঠাৎ চলে গেলেন যে বড়?

বিজয়া। কেমন করে চলে গেলুম শুনি?

নরেন। যেন রাগ করে।

বিজয়া। আপনার চোখের দৃষ্টিটা খুলচে দেখচি তা হলে! আচ্ছা, সেই ভূতের কাহিনীটি শেষ করুন এবার।

নরেন। কোন্‌ ভূতের কাহিনী?

বিজয়া। সেই যে পাগলা ভূতটা দিন–কতক আপনার কাঁধে চেপেছিল? সে নেবে গেছে ত?

নরেন। (সহাস্যে) ওঃ—তাই? হাঁ সে নেবে গেছে।

বিজয়া। যাক তা হলে বেঁচে গেছেন বলুন। নইলে আরও কতদিন যে আপনাকে এই পথে ঘোড়দৌড় করিয়ে বেড়াত কে জানে।

[কালীপদ প্রবেশ করিল]

কালীপদ। (নরেনকে দেখাইয়া) উনি চা খাবেন না।

বিজয়া। (কালীপদকে) কেন খাবেন না? যা তুই ঠিক করে আনতে বলে দি গে।

[কালীপদ প্রস্থান করিল

নরেন। আমাকে মাপ করবেন, আজ আমি চা খেতে পারব না।

বিজয়া। কেন পারবেন না?—আপনাকে নিশ্চয় খেয়ে যেতে হবে!

নরেন। (মাথা নাড়িয়া) না না, সে ঠিক হবে না। সেদিন তাঁদের কথা দিয়েছিলুম আজ এসে তাঁদের বাড়িতে খাব। না খেলে তাঁরা বড় দুঃখ করবেন।

বিজয়া। তাঁরা কে? দয়ালবাবুর স্ত্রী, না নলিনী?

নরেন। দুজনেই দুঃখ পাবেন। হয়ত আমার জন্যে আয়োজন করে রেখেচেন।

বিজয়া। আয়োজনের কথা থাক, কিন্তু দুঃখ পেতে বুঝি শুধু তাঁরাই আছেন, আর কেউ নেই নাকি?

নরেন। আর কেউ কে, দয়ালবাবু? ( হাসিয়া ) না না, তিনি বড় শান্ত মানুষ—সাদাসিধে নিরীহ লোক। তা ছাড়া তাঁকে ত এ বাড়িতেই দেখলুম। তাঁকে ভয় নেই, কিন্তু ওঁরা বড় রাগ করবেন।

বিজয়া। ওঁরা কারা নরেনবাবু? ওঁরা কেউ নেই—আছেন শুধু নলিনী। এখানে খেয়ে গেলে তিনিই রাগ করবেন। বলুন তাঁকেই আপনার ভয়, বলুন এই কথাই সত্যি।

নরেন। রাগ করতে আপনারা কেউ কম নয়। আপনাকে কথা দিয়ে সেখানে খেয়ে এলে আপনিই কি রাগ কম করতেন নাকি?

বিজয়া। হাঁ, তাই যান। শিগগির যান, আপনার অনেক দেরি হয়ে গেছে, আর আপনাকে আটকাব না।

নরেন। হাঁ, দেরি হয়ে গেছে বটে। ফিরে যাবার সাতটার ট্রেনটা হয়ত আর ধরতে পারব না।

বিজয়া। পারবেন না কেন? এখন থেকে সাতটা পর্যন্ত আপনাকে ধরে বসিয়ে নলিনী খাওয়াবেন নাকি? এখানে ত একটুখানি খেয়েই—না না করতে থাকেন, শত উপরোধেও কথা রাখেন না, উপেক্ষা করে উঠে পড়েন।

নরেন। একেবারে উলটো অভিযোগ? মানুষকে বেশী খাওয়ানোর রোগ আপনার চেয়ে সংসারে কারো আছে নাকি? উপেক্ষা করা? আপনাকে উপেক্ষা করে কারো নিস্তার আছে? ভয়েই ত সারা হয়ে যায়।

বিজয়া। কিন্তু আপনার ত ভয় নেই। এই ত স্বচ্ছন্দে উপেক্ষা করে চলে যাচ্চেন।

নরেন। উপেক্ষা করে নয়, তাঁদের কথা দিয়েছি বলে। আর খাওয়াই শুধু নয়, একটা বইয়ের কতকগুলো জিনিস নলিনীর বেধেছে সেইগুলো তাঁকে বুঝিয়ে দিতে হবে।

বিজয়া। কি বই?

নরেন। একটা ডাক্তারি বই। তাঁর ইচ্ছে বি. এ. পাসের পরে মেডিকেল কলেজে গিয়ে ভর্তি হন। তাই সামান্য যা জানি অল্পস্বল্প তাঁকে সাহায্য করি।

বিজয়া। আপনি কি তাঁর প্রাইভেট টিউটার? মাইনে কি পান?

নরেন। এ বলা আপনার অন্যায়। আপনার কথাবার্তায় আমার প্রায় মনে হয় তাঁর প্রতি আপনি প্রসন্ন নন। কিন্তু তিনি আপনাকে কত যে শ্রদ্ধা করেন জানেন না। এখানে এসে পর্যন্ত যত ভালো কাজ আপনি করেছেন সমস্ত তাঁর মুখে শুনতে পাই। আপনার কত কথা। এক কলেজে পড়তেন আপনারা — আপনি কলেজে আসতেন মস্ত একটা জুড়ি–গাড়ি করে, মেয়েরা সবাই চেয়ে থাকত। নলিনী বলছিলেন, যেমন রূপ তেমনি নম্র আচরণ,—পরিচয় ছিল না, কিন্তু তখন থেকে আমরা সবাই বিজয়াকে মনে মনে ভালবাসতুম। এমনি কত গল্প হয়।

বিজয়া। কেবল গল্পই যদি হয় আপনি পড়ান কখন?

নরেন। পড়াই কখন? আমি কি তাঁর মাস্টার, না পড়ানোর ভার আমার ওপর? আপনার কথাগুলো সব এত বাঁকা যে মনে হয় সোজা কথা বলতে কখনো শেখেন নি।

বিজয়া। শিখব কি করে, মাস্টার ত ছিল না।

নরেন। আবার সেই বাঁকা কথা!

বিজয়া। (হাসিয়া ফেলিয়া) কিন্তু আপনি যাবেন কখন? খাওয়া আজ না হয় না–ই হলো, কিন্তু পড়ানো না হলে যে ভয়ানক ক্ষতি!

নরেন। আবার সেই! চললুম। (টুপিটা হাতে লইয়া কয়েক পদ অগ্রসর হইয়া দ্বারের নিকটে সহসা থমকিয়া দাঁড়াইয়া) একটা কথা বলবার ছিল, কিন্তু ভয় হয় পাছে রাগ করে বসেন।

বিজয়া। রাগই যদি করি তাতে আপনার ভাবনা কি? দেনা শোধ করুন বলে চোখ রাঙ্গাবো সে জো–ও নেই। ভয়টা আপনার কিসের?

নরেন। আবার তেমনি বাঁকা কথা। কিন্তু শুনুন। এখানে এসে পর্যন্ত আপনি বহু সৎকার্য করেছেন। কত দুঃস্থ প্রজার খাজনা মাপ করেছেন, কত দরিদ্রকে দান করেছেন, ধর্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন—

বিজয়া। এ-সব শোনালে কে? নলিনী?

নরেন। হাঁ, তাঁর মুখেই শুনেছি। কত দরিদ্র কত কি পেলে, আমি কি কিচ্ছু পাব না? আমাকে সেই মাইক্রোস্কোপটা আজ উপহার দিন, কাল–পরশু দামটা তার পাঠিয়ে দেব।

বিজয়া। দাম দিয়ে উপহার নেবার বুদ্ধি আপনাকে কে যোগালে? নলিনী?

নরেন। না না, তিনি নয়। তিনি শুধু বলছিলেন সেটা আপনার ত কোন কাজে লাগল না, কিন্তু তিনি পেলে অনেক কিছু শিখতে পারেন—সে শিক্ষা পরে তাঁর অনেক কাজে লাগবে।

বিজয়া। অর্থাৎ, সেটা গিয়ে পৌঁছবে তাঁর হাতে? আমি বেচলে আপনি নিয়ে গিয়ে তাঁকে উপহার দেবেন—এই ত প্রস্তাব?

নরেন। না না, তা নয়। কিন্তু সেটা আপনারও কোন কাজে এল না, অথচ, সকলেরই চক্ষুশূল হয়ে রইল। তাই বলছিলুম—

বিজয়া। বলার কোন দরকার ছিল না নরেনবাবু। আপনার টাকার অভাব নেই, দোকানেও মাইক্রোস্কোপ কিনতে পাওয়া যায়। কিনেই যদি উপহার দিতে হয় তাঁকে বাজার থেকে কিনেই দিবেন। এটা আমার চক্ষুশূল হয়েই আমার কাছে থাক।

নরেন। কিন্তু—

বিজয়া। কিন্তুতে আর কাজ নেই। আপনি নিরর্থক নিজেরও সময় নষ্ট করছেন, আমারও করছেন। আরও ত কাজ আছে।

নরেন। (ক্ষণকাল হতবুদ্ধিভাবে চাহিয়া থাকিয়া) আপনার সুমুখে সব কথা আমি গুছিয়ে বলতে পারিনে, আপনিও রেগে ওঠেন। হয়ত আপনার মনে হয় নিজের অবস্থাকে ডিঙিয়ে আপনাদের সমকক্ষ হয়ে আমি চলতে চাই, কিন্তু তা কখনো সত্যি নয়। আপনার বাড়িতে আসতে কত যে সঙ্কুচিত হই সে আমিই জানি। এসে কি বলতে কি বলি, নিজের ওজন রাখতে পারিনে, আপনি উত্যক্ত হয়ে পড়েন, কিন্তু সে আমার অন্যমনস্ক প্রকৃতির দোষে, আপনাকে অমর্যাদা করার জন্যে না। কিন্তু আর আপনাকে বিরক্ত করতে আমি আসব না। নমস্কার।

[নরেন ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল

[ব্যগ্রপদে রাসবিহারীর প্রবেশ। তাঁহার পিছনে দয়াল, হাতে রৌপ্যপাত্রে ফুল, চন্দন ও একজোড়া মোটা সোনার বালা। তাঁহার পিছনে দুইজন ভৃত্যের হাতে ফুল, মালা ইত্যাদি এবং তাহাদের পিছনে কর্মচারীর দল। বিজয়া চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল]

রাস। মা বিজয়া, আজ যে নব–বৎসরের প্রথম দিন সে কথা কি তোমার স্মরণ আছে?

বিজয়া। একটু পূর্বেই আপনি বলে গেলেন, নইলে ছিল না।

রাস। (মৃদু হাসিয়া) তুমি ভুলতে পার, কিন্তু আমি ভুলি কি করে? এই যে আমার ধ্যান–জ্ঞান। বনমালী বেঁচে থাকলে আজকের দিনে তিনি কি করতেন মনে পড়ে মা?

বিজয়া। পড়ে বৈ কি। আজকের দিনে বিশেষ করে তিনি আমাকে আশীর্বাদ করতেন।

রাস। বনমালী নেই, কিন্তু আমি আজ আছি। ভেবেছিলাম এই কর্তব্য প্রভাতেই নিষ্পন্ন করব, তোমাদের স্বাস্থ্য, আয়ু, নির্বিঘ্ন–জীবন ভগবানের শ্রীচরণে প্রসাদ ভিক্ষা করে নেব, কিন্তু নানা কারণে তাতে বাধা পড়ল। কিন্তু বাধা ত সত্যি নয়, সে মিথ্যে। তাকে স্বীকার করে নিতে পারিনে ত মা! জানি আজ তোমার মন চঞ্চল, তবু দয়ালকে বললাম, ভাই, আজকের এই পুণ্যদিনটিকে আমি ব্যর্থ যেতে দিতে পারব না, তুমি আয়োজন কর। আয়োজন যত অকিঞ্চনই হোক,—কিন্তু নিজেই যে আমি বড় অকিঞ্চন মা! দয়াল বললেন, সময় কৈ? বেলা যে যায়। সজোরে বললুম, যায়নি বেলা—আছে সময়। কোন বিঘ্নই আজ আমি মানব না। আয়োজনের স্বল্পতায় কি আসে–যায় দয়াল, আড়ম্বরে বাইরের লোককেই শুধু ভোলানো যায়, কিন্তু এ যে বিজয়া! মা যে বুঝবেই এ তার পিতৃকল্প কাকাবাবুর অন্তরের শুভ–কামনা। লোক ছুটল আমার বাড়িতে, বাগানে ছুটল মালী ফুল তুলতে—মাঙ্গলিক যা– কিছু সংগৃহীত হতে বিলম্ব ঘটল না। মুকুট-মালা না-ই বা হলো—এ যে কাকাবাবুর আশীর্বাদ! কিন্তু বিলাস এল না কেন? তখনি স্মরণ হলো সে আসবে কি করে? সে সাহস তার কৈ? ভাবলাম ভালই হয়েছে যে সে লজ্জায় লুকিয়ে আছে। এমনিই হয় মা,—অপরাধের দণ্ড এমনি করেই আসে। জগদীশ্বর! (একমুহূর্ত পরে) তখন কাছারিঘরে ডাক দিয়ে বললাম, তোমরা কে কে আছ এসো আমাদের সঙ্গে। আজকের দিনে তোমাদের কাছেও বিজয়ার চিরদিনের কল্যাণ–ভিক্ষা করে আমি নিতে চাই। এসো ত মা আমার কাছে। (এই বলিয়া তিনি নিজেই অগ্রসর হইয়া গেলেন। বিজয়া উদ্‌ভ্রান্ত–মুখে এতক্ষণ নীরবে চাহিয়াছিল, এইবার ঘাড় হেঁট করিল। রাসবিহারী তাহার কপালে চন্দনের ফোঁটা দিলেন, মাথায় ফুল ছড়াইয়া দিতে দিতে ) সংসারে আনন্দ লাভ কর, স্বাস্থ্য–আয়ু–সম্পদ লাভ কর, ব্রহ্মপদে অবিচলিত শ্রদ্ধা–ভক্তি–বিশ্বাস লাভ কর, আজকের পুণ্যদিনে এই তোমার কাকাবাবুর আশীর্বাদ মা।

[বিজয়া দুই হাত জোড় করিয়া নিজের ললাট স্পর্শ করিয়া নমস্কার
করিল। অনেকের হাতেই ফুল ছিল তাহারা ছড়াইয়া দিল]

রাস। দেখি মা তোমার হাত–দুটি—(এই বলিয়া বিজয়ার হাত টানিয়া লইয়া একে একে সেই সোনার বালা–দুটি পরাইয়া দিলেন) টাকার মূল্যে এ–বালার দাম নয় মা, এ তোমার—(দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া) এ আমার বিলাসের জননীর হাতের ভূষণ। চেয়ে দেখ মা কত ক্ষয়ে গেছে। মৃত্যুকালে তিনি বলেছিলেন এ যেন না কখনো নষ্ট করি, এ যেন শুধু আজকের দিনের জন্যেই—

[রাসবিহারীর বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠস্বর এইবার একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িল]

দয়াল। (আশীর্বাদ করিতে কাছে আসিয়া ব্যস্তভাবে) মা, মুখখানি যে বড় পাণ্ডুর দেখাচ্চে, অসুখ করেনি ত?

বিজয়া। (মাথা নাড়িয়া) না।

দয়াল। সুখী হও, আয়ুষ্মতী হও, জগদীশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা করি।

[বিজয়া জানু পাতিয়া তাঁহার পায়ের কাছে প্রণাম করিল]

দয়াল। (ব্যস্ত হইয়া) থাক মা থাক—আনন্দময় তোমাকে আনন্দে রাখুন। কিন্তু মুখ দেখে তোমাকে বড় শ্রান্ত মনে হচ্চে। বিশ্রাম করার প্রয়োজন।

রাস। প্রয়োজন বৈ কি দয়াল, একান্ত প্রয়োজন। আজ বনমালীর উল্লেখ করে হয়তো তোমার মনে বড় কষ্ট দিয়েছি, কিন্তু না করেও যে উপায় ছিল না। আজকের শুভদিনে তাঁকে স্মরণ করা যে আমার কর্তব্য। কিন্তু আর কথা কয়ে তোমাকে ক্লান্ত করব না মা, যাও বিশ্রাম কর গে। দয়াল, চল ভাই আমরা যাই। (কর্মচারীদের লক্ষ্য করিয়া) তোমরা সকলেই বয়োজ্যেষ্ঠ, তোমাদের মঙ্গলকামনা কখনো নিষ্ফল হবে না। শুধু দয়াল নয়, তোমাদের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু চল সকলে যাই, মাকে বিশ্রাম করার একটু অবসর দিই।

[সকলের একে একে প্রস্থান

[বিজয়া বালা–জোড়া হাত হইতে খুলিয়া ফেলিল এবং নিঃশব্দে ফিরিয়া আসিয়া টেবিলে মাথা রাখিয়া উপবেশন করিল। ক্ষণেক পরে পরেশ প্রবেশ করিয়া ক্ষণকাল নীরবে চাহিয়া রহিল]

পরেশ। মা গো!

বিজয়া। (মুখ তুলিয়া) কি রে পরেশ?

পরেশ। তোমার যে বিয়ে হবে গো!

বিজয়া। বিয়ে হবে? কে তোরে বললে?

পরেশ। সবাই বলচে। এই যে আশীর্বাদ হয়ে গেল আমরা সবাই দেখনু।

বিজয়া। কোথা দিয়ে দেখলি?

পরেশ। উই দোরের ফাঁক দিয়ে। আমি, মা, সতুর পিসী—সব্বাই। দু-গণ্ডা পয়সা দাও না মা, একটা ভালো নাটাই কিনব—(জানালার বাহিরে দৃষ্টিপাত করিয়া) উই গো! ডাক্তারবাবু যায় মা। হনহন করে চলেচ ইস্টিসানে—

বিজয়া। (দ্রুতপদে জানালার কাছে আসিয়া বাহিরে চাহিয়া) পরেশ, ধরে আনতে পারিস ওঁকে? তোকে খুব ভালো লাটাই কিনে দেব।

পরেশ। দেবে ত মা?

[পরেশ দৌড় মারিল। পরেশের মা মৃদুপদে প্রবেশ করিল]

পরেশের মা। আজকে কি কিছু খাবে না দিদিমণি? একফোঁটা চা পর্যন্ত যে খাওনি! (টেবিলের কাছে আসিয়া বালা-দুটা হাতে তুলিয়া লইয়া) একি কাণ্ড! আজকের দিনে কি হাত থেকে সরাতে আছে দিদিমণি! তোমার যে ভুলো মন, হয়ত এখানেই ফেলে চলে যাবে, যার চোখে পড়বে সে কি আর দেবে!—তোমার পরেশকে কিন্তু একটা আংটি গড়িয়ে দিতে হবে দিদিমণি, তার কতদিনের শখ।

বিজয়া। আর তোমাকে একটা হার,—না?

পরেশের মা। তামাশা করছ বটে, কিন্তু না নিয়েই কি ছাড়ব ভেবেছ?

বিজয়া। না, ছাড়বে কেন, এই ত তোমাদের পাবার দিন।

পরেশের মা। সত্যি কথাই ত! এসব কাজকর্মে পাব না ত কবে পাব বল ত? পাওনা যাবে না আমাদের, তোলাই আছে, কিন্তু কি খাবে বলত? এক বাটি চা আর কিছু খাবার নিয়ে আসব? না হয় তোমার শোবার ঘরে চল, আমি সেখানেই দিয়ে আসি গে।

বিজয়া। তাই যাও পরেশের মা, আমার শোবার ঘরেই দাও গে।

পরেশের মা। যাই দিদিমণি, বামুনঠাকুরকে দিয়ে খান-কতক গরম লুচি ভাজিয়ে নিই গে।

[পরেশের মা চলিয়া গেল। প্রবেশ করিল পরেশ এবং তাহার পিছনে নরেন]

বিজয়া। এই নে পরেশ একটা টাকা। খুব ভালো লাটাই কিনিস, ঠকিস নে যেন!

পরেশ। না—

[পরেশ নিমিষে অদৃশ্য হইয়া গেল

নরেন। ওঃ—তাই ওর এত গরজ! আমাকে নিশ্বাস নেবার সময় দিতে চায় না। লাটাই কেনার টাকা ঘুষ দেওয়া হলো! কিন্তু কেন? হঠাৎ যে আবার ডাক পড়ল?

বিজয়া। (ক্ষণকাল নরেনের মুখের প্রতি চাহিয়া) মুখ ত শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠেচে। কি খেলেন সেখানে?

নরেন। খাইনি। দোরগোড়া পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এলুম, ঢুকতে ইচ্ছেই হলো না।

বিজয়া। কেন?

নরেন। কি জানি কেন! মনে হলো কোথাও কারো কাছে আর যাবো না,—এদিকেই আর আসব না।

বিজয়া। আমি মন্দ লোক, মিছিমিছি রাগ করি, আর আপনি ভয়ানক ভালো লোক—না?

নরেন। কে বলেছে আপনাকে মন্দ লোক?

বিজয়া। আপনি বলেছেন। আমাকেই অপমান করলেন, আর আমাকেই শাস্তি দিতে না খেয়ে কলকাতা চলে যাচ্ছেন—কি করেছি আপনার আমি?

[বলিতে বলিতে তাহার চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল এবং তাহাই গোপন
করিতে সে জানালার বাহিরে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইল]

নরেন। কি আশ্চর্য! বাসায় ফিরে যাচ্চি তাতেও আমার দোষ!

[কালীপদ প্রবেশ করিল]

কালীপদ। মা, আপনার শোবার ঘরে খাবার দেওয়া হয়েছে!

বিজয়া। (নরেনের প্রতি) চলুন আপনার খাবার দিয়েছে।

নরেন। আমার কি রকম? আমি যে আসব নিজেই ত জানতুম না।

বিজয়া। আমি জানতুম, চলুন।

নরেন। আমার খাবার ব্যবস্থা আপনার শোবার ঘরে? এ কখনো হয়? হাঁ কালীপদ, কার খাবার দেওয়া হয়েছে সত্যি করে বল ত?

কালীপদ। আজ্ঞে মা’র। আজ সারাদিন উনি প্রায় কিছুই খাননি।

নরেন। তাই সেগুলো এখন আমাকে গিলতে হবে? দেখুন, অন্যায় হচ্চে—এতটা জুলুম আমার ‘পরে চালাবেন না।

বিজয়া। কালীপদ, তুই নিজের কাজে যা। যা জানিস নে তাতে কেন কথা বলিস বল ত? (নরেনের প্রতি) চলুন, ওপরের ঘরে।

নরেন। চলুন, কিন্তু ভারী অন্যায় আপনার।

[সকলের প্রস্থান

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *