বিজয়া – ২.৫

পঞ্চম দৃশ্য

বিজয়ার শয়নকক্ষ

[অসুস্থ বিজয়া বিছানায় শুইয়া, অনতিদূরে উপবিষ্ট পিতা-পুত্র রাসবিহারী ও বিলাসবিহারী। ঘরে অন্য আসন নাই, রোগীর প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যই নিকটে রক্ষিত, ব্যস্ত পদক্ষেপে নরেন প্রবেশ করিল—তাহার মুখে উৎকণ্ঠার চিহ্ন]

নরেন। কি ব্যাপার? কালীপদর মুখে শুনলাম জ্বর নাকি একটু বেড়েচে। তা হোক—কেমন আছেন এখন?

বিলাস। আপনি সকালে এসে নাকি ওঁকে বসন্তের ভয় দেখিয়ে গেছেন?

বিজয়া। (ক্ষীণস্বরে দুই বাহু বাড়াইয়া) বসুন। (নরেন অগত্যা বিছানার একাংশে বসিল) কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? কেন এত দেরি করে এলেন? আমি যে সমস্তক্ষণ শুধু আপনার পথ চেয়ে ছিলুম। (বিলাসের মুখের অবস্থা ভীষণ হইয়া উঠিল। নরেনের হাতখানা বুকের উপর টানিয়া লইয়া) কিন্তু আমি ভাল না হওয়া পর্যন্ত কোথাও যাবেন না বলুন। আপনি চলে গেলে হয়ত আমি বাঁচব না। (নরেন হতবুদ্ধি হইয়া, মুখ তুলিতেই দুইজোড়া ভীষণ চক্ষুর সহিত তাহার চোখাচোখি হইল—কালীপদ একবার পর্দার ফাঁক হইতে উঁকি মারিতেই বিলাস গর্জিয়া উঠিল)

বিলাস। এই শূয়ার, এই জানোয়ার—একটা চেয়ার আন্‌।

[কালীপদ ভয়ে হতবুদ্ধি হইয়া রহিল]

রাসবিহারী। (গম্ভীর স্বরে) ওঘর থেকে একটা চেয়ার নিয়ে এস কালীপদ। বাবুকে বসতে দাও (নরেন উঠিয়া পড়িল। শান্তকণ্ঠে বিলাসের প্রতি) রোগী মানুষের ঘর—অমন hasty হয়ো না বিলাস। Temper lose করা কোনও ভদ্রলোকের পক্ষেই শোভা পায় না।

[কালীপদ চেয়ার লইয়া প্রবেশ করিল]

বিলাস। মানুষ এতে temper lose করে না ত করে কিসে শুনি? হারামজাদা চাকর, বলা নেই, কওয়া নেই, এমন একটা অসভ্য লোককে ঘরে এনে ঢোকালে যে ভদ্রমহিলার সম্মান পর্যন্ত রাখতে জানে না।

[বিজয়ার জ্বরের ঘোরটা হঠাৎ ঘুচিয়া গেল। নরেনের হাত ছাড়িয়া
সে দেওয়ালের দিকে মুখ করিয়া পাশ ফিরিয়া শুইল]

রাস। আমি সবই বুঝি বিলাস, এ-ক্ষেত্রে তোমার রাগ হওয়াটা যে অস্বাভাবিক নয়—বরঞ্চ খুবই স্বাভাবিক তাও মানি, কিন্তু এটা তোমার ভাবা উচিত ছিল যে, সবাই ইচ্ছা করে অপরাধ করে না। সকলেই যদি ভদ্র রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার জানত—তা হলে ভাবনা ছিল কি? সেইজন্য রাগ না করে শান্তভাবে মানুষের দোষত্রুটি সংশোধন করে দিতে হয়।

বিলাস। না বাবা! এরকম impertinence সহ্য হয় না। তা ছাড়া আমার এ বাড়ির চাকরগুলো হয়েছে যেমন হতভাগা—তেমনি বজ্জাত। কালই আমি ব্যাটাদের সব দূর করে তবে ছাড়ব।

রাস। এর মন খারাপ হয়ে থাকলে যে কি বলে তার ঠিকানাই নাই। আর ছেলেকেই বা দোষ দোব কি, আমি বুড়োমানুষ, আমি পর্যন্ত অসুখ শুনে কি রকম চঞ্চল হয়ে উঠেছিলুম। বাড়িতেই হলো একজনের বসন্ত—তার ওপর উনি ভয় দেখিয়ে গেলেন।

নরেন। না, আমি কোনরকম ভয় দেখিয়ে যাইনি।

বিলাস। আলবত ভয় দেখিয়ে গেছেন। কালীপদ তার সাক্ষী আছে।

নরেন। কালীপদ ভুল শুনেছে।

[বিলাস ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিবে এমন সময়ে]

রাস। আঃ কর কি বিলাস! উনি যখন অস্বীকার করছেন তখন কি কালীপদকে বিশ্বাস করতে হবে? নিশ্চয়ই ওঁর কথা সত্যি।

বিলাস। তুমি বুঝছ না বাবা—(বিলাস বাধা দিতে চাহিল)

রাস। এই সামান্য অসুখেই মাথা হারিয়ো না বিলাস। স্থির হও! মঙ্গলময় জগদীশ্বর যে শুধু আমাদের পরীক্ষা করবার জন্যই বিপদ পাঠিয়ে দেন, বিপদে পড়লে তোমরা সকলের আগে এই কথাটাই কেন ভুলে যাও—আমি ত ভেবে পাইনে। (একটু স্থির থাকিয়া) আর তাই যদি একটা ভুল অসুখের কথা বলেই থাকেন, তাতেই বা কি? কত পাস-করা ভাল ভাল, বিচক্ষণ ডাক্তারেরও যে ভ্রম হয়, ইনি ত ছেলেমানুষ। যাক। (নরেনের প্রতি) জ্বর ত তা হলে অতি সামান্যই আপনি বলছেন। চিন্তা করবার কোনই কারণ নেই—এই ত আপনার মত।

নরেন। আমার মতামতে কি আসে-যায় রাসবিহারীবাবু? আমার ওপর ত নির্ভর করছেন না। বরং তার চেয়ে কোন ভাল পাস-করা বিচক্ষণ ডাক্তার দেখিয়ে তাঁর অভিমত নিন।

বিলাস। (চেঁচাইয়া উঠিয়া) তুমি কার সঙ্গে কথা কইছ, মনে করে কথা কয়ো বলে দিচ্ছি। এ-ঘর না হয়ে, আর কোথাও হলে তোমার বিদ্রূপ করা—

[বিজয়া মুখ ফিরাইয়া ব্যথিত সুরে]

বিজয়া। আমি যতদিন বাঁচব নরেনবাবু, আপনার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকব। কিন্তু এঁরা যখন অন্য ডাক্তার দিয়ে আমার চিকিৎসা করা স্থির করেছেন, তখন আর আপনি অনর্থক অপমান সইবেন না।

[পুনরায় মুখ ফিরাইয়া শুইল]

রাস। (ব্যস্ত হইয়া) বিলক্ষণ, যাঁকে তুমি ডেকে পাঠিয়েছ তাঁকে অপমান করে কার সাধ্য মা? (ক্ষণকাল পরে) এ কথাও সত্যি বিলাস! এই অসংযত ব্যবহারের জন্য তোমার অনুতপ্ত হওয়া উচিত। মানি, সমস্তই মানি যে মা বিজয়ার অসুখের গুরুত্ব কল্পনা করেই তোমার মানসিক চঞ্চলতা শতগুণে বেড়ে গেছে, তবু—স্থির ত তোমাকে হতেই হবে। সমস্ত ভাল-মন্দ সমস্ত দায়িত্ব ত শুধু তোমারই মাথায় বাবা! মঙ্গলময়ের ইচ্ছায় যে গুরুভার একদিন তোমাকেই শুধু বহন করতে হবে—এ ত শুধু তারই পরীক্ষার সূচনা—(নরেন নিঃশব্দে লাঠি ও ছোট ব্যাগটি তুলিয়া লইল) নরেনবাবু, আপনার সঙ্গে একটা জরুরি কথা আলোচনা করবার আছে—চলুন।

[রাসবিহারী নরেনকে লইয়া রঙ্গমঞ্চের সম্মুখের দিকে আসিতেই মধ্যের পর্দা পড়িয়া রোগীর কক্ষটিকে সম্পূর্ণ আবৃত করিয়া দিল। উভয়ে মুখোমুখি দুইখানি চৌকিতে উপবেশন করিল]

রাস। পাঁচজনের সামনে তোমায় বাবুই বলি, আর যাই বলি, বাবা, এটা কিন্তু ভুলতে পারিনে, তুমি আমাদের সেই জগদীশের ছেলে। নইলে তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিলুম এ কথা তোমার মুখের ওপর বলে তোমাকে ক্লেশ দিতুম না।

নরেন। যা সত্য তাই বলেছেন—এতে দুঃখ করবার কিছু নেই।

রাস। না না, ও কথা বলো না নরেন। কঠোর কথা মনে বাজে বৈ কি! যে শোনে তার ত বাজেই, যে বলে তারও বড় কম বাজে না বাবা। জগদীশ্বর! কিন্তু তুমি, বাবা, বিলাসের মনের অবস্থা বুঝে মনের মধ্যে কোনও ক্ষোভ রাখতে পারবে না। আর একটা অনুরোধ আমার এই রইল, এদের বিবাহ ত সামনের বৈশাখেই হবে, যদি কলকাতাতেই থাকো বাবা, শুভকর্মে যোগ দিতে হবে। না বললে চলবে না।

নরেন। আচ্ছা। কিন্তু—

রাস। না, কোন কিন্তু নয় বাবা, সে আমি শুনব না। ভাল কথা, কলকাতাতেই কি এখন থাকা হবে? একটু সুবিধে-টুবিধে—

নরেন। আজ্ঞে হাঁ। একটা বিলিতী ওষুধের দোকানে সামান্য একটা কাজ পেয়েছি।

রাস। বেশ, বেশ, ওষুধের দোকানে কাঁচা পয়সা! টিকে থাকতে পারলে আখেরে গুছিয়ে নিতে পারবে নরেন।

নরেন। আজ্ঞে।

রাস। তা হলে মাইনেটা কি রকম?

নরেন। পরে কিছু বেশী দিতে পারে। এখন চারশো টাকা মাত্র দেয়।

রাস। (বিবর্ণমুখে চোখ কপালে তুলিয়া) চারশো! আহা বেশ—বেশ! শুনে বড় সুখী হলুম।

নরেন। সেই পরেশ ছেলেটি কেমন আছে বলতে পারেন?

রাস। তাকে একটু আগেই তাদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

নরেন। গ্রামটা কি দূরে?

রাস। তা জানিনে বাবা।

নরেন। (ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া) তা হলে আর উপায় কি। সে কথা যাক, কিন্তু আমার হয়ে বিলাসবাবুকে আপনি একটা কথা জানাবেন। বলবেন—প্রবল জ্বরে মানুষের আবেগ নিতান্ত সামান্য কারণে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে পারে। বিজয়ার সম্বন্ধে ডাক্তারের মুখের এই কথাটা তিনি যেন অবিশ্বাস না করেন।

রাস। অবিশ্বাস করবে কি নরেন, এ কি আমরা জানিনে? বাপ হয়ে এ কথা বলতে আমার মুখে বাধে, কিন্তু তুমি আপনার জন বলেই বলি, দুজনের কি গভীর ভালবাসার চিহ্নই যে মাঝে মাঝে আমার চোখে পড়ে সে প্রকাশ করিবার আমার ভাষা নেই। মনে হয় ভগবান যেন সঙ্কল্প করেই পরস্পরের জন্যে এদের সৃজন করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তাঁকে প্রণাম করি, আর ভাবি সার্থক এদের মিলন, সার্থক এদের জীবন।

নরেন। এই বৈশাখেই বুঝি এঁদের বিবাহ হবে?

রাস। হাঁ নরেন। সেদিন কিন্তু তোমাকে আসতে হবে, উপস্থিত থেকে নব-দম্পতিকে আশীর্বাদ করতে হবে। তাড়াতাড়ি করার আমার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু সকলেই পুনঃ পুনঃ বলচেন অন্তরের আত্মা যাঁদের এমন করে এক হয়েছে বাইরে তাদের পৃথক করে রাখা অপরাধ। আমি বললুম, তাই হোক। তোমাদের সকলের ইচ্ছেই আমার ভগবানের ইচ্ছে। এই বৈশাখেই এক হয়ে এরা সংসার-সমুদ্রে জীবন-তরণী ভাসাক। জগদীশ্বর! আমার দিন শেষ হয়েছে, কিন্তু তুমি এদের দেখো—তোমার চরণেই এদের সমর্পণ করলুম। (যুক্তকর ললাটে স্পর্শ করিয়া হেঁট হইয়া তিনি প্রণাম করিলেন) কিন্তু তোমার যে রাত হয়ে যাচ্ছে বাবা, আজই কি কলকাতায় ফিরে না গেলেই নয়?

নরেন। না আমাকে যেতেই হবে। সাড়ে-আটটার ট্রেনেই যাব।

রাস। জিদ করতে পারিনে নরেন, নতুন চাকরি, কামাই হওয়া ভাল নয়—মনিব রাগ করতে পারে। আজকের দিনটাও ত তোমার বৃথায় নষ্ট হ’লো। কিন্তু কি জন্যে আজ এসেছিলে বাবা, জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?

নরেন। দিনটা নষ্ট হলো সত্যি, কিন্তু সকালে এসেছিলুম এই আশা করে যদি টাকাটা দিয়ে সেই মাইক্রস্‌কোপটা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি।

রাস। টাকাটা দিয়ে? বেশ ত, বেশ ত—নিয়ে গেলে না কেন?

নরেন। বিজয়া দিলেন না। বললেন, তার দাম চারশো টাকা—এর এক পয়সা কমে হবে না।

রাস। সে কি কথা নরেন? দুশো টাকার বদলে চারশো টাকা! বিশেষতঃ তাতে যখন তোমার এত দরকার অথচ তাঁর কোন প্রয়োজন নেই।

নরেন। ভেবেছি তাঁকে চারশো টাকা দিয়েই আমি নিয়ে যাব।

রাস। না, সে কোনমতেই হতে পারে না। এত বড় অধর্ম আমি সইতে পারব না। ও আমার ভাবী পুত্রবধূ, এ অন্যায় যে আমাকে পর্যন্ত স্পর্শ করবে নরেন। (ক্ষণকাল অধোমুখে নিঃশব্দে থাকিয়া) একটা কথা আমি বার বার ভেবে দেখেচি। তোমার সঙ্গে ওর কথাবার্তায়, বাইরের আচরণে আমি দোষ দেখতে পাইনে কিন্তু অন্তরে কেন তোমার প্রতি বিজয়ার এতবড় ক্রোধ! কেবল যে তোমার ঐ বাড়িটার ব্যাপারেই দেখতে পেলাম তাই নয় এই microscope-টার ব্যাপারেও ঢের বেশী চোখে পড়ল! ওটা নিতে আমার নিজেরই আপত্তি ছিল শুধু যে দরকার নেই বলেই তা নয়—ওতে তোমার নিজেরই অনেক বেশী প্রয়োজন বলে। কিন্তু যখনি টের পেলাম তোমার টাকার প্রয়োজন, যখনি কানে এল তোমাকে কথা দেওয়া হয়েছে, তখনি সঙ্কল্প আমার স্থির হয়ে গেল। ভাবলাম, দাম ওর যাই হোক কিন্তু টাকা দিতেই হবে, কিছুতে অন্যথা করা চলবে না। মনে মনে বললাম, বিজয়ার যখন ইচ্ছে, যতদিনে ইচ্ছে আমাকে টাকা শোধ দিন, কিন্তু আমি বিলম্ব করতে পারব না। তাই তোমাকে দুশো টাকা সকালেই পাঠিয়ে দিলাম। এ যে আমার কর্তব্য—সত্যরক্ষা আমাকে যে করতেই হবে।

নরেন। সামান্য দুশো টাকা দেবারও বুঝি ওঁর ইচ্ছে ছিল না? বিশ্বাস ছিল ঠকিয়ে নিয়ে যাচ্চি?

রাস। (জিভ কাটিয়া) না না না। কিন্তু সে বিচারে আর ত প্রয়োজন নেই নরেন। কিন্তু তাই বলে এ কি অসঙ্গত প্রস্তাব! এ কি অন্যায়! দুশোর বদলে চারশো! না বাবা, এ তাঁকে আমি কোনমতে করতে দেব না, তুমি দুশো টাকা দিয়েই তোমার জিনিস ফিরিয়ে নিয়ে যেও।

নরেন। না রাসবিহারীবাবু, আমার হয়ে আপনি তাঁকে অনুরোধ করবেন না। তিনি ভাল হলে জানাবেন তাঁকে চারশো টাকাই এনে দেব—তাঁর এতটুকু অনুগ্রহও আমি গ্রহণ করব না। বিলাসবাবুকে বলবেন তিনি যেন আমাকে ক্ষমা করেন—এত কথা আমি কিছুই জানতুম না। কিন্তু আর না—আমার গাড়ির সময় হয়ে আসছে আমি চললুম।

[প্রস্থান

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *