বিজয়া – ২.২

দ্বিতীয় দৃশ্য

গ্রাম্যপথ

[আমন্ত্রিত পুরুষ ও মহিলারা বিজয়ার গৃহ কৃষ্ণপুর গ্রামের অভিমুখে ধীরে ধীরে গল্প করিতে করিতে চলিয়াছেন। রঙ্গমঞ্চে সকলেই একত্রে প্রবেশ করিবেন না, দুইজনে প্রবেশ করিয়া বাহির হইয়া গেলে আবার দুই-তিনজন প্রবেশ করিবেন]

১ম। দয়ালবাবুই আচার্য হবেন, এ কি স্থির হয়েছে?

২য়। হাঁ স্থির বৈ কি। তিনি কালই এসে পৌঁচেছেন শুনতে পেলাম।

১ম। কিন্তু তাঁর উপাসনা ত শুনেছি তেমন হৃদয়গ্রাহী নয়। ঢাকার যোগেশবাবুর পিতৃশ্রাদ্ধে সান্ধ্য-উপাসনাটা তাই আমাকেই করতে হলো। শরীর অসুস্থ, সর্দিতে গলা ভাঙ্গা, বার বার অস্বীকার করলাম, কিন্তু কেহ ছাড়লেন না। কিন্তু করুণাময়ের কি অপার করুণা! এই দীনহীনের উপাসনা শুনে সেদিন উপস্থিত সকলকেই ঘন ঘন অশ্রুপাত করতে হলো। মহিলাদের ত কথাই নেই। ভাবাবেশে তাঁরা প্রায় বিহ্বল হয়ে পড়লেন।

২য়। তাতে সন্দেহ কি? আপনার উপাসনা যে এক স্বর্গীয় বস্তু!

১ম। কিন্তু ত্রিশ টাকার কমে ত দয়ালবাবুর সংসারযাত্রা নির্বাহ হতে পারে না।

২য়। ত্রিশ টাকা কি বলছেন প্রভাতবাবু? বনমালীবাবুর এস্টেটে তাঁকে সামান্য কি একটু কাজও করতে হবে, শুনেছি সত্তর টাকা করে দেওয়া হবে। বাড়িভাড়া ত লাগবেই না।

১ম। বলেন কি? সত্তর টাকা! ঈশ্বর তাঁর মঙ্গল করুন!

২য়। তা ছাড়া বনমালীবাবুর মেয়েটি শুনেছি যেমন সুশীলা তেমনি দয়াবতী। প্রসন্ন হলে একশো টাকা হওয়াও বিচিত্র নয়।

১ম। এক—শো! পল্লীগ্রামে ত কোন খরচই নেই! একশো! ঈশ্বর তাঁর মঙ্গল করুন। বড় সুসংবাদ। একটু দ্রুত চলুন। তাঁর প্রাতঃকালীন উপাসনায় যেন যোগ দিতে পারি।

[প্রস্থান]

[৩য়, ৪র্থ ও ৫ম ভদ্রব্যক্তির প্রবেশ। সঙ্গে জন-দুই মহিলা]

৩য়। এ বিবাহ যদি ঘটে বনমালীবাবুর কন্যা ভাগ্যবতী—এ কথা বলতেই হবে। বিলাসবিহারী অতি সুপাত্র। যেমন বলবান, তেমনি উদ্যমশীল। যেমন ভগবদ্ভক্তি, তেমনি স্বধর্মনিষ্ঠা। সমাজের উদীয়মান স্তম্ভস্বরূপ বললেও অত্যুক্তি হয় না। আধুনিক কালের শিথিল-বিশ্বাস ভ্রষ্টাচারী বহু যুবকের তিনি দৃষ্টান্তস্থল।

৪র্থ। বনমালীবাবুর সম্পত্তি কি বেশ বড়?

৩য়। বড়! অগাধ। যেমন জমিদারি তেমনি নগদ টাকা। একমাত্র কন্যার জন্যে বনমালী প্রভূত ঐশ্বর্য রেখে গেছেন। বিলাসের হাতে তা বহুগুণিত হবে আমি বললেম।

৫ম। কিন্তু শুনেচি যুবকটি একটু রূঢ়ভাষী।

৩য়। রূঢ়ভাষী নয়, স্পষ্টভাষী। সত্যের আদর তিনি জানেন। (১ম মহিলাটিকে ইঙ্গিতে দেখাইয়া) আমার স্ত্রীর প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়ে বনমালীর কন্যা বিজয়াকে দিয়ে তিনি একশো টাকা সাহায্য করিয়েছিলেন। তাদের পুরস্কার-বিতরণের জন্যে আরও একশো টাকা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

১ম মহিলা। আহা, পথের মধ্যে ও-সব কথা কেন?

৪র্থ। তা হলে বালিকা বিদ্যালয়ের দিকে ত তাঁদের বেশ ঝোঁক আছে?

৩য়। ঝোঁক? মুক্তহস্ত।

৪র্থ। মুক্তহস্ত? বেশ বেশ, মঙ্গলময় তাঁদের মঙ্গল-বিধান করুন।

[প্রস্থান।

[৬ষ্ঠ ও ৭ম ব্যক্তিদ্বয়ের প্রবেশ]

৬ষ্ঠ। না আর দূর নেই, আমরা এসে পড়েছি। হাঁ স্বর্গীয় বনমালীবাবুর সম্পত্তির সমস্ত ভার তাঁর বাল্যবন্ধু রাসবিহারীবাবুর পরেই। শুধু এখন নয়, বরাবরই এই ব্যবস্থা। বনমালীবাবু সেই যে দেশ ছেড়ে কলকাতায় এসেছিলেন আর ত কখনো ফিরে যাননি।

৭ম। তাঁর কন্যার সঙ্গে রাসবিহারীবাবুর পুত্রের বিবাহ কি স্থির হয়ে গেছে?

৬ষ্ঠ। স্থির বৈ কি। সম্বন্ধ কন্যার পিতা নিজেই করে যান, হঠাৎ মৃত্যু না হলে বিবাহ তিনিই দিয়ে যেতেন।

৭ম। এ বিবাহ কি গ্রামেই হবে?

৬ষ্ঠ। এই কথাই তো রাসবিহারীবাবু সেদিন নিজেই বললেন। শুধু তাই নয়, বিয়ের পর ছেলে-বৌ দেশেই বাস করবে, শহরের নানা প্রলোভনের মধ্যে তাদের পাঠাবেন না এই তাঁর সঙ্কল্প। অন্ততঃ, যতদিন বেঁচে আছেন। বিশেষতঃ, এত বড় সম্পত্তি দূর থেকে দেখাশোনা যায় না, নষ্ট হবার ভয় থাকে। নিজের জীবিতকালেই সমস্ত কাজকর্ম ছেলেকে শিখিয়ে দিয়ে যাবেন।

৭ম। অতিশয় সৎ বিবেচনা। বিবাহ হবে কবে।?

৬ষ্ঠ। ইচ্ছা যত শীঘ্র সম্ভব। মন্দির-প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই কথাবার্তা বোধ করি আপনাদের সম্মুখেই পাকা হয়ে যাবে। এ বড় সুখের বিবাহ অবিনাশবাবু। বর-বধূর পরে ভগবান তাঁর শুভহস্ত প্রসারিত করুন আমরা এই প্রার্থনা করি। চলুন, এই বাগানটার শেষেই বনমালীবাবুর বাড়ি।

৭ম। আপনি কি পূর্বে এখানে এসেছিলেন?

৬ষ্ঠ। (সহাস্যে) বহুবার। রাসবিহারীবাবু আমার অনেককালের বন্ধু। তিনি পত্রে জানিয়েছেন, নূতন মন্দির-গৃহটি আছে নদীর ওপারে—একটু দূরে। আমাদের থাকার জায়গাও সেইখানেই নির্দিষ্ট হয়েছে, কিন্তু বিজয়ার ইচ্ছে আজ সকালেই একটি ছোট অনুষ্ঠান তাঁর গৃহেই সম্পন্ন হয় এবং পরে সে-বাড়িতে যাই।

৭ম। উওম প্রস্তাব। চলুন, আমাদের হয়ত বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে।

[প্রস্থান

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *