বিজয়া – ১.৩

তৃতীয় দৃশ্য

সরস্বতী নদীতীর

[শরৎ অন্তে শীর্ণ সঙ্কীর্ণ সরস্বতী নদী। এ-তটে বিস্তীর্ণ মাঠ, ও-তটে লতাগুল্ম-পরিব্যাপ্ত ঘন বন। বনান্তরালে দিঘ্‌ড়া গ্রাম। নদীর উভয় তীর ক্ষুদ্র বাঁশের সেতু দিয়া সংযুক্ত। একটা পায়ে-হাঁটা সঙ্কীর্ণ পথ বনের মধ্য দিয়া দিঘ্‌ড়া গ্রামে গিয়া প্রবেশ করিয়াছে। এই সকলের অন্তরালে নরেনের বৃহৎ অট্টালিকার কিছু কিছু দেখা যায় মাত্র। নদীর তীরে বসিয়া নরেন ছিপে মাছ ধরিতেছিল। বিজয়া ও কানাই সিং প্রবেশ করিল।]

বিজয়া। এই নদীর পারেই দিঘ্‌ড়া, না কানাই সিং?

কানাই। হাঁ মা-জী।

বিজয়া। এই গাঁয়েই জগদীশবাবুর বাড়ি, না?

কানাই। হাঁ মা-জী, বহুৎ বড়া বাড়ি।

বিজয়া। এই পুল পেরিয়ে বুঝি ঐ গাঁয়ে যেতে হয়?

[বিজয়া পুলের কাছে অগ্রসর হইতে নরেন্দ্র তাহাকে দেখিয়া]

নরেন। এই যে—নমস্কার! বিকেলবেলা একটুখানি বেড়াবার পক্ষে নদীর ধারটি মন্দ জায়গা নয় বটে, কিন্তু এ সময় ম্যালেরিয়ার ভয়ও ত বড় কম নয়। এ বুঝি আপনাকে কেউ সাবধান করে দেয়নি?

বিজয়া। না, কিন্তু ম্যালেরিয়া ত লোক চিনে ধরে না। আমি ত বরং না জেনে এসেছি, আপনি যে জেনেশুনে জলের ধারে বসে আছেন? কৈ দেখি কি মাছ ধরলেন?

নরেন। (পুলের অপর প্রান্ত হইতে) পুঁটি মাছ। কিন্তু দু ঘণ্টায় মাত্র দুটি পেয়েছি, মজুরি পোষায় নি। সময়টা ত কোনমতে কাটাতে হবে?

বিজয়া। কিন্তু মামার পূজোবাড়িতে এসে তাঁকে সাহায্য না করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন যে বড়ো? গুটি-দুই পুঁটি মাছ দিয়ে ত তাঁর সাহায্য হবে না!

নরেন। (হাসিয়া) না, কিন্তু প্রথমতঃ, মামার বাড়িতে আমি আসিনি, দ্বিতীয়তঃ, তাঁকে সাহায্য করবার বহুলোক আছে। আমার প্রয়োজন নেই।

বিজয়া। মামার বাড়ি আসেন নি? এখানে তবে আছেন কোথায়?

নরেন। বাড়ি আমার ঐ দিঘ্‌ড়া গ্রামে। এই বাঁশের সাঁকো দিয়ে যেতে হয়।

বিজয়া। দিঘ্‌ড়ায়? তা হলে নরেনবাবুকে তো আপনি চেনেন? তিনি কি রকম লোক বলতে পারেন?

নরেন। ও—নরেন? তার বাড়িটা ত আপনি দেনার দায়ে কিনে নিয়েছেন? এখন তার সম্বন্ধে অনুসন্ধানে আর ফল কি? যে উদ্দেশ্যে নিলেন সে কথাও এ অঞ্চলের সবাই শুনেছে।

বিজয়া। একেবারে নেওয়া হয়ে গেছে এই বুঝি এদিকে রাষ্ট্র হয়েছে?

নরেন। হবারই কথা। জগদীশবাবুর সর্বস্ব আপনার বাবার কাছে বিক্রি-কবলায় বাঁধা ছিলো, তাঁর ছেলের সাধ্য নেই তত টাকা শোধ করে। মেয়াদও শেষ হয়েছে—এ খবর সবাই জানে কিনা!

বিজয়া। আপনি নিজেই যখন গ্রামের লোক তখন খবর জানবেন বৈ কি। আচ্ছা, শুনেছি নরেনবাবু বিলেত থেকে ভাল করেই ডাক্তারি পাস করে এসেছেন। কোন ভাল জায়গায় practice আরম্ভ করে আরও কিছুদিন সময় নিয়ে কি বাপের ঋণটা শোধ করতে পারেন না?

নরেন। সম্ভব নয়। শুনেছি practice করাই নাকি তার সঙ্কল্প নয়।

বিজয়া। তবে তাঁর সঙ্কল্পটাই বা কি? এত খরচপত্র করে বিলেত গিয়ে কষ্ট করে ডাক্তারি শেখবার ফলটাই বা কি হতে পারে? একেবারে অপদার্থ।

নরেন। অপদার্থ? (হাসিয়া) ঠিক ধরেছেন। এইটেই বোধ হয় তার আসল রোগ। তবে শুনতে পাই নাকি সে নিজে চিকিৎসা করার চেয়ে এমন একটা-কিছু বার করে যেতে চায়, যাতে বহুলোকের উপকার হবে। খবর পাই এ নিয়ে সে পরিশ্রমও খুব করে।

বিজয়া। সত্যি হলে ত এ খুব বড় কথা। কিন্তু বাড়িঘর গেলে কি করে এ-সব করবেন? তখন ত রোজগার করা চাই। আচ্ছা আপনি ত নিশ্চয়ই বলতে পারেন বিলেত যাবার জন্যে এখানকার লোক তাঁকে একঘরে করে রেখেছে কিনা।

নরেন। সে ত নিশ্চয়ই। আমার মামা পূর্ণবাবু তারও একপ্রকার আত্মীয়, তবুও পূজোর কদিন বাড়িতে ডাকতে সাহস করেন নি। কিন্তু তাতে তার ক্ষতি হয়নি। নিজের কাজকর্ম নিয়ে থাকে, সময় পেলে ছবি আঁকে। বাড়ি থেকে বড় বারই হয় না।

কানাই। মা-জী, সন্‌ঝা হয়ে আসলে; বাড়ি ফিরতে রাত হবে।

নরেন। হাঁ, কথায় কথায় সন্ধ্যা হয়ে এলো।

বিজয়া। তা হলে বাড়িটা গেলে কোনও আত্মীয়-কুটুম্বের ঘরেও তাঁর আশ্রয় পাবার ভরসা নেই বলুন?

নরেন। একেবারেই না।

বিজয়া। (মুহূর্তকাল নীরব থাকিয়া) তিনি যে কারও কাছেই যেতে চান না—নইলে এই মাসের শেষেই ত তাঁকে বাড়ি ছেড়ে দেবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে—আর কেউ হলে অন্ততঃ আমাদের সঙ্গেও একবার দেখা করবার চেষ্টা করতেন।

নরেন। হয়ত তার দরকার নেই, নয়, ভাবে লাভ কি? আপনি ত সত্যিই তাকে বাড়িতে থাকতে দিতে পারেন না।

বিজয়া। চিরকাল না পারলেও আর কিছুকাল থাকতে দেওয়া ত যায়। কিন্তু মনে হচ্ছে আপনার সঙ্গে তাঁর বিশেষ পরিচয় আছে। কি বলেন সত্যি না?

নরেন। কিন্তু এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে যে।

বিজয়া। আসুক।

নরেন। আসুক? অর্থাৎ, দেশের প্রতি আপনার সত্যিকার টান আছে।

বিজয়া। (গম্ভীর হইয়া) তার মানে?

নরেন। মানে এই যে সন্ধ্যাবেলায় এখানে দাঁড়িয়ে থেকে দেশের ম্যালেরিয়াটা পর্যন্ত না নিলে আপনার চলছে না।

বিজয়া। (হাসিয়া) ওঃ, এই কথা! কিন্তু দেশ ত আপনারও। ওটা আপনারও নেওয়া হয়ে গেছে বোধ হয়? কিন্তু মুখ দেখে ত মনে হয় না।

নরেন। ডাক্তারদের একটু সবুর করে নিতে হয়।

বিজয়া। আপনিও কি ডাক্তার নাকি?

নরেন। হাঁ ডাক্তার বটে কিন্তু খুব ছোট্ট ডাক্তার।

বিজয়া। তা হলে আপনি শুধু প্রতিবেশী নন,—তাঁর বন্ধু। তাঁর সম্বন্ধে যে-সব কথা আমি বলেচি, হয়ত গিয়ে তাঁকেই গল্প করবেন—না?

নরেন। (হাসিয়া) কি গল্প করব, বলেছেন একটা অপদার্থ হতভাগা লোক, এই ত? আপনার চিন্তা নেই, এ অত্যন্ত পুরোনো কথা, এ তাকে সবাই বলে। নতুন করে বলবার দরকার নেই। তবে, বললে হয়ত সে কোনদিন আপনার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারে।

বিজয়া। আমার সঙ্গে দেখা করে তাঁর লাভ কি? কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে ত ঠিক ও-রকম কথা আপনাকে আমি বলিনি।

নরেন। না বলে থাকলেও বলা উচিত ছিল।

বিজয়া। উচিত ছিল? কেন?

নরেন। ঋণের দায়ে যার বাস করবার গৃহ, যার সর্বস্ব বিক্রি হয়ে যায়, তাকে সবাই হতভাগ্য বলে। আমরাও বলি। সুমুখে না পারলেও আড়ালে বলতে বাধা কি?

বিজয়া। (হাসিয়া) আপনি ত তাঁর চমৎকার বন্ধু!

নরেন। (ঘাড় নাড়িয়া) হ্যাঁ, অভেদ্য বললেও চলে। এমন কি তার হয়ে আমি নিজে গিয়েই আপনাকে ধরতুম, যদি না জানতুম সৎ উদ্দেশ্যেই তার বাড়িখানি আপনি গ্রহণ করছেন।

বিজয়া। আচ্ছা, আপনার বন্ধুকে একবার রাসবিহারীবাবুর কাছে যেতে বলতে পারেন না?

নরেন। কিন্তু তাঁর কাছে কেন?

বিজয়া। তিনি বাবার বিষয়-সম্পত্তি দেখেন কিনা।

নরেন। সে আমি জানি; কিন্তু তাঁর কাছে গিয়ে লাভ নেই। সন্ধ্যা হয়—আসি তবে,—নমস্কার।

[নরেন পুল পার হইয়া বনের ভিতর অদৃশ্য হইয়া গেল। বিজয়া সেইদিকে চাহিয়া রহিল।]

কানাই। এ বাবুটি কে মা-জী?

বিজয়া। (চমকিয়া আপন মনে কহিল) কে তা ত জানিনে। ঐ যাঁদের বাড়িতে পূজো হচ্ছে তাঁদের ভাগনে।

[রাসবিহারীর প্রবেশ]

রাস। তোমাকে খুঁজছিলাম মা। খবর পেলুম তুমি নদীর দিকে একটু বেড়াতে এসেছ। ভাল কথা—তাকে আমরা নোটিশ দিয়েছি, আবার আমরা যদি রদ করতে যাই, আর পাঁচজন প্রজার কাছে সেটা কি-রকম দেখাবে ভেবে দেখ দিকি।

বিজয়া। একখানা চিঠি লিখে তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিন না। আমার নিশ্চয়ই বোধ হচ্ছে তিনি শুধু অপমানের ভয়েই এখানে আসতে সাহস করেন না।

রাস। (বিদ্রূপের ভাবে) মহামানী লোক দেখছি! তাই অপমানটা ঘাড়ে নিয়ে আমাদেরই উপযাচক হয়ে তাঁকে থাকবার জন্যে চিঠি লিখতে হবে?

বিজয়া। (কাতর হইয়া) তাতে দোষ নেই কাকাবাবু—অযাচিত দয়া করার মধ্যে লজ্জা নেই।

রাস।(ঈষৎ হাসিয়া) মা, তোমার জিনিস তুমি দান করবে, আমি বাদ সাধব কেন? আমি শুধু এইটুকুই দেখাতে চেয়েছিলুম যে, বিলাস যা করতে চেয়েছিল, তা স্বার্থের জন্যও নয়, রাগের জন্যেও নয়—শুধু কর্তব্য বলেই করতে চেয়েছিল। একদিন আমার বিষয় তোমার বাবার বিষয় সব এক হয়েই তোমাদের দুজনের হাতে পড়বে। সেদিন বুদ্ধি দেবার জন্যে এ বুড়োটাকে খুঁজে পাবে না মা।

[বিলাসের প্রবেশ—পরনে বিলাতী পোশাক, হাতে ছোট ব্যাগ, অত্যন্ত ব্যস্তভাবে]

বিলাস। এই যে তোমরা। বাবা, এখনো বাড়ি যাবার সময় পাইনি, কলকাতা থেকে ফিরেই শুনলুম তোমরা এসেছ নদীর তীরে বেড়াতে। বেড়ানো! বিরাট কার্যভার মাথায় নিয়ে কি করে যে মানুষ আলস্যে সময় কাটাতে পারে আমি তাই শুধু ভাবি। বাবা, একরকম সমস্ত কাজই প্রায় শেষ করে এলুম। কাদের আহ্বান করতে হবে, কাদের ওপর সেদিনের ভার দিতে হবে, কি কি করতে হবে,—সমস্ত।

রাস। সমস্ত? বল কি? এর মধ্যে করলে কি করে?

বিলাস। হ্যাঁ, সমস্ত। আমার কি আর নাওয়া-খাওয়া ছিল! বিজয়া, তুমি নিশ্চয়ই ভাবচ এই ক’টা দিন আমি রাগ করে আসিনি। যদিও রাগ আমি করিনি, কিন্তু করলেও সেটা কিছুমাএ অন্যায় হতো না।

রাস। কানাই সিং, চলো ত বাবা একটু এগিয়ে দু পা ঘুরে আসি গে। অনেকদিন নদীর এ দিকটায় আসতে পারিনি।

কানাই সিং। চলিয়ে হুজুর।

[রাসবিহারী ও কানাই সিং-এর প্রস্থান

বিলাস। তুমি স্বচ্ছন্দে চুপ করে থাকতে পার, কিন্তু আমি পারিনে। আমার দায়িত্ববোধ আছে। একটা বিরাট কার্যভার ঘাড়ে নিয়ে আমি কিছুতেই থাকতে পারিনে। আমাদের মন্দির-প্রতিষ্ঠা এই বড়দিনের ছুটিতেই হবে। সমস্ত স্থির হয়ে গেল। এমন কি নিমন্ত্রণ করা পর্যন্ত বাকী রেখে আসিনি। উঃ—কাল সকাল থেকে কি ঘোরাটাই না আমাকে ঘুরতে হয়েছে। যাক, ওদিকের সম্বন্ধে একরকম নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, কারা কারা আসবেন তাও নোট করে এনেছি, পড়ে দ্যাখো অনেককেই চিনতে পারবে।
[সে ব্যাগ খুলিয়া হাতড়াইয়া, কাগজখানা বাহির করিয়া ধরিল। বিজয়া গ্রহণ করিল বটে, কিন্তু তার মুখ দেখিয়া মনে হইল বিতৃষ্ণার সীমা নাই]

বিলাস। ব্যাপার কি? এমন চুপচাপ যে?

বিজয়া। আমি ভাবছি, আপনি যে তাঁদের নিমন্ত্রণ করে এলেন এখন তাঁদের কি বলা যায়?

বিলাস। তার মানে?

বিজয়া। মন্দির-প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে আমি এখনও কিছু স্থির করে উঠতে পারিনি।

বিলাস। (সুতীব্র বিস্ময়ে ও ততোধিক ক্রোধে বিলাসের মুখ ভীষণ হইয়া উঠিল। কিন্তু কণ্ঠস্বর তাহার পক্ষে যতটা সম্ভব সংযত করিয়া কহিল) তার মানে কি? তুমি কি ভেবেচ আসছে ছুটির মধ্যে না করতে পারলে আর কখনো করা যাবে? তারা ত কেউ তোমার—ইয়ে নন যে তোমার যখন সুবিধে হবে তখনই তাঁরা ছুটে এসে হাজির হবেন। মন স্থির হয়নি তার অর্থ কি শুনি?

বিজয়া। (মৃদুকণ্ঠে) এখানে ব্রহ্মমন্দির-প্রতিষ্ঠার কোন সার্থকতা নেই। সে হবে না।

বিলাস। (কিছুক্ষণ স্তম্ভিত থাকিয়া) আমি জানতে চাই তুমি যথার্থই ব্রাহ্মমহিলা কিনা।

বিজয়া। (তাহার মুখের দিকে নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া) আপনি বাড়ি থেকে শান্ত হয়ে ফিরে না এলে আপনার সঙ্গে আলোচনা হতে পারবে না। এ কথা এখন থাক।

বিলাস। আমরা তোমার সংস্রব পরিত্যাগ করতে পারি জানো?

বিজয়া। সে আলোচনা আমি কাকাবাবুর সঙ্গে করব, আপনার সঙ্গে নয়।

বিলাস। আমরা তোমার সংস্পর্শ ত্যাগ করলে কি হয় জানো?

বিজয়া। না, কিন্তু আপনার দায়িত্ববোধ যখন এত বেশি তখন আমার অনিচ্ছায় যাঁদের নিমন্ত্রণ করে অপদস্থ করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তাঁদের ভার নিজেই বহন করুন। আমাকে অংশ নিতে অনুরোধ করবেন না।

বিলাস। আমি কাজের লোক, কাজই ভালবাসি, খেলা ভালবাসি নে তা মনে রেখো বিজয়া।

বিজয়া। (শান্তস্বরে) আচ্ছা আমি ভুলবো না।

বিলাস। (প্রায় চীৎকার করিয়া) হাঁ—যাতে না ভোলো সে আমি দেখব।

[বিজয়া কোন কথা না বলিয়া যাইবার উদ্যোগ করিল]

বিলাস। আচ্ছা, এত বড় বাড়ি তবে কি কাজে লাগবে শুনি? এ ত আর শুধু শুধু ফেলে রাখা যেতে পারবে না?

বিজয়া। (মুখ তুলিয়া দৃঢ়ভাবে) কিন্তু এ বাড়ি যে নিতেই হবে সে ত এখনও স্থির হয়নি!

বিলাস। (রাগিয়া সজোরে মাটিতে পা ঠুকিয়া) হয়েছে একশো বার স্থির হয়েছে। আমি সমাজের মান্য ব্যক্তিদের আহ্বান করে এনে অপমান করতে পারব না। এ বাড়ি আমাদের চাই-ই, এ আমি করে তবে ছাড়ব। এই তোমাকে আমি জানিয়ে দিলুম।

[রাসবিহারী ফিরিয়া আসিলেন।]

বিলাস। শুনছো বাবা, বিজয়া বলছেন, এ এখন হবে না—এ অপমান—

রাস। হবে না? কি হবে না? কে বলেচে হবে না?

বিলাস। (আঙুল দিয়া দেখাইয়া) উনি বলচেন মন্দির-প্রতিষ্ঠা এখন হতে পারবে না।

রাস। বিজয়া বলচেন হবে না? বল কি? আচ্ছা স্থির হও বাবা, স্থির হও। কোন অবস্থাতেই উতলা হতে নেই। আগে শুনি সব। নিমন্ত্রণ হয়ে গেছে? হয়েছে। বেশ, সে ত আর প্রত্যাহার করা যায় না—অসম্ভব। এদিকে দিনও বেশি নেই, করতে হলে এর মধ্যেই সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ করা চাই। এতে ত সন্দেহ নেই মা।

বিজয়া। কিন্তু তিনি স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে না গেলে ত কিছুতেই হতে পারে না কাকাবাবু!

রাস। কার স্বেচ্ছায় বাড়ি ছাড়ার কথা বলছ মা, জগদীশের ছেলের? সে ত বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে—শোননি?

[বিজয়া বিলাসের দিক হইতে ফিরিয়া দাঁড়াইল। তাহার ঠোঁট কাঁপিতে লাগিল। নিজেকে সংযত করিয়া]

বিজয়া। না শুনিনি। কিন্তু তাঁর জিনিসপত্র কি হলো? সমস্ত নিয়ে গেছেন?

বিলাস। (হাসির ভঙ্গীতে) শুনেচি থাকবার মধ্যে ছিল নাকি একটা ভাঙ্গা খাট—তার ওপরই বোধ করি তাঁর শয়ন চলত। আমি সেটা বাইরে গাছতলায় টেনে ফেলে দেবার হুকুম দিয়ে কলকাতায় গিয়েছিলুম। আজ স্টেশনে নেবেই দরোয়ানের মুখে খবর পেলুম সেগুলো নেবার জন্যে আজ সকালে নাকি সে আবার এসেছে। যা কিছু তার আছে নিয়ে যাক, আমার কোন আপত্তি নেই।

রাস। তোমার দোষ বিলাস। মানুষ যেমন অপরাধীই হোক, ভগবান তাকে যত দণ্ডই দিন, তার দুঃখে আমাদের দুঃখিত হওয়া, সমবেদনা প্রকাশ করা উচিত। আমি বলছি নে যে অন্তরে তুমি তার জন্যে কষ্ট পাও না, কিন্তু বাইরেও সেটা প্রকাশ করা কর্তব্য। তাকে একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে বললে না কেন? দেখতুম—যদি কিছু—

বিলাস। তাঁর সঙ্গে দেখা করে নিমন্ত্রণ করা ছাড়া আমার ত আর কাজ ছিল না বাবা! তুমি কি যে বল তার ঠিক নেই। তা ছাড়া আমার পৌঁছুবার আগেই ত ডাক্তারসাহেব তাঁর তোরঙ্গ-পেটরা যন্ত্রপাতি গুটিয়ে নিয়ে সরে পড়েছেন। বিলাতের ডাক্তার! একটা অপদার্থ humbug কোথাকার!

রাস। না বিলাস, তোমার এরকম কথাবার্তা আমি মার্জনা করতে পারিনে। নিজের ব্যবহারে তোমার লজ্জিত হওয়া উচিত—অনুতাপ করা উচিত।

বিলাস। কি জন্যে শুনি? পরের দুঃখে দুঃখিত হওয়া, পরের ক্লেশ নিবারণ করার শিক্ষা আমার আছে, কিন্তু যে দাম্ভিক বাড়ি বয়ে অপমান করে যায়—তাকে আমি মাপ করিনে। অত ভণ্ডামি আমার নেই।

রাস। কে আবার তোমাকে বাড়ি বয়ে অপমান করে গেল? কার কথা তুমি বলছ?

বিলাস। জগদীশবাবুর সুপুত্র নরেনবাবুর কথাই বলছি বাবা। তিনি একদিন ওঁর ঘরে বসেই আমাকে অপমান করে গিয়েছিলেন। তখন তাকে চিনতুম না তাই—(বিজয়াকে দেখাইয়া) নইলে ওঁকেও অপমান করে যেতে সে বাকী রাখেনি। তোমরা জান সে কথা? (বিজয়ার প্রতি) পূর্ণবাবুর ভাগনে বলে নিজের পরিচয় দিয়ে যে তোমাকে পর্যন্ত সেদিন অপমান করে গিয়েছিল সে কে? তখন যে তাকে ভারী প্রশ্রয় দিলে! সেই নরেন। তখন নিজের যথার্থ পরিচয় দিতে যদি সে পারত—তবেই বলতে পারতুম সে পুরুষমানুষ। ভণ্ড কোথাকার!

বিজয়া। তিনিই নরেনবাবু! দরোয়ান পাঠিয়ে তাঁকেই বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছেন? আমারই নাম করে?
আমারই দেনার দায়ে?

[ক্রোধ ও ক্ষোভে সে যেন ছুটিয়া চলিয়া গেল]

রাস। (হতবুদ্ধিভাবে) এ আবার কি?

বিলাস। আমি তার কি জানি!

রাস। যদি জানো না ত অত কথা দম্ভ করে বলতেই বা গেলে কেন? গোড়া থেকে শুনচ জগদীশের ছেলের ওপর ও জোর-জবরদস্তি চায় না, তবুও—

বিলাস। অত ভণ্ডামি আমি পারিনে। আমি সোজা পথে চলতে ভালবাসি।

রাস। তাই বেসো। সোজা পথ ও-ই একদিন তোমাকে আশ মিটিয়ে দেখিয়ে দেবে’খন। সোজা পথ! সোজা পথ!

[বলিতে বলিতে তিনি দ্রুতপদে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেলেন]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *