বামুনের মেয়ে – ২.৫

রাত্রি খুব বেশী হয় নাই, বোধ হয় একপ্রহর হইয়া থাকিবে, কিন্তু শীতের দিনের পল্লীগ্রামে ইহারই মধ্যে অত্যন্ত গভীর মনে হইতেছিল। জ্ঞানদার শয়ন-কক্ষের এক কোণে একটা মাটির প্রদীপ মিটমিট করিয়া জ্বলিতেছিল। ঘরের মেঝেয় বসিয়া জ্ঞানদা এবং তাহারই অদূরে বসিয়া রাসমণি হাত-মুখ নাড়িয়া বুঝাইয়া বলিতেছেন, কথা শোন্‌ জ্ঞানদা, পাগলামি করিস নে। ওষুধটুকু দিয়ে গেছে—খেয়ে ফ্যাল্‌। আবার যেমন ছিল সব তেমনি হবে, কেউ জানতেও পারবে না।

জ্ঞানদা অশ্রুরুদ্ধ-স্বরে বলিল, এমন কথা আমাকে তোমরা কেমন করে বল দিদি! পাপের ওপর এতবড় পাপ আমি কি করে করব? নরকেও যে আমার জায়গা হবে না!

রাসমণি ভর্ৎসনা করিয়া কহিলেন, আর এতবড় কুলে কালি দিয়েই বুঝি তুমি স্বর্গে যাবে ভেবেচ? যা রয় সয় তাই কর্‌ জ্ঞানদা, আদিখ্যেতা করে এতবড় একটা দেশপুজ্যি লোকের মাথা হেঁট করে দিসনে।

জ্ঞানদা হাতজোড় করিয়া কাঁদিয়া বলিল, ও আমি কিছুতে খেতে পারব না, আমাকে বিষ দিয়ে তোমরা মেরে ফেলবে, আমি টের পেয়েচি।

রাসমণি মুখখানা অতিশয় বিকৃত করিয়া কহিলেন, তবে, তাই বল্‌ মরবার ভয়ে খাব না। মিছে ধর্ম ধর্ম করিস নে।

জ্ঞানদা কহিল, কিন্তু ও যে বিষ!

রাসমণি বলিলেন, বিষ তা তোর কি? তুই ত আর মরচিস নে। বলিয়াই তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর চক্ষের নিমিষে কোমল ও করুণ করিয়া কহিলেন, পাগলী আর বলে কাকে! আমরা কি তোকে খারাপ জিনিস খেতে বলতে পারি বোন? এ কি কখনো হয়? রাসী-বাম্‌নীকে এমন কথা কি কেউ বলতে পারে? তা নয় দিদি—কপালের দোষে যে শত্রুটা তোর পেটে জন্মেচে, সেই আপদ-বালাইটা ঘুচে যাক—কতক্ষণেরই বা মামলা! তারপরে যা ছিলি তাই হ—খা, দা, ঘুরে বেড়া, তীর্থ-ধর্ম বার-ব্রত কর্‌—এ কথা কে-ই বা জানবে, আর কে-ই বা শুনবে!

জ্ঞানদা অধোমুখে স্থির হইয়া বসিয়া রহিল।

রাসমণি জিজ্ঞাসা করিলেন, তা হলে আনতে বলে দি’ বোন?

জ্ঞানদা মুখ তুলিল না, কিন্তু কাঁদিয়া ফেলিয়া কহিল, না, আমি ওসব কিছুতেই খাবো না—আমি কখ্‌খনো তা হলে আর বাঁচব না।

রাসমণি ভয়ানক রাগ করিয়া বলিলেন, এ ত তোর ভারী ছিষ্টিছাড়া অন্যায় জ্ঞানদা? খেতে না চাস্‌, যা এখান থেকে। পুরুষ মানুষ, একটা অ-কাজ না হয় করেই ফেলেচে, তা বলে মেয়েমানুষের এমনি জিদ ধরলে ত চলে না। চাটুয্যেদাদা ত বলেচেন, বেশ, যা হবার হয়েচে, ওকে আমি পঞ্চাশটা টাকা দিচ্চি, ও কাশী-বৃন্দাবনে চলে যাক। তারপরে ত তাঁকে আর দোষ দিতে পারিনে জ্ঞানদা? টাকাটাও ত কম নয়? একসঙ্গে একমুঠো!

জ্ঞানদা কহিল, আমি টাকা চাইনে দিদি, টাকা নিয়ে আমি কি করব? আমি যে কাউকে কোথাও চিনিনে—আমি কেমন করে কার কাছে গিয়ে এ মুখ নিয়ে দাঁড়াব?

রাসমণি বলিলেন, এ তোমার জব্দ করার মতলব নয় জ্ঞানদা? লোকে কথায় বলেচে কাশী-বৃন্দাবন! এত লোকের স্থান হয়, আর তোমারই হবে না?

জ্ঞানদা খানিকক্ষণ নিঃশব্দে থাকিয়া বলিল, রাসুদিদি, আমি সব জানি। কাল ওঁর প্রাণকৃষ্ণ মুখুয্যের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হবে, তাও জানি। আজ, তাই আমাকে বিষ দিয়ে হোক, কাশীতে পাঠিয়ে হোক, বাড়ি থেকে দূর করা চাই। কিন্তু ভগবান! বলিতে বলিতে সে সহসা ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিয়া দুই হাত জোড় করিয়া কহিতে লাগিল, ভগবান! তোমার পায়ে এত লোকের যখন স্থান হয়, তখন আমারও হবে।

কিন্তু ছেলেবেলা থেকে কখনো কোন পাপ করিনি, হয়ত কখনো করতেও হতো না—কিন্তু তুমি ত সব জানো? এর সমস্ত শাস্তির বোঝা কি কেবল নিরুপায় বলে আমার মাথাতেই তুলে দেবে?

ভগবানের নামে রাসমণির বোধ করি বিরক্তির অবধি রহিল না, তিনি ধমক দিয়া বলিলেন, আ-মর্‌! শাপমন্যি দিস কেন? কচি খুকি! চোর মরে সাত বাড়ি জড়িয়ে,—এ হয়েচে তাই। তুমি আশকারা না দিলে পুরুষমানুষের দোষ কি! কৈ বলুক ত দেখি এমন ব্যাটাছেলে কে আছে রাসী-বাম্‌নীকে—

ইহার আর উত্তর কি? জ্ঞানদা নীরবে অঞ্চলে চোখ মুছিতে লাগিল। রাসমণি অপেক্ষাকৃত শান্ত গলায় বলিলেন, বেশ ত জ্ঞানদা, ক্যাওরা-বৌয়ের ওষুধ খেতে যদি তোমার ভয় হয়, প্রিয় মুখুয্যেকে ত বিশ্বেস হয়? সেই না হয় একটা কিছু দেবে যাতে—

জ্ঞানদা অবাক হইয়া বলিল, তিনি দেবেন?

রাসমণি বলিলেন, হুঁ! দেবে না আবার! চাটুয্যেদাদা বললে দিতে পথ পাবে না। খবর দেওয়া হয়েচে, এসে পড়ল বলে! তখন কিন্তু না বললে আর হবে না বলে দিচ্চি।

জ্ঞানদা চুপ করিয়া রহিল। রাসমণি অধিকতর উৎসাহজনক আরও কিছু বলিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু অদূরে প্রাঙ্গণে জুতার শব্দ এবং প্রিয় মুখুয্যের গলা শোনা গেল— আঃ! এখানে একটা আলো দেয় না কেন? লোকজন সব গেল কোথায়?—বলিতে বলিতে খটখট করিয়া তিনি ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বগলে চাপা ছোট-বড় চার-পাঁচখানা বই তক্তপোশের উপর এবং হাতের বাক্সটা নীচে রাখিতে রাখিতে বলিলেন, আজ কেমন আছ জ্ঞানদা? উঁহুঁ, হুঁ,—ও চলবে না—ঠাণ্ডা পড়েচে, মাটিতে বসা চলবে না—রেমিডিটা একটু পালটে দিতে হলো দেখচি! এ কে, মাসী যে! কতক্ষণ? ভালো ত সব? তোমার নাতনীটিকে কাল রাস্তায় দেখলাম—তেমন ভালো বলে ত মনে হলো না? ক্ষিদে কেমন? কাল নিয়ে গিয়ে তার জিভটা একবার দেখিয়ো দিকি। মরবার ফুরসত নেই, কোন্‌দিকে যে যাই! যেদিকে নজর না রাখব অমনি—কাল মেয়েটার বিয়ে—মাসী, কাল কিন্তু সকালবেলাতেই যাওয়া চাই। মেয়ের বিয়ে, কাল কিছু আর বা’র হতে পারব না,—কিন্তু রোগীগুলোর কি যে হবে তাই কেবলি ভাবচি। একটা আধটা ত নয়! এমনি হয়েচে যে প্রিয় মুখুয্যেকে ছেড়ে কেউ আর বিপ্‌নেকে ডাকতেই চায় না। তারই বা চলে কি করে? দুঃখও হয়, তবু যা হোক একটু শিখেচে ত! দাও হাতটা একবার দেখি। পঞ্চা গয়লার শুনলাম বুকে সর্দি বসে গেছে—খপ্‌ করে একবার দেখে আসতে হবে। দাও হাতটা একবার—

জ্ঞানদা হাত বাড়াইয়া দিল না, নীরবে নতমুখে বসিয়া রহিল।

রাসমণি বলিলেন, ছুড়ীর ব্যারামটা কি ঠাওরালে বল দিকি জামাই?

প্রিয় তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া কহিলেন, ডিজিস্‌—গরহজম, অজীর্ণ—অম্বল! অম্বল!

কিন্তু প্রশ্নকারিণীর মৃদু মৃদু শিরশ্চালনা দেখিয়া তাঁহার ডাক্তারি-বিদ্যা একেবারে নিবিবার উপক্রম করিল। ব্যগ্র হইয়া কহিলেন, কেন, কেন? নয় কেন? বিপ্‌নে এসেছিল বুঝি? কি বললে সে? কৈ দেখি, কি ওষুধ দিয়ে গেল?

রাসমণির মুখে সত্য-মিথ্যা, উগ্র-কোমল, ভাল-মন্দ কিছুই বাধে না, ভূমিকা করিয়া কথা কহিবার প্রয়োজন তাঁহার দৈবাৎ ঘটে—কিন্তু তবুও তাঁহাকে আজ সাবধান হইতে হইল। মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না বাবা, বিপিন ডাক্তারকেও ডাকা হয়নি, পরাণ চাটুয্যেও আসেনি—তোমার কাছে কি আবার তারা? ডাক্তারির তারা জানে কি? এ কথা চাটুয্যেদাদা যে সক্কলের কাছে বলে বেড়ায়।

বলবে না? এ যে সবাই বলবে। বিপ্‌নেকে যে আমি দশ বচ্ছর শেখাতে পারি। সেবার পল্‌সেটিলা দিয়ে—

মাসী বললে, তা ছাড়া ছুড়ী এমন কাণ্ড করে বসল বাবা যে, আপনার লোক ছাড়া পরকে ডাকবার পর্যন্ত জো নেই।

প্রিয় উত্তপ্ত হইয়া কহিলেন, আমি থাকতে পর ঢুকবে এখানে ডাক্তারি করতে! তবে কি জানো মাসী, এ-সব রোগে একটু টাইম লাগে—কিন্তু, তাও বলে যাচ্চি, দুটির বেশি তিনটি রেমিডি আমি দেব না। কেমন জ্ঞানদা, গা-বমিটা আমার দুটি ফোঁটা ওষুধে থামল কিনা? ঠিক বল?

জ্ঞানদার আনত-শির একেবারে যেন মাটির সঙ্গে মিশিয়া যাইতে চাহিল। তাহার হইয়া রাসমণি বলিলেন, তোমাকে ছাড়া ও আর কাউকে বিশ্বাস করে না বাবা, তোমার ওষুধ যেন ওর ধন্বন্তরি। কিন্তু ব্যামোটা যে তা নয় পিওনাথ। অদিষ্টের ফেরে পোড়া-কপালীর অসুখটা যে হয়ে দাঁড়িয়েচে উলটো!

প্রিয় হাতটা তুলিয়া কহিলেন, উলটো নয় মাসী, উলটো নয়। বিপ্‌নে মিত্তিরের হাতে পড়লে তাই হয়ে দাঁড়াত বটে, কিন্তু কিছু ভয় নেই, এ প্রিয় মুখুয্যে!

রাসমণি ললাটে একটুখানি করাঘাত করিয়া বলিলেন, তুমি বাঁচাও ত ভয় নেই সত্যি, কিন্তু সর্বনাশী যে এদিকে সর্বনাশ করে বসেচে! এখন তার মত একটু ওষুধ দিয়ে উদ্ধার না করলে যে কুলে কালি পড়বার জো হলো বাবা।

কিন্তু এত বড় অভিজ্ঞ চিকিৎসকের কাছেও তাঁহার শেষ কথাটা যে বেশ প্রাঞ্জল হইয়া উঠিল না, তাঁহার মুখের পানে চাহিয়া মাসী চক্ষের নিমিষে অনুভব করিলেন, এবং ইহাই যথেষ্ট পরিস্ফুট করিতে প্রিয়নাথকে তিনি ঘরের একধারে টানিয়া লইয়া গিয়া কানে কানে গুটিকয়েক কথা বলিতেই সে চমকাইয়া উঠিয়া কহিল, বল কি মাসী? জ্ঞানদা—?

মাসী কহিলেন, কি আর বলব বাবা, কপালের লেখা কে খণ্ডাবে বল? এখন দাও একটু ওষুধ পিওনাথ, যাতে গোলোক চাটুয্যের উঁচু মাথা না নিচু হয়। একটা দেশের মাথা, সমাজের শিরোমণি! পুরুষমানুষ—তার দোষ কি বাবা? কিন্তু তার ঘরে এসে তুই ছুড়ি কি ঢলাঢলিটা করলি বল্‌ দিকি!

প্রিয়র মুখ ফ্যাকাশে হইয়া গেল। একবার জ্ঞানদার মুখখানা তিনি দেখিবার চেষ্টা করিলেন, তারপরে ধীরে ধীরে কহিলেন, তোমরা বরঞ্চ বিপিন ডাক্তারকে খবর দাও মাসী, এ-সব ওষুধ আমার কাছে নেই। বলিয়া তিনি হেঁট হইয়া নিজের বাক্সটা এবং বইগুলা সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।

রাসমণি আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, বল কি পিওনাথ, আর কি পাঁচ-কান করা যায়? হাজার হোক তুমি আপনার জন, আর বিপিন ডাক্তার পর, শূদ্দুর, বামুনের মান-মর্যাদা কি তারে বলা যায়?

কিন্তু বলিবার পূর্বেই সহসা দ্বার খুলিয়া নিঃশব্দে গোলোক প্রবেশ করিলেন এবং প্রিয়র বাঁ হাতটা চাপিয়া ধরিয়া মিনতি করিয়া কহিলেন, বিষের ভয়ে ও যে আর কারও ওষুধ খেতে চায় না বাবা, নইলে কষ্ট তোমাকে দিতাম না। এ বিপদটি তোমাকে উদ্ধার করতেই হবে, প্রিয়নাথ।

প্রিয় হাত ছাড়াইয়া লইয়া বলিলেন, না, না, ওসব নোংরা কাজের মধ্যে আমি নেই। আমি রোগী দেখি, রেমিডি সিলেক্ট করি, ব্যস্‌! বিপিন-টিপিনকে ডেকে পরামর্শ করুন—আমি ওসব জানি-টানিনে। বলিয়া আর একবার তিনি বইগুলা বগলে চাপিবার আয়োজন করিলেন।

গোলোক সেই হাতটা তাহার আর একবার নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া প্রায় কাঁদ-কাঁদ গলায় কহিতে লাগিলেন, প্রিয়নাথ, বুড়োমানুষের কথাটা রাখো বাবা। সম্পর্কে তোমার আমি শ্বশুরই হই। রাখবে না জানলে যে তোমাকে আমরা বলতাম না। দোহাই বাবা, একটা উপায় করে দাও—হাতে ধরচি তোমার—

প্রিয়নাথ হাতটা পুনরায় ছাড়াইয়া লইয়া কহিলেন, সম্পর্কে শ্বশুর হন বলে কি আপনার কথায় জীবহত্যা করব? আচ্ছা লোক ত আপনি! পরলোকে জবাব দেব কি!

গোলোক দ্বারের কাছে সরিয়া গেলেন। তাঁহার মুখের চেহারা, চোখের ভাব, গলার স্বর সমস্তই যেন অদ্ভুত জাদুবলে এক নিমিষে পরিবর্তিত হইয়া গেল। কর্কশকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, এত রাত্রে তুমি ভদ্রলোকের বাড়ির ভেতরে ঢুকেচ কেন? এখানে তোমার কি দরকার?

প্রশ্ন শুনিয়া প্রিয় শুধু আশ্চর্য নয়, হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন; বলিলেন, কি দরকার! বাঃ- বেশ ত! চিকিৎসা করতে কে ডেকে পাঠালে? বাঃ—

গোলোক চীৎকার করিয়া উঠিলেন, বাঃ—? চিকিৎসার তুই কি জানিস হারামজাদা নচ্ছার? কে তোকে ডেকেচে? কোথা দিয়ে বাড়ি ঢুকলি? খিড়কির দরজা কে তোকে খুলে দিলে?

জ্ঞানদার প্রতি ফিরিয়া কহিলেন, হারামজাদী! তাই অন্ধ শ্বশুর কেঁদে কেঁদে ফিরে গেল, যাওয়া হলো না! বুড়ো শাশুড়ী মরে—আমি নিজে কত বললুম, জ্ঞানদা যাও, এ-সময়ে তাঁর সেবা করো গে। কিছুতে গেলিনে এইজন্যে? রাত-দুপুরে চিকিচ্ছে করাবার জন্যে? দাঁড়া হারামজাদী, কাল যদি না তোর মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে গ্রামের বার করে দিই ত, আমার নাম গোলোক চাটুয্যেই নয়।

জ্ঞানদার মাথায় কাপড় নাই—কখন পড়িয়া গেছে জানিতেই পারে নাই—মুখেও কথা নাই—কেবল দুই চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া সে যেন একেবারে পাথর হইয়া রহিল।

গোলোক রাসমণির প্রতি চাহিয়া কহিলেন, রাসু, চোখে দেখলি ত এদের কাণ্ড? আমি দশখানা গ্রামের সমাজের কর্তা, আমার বাড়িতে পাপ! এ যে বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা হলো রে!

রাসমণি নিজেও এতক্ষণ আড়ষ্ট হইয়া বসিয়াছিলেন, কহিলেন, হলোই ত দাদা!

গোলোক কহিলেন, কিন্তু সাক্ষী রইলি তুই।

রাসমণি কহিল, রইলুম বৈ কি। আমি বলি, রাত্রিতে ত একটু হাত আজাড় হলো—দেখে আসি জ্ঞানদা কেমন আছে, দেখি, না বেশ দুটিতে বসে বসে হাসি-তামাশা, খোশগল্প হচ্ছে।

জ্ঞানদা ইহার কোন উত্তর দিল না, তেমনি প্রসারিত-চক্ষে পাষাণমূর্তির ন্যায় বসিয়া রহিল।

প্রিয় আচ্ছন্ন অভিভূতের মত দাঁড়াইয়া ছিলেন, গোলোক ছোঁ মারিয়া তাঁহার হাত হইতে বইগুলি কাড়িয়া লইয়া তাঁহার গলায় সজোরে একটা ধাক্কা মারিয়া বলিলেন, বেরো ব্যাটা পাজী নচ্ছার আমার বাড়ি থেকে! কি বলব, তুই রামতনু বাঁড়ুয্যের জামাই, নইলে জুতিয়ে আজ আধ-মরা করে তোকে থানায় চালান দিতাম! বলিয়া পুনশ্চ একটা ধাক্কা দিলেন এবং যে চাকর-দাসীরা গোলযোগ শুনিয়া বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাদেরই মধ্য দিয়া তাঁহাকে বারংবার ঠেলিতে ঠেলিতে বাহির করিয়া লইয়া গেলেন।

প্রিয় বলিতে বলিতে গেলেন, বাঃ—বেশ মজা ত!

চাকর-দাসীরাও সঙ্গে সঙ্গে গেল এবং রাসমণি নীরবে তাহাদেরই পিছনে পিছনে নিঃসাড়ায় সরিয়া পড়িলেন।

রহিল কেবল জ্ঞানদা—তেমনি নিশ্চল, তেমনি বাক্যহীন, তেমনি অচেতন মূর্তির মত বসিয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *