বামুনের মেয়ে – ২.১

দুই

সন্ধ্যার অন্ধকার ধীরে ধীরে গাঢ় হইয়া আসিতেছিল, কিন্তু তখনও আলো জ্বালা হয় নাই। অরুণ তাহার পড়িবার ঘরের মধ্যে টেবিলের উপর দুই পা তুলিয়া দিয়া কড়িকাঠের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া স্থির হইয়া বসিয়াছিল। তাহার ক্রোড়ের উপর বই খোলা, কিন্তু একটু মনোযোগ করিলেই দেখা যাইত যে, এ কেবল সন্ধ্যার অজুহাতেই পড়া বন্ধ হয় নাই, বরঞ্চ আলো যখন যথেষ্ট ছিল, তখনও ঐ বই ওখানে অমনি করিয়াই পড়িয়া ছিল। বস্তুতঃ সেইদিন হইতে সে কাজেও যায় নাই, বাড়ির বাহির পর্যন্ত হয় নাই। এই কয়টা দিন তাহার কেবল একটা কথাই বার বার মনে পড়িয়াছে যে, একজনের কাছে সে একেবারে অস্পৃশ্য হইয়া গেছে! ঘৃণা এবং অশুচিতা এতদূরে গিয়াছে যে, তাহাকে ছুঁইয়া ফেলিলেও একজনের মুখের পান ফেলিয়া দিবার প্রয়োজন হয়!

সহসা তাহার চিন্তা বাধা পাইল। দ্বারের কাছে একটা শব্দ শুনিয়া সে চোখ নামাইয়া ঠাহর করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে ওখানে?

আমি সন্ধ্যা,—বলিয়া সাড়া দিয়া সন্ধ্যা দরজা খুলিয়া চৌকাঠ ধরিয়া দাঁড়াইল।

অরুণ ব্যস্ত হইয়া পা নামাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, এবং একান্ত বিস্ময়ের কণ্ঠে প্রশ্ন করিল, তুমি এখানে? এমন সময়ে যে? ঘরে এসে বসো।

সন্ধ্যা কহিল, আমার বসবার সময় নেই। আমি পুকুরে গা ধুতে এসে তোমার এখানে লুকিয়ে এসেচি। আমাদের একটা মান রাখবে অরুণদা?

অরুণ অধিকতর বিস্মিত হইয়া বলিল, মান? তোমাদের? নিশ্চয় রাখব সন্ধ্যা।

তা আমি জানতুম, বলিয়া সন্ধ্যা ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, বাবার কাছে শুনলুম এ ক’দিন তুমি কাজে যাওনি, বাড়ি থেকে পর্যন্ত বেরোও নি—কেন শুনি?

আমার শরীর ভাল নেই।

সন্ধ্যা কহিল, না থাকা আশ্চর্য নয়, কিন্তু তা নয়। বাবা তা হলে সকলের আগে সেই কথাটাই বলতেন।

অরুণ চুপ করিয়া রহিল। সন্ধ্যা নিজেও একটুখানি স্থির থাকিয়া পুনশ্চ কহিল, কারণ আমি জানি অরুণদা। কিন্তু আমাদের বাড়িতে তুমি আর কখনো যেয়ো না।

অরুণ আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না—শুধু কেবল তোমাদের বাড়িতে নয়—এ গ্রামের বাস তুলে দিয়ে আর কোথাও যাব কিনা, যেথায় বিনাদোষে মানুষে মানুষকে এত হীন, এত লাঞ্ছিত করে না—আমি সেই কথাই দিনরাত ভাবচি।

সন্ধ্যা মুখ তুলিয়া বলিয়া উঠিল, জন্মভূমি ত্যাগ করে চলে যাবে?

অরুণ কহিল, জন্মভূমিই ত আমাকে ত্যাগ করচে সন্ধ্যা। আজ তোমার কাছেও আমি এমন অশুচি হয়ে গেছি যে, তোমাকেও মুখের পান ফেলে দিতে হলো। এই ঘৃণা সয়েও কি আমাকে তুমি এই গ্রামে থাকতে বল?

সন্ধ্যা নিরুত্তরে অধোমুখে দাঁড়াইয়া রহিল। অরুণ কহিল, আচারের নাম নিয়ে এই চিরাগত সংস্কার তোমাদের মনটাকে হয়ত আর স্পর্শ পর্যন্ত করে না, কিন্তু যেখানে করে, সেখানে মানুষের হাত থেকে মানুষের এই লাঞ্ছনা মানুষকে যে বেদনায় কতদূর বিদ্ধ করতে পারে, এই কথাটা যে একদিন আমাকে এমন করে অনুভব করতে হবে এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি সন্ধ্যা।

সন্ধ্যা ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিল, কিন্তু এ লাঞ্ছনা কি তুমি নিজেই টেনে আনোনি অরুণদা?

অরুণ কহিল, কি জানি। কিন্তু, আচ্ছা সন্ধ্যা, প্রায়শ্চিত্ত করলে কি এর কোন উপায় হয় বলতে পার?

সন্ধ্যা বলিল, হতে পারে, কিন্তু একদিন আত্মমর্যাদা হারাবার ভয়ে তুমি রাজী হওনি—আবার আজ যদি নিজেই তাকে বিসর্জন দাও ত, আমি বলি অরুণদা, তুমি আর যাই কর, এখানে আর থেকো না।

অরুণ কহিল, কিন্তু তোমার ঘৃণা যে সেখানেও আমাকে টিকতে দেবে না!

কিন্তু তাতেই বা তোমার কতটুকু ক্ষতিবৃদ্ধি?

অরুণ কহিল, সন্ধ্যা! এ কথা তুমিও মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারলে?

সন্ধ্যা বলিল, তুমি যে আমার লজ্জার, আমার সঙ্কোচের আবরণটুকু রাখতে দিলে না অরুণদা। আভাসে ইঙ্গিতে তোমাকে কতবার জানিয়েচি সে কিছুতেই হয় না, তবুও তোমার ভিক্ষার জবরদস্তি যেন কোনমতেই শেষ হতে চায় না। বাবা রাজী হতে পারেন, মাও ভুলতে পারেন, কিন্তু আমি ভুলতে পারিনে আমি কতবড় বামুনের মেয়ে!

অরুণ বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া বলিল, আর আমি?

সন্ধ্যা বলিল, তুমিও আমার স্বজাতি—কিন্তু তবুও বাঘ আর বেড়াল ত এক নয় অরুণদা! কিন্তু কথাটা বলিয়া ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই সে নিজেই যেন মনে মনে শিহরিয়া উঠিল।

অরুণ আর কথা কহিল না, কেবল তাহার মুখের উপর হইতে নিজের বিস্মিত, ব্যথিত চোখ দুটি সরাইয়া লইল।

সন্ধ্যা জোর করিয়া একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, তুমি যেখানেই যাও না অরুণদা, আমাকে কিন্তু সহজে ভুলতে পারবে না। অনেককাল তোমার মনে থাকবে, বার বার এত অপমান তোমাকে কেউ করেনি।

অরুণ মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, তুমি যে-জন্যে এসেছিলে তা ত এখনো বলনি?

সন্ধ্যা প্রত্যুত্তরে শুধু একটু হাসিল। একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, পৃথিবীতে আশ্চর্যের আর অন্ত নেই। তারপরে কি একটা বলিতে গিয়া হঠাৎ থামিয়া গিয়া কহিল, অথচ আমার মান তুমি না রাখলে পৃথিবীতে আর কেউ রাখবার নেই। এ তোমার বিশ্বাস হয় অরুণদা?

অরুণ শুধু নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল।

সন্ধ্যা কহিল, এককড়ি দুলের বিধবা স্ত্রীকে আর তার মেয়েকে এককড়ির বাপ তাড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু আমার বাবা তাদের ডেকে এনেচেন। আমি দিয়েছি তাদের আশ্রয়।

কোথায়?

আমাদের পুরানো গোয়ালঘরে। কিন্তু বামুনপাড়ার মধ্যে তারা থাকতে পাবে না।

অরুণ বিস্ময়াপন্ন হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন?

সন্ধ্যা বলিল, কেন কি? তারা যে দুলে! তারা আমাদের পুকুরঘাট থেকে খাবার জল নেয়, তারা পথের ওপর ছাগলকে ফ্যান খাওয়ায়—গোলোকঠাকুর্দা না জেনে পাছে মাড়িয়ে ফেলেন—মা প্রতিজ্ঞা করেছেন কাল সকালে তাদের ঝাঁটা মেরে বিদায় করে তবে স্নান করবেন। তুমি তাদের স্থান দাও অরুণদা—তাদের কিছু নেই—তারা একেবারে নিরাশ্রয়।

অরুণ কহিল, বেশ, কিন্তু কোথায় স্থান দেব?

সন্ধ্যা বলিল, তা আমি জানিনে—যেখানে হোক। তুমি ছাড়া আর আমি কাকে গিয়ে বলব?

অরুণ একটু ভাবিয়া বলিল, আমার উড়ে মালীটা বাড়ি চলে গেছে—তার ঘরটাতে কি তারা থাকতে পারবে? না হয় একটু-আধটু সারিয়ে দেব।

সন্ধ্যা মুখ তুলিয়া কথা কহিতে পারিল না, কেবল অধোমুখে মাথা নাড়িয়া তাহার সম্মতি জানাইল।

অরুণ কহিল, তা হলে তাদের পাঠিয়ে দাও গে। মালীটা ফিরে এলে তার অন্য ব্যবস্থা করে দেব।

সন্ধ্যা ইহারও জবাব দিতে পারিল না। তেমনি নতনেত্রে থাকিয়া বোধ হয় আপনাকে সামলাইতে লাগিল। তারপর আস্তে আস্তে বলিল, এখন আমার মুখেও পান নেই, গা ধুতেও এসেছিলাম। এই সময়ে তোমাকে একটু প্রণাম করে পায়ের ধুলো নিয়ে যাই। এই বলিয়া সে গড় হইয়া নমস্কার করিয়া তাহার পায়ের ধূলা মাথায় দিয়া দ্রুতপদে অদৃশ্য হইয়া গেল।

অরুণ তাহাকে ফিরিয়া ডাকিবার, বা আর কিছু জিজ্ঞাসা করিবার চেষ্টা করিল না, কেবল সেইদিকে চাহিয়া সে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *