দত্তা – ০৫-০৬

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

সে চলিয়া গেলে, মিনিট-খানেক বিজয়া অন্যমনস্ক ও নীরব থাকিয়া সহসা চকিত হইয়া মুখ তুলিতেই, নিতান্ত অকারণেই তাহার কপোলের উপর একটা ক্ষীণ আরক্ত আভা দেখা দিল। বিলাসের দৃষ্টি অন্যত্র নিবদ্ধ না থাকিলে তাহার বিস্ময় ও অভিমানের হয়ত পরিসীমা থাকিত না। বিজয়া মৃদু হাসিয়া কহিল, আমাদের কথাটা যে শেষ হতেই পেলে না। তা হলে তালুকটা নেওয়াই আপনার বাবার মত?

বিলাস জানালার বাহিরে চাহিয়াছিল—সেইভাবেই কহিল, হুঁ।

বিজয়া জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু এর মধ্যে কোন রকম গোলমাল নেই ত?

বিলাস বলিল, না।

বিজয়া পুনরায় প্রশ্ন করিল, আজ কি তিনি ও-বেলায় এদিকে আসবেন?

বিলাস কহিল, বলতে পারিনে।

বিজয়া হাসিয়া কহিল, আপনি রাগ করলেন নাকি?

এবার বিলাস মুখ ফিরাইয়া গম্ভীরভাবে জবাব দিল, রাগ না করলেও পিতার অপমানে পুত্রের ক্ষুণ্ণ হওয়া বোধ করি অস্বাভাবিক নয়।

কথাটা বিজয়াকে আঘাত করিল, তবু সে হাসিমুখেই কহিল, কিন্তু এতে তাঁর মানহানি হয়েছে—এ ভুল ধারণা আপনার কি করে জন্মাল? তিনি স্নেহবশে মনে করেছেন, আমার কষ্ট হবে, কিন্তু কষ্ট হবে না এইটেই শুধু ভদ্রলোককে জানিয়ে দিলুম। এতে মান-অপমানের কথা ত কিছুই নেই বিলাসবাবু!

বিলাসের গাম্ভীর্যের মাত্রা তাহাতে বিন্দুমাত্র কমিল না; সে মাথা নাড়িয়া উত্তর দিল, ওটা কথাই নয়। বেশ, আপনার এস্টেটের দায়িত্ব নিজে নিতে চান, নিন, কিন্তু এর পরে বাবাকে আমায় সাবধান করে দিতেই হবে, নইলে পুত্রের কর্তব্যে ত্রুটি হবে।

এই অচিন্তনীয় রূঢ় প্রত্যুত্তরে বিজয়া বিস্ময়ে অবাক হইয়া রহিল; এবং কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে থাকিয়া অত্যন্ত ব্যথার সহিত কহিল, বিলাসবাবু, এই সামান্য বিষয়টাকে যে আপনি এমন করে নিয়ে এত গুরুতর করে তুলবেন, এ আমি মনেও করিনি। ভাল, আমার বোঝবার ভুলে যদি অন্যায়ই হয়ে থাকে, আমি অপরাধ স্বীকার করছি, ভবিষ্যতে আর হবে না। এই বলিয়া বিজয়া বিলাসের মুখের প্রতি চাহিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিল। সে ভাবিয়াছিল, ইহার পরে কাহারও কোন কথাই আর থাকিতে পারে না—দোষ-স্বীকারের সঙ্গে সঙ্গেই তাহার সমাপ্তি হইয়া যায়। কিন্তু এ সংবাদ তাহার জানা ছিল না যে, দুষ্ট ব্রণের মত এমন মানুষও আছে, যাহার বিষাক্ত ক্ষুধা একবার কাহারও ত্রুটির মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিলে আর কোন মতেই নিবৃত্ত হইতে চাহে না। তাই বিলাস যখন প্রত্যুত্তরে কহিল, তা হলে পূর্ণ গাঙ্গুলীকে জানিয়ে পাঠান যে রাসবিহারীবাবু যে হুকুম দিয়েছেন, তার অন্যথা করা আপনার সাধ্য নয়, তখন বিজয়ার দৃষ্টির সম্মুখে এই লোকটির হিংস্র প্রকৃতিটা একমুহূর্তেই একেবারে পরিস্ফুট হইয়া দেখা দিল।
সে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে কহিল, সেটা কি ঢের বেশী অন্যায় কাজ হবে না? আচ্ছা, আমি নিজেই নাহয় চিঠি লিখে তাঁর অনুমতি নিচ্চি।

বিলাস বলিল, এখন অনুমতি নেওয়া-না-নেওয়া দুই-ই সমান। আপনি যদি তাঁকে সমস্ত গ্রামের মধ্যে অশ্রদ্ধার পাত্র করে তুলতে চান, আমাকেও তা হলে অত্যন্ত অপ্রিয় কর্তব্য পালন করতে হবে।

বিজয়ার অন্তরটা অকস্মাৎ ক্রোধে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল; কিন্তু সে আত্মসংযম করিয়া ধীরভাবে প্রশ্ন করিল, এই কর্তব্যটা কি শুনি?

বিলাস বলিল, আপনার জমিদারি শাসনের মধ্যে তিনি যেন আর হাত না দেন।

আপনার নিষেধ তিনি শুনবেন, আপনি মনে করেন?

অন্ততঃ সেই চেষ্টাই আমাকে করতে হবে।

বিজয়া ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া অন্য দিকে চাহিয়া, তেমনি শান্তকণ্ঠেই জবাব দিল, বেশ, আপনি যা পারেন করবেন; কিন্তু অপরের ধর্ম-কর্মে আমি বাধা দিতে পারব না।

তাহার কণ্ঠস্বরের মৃদুতা সত্ত্বেও তাহার ভিতরের ক্রোধ গোপন রহিল না। বিলাস তীব্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, আপনার বাবা কিন্তু এ কথা বলতে সাহস করতেন না।

বিজয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া চোখ তুলিয়া তাহার মুখের প্রতি চাহিল; কহিল, আমার বাবার কথা আপনার চেয়ে আমি ঢের বেশী জানি বিলাসবাবু। কিন্তু সে নিয়ে তর্ক করে কি হবে? আমার স্নানের বেলা হল, আমি উঠলুম। বলিয়া সে সমস্ত বাগ্‌বিতণ্ডা জোর করিয়া বন্ধ করিয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইবামাত্রই ক্রোধোন্মত্ত বিলাসের মুখের উপর হইতে তাহার ধার-করা ভদ্রতার মুখোশ একমুহূর্তে খসিয়া পড়িল। সে নিজেও স্বভাবটাকে একেবারে অনাবৃত উলঙ্গ করিয়া দিয়া, নিরতিশয় কটুকণ্ঠে বলিয়া ফেলিল, মেয়েমানুষ জাতটাই এমনি নেমকহারাম।

বিজয়া পা বাড়াইয়াছিল, বিদ্যুদ্বেগে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া, পলকমাত্র এই বর্বরটার মুখের প্রতি তীক্ষ্ম দৃষ্টিপাত করিয়া, নিঃশব্দে ধীরে ধীরে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল; এবং সঙ্গে সঙ্গে বিলাস শুষ্ক হইয়া উঠিল।

সে যে পিতৃভক্তির আতিশয্যবশতঃই বিবাদ করিতেছিল, এ ভ্রম যেন কেহ না করেন। এ সকল লোকের স্বভাবই এই যে, ছিদ্র পাইলেই তাহাকে নিরর্থক বড় করিয়া দুর্বলকে পীড়া দিতে, ভীতুকে আরও ভয় দেখাইয়া ব্যাকুল করিয়া তুলিতেই আনন্দ অনুভব করে—তা সে যাই থাক এবং হেতু যত অসংলগ্নই হোক। কিন্তু বিজয়া যখন তিলার্ধ অবনত না হইয়া তাহাকেই তুচ্ছ করিয়া দিয়া ঘৃণাভরে চলিয়া গেল, তখন এই গায়ে-পড়া কলহের সমস্ত ক্ষুদ্রতা তাহাকে তাহার নিজের কাছেও অত্যন্ত ছোট করিয়া ফেলিল। সে খানিকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া, মুখখানা কালি করিয়া আস্তে আস্তে বাড়ি চলিয়া গেল।

অপরাহ্নকালে রাসবিহারী ছেলে সঙ্গে করিয়া দেখা করিতে আসিলেন। বলিলেন, কাজটা ভাল হয়নি মা। আমার হুকুমের বিরুদ্ধে হুকুম দেওয়ায় আমাকে ঢের বেশী অপ্রতিভ করা হয়েছে। তা যাক, বিষয় যখন তোমার, তখন এ কথা নিয়ে আর অধিক ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাইনে। কিন্তু বারংবার এ রকম ঘটলে আত্মসম্মান বজায় রাখবার জন্যে আমাকে তফাত হতেই হবে, তা জানিয়ে রাখছি।
বিজয়া কোন উত্তর দিল না; বরঞ্চ মৌনমুখে সে অপরাধটা একরকম স্বীকার করিয়াই লইল। রাসবিহারী তখন কোমল হইয়া বিষয়-সংক্রান্ত অন্যান্য কথাবার্তা তুলিলেন। নূতন তালুকটা খরিদ করিবার আলোচনা শেষ করিয়া বলিলেন, জগদীশের দরুন বাড়িটা যখন তুমি সমাজকেই দান করলে মা, তখন আর বিলম্ব না করে এই পূজার ছুটিটা শেষ হলেই তার দখল নিতে হবে—কি বল?

বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিল, আপনি যা ভাল বুঝবেন,তাই হবে। টাকা পরিশোধ করবার মেয়াদ ত তাঁদের শেষ হয়ে গেছে!

রাসবিহারী কহিলেন, অনেক দিন। জগদীশ তার সমস্ত খুচরা ঋণ ত্রকত্র করবার জন্যে তোমার বাবার কাছে আট বছরের কড়ারে দশ হাজার টাকা কর্জ নিয়ে কবালা লিখে দেয়। শর্ত ছিল, এর মধ্যে শোধ দিতে পারে ভালই; না পারে, তার বাড়ি-বাগান-পুকুর—তার সমস্ত সম্পত্তিই আমাদের। তা আট বৎসর পার হয়ে এটা নয় বৎসর চলছে।

বিজয়া কিছুক্ষণ অধোমুখে নীরবে বসিয়া থাকিয়া মৃদুকণ্ঠে কহিল, শুনতে পাই, তাঁর ছেলে এখানে আছেন; তাঁকে ডেকে আরো কিছুদিন সময় দিয়ে দেখলে হয় না, যদি কোন উপায় করতে পারেন?

রাসবিহারী মাথা নাড়িতে নাড়িতে কহিলেন, তা পারবে না—পারবে না। পারলে—

পিতার কথাটা শেষ না হইতেই বিলাস হঠাৎ গর্জন করিয়া উঠিল। এতক্ষণ সে কোনরূপে ধৈর্য ধরিয়া ছিল, আর পারিল না। কর্কশস্বরে বলিল, পারলেই বা আমরা দেব কেন? টাকা নেবার সময় সে মাতালটার হুঁশ ছিল না—কি শর্ত করছি? এ শোধ দেব কি কোরে?

বিজয়া বিলাসের প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করিয়াই রাসবিহারীর মুখের দিকে চাহিয়া শান্ত-দৃঢ়কণ্ঠে কহিল, তিনি আমার বাবার বন্ধু ছিলেন; তাঁর সম্বন্ধে সসম্মানে কথা কইতে বাবা আমাকে আদেশ করে গেছেন—

বিলাস পুনরায় তর্জন করিয়া উঠিল, হাজার করে গেলেও সে যে একটা—

রাসবিহারী বাধা দিলেন,—তুমি চুপ কর না বিলাস।

বিলাস জবাব দিল, এ সব বাজে সেন্টিমেন্ট আমি কিছুতেই সইতে পারিনে—তা’ সে কেউ রাগই করুক, আর যাই করুক। আমি সত্য কথা বলতে ভয় পাইনে, সত্য কাজ করতে পেছিয়ে দাঁড়াই নে!

রাসবিহারী উভয় পক্ষকেই শান্ত করিবার অভিপ্রায়ে হাসিবার মত মুখ করিয়া বার বার মাথা নাড়িতে নাড়িতে বলিতে লাগিলেন, তা বটে, তা বটে। আমাদের বংশের এই স্বভাবটা আমারও গেল না কিনা! বুঝলে না মা বিজয়া, আমি আর তোমার বাবা এই জন্যেই সমস্ত দেশের বিরুদ্ধে সত্য-ধর্ম গ্রহণ করতে ভয় পাইনি।

বিজয়া কহিল, বাবা মৃত্যুর পূর্বে আমাকে আদেশ করে গিয়েছিলেন, ঋণের দায়ে তাঁর বাল্যবন্ধুর প্রতি যেন অত্যাচার না করি | বলিতে বলিতেই তাহার চোখ ছলছল করিয়া উঠিল। স্নেহময় পিতার অনুরোধ যে তাঁহার জীবিতকালে অসঙ্গত খেয়াল বলিয়াই বোধ হইয়াছিল, তাঁহার মৃত্যুর পরে আজ তাহাই দুরতিক্রম্য আদেশের মত তাহাকে বাধা দিতেছিল |
বিলাস কহিল, তবে তিনিই কেন সমস্ত দেনাটা নিজে ছেড়ে দিয়ে গেলেন না শুনি?

বিজয়া তাহার কোন উত্তর না দিয়া, রাসবিহারীর মুখের প্রতি চাহিয়া পুনরায় কহিল, জগদীশবাবুর ছেলেকে ডেকে পাঠিয়ে সমস্ত কথা জানানো হয়, এই আমার ইচ্ছে।

তিনি জবাব দিবার পূর্বেই বিলাস নির্লজ্জের মত আবার গর্জন করিল, সে যদি আরো দশ বৎসর সময় চায়? তাই দিতে হবে নাকি? তা হলে দেশে সমাজ-প্রতিষ্ঠার আশা সাগরের অতল-গর্ভে বিসর্জন দিতে হবে দেখছি!

বিজয়া ইহার উত্তর না দিয়া রাসবিহারীকেই লক্ষ্য করিয়া কহিল, আপনি একবার তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে এ বিষয়ে তাঁর কি ইচ্ছা, জানতে পারবেন না কি ?

রাসবিহারী অতিশয় ধূর্ত লোক; তিনি ছেলের ঔদ্ধত্যের জন্য মনে মনে বিরক্ত হইলেও, বাহিরে তাহারই মতটাকে সমীচীন প্রমাণ করিতে একটুখানি ভূমিকাচ্ছলে ধীরভাবে কহিলেন, দেখ মা, তোমাদের মতান্তরের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির কথা কওয়া উচিত নয় | কারণ, কিসে তোমাদের ভালো সে আজ নাহয় কাল তোমরাই স্থির করে নিতে পারবে, এ বুড়োর মতামতের আবশ্যক হবে না; কিন্তু কথা যদি বলতে হয় মা, বলতেই হবে—এ ক্ষেত্রে তোমারই ভুল হচ্ছে। জমিদারি চালাবার কাজে আমাকেও বিলাসের কাছে হার মানতে হয়—সে আমি অনেকবার দেখেছি। আচ্ছা, তুমিই বল দেখি, কার গরজ বেশি, তোমার না জগদীশের ছেলের? তার ঋণ পরিশোধের সাধ্যই যদি থাকতো, সে কি নিজে এসে একবার চেষ্টা করে দেখত না? সে ত জানে, তুমি এসেছ। এখন আমরাই যদি উপযাচক হয়ে তাকে ডাকিয়ে পাঠাই, সে নিশ্চয়ই একটা বড় রকমের সময় নেবে, কিন্তু তাতে ফল শুধু এই হবে যে, সে টাকাও দিতে পারবে না, তোমাদের সমাজ প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্পও চিরদিনের জন্যে ডুবে যাবে। বেশ করে ভেবে দেখ দেখি মা, এই কি ঠিক নয়?

বিজয়া নীরবে বসিয়া রহিল। তাহার মনের ভাব অনুমান করিয়া বৃদ্ধ রাসবিহারী ক্ষণকাল পরে কহিলেন, বেশ ত, তার অগোচরে ত কিছুই হতে পারবে না। তখন নিজে যদি সে সময় চায় তখন নাহয় বিবেচনা করেই দেখা যাবে। কি বল মা?

বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, আচ্ছা। কিন্তু তাহার মুখের চেহারা দেখিয়া স্পষ্ট বুঝা গেল, সে মনে মনে এই প্রস্তাব অনুমোদন করে নাই। রাসবিহারী আজ বিজয়াকে চিনিলেন। তিনি নিশ্চয়ই বুঝিলেন, এ মেয়েটির বয়স কম কিন্তু সে যে তাহার পিতার বিষয়ের মালিক, ইহা সে জানে, এবং তাহাকে মুঠার ভিতরে আনিতেও সময় লাগিবে। সুতরাং একটা কথা লইয়াই বেশী টানা-হেঁচড়া সঙ্গত নয় বিবেচনা করিয়া সান্ধ্য-উপাসনার নাম করিয়া গাত্রোত্থান করিলেন। বিজয়া প্রণাম করিয়া নিঃশব্দে আসন ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। তিনি আশীর্বাদ করিয়া বাহির হইয়া গেলেন। বিজয়া মুহূর্তকালমাত্র চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া কহিল, আমার অনেকগুলো চিঠিপত্র লিখতে আছে—আপনার কি আমাকে কোন আবশ্যক আছে?

বিলাস রূঢ়ভাবে জবাব দিল, কিছু না। আপনি যেতে পারেন।

আপনাকে চা পাঠিয়ে দিতে বোলব কি?

না, দরকার নেই।

আচ্ছা নমস্কার, বলিয়া বিজয়া দুই করতল একবার একত্র করিয়াই ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

দিঘ্‌ড়ায় স্বর্গীয় জগদীশবাবুর বাড়িটা সরস্বতীর পরপারে। ইহা গ্রামান্তরে হইলেও নদীতীরের কতকগুলি বাঁশঝাড়ের জন্যেই বনমালীবাবুর বাটীর ছাদ হইতে তাহা দেখা যাইত না। তখন শরৎকালের অবসানে সরস্বতীর জলধারা শীর্ণতর হইয়া আসিতেছিল, এবং তীরের উপর দিয়া কৃষকদিগের গমনাগমনের পথটিও পায়ে পায়ে শুকাইয়া কঠিন হইয়া উঠিতেছিল। এই পথের উপর দিয়া আজ অপরাহ্নবেলায় বিজয়া বৃদ্ধ দরোয়ান কানহাইয়া সিংকে সঙ্গে করিয়া বেড়াইতে বাহির হইয়াছিল। ও-পারের বাবলা, বাঁশ, খেজুর প্রভৃতি গাছপালার ফাঁক দিয়া অস্তগমনোন্মুখ সূর্যের আরক্ত-আভা মাঝে মাঝে তাহার মুখের উপর আসিয়া পড়িতেছে—অন্যমনস্ক-দৃষ্টিতে উভয় তীরের এটা-ওটা-সেটা দেখিতে দেখিতে বরাবর উত্তরমুখে চলিতে চলিতে হঠাৎ একস্থানে আসিয়া তাহার চোখে পড়িল—নদীর মধ্যে গোটা-কয়েক বাঁশ একত্র করিয়া পারাপারের জন্য একটা সেতু প্রস্তুত করা হইয়াছে। এইটি ভাল করিয়া দেখিবার জন্য বিজয়া জলের ধারে আসিয়া দাঁড়াইতে দেখিতে পাইল, অনতিদূরে বসিয়া একজন অত্যন্ত নিবিষ্টচিত্তে মাছ ধরিতেছে। সাড়া পাইয়া লোকটি মুখ তুলিয়া নমস্কার করিল। ঠিক সেই সময়ে বিজয়ার মুখের উপর সূর্যরশ্মি আসিয়া পড়িল কি না জানি না; কিন্তু চোখাচোখি হইবামাত্রই তাহার গৌরবর্ণ মুখখানি একেবারে যেন রাঙা হইয়া গেল। যে মাছ ধরিতেছিল, সে পূর্ণবাবুর সেই ভাগিনেয়টি, যে সেদিন মামার হইয়া তাহার কাছে দরবার করিতে আসিয়াছিল। বিজয়া প্রতি-নমস্কার করিতেই সে কাছে আসিয়া হাসিমুখে কহিল, বিকেলবেলায় একটুখানি বেড়াবার পক্ষে নদীর ধারটা মন্দ জায়গা নয় বটে, কিন্তু এই সময়টা ম্যালেরিয়ার ভয়ও কম নেই। এ বুঝি আপনাকে কেউ সাবধানে করে দেয়নি?

বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না; এবং পরক্ষণেই আত্মসংবরণ করিয়া লইয়া মৃদু হাসিয়া বলিল, কিন্তু ম্যালেরিয়া ত লোক চিনে ধরে না! আমি ত বরং না জেনে এসেচি, আপনি যে জেনে-শুনে জলের ধারে বসে আছেন? কৈ দেখি, কি মাছ ধরলেন?

লোকটি হাসিয়া কহিল, পুঁটি মাছ। কিন্তু দু’ ঘণ্টায় মাত্র দুটি পেয়েছি। মজুরি পোষায় নি। কিন্তু কি করি বলুন, আপনার মত আমিও প্রায় বিদেশী বললেই হয়। বাইরে বাইরে দিন কেটেছে, প্রায় কারুর সঙ্গেই তেমন আলাপ-পরিচয় নেই—কিন্তু বিকেলটা ত যা করে হোক কাটাতে হবে?

বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া সহাস্যে কহিল, আমারও প্রায় সেই দশা। আপনাদের বাড়ি বুঝি পূর্ণবাবুর বাড়ির কাছেই?

লোকটি কহিল, না। হাত দিয়া নদীর ওপার দেখাইয়া বলিল, আমাদের বাড়ি ঐ দিঘ্‌ড়ায়। এই বাঁশের পুল দিয়ে যেতে হয়।

গ্রামের নাম শুনিয়া বিজয়া জিজ্ঞাসা করিল, তা হলে বোধ হয় জগদীশবাবুর ছেলে নরেনবাবুকে আপনি চেনেন?
লোকটি মাথা নাড়িবামাত্রই বিজয়া একান্ত কৌতূহলবশে সহসা প্রশ্ন করিয়া ফেলিল, তিনি কি রকম লোক, আপনি বলতে পারেন?

কিন্তু, বলিয়া ফেলিয়াই নিজের অভদ্র প্রশ্নে অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া উঠিল। এই লজ্জা লোকটির দৃষ্টি এড়াইল না। সে হাসিয়া বলিল, তার বাড়ি ত আপনি দেনার দায়ে কিনে নিয়েছেন; এখন তার সম্বন্ধে অনুসন্ধান করে আর ফল কি? কিন্তু যে সদুদ্দেশ্যে নিলেন সে -কথাও এ অঞ্চলের সবাই শুনেছে।

বিজয়া জিজ্ঞাসা করিল, একেবারে নেওয়া হয়ে গেছে—এই বুঝি এদিকে রাষ্ট্র হয়ে গেছে?

লোকটি বলিল, হবারই কথা। জগদীশবাবুর সর্বস্ব আপনার বাবার কাছে বিক্রিকবালায় বাঁধা ছিল। তাঁর ছেলের সাধ্য নেই, তত টাকা শোধ করেন—মিয়াদও শেষ হয়েছে—খবর সবাই জানে কিনা!

বাড়িটি কেমন?

মন্দ নয়, বেশ বড় বাড়ি। যে জন্যে নিচ্ছেন, তার পক্ষে ভালই হবে। চলুন না, আর একটু এগিয়ে গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে।

চলিতে চলিতে বিজয়া কহিল, আপনি যখন গ্রামের লোক, তখন নিশ্চয় সমস্ত জানেন। আচ্ছা, শুনেছি নরেনবাবু বিলেত থেকে ভাল করেই ডাক্তারি পাশ করে এসেছেন। কোন ভাল জায়গায় প্র্যাক্‌টিস আরম্ভ কোরে আরও কিছুদিন সময় নিয়েও কি বাপের ঋণটা শোধ করতে পারেন না?

লোকটি ঘাড় নাড়িয়া কহিল, সম্ভব নয়। শুনেছি, চীকিৎসা করাই নাকি তার সঙ্কল্প নয়।

বিজয়া বিস্মিত হইয়া কহিল, তবে তাঁর সঙ্কল্পটাই বা কি শুনি? এত খরচ-পত্র করে বিলেতে গিয়ে কষ্ট করে ডাক্তারি শেখবার ফলটাই বা কি হতে পারে। লোকটি বোধ হয় একেবারেই অপদার্থ।

ভদ্রলোক একটুখানি হাসিয়া বলিল, অসম্ভব নয়। তবে শুনেছি নাকি নরেনবাবু নিজে চিকিৎসা করে রোগ সারানোর চেয়ে, এমন কিছু একটা নাকি বার করে যেতে চান, যাতে ঢের ঢের বেশী লোকের উপকার হবে। শুনতে পাই, নানাপ্রকার যন্ত্রপাতি নিয়ে দিনরাত পরিশ্রমও খুব করেন।

বিজয়া চকিত হইয়া কহিল, সে ত ঢের বড় কথা। কিন্তু তাঁর বাড়ি-ঘরদোর গেলে কি করে এসব করবেন? তখন ত রোজগার করা চাই! আচ্ছা, আপনি ত নিশ্চয় বলতে পারবেন, বিলেত যাওয়ার জন্যে এখানকার লোকে তাঁকে ‘একঘরে’ করে রেখেছে কি না।

ভদ্রলোক কহিল, সে ত নিশ্চয়। আমার মামা পূর্ণবাবু তারও ত একপ্রকার আত্মীয়, তবুও পূজোর ক’দিন বাড়িতে ডাকতে সাহস করেন নি—কিন্তু তাতে তাঁর কিছুই আসে-যায় না। নিজের কাজকর্ম নিয়ে আছেন, সময় পেলে ছবি আঁকেন—বাড়ি থেকে বারই হন না। ঐ তাঁর বাড়ি, বলিয়া আঙুল দিয়া গাছপালায় ঘেরা একটা বৃহৎ অট্টালিকা দেখাইয়া দিল।
এই সময় বুড়া দরোয়ান পিছন হইতে ভাঙা-বাঙলায় জানাইল যে, অনেকদূর আসিয়া পড়া হইয়াছে, বাটী ফিরিতে সন্ধ্যা হইয়া যাইবে।

লোকটি ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, হাঁ, কথায় কথায় অনেক পথ এসে পড়েছেন।

তাহাকেও সেই বাঁশের সেতু দিয়াই গ্রামে ঢুকিতে হইবে, সুতরাং ফিরিবার মুখেও সঙ্গে সঙ্গে আসিতে লাগিল। বিজয়া মনে মনে ক্ষণকাল কি যেন চিন্তা করিয়া কহিল, তা হলে তাঁর কোন আত্মীয়-কুটুম্বের ঘরেও আশ্রয় পাবার ভরসা নেই বলুন?

লোকটি কহিল, একেবারেই না।

বিজয়া আবার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া চলিয়া কহিল, তিনি যে কারও কাছে যেতে চান না, সে কথা ঠিক। নইলে এই মাসের শেষেই ত তাঁকে বাড়ি ছেড়ে দেবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে—আর কেউ হলে অন্ততঃ আমাদের সঙ্গেও একবার দেখা করার চেষ্টা করতেন।

লোকটি কহিল, হয়ত তাঁর দরকার নেই—নয় ভাবেন, লাভ কি। আপনি ত আর সত্যিই তাঁকে বাড়িতে থাকতে দিতে পারবেন না!

বিজয়া কহিল, না পারলেও, আর কিছুকাল থাকতে দিতেও ত পারা যায়! দেনার দায়ে হাজার হলেও ত একজনকে তার বাড়ি-ছাড়া করতে সকলেরই কষ্ট হয়! কিন্তু আপনার কথাবার্তার ভাবে বোধ হয়, যেন তাঁর সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে। কি বলেন, সত্যি নয়?

লোকটি শুধু হাসিল, কোন কথা কহিল না। পুলটির কাছেই তাহারা আসিয়া পড়িয়াছিল। সে ছোট ছিপটা কুড়াইয়া লইয়া কহিল, এই আমাদের গ্রামে ঢোকবার পথ। নমস্কার। বলিয়া হাত তুলিয়া নমস্কার করিয়া সেই বংশ-নির্মিত পুলটির উপর দিয়া টলিতে টলিতে কোনমতে পার হইয়া সঙ্কীর্ণ বন্যপথের ভিতরে অদৃশ্য হইয়া গেল।

বহুদিনের বৃদ্ধ ভৃত্য কানাই সিং বিজয়াকে শিশুকালে কোলে-পিঠে করিয়া মানুষ করিয়াছিল, এবং সেই সঙ্গে সে দরোয়ানীর ন্যায্য অধিকারকেও বহুদূরে অতিক্রম করিয়া গিয়াছিল। সে কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, এ বাবুটি কে মাইজী?

বিজয়া কিন্তু এতটাই বিমনা হইয়া পড়িয়াছিল যে, বুড়ার প্রশ্ন তাহার কানেই পৌঁছিল না। সেই প্রায়ান্ধকার নদীতটের সমস্ত নীরব মাধুর্যকে সে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া স্বপ্নাবিষ্টের মত শুধু এই কথা ভাবিতে ভাবিতেই পথ চলিতে লাগিল—লোকটি কে, এবং আবার কবে দেখা হইবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *