চরিত্রহীন – ১৫-১৬

পনর

সতীশ স্থির করিল, সে ডাক্তারী পড়া ছাড়িবে না। তাই পরদিন সন্ধ্যার সময় কাহাকেও কিছু না বলিয়া বেহারীকে সঙ্গে করিয়া তাহার সাবেক বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইল। বাড়িটা তখনও খালি পড়িয়া ছিল, বাড়িওয়ালাকে ধরিয়া ছয় মাসের বন্দোবস্ত করিল এবং নিকটবর্তী হিন্দু-আশ্রমে গিয়া সন্ধান করিয়া এক পাচক নিযুক্ত করিয়া খুশী হইয়া বাহির হইয়া পড়িল। বেহারীকে কহিল, আমরা কালই চলে আসব—কি বলিস বেহারী?

বেহারী সম্মতি জানাইল।

পথে চলিতে চলিতে সতীশ বলিল, কাজটা ভাল হয় না বেহারী। যাই হোক সে আমার ঢের করেছে; তা ছাড়া একরকম ধরতে গেলে আমার জন্যেই তার ও-বাসার কাজটা গেল, একবার খবর দেওয়া উচিত।

বেহারী বুঝিল, কাহার কথা হইতেছে—চুপ করিয়া রহিল।

সতীশ বলিতে লাগিল, যে কেউ হোক না কেন, পথের ভিখিরী হলেও দুঃখে পড়লে দেখা চাই—না হলে মানুষ-জন্মই বৃথা।

কিন্তু আমি তাদের বাড়িতে ঢুকব না—গলির মধ্যেও না—মোড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকব; তুই একটিবার গিয়ে জেনে আসবি, কষ্টে পড়েছে কিনা। কষ্টে ত নিশ্চয় পড়েছে—সে আমি বেশ দেখতে পাচ্চি, তাই কোন রকমে কিছু দিয়ে আসা। বেহারী নিঃশব্দে পিছনে চলিতে লাগিল। সতীশ বলিল, কিন্তু আমাকে সে সব কথা বলবে না, অথচ তোর কাছে কিছুই লুকোবে না। বুঝলি না বেহারী!

বেহারী তথাপি কথা কহিল না।

সাবিত্রীদের গলির মোড়ে আসিয়া সতীশ দাঁড়াইল। বলিল, বেশী দেরী করিস নে যেন।

বেহারী গলির মধ্যে প্রবেশ করিল, সতীশ কাছাকাছি পায়চারি করিয়া বেড়াইতে লাগিল—দূরে যাইতে সাহস করিল না, পাছে নির্বোধ বেহারী তাহাকে দেখিতে না পাইয়া আর কোথাও যায়।

মিনিট-দশেক পরেই বেহারী ফিরিয়া আসিয়া বলিল, নেই!

সতীশ উৎসুক হইয়া প্রশ্ন করিল, কখন ফিরে আসবে?

বেহারী কহিল, সে আর আসবে না। দু’মাস হতে চললো একদিনও আসে না!

সতীশ গ্যাস পোস্টে হেলান দিয়া দাঁড়াইয়া ভীষণ-কণ্ঠে বলিল, মিথ্যা কথা। তোকে ঠকিয়েছে।

বেহারীও দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল, কেউ ঠকায়নি। সত্যিই সে আর আসে না। সত্যিই সে বাড়ি চলে গেছে।

তার ঘরের জিনিস?

পড়ে আছে। সে আর এমন কি জিনিস বাবু, যে তার জন্যে মায়া হবে!
সতীশ রাগিয়া বলিল, এমনই বা সে কি বড়লোক যে হবে না? তুই নিতান্ত বোকা, তুই বুঝে চলে এলি সে আর আসে না! একি হতে পারে বেহারী, একটা লোক নিরুদ্দেশ হয়ে গেল, আর কেউ তার খবর নিলে না? আমি পুলিশে জানাব।

বেহারী মৌন-নতমুখে দাঁড়াইয়া রহিল।
সতীশ বলিল, মোক্ষদা কি বলে, সে জানে না? আমি বিশ্বাস করি না। সে নিশ্চয়ই জানে। আমি যাচ্চি তার কাছে।

বেহারী ব্যস্ত হইয়া উঠিল, আপনি যাবেন না, বাবু!

কেন যাব না? কেন তারা লুকোচ্চে? আমি কাউকে খেয়ে ফেলতে এসেছি, যে আমার কাছে লুকোচুরি! আমি বলছি তোকে, যেমন করে পারি আমি জানব সে কোথায় আছে।

বেহারী ভীত হইয়া কহিল, তার মাসীর দোষ নেই বাবু। সাবিত্রী নিজের ইচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে গেছে। ঝগড়া করে গেছে—কাউকে জানিয়ে যায়নি।

সতীশ ধমকাইয়া উঠিল—তবু বলবি জানিয়ে যায়নি! জানিয়ে গেছে—নিশ্চয়ই গেছে।

বেহারী মাথা নাড়িয়া বলিল, না। কিন্তু সে শহরেই আছে।

কোন্‌ ঠিকানায় আছে? গাধার মত হাঁ করে থাকিস নে বেহারী! কি হয়েছে বল।

বেহারী ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া কি ভাবিয়া লইয়া বলিল, আপনি দুঃখ পাবেন তাই—না হলে সব কথা সবাই জানে—
আমিও জানি।

সতীশ অধীর হইয়া উঠিল—কি জানিস তাই বল্‌ না?

বেহারী আবার চুপ করিয়া রহিল।

সতীশ প্রায় চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, তোর পায়ে পড়ি হারামজাদা, শিগগির বল।

বেহারী তৎক্ষণাৎ ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিয়া জুতার ধূলা মাথায় লইয়া কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিল।

বাবু আমাকে নরকে ডুবালেন। একটু আড়ালে চলুন, বলচি, বলিয়া অন্ধকার গলিটার ভিতরে ঢুকিয়া একপাশে দাঁড়াইল।

সতীশ সামনে দাঁড়াইয়া বলিল, কি?

বেহারী ঢোক গিলিয়া বলিল, সাবিত্রীর মাসী মনে করেছে সে আপনার কাছে আছে। কিন্তু আমি জানি, তা নয়।
সতীশ অস্থির হইয়া বলিল, তুই খুব পণ্ডিত। সে আমিও জানি—তার পরে কি বল্‌।

সবুর করুন বাবু, বলচি, বলিয়া বেহারী আর একবার বেশ করিয়া ঢোক গিলিয়া বলিল, আমার খুব আশা হচ্চে—

কি আশা হচ্চে?

বেহারী মরিয়া হইয়া বলিয়া ফেলিল, সে ঐখানেই গেছে; ঐ বিপিনবাবুর কাছেই—

কোন্‌ বাবু? আমাদের বিপিন?

হাঁ বাবু তিনিই—হাঁ হাঁ—ওখানেই বসবেন না, চান করতে হবে! রাজ্যের লোক যে ওখানে—

সতীশ সে কথা কানেও তুলিল না। ওধারের দেওয়ালে পিঠ দিয়া সোজা হইয়া বসিয়া শুষ্ক ভাঙ্গা-গলায় জিজ্ঞাসা করিল, তবে তার মাসী কেন মনে করলে সে আমার কাছে আছে?

বেহারী কহিল, সাবিত্রী যেদিন বিপিনবাবুকে অপমান করে বিদেয় করে দেয়, সেদিন স্পষ্ট করে বলে, সে সতীশবাবু ছাড়া আর কারো কাছে যাবে না—বাড়ির লোক আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের ঝগড়া শুনেছিল।

সতীশ উঠিয়া দাঁড়াইল। জোর করিয়া নিজেকে কতকটা প্রকৃতিস্থ করিয়া প্রশ্ন করিল, তবে তুই কেমন করে জানলি, সে বিপিনবাবুর কাছেই গেছে?
বেহারী মৌন হইয়া রহিল।

সতীশ বলিল, বল্‌।
বেহারী আর একবার ইতস্ততঃ করিল, সাবিত্রীর কাছে সেই যে বলিবে না বলিয়া অহঙ্কার করিয়া আসিয়াছিল, তাহা মনে করিল। শেষে আর একবার ঢোঁক গিলিয়া কহিল, আমি নিজের চোখে দেখে গেছি।

সতীশ চুপ করিয়া শুনিতে লাগিল।

বেহারী বলিল, আমরা যেদিন বাসা বদল করি, তার পরদিন দুপুরবেলায় আমি আসি। তখন বিপিনবাবু সাবিত্রীর বিছানায় ঘুমুচ্ছিলেন।

সতীশ ভয়ানক ধমক দিয়া উঠিল, মিথ্যে কথা!

বেহারী চমকাইয়া উঠিয়া বলিল, না বাবু, সত্যি কথাই বলচি।

সতীশ তাহার মুখের দিকে তীব্র দৃষ্টি করিয়া মুহূর্তকাল চুপ করিয়া থাকিয়া প্রশ্ন করিল, সাবিত্রী নিজে কোথায় ছিল?

সাবিত্রী সেই ঘরেই ছিল। বাইরে এসে আমাকে মাদুর পেতে বসালে। জিজ্ঞাসা করতে লাগল, বাবুরা রাগ করেছেন কিনা, আমরা বাসা বদলালুম কেন এই-সব।

তার পরে?

আমি রেগে চলে এলুম। সেইদিন থেকেই সে বাবুর সঙ্গে চলে গেছে।

এতদিন বলিস নি কেন?

বেহারী চুপ করিয়া রহিল।

সতীশ জিজ্ঞাসা করিল, তুই নিজের চোখে দেখেছিস না শুনেছিস?

না বাবু, আমার স্বচক্ষে দেখা! একেবারে নিরীক্ষণ করে দেখা!

আমার পা ছুঁয়ে দিব্যি কর্‌—তোর চোখে দেখা! বামুনের পায়ে হাত দিচ্ছিস, মনে থাকে যেন!

বেহারী তৎক্ষণাৎ নত হইয়া সতীশের পায়ে হাত দিয়া বলিল, সে কথা আমার দিবা রাত্রই মনে থাকে বাবু! আমার স্বচক্ষে দেখা।

সতীশ আবার একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, আচ্ছা বাসায় যা। উপেনদাকে বলিস, আজ রাত্রে আমি ভবানীপুরে যাব, ফিরব না।

বেহারী বিশ্বাস করিল না, কাঁদিয়া ফেলিল।

সতীশ বিস্মিত হইয়া বলিল, ও কি রে, কাঁদিস কেন?

বেহারী চোখ মুছিতে মুছিতে বলিল, বাবু, আমি আপনার ছেলের মত, আমাকে লুকোবেন না। আমিও সঙ্গে যাব।
সতীশ জিজ্ঞাসা করিল, কেন?

বেহারী বলিল, বুড়ো হয়েছি সত্যি, কিন্তু জাতে গোয়ালা। একগাছা হাতে পেলে এখনো পাঁচ-ছ’জনের মোয়াড়া রাখতে পারি। আমরা দাঙ্গা করতেও জানি, দরকার হলে মরতেও জানি।

সতীশ শান্তভাবে বলিল, আমি কি দাঙ্গা করতে যাচ্চি? আহাম্মক কোথাকার! বলিয়াই চলিয়া গেল।

বেহারী এবার বোধ হয় বুঝিল কথাটা মিথ্যা নয়। তখন চোখটা মুছিয়া ফেলিয়া সেও প্রস্থান করিল।

সতীশ ময়দানের দিকে দ্রুতপদে চলিয়াছিল। কোথায় যাইবে, স্থির করে নাই—কিন্তু কোথাও তাহাকে যেন শীঘ্র যাইতেই হইবে। তাহার প্রধান কারণ সে নিঃসংশয়ে অনুভব করিতেছিল, একমুহূর্তেই তাহার মুখের চেহারায় এমন একটা বিশ্রী পরিবর্তন ঘটিয়াছে যাহা লইয়া কাহারও সম্মুখে দাঁড়ানো চলে না।
ময়দানের একটা নিভৃত অংশে গাছতলায় বেঞ্চ পাতা ছিল। সতীশ তাহার উপরে গিয়া বসিল এবং নির্জন দেখিয়া স্বস্তি বোধ করিল। অন্ধকার বৃক্ষতলে বসিয়া প্রথমেই তাহার মুখ দিয়া বাহির হইল, কি করা যায়! প্রশ্নটা কিছুক্ষণ ধরিয়া তাহার দুই কানের মধ্যে অর্থহীন প্রলাপের মত ঘুরিতে লাগিল। শেষে উত্তর পাইল, কিছুই করা যায় না।

প্রশ্ন করিল, সাবিত্রী এমন কাজ করিল কেন?

উত্তর পাইল, এমন কিছুই করে নাই, যাহাতে নূতন করিয়া তাহাকে দোষ দেওয়া যায়।

প্রশ্ন করিল, এতবড় অবিশ্বাসের কাজ করিল কি জন্য?

উত্তর পাইল, কোন্‌ বিশ্বাস তোমাকে সে দিয়াছিল, তাই আগে বল?

সতীশ কিছুই বলিতে পারিল না। বস্তুতঃ সে ত কোন মিথ্যা আশাই দেয় নাই। একদিনের জন্যও ছলনা করে নাই। বরং, পুনঃ পুনঃ সতর্ক করিয়াছে, শুভ কামনা করিয়াছে, ভগিনীর অধিক স্নেহ-যত্ন করিয়াছে। সেই রাত্রির কথা সে স্মরণ করিল। সেদিন নিষ্ঠুর হইয়া তাহাকে ঘর হইতে বাহির করিয়া দিয়া রক্ষা করিয়াছিল। কে এমন করিতে পারিত! কে নিজের বুকে শেল পাতিয়া লইয়া তাহাকে অক্ষত রাখিত? সতীশের চোখের পাতা ভিজিয়া উঠিল, কিন্তু, এ সংশয় তাহার কিছুতেই ঘুচিতে চাহিল না, যে, এই প্রশ্নোত্তরমালায় কোথায় যেন একটা ভুল থাকিয়া যাইতেছে।

সে আবার প্রশ্ন করিল, কিন্তু, তাকে যে ভালবাসিয়াছি।

উত্তর পাইল, কেন বাসিলে? কেন জানিয়া বুঝিয়া পঙ্কের মধ্যে নামিলে?

প্রশ্ন করিল, তা জানিনে। পদ্ম তুলিতে গেলেও ত পাঁক লাগে।
.
উত্তর পাইল, ওটা পুরাতন উপমা—কাজে লাগে না। মানুষ ঘরে আসিবার সময় পাঁক ধুইয়া পদ্ম লইয়া আসে।
তোমার পদ্মই বা কি, আর এ পাঁক কোথায় ধুইয়াই বা ঘরে আসিতে?

প্রশ্ন করিল, না হয়, নাই ঘরে আসিতাম।

উত্তর পাইল, ছিঃ! ও-কথা মুখেও আনিও না।

তাহার পরে কিছুক্ষণ পর্যন্ত সে স্তব্ধ হইয়া নক্ষত্র-খচিত কালো আকাশের পানে চাহিয়া হঠাৎ বলিয়া উঠিল, আমি ত তার আশা ছাড়িয়াই ছিলাম। তাহাকে পাইতেও চাহি না, কিন্তু আমাকে সে এমন করিয়া অপমান করিল কেন? একবার জিজ্ঞাসা করিল না কেন? কি দুঃখে সে এ কাজ করিতে গেল? টাকার লোভে করিয়াছে, এ কথা যে কোনমতেই ভাবিতে পারি না? বিপিনের মত অনাচারী মদ্যপকে সে মনে মনে ভালবাসিয়াছিল, এ কথা বিশ্বাস করিব কি করিয়া? তবে কেন?
গঙ্গার শীতল বাতাসে তাহার শীত করিতে লাগিল। সে র্যা পারটা আগাগোড়া মুড়িয়া দিয়া চোখ বুজিয়া বেঞ্চের উপর শুইয়া পড়িতেই সাবিত্রীর মুখ উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়া উঠিল। পতিতার কোন কালিমাই ত সে মুখে নাই! গর্বে দীপ্ত, বুদ্ধিতে স্থির, স্নেহে স্নিগ্ধ, পরিণত যৌবনের ভারে গভীর অথচ রসে, লীলায় চঞ্চল—সেই মুখ, সেই হাসি, সেই দৃষ্টি, সেই সংযত পরিহাস, সর্বোপরি তাহার সেই অকৃত্রিম সেবা! এমন সে তাহার এতখানি বয়সে কোথায় কবে পাইয়াছিল! ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নির মত তাহার আবরণটা লইয়া খেলা করিতে গিয়া যে আগুন বাহির হইয়া পড়িয়াছে, ইহার দাহ হইতে কেমন করিয়া কোন্‌ পথে পলাইয়া আজ সে নিষ্কৃতি লাভ করিবে! নিষ্কৃতি লাভ করিয়াই বা কি হইবে! তাহার দুই চোখ দিয়া অশ্রু ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। এ অশ্রু সে দমন করিতে চাহিল না—এ অশ্রু সে মুছিয়া ফেলিতে ইচ্ছা করিল না। অশ্রু যে এত মধুর, অশ্রুতে যে এত রস আছে, আজ সে তাহার পরম দুঃখের মধ্যে এই প্রথম উপলব্ধি করিয়া সুখী হইল এবং যাহাকে উপলক্ষ, করিয়া এতবড় সুখের আস্বাদ সে জীবনে এই প্রথম গ্রহণ করিতে পাইল, তাহারি উদ্দেশে দুই হাত যুক্ত করিয়া নমস্কার করিল।

সতীশ আর যাই হোক,—ভগবান আছেন, তাঁকে ফাঁকি দেওয়া যায় না, ছোটবড় সকলেই একদিন তাঁর কাছে জবাবদিহি করিতে হয়, এ কথাগুলা অসংশয়ে বিশ্বাস করিত। চোখ মুছিয়া উঠিয়া বসিয়া মনে মনে বলিল, ভগবান! কার হাত দিয়ে তুমি কখন যে কাকে কি পাঠিয়ে দাও, কেউ বলতে পারে না। আজ তোমারি হুকুমে সাবিত্রী দাতা, আমি ভিক্ষুক। তাই সে ভাল হোক, মন্দ হোক, সে বিচার আর যে-ই করুক আমি যেন না করি। আমার বুক থেকে সব জ্বালা, সব বিদ্বেষ মুছে দাও—তার বিরুদ্ধে আমি যেন কৃতঘ্ন হয়ে না থাকি।

ওদিকে জ্যোতিষসাহেবের বাড়িতে সন্ধ্যার পরে, বসিবার ঘরে সরোজিনী, জ্যোতিষ, উপেন্দ্র এবং আরও একজন খর্বাকৃতি গোঁফ-দাড়ি-কামানো গুলিভাঁটার মত শক্ত-সমর্থ ভদ্রলোক বসিয়াছিলেন। ইঁহার নাম শশাঙ্কমোহন। ইনিও বিলাত-প্রত্যাগত—সুতরাং সাহেব। অল্পদিনেই সরোজিনীর প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছেন এবং তাহা প্রাণপণে ব্যক্ত করতে প্রয়াস পাইতেছেন। সে প্রয়াস যে কতদূর সফলতার দিকে অগ্রসর হইতেছিল, সে শুধু বিধাতাপুরুষই জানিতেছিলেন। আজ সতীশের প্রসঙ্গ উত্থিত হইয়াছিল। উপেন্দ্র তাহার অসাধারণ গায়ের জোর এবং অদ্ভুত সাহসের ইতিহাস শেষ করিয়া, আশ্চর্য কণ্ঠস্বর ও তদপেক্ষা আশ্চর্য শিক্ষার কথা পড়িয়াছিলেন। অদূরে সোফার উপর বসিয়া সরোজিনী দুই হাতের উপর চিবুক রাখিয়া ঝুঁকিয়া পড়িয়া নিবিষ্টচিত্তে শুনিতেছিল। এমনি সময়ে বেহারী ভগ্নদূতের মত ঘরে ঢুকিয়া সতীশের ভবানীপুর যাওয়ার সংবাদ ঘোষণা করিয়া দিল।
উপেন্দ্র কিছু বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিলেন, তার কে আছে সেখানে?

বেহারী সংক্ষেপে ‘জানি না’ বলিয়াই চলিয়া গেল।

সতীশের জন্যই সকলে অপেক্ষা করিতেছিলেন, অতএব সকলেই নিরাশ হইলেন।

সরোজিনী সোজা হইয়া বসিয়া হঠাৎ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিয়া উঠিল, তবে আর কি হবে!

জ্যোতিষ তাহার মুখের পানে চাহিয়া দেখিয়া সস্নেহে একটুখানি হাসিলেন; কিন্তু, দমিলেন না শুধু শশাঙ্কমোহন। বরং খুশী হইয়া প্রস্তাব করিলেন, এখন সরোজিনীই কর্ণধার হউন। সঙ্গীত হইতে কতটা পরিমাণে আনন্দ আহরণ করিবার ক্ষমতা তাঁহার ছিল তাহা তিনিই জানিতেন, কিন্তু সরোজিনী দৃঢ় আপত্তি প্রকাশ করিতেই বলিয়া বসিলেন, বরং আমি ত বলি, পুরুষের গান গাওয়াটাই ভুল। তার স্বভাবতঃ গলা মোটা এবং ভারী, সুতরাং শিক্ষা তার যতই হোক এবং যত ভাল করেই গাইবার চেষ্টা করুন না কেন, কোনমতেই শোনবার যোগ্য হতে পারে না।

এ কথার আর কেহ যদিও প্রতিবাদ করিলেন না, কিন্তু সরোজিনী করিল। সে বলিল, আপনার কাছে নিশ্চয়ই যোগ্য নয়। হারমোনিয়ম পিয়ানোর গোড়ার মোটা ও ভারী পর্দাগুলো তৈরী করাও হয়ত ভুল, কিন্তু তবু সেগুলো তৈরিও হচ্চে, লোকেও কিনচে।

শশাঙ্কমোহনের তরফে এ কথার উত্তর ছিল না। তথাপি তিনি তাঁহার গৌরবর্ণ মুখ ঈষৎ রক্তাভ করিয়া কি একটা বলিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু সরোজিনী হঠাৎ দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, মাকে খবর দিয়ে আসি—তিনি আবার খাবার নিয়ে বসে থাকবেন।

উপেন্দ্র চকিত হইয়া বলিলেন, ওহো, তার খাওয়া-দাওয়া বুঝি ঐ-দিকেই হচ্ছে—হমব্যাগ্‌!

উপেন্দ্রর বলার মধ্যে যে আন্তরিক স্নেহ ভিন্ন আর কিছুই ছিল না এবং সতীশ তাঁহার নিতান্ত স্নেহাস্পদ না হইলে তিনি এ ভাষা যে মুখে আনিতেও পারিতেন না ইহা সরোজিনী সম্পূর্ণ বুঝিতে পারিয়া সহাস্যে কহিল, এ আপনার ভারী অন্যায়। তাঁর রুচি যদি আপনার কুরুচির সঙ্গে না মেলে ত দোষ আপনার—তাঁর নয়! আচ্ছা, মাকে বলেই আসচি। বলিয়া সরোজিনী দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেল।

সে চলিয়া যাইতেই শশাঙ্কমোহন উপেন্দ্রর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, আপনার বন্ধু বুঝি খুব গোঁড়া?

উপেন্দ্র একটুখানি হাসিয়া বলিলেন, কম নয়। পূজো-আহ্নিকও করে জানি।

সতীশ যে মাঝে মাঝে লুকাইয়া মদ খাইত, এ কথা তিনি জানিতেন না, বোধ করি স্বপ্নেও ভাবিতে পারিতেন না।

শশাঙ্কমোহন প্রশ্ন করিলেন, কি করেন তিনি?

উপেন্দ্র বলিলেন, কিছুই না; কোনদিন যে কিছু করবে এ ভরসাও কারো নেই।

এই সংবাদে শশাঙ্কমোহনের মনের উপর হইতে যেন একটা পাথর নামিয়া গেল। খুশী হইয়া বলিলেন, তাইতেই!
জ্যোতিষ এতক্ষণ চুপ করিয়া শুনিতেছিলেন, উপেন্দ্রকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, কথাটি ঠিক হলো না, উপেন। শারীরিক উৎকর্ষটা কিছুই নয় নাকি? তা ছাড়া আমি ত তাঁর গানে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেছি। যা কিছু তিনি করেছেন, আমাদের এদেশে সে সম্মান যদি তাঁর নাও মেলে, দুঃখের বিষয় সন্দেহ নেই, কিন্তু সে দোষ আমাদেরই—তাঁর নয়। মকদ্দমার নথি-পত্র না ঘেঁটে, এটর্নির সঙ্গে ধস্তাধস্তি না করে, হাকিমের তাড়া না খেয়েও যার ষোলআনা আদায় হয়েই আছে, সে যদি একটু এদিকে না তাকায় ত সংসারটা নিতান্ত মারোয়াড়ীর কাপড়ের দোকান হয়ে দাঁড়ায়। আমার ত তোমার বন্ধুটিকে দেখে সত্যিই হিংসা হয়। ভাল কথা, বৃদ্ধের আয় কত হে?

এই সময় সরোজিনী নিঃশব্দে ঘরে ঢুকিয়া তাহার দাদার চৌকির পিঠের উপর ভর দিয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কার দাদা?

জ্যোতিষ বলিলেন, সতীশবাবুর বাবার।

উপেন্দ্র বলিলেন, ঠিক জানি না, বোধ করি, প্রায় দু’লাখ।

জ্যোতিষ দুই চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিয়া উঠিল, রাজা নাকি হে!

উপেন্দ্র বলিলেন, না, রাজা নয়, তবে বরাবরই ওরা বড় জমিদার। তার ওপর বৃদ্ধ বিশেষ করেই বৃদ্ধি করেছেন।

জ্যোতিষ চৌকিতে হেলান দিয়া পড়িয়া একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, একেবারে সৌভাগ্যের প্রিয়তম পুত্র! স্বাস্থ্য, শক্তি, রূপ, ঐশ্বর্য! মানুষ যা-কিছু কামনা করে, একাধারে সমস্তই।

উপেন্দ্র হাসিতে লাগিলেন। শেষে বলিলেন, একটা মারাত্মক দোষও আছে। পরের দায় যেচে ঘাড়ে নিয়ে অসময়ে অপঘাতে মারা না পড়ে ত তুমি যা বলচ সে-সবই ঠিক বটে।

জ্যোতিষ সোজা হইয়া বসিয়া বলিলেন, অপঘাতে মারা পড়বে কেন?

উপেন্দ্র বলিলেন, অসম্ভব নয়, এবং পূর্বে হয়েও গেছে। রাগ পদার্থটি ওর দেহে যেমন ভয়ানক বেশী, প্রাণের মায়াটাও ঠিক তেমনি পরিমাণে কম। এই কলিযুগে বাস করেও যাদের অন্যায় অত্যাচারের ধারণাটা সত্যযুগের মতই থাকে, এবং রেগে উঠলে যাদের হিতাহিত বোধ থাকে না, তাদের বেঁচে থাকা-না-থাকার উপর আমি ত বেশী আস্থা রাখিনে। সহ্য করতে পারাও যে একটা ক্ষমতা, অনাহূত সাহায্য করবার লোভ সংবরণ করতে পারাও যে অবস্থাবিশেষে প্রয়োজন, সেটা ও বোঝেই না। ও যেন সেই সেকালের ইউরোপের নাইট, একালে বাঙলাদেশে এসে জন্মেছে।

জ্যোতিষ হাসিয়া বলিলেন, কিন্তু যাই বল, শুনে শ্রদ্ধা হয়।

উপেন্দ্র বলিলেন, হয়ও না! সংসারে বাস করতে গেলে অনেক ছোটখাটো মন্দ জিনিসকে অগ্রাহ্য করতে হয়—এ শিক্ষা ওর আজো হয়নি। কোনদিন হবে কি না জানি না, কিন্তু যদি না হয়, শেষকালের ফলটা মধুর হবে না। ওরও না, ওর আত্মীয়-বন্ধুদেরও না।
জ্যোতিষ বলিলেন, কিন্তু তুমি ওর আত্মীয়-বন্ধু, তুমি কেন শেখাও না?

উপেন্দ্রর মুখে হাসি ফুটিয়া উঠিল। বলিলেন, আমি ওর বন্ধু বটে, কিন্তু এ শিক্ষার ভার এ-রকম বন্ধুর উপরে নয়। যিনি সব বন্ধুর বড় বন্ধু হবেন, যিনি সমস্ত আত্মীয়ের উপর আত্মীয় হবেন, এ বিদ্যা হয় তিনি শেখাবেন, না হয় চিরদিন ওকে অশিক্ষিত হয়েই থাকতে হবে।

সরোজিনী এতক্ষণ নীরবে স্থির হইয়া শুনিতেছিল, এখন মুখ ফিরাইয়া বোধ করি একটুখানি হাসি গোপন করিল।

উপেন্দ্র বলিলেন, কিন্তু সতীশের কথা আজ এই পর্যন্ত। আমাকে উঠতে হবে, খান-দুই চিঠি লেখবার আছে।

জ্যোতিষেরও জরুরী কাগজপত্র দেখিবার ছিল, তাঁহারও বসিবার জো ছিল না, তাই তিনিও উঠি-উঠি করিতেছিলেন। কিন্তু সকলের পূর্বেই উঠিয়া পড়িল সরোজিনী। একবার মনে হইল সে উপেন্দ্রকে কি কথা যেন বলিতে চাহিল, কিন্তু শেষে কিছুই বলিল না, কাহাকেও একটি ক্ষুদ্র নমস্কার পর্যন্ত করিল না—অন্যমনস্কের মত ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। আজিকার সভা যেমন করিয়া জমিবার কথা ছিল, তেমন করিয়া জমিতে পারে নাই বটে, কিন্তু ভাঙ্গিল আরো বিশ্রী করিয়া।

উপেন্দ্র কিছুই জানিতেন না, তিনি কিছুই জানিলেন না।

ষোল

তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী কিরণময়ী স্বামীর পীড়া উপলক্ষে এই কয়টা দিন উপেন্দ্রকে ঘনিষ্ঠভাবে কাছে পাইয়া তাহাকে চিনিল। ইহাতে শুধু যে তাহার স্বার্থহানির ব্যাকুল আশঙ্কাটাই তিরোহিত হইল তাহা নহে, এই অপরিচিতের উদ্দেশে একটা গভীর শ্রদ্ধার ভারে তাহার সমস্ত হৃদয় জলভারাক্রান্ত মেঘের মত বর্ষণোন্মুখ হইয়া উঠিল। এমন লোক সে কখন দেখে নাই। এমন লোকের সংসর্গে আসিতে পারার ভাগ্য কোন দিন সে কল্পনা করিতে পারে নাই। তাই এই অত্যল্পকালের পরিচয়েই সে তাহার ভবিষ্যতের সকল সুখ-দুঃখ ইহারই হাতে নিঃশঙ্কচিত্তে তুলিয়া দিল, এবং নির্ভয়ে নির্ভর করিতে পারা যে কি, তাহা এই প্রথম উপলব্ধি করিয়া তাহার চিরকারারুদ্ধ প্রাণ যেন মুক্ত পথের আলোক দেখিতে পাইল।

উপেন্দ্র প্রভাত হইতে রাত্রি পর্যন্ত থাকিয়া মুমূর্ষু বন্ধুর সেবা করিতেছিলেন। প্রয়োজন হিসাবে এ সেবার মূল্য ছিল না, কারণ হারানের জীবনের আশা আদৌ ছিল না—কিন্তু, এই সেবা, কিরণময়ীর চোখে তাঁহার স্বামীর শুষ্ক দেহটাকেও আজ মহামূল্য করিয়া দিল। এই অর্ধমৃত দেহটার লোভেই অকস্মাৎ সে ভয়ানক লুব্ধ হইয়া উঠিল। তাহার আচার-ব্যবহারের এই আকস্মিক অভাবনীয় পরিবর্তন মৃত্যুর উপকূলে দাঁড়াইয়া হারানও লক্ষ্য করিলেন। ছেলেবেলায় কিরণ আত্মীয়ের ঘরে মানুষ হইয়া ছেলেবেলাতেই ততোধিক অনাত্মীয় স্বামীভবনে আসিয়াছিল। শ্বশ্রূ অঘোরময়ী তাহাকে কোনদিন আদর-যত্ন করেন নাই; বরং যতদূর সম্ভব নির্যাতন করিয়া আসিয়াছেন। স্বামীও তাহাকে একদিনের জন্য ভালবাসেন নাই। তিনি দিনের বেলা স্কুলে শিক্ষা দিতেন, রাত্রে নিজে অধ্যয়ন করিতেন, বধূকে শিক্ষা দান করিতেন। বিদ্যার্জনের নেশা তাঁহাকে এমনি গ্রাস করিয়াছিল যে উভয়ের মধ্যে গুরু-শিষ্যের কঠোর সম্বন্ধ ভিন্ন স্বামী-স্ত্রীর মধুর সম্বন্ধের কিছুমাত্র অবকাশ ঘটে নাই। এমনি করিয়াই এই নিরুপমা প্রখর বুদ্ধিশালিনী রমণী শৈশব অতিক্রম করিয়া পরিপূর্ণ যৌবনের মাঝখানে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল,—এমনি করিয়াই সংসারের সৌন্দর্য মাধুর্য হইতে নির্বাসিতা, শুষ্ক কঠোর হইয়া উঠিয়াছিল, এবং এমনি স্নেহপ্রেমে বঞ্চিত হইয়াই সে নারীর শ্রেষ্ঠ ধর্মেও জলাঞ্জলি দিতে বসিয়াছিল। অঘোরময়ী সমস্ত জানিতেন। তাঁহার রূপসী বধূ যে ইদানীং সতীধর্মেরও সম্পূর্ণ মর্যাদা বহন করিয়া চলে না, ইহাও তিনি বুঝিতেন। কিন্তু, পুত্র তাঁহার মৃতকল্প, দুঃসহ দুঃখের দিন সমাগতপ্রায়। এই মনে করিয়াই বোধ করি, বধূর বিসদৃশ আচার-ব্যবহারও উপেক্ষা করিয়া চলিতেন। যে ডাক্তার হারানের চিকিৎসা করিতেছিল, সে যে কি আশায় বিনা ব্যয়ে ঔষধপথ্য যোগাইতেছে, কেন সংসারের অর্ধেক ব্যয়ভারও বহন করিতেছে, ইহা তাঁহার অগোচর ছিল না। কিন্তু মৃতকল্প সন্তানের চিকিৎসার কাছে কোন অন্যায়কেই বড় করিয়া দেখিবার তাঁহার সাহস ছিল না, শিক্ষাও ছিল না। অধিকন্তু তিনি পুত্রবধূকে ভালবাসিতেন না। উপেন্দ্রও যে এই জালে ধীরে ধীরে আবদ্ধ হইতেছিল,তাহার অকাতর অর্থব্যয় এবং অক্লান্ত সেবার গোপন উদ্দেশ্য যে, আশৈশব বন্ধুত্বকে অতিক্রম করিয়া নিঃশব্দে আর একস্থানে মূল বিস্তার করিতেছিল, এ বিষয়ে তাঁহার সন্দেহও ছিল না, আপত্তিও ছিল না। কাল হইতে উপেন্দ্র আসে নাই। এই কথা অঘোরময়ী তাঁহার ঘরের চৌকাঠের বাহিরে একখানা জীর্ণ মলিন বালাপোশ গায়ে দিয়া বসিয়া ভাবিতেছিলেন।
শীতের সূর্য তখনও অস্ত যায় নাই, কিন্তু এ বাড়ির ভিতরটায় ইহারই মধ্যে অন্ধকারের ছায়া পড়িয়াছিল। সূর্যদেব কখন উদয় হন, কখন অস্ত যান, সুদিনেও সে সংবাদটা এ বাটীর লোকে রাখে নাই, এখন দুঃখের দিনে তাঁহার সহিত প্রায় সমস্ত সম্বন্ধই বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছিল।

অঘোরময়ী ডাকিলেন, বৌমা, সন্ধ্যেটা জ্বেলে দিয়া একবার বস ত মা, একটা কথা আছে।

কিরণময়ী তাঁহারই ঘরের মধ্যে কাজ করিতেছিল, বলিল, এখনো সন্ধ্যে হয়নি মা, তোমার বিছানাটা পেতে দিয়েই যাচ্চি।

আঘোরময়ী বলিলেন, আমার আবার বিছানা! শোবার সময় আমিই পেতে নেব। না না, তুমি যাও মা, প্রদীপগুলো জ্বেলে দিয়ে একটু ঠাণ্ডা হয়ে বসো। দিবারাত্রি খেটে খেটে দেহ তোমার আধখানি হয়ে গেল, সেদিকে একটু দৃষ্টি রাখা যে দরকার মা। বলিয়া একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া চুপ করিয়া রহিলেন। অনতিকাল পরে বধূ কাছে আসিয়া বসিতে গেলে, তিনি বাধা দিয়া বলিয়া উঠিলেন, আগে প্রদীপগুলো—

বধূ শ্রান্তভাবে বলিল, তুমি কেন ব্যস্ত হচ্চ মা, সন্ধ্যের এখনো ঢের দেরী আছে।

অঘোরময়ী বলিলেন, তা হোক—নীচে যে অন্ধকার, একটু বেলা থাকতেই সিঁড়ির আলোটা জ্বেলে দেওয়া ভাল। এখনি হয়ত উপীন এসে পড়বে, কাল থেকে সে আসেনি—কৈ বৌমা, এখনো তোমার ত গা-ধোয়া, চুল-বাঁধা হয়নি দেখচি—কি কচ্ছিলে গা এতক্ষণ?

শ্বশ্রূর কণ্ঠস্বরে অকস্মাৎ এই বিরক্তির আভাসে বিস্মিত বধূ ক্ষণকাল তাঁহার মুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া একটুখানি হাসিয়া বলিল, আমি রোজ এমনি সময়ে গা ধুই, না কাপড় ছাড়ি মা? এখনো ত আমার রান্নাঘরেরই কাজ মেটে না! তার পরে—

শাশুড়ী বিরক্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, তার পরের কাজ তার পরে হবে বৌমা, এখন যা বলি শোন।

বধূ যাইতে উদ্যত হইয়া কহিল, যাই প্রদীপগুলো জ্বেলে দিয়ে তোমার কাছে এসেই বসি।

অঘোরময়ী রাগ করিয়া উঠিলেন—আমার কাছে এখন মিছিমিছি বসে থেকে কি হবে বাছা! কাজ আগে, না বসা আগে? দিন দিন তুমি কি রকম যেন হয়ে যাচ্ছো বৌমা!

তাঁহার স্নেহের অনুযোগ হঠাৎ তিরস্কারের আকার ধরিতেই কথাগুলো অত্যন্ত শক্ত ও রুক্ষ হইয়া কিরণময়ীর কানে গিয়া বিঁধিল। সেও রাগ করিয়া জবাব দিল, তোমরাই আমাকে কি-রকম করে তুলচ মা। সব সময়ে উলটো উলটো কথা বললে শোনা চুলোয় যাক, বুঝতেই ত পারা যায় না। কি বলতে চাও তুমি স্পষ্ট করেই বল না? বলিয়া উত্তরের জন্য মুহূর্তকাল অপেক্ষা না করিয়া দ্রুত চলিয়া গেল। বধূর দ্রুতপদে চলিয়া যাওয়া যে কি, তাহা এ বাড়ির সকলেই বুঝিত, অঘোরময়ীও বুঝিলেন।
কিরণময়ী নীচে-উপরে আলো জ্বালিয়া তাহার শাশুড়ীর ঘরে যখন প্রদীপ দিতে আসিল, তখন শাশুড়ী কাঁদিতেছিলেন। তাঁহার কান্না যখন-তখন, যে-সে কারণেই উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিত।

কিরণময়ী থমকিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, তোমার হরিনামের মালাটা এনে দেব মা?

শাশুড়ী বালাপোশের কোণে চোখ মুছিয়া কাঁদ-কাঁদ স্বরে বলিলেন, দাও।

সে ঘরে গিয়া দেয়ালে টাঙ্গান মালার ঝুলিটা পাড়িয়া আনিয়া হাতে দিতে গেলে তিনি ঝুলিটা না লইয়া বধূর হাতখানি ধরিয়া ফেলিয়া একটুখানি বসো মা, বলিয়া টানাটানি করিয়া নিজের কাছে বসাইয়া তাহার মুখে কপালে মাথায় হাত বুলাইয়া দিলেন, চিবুক স্পর্শ করিয়া চুমো খাইলেন এবং বহুক্ষণ পর্যন্ত কিছুই না বলিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। কিরণময়ী শক্ত হইয়া বসিয়া এই-সমস্ত স্নেহের অভিনয় সহ্য করিতে লাগিল।

খানিক পরে অঘোরময়ী আর একবার বালাপোশের কোণে চোখের জল মুছিয়া বলিলেন, শোকে-তাপে আমি পাগল হয়ে গেছি, আমার সামান্য একটা কথায় রাগ করলে কেন বল ত মা?

কিরণ অবিচলিতভাবে বলিল, শোক-তাপ তোমার ত একলার নয় মা। আমরাও মানুষ, সেটা ভুলে গিয়ে একটা কথা বলাই যে যথেষ্ট। না হলে হাজার কথাতেও রাগ হয় না।

অঘোরময়ী চোখ মুছিতে মুছিতে বলিলেন, সে কথা কি জানি না মা, জানি। কিন্তু আমার একে একে সবাই গেল, এখন তুমিই আমার সব, তুমিই আমার ছেলেমেয়ে। হারানের শোকে যদি বুক বাঁধতে পারি, ত তোমার মুখ চেয়েই পারব। বলিয়া আর একবার বালাপোশ চোখে দিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। কিন্তু, এ ছলনায় কিরণ ভুলিল না। সে মনে মনে জ্বলিয়া উঠিয়াও শান্তভাবেই বলিল, তুমি কি করে বুক বাঁধবে, সেটা এখন থেকে ঠিক করে রেখেচ, কিন্তু আমি কি করে বুক বাঁধব, সেটা ত ভাবোনি মা! আবার তাও বলি— এ-সব কথা এখনি বা কেন? যখন সত্যই বুক বাঁধাবাঁধির দিন আসবে, তখন সময়ের টানাটানি হবে না; ও-সময় এত কম করে আসে না, মা, যে আগে থেকে ঠিক হয়ে না থাকলে সময়ে কুলোয় না।

বধূর কথাগুলি মধুর না শুনাইলেও ইহার ভিতরে যে কতখানি শ্লেষ ছিল, অঘোরময়ী ধরিতে পারিলেন না। বরঞ্চ বলিলেন, সময় আসা বৈ কি মা, উপীন সেদিন যে সাহেব ডাক্তারকে এনেছিলেন, তিনিও ত ভাল কথা কিছুই বলে গেলেন না। আমি তাই কেবলি ভাবছি বৌমা, উপীন যদি এ সময়ে না এসে পড়ত, তা হলে কি দুর্দশাই না আমাদের হতো।

বৌ চুপ করিয়া শুনিতেছে দেখিয়া তিনি একটু উৎসাহিত হইয়াই বলিতে লাগিলেন, ওকে ছেলেবেলা থেকেই জানি কিনা! ন’খালিতে ওরা দুটি ভায়ের মত আসত যেত— তখন হতেই আমাকে মাসী বলে ডাকত। যেমন বড়লোকের ছেলে, তেমনি নিজেও বড় হয়েছে। সেদিন আমাকে কাঁদতে দেখে বললে, মাসীমা, আমাকে হারানদার ছোট বলেই মনে করবেন, এর বেশী আমার আর কিছুই বলবার নেই। আমি বললুম, বাবা, আমাকে কোন একটি তীর্থস্থানে রেখে দিস। যে-ক’টা দিন বাঁচি, যেন গঙ্গাস্নান করতে করতে মা গঙ্গার কোলে আমার হারানের কাছে যেতে পারি।
আর তিনি বলিতে পারিলেন না, এইবার আকুল হইয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। বৌ চুপ করিয়া ছিল, চুপ করিয়াই রহিল। তিনি কিছুক্ষণ কাঁদিয়া বুকের ভার লঘু করিয়া পরিশেষে চোখ মুছিয়া গাঢ়স্বরে বলিলেন, থেকে থেকে এই কথাই মনে ওঠে, ও যদি না এসে পড়ত! নীচে কে ডাকলে না বৌমা?

বৌ কহিল, নীচে ঝি বাসন ধুচ্ছে, কেউ ডাকলেই খুলে দেবে।

শাশুড়ী অস্থির হইয়া বলিলেন, না না বৌমা, তুমিই যাও। ঝি কাজে ব্যস্ত থাকলে কিছুই শুনতে পায় না।

কিরণ কিছুমাত্র উদ্বেগ প্রকাশ না করিয়া আস্তে আস্তে বলিল, আমারও কাজ আছে মা, খাবার তৈরী—

অঘোরময়ী অকস্মাৎ আগুন হইয়া উঠিলেন—খাবার ত পালিয়ে যাচ্চে না বাছা! তুমি কিছুই বোঝ না কেন গা? যে না হলে—

কিরণ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আমার বুঝেও কাজ নেই। আমাদের আপনার লোক সবাই গেলেও যদি আমাদের দিন চলে ত উপীনবাবু না থাকলেও আটকাবে না।—বলিয়া রান্নাঘরের দিকে চলিয়া গেল।

অঘোরময়ী ক্রোধে কথা কহিতে পারিলেন না; এবং যতক্ষণ বধূকে দেখা গেল, ততক্ষণ তাঁহার জ্বলন্ত চোখ দুটো আগুন ছড়াইয়া তাহাকে যেন ঠেলিয়া বিদায় করিয়া দিয়া আসিল। তারপর তিনি অত্যন্ত ক্রোধের সহিত ঝিকে পুনঃ পুনঃ ডাকাডাকি করিতে লাগিলেন। তাহারও সাড়া পাওয়া গেল না। সে শীতের ভয়ে সন্ধ্যার পূর্বেই খনখন ঝনঝন শব্দ করিয়া মাজা-ধোয়া সারিয়া লইতেছিল, তাঁহার ক্রুদ্ধ আহ্বান শুনিতে পাইল না। তখন ঘরের প্রদীপটা হাতে লইয়া বারান্দার ধারে আসিয়া চেঁচাইয়া বলিলেন, তুই কি কানের মাথা খেয়েচিস লা? শুনতে পাসনে, উপীনবাবু একঘণ্টা বাইরে দাঁড়িয়ে ডাকাডাকি কচ্চেন!

এ চীৎকার ঝি শুনিতে পাইল এবং উপেন্দ্রর নাম শুনিয়া ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া পড়িয়া ছুটিয়া গিয়া কবাট খুলিয়া ফেলিল, কিন্তু, কেহই নাই। বাহিরে গলা বাড়াইয়া অন্ধকারে যতদূর দেখা যায়, ভাল করিয়া দেখিয়াও কাহাকেও দেখিতে না পাইয়া ফিরিয়া আসিয়া বলিল, কেউ নেই ত মা!

অঘোরময়ী প্রদীপ-হাতে উদ্বিগ্ন হইয়া অপেক্ষা করিতেছিলেন, অবিশ্বাস করিয়া বলিলেন, নেই কি রে! আমি যে নিজের কানে তার ডাক শুনলুম। তুই গলির মধ্যে গিয়ে একবার দেখলি নে কেন?

ঝি বলিল, দেখেছি, কেউ নেই।

কথাটা বিশ্বাস করিবার মত নয়। উপীন কাল আসে নাই, আজও আসিবে না? তাই বিরক্ত হইয়াই বলিলেন, তুই আর একবার ভাল করে দেখ্‌ দেখি, কেউ আছে কিনা?

বাহিরে অন্ধকার গলির মধ্যে যাইতে ঝির আপত্তি ছিল। সেও বিরক্ত হইয়া জবাব দিল, তোমার এ কি কথা মা! তিনি কি লুকোচুরি খেলচেন যে, অন্ধকার গলির মধ্যে গিয়ে হাতড়ে দেখতে হবে!—বলিয়া সে নিজের কাজে মন দিল।
অঘোরময়ী ঘরে ফিরিয়া আসিয়া নির্জীবের মত বিছানায় শুইয়া পড়িলেন। পীড়িত সন্তানের সংবাদ লইবার উৎসাহও তাঁহার রহিল না। তাঁহার ফিরিয়া ফিরিয়া কেবলি মনে হইতে লাগিল, সে কাল আসে নাই, আজিও আসিল না। সম্ভব-অসম্ভব নানারূপ কারণ খুঁজিয়া ফিরিবার মধ্যে এ কথাটি তাঁহার কিন্তু একবারও মনে হইল না যে, সে কলিকাতাবাসী নহে, অন্যত্র তাহার বাড়ি-ঘর আত্মীয়-স্বজন আছে—তথায় ফিরিয়া যাওয়াও সম্ভব। ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ তাঁহার মনে হইল, রাগ করে নাই ত? কথাটা আবৃত্তি করিতেই তাঁহার অন্তঃকরণ আশঙ্কায় পূর্ণ হইয়া উঠিল; এবং বধূর ক্ষণপূর্বের আচরণের সহিত মনে মনে মিলাইয়া দেখিয়াই সন্দেহ সুদৃঢ় হইল,—তাই ত বটে! বৌ যদি এমন কিছু—তিনি আর শুইয়া থাকিতে পারিলেন না, উঠিয়া রান্নাঘরের দিকে গেলেন।

কিরণময়ী প্রজ্বলিত উনানের দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া বসিয়া ছিল। জ্বলন্ত ইন্ধনের উজ্জ্বল রক্তাভ আলোক প্রচুর পরিমাণে তাহার মুখের উপর পড়িয়াছে। মাথায় কাপড় ছিল না, আজ সে চুল বাঁধে নাই—এলোমেলো চুলের রাশি কোনমতে জড়াইয়া রাখিয়াছিল।

অঘোরময়ী দ্বারের সম্মুখে নির্বাক্‌ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। আজ যে বস্তুটি তাঁহার চোখে পড়িল, তাহা সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করিবার সামর্থ্য তাঁহার ছিল না। যে স্তব্ধ মুখের উপরে উনানের রক্তাভ আলোক বিচিত্র তরঙ্গের মত খেলিয়া ফিরিতেছিল, সেই মুখ তাঁহার সমস্ত অভিজ্ঞতার বাহিরে। এ মুখে খুঁত আছে কিনা সে আলোচনা চলে না। নিখুঁত বলিয়াও ইহাকে প্রকাশ করা যায় না। ইহা আশ্চর্য! ইহাকে পূর্বে দেখেন নাই—ইহা অপূর্ব! নির্নিমেষ-চোখে অনেকক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া হঠাৎ মুখ দিয়া তাঁহার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়িল।

সেই শব্দে বধূ চকিত হইয়া দেখিল শাশুড়ী দাঁড়াইয়া। স্খলিত আঁচলটা মাথায় তুলিয়া দিয়া কহিল, তুমি এখানে কেন মা?

স্বর শুনিয়া তাঁহার আরও চমক লাগিয়া গেল; এমন শান্ত, এমন করুণ কণ্ঠস্বর তিনি আর কখনও শোনেন নাই। খপ্‌ করিয়া বলিয়া ফেলিলেন, তুমি একলাটি রান্না করচ মা, তাই একবার বসতে এলুম।

বধূ তাঁহার দিকে একটা পিঁড়ি ঠেলিয়া উনানের দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া রহিল। তাহার মনের মধ্যে আবার বিরক্তি মাথা তুলিয়া উঠিল। গন্ধ যেমন বাতাস আশ্রয় করিয়া ফুলের বাহিরে আসে, অথচ ঝড়ে উড়িয়া যায়, কিরণময়ীর তৎকালীন মনের ভাবটা শাশুড়ীর আকস্মিক আগমনে তেমনি মুহূর্তের মধ্যে বাহিরে আসিয়াই এই ছদ্ম-স্নেহের ঝড়ে উড়িয়া গেল। ইহা সত্য নহে—কদর্য প্রতারণা মাত্র; কিন্তু কথা কাটাকাটি করিতে তাহার আর ভাল লাগিতেছিল না, নিরন্তর ঝগড়া করিয়া সে সত্যই শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছিল।

কিছুক্ষণ স্থির থাকিয়া অঘোরময়ী বলিলেন, ঝিকে একবার ডেকে দিয়ে যাব?
কিরণময়ী অন্তরস্থ সমস্ত বিদ্রোহ দমন করিয়া শান্তভাবে বলিল, কি দরকার মা। আমি রোজই একলা রাঁধি—একলা থাকা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। বরং উনি ঘরে একলা আছেন—তাঁর কাছে গিয়ে কেউ বসলে ভাল হয়।

পীড়িত সন্তানের উল্লেখে জননী আঘাত পাইয়া ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, তাই যাই। তুমিও একটু শীঘ্র করে কাজ সেরে চলে এস মা।

ইতিমধ্যে উপেন্দ্র বাড়ি ফিরিয়া গিয়াছেন, সতীশও আর একটি দিন মাত্র উপেন্দ্রর সঙ্গে হারানকে দেখিতে আসিয়াছিল—আর আসে নাই।সে নিজের ব্যথা লইয়াই বিব্রত ছিল। উপেন্দ্র তাহার অন্যমনস্ক ভাব এবং এ বাটীতে আসিতে অনিচ্ছা জানিয়া তাহাকে আর আহ্বান করেন নাই, চিকিৎসা এবং অন্যান্য ব্যবস্থা একাকীই স্থির করিতেছিলেন। শুধু কলিকাতা ছাড়িয়া বাড়ি ফিরিয়া যাইবার দিন সতীশকে ডাকিয়া মধ্যে মধ্যে সংবাদ লইতে এবং তাঁহাকে চিঠি লিখিয়া জানাইতে অনুরোধ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন। আজ সতীশ ইস্কুল হইতে ফিরিয়াই উপেন্দ্রর পত্র পাইল। তিনি লিখিয়াছেন,—ভরসা করি, তোমার লেখাপড়া ভালই হইতেছে। কয়দিন হারানদার সংবাদ না পাইয়া ভাবিত হইয়াছি। যদিও জানি, সংবাদ দিবার প্রয়োজন হয় নাই বলিয়াই দাও নাই, তথাপি তাঁহার চিকিৎসাটা কিরূপ হইতেছে, লিখিয়া জানাইবে।

সতীশের পিঠে চাবুক পড়িল। সে একদিনও যাইয়া সংবাদ লয় নাই। ইতিমধ্যে ও-বাটীতে কত কি ঘটিয়া থাকিতে পারে, অথচ, তাহারই উপরে নির্ভর করিয়া উপীনদা বাড়ি গিয়াছেন। সে দ্রুতপদে নীচে নামিয়া গেল। বেহারী জলখাবার আনিতেছিল, ধাক্কা খাইয়া তাহার থালা গেলাস ছড়াইয়া পড়িল—সতীশ ফিরিয়া দেখিল না। রাস্তায় আসিয়া একখানা খালি গাড়িতে চড়িয়া বসিল এবং দ্রুত হাঁকাইতে অনুরোধ করিয়া পথের দিকে সতর্ক হইয়া রহিল। তাহার ভয় ছিল পাছে চিনিতে না পারায় গলিটা পার হইয়া যায়। মিনিট-কুড়ি পরে, যখন গাড়ি ছাড়িয়া সে ক্ষুদ্র গলির মধ্যে প্রবেশ করিল, তখনও বেলা আছে। পায়ের নীচে খোলা নর্দমা ও চলিবার পথ, এবং মাথার উপরে আকাশ ও আলো তখনও অন্ধকারে একাকার হয় নাই। দ্রুতপদে হাঁটিয়া ১৩ নম্বর বাটীর সম্মুখে আসিতেই কবাট খুলিয়া গেল। কে যেন তাহারি জন্য অপেক্ষা করিয়া পথ চাহিয়া ছিল। সতীশের বুকের ভিতরটা কাঁপিয়া উঠিল, সহসা প্রবেশ করিতে পারিল না।

কবাটের পার্শ্বেই কিরণময়ী, সে তাহার হাসিমুখ একটুখানি বাহির করিয়া ভারী সমাদরের সহিত কহিল, এস ঠাকুরপো, দাঁড়িয়ে রইলে যে!

আবার সেই ঠাকুরপো! লজ্জায় সতীশের মুখ রাঙ্গা হইয়া উঠিল, কিন্তু, তখনি সামলাইয়া লইয়া বিনীতভাবে কহিল, আপনি দেখচি আমাকে এখনো মাপ করেন নি।

কিরণময়ী কহিল, না, তুমি ত মাপ চাওনি। চাইবার আগেই গায়ে পড়ে দিলে, মানী লোকের অমর্যাদা করা হয়। অমর্যাদা করবার মত কম-দামী জিনিস ত তুমি নও ঠাকুরপো।
তাহার এই প্রসন্ন রহস্যালাপের মধ্যেও এমন একটা গভীর কারুণ্য স্পষ্ট হইয়া উঠিল যে, সতীশ আনতমুখে মৃদুকণ্ঠে কহিল, আমার কোন দাম নেই বৌঠাকরুন! আমার কোন অমর্যাদা হবে না—আমাকে আপনি মাপ করুন।

কিরণময়ী একটুখানি হাসিয়া বলিল, এমন জিনিস অনেক আছে ঠাকুরপো, যাকে ক্ষমা করলেই তার শেষ হয়ে যায়। আজ তোমাকে ক্ষমা করতে গিয়ে যদি আবার সতীশবাবু বলে ডাকতে হয়, তা হলে বলে রাখচি ঠাকুরপো, সে ক্ষমা তুমি পাবে না। তোমাকে ধরে রাখবার ঐ একটুখানি শেকল তুমি নিজে আমার হাতে তুলে দিয়েচ, সেটি যে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে ফিরিয়ে নেবে, তত নির্বোধ এই বৌঠাকরুনটি নয়। এই বলিয়া সে একটু বিশেষভাবে ঘাড় নাড়িল। কিন্তু সতীশ চমকাইয়া উঠিল। এই শিকল-বাঁধাবাঁধির উপমাটা তাহার ভাল লাগিল না, বরং হঠাৎ তাহার মনে হইল, তাহাকে অসাবধান পাইয়া এই মেয়েটি যেন সত্যই কিসের শক্ত শিকল তাহার পায়ে জড়াইয়া দিতেছে এবং মুহূর্তেই তাহার সমস্ত সহজবুদ্ধি আত্মরক্ষার্থে সাজিয়া দাঁড়াইল। বাটীতে প্রবেশ করিবার সময় তাহার চক্ষে যে দৃষ্টি কর্তব্য-ত্রুটির ধিক্কারে কুণ্ঠিত ও লজ্জায় বিনম্র দেখাইয়াছিল, ধাক্কা খাইয়া তাহা সন্দিগ্ধ ও তীব্র হইয়া উঠিল।

কিরণময়ী কহিল, তোমার মুখ কিন্তু শুকিয়ে গেছে ঠাকুরপো, হয়ত এখনো জল খাওয়াও হয়নি। এস, কিছু খাবে চল।

সতীশ কিছুই না বলিয়া নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে প্রস্তুত হইল এবং এই সমস্ত রহস্য-কৌতুকের কতটুকু শুধুই রহস্য এবং কতটুকু নয়, অত্যন্ত সংশয়ের সহিত ইহাই বিচার করিতে সে এই রহস্যময়ীর অনুসরণ করিয়া চলিল।

উপরে উঠিয়া বৌ ফিরিয়া চাহিয়া বলিল, আজ ঝিকে নিয়ে মা কালীবাড়ি গেছেন। রান্নাঘরে বসে তুমি আমার লুচি বেলে দেবে, আমি ভেজে তুলব—পারবে ত? বলিয়াই হাসিয়া উঠিয়া বলিল, তুমি যে পারবে, সে তোমাকে দেখলেই বোঝা যায়—এস।

সতীশ অন্তরের দ্বন্দ্ব থামাইয়া রাখিয়া ভাল মানুষের মত প্রশ্ন করিল, লুচি বেলতে পারি সে কথা কি আমার গায়ে লেখা আছে বৌঠাকরুন?

কিরণময়ী বলিল, লেখা পড়তে জানা চাই ঠাকুরপো। সে রাত্রে আমার গায়েতেই কি কিছু লেখা ছিল—অথচ তুমি পড়েছিলে?

সতীশ আবার মুখ হেঁট করিল। রান্নাঘরে গিয়া প্রথমে এমনিধারা ঠোকাঠুকি এবং তার পরে দুজনে মিলিয়া খাবার তৈরির মধ্যে যখন এই সংঘর্ষের উত্তাপ অনেকটা শীতল হইয়া গেল, তখন কিরণময়ী জিজ্ঞাসা করিল, তোমার অনেক কথাই তোমার উপীনদার মুখে শুনেছি। আচ্ছা ঠাকুরপো, তিনি এখন এখানে নেই বুঝি? বাড়ি ফিরে গেছেন, না?

সতীশ, ‘হাঁ’ বলিলে, কিরণময়ী কহিল, আমি জানি, তিনি এখানে নেই, কিন্তু মা বিশ্বাস করতে চান না। মা বলেন, তাঁকে না জানিয়ে উপীনবাবু কখনই যাবেন না—তাঁকে বুঝি হঠাৎ যেতে হয়েছে?
সতীশ ইহা ঠিক জানিত না। বস্তুতঃ সে কিছুই জানিত না। ইতিমধ্যে ইহাদিগকে উপলক্ষ করিয়া দুই বন্ধুতে যে-সকল অপ্রিয় কথা হইয়া গেছে, তাহাও বলা যায় না—সতীশ চুপ করিয়া রহিল। তাঁহার না বলিয়া চলিয়া যাইবার কারণ সে কিছুতেই অনুমান করিতে পারিল না। কিন্তু কিরণময়ী কথাটা চাপা পড়িতে দিল না, কহিল, কাজটা তোমার দাদার ভাল হয়নি ঠাকুরপো, জানিয়ে গেলে কেউ তাঁকে ধরে রাখত না, অথচ, মা এমন ভেবে সারা হতেন না। আমি কোন রকমেই তাঁকে বোঝাতে পারিনে যে, উপেনবাবু চিরকাল এ দেশেই থাকেন না; অন্যত্র তাঁর ঘর-বাড়ি আছে, কাজকর্ম আছে—এ-সমস্ত ছেড়ে কতদিন মানুষে পরের দুর্ভাগ্য নিয়ে আটকে থাকতে পারে? কিন্তু বুড়োমানুষের কাছে কোন যুক্তিই যুক্তি নয়—তাঁদের নিজের প্রয়োজনের বাড়া সংসারে আর কিছু তাঁরা দেখতেই পান না।

সতীশ সে কথার ঠিক জবাব না দিয়া বলিল, উপীনদা এতদিন বাইরে ছিলেন, এই ত আশ্চর্য! কোথাও বেশিদিন থাকা তাঁর স্বভাব নয়। বিশেষ, বিয়ের পর থেকে একটা রাতও কোথাও রাখতে হলে মাথা-খোঁড়াখুঁড়ি করতে হয়। আগে, সমস্ত বিষয়েই তিনি আমাদের কর্তা ছিলেন, এখন, একে একে সব ছেড়ে দিয়ে ঘরের কোণ নিয়েছেন—আদালতে নিতান্তই না গেলে নয়, তাই বোধ করি, একটিবার যান। এই একবার দেখুন না—

বৌ বাধা দিয়া বলিল, বসো ঠাকুরপো, তোমার খাবার জায়গা করে দিয়ে বসি। তুমি খেতে খেতে গল্প করবে, সেই বেশ হবে। বলিয়া আসন পাতিয়া থালের উপর পরিপাটি করিয়া আহার্য সাজাইয়া দিয়া কাছে বসিয়া একান্ত আগ্রহের সহিত বলিল, তার পরে?

সতীশ একখণ্ড লুচি মুখে পুরিয়া দিয়া বলিল, সে একটা বিয়ে দিতে যাবার কথা, বৌঠাকরুন! উপীনদা একজন মস্ত ঘটক—কত লোকের যে বিয়ে দিয়েছেন ঠিক নেই। আমাদের দলের একটি ছেলের বিয়ে, উপীনদা ঘটকালি থেকে শুরু করে সমস্ত উদ্যোগ-আয়োজন নিজের হাতে করেন। অথচ, বিয়ের রাত্রে দাদাকে আর পাওয়া গেল না। ছোটবৌর শরীর ভাল নেই বলে কিছুতেই ঘর থেকে বার হলেন না। আমরা সমস্ত লোক মিলে ওঃ—সে কি অনুরোধ, বৌঠাকরুন! কিন্তু কিছুতেই না। পাথরের দেবতা হলে বর পাওয়া যেত, কিন্তু উপীনদাকে রাজী করা গেল না। ভাল আছি বলে ছোটবৌ নিজে অনুরোধ করাতে বললেন, তোমার ভাল-মন্দ বিবেচনা করবার ভার আমার ওপরে, তোমার নিজের ওপরে নয়, তুমি চুপ করো।

কিরণময়ী স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। তাহার সমস্ত বিগত জীবন, তাহারই হৃদয়ের অন্ধকার অন্তঃস্থলে নামিয়া আঁচড়াইয়া আঁচড়াইয়া কি যেন একটা রত্ন খুঁজিয়া ফিরিতে লাগিল। কিন্তু সতীশ কিছুই বুঝিল না। কোন্‌ কাহিনী কোথায় কি করিয়া বাজে, সে তার কি সংবাদ রাখে! সে বলিয়া চলিল, এই অনুপস্থিতিতে কে কিরূপ নিন্দা করিয়াছিল, কে কি বলিয়া উপহাস বিদ্রূপ করিয়াছিল, কত আনন্দ পণ্ড হইয়াছিল, এই-সব।
কিন্তু শ্রোতা কোথায়? এই তুচ্ছ কাহিনী হইতে কিরণময়ী তখন অনেক দূরে সরিয়া গিয়াছিল।

হঠাৎ একসময়ে সতীশ তাহার লুচি খাওয়া ও গল্প বলা বন্ধ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনি শুনচেন না—কি ভাবচেন?

কিরণময়ী চকিত হইয়া হাসিয়া বলিল, শুনচি বৈ কি ঠাকুরপো! কিন্তু আমি বলি, অসুখ-বিসুখে যত্ন করাই ত ভাল।

সতীশ উত্তেজিত হইয়া বলিল, ভাল, কিন্তু বাড়াবাড়ি করা কি ভাল? এই সেবার ছোটবৌর পান-বসন্ত হয়েছিল, উপীনদা আট-দশদিন তাঁর শিয়র থেকে উঠলেন না। বাড়িতে এত লোক আছে, তাঁর নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করার কি প্রয়োজন ছিল?

কিরণময়ী ক্ষণকাল তাহার মুখের পানে নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিল, আচ্ছা ঠাকুরপো, তোমার উপীনদা কি ছোটবৌকে বড্ড ভালবাসেন?

সতীশ তৎক্ষণাৎ বলিল, ওঃ—ভয়ানক ভালবাসেন।

কিরণময়ী আবার কতক্ষণ চুপ করিয়া চাহিয়া থাকিয়া বলিল, ছোটবৌ দেখতে কেমন ঠাকুরপো? খুব সুন্দরী?

হাঁ, খুব সুন্দরী।

কিরণময়ী মৃদু হাসিয়া বলিল, আমার মতন?

সতীশ মুখ নীচু করিয়া রহিল; খানিক পরে কি ভাবিয়া লইয়া মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি এ কথা সত্যিই জানতে চান?

সত্যি বৈ কি ঠাকুরপো।

সতীশ বলিল, দেখুন, আমার মতামতের বেশী দাম নেই। কিন্তু যদি থাকে, তা হলে এই বলি আমি, আপনার মত রূপ বোধ করি পৃথিবীতে আর নেই।

কিরণময়ী কি একটা জবাব দিতে যাইতেছিল, কিন্তু ঠিক এই সময়ে নীচে ডাকাডাকির শব্দে সে উঠিয়া পড়িল। মা কালীবাড়ি হইতে ফিরিয়া আসিয়াছেন।

সতীশ তাহার জল-খাওয়া শেষ করিয়া বাহিরে আসিতেই অঘোরময়ীর সম্মুখে পড়িয়া গেল। তিনি মুখপানে চাহিয়া বধূকে জিজ্ঞাসা করিলেন, উপীনের ভাই না বৌমা? সে কোথায়?

কিরণময়ী বলিল, তিনি বাড়ি ফিরে গেছেন।

অঘোরময়ী সংক্ষেপে ‘ভাল’ বলিয়া তাঁহার সিন্দূর ও চন্দনচর্চিত মুখখানি কালি করিয়া তাঁহার ছেলের ঘরের মধ্যে চলিয়া গেলেন।

সতীশ কহিল, আমি তবে যাই বৌঠাকরুন।
কিরণময়ী অন্যমনস্কভাবে বলিল, এস।

সতীশ দুই-এক পা গিয়াই ফিরিয়া আসিয়া বলিল, উপীনদা চিঠি দিয়েছেন। জানতে চেয়েছেন, হারানদার চিকিৎসা কিরূপ হচ্ছে।

কিরণময়ী বলিল, চিকিৎসা বন্ধ আছে। যে ডাক্তার দেখছিল, তাঁকে দেখান অমত; অথচ, কি মত, তাও বলে যাননি।

সতীশ আশ্চর্য হইয়া বলিয়া উঠিল, সে কি কথা! চিকিৎসা একেবারে বন্ধ করে বসে আছেন—এ কি রকম ব্যবস্থা?

ব্যবস্থা না করেই তিনি চলে গেছেন। আমার মনে হচ্চে, একবার যেন তিনি বলেছিলেন, সতীশ রইল, সে-ই ব্যবস্থা করবে—তুমি তো আসনি ঠাকুরপো।

সতীশ ক্ষণকাল অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া কহিল, কাল সকালেই আসব, বলিয়াই দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেল।

সতীশ চলিয়া গেলে, কিরণময়ী স্বামীর ঘরের কবাট একটুখানি খুলিয়া দেখিয়া লইল, তিনি একটা মোটা তাকিয়া হেলান দিয়া মায়ের সহিত আস্তে আস্তে কথা কহিতেছেন। তাঁহার আজো সন্ধ্যায় জ্বর আসে নাই, এই খবরটুকু লইয়াই সে নিঃশব্দে ফিরিয়া আসিল, এবং বাহিরের অন্ধকারে চুপ করিয়া বসিয়া অপূর্ব মমতার সহিত এইটুকুকে মনের মধ্যে লালন করিতে লাগিল। আজ সতীশের মুখে উপেন্দ্রর অধঃপতনের ইতিহাস তাহার সমস্ত বক্ষ মাধুর্যে ভরিয়া দিয়াছিল, আজ তাই যাহা কিছু এখানে আসিয়া পড়িল, তাহাই মধুর হইয়া কিরণময়ীকে অনির্বচনীয় রসে স্নিগ্ধ করিয়া দিতে লাগিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *