চন্দ্রনাথ – ১১-১৫

একাদশ পরিচ্ছেদ

সমস্ত রাত্রি মণিশঙ্কর ঘুমাইতে পারিলেন না। সারারাত্রি ধরিয়াই তাঁহার দুই কানের মধ্যে একটা ভারী গাড়ির গভীর আওয়াজ গুমগুম শব্দ করিতে লাগিল। প্রত্যুষেই শয্যা ত্যাগ করিয়া বাহিরে আসিলেন। দেখিলেন, গেটের উপর একজন অপরিচিত লোক দীনবেশে অর্ধ-সুপ্তাবস্থায় বসিয়া আছে। কাছে যাইতেই লোকটা উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আমি একজন পথিক। মণিশঙ্কর চলিয়া যাইতেছিলেন, সে পিছন হইতে ডাকিল, মণিশঙ্করবাবুর বাড়ি কি এই?

তিনি ফিরিয়া বলিলেন, এই।

তাঁহার সহিত কখন দেখা হ’তে পারে, ব’লে দিতে পারেন?

আমার নাম মণিশঙ্কর।

লোকটা সসম্ভ্রমে নমস্কার করিয়া বলিল, আপনার কাছেই এসেছি।

মণিশঙ্কর তাহার আপাদমস্তক বার বার নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন, কাশী থেকে কি আসছ বাপু?

আজ্ঞে হাঁ।

দয়াল পাঠিয়েছে?

আজ্ঞে হাঁ।

টাকার জন্য এসেছ?

আজ্ঞে হাঁ।

মণিশঙ্কর মৃদু হাসিয়া বলিলেন, তবে আমার কাছে কেন? আমি টাকা দেব, তাই কি তুমি মনে করেচ?

লোকটি ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না। দয়ালঠাকুর ব’লে দিয়েচেন, আপনি টাকা পাবার সুবিধে করে দিতে পারবেন।

মণিশঙ্কর ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, পারব। তবে ভেতরে এস।

দুইজনে নির্জন-কক্ষে দ্বার রুদ্ধ করিয়া বসিলেন। মণিশঙ্কর বলিলেন, সমস্ত তবে সত্য?

সমস্ত সত্য। এই বলিয়া সে কয়েকখানা পত্র বাহির করিয়া দিল। মণিশঙ্কর তাহা আগাগোড়া পাঠ করিয়া বলিলেন, তবে বউমার দোষ কি?

তার দোষ নেই, কিন্তু মায়ের দোষে মেয়েও দোষী হয়ে পড়েছে।

তবে যার নিজের দোষ নেই, তাকে কি জন্য বিপদগ্রস্ত করচ?
আমারও উপায় নেই। টাকার জন্য সব করতে হয়।

মণিশঙ্কর কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন, দেখ বাপু, এ দুর্নাম প্রকাশ পেলে আমারও অত্যন্ত লজ্জার কথা। চন্দ্রনাথ আমার ভ্রাতুষ্পুত্র।

রাখালদাস মাথা নাড়িয়া দৃঢ়ভাবে কহিল, আমি নিরুপায়।

সে কথা তোমার দিকে তাকালেই জানা যায়। ধর, টাকা যদি আমি নিজেই দিই, তা হ’লে কি রকম হয়!

ভালই হয়! আর ক্লেশ স্বীকার ক’রে চন্দ্রনাথবাবুর নিকট যেতে হয় না।

টাকা পেলেই তুমি গ্রাম ছেড়ে চ’লে যাবে, আর কোন কথা প্রকাশ করবে না, এ নিশ্চয়?

নিশ্চয়।

কত টাকা চাই?

অন্ততঃ দুই সহস্র।

মণিশঙ্কর বাহিরে গিয়া নায়েব লক্ষীনারায়ণকে ডাকিয়া দুই-তিনটি কথা বলিয়া দিলেন, তাহার পর ভিতরে আসিয়া একসহস্র করিয়া দুইখানি নোট বাক্স খুলিয়া রাখালদাসের হাতে দিয়া বলিলেন, এখান থেকে দশ ক্রোশ দূরে সরকারী খাজনা ঘর, সেখানে ভাঙ্গিয়ে নিয়ো, আর কোথাও ভাঙ্গান যাবে না । আর কখনো এ দিকে এসো না। আমি তোমার উপর সন্তুষ্ট নই, তাই আর যদি কখনো এ দিকে আসবার চেষ্টা কর, জীবিত ফিরতে পারবে না, তাও বলে দিলাম।

রাখালদাস চলিয়া গেল।

প্রাণপণে হাঁটিয়া অপরাহ্ণে সে শহরে উপস্থিত হইল। তখন কাছারি বন্ধ হইয়াছে। কোন কাজ হইল না। পরদিন সময়ে রাখালদাস খাজাঞ্চীর নিকট দুইখানি হাজার টাকার নোট দিয়া কহিল, টাকা চাই।

খাজাঞ্চীবাবু নোট দুইখনি ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিয়া, বসো, বলিয়া বাইরে গিয়া একজন পুলিশের দারোগা সঙ্গে লইয়া ফিরিয়া আসিয়া রাখালকে দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, এই নোট চুরি হয়েছে। জমিদার মণিশঙ্করবাবুর লোক বলচে, কাল সকালে ভিক্ষার ছল ক’রে তাঁর ঘরে ঢুকে এই দু’খানি নোট চুরি করেচে। নোটের নন্বর মিলচে।

রাখালদাস কহিল, জমিদারবাবু নিজে দিয়েছেন।

খাজাঞ্চী কহিল, বেশ হাকিমের কাছে বলো।

যথাসময়ে হাকিমের কাছে রাখাল বলিল, যাঁর টাকা, তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেই সমস্ত পরিষ্কার হবে। বিচারের দিন ডেপুটির আদালতে জমিদার মণিশঙ্কর উপস্থিত হইয়া হলফ লইয়া বলিলেন, তিনি লোকটাকে জীবনে কখনও দেখেন নাই। নোট তাহারই বাক্সে ছিল, কাহাকেও দেন নাই। রাখাল নিজেকে বাঁচাইবার জন্য অনেক কথা কহিতে চাহিল, হাকিম তাহা কতক কতক লিখিয়া লইলেন, কতক বা মণিশঙ্করের উকিল-মোক্তার গোলমাল করিয়া দিল। মোটের উপর, কথা কেহই বিশ্বাস করিল না, ডেপুটি তাহার দুই বৎসর সশ্রম কারাবাসের হুকুম করিলেন।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

হরিদয়ালের বাটীতে পুরাতন দাসীটি পর্যন্ত নাই। বামুন-ঠাকরুন ত সম্পূর্ণ নিরুদ্দেশ। সরযূ যখন প্রবেশ করিল, তখন বাটীতে কেহ নাই, শূন্য বাটী হাহা করিতেছে। বৃদ্ধ সরকার কাঁদিয়া কহিল, মা, আমি তবে যাই?

সরযূ প্রণাম করিয়া নতমুখে দাঁড়াইয়া রহিল। সরকার কাঁদিতে কাঁদিতে প্রস্থান করিল—দয়ালঠাকুরের আগমন পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে পারিল না—ইচ্ছাও ছিল না।

সন্ধ্যার সময় দয়াল বাটী আসিলেন। সরযূকে দয়াল বসিয়া থাকিতে দেখিয়া বলিলেন, কে?

সরযূ প্রণাম করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। মুখ তুলিয়া বলিল, আমি।

সরযূ!—দয়াল বিস্মিত হইয়া মনোযোগ-সহকারে দেখিলেন, সরযূর গাত্রে একখানিও অলঙ্কার নাই, পরিধেয় বস্ত্র সামান্য, দাসদাসী কেহ সঙ্গে আসে নাই, অদূরে একটা বাক্স মাত্র পড়িয়া আছে। ব্যাপারটা সমস্ত বুঝিয়া লইয়া বিদ্রূপ করিয়া বলিলেন, যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই হয়েচে। তাড়িয়ে দিয়েচে?

সরযূ মৌন হইয়া রহিল।

দয়ালঠাকুর তখন অতিশয় কর্কশ-কণ্ঠে কহিলেন, এখানে তোমার স্থান হবে না। একবার আশ্রয় দিয়ে আমার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েচে—আর নয়।

সরযূ মাথা হেঁট করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, মা কোথায়?

মাগী পালিয়েচে। আমাকে ডুবিয়ে দিয়ে স’রে পড়েচে, যেমন চরিত্র, সেইরূপ করেচে। রাগে তাঁহার সর্বাঙ্গ পুড়িয়া যাইতেছিল, হঠাৎ ব্যঙ্গ করিয়া বলিয়া উঠিলেন, বলা যায় না—হয়ত কোথাও খুব সুখেই আছে।

সেইখানে সরযূ বসিয়া পড়িল। সে যে অবশেষে তাহার মায়ের কাছেই ফিরিয়া আসিয়াছিল।

দয়াল বলিতে লাগিলেন, আমি তোমাকে স্থান দিয়ে জাত হারাতে চাইনে! যারা আদর ক’রে নিয়ে গিয়েছিল, শেষকালে তারা কি তোমার মাথা রাখবার একটু কুঁড়েও বেঁধে দিতে পারেনি, তাই রেখে গেছে আমার কাছে? যাও এখান থেকে।

এবার সরযূ কাঁদিয়া ফেলিল, বলিল, দাদামশাই, মা নেই, আমি যাব কোথায়?

হরিদয়ালের শরীরে আর মায়া-মমতা নাই। তিনি স্বচ্ছন্দে বলিলেন, কাশীর মত স্থানে তোমাদের স্থানাভাব হয় না। সুবিধামত একটা খুঁজে নিয়ো। তিনি নাকি বড় জ্বালায় জ্বলিতেছিলেন, তাই এমন কথাটাও কহিতে পারিলেন।

সরযূর স্বামী তাঁহাকে গৃহে স্থান দেয় নাই, হরিদয়াল দিবেন কেন? ইহাতে তাঁহাকে দোষ দিবার কিছু নাই, সরযূ তাহা বুঝিল। কিন্তু তাহারও যে আর দাঁড়াইবার স্থান নাই। স্বামীর গৃহে দু’দিনের আদর-যত্নে অতিথির মত গিয়াছিল—এখন বিদায় হইয়া আসিয়াছে। এ সংসারে, সেই যত্নপরায়ণ গৃহস্থ আর ফিরিয়া দেখিবে না, অতিথিটি কোথায় গেল! বড় যাতনায় তাহার নীরব-অশ্রু গণ্ড বাহিয়া পড়িতেছিল। এই তাহার সতেরো বছর বয়স—তাহার সব সাধ ফুরাইয়াছে! মাতা নাই, পিতা নাই, স্বামী পরিত্যাগ করিয়াছেন। দাঁড়াইবার স্থান নাই, আছে শুধু কলঙ্ক, লজ্জা আর বিপুল রূপযৌবন ।

এ নিয়ে বাঁচা চলে, কিন্তু সরযূর চলে না। সে ভাবিতেছিল, তাহার কত আয়ু, আর কতদিন বাঁচিতে হইবে! যতদিন হউক, আজ তাহার নূতন জন্মদিন। যদিও দুঃখকষ্টের সহিত তাহার পূর্বেই পরিচয় ঘটিয়াছে, কিন্তু এরূপ তীব্র অপমান এবং লাঞ্ছনা কবে সে ভোগ করিয়াছে? দয়ালঠাকুর উত্তরোত্তর উত্তেজিত-কণ্ঠে কথা কহিতেছিলেন, এবার চিৎকার করিয়া উঠিলেন, ব’সে রইলে যে?

সরযূ আকুলভাবে জিজ্ঞাসা করিল, কোথায় যাব?

আমি তার কি জানি ?

সরযূ রুদ্ধকণ্ঠে বলিল, দাদামশাই, আজ রাত্রি—

দূর দূর, একদণ্ডও না।

এবার সরয়ূ উঠিয়া দাঁড়াইল। চকিতে মনে একটু সাহস হইল, মনে করিল, যাহার কাছে শত অপরাধেও ভিক্ষা চাহিবার অধিকার ছিল, তাহার কাছেই যখন চাহি নাই, তখন পরের কাছে চাহিব কি জন্য? মনে মনে বলিল, আর কিছু না থাকে কাশীর গঙ্গা ত এখনও শুকায় নাই, সে সমাজের ভয়ও করে না, তাহার জাতিও যায় না; এ দুঃখের দিনে একটি দুঃখী মেয়েকে স্বচ্ছন্দে কোলে তুলিয়া লইবে। আমার আর কোথাও আশ্রয় না থাকে সেখানে থাকিবেই। সরযূ চলিতে লাগিল, কিন্তু চলিতে পারিল না, আবাব বসিয়া পড়িল।

দয়ালঠাকুর ভাবিলেন, এমন বিপদে তিনি জন্মে পড়েন নাই। তাঁহার গলাটা শুকাইয়া আসিতেছিল; পাছে অবশেষে দমিয়া পড়েন, এই ভয়ে চিৎকার করিয়া কহিলেন, অপমান না হলে বুঝি যাবে না? এই বেলা দূর হও—

এমন সময় সহসা বাহির হইতে ডাক আসিল, বাবাজী!

হরিদয়াল ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন । ঐ বুঝি খুড়ো আসচে। বলিতে বলিতেই কৈলাসচন্দ্র এক হাতে দাবার পুঁটুলি, অপর হাতে হুঁকা লইয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন। তিনি যে এইমাত্র আসিয়াছিলেন, তাহা নহে; গোলমাল শুনিয়া বাহিরে দাঁড়াইয়া হরিদয়ালের তিরষ্কার ও গালিগালাজ শুনিতেছিলেন । তাই যখন ভিতরে প্রবেশ করিলেন, তখন হাতে দাবার পুঁটুলি ও হুঁকা ছিল, কিন্তু মুখে হাসি ছিল না। সোজা সরযূর কাছে আসিয়া দাঁডাইয়া কহিলেন, সরযূ যে! কখন এলে মা?

সরযূ কৈলাসখুড়োকে চিনিত, প্রণাম করিল।

তিনি আশীর্বাদ করিলেন, এস মা, এস। তোমাদের ছেলের বাড়িতে না গিয়ে এখানে কেন মা? তাহার পর হুঁকা নামাইয়া রাখিয়া সরযূর টিনের বাক্সটা একেবারে কক্ষে তুলিয়া লইয়া বলিলেন, চল মা, সন্ধ্যা হয়। কথাগুলি তিনি এরূপভাবে কহিলেন, যেন তাহাকে লইবার জন্যই আসিয়াছিলেন!

সরযূ কোন কথাই পরিস্কার বুঝিতে পারিল না, অধোমুখে বসিয়া রহিল।

কৈলাসচন্দ্র ব্যস্ত হইলেন, কহিলেন, তোর বুড়ো ছেলের বাড়ি যেতে লজ্জা কি? সেখানে কেউ তোকে অপমানের কথা বলবে না, মা-ব্যাটায় মিলে নূতন করে ঘরকন্না করব। চল মা, দেরি করিস নে।

সরযূ তথাপি উঠতে পারিল না। হরিদয়াল হাঁকিয়া বলিলেন, খুড়ো, কি করচো?

কিছু না বাবাজী। কিন্তু তখনই সরযূর খুব নিকটে আসিয়া হাতখানি প্রায় ধরিয়া ফেলিবার মত করিয়া নিতান্ত কাতরভাবে বলিলেন, চল্‌ না মা, বসে বসে কেন মিছে কটু কথা শুনচিস?

সরযূ উঠিয়া দাঁডাইল দেখিয়া হরিদয়াল কহিলেন, খুড়ো কি একে বাড়ি নিয়ে যাচ্চ?

খুড়ো জবাব দিলেন, না বাবা, রাস্তায় বসিয়ে দিতে যাচ্চি।

ব্যঙ্গোক্তি শুনিয়া হরিদয়াল বিরক্ত হইয়া বলিলেন, কিন্তু খুড়ো কাজটি ভাল হচ্চে না। কাল কি হবে, ভেবে দেখো।
কৈলাস তাহার উত্তর দিলেন না, কিন্তু সরযূকে কহিলেন, শিগ্‌গির চল না মা, নইলে আবার হয়ত কি ব’লে ফেলবে।

সরযূ দরজার বাহিরে আসিয়া পড়িল। কৈলাসচন্দ্রও ঘাড়ে বাক্স লইয়া পশ্চাতে চলিলেন।

হরিদয়াল পিছন হইতে কহিলেন, খুড়ো, শেষে কি জাতটা দেবে?

কৈলাসচন্দ্র না ফিরিয়াই বলিলেন, বাবাজী, নাও ত দিতে পারি।

আমাদের সঙ্গে তবে আহার বন্ধ হ’ল।

কৈলাসচন্দ্র এবার ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, কবে কার বাড়িতে দয়াল, কৈলাসখুড়ো পাত পেতেছে?

তা না পাত, কিন্তু সাবধান করে দিচ্চি।

কৈলাস ভ্রূ-কুঞ্চিত করিলেন। তাঁহার সুদীর্ঘ কাশীবাসের মধ্যে আজ তাঁহার এই প্রথম ক্রোধ দেখা দিল। বলিলেন, হরিদয়াল, আমি কি কাশীর পাণ্ডা, না যজমানের মন জুগিয়ে অন্নের সংস্থান করি? আমাকে ভয় দেখাচ্চ কেন? আমি যা ভাল বুঝি, তাই চিরদিন করেচি, আজও তাই করব। সেজন্য তোমার দুর্ভাবনার আবশ্যক নেই।

হরিদয়াল শুষ্ক হইয়া কহিলেন, তোমার ভালর জন্য—

থাক বাবাজী! যদি এই পঁয়ষট্টি বছর তোমার পরামর্শ না নিয়েই কাটাতে পেরে থাকি, তখন বাকি দু’চার বছর পরামর্শ না নিলেও আমার কেটে যাবে। যাও বাবাজী, ঘরে যাও।

হরিদয়াল পিছাইয়া পড়িলেন।

কৈলাসচন্দ্র বাটীতে পৌঁছিয়া বাক্স নামাইয়া সহজভাবে বলিলেন, এ ঘরবাড়ি সব তোমার মা, আমি তোমার ছেলে। বুড়োকে একটু-আধটু দেখো, আর তোমার নিজের ঘরকন্না চালিয়ে নিয়ো, আর কি বলব?

কৈলাসের আর কোন কথা কহিবার ছিল কি না, বলিতে পারি না, কিন্তু সরযূ বহুক্ষণ অবধি অশ্রু মুছিতে মুছিতে ভাবিয়া দেখিল, তাহার কোন কথাই আর বলিবার নাই।

সরযূ আশ্রয় পাইল।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

শরৎকালে প্রাতঃসমীরণ যখন স্নিগ্ধ-মধুর সঞ্চরণে চন্দ্রনাথের কক্ষে প্রবেশ করিত, সারা রাত্রির দীর্ঘ জাগরণের পর চন্দ্রনাথ এই সময়টিতে ঘুমাইয়া পড়িত। তাহার পর তপ্ত সূর্যরশ্মি জানালা দিয়া তাহার মুখের উপর, চোখের উপর পড়িত, চন্দ্রনাথের আবার ঘুম ভাঙ্গিয়া যাইত। কিন্তু ঘুমের ঘোর কিছুতেই কাটিতে চাহিত না, পাতায় পাতায় জড়াইয়া থাকিত, তথাপি সে জোর করিয়া বিছানা ছাড়িয়া বাহিরে আসিয়া পড়িত। সারাদিন কাজকর্ম নাই, আমোদ নাই, উৎসাহ নাই, দুঃখ-ক্লেশও প্রায় নাই; সুখের কামনা ত সে একেবারেই ছাড়িয়া দিয়াছে। শীর্ণকায়া নদীর উপর দিয়া সন্ধ্যার দীর্ঘ ভারবাহী তরণী যেমন করিয়া এপাশ ওপাশ করিয়া হেলিয়া দুলিয়া বাঁকিয়া চুরিয়া মন্থরগমনে স্বেচ্ছামত ভাসিয়া যায়, চন্দ্রনাথের ভাবী দিনগুলাও ঠিক তেমনি করিয়া এক সূর্যোদয় হইতে পুনঃ সূর্যোদয় পর্যন্ত ভাসিয়া যাইতে থাকে। সে নিঃসংশয়ে বুঝিয়াছে, যে দিগন্ত-প্রসারিত কালোমেঘ তাহার মুখের সূর্যকে জীবনের মধ্যাহ্নেই আচ্ছাদিত করিয়াছে, এই মেঘের আড়ালেই একদিন সে সূর্য অস্তগমন করিবে। ইহজীবনে আর সাক্ষাৎলাভ ঘটিবে না। তাহার নীবব, নির্জন কক্ষে এই নিরাশার কালো ছায়াই প্রতিদিন ঘন হইতে ঘনতর হইতে লাগিল এবং তাহারি মাঝখানে বসিয়া চন্দ্রনাথ অলস-নিমীলিত চোখে দিন কাটাইয়া দিতে লাগিল।

হরকালী বলেন, এই অগ্রহায়ণ মাসেই চন্দ্রনাথের আবার বিবাহ হইবে। চন্দ্রনাথ চুপ করিয়া থাকে। এই চুপ করিয়া থাকা সম্মতি বা অসম্মতির লক্ষণ, তাহা নির্ণয় করিতে স্বামীর সঙ্গে তাঁহার তর্ক-বিতর্ক হয়। মণিশঙ্করবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলেন, চন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা না করিয়া কিছু বলা যায় না।

এবার কার্তিক মাসে দুর্গাপূজা। মণিশঙ্করের ঠাকুর-দালান হইতে সানাইয়ের গান প্রাতঃকাল হইতে গ্রামবাসীদের কানে কানে আগামী আনন্দের বার্তা ঘোষণা করিতেছে। চন্দ্রনাথের ঘুম ভাঙ্গিয়াছিল। নিমীলিতচক্ষে বিছানায় পড়িয়া শুনিতেছিল, একে একে কত কি সুর বাজিয়া যাইতেছে। কিন্তু একটা সুরও তাহার কাছে আনন্দের ভাষা বহিয়া আনিল না; বরঞ্চ ধীরে ধীরে হৃদয়-আকাশ গাঢ় কালোমেঘে ছাইয়া যাইতে লাগিল। আজ হঠাৎ তাহার মনে হইল, এখানে আর ত থাকা যায় না; একজন ভৃত্যকে ডাকিয়া কহিল, আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নে, রাত্রির গাড়িতে এলাহাবাদ যাব।

এ কথা হরকালী শুনিতে পাইয়া ছুটিয়া আসিলেন, ব্রজকিশোর আসিয়া বুঝাইতে লাগিলেন, এমন কি মণিশঙ্কর নিজে আসিয়াও অনুরোধ করিলেন যে আজ ষষ্ঠীর দিনে কোথাও গিয়া কাজ নাই।

চন্দ্রনাথ কাহারও কথা শুনিল না।

দুপুরবেলা হরিবালা আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সরযূ গিয়া অবধি এ বাটীতে তিনি আসেন নাই।

চন্দ্রনাথ তাঁহাকে দেখিয়া বলিল, হঠাৎ ঠানদিদি কি মনে ক’রে!

ঠানদিদি জবাব না দিয়া প্রশ্ন করিলেন, আজ বিদেশে যাচ্চ?

চন্দ্রনাথ বলিল, যাচ্চি।

পশ্চিমে যাবে?

যাবো।

হরিবালা কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া মৃদুস্বরে বলিলেন, দাদা, আর কোথাও যাবে কি?

চন্দ্রনাথ হরিবালার অভিপ্রায় বুঝিয়া বলিল, না। তাহার পর অন্যমনস্কভাবে এটা-ওটা নাড়িতে লাগিল।

হরিবালা যে কত কথা বলিতে আসিয়াছিলেন, তাহা বলিতে তাঁহার লজ্জা করিতেছেল, সাহসও হইতেছিল না। কিন্তু কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সাহস করিয়া বলিয়া ফেলিলেন, দাদা, তার একটা উপায় করলে না? দুইজনের দেখা হওয়া অবধি দুইজনেই মনে মনে তাহার কথাই ভাবিতেছিল,—তাই এই সামান্য কথাটিতে দুইজনের চক্ষেই জল আসিয়া পড়িল। চন্দ্রনাথ সামলাইয়া লইয়া অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া কহিল, উপায় আর কি করব দিদি?

কাশীতে সে আছে কোথায়?

বোধ হয়, তার মায়ের কাছে আছে।

তা আছে, কিন্তু—

চন্দ্রনাথ মুখপানে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু কি?

ঠানদিদি ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া মৃদুকন্ঠে কহিলেন, রাগ করো না দাদা—

চন্দ্রনাথ নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল।

ঠানদিদি তেমনি মৃদু মিনতির স্বরে বলিলেন, কিছু টাকাকড়ি দিয়ো দাদা—আজ যেন সে একলা আছে, কিন্তু দু’দিন পরে—

চন্দ্রনাথ কথাটা বুঝিয়াও বুঝিল না, বলিল, কি দু’দিন পরে?

বড় বড় দু’ফোটা চোখের জল হরিবালা চন্দ্রনাথের সম্মুখেই মুছিয়া ফেলিলেন। বলিলেন, তার পেটে যা আছে, ভালয় ভালয় তা যদি বেঁচে-বত্তে থাকে, তা হ’লে—

চন্দ্রনাথের আপাদমস্তক কাঁপিয়া উঠিল, তাড়াতাড়ি সে বলিয়া উঠিল, ঠানদিদি আজ বুঝি ষষ্ঠী?

হ্যাঁ, ভাই।

আজ তা হ’লে—

যাবে না মনে কচ্চ?

তাই ভাবছি।

তবে তাই করো। পূজোর’পর যেখানে হয় যেয়ো, এ ক’টা দিন বাড়িতেই থাক।

কি জানি কি ভাবিয়া চন্দ্রনাথ তাহাতেই সম্মত হইল।

বিজয়ার পর একদিন চন্দ্রনাথ গোমস্তাকে ডাকিয়া বলিল, সরকারমশাই, কাশীতে তাকে রেখে আসবার সময় হরিদয়াল কি কিছু ব’লে দিয়েছেলেন?

সরকার কহিল, তাঁর সঙ্গে আমার ত দেখা হয় নি।

চন্দ্রনাথ ভয় পাইয়া কহিল, দেখা হয় নি? তবে কার কাছে দিয়ে এলেন? তার মায়ের সঙ্গে ত দেখা হয়েছিল?

সরকার মাথা নাড়িয়া বলিল, আজ্ঞে না, বাড়িতে ত কেউ ছিল না।

কেউ ছিল না? সে বাড়িতে কেউ থাকে কি না, সে সংবাদ নিয়েছিলেন ত? হরিদয়াল আর কোথাও উঠে যেতেও ত পারেন!

সরকার কহিল, সে সংবাদ নিয়েছিলাম। দয়াল ঘোষাল সেই বাড়িতে থাকতেন।

চন্দ্রনাথ নিঃশ্বাস ফেলিয়া ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, এ পর্যন্ত কত টাকা পাঠিয়েছেন?

আজ্ঞে, টাকাকড়ি ত কিছু পাঠাই নি।

পাঠান নি! চন্দ্রনাথ বিস্ময়ে, বেদনায়, উৎকণ্ঠায় পাংশুবর্ণ হইয়া কহিল, কেন?

সরকার লজ্জায় ম্রিয়মাণ হইয়া কহিল, মামাবাবু বলেন, পাঁচ টাকার হিসাবে কিছু পাঠালেই হবে।

জবাব শুনিয়া চন্দ্রনাথ অগ্নিমূর্তি হইয়া উঠিল।

পাঁচ টাকার হিসাবে? কেন, টাকা কি মামাবাবুর? আপনি প্রতি মাসে কাশীর ঠিকানায় পাঁচ শ টাকা করে পাঠাবেন।

সরকার, যে আজ্ঞে, বলিয়া স্তম্ভিত হইয়া ধীরে ধীরে সরিয়া গেল।

হরকালী এ কথা শুনিয়া চক্ষু কপালে তুলিয়া বলিলেন, সে পাগল হয়েচে। সরকারকে তলব করিয়া অন্তরাল হইতে জোর করিয়া হাসিলেন। হাসির ছটা ও ঘটা বৃদ্ধ সরকার শুনিতেও পাইলো, বুঝিতেও পারিল। হরকালী কহিলেন, সরকারমশাই, কত টাকা পাঠাতে বলেচে?

প্রতিমাসে পাঁচ শ টাকা।

ভিতর হইতে পুনর্বার বিদ্রূপের হাসি শুনিয়া সরকার ব্যস্ত হইয়া পড়িল।

হরকালী অনেক হাসিয়া পরিশেষে গম্ভীর হইলেন। ভিতর হইতে বলিলেন, আহা, বাছার রাগ হ’লে আর জ্ঞান থাকে না। সে পোড়া-কপালীর যেমন অদৃষ্ট! আমি পাঁচ টাকা ক’রে দিতে বলেচি, তাই রেগে উঠেচে। বলে, পাঁচ শ টাকা করে দিও। বুঝলেন সরকারমশায়, চন্দ্রনাথের ইচ্ছা নয় যে, এক পয়সাও দেওয়া হয়।

কথাটা কিন্তু সরকার মহাশয় প্রথমে তেমন বুঝিল না; কিন্তু মনে মনে যত হিসাব করিল, তত বোধ হইতে লাগিল, হরকালীর কথাটাই সত্য। যাহাকে বাড়ি হইতে বাহির করা হইয়াছে, তাহাকে কি কেহ ইচ্ছাপূর্বক অত টাকা দেয়?

ভাবিয়া চিন্তিয়া সে বলিল, তা আপনি যা বলেন।

বলব আর কি! এই সামান্য কথাটা বুঝলেন না?

সরকার মহাশয় অপ্রতিভ হইয়া বলিল, তাই হবে।

হ্যাঁ, তাই। আপনি কিন্তু পাঁচ টাকা হিসাবে পাঠাবেন। চন্দ্র না দেয়, আমার হিসেব থেকে পাঁচ টাকা পাঠাবেন।

হরকালী মাসিক পঞ্চাশ টাকা করিয়া নিজের হিসাবে হাতখরচ পাইতেন।

সরকার মহাশয় প্রস্থান করিবার সময় বলিল, তাই পাঠাব।

চন্দ্রনাথ বাড়ি নাই। এলাহাবাদ গিয়াছে। সরকার মহাশয় তাহাকে পত্র লিখিয়া মতামত জানিবার ইচ্ছা করিল, কিন্তু পরে মনে হইল, এরূপ অসম্ভব কথা লইয়া অনর্থক তোলাপাড়া করিয়া নিজের বুদ্ধিহীনতার পরিচয় দিয়া লাভ নাই।

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

উপরিউক্ত ঘটনার পর দুই বৎসর অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে। এই দুই বৎসরে আর কোন পরিবর্তন হউক বা না হউক, কৈলাশখুড়ার জীবনে বড় পরিবর্তন ঘটিয়াছে। যেদিন তাঁহার কমলা চলিয়া গিয়াছিলেন, যেদিন তাঁহার কমলচরণ সর্বশেষ নিশ্বাসটি ত্যাগ করিয়া ইহজীবনের মত চক্ষু মুদিয়াছিল, সেই দিন হইতে বিপুল বিশ্বও কৈলাশচন্দ্রের পক্ষে চক্ষু মুদিয়াছিল; কিন্তু সরযূর ওই ক্ষুদ্র শিশুটি তাঁহাকে পুনর্বার সেই বিস্মৃত-সংসারের স্নেহময় জটিল-পথে ফিরাইয়া আনিয়াছে। সেদিন তাঁহার ক্ষুদ্র চক্ষু-দু’টি বহুদিন পরে আর-একবার জলে ভরিয়া গিয়াছিল, চক্ষু মুছিয়া বলিয়াছিলেন, আমার ঘরে বিশ্বেশ্বর এসেছেন।

তখনও সে ছোট ছিল; ‘বিশু’ বলিয়া ডাকিলে উত্তর দিতে পারিত না, শুধু চাহিয়া থাকিত। তখন সে সরযূর ক্রোড়ে, লখীয়ার মার ক্রোড়ে এবং বিছানায় শুইয়া থাকিত; কিন্তু যেদিন হইতে সে তাহার চঞ্চল পা-দু’টি চৌকাঠের বাহিরে লইয়া যাইতে শিখিয়াছে, সেদিন হইতে সে বুঝিয়াছে, দুধের চেয়ে জল ভাল এবং দ্বিধাশূন্য হইয়া পরিষ্কার-অপরিষ্কার সর্ববিধ জলপাত্রেই মুখ ডুবাইয়া সরযূকে ফাঁকি দিয়া আকণ্ঠ জল খায় এবং যেদিন হইতে তাহার বিশ্বাস জন্মিয়াছে যে, তাহার শুভ্রকোমল উদর এবং মুখের উপর কয়লা কিংবা ধূলার প্রলেপ দিতে পারিলেই দেহের শোভা বাড়ে, সেইদিন হইতে সে সরযূর কোল ছাড়িয়া মাটি এবং তথা হইতে কৈলাসচন্দ্রের ক্রোড়ে স্থান করিয়া লইয়াছে। সকালবেলা কৈলাসচন্দ্র ডাকেন, ‘বিশু’, বিশু মুখ বাড়াইয়া বলে, ‘দাদু’; কৈলাসচন্দ্র বলেন, ‘চল ত দাদা, শম্ভু মিশিরকে এক বাজি দিয়ে আসি’, সে অমনি দাবার পুঁটলিটা হাতে লইয়া ‘তল’ বলিয়া দুই বাহু প্রসারিত করিয়া বৃদ্ধের গলা জড়াইয়া ধরে। কৈলাসচন্দ্রের আনন্দের সীমা থাকে না। সরযূকে ডাকিয়া বলেন, মা, বিশু আমার একদিন পাকা খেলোয়াড় হবে। সরযূ মুখ টিপিয়া হাসে, বিশু দাবার পুঁটলি হাতে লইয়া বৃদ্ধের কোলে বসিয়া দাবা খেলিতে বাহির হয়। পথে যাইতে যদি কেহ তামাশা করিয়া কহে, খুড়ো, বুড়ো-বয়সে কি আরও দুটো হাত গজিয়েছে?

বৃদ্ধ একগাল হাসিয়া বলেন, বাবাজী, এ হাত-দুটোতে আর জোর নেই, বড় শুকনো হয়ে গেছে; তাই দু’টো নতুন হাত বেরিয়েচে, যেন সংসারের গাছ থেকে প’ড়ে না যাই।

তাহারা সরিয়া যায়—বুড়োর কাছে কথায় পারিবার জো নেই।

শম্ভু মিশিরের বাটীতে সতরঞ্চ খেলার মধ্যে শ্রীমান্‌ বিশ্বেশ্বরেরও একটা নির্দিষ্ট স্থান আছে। দাদামহাশয়ের জানুর উপর বসিয়া, লাল রঙের কোঁচা ঝুলাইয়া, গম্ভীরভাবে চাহিয়া থাকে, যেন দরকার হইলে সেও দুই-একটা চাল বলিয়া দিতে পারে।

হস্তীদন্তনির্মিত বলগুলা যখন একটির পর একটি করিয়া তাহার দাদামহাশয়ের হস্তে নিহত হইতে থাকে, অতিশয় উৎসাহের সহিত বিশ্বেশ্বর সেগুলি দুই হাতে লইয়া পেটের উপর চাপিয়া ধরে। কিন্তু লাল রঙের মন্ত্রীটার উপরই তাহার ঝোঁকটা কিছু অধিক। সেটা যতক্ষণ হাতে না আসিয়া উপস্থিত হয়, ততক্ষণ সে লোলুপদৃষ্টিতে চাহিয়া থাকে।

মাঝে মাঝে তাগিদ দিয়া কহে, দাদু ঐতে? কৈলাসচন্দ্র খেলার ঝোঁকে অন্যমনস্ক হইয়া কহেন, দাঁড়া দাদা—। কখনও হয়ত বা সে আশেপাশে সরিয়া যায়, কৈলাসচন্দ্রের মনটিও চঞ্চলভাবে একবার বিশু ও একবার সতরঞ্চের উপর আনাগোনা করিতে থাকে, গোলমালে হয়ত বা একটা বল মারা পড়ে—কৈলাসচন্দ্র অমনি ফিরিয়া ডাকেন, দাদু, হেরে যাই যে—আয় আয় ছুটে আয়। বিশ্বেশ্বর ছুটিয়া আসিয়া তাহার পূর্বস্থান অধিকার করিয়া বসে, সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধেরও দ্বিগুণ উৎসাহ ফিরিয়া আসে। খেলা শেষ হইলে সে লাল মন্ত্রীটা হাতে লইয়া দাদামহাশয়ের কোলে উঠিয়া বাটী ফিরিয়া যায়।

কৈলাসচন্দ্রের এইরূপে নূতন ধরনের দিনগুলা কাটে। পুরাতন বাঁধা নিয়মে বিষম বাধা পড়িয়াছে। সাবেক দিনের মত দাবার পুঁটলি আর সব সময়ে তেমন যত্ন পায় না, হয়ত বা ঘরের কোণে একবেলা পড়িয়া থাকে; শম্ভু মিশিরের সহিত রোজ সকালবেলা হয়ত বা দেখাশুনা করিবার সুবিধা ঘটিয়া উঠে না। গঙ্গা পাঁড়ের দ্বিপ্রাহরিক খেলাটা ত একরূপ বন্ধ হইয়া গিয়াছে, সন্ধ্যার পর মুকুন্দ ঘোষের বৈঠকখানায় আর তেমন লোক জমে না,—মুকুন্দ ঘোষ ডাকিয়া ডাকিয়া হার মানিয়াছে—কৈলাসচন্দ্রকে রাত্রে আর কিছুতেই পাওয়া যায় না। সে সময়টা তিনি প্রদীপের আলোকে বসিয়া নূতন শিষ্যটিকে খেলা শিখাইতে থাকেন; বলেন, বিশু, ঘোড়া আড়াই পা চলে।

বিশু গম্ভীরভাবে বলে, ঘোয়া—

হাঁ ঘোড়া—

ঘোয়া চলে—ভাবটা এই যে, ঘোড়া চলে।

হাঁ, ঘোড়া চলে, আড়াই পা চলে।

বিশ্বেশ্বরের মনে নূতন ভাবোদয় হয়, বলে গায়ী চয়ে—

কৈলাসচন্দ্র প্রতিবাদ করিয়া বলেন, না দাদা, এ ঘোড়া গাড়ি টানে না। সে ঘোড়া আলাদা।

সরযূ এ সময়ে নিকটে থাকিলে, পুত্রের বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা দেখিয়া মুখে কাপড় দিয়া হাসিয়া চলিয়া যায়।

বিশু আঙুল বাড়াইয়া বলে, ঐতে। অর্থাৎ সেই লাল রঙের মন্ত্রীটা এখন চাই। বৃদ্ধ কিছুতেই বুঝিয়া উঠিতেন না যে, এতগুলা দ্রব্য থাকিতে ঐ লাল মন্ত্রীটার উপরেই তাহার এত নজর কেন?

প্রার্থনা কিন্তু অগ্রাহ্য হইবার জো নাই। বৃদ্ধ প্রথমে দুই-একটা ‘বোড়ে’ হাতে দিয়া ভুলাইবার চেষ্টা করিতেন; বিশু বড় বিজ্ঞ, কিছুতেই ভুলিত না। তখন অনিচ্ছা-সত্ত্বে তাহার ক্ষুদ্র হস্তে প্রার্থিত বস্তুটি তুলিয়া দিয়া বলিতেন, দেখিস দাদা, যেন হারায় না।

কেন?

মন্ত্রী হারালে কি খেলা চলে?

চয়ে না?

কিছুতেই না।

বিশু গম্ভীর হইয়া বলিত, দাদু—মন্‌তী!

হাঁ দাদু—মন্ত্রী!

সেদিন ভোলানাথ চাটুয্যের বাটীতে কথা হইতেছিল, কৈলাসচন্দ্র ডাকিলেন, বিশু, চল দাদা, কথা শুনে আসি।

বিশ্বেশ্বর তখন লাল কাপড় পরিয়া, জামা গায়ে দিয়া, টিপ পরিয়া, চুল আঁচড়াইয়া দাদুর কোলে চড়িয়া কথা শুনিতে গেল। কথকঠাকুর রাজা ভরতের উপাখ্যান কহিতেছিলেন। করুণকণ্ঠে গাহিতেছিলেন, কেমন করিয়া সেই বনবাসী মহাপুরুষের ক্রোড়ের নিকট হরিণ-শিশু ভাসিয়া আসিয়াছিল, কেমন করিয়া সেই সদ্যঃপ্রসূত মৃগ-শাবক কাতরনয়নে আশ্রয় ভিক্ষা চাহিয়াছিল। আহা, রাজা ভরত নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দিয়াছিলেন। এই সময় বিশু একটু সরিয়া বসিয়াছিল, কৈলাসচন্দ্র তাহাকে কোলের উপর টানিয়া লইলেন।

তাহার পর কথক গাহিলেন, সেই মৃগ-শিশু কেমন করিয়া পলে পলে, দণ্ডে দণ্ডে, দিনে দিনে তাঁহার ছিন্ন স্নেহডোর আবার গাঁথিয়া তুলিতে লাগিল, কেমন করিয়া সেই শতভগ্ন মায়াশৃঙ্খল তাঁহার চতুষ্পার্শ্বে জড়াইয়া দিতে লাগিল, কেমন করিয়া সেই মৃগ-শিশু নিত্যকর্ম পূজাপাঠ, এমন কি, ঈশ্বর-চিন্তার মাঝে আসিয়াও অংশ লইয়া যাইত। ধ্যান করিবার সময়ে মনশ্চক্ষে দেখিতে পাইতেন, সেই নিরাশ্রয় পশু-শাবকের সজলকরুণ-দৃষ্টি তাঁহার পানে চাহিয়া আছে; তাহার পর সে বড় হইতে লাগিল। ক্রমে কুটীর ছাড়িয়া প্রাঙ্গণে, প্রাঙ্গণ ছাড়িয়া পুষ্পকাননে, তাহার পর অরণ্যে, ক্রমে সুদূর অরণ্যপথে স্বেচ্ছামত বিচরণ করিয়া বেড়াইত। ফিরিয়া আসিবার নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হইলে রাজা ভরত উৎকণ্ঠিত হইতেন। সঘনে ডাকিতেন, আয়, আয়, আয়! তাহার পর কবি নিজে কাঁদিলেন, সকলকে কাঁদাইয়া উচ্ছ্বসিতকণ্ঠে গাহিলেন, কেমন করিয়া একদিন সে আজন্ম মায়াবন্ধন নিমেষে ছিন্ন করিয়া গেল,—বনের পশু বনে চলিয়া গেল, মানুষের ব্যথা বুঝিল না। বৃদ্ধ ভরত উচ্চৈঃস্বরে ডাকিলেন, আয়, আয়, আয়! কেহ আসিল না, কেহ সে আকুল আহ্বানের উত্তর দিল না। তখন সমস্ত অরণ্য অন্বেষণ করিলেন, প্রতি কন্দরে কন্দরে, প্রতি বৃক্ষতলে, প্রতি লতাবিতানে কাঁদিয়া ডাকিলেন, আয়, আয়, আয়! কেহ আসিল না। প্রথমে তাঁহার আহার-নিদ্রা বন্ধ হইল, পূজাপাঠ উঠিয়া গেল—তাঁহার ধ্যান, চিন্তা—সব সেই নিরুদ্দেশ স্নেহাস্পদের পিছে পিছে অনুদ্দেশ বনপথে ছুটিয়া ফিরিতে লাগিল।

কবি গাহিলেন, মৃত্যুর কালোছায়া ভূলুণ্ঠিত ভরতের অঙ্গ অধিকার করিয়াছে, কণ্ঠ রূদ্ধ হইয়াছে, তথাপি তৃষিত ওষ্ঠ ধীরে ধীরে কাঁপিয়া উঠিতেছে। যেন এখনও ডাকিতেছেন, ফিরে আয়, ফিরে আয়, ফিরে আয়!

কৈলাসচন্দ্র বিশ্বেশ্বরকে সবলে বক্ষে চাপিয়া হাহা-রবে কাঁদিয়া উঠিলেন। অন্তরের অন্তর কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিল, আয়, আয়, আয়!

সভায় কেহই বৃদ্ধের এ ক্রন্দন অস্বাভাবিক মনে করিল না। কারণ, বয়সের সহিত সকলেরই কেহ না কেহ হারাইয়া গিয়াছে। সকলেরই হৃদয় কাঁদিয়া ডাকিতেছে—ফিরে আয়, ফিরে আয়, ফিরে আয়!

কৈলাসচন্দ্র চক্ষু মুছিয়া বিশ্বেশ্বরকে ক্রোড়ে তুলিয়া বলিলেন, চল দাদা, বাড়ি যাই—রাত্তির হয়েচে।

বিশু কোলে উঠিয়া বাড়ি চলিল। অনেকক্ষণ একস্থানে বসিয়া থাকিয়া ঘুম পাইয়াছিল, পথিমধ্যে ঘুমাইয়া পড়িল।

বাড়ি গিয়া কৈলাসচন্দ্র সরয়ূর নিকট তাহাকে নামাইয়া দিয়া বলিলেন, নে মা, তোর জিনিস তোর কাছে থাক।

সরযূ দেখিল, বুড়োর চক্ষু-দুটি আজ বড় ভারী হইয়াছে।

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

এই দুই বৎসরের মধ্যে চন্দ্রনাথের সহিত তাহার বাটীর সম্বন্ধই ছিল না। শুধু অর্থের প্রয়োজন হইলে সরকারকে পত্র লিখিত, সরকার লিখিত ঠিকানায় টাকা পাঠাইয়া দিত।

দুঃখ করিয়া হরকালী মধ্যে মধ্যে পত্র লিখিতেন। ব্রজকিশোর ফিরিয়া আসিবার জন্য অনুরোধ করিয়া চিঠি দিতেন। মণিশঙ্করও দুই-একখানা পত্র লিখিয়াছিলেন যে, তাঁহার শারীরিক অবস্থা ক্রমশঃ মন্দ হইয়া আসিতেছে, এ সময় একবার দেখিবার ইচ্ছা করে।

প্রথমে চন্দ্রনাথ সে-সকল কথায় কর্ণপাত করিত না, কিন্তু, যেদিন হরিবালা লিখিলেন, তুমি সুবিধা পাইলে একবার আসিয়ো, কিছু বলিবার আছে, সেই দিন চন্দ্রনাথ তল্পি বাঁধিয়া গাড়িতে উঠিল।

হরিবালা যদি কিছু কহেন, যদি কোন পত্র, যদি কোন হস্তলিপি দেখাইতে পারেন, যদি সেই বিগত সুখের একটু আভাস তাহাতে দেখিতে পাওয়া যায়,—তাহা হইলে—কিছু নয়। তথাপি চন্দ্রনাথ বাটী অভিমুখে ছুটিয়া আসিতে চাহিল। কিন্তু এতখানি পথ যে আশায় ভর করিয়া ছুটিয়া আসিল, বাটীতে আসিয়া তাহার কিছুই মিলিল না। হরিবালার সহিত সাক্ষাৎ হইলে জিজ্ঞাসা করিল, ঠানদিদি, আর কিছু বলবে না?

না, আর কিছু না।

নিরাশ হইয়া চন্দ্রনাথ কহিল, তবে কেন মিথ্যা ক্লেশ দিয়ে ফিরিয়ে আনলে?

বাড়ি না এলে কি ভাল দেখায়? তাহার পর দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিল, দাদা, যা হবার হয়েছে—এখন তুমি সংসারী না হ’লে আমাদের দুঃখ রাখবার স্থান থাকবে না।

চন্দ্রনাথ বিরক্ত হইয়া মুখ ফিরাইয়া বলিল, তা আমি কি করব?

কিন্তু মণিশঙ্কর কিছুতেই ছাড়িলেন না। হাত ধরিয়া বলিলেন, বাবা, আমাকে মাপ কর। সেই দিন থেকে যে জ্বালায় জ্বলে যাচ্চি তা শুধু অন্তর্যামীই জানেন।

চন্দ্রনাথ বিপন্ন হইল, কিন্তু কথা কহিতে পারিল না।

মণিশঙ্কর পুনরপি বলিতে লাগিলেন, আবার বিবাহ ক’রে সংসারধর্ম পালন কর। আমি তোমার মনোমত পাত্রী অন্বেষণ করে রেখেচি, শুধু তোমার অভিপ্রায় জানবার অপেক্ষায় এখনও কথা দিইনি। বাবা, এক সংসার গত হ’লে লোকে কি দ্বিতীয় সংসার করে না?

চন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে কহিল, এক সংসার গত হয়েচে—সে সংবাদ পেলে পারি।

দুর্গা—দুর্গা—এমন কথা বলতে নেই বাবা।

চন্দ্রনাথ চুপ করিয়া রহিল।

মণিশঙ্কর হঠাৎ কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিলেন, আমার মনে হয়, আমিই তোমাকে সংসারত্যাগী করিয়েচি। এ দুঃখ আমার ম’লেও যাব না।

চন্দ্রনাথ বহুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিল, কোথায় সম্বন্ধ স্থির করেচেন?

মণিশঙ্কর চক্ষু মুছিয়া উঠিয়া বসিলেন। বলিলেন, কলকাতায়; তুমি একবার নিজে দেখে এলেই হয়।

চন্দ্রনাথ কহিল, তবে কালই যাব।

মণিশঙ্কর আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, তাই করো। যদি পছন্দ হয় আমাকে পত্র লিখো, আমি বাটীর সকলকে নিয়ে একেবারে কলকাতায় উপস্থিত হব। কিছুক্ষণ থামিয়া বলিলেন, আমার আর বাঁচবার বেশি দিন নেই চন্দ্রনাথ, তোমাকে সংসারী এবং সুখী দেখলেই স্বচ্ছন্দে যেতে পারব।

পরদিন চন্দ্রনাথ কলিকাতায় আসিল। সঙ্গে মাতুল ব্রজকিশোরও আসিয়াছিলেন। কন্যা দেখা শেষ হইলে ব্রজকিশোর বলিলেন, কন্যাটি দেখিতে মা-লক্ষ্মীর মত।

চন্দ্রনাথ মুখ ফারাইয়া রহিল, কোনও মতামত প্রকাশ করিল না।

স্টেশনে আসিয়া টিকিট লইয়া দুইজনে গাড়িতে উঠিলে ব্রজকিশোর জিজ্ঞাসা করিলেন, তবে বাবাজী, পছন্দ হয়েছে ত?

চন্দ্রনাথ মাথা নাড়িয়া বলিল, না।

ব্রজকিশোর যেন আকাশ হইতে পড়িলেন,—এমন মেয়ে, তবু পছন্দ হ’ল না?

চন্দ্রনাথ মাথা নাড়িয়া বলিল, না।

ব্রজকিশোর মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, তিনি সরযূকে দেখেন নাই।

তাহার পর নির্দিষ্ট স্টেশনে ট্রেন থামিলে ব্রজকিশোর নামিয়া পড়িলেন। চন্দ্রনাথ এলাহাবাদের টিকিট লইয়াছিল।

ব্রজকিশোর বলিলেন, তবে কতদিনে ফিরবে?

কাকাকে প্রণাম জানিয়ে বলবেন, শীঘ্র ফেরবার ইচ্ছা নেই।

মণিশঙ্কর সে কথা শুনিয়া কপালে করাঘাত করিয়া কহিলেন, যা হয় হবে। আমার দেহটা একটু ভাল হ’লেই নিজে গিয়ে বউমাকে ফিরিয়ে আনব। মিথ্যা সমাজের ভয় ক’রে চিরকাল নরকে পচতে পারব না—আর সমাজই বা কে? সে ত আমি নিজে।

হরকালী এ সংবাদ শুনিয়া দন্তে দন্তে ঘর্ষণ করিয়া বলিলেন, মরবার আগে মিন্‌সের বায়াত্তুরে ধরেচে! সরকারকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, চন্দ্রনাথ কি বললে?

সরকার কহিল, আজ পর্যন্ত কত টাকা কাশীতে পাঠানো হয়েচে?

শুধু এই জিজ্ঞেস করেছিল—আর কিছু না?

না।

হরকালী মুখের ভাব অতি ভীষণ করিয়া চলিয়া গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *