দেশসেবা

দেশসেবা কথার কথা নয় দেশসেবা মানবের শ্রেষ্ঠ সাধনা। স্বার্থ-গন্ধ থাকবে না, নাম-যশের আকাঙ্ক্ষা থাকবে না, প্রাণের ভয় পর্যন্ত থাকবে না, এক দিকে দেশসেবক নিজে, আর দিকে তার দেশ, মাঝে আর কিছু থাকবে না। যশ, অর্থ, দুঃখ, পাপ, পুণ্য, ভাল, মন্দ সব যে দেশের জন্য বলি দিতে পারবে, দেশসেবা তার দ্বারাই হবে।

রাষ্ট্রীয় সাধনাতে নারীকেও নাবতে হবে—দেশের স্বাধীনতার জন্য নারী-পুরুষের সম্মিলিত সাধনা চাই, তা নইলে কিছু হবে না। আমি জানি ছেলেরা আর মেয়েরা যদি এক সঙ্গে কাজে নামে, তাহলে দেশের লোক নানারকম কুৎসা রটাবেই—তা রটাক। নিন্দুক তার কাজ করবেই, কিন্তু তাই বলে কি আমরা কাজ বন্ধ রাখবো? দেশের জন্য যে সুনামের প্রতিষ্ঠা ত্যাগ করতে পারবে না, তার আবার ত্যাগ কোথায়?

দেশের স্বাধীনতা কেউ চায় না—সবাই চায় নাম প্রতিষ্ঠা, বড় বড় বচন ঝেড়ে নেতা হতে—সত্যিকার ক’টা লোক পরাধীনতার জ্বালা অনুভব করে? দেশের কি দেখে আশান্বিত হব? আমার দেশের ছেলেরা ম্যালেরিয়ায় ভুগে মরবে, তবু দেশের জন্য মহিমময় মৃত্যুবরণ করতে পারবে না। দেশের জন্য লাঞ্ছনা সওয়া, দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া সে কি সোজা সৌভাগ্য? দেশ উঠবে কি করে? দেশের জন্য কি কেউ প্রাণ দিতে চায়? দেশের জন্য কি কেউ ত্যাগ স্বীকার করতে চায়? আবার যেদিন দেশে নগরে স্বার্থত্যাগী সন্তান জন্মাবে, সত্যিকার দেশের কাজ সেই দিন সম্ভব হবে।

‘নারীর মূল্য’র ভূমিকা

১৩২০ সালের ‘যমুনা’ মাসিকপত্রে ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধগুলি ধারাবাহিকরূপে যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন আমরা এগুলি গ্রন্থাকারে ছাপিবার অনুমতি লাভ করি।

কি মনে করিয়া যে শরৎবাবু তখন আত্মগোপন করিয়া শ্রীমতী অনিলা দেবীর ছদ্মনাম গ্রহণ করিয়াছিলেন, সে তিনিই জানেন। তবে, তাঁহার ইচ্ছা ছিল এমনি আরও কয়েকটি ‘মূল্য’ লিখিয়া ‘দ্বাদশ মূল্য’ নাম দিয়া পরে যখন গ্রন্থ ছাপা হইবে, তখন তাহা নিজের নামেই বাহির করিবেন। তারপরে, এই দীর্ঘ দশ বৎসর কাটিয়া গেল, না লিখিলেন তিনি আর কোন ‘মূল্য’, না হইতে পাইল ‘দ্বাদশ মূল্য’ ছাপা। আমরা গিয়া বলি, মশায়, আপনার দ্বাদশ ‘মূল্য’ আপনারই থাক, পারেন ত আগামী জন্মে লিখিবেন, কিন্তু যে ‘মূল্য’ আপাততঃ হাতে পাইয়াছি, তাহার সদ্ব্যবহার করি,—তিনি বলেন, না হে, থাক, এ আর বই করিয়া কাজ নাই। কিন্তু কারণ কিছুই বলেন না। এমনি করিয়াই দিন কাটিতেছিল। অথচ, তাঁহার মতের পরিবর্তন হইয়াছে তাহাও নয়,—আমাদের শুধু মনে হয়, তখনকার কালে নারীরা নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে কথা কহিতে শিখে নাই বলিয়াই এ কাজ তিনি করিয়াছিলেন, কিন্তু এখন কাগজে কাগজে ইঁহাদের দাবী-দাওয়ার প্রাবল্য ও পরাক্রান্ত নিবন্ধাদি দর্শন করিয়া এই বৃদ্ধ গ্রন্থকার ভয় পাইয়া গেছেন। তবে, এ কেবল আমাদের অনুমান, সত্য নাও হইতে পারে। কিন্তু এ কথা ঠিক যে, এ বই ছাপাইবার তাঁহার প্রবৃত্তি ছিল না। তাঁহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইহা প্রকাশ করিয়া ভাল করিয়াছি, কি মন্দ করিয়াছি, তাহা পাঠক বলিতে পারেন, আমাদের ত মনে হয় মন্দ করি নাই। কিন্তু ইহার যত কিছু দায়িত্ব সে আমাদেরই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *