চরিত্রহীন – ৩৭-৩৮

সাঁইত্রিশ

সতীশের অরণ্যবাসের ব্যবস্থাটা যদিচ আজও তেমনি আছে বটে, কিন্তু তাহার সেই বৈরাগ্যসাধনের ধারাটা ইতিমধ্যেই যে কতখানি বিপথে সরিয়া গিয়াছে, তাহা যে-কেহ তাহাকে মাস-দুই পূর্বে দেখিয়াছে তাহারই চোখে পড়িবে।

যে লোক স্বেচ্ছায় নির্বাসন-দণ্ড গ্রহণ করিয়া এই নির্জন নির্বান্ধব পুরীতে একাকী বাস করিতে আসিয়াছে, তাহার এই আকস্মিক বেশভূষার প্রতি অনুরাগের হেতুটাই বা কি এবং কেনই বা পাখির গানের পরিবর্তে তাহার নিজের গানের খাতাটা আবার তোরঙ্গের ভিতর হইতে বাহিরে আসিয়া পড়িল, বেহালা, সেতার, বাঁশী প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রগুলাই বা কেন তাহাদের অনাদৃত বাসস্থান পরিত্যাগ করিয়া সাবেক দিনের মত টেবিলের উপরে আসিয়া জুটিল, তাহার মুখচোখের সেই মলিন ছায়াটাই বা কি করিয়া সহসা তিরোহিত হইয়া গেল—এ-সব ভাবিবার কথা বটে!

বস্তুতঃ, মাস দুই-তিন পূর্বের সতীশকে এখন হঠাৎ যেন চেনাই ভার!

কিন্তু এই এতবড় অদ্ভুত পরিবর্তনের আসল কারণটা হয়ত এখানে খুলিয়া না বলিলেও চলিত, কিন্তু পাছে সাঁওতাল-পরগণার অসাধারণ জলহাওয়ার গুণ মনে করিয়া কতকগুলা নির্বোধের দল ছুটিয়া আসিয়া পড়ে, এই শুধু ভয়!

সুতরাং এটুকু আভাসে বলা প্রয়োজন যে, কোন পক্ষ হইতেই যদিচ বিবাহের প্রস্তাবটাকে এখনও স্পষ্ট করিয়া উত্থাপিত করা হয় নাই, কিন্তু আত্মীয়-স্বজনের কাছে সতীশ-সরোজিনীর মনের কথাটা সুস্পষ্ট হইয়া উঠিতে বাকী ছিল না।

সরোজিনীর জননী জগৎতারিণীর আগ্রহটাই যে এ-বিষয়ে সবচেয়ে বেশী, তাহা বছর খানেক পূর্বে কলিকাতাতেই জানা গিয়াছিল। কিন্তু আগ্রহ এবং ব্যাকুলতা সর্বাপেক্ষা অধিক বলিয়াই বোধ করি সমস্ত লোকের মধ্যে শুদ্ধ মাত্র তাঁরই মনের মধ্যে একটা সংশয়ের ছায়া ছিল, কি জানি তাঁর শিক্ষিতাভিমানিনী কন্যা চিরদিনের সমাজ ও সংস্কার কাটাইয়া সতীশকে গ্রহণ করিতে রাজী হইবে কি না! সম্প্রতি তিনি বাপের বাড়ি শান্তিপুরে গিয়াছিলেন, ফিরিয়া আসিয়াই কথাটা তিনিই পাকা করিয়া লইবেন এমনই একটা ইঙ্গিত যাইবার সময় জগৎতারিণী প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন।

সকালে সতীশ বেহালায় নূতন তার চড়াইতেছিল, বেহারীর সঙ্গে একজন ভদ্রলোক আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ইনি জ্যোতিষবাবুর বাড়ির সরকার। জগৎতারিণীর সঙ্গে শান্তিপুরে গিয়াছিলেন, আবার তাঁর সঙ্গেই ফিরিয়া আসিয়াছেন।

সরকার নমস্কার করিয়া জানাইল, মা আপনাকে আজ আহারের নিমন্ত্রণ করে পাঠিয়েছেন।

খবর শুনিয়া সতীশের বুকের রক্ত চমক খাইয়া গেল, কহিল, তিনি কবে ফিরে এলেন?

সরকার কহিল, আজ তিনদিন হলো।

প্রায় ছয়-সাতদিন হইল সতীশ ওদিকে যায় নাই। তাহাদের সম্বন্ধটা অত্যন্ত স্পষ্ট হইবার পর হইতে জ্যোতিষবাবুর বাড়িতে যখন-তখন বেড়াইতে যাইতে তাহার লজ্জা করিত। কহিল, আচ্ছা, মাকে জানাবেন আমি দশটা-এগারটার মধ্যেই গিয়ে হাজির হব।

যে আজ্ঞা, বলিয়া লোকটা নমস্কার করিয়া চলিয়া গেল।

সতীশকে নিমন্ত্রণ করিতে পাঠাইয়া দিয়াও জগৎতারিণী আহারের কোনরূপ উদ্যোগ না করিয়াই নিশ্চিন্ত ছিলেন, কারণ তাঁহার ধারণা ছিল, সতীশ সন্ধ্যার পূর্বে আসিবে না। এখন সরকারের মুখে খবর শুনিয়া তিনি ব্যস্ত এবং ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিলেন।

আজ ছিল একাদশী। তাঁহার নিজের জন্য কোনরূপ আয়োজনের আবশ্যক ছিল না, এবং যে বিধবা ব্রাহ্মণকন্যার দ্বারা তাঁহার রাঁধাবাড়ার কাজ চলিত, তিনিও দিন-দুই হইতেই শান্তিপুরের কল্যাণে ম্যালেরিয়া জ্বরে শয্যাগত ছিলেন।

অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া সরকারকে কহিলেন, তুমি এবেলা খাবার কথা বলে আসতে গেলে কেন? তোমার কি কোন বুদ্ধিই নেই?

সরকার ভয়ে ভয়ে কহিল, আমি বলিনি, তিনি নিজেই এবেলার কথা বলেছিলেন।

জগৎতারিণী তখন রাগ করিয়া হুকুম করিলেন, তবে তুমিই যাও বাপু, ভাল মাছ-টাছ কোথায় পাওয়া যায়, শিগগির নিয়ে এসো।

আজ সকাল হইতেই যেজন্য তাঁহার মন বিগড়াইয়া গিয়াছিল, তাহার হেতু ছিল। সতীশকে নিমন্ত্রণ করিতে পাঠাইবার পরে তিনি খবর পাইয়াছেন কাল রাত্রে সহসা শশাঙ্কমোহন পুনরায় আসিয়া হাজির হইয়াছেন। এই লোকটাকে উৎকট সাহেবীয়ানার জন্য তিনি কোনদিন দেখিতে পারিতেন না, এবং বিশেষ করিয়া যখন হইতে শুনিয়াছিলেন সে সরোজিনীর পাণিপ্রার্থী তখন হইতে লোকটি তাঁহার দু’চক্ষের বিষ হইয়া গিয়াছিল। দিন-কুড়ি পূর্বে যখন সে কি উপলক্ষ সৃষ্টি করিয়া কলিকাতা হইতে এখানে আসিয়াছিল তখন জগৎতারিণী তাহাকে একপ্রকার স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছিলেন যে তাঁহার কন্যার সহিত বিবাহ অসম্ভব। তবুও বেহায়া লোকটা বলা
নাই, কহা নাই, আবার আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে শুনিয়াই তাঁহার চিত্ত সংশয়ে কণ্টকিত হইয়া উঠিয়াছিল। তা ছাড়া, এ সংবাদ একটুখানি পূর্বাহ্ণে জানিতে পারিলে আজ সতীশকে হয়ত তিনি নিমন্ত্রণ করিতেই পাঠাইতেন না। কেন এ খবর যথাসময়ে তাঁহাকে জানান হয় নাই বলিয়া তিনি জ্যোতিষ হইতে বাড়ির বেহারাটা পর্যন্ত সকলের উপরেই চটিয়া গিয়াছিলেন। সরোজিনী বাহিরে বসিবার ঘর হইতে বাহির হইয়া কোনমতে মায়ের চোখ এড়াইয়া উপরে যাইতেছিল—শশাঙ্কমোহনের আগমন সেও জানিত না। কিন্তু জগৎতারিণী ফিরিয়া দাঁড়াইয়া তাহার আপাদমস্তক ক্ষণকাল নিঃশব্দে নিরীক্ষণ করিয়া গূঢ় ক্রোধের স্বরে বলিলেন, বেড়ানো হলো ত? এখন জুতা-মোজাটা একদণ্ড ছাড় বাছা! সতীশ আজ এখানে খাবে, আমি নিজে না রাঁধলে ত তোমাদের এই খ্রিষ্টানের বাড়িতে সে জলস্পর্শ করবে না। যাও, ঘাগ্‌রা-টাগ্‌রা ছেড়ে আমার রান্নাঘরে এসো গে। বুড়ো মায়ের একটুখানি সাহায্য করলে তোমাদের যীশুখৃষ্ট রাগ করবেন না বাছা, যাও।
মা রাগিলে যে কিরূপ অগ্নিমূর্তি হইতেন এবং সত্য-মিথ্যা নির্বিচারে লঙ্ঘন করিয়া যা মুখে আসে বলিতেন, তাহা কাহারও অবিদিত ছিল না। সরোজিনী কুণ্ঠিত হইয়া কহিল, আমি এখুনি আসচি মা।

কিন্তু মায়ের রাগ তাহাতে কিছুমাত্র শান্ত হইল না; বলিলেন, এসেই বা আমার কি মাথা কিনবে মা? সতের-আঠার বছরের মেয়ে হলে, আজও এক মুঠা চাল সিদ্ধ করতে শিখলে না। আমরাও গরীবের ঘরের মেয়ে ছিলুম না মা, কিন্তু ও-বয়সে সংসার চালিয়ে এসেচি। বামুনমেয়ে আজ যদি চলে যায়, আমাকে তা হলে খাবার অভাবে শুকিয়ে মরতে হবে। যে ঘর-সংসারে ধর্ম-কর্ম নেই, সে ঘরে ছেলেমেয়ে পেটে ধরাই বৃথা! এই কঠোর মন্তব্য অত্যন্ত কঠিন করিয়া ব্যক্ত করিয়া জগৎতারিণী মুখ হাঁড়িপানা করিয়া নিজেই রান্নাঘরে গিয়া প্রবেশ করিলেন। কিন্তু কেন যে তাঁহার নিজের ছেলে-মেয়ে এবং নিজের সংসারের আচার-ব্যবহারের উপর এই মর্মান্তিক আক্রোশ, তাহা তাঁহার পূর্ব-ইতিহাস হইতে অনেকটা বুঝা যাইবে।

জগৎতারিণীর পরলোকগত স্বামী পরেশনাথ ওকালতি করিয়া অগাধ অর্থ উপার্জন করিয়াও যখন অনেক বয়সে অধিকতর উপার্জনের আশায় ব্যারিস্টার হইতে কৃতসঙ্কল্প হইলেন, তখন স্ত্রী কান্নাকাটি করিয়া, উপবাস করিয়া, মাথা খুঁড়িয়া অশেষ প্রকারে বাধা দিবার চেষ্টা করিয়াও কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। পরেশনাথ কোন কথা শুনিলেন না, জগৎতারিণীকে এবং বারো বৎসরের পুত্র জ্যোতিষ ও ছয় বৎসরের কন্যা সরোজিনীকে দেশের মাটিতে রাখিয়া বিলাত চলিয়া গেলেন। প্রথম কয়েকদিন জগৎতারিণী একেবারেই হাল ছাড়িয়া দিলেন, কিন্তু পরে প্রকৃতিস্থ হইয়া নায়েব-গোমস্তার সাহায্যে বিষয়কর্ম দেখিতে লাগিলেন। কিন্তু, স্বামীর উপর চিত্ত তাঁহার চিরদিনের মত ভাঙ্গিয়া গেল। কিছুদিনের পর পরেশনাথ ব্যারিস্টার হইয়া ফিরিয়া আসিয়া আশাতিরিক্ত অর্থোপার্জন করিতে লাগিলেন, কলিকাতায় নূতন অট্টালিকা প্রস্তুত করাইয়া নূতন ধরনে বাড়িঘর সাজাইতে শুরু করিলেন, বয়-বাবুর্চি নিযুক্ত করিলেন, কিন্তু জগৎতারিণী নীরবে পৃথক হইয়া রহিলেন—স্বামীর গৃহকর্মে লেশমাত্র যোগদান করিলেন না। এমনি করিয়া দিন দিন স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ নিদারুণ হইয়া উঠিতে লাগিল। বাক্যালাপ ত বন্ধই ছিল, সংবাদ লওয়াও প্রায় বন্ধ হইয়া আসিল।

একদিন জ্যোতিষ আসিয়া কহিল মা, বাবা আমাকে বিলেতে পাঠাতে চাচ্চেন।

এ আশঙ্কা জননীর ছিলই, তিনি অত্যন্ত কঠিন হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কবে?

জ্যোতিষ কহিল, বোধ করি মাস-দুয়ের মধ্যেই।
আচ্ছা, বলিয়া মা মুখ অন্ধকার করিয়া অন্যত্র চলিয়া গেলেন। বিলাত-যাত্রার দিন তিনি দ্বার বন্ধ করিয়া রহিলেন, জ্যোতিষ রুদ্ধ-দ্বারের সম্মুখ হইতেই প্রণাম করিয়া বিদায় লইয়া গেল। পরেশনাথ সরোজিনীকে সঙ্গে করিয়া বোম্বাই পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিতে গেলেন, ফিরিয়া আসিয়া শুনিলেন, জগৎতারিণী শান্তিপুরে পিত্রালয়ে চলিয়া গেছেন। কারণ অনুসন্ধান করিয়া অবগত হইলেন, ইতিমধ্যে তাঁহার খুড়শ্বশুর গোবিন্দবাবু সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন, কিন্তু এ বাটীতে আহারাদি করেন নাই। সুতরাং স্ত্রীর গৃহত্যাগের কারণ বুঝিতে তাঁহার বিলম্ব হইল না।

ফিরাইয়া আনিতে লোক পাঠাইলেন, কিন্তু জগৎতারিণী আসিলেন না। পরেশনাথ সরোজিনীকে বোর্ডিঙে ভরতি করিয়া দিলেন এবং প্র্যাক্‌টিস প্রায় ছাড়িয়া শূন্য বাটীতে অদ্ভুত কীর্তি আরম্ভ করিয়া দিলেন। জগৎতারিণী পিত্রালয়ে থাকিয়া স্বামীর অধঃপতনের সমস্ত বিবরণ শুনিতে পাইলেন, কিন্তু বাধা দিবার লেশমাত্র চেষ্টা করিলেন না। যে স্বামী তাঁহাকে আত্মীয়-সমাজের বাহিরে টানিয়া ফেলিয়া দিয়া গেলেন, তাঁহার উপর জগৎতারিণীর অভিমানের অবধি রহিল না।

এমনি করিয়া দীর্ঘ পাঁচ বৎসর হইয়া গেল। জ্যোতিষ ফিরিয়া আসিয়া মাকে আনিতে গেল, কিন্তু মা অটল হইয়া রহিলেন, গৃহে ফিরিলেন না। কাঁদিয়া কহিলেন, সব ত শুনেচিস জ্যোতিষ, এখন যাতে তোরা সুখে থাকিস, তাই কর গে বাবা, কিন্তু আমাকে সে নরকের মাঝে আর টানিস নে—ও আমি সইতে পারব না।

জ্যোতিষ কহিল, আমরা আলাদা বাসা করে থাকব মা, তোমাকে সে বাড়ির ছায়াও মাড়াতে হবে না। আমি যা উপার্জন করব, তাতেই আমাদের কোনমতে দুঃখকষ্টে চলে যাবে তুমি এসো।

অনেক কষ্টে জগৎতারিণী সম্মত হইলেন এবং পুত্রকে কলিকাতা আলাদা বাসা ঠিক করিতে বলিয়া দিয়া যাত্রার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। জ্যোতিষ এক সপ্তাহের মধ্যেই ফিরিয়া আসিয়া লইয়া যাইবে বলিয়া মায়ের কাছে বিদায় লইয়া চলিয়া গেল। কিন্তু অত বিলম্বের আবশ্যক হইল না। পাঁচদিন পরেই সে ফিরিয়া আসিল, কিন্তু তাহার খালি পা, খালি গায়ে একখানা শাল জড়ানো দেখিয়াই জগৎতারিণী চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন।

জ্যোতিষ যেদিন কলিকাতায় ফিরিয়া গিয়াছিল, তাহার তৃতীয় রাত্রেই অকস্মাৎ হৃদ্‌রোগে পরেশনাথের মৃত্যু হইয়াছিল।

নিদারুণ অভিমানে একদিন জগৎতারিণী বাড়ি ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছিলেন, সুদীর্ঘ পাঁচ বৎসর পরে আবার একদিন কাঁদিতে কাঁদিতে সে বাড়িতেই ফিরিয়া আসিলেন, কিন্তু স্বামীর সঙ্গে ইহলোকে আর দেখা হইল না।

মেয়েকে স্কুল ছাড়াইয়া বাড়ি আনিলেন এবং তাহার আগাগোড়া পুনঃ পুনঃ নিরীক্ষণ করিয়া ভয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। জ্যোতিষকে আড়ালে ডাকিয়া আনিয়া কহিলেন, বোনের বিয়ে দিবি কবে বল্‌ দেখি?
জ্যোতিষ মায়ের মনের ভাব বুঝিয়া হাসিয়া কহিল, ওর চেয়েও অনেক বড় বয়সের মেয়েদের বিয়ে হচ্চে মা, তুমি নির্ভাবনায় থাকো। জগৎতারিণী বিস্ময়ে চোখ তুলিয়া বলিলেন, নির্ভাবনায় থাকব কি রে! তোর বাপ যা করে গেছেন সে ত ফিরবে না জানি, কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে ত বামুনের মেয়েকে মোসলমান খ্রিষ্টানদের হাতে দিতে পারব না, তাতে মেয়ের বিয়ে হোক আর নাই হোক। তোর জন্যে ভাবনি, একটা প্রায়শ্চিত্ত করলেই হতে পারবে—সে বিধান আমি কাকার কাছ থেকে জেনেই এসেচি, কিন্তু হাজার প্রায়শ্চিত্ত করেও ত মেয়ের বয়স কমাতে পারা যাবে না? তার উপায় হবে কি?

জ্যোতিষ কহিল, তোমাকে বয়স কমাতে হবে না মা, কিন্তু দু’দিন সবুর করতে হবে। আমি ভাল বামুনের ছেলে এনে দেব, তোমাকে মোসলমান খ্রিষ্টানের ঘরে খুঁজে বেড়াতে হবে না।

জগৎতারিণী রাগিয়া বলিলেন, তুই আরও সবুর করতে বলিস জ্যোতিষ?

জ্যোতিষ জবাব দিল, দোষ ত আমার নয় মা, যে সবুর করতে বলায় অপরাধ হবে। দোষ তোমার এবং বাবার। আমি ত ছিলুম বিদেশে।

এ কথা যে সত্য, তাহা জগৎতারিণী মনে মনে বুঝিলেন, কিন্তু সৎ-ব্রাহ্মণসন্তান কোথায় কেমন করিয়া জুটিবে তাহাও ভাবিয়া পাইলেন না। বলিলেন, যা ভাল বুঝিস কর বাছা, কিন্তু আমি কিছুর মধ্যেই নেই তা আগে থেকে বলে দিয়ে যাচ্চি, বলিয়া ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কাজে চলিয়া গেলেন।

প্রায়শ্চিত্ত করিয়া জ্যোতিষ পিতার শ্রাদ্ধ করিল।

ইহার অনতিকাল পরেই পাত্র জুটিল একজন বিলাত-ফেরত বাঙালী সাহেব। ব্যারিস্টারি পাস করিয়া তিনি বছর-দুই পূর্বে দেশে ফিরিয়াছিলেন।

শশাঙ্কমোহনের রঙ্‌টা নেটিভ, মেজাজটা ব্রিটিশ—তিনি বাংলা বলিতেন অশুদ্ধ, ইংরাজী বলিতেন ভুল। অল্পদিনেই তাঁহার নিয়মিত আসা-যাওয়াটা অনিয়মিত এবং সরোজিনীর প্রতি মনের ভাবটা অস্পষ্ট হইতে সুস্পষ্টতর হইয়া উঠিল।

জগৎতারিণী পর্দার আড়াল হইতে ভাবী জামাতাকে অবলোকন করিয়া ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিলেন; এবং সেই আক্রোশ মিটাইলেন মেয়ের উপর। তাহাকে নিভৃতে ডাকিয়া ভর্ৎসনা করিয়া কহিলেন, তুই বেহায়ার মত যার-তার সামনে বার হস কেন বল ত?

সরোজিনী লজ্জায় সঙ্কুচিত হইয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ক্রুদ্ধা জননী আর কিছু না বলিয়া দ্রুতপদে অন্যত্র চলিয়া গেলেন। অতঃপর শশাঙ্কমোহন অনেকবার আসিলেন গেলেন, কিন্তু যাহার জন্য যাতায়াত তাহার দেখা পাইলেন না। মায়ের অনুশাসন স্মরণ করিয়া সরোজিনী অত্যন্ত সতর্ক হইয়া অন্তরালে রহিল। জ্যোতিষ লক্ষ্য করিয়া একদিন ভগিনীকে কহিলেন, সরো, আজকাল তুই অমন পালিয়ে থাকিস কেন রে?

সরোজিনী মুখ নীচু করিয়া অস্ফুটকণ্ঠে কহিল, মা—আর কিছুই বলিতে হইল না, জ্যোতিষ নীরবে চলিয়া গেলেন। এ বাড়িতে ঐ একটা অক্ষরই যথেষ্ট।
প্রায় মাস-দুই পরে একদিন সকালে সেই পাত্রটির তরফ হইতেই প্রস্তাব লইয়া জ্যোতিষ মায়ের কাছে উপস্থিত হইয়া রীতিমত বকুনি খাইল।

ছেলেকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া মা কিঞ্চিৎ কোমল হইয়া বলিলেন, আচ্ছা, তোরাও ত বিলেতে ছিলি বাছা, কিন্তু ওই রকমটি হয়েছিস কি?

জ্যোতিষ ধীরে ধীরে বলিল, সবাই একই রকম হয় না মা, কেউ কেউ একটু-আধটু বদলেও যায়। কিন্তু তাই বলে এমন ছেলে কি হাতছাড়া করা ভাল? শশাঙ্ক ব্যারিস্টার হয়ে এসেচে, এর মধ্যেই একটু পসারও করেচে, আমার ত মনে হয় না মা, বিয়ে হলে সরোজিনী মন্দ হাতে পড়বে। চাল-চলনে যা একটু তফাত ঘটেচে, সেটুকু যদি মাপ করে নিতে পার মা, ভবিষ্যতে বোধ করি ভালই হবে।

মা বলিলেন, আমি বলচি জ্যোতিষ, এ কোনদিন ভাল হবে না। তা ছাড়া বিদেশে গিয়েই যে বিদেশী হয়ে যায়, তাকে ত আমি কোনমতেই বিশ্বাস করতে পারব না। আর এই বা কেমন কথা যে, হিন্দুস্থানে গেলে হিন্দুস্থানী হব, কাবুলে গেলে কাব্‌লি হব, কটকে গিয়ে উড়ে হয়ে যাব—না না জ্যোতিষ, তুই ওকে বিদায় কর বাছা। ওটা মানুষ নয়—বাঁদর। বাঁদরের হাতে আমি মাথা খুঁড়ে মলেও মেয়ে দিতে পারব না।

কাহারও সম্বন্ধে মত প্রকাশ করিতেও যেমন জগৎতারিণীর বিলম্ব ঘটিত না, তাঁহার প্রকাশিত মতামতের মধ্যেও তেমনি সংশয়-দ্বিধার অবকাশ মাত্র থাকিত না। তা ছাড়া, যে অপরাধে তিনি স্বামী পর্যন্ত ত্যাগ করিতে পারিয়াছিলেন, সে অপরাধ যে তিনি কোন প্রলোভনেই ক্ষমা করিবেন না, তাহা নিশ্চয় বুঝিয়া জ্যোতিষ নীরবে চলিয়া গেল, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ফিরিয়া আসিয়া কহিল, মা, একটা কথা কিন্তু ভেবে দেখবার আছে।

মা জিজ্ঞাসা করিলেন, কি কথা?

জ্যোতিষ কহিল, সরোজিনীকে তোমরা যে শিক্ষা দিয়ে এসেছ, তাতে তার অমতেও কাজ করা চলবে না। সেটা সবচেয়ে মন্দ কাজ হবে। শিশুকাল থেকে ওর ভার তোমরা নিলে না, দিলে বিদেশী মেমদের ওপর। এখন বড় হয়ে ওর মনের টানটা যে কোন্‌ দিকে ঝুঁকে থাকবে সেটা বোঝা ত শক্ত নয় মা।

জগৎতারিণী চুপ করিয়া রহিলেন।

এই কথাটা তিনি মনে মনে অস্বীকার করিতেও পারিলেন না, অথচ, প্রকাশ্যে স্বীকার করিতে পারাও অসম্ভব।

কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া বলিলেন, বেশ ত জ্যোতিষ, তোমরা সবাই যদি সায়েব-মেম হতে চাও হও, কিন্তু তার আগে আমাকে কাশী পাঠিয়ে দাও। আমি এতই যদি সহ্য করতে পেরে থাকি, এও সইতে পারব।

জ্যোতিষ তাড়াতাড়ি হেঁট হইয়া মায়ের পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া হাসিয়া কহিল, তা হলে আমাকেও কাশীতে গিয়ে থাকতে হবে। মাকে ছেড়ে যে আমার কোথাও থাকা চলবে না, সে ত দেশে ফিরেই ঠিক হয়ে গেছে মা।
জগৎতারিণী মুখ তুলিয়া চাহিলেন। তাঁহার মনের সমস্ত আগুন একমুহূর্তেই নিবিয়া জল হইয়া গেল। ক্ষণকাল গভীর স্নেহে পুত্রমুখ নিরীক্ষণ করিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, না বাছা, তুই আমাদের কাশীর বাড়িটা খালি করে দিতে চিঠি লিখে দে। আমি যে চিরকাল উপস্থিত থেকে নিজের মত নিয়ে তোদের বিব্রত করে রাখব, সেটা উচিতও নয়, দরকারও নয়।

জ্যোতিষ হাসিয়া বলিল, তাই ভাল মা, চল, সবাই গিয়ে কাশীতে থাকা যাক।

মাতা-পুত্রে উক্ত কথোপকথন কলিকাতার বাটীতে যেদিন হইয়াছিল, তাহার কিছুদিন পরেই উপেন্দ্র সতীশকে লইয়া জ্যোতিষের বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন। ইহার পরের ঘটনা পাঠকের অবিদিত নাই।

জগৎতারিণী সতীশকে দেখিলেন। তাহার গলায় মোটা পৈতা, সে সন্ধ্যা-আহ্নিক করে, সে মোসলমানের ছোঁয়া পাউরুটি বিস্কুট খায় না, সে শ্রীমান্‌, নিষ্ঠাবান্‌, তাহার পিতার অগাধ টাকা—জগৎতারিণী একেবারে মুগ্ধ হইয়া গেলেন। তাহার পরে ক্রমশঃ যখন আভাসে ইঙ্গিতে অনুভব করিলেন, সে বিলাতে গিয়া পাস না করিলেও, এমন কি এতগুলা কুসংস্কার থাকা সত্ত্বেও মেয়ের মনে অশ্রদ্ধার ভাব নাই, কি জানি, হয়ত বা সে মনে মনে—তখন হইতে জগৎতারিণীর চোখে সংশয়ের চেহারা আবার পরিবর্তিত এবং এতকালের পুঞ্জীভূত বেদনাও সহজ হইয়া উঠিবার পথ পাইল। সতীশের মুখের মাতৃসম্বোধনও তাঁহার ভাগ্যে ঘটিল।

কিন্তু, তার পরে বহুদিন পর্যন্ত সতীশের আর দেখা ছিল না। ইহার প্রত্যেক দিনটিই জগৎতারিণীকে বিঁধিয়া গিয়াছে, তথাপি নিজে উদ্যোগী হইয়া এ সম্বন্ধে কোন উপায়ই খুঁজিয়া বাহির করিবার প্রয়াস করেন নাই। তাঁহার বড় একটা ভয় ছিল, পাছে চেষ্টা করিতে গেলেই একটা অত্যন্ত মন্দ সংবাদ শুনিতে হয়।

তিনি মনে মনে জানিতেন, তাঁহার নিজের কন্যার মতামতের উপরেই শুধু বিবাহের সমস্ত ফলাফল নির্ভর করে না। কারণ সতীশের বৃদ্ধ পিতা এখনও জীবিত আছেন। কি জানি তিনি কি বলিবেন। তা ছাড়া সতীশ নিজেই যে বিলাত-ফেরতের বাড়িতে বিবাহ করিতে ভয় পাইয়া পিছাইয়া যাইবে না, তাহারও বিশেষ কোন নিশ্চয়তা ছিল না।

এমনি করিয়া অনেকদিন অনেক দুঃখ ও দুশ্চিন্তায় কাটাইয়া সেদিন হঠাৎ যখন বৈদ্যনাথে আসিয়া দেখিতে পাইলেন সতীশ বসিয়া গল্প করিতেছে, তখন আনন্দে তাঁহার চোখে জল আসিয়া পড়িল। সতীশ কাছে আসিয়া প্রণাম করিয়া পদধূলি লইল।

সে কলিকাতা হইতে পালাইয়া আসিয়া অজ্ঞাতবাস করিতেছিল। সরোজিনীই তাহাকে আবিষ্কার করিয়াছে, ইহা জ্যোতিষ গল্প করিয়া মাকে শুনাইল। নিজের কন্যার দুর্ঘটনার বিবরণ শুনিয়া তিনি সতীশের মাথায় হাত দিয়া তাহাকে অসংখ্য আশীর্বাদ করিলেন, এবং এই উপলক্ষে ইংরাজী শিখিয়া ইংরেজের নকল করাকে অজস্র গালি পাড়িয়া বলিলেন, বাবা সতীশ, তুমি যে মেয়েটাকে রক্ষা করেছ এ কথা যেন ওরা কোনদিন না ভুলে যায়। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে একলা থাকার দরকার কি সতীশ? তুমি এ-বাড়ির ছেলে, যতদিন আমরা এখানে আছি, ততদিন এই বাড়িতেই এসে কেন থাক না?
সতীশ হাসিয়া বলিল, বেশ আছি মা। আমার সেখানে কোন কষ্ট নেই।

জগৎতারিণী কহিলেন, কষ্টের জন্য নয় বাবা, একা থাকার অনেক বিপদ। এ বাড়িতে অনেক ঘর খালি পড়ে আছে, তুমি চলে এস। জল-হাওয়া সেখানেও যা, এখানেও ত তাই।

সরোজিনী কহিল, তা হলে ওঁর জাত যাবে মা।

জগৎতারিণী তখনও ভিতরের কথা জানিতেন না, মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বলিলেন, তুই ত খুব মেয়ে সরি! কেন, আমরা কি, যে আমাদের এখানে, লোকের জাত যাবে? না বাবা সতীশ, তুমি ওর কথা বিশ্বাস করো না। আর তাই যদি হবে, উপীন বৌ নিয়ে আমাদের বাড়িতে অতদিন থেকে গেলেন কি করে? তাঁদের কৈ জাত গেল না? তুই অমন মিছে করে ওকে ভয় দেখাস নে বলে দিচ্চি।

সরোজিনী মুখ ফিরাইয়া হাসিতে লাগিল; সতীশ কহিল, না মা, জাত যাবে কেন? আমি ত প্রায় প্রত্যহই আসি, রাত্রের খাওয়াটাও ত আমার এ বাড়িতেই হয়।

শুনিয়া জগৎতারিণী পুলকিত-চিত্তে বলিতে লাগিলেন, তাই এসো বাবা। অন্ততঃ আমি যে ক’দিন আছি, আমার কাছেই তোমাকে রোজ খেয়ে যেতে হবে। বলিয়া তিনি তৎক্ষণাৎ খাবার ব্যবস্থা করিতে অন্যত্র চলিয়া গেলে সরোজিনী কহিল, আপনি যে আমাকে গান শেখাবেন বলেছিলেন?

সতীশ কহিল, আমি ত প্রায় রোজ আসি, শিখলেই ত পারেন।

সরোজিনী বলিল, আপনি এলেই ত সমস্ত ভদ্রলোক আপনার গান শুনতে আসেন—তার মধ্যেই বুঝি শেখা যায়?

সতীশ হাসিয়া কহিল, ‘নো অ্যাডমিশন’ বলে ফটকে দরোয়ান বসিয়ে দিন না কেন?

সরোজিনী বলিল, তার চেয়ে মা যা বললেন তাই করুন। সেই জঙ্গলের মধ্যে আর পড়ে থাকবেন না।

কিন্তু জঙ্গলে থাকার প্রয়োজন আর যাহাকেই বলা যাক, সরোজিনীর কাছে বলা চলে না। সতীশ চুপ করিয়া রহিল।

সরোজিনী পুনরায় কহিল, আচ্ছা, দাদা যে বললেন, পাঁচ-ছ’দিন পরে কলকাতায় যাবেন, তখন আমাদের দেখবে কে?

সতীশ জিজ্ঞাসা করিল, ক’দিনের জন্য যাবেন?

সরোজিনী কহিল, অন্ততঃ সাত-আটদিন তাঁকে সেখানে থাকতেই হবে।

সতীশ কহিল, তা হলে সে ব্যবস্থা তিনিই করে যাবেন। আর এত ভয়ই বা কি জন্যে? আপনারা ত আমাদের হিন্দুর ঘরের মত অসূর্যস্পশ্যা নন যে, বাড়িতে পুরুষ মানুষ না থাকলেই মুশকিলে পড়ে যাবেন। আপনারই বরঞ্চ কত পুরুষের—

সরোজিনীর মুখ পলকের জন্য আরক্ত হইয়া উঠিল, কহিল, কি আমরা করি শুনি? পুরুষের কান কেটে নিই? না, হিন্দুর ঘরের মেয়ে নই আমরা?
সতীশ অপ্রতিভ হইয়া তাড়াতাড়ি কথাটা সারিয়া লইবার জন্য মুখ তুলিয়াই দেখিতে পাইল, সম্মুখে শশাঙ্কমোহন ব্যারিস্টারকে লইয়া জ্যোতিষ ঘরে ঢুকিতেছেন। অন্যদিনের মত আজও তিনি স্টেশনে বেড়াইতে গিয়া দেখেন ব্যারিস্টার সাহেব ফার্স্টক্লাস কামরা হইতে অবতরণ করিতেছেন।

ঘরে পা দিয়াই শশাঙ্কমোহন সরোজিনীর দিকে হাত বাড়াইয়া দ্রুত অগ্রসর হইয়া করমর্দন করিয়া কুশল প্রশ্ন করিলেন এবং নিজের এইরূপ অকস্মাৎ আগমনের কৈফিয়তস্বরূপে কহিলেন, কেন যে সহসা কলিকাতা তাঁহার অসহ্য বোধ হইল, কেন যে কিছুমাত্র চিন্তা না করিয়া স্টেশনে আসিয়া দেওঘরের ফার্স্টক্লাস টিকিট কিনিয়া বসিলেন, তাহার হেতু নিজেই এখন পর্যন্ত জানেন না। অতঃপর নিকটে একটা চৌকি টানিয়া লইয়া ব্যারিস্টার-সাহেব অনর্গল বকিয়া যাইতে লাগিলেন, কিন্তু সরোজিনীর পাংশু মুখ দিয়া দুই-একটা সাধারণ কথা ছাড়া কথাই বাহির হইল না।

মিনিট-দশেক পরে সতীশকে উঠিয়া যাইতে দেখিয়া তাঁহার দৃষ্টি আকৃষ্ট হওয়ায় ঘাড়টা একটু কাত করিয়া বিস্ময়ের কণ্ঠে সরোজিনীকে কহিলেন, এঁকে কোথায় দেখেচি বলে মনে হচ্ছে না!

সরোজিনীর পাংশু মুখ প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। সংক্ষেপে কহিল, বলতে পারি না কোথায় দেখেছেন।

অনতিকাল পরে জগৎতারিণী খাবার দিয়া সতীশকে যখন ডাকিতে পাঠাইলেন তখন দেখা গেল, সতীশ কাহাকেও কোন কথা না কহিয়া চলিয়া গিয়াছে।

ইহার পরে তিন দিন পর্যন্ত সতীশের আর দেখা না পাইয়া জগৎতারিণী ভিতরে ভিতরে ক্রুদ্ধ ও উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন। ছেলেকে নিভৃতে ডাকিয়া কড়া করিয়া প্রশ্ন করিলেন, লোকটি আর কতদিন এখানে থাকবে জ্যোতিষ? বরঞ্চ আমি বলচি, তোমরা ওঁকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দাও যে, তাঁর থাকবার আর কোন আবশ্যক নেই।

মাতৃ-আজ্ঞা জ্যোতিষ কিভাবে পালন করিয়াছিল বলিতে পারি না, কিন্তু প্রস্থানের পূর্বে শশাঙ্কমোহন নিঃসংশয়ে শুনিয়া গেলেন যে, যে-জন্য তাঁহার আসা সে আশা লেশমাত্র নাই, এবং সতীশই যে সেই ভাগ্যবান পাত্র, তাহাও জানিতে তাঁহার অবশিষ্ট রহিল না।

সাহেবের মুখ কালো হইয়া উঠিল, কিন্তু আঘাতটা তিনি ভদ্রভাবেই গ্রহণ করিলেন। এমন কি, যাইবার সময় তিনি সরোজিনীর সহিত সাক্ষাৎ করিতেও চেষ্টা করিলেন না।

ট্রেনে উঠিয়া বসিয়া বিদায় লইবার ঠিক পূর্বক্ষণেই অত্যন্ত অকস্মাৎ জ্যোতিষকে জিজ্ঞাসা করিলেন, সতীশবাবু কোথায় যে ডাক্তারি শেখবার চেষ্টা করছিলেন, তা হয়েচে?

জ্যোতিষ মাথা নাড়িয়া কহিল, বোধ হয় না। হোমিওপ্যাথি স্কুলে কিছুদিন পড়েছিলেন মাত্র।

ওঃ, হোমিওপ্যাথিক স্কুল! বলিয়া শশাঙ্ক অন্য কথা পাড়িলেন।

আটত্রিশ

সহসা ভ্রাতার অসুখের টেলিগ্রাম পাইয়া জগৎতারিণীকে তাড়াতাড়ি শান্তিপুরে যাইতে হইয়াছিল। সুতরাং সতীশের কাছে প্রস্তাবটা উত্থাপন করিবার তখন সুযোগ পান নাই। আজ তাহাকে ভাল করিয়া খাওয়াইয়া কথাটা পাড়িবেন, মনে মনে এই সঙ্কল্প স্থির করিয়া সকালে উঠিয়াই সরকারকে নিমন্ত্রণ করিয়া আসিতে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। ইতিমধ্যে এই অভাবনীয় কাণ্ড ঘটিল। যাহার আগমন সবচেয়ে অপ্রীতিকর, অকস্মাৎ সেই শশাঙ্কমোহন সকালের ট্রেনে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন শুনিয়া জগৎতারিণীর বিরক্তির আর অবধি রহিল না। মানুষের অত্যন্ত কামনার বস্তু হঠাৎ বাধাপ্রাপ্ত হইলে তাহার সন্দেহের আর হিসাব-নিকাশ থাকে না। সুতরাং ঠিক সেই সময়ে বাহির হইতে সরোজিনীকে আসিতে দেখিয়া তাঁহার সর্বাঙ্গে বিষের জ্বালা দিয়া মনে হইল, শশাঙ্কর এই আকস্মিক প্রত্যাবর্তনের মধ্যে হয়ত বা এই হতভাগা মেয়েটারও কোন হাত আছে। তাঁহার ব্যারিস্টার ছেলেকে ত তিনি কোনদিনই সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতে পারেন নাই। বস্তুতঃ, তাঁহাকে দোষ দেওয়াও যায় না। তাঁহার হিন্দু আচারভ্রষ্ট ছেলে-মেয়েরা যে সতীশের আচারপরায়ণতা প্রীতির চক্ষে দেখিতে পারে, এ কথা তিনি হৃদয়ের মধ্যে গ্রহণ করিতে পারিতেন না।

মেয়েকে কটূক্তি করিয়া তিনি রান্নাঘরে প্রবেশ করিয়া ঝিকে রান্নার আয়োজন ঠিক করিয়া রাখিতে আদেশ দিয়া স্নানে চলিয়া গেলেন। কিন্তু ঘণ্টা-খানেক পরে ফিরিয়া আসিয়া কন্যার প্রতি চাহিয়া জননীর চক্ষু জুড়াইয়া গেল।

ইতিমধ্যে তাড়াতাড়ি সে স্নান সারিয়া লইয়া পট্টবস্ত্র পরিয়া মায়ের রান্নাঘরে ঢুকিয়া অপটুহস্তে বঁটিতে তরকারি কুটিতেছিল এবং ঝি অদূরে বসিয়া দেখাইয়া দিতেছিল।

জগৎতারিণী নীরবে ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, হিঁদুর মেয়ের যে আর কোন পোশাকেই সাজে না, তোকে দেখে আজ তা টের পেলুম বাছা! তোর পানে চেয়ে এত আহ্লাদ আর আমার কোনদিন হয়নি।

সরোজিনী লজ্জায় মুখ নত করিয়া কাজ করিতে লাগিল; মা তাহাকেই খোঁচা দিয়া বলিতে লাগিলেন, আমি সব বুঝি মা, সব বুঝি। তা সে যতই পাস করুক, বাঁদর ছাড়া তাকে আমি কিছুই বলিনে। আর যার ইশারা পেয়েই কেন না বেহায়াটা আবার ফিরে আসুক, আমি থাকতে তা হবে না, তা সত্যি করে বলে দিচ্চি বাছা!

একটুখানি স্থির থাকিয়া পুনরায় কহিলেন, জ্যোতিষ বলে, ছেলেবেলায় যে যেমন শিক্ষা পেয়ে আসে, মনের টানটা তার সেইদিকেই যায়। কিন্তু তাই বা সত্যি হবে কেন? দিন-রাত হ্যাট-কোট পরে না থাকলে পছন্দ হবে না, এই বা কোন্‌ শাস্ত্রে লেখা আছে মা?

আয়োজন সম্পূর্ণ করিয়া লইয়া জগৎতারিণী রাঁধিতে বসিয়া একসময়ে কহিলেন, আমার মনের বাসনা ভগবান যদি পূর্ণ করেন, তুই দেখিস দিকি বাছা, তাতে তোর ভালই হবে।
সরোজিনী আনতমুখে মায়ের মনের বাসনাটা স্পষ্ট শুনিবার প্রত্যাশায় উৎকর্ণ হইয়া রহিল, জগৎতারিণী আর তাহা প্রকাশ করিয়া বলিলেন না, নিজের মনে রাঁধিতে লাগিলেন। তিনি নীরবে মনে মনে কি আলোচনা করিতে লাগিলেন সরোজিনী তাহা বুঝিল এবং হ্যাট-কোটধারী সম্বন্ধে যে লজ্জাকর অপবাদের ইঙ্গিতে তাহাকে পুনঃ বিদ্ধ করিলেন, তাহারও প্রতিবাদ করা কঠিন ছিল না, কিন্তু নিরতিশয় অসহিষ্ণু-প্রকৃতি জগৎতারিণীকে কোন কথাই শেষ পর্যন্ত শুনানো যায় না জানিয়াই সে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।

বেলা প্রায় দশটা বাজে এমন সময় একটা গোল বাধিল। সরকারমশাই কোথা হইতে খুঁজিয়া পাতিয়া একটা প্রকাণ্ড বড় রুইমাছ আনিয়া হাজির করিলেন। জগৎতারিণী রান্নাঘরের ভিতর হইতে উঁকি মারিয়া দেখিয়া খুশী হইয়া বলিলেন, বাঃ—বেশ মাছ কিন্তু—

সরোজিনী কহিল, সতীশবাবুর আসতে এখনও দেরী আছে মা, এখনও দশটা বাজেনি।

জগৎতারিণী বলিলেন, বাজা-বাজির কথা নয় মা, আজ আমার একাদশী, আমি ত মাছ ছোঁব না। ভাবচি, তোদের বামুনঠাকুর রাঁধতে পারবে কি? আচ্ছা দেখ ত এলোকেশী, ও-ঘরের রান্না কতদূর এগুলো?

ঝি বাহিরে যাইতেই সরোজিনী লজ্জিত-মুখে আস্তে আস্তে বলিল, তুমি দেখিয়ে দিলে আমি কি পারব না?

জগৎতারিণী বিস্মিত-মুখে বলিলেন, পারবি তুই?

পারব না? তুমি কেবল দেখিয়ে দাও।

ঝি থমকিয়া দাঁড়াইল। এমন চারু-দর্শন বৃহদায়তন রোহিত একটা আনাড়ীর হাতে পড়িয়া সম্পূর্ণ নষ্ট হইবার আশঙ্কায় সে ভীত হইয়া উঠিল। কহিল, সে কি হতে পারে মা, বাইরের লোক খাবে যে।

জগৎতারিণী ক্ষণকাল কি ভাবিয়া লইয়া কহিলেন, তা হোক, সতীশ আমার বাইরের লোক নয়, সে আমার ঘরের ছেলে। তুই হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকিস্‌ নে এলোকেশী, ওধারের উনুনটা বেশ করে নিকিয়ে দিয়ে মাছ কুটে আন্‌। তুইও এক কাজ কর মা। গরদের কাপড় পরে ত সুবিধে হবে না—আচ্ছা তা হোক, না হয় আঁচলটা বেশ করে কোমরে জড়িয়ে নে। হাসিয়া বলিলেন, আজ আঁশ-হাতেই তোর হাতেখড়ি হয়ে যাক, সরি, আশীর্বাদ করি, চিরকাল আজকের দিনের মত যেন তোর আঁশ-হাতই হয়।

এই আশীর্বাদে সরোজিনী মুখখানি আরও একটু অবনত করিল। ঘণ্টা-খানেক পরে জ্যোতিষ মায়ের কাছে কি একটা কাজের জন্য রান্নাঘরের দরজার কাছে আসিয়া নিরতিশয় বিস্ময়ে অবাক হইয়া গেল। ঠাহর করিয়া দেখিয়া কহিল, ওখানে রাঁধে কে মা? সরো না কি?

মা একটু হাসিয়া বলিলেন, দেখ দেখি, চিনতে পারিস কি না!

চিনতে না পারারই কথা মা। কিন্তু ও কি সত্যই রাঁধচে, না তোমার ঢাক ঘাড়ে করে আছে?
মা একটা নিগূঢ় ইঙ্গিত করিয়া বলিলেন, রাঁধাবাড়ার কাজে কি হিঁদুর মেয়েকে শিখতে হয় রে, এ ত আমাদের জন্মকাল থেকেই শেখা হয়ে থাকে। কিন্তু—

কি মা?

ছেলেকে একটু আড়ালে লইয়া জগৎতারিণী বলিলেন, কিন্তু আমি এখন ভাবছি সতীশ শুনলে কি জানি ওর হাতে খাবে কি না!

জ্যোতিষ হাসিয়া উঠিতেই সরোজিনী মুখ তুলিয়া চাহিল। জ্যোতিষ কহিল, মা, তুমি সতীশকে মস্ত একটা মনু-পরাশর গোছের লোক ভাবো কেন বল দেখি?

মা বলিলেন, সে তোদের চেয়ে ত ভাল?

জ্যোতিষ কহিল, এমনই বা কি ভাল শুনি? ঐ সরো গিয়ে তাদের ভাত-ডাল রেঁধে দিয়ে এসেছিল বলে সে রাত্রে খেতে পেয়েছিল, নইলে উপোস করে থাকতে হতো—সে জান?

মা পুলকিত বিস্ময়ে ব্যগ্র হইয়া কহিলেন, কবে রে?

জ্যোতিষ সে রাত্রের সমস্ত ঘটনা বিবৃত করিয়া কহিলেন।

তিনি আনন্দে বিহ্বলপ্রায় হইয়া ক্ষুণ্ণ অভিমানের সুরে মেয়েকে বলিলেন, ধন্যি মেয়ে মা তুই! আমি তখন থেকে ভেবে মরচি, আর তুই চুপ করে আছিস?

জ্যোতিষ হাসিয়া বলিল, ওই বা কি করে জানবে মা, তুমি নিজের মনে ভেবে সারা হচ্চ? কিন্তু সেদিন ত খেতে পাইনি, আজ খেয়ে দেখি পোড়ারমুখী পেট থেকে পড়েই কেমন রাঁধতে শিখেছে। বলিয়া হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেল।

জগৎতারিণী মেয়ের লজ্জাবনত মুখখানির পানে চাহিয়া গভীর স্নেহে কহিলেন, লজ্জা কি মা? আপনার জনকে রেঁধে-বেড়ে খেতে দেবে এর চেয়ে সৌভাগ্য মেয়েমানুষের কি আর আছে! আমি আহ্নিকটা ততক্ষণ সেরে নি গে, বলিয়া কিছুক্ষণের জন্য বাহির হইয়া গেলেন।

তার পর সমস্ত দিন গেল, কিন্তু সতীশের দেখা নাই। না আসার কারণও কেহ জানাইয়া গেল না। সারাদিন ছটফট করিয়া জগৎতারিণী সন্ধ্যার পর জ্যোতিষকে ডাকিয়া বলিলেন, তার নিশ্চয় কিছু একটা হয়েচে, কাউকে খবর নিতে একবার পাঠিয়ে দিলিনে কেন?

জ্যোতিষ নিতান্ত তাচ্ছিল্যভরে জবাব দিল, কাকে ততদূর আবার পাঠাতে যাব মা!

জগৎতারিণী আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, কেন, দরোয়ান একবার যেতে পারত না?

দরকার কি মা?

তুই বলচিস কি জ্যোতিষ? তার অসুখ-বিসুখ হলো, না কি হলো, একবার খবর নেওয়াও আবশ্যক নয়?

কি আবশ্যক? সে আমাদের আত্মীয়ও নয়, বন্ধুও নয়, তার জন্যে ভেবে মরার আমি কোন প্রয়োজনই দেখিনে, বলিয়া জ্যোতিষ বাহিরে চলিয়া গেল।

সতীশের সম্বন্ধে ছেলের মুখে জবাব শুনিয়া জগৎতারিণী হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন।
মাত্র এই একটা বেলার মধ্যে সতীশ আর তাহাদের কেহ নয়? তাঁহার মুখের উপর ছেলের এই স্পর্ধিত উত্তর ক্ষণকালের জন্য তাঁহার কাছে দুঃস্বপ্নের মত ঠেকিল। সেইখানে দাঁড়াইয়া কয়েক মুহূর্তেই কত কি যে তাঁর উপবাসক্ষীণ মাথার মধ্য দিয়া ছুটিয়া গেল, তাহা ভাল করিয়া ঠাহর করিতেও পারিলেন না।

ধীরে ধীরে উপরে গিয়া নিজের শয্যায় শুইয়া পড়িয়া সরোজিনীকে কাছে ডাকাইয়া আনিয়া জগৎতারিণী মেয়ের মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া আরও ভয় পাইয়া গেলেন। একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, সরি, সতীশ এলো না কেন জানিস?

সরোজিনী বলিল, না।

কন্যার এই সংক্ষিপ্ত উত্তরে জগৎতারিণী উঠিয়া বসিয়া কহিলেন, না! যদি জানোই না, তবে লোক পাঠিয়ে জানতে কি হয়েছিল? এও কি আমাকে বলে দিতে হবে নাকি?

সরোজিনী মৃদুকণ্ঠে কহিল, দাদা বললেন লোক পাঠাবার দরকার নেই।

কেন নেই, সেইটাই জানতে চাই। যাও এখ্‌খুনি দরোয়ানকে পাঠিয়ে দাও, তার খবর নিয়ে আসুক।

সে ত নেই মা, দাদা তাকে উপীনবাবুকে টেলিগ্রাম করতে পাঠিয়েছেন!

উপীনবাবুকে! হঠাৎ তাকে টেলিগ্রাম করা কেন?

আমি সব কথা জানিনে মা, তুমি দাদাকে জিজ্ঞাসা কর, বলিয়া সরোজিনী মাকে এক প্রকার উপেক্ষা করিয়াই চলিয়া গেল।

এইবার জগৎতারিণীর অকস্মাৎ মনে হইল সতীশকে নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে নিষেধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। ইহার হেতু যে কি, তাহা কেহই তাঁহার কাছে ব্যক্ত করিতে চাহে না বটে, কিন্তু সে যে গুরুতর, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই; এবং এই ভীষণ অনিষ্টের মূলে যে ঐ শশাঙ্কমোহন এবং এই দুরভিসন্ধি লইয়াই সে পুনরায় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে তাহাতেও তাঁহার কোন সংশয় রহিল না। কিন্তু, কারণ যতবড় ভয়ানকই হোক, তিনি স্বয়ং উপস্থিত থাকিতেও যে ছেলে-মেয়েরা তাঁহার অনুমতি না লইয়া সতীশকে মানা করিয়াছে, ইহা মনে করিতেই তাঁহার চিত্ত ক্রোধে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। তৎক্ষণাৎ এলোকেশীকে দিয়া জ্যোতিষকে ডাকাইয়া আনিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তুই সতীশকে এ বাড়িতে আসতে বারণ করেছিস?

জ্যোতিষ আশ্চর্য হইয়া বলিল, না, এ তোমাকে কে বললে?

উপীনকে তুই সতীশের কথা নিয়ে টেলিগ্রাম করেচিস?

হ্যাঁ।

সতীশ কি করেচে?

জ্যোতিষ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, যা করেচে, সে যদি সত্যি হয়, তা হলে তার সঙ্গে আমাদের আর কোন সম্বন্ধই নেই।

এ খবর তোকে কে দিলে, শশাঙ্কমোহন? দুষ্টু লোক, ওর কথা আমি একতিল বিশ্বেস করিনে।

জ্যোতিষ কহিল, আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু তার অর্ধেকও যদি সত্যি হয়, তা হলেও আমি বলচি মা, সতীশের ছায়া মাড়াতেও আমাদের ঘৃণা হওয়া উচিত।
ছেলের উত্তপ্ত কণ্ঠস্বরে জগৎতারিণী নরম হইয়া বলিলেন, বেশ ত, আমাকে খুলেই বল না বাছা কি হয়েচে। সতীশ কিছু চুরি-ডাকাতিও করেনি, খুন করেও পালিয়ে আসেনি যে, তার ছায়া মাড়াতেও তোমাদের ঘৃণা হবে। ছেলেমানুষ, মনের ভুলে যদি কিছু দোষ-ঘাট করেই থাকে—এমন কত লোকই ত করে—শুধরে নিতে কতক্ষণ?

জ্যোতিষ ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না মা, সে সব অপরাধ মাপ করা যায় না। অন্ততঃ সরোজিনী পারবে না, এ তোমাকে আমি নিশ্চয় বলচি।

জগৎতারিণী একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, অপরাধটা কি শুনি?

কাল শুনো মা। উপীনের চিঠি না পাওয়া পর্যন্ত এ আলোচনায় আর কাজ নেই, বলিয়া জ্যোতিষ দ্বিতীয় অনুরোধের পূর্বেই ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

এতক্ষণ উত্তেজনার আবেগে জগৎতারিণী বিছানায় উঠিয়া বসিয়াছিলেন, ছেলে চলিয়া যাইতেই একেবারে নির্জীবের মত শয্যা গ্রহণ করিলেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, ভগবান! এ কলিকালে কি কাউকে বিশ্বাস করবার তুমি জো রাখোনি ঠাকুর!

আভাসে অনুমানে তিনি অনেক কথাই বুঝিলেন। তাই শুধু সতীশের জন্য নয়, স্বামীর কথা মনে পড়িয়াও তাঁহার দু’চক্ষু বাহিয়া এখন হুহু করিয়া অশ্রু ঝরিতে লাগিল।

রাত্রে একবার মেয়েকে ডাকিতে পাঠাইয়াছিলেন, এলোকেশী সরোজিনীর সাড়া না পাইয়া ফিরিয়া আসিয়া জানাইল, দিদিমণি ঘুমিয়ে পড়েছে।

শুনিয়া তিনি কপালে করাঘাত করিলেন। যে মেয়ে এত দুঃসংবাদ শুনিয়াও ঘুমাইতে পারে, অর্থাৎ সে যে সতীশের চেয়ে মনে মনে ওই বাঁদরটার প্রতি বেশী অনুরাগী, এ কথা মনে করিয়া তাঁহার মেয়ের প্রতি ক্রোধ ও অশ্রদ্ধার অন্ত রহিল না।
পরদিন বেলা প্রায় তিনটা বাজে, গেটের থামে সাইকেল কাত করিয়া রাখিয়া সতীশ বাহিরের বসিবার ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল।

তাহার শুষ্ক মুখ, এলোমেলো রুক্ষ চুল, উপস্থিত সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। সরোজিনী মুখ তুলিয়া চাহিল, কিন্তু কথা কহিল না। জ্যোতিষ জিজ্ঞাসা করিল, আপনার অসুখ করেচে নাকি সতীশবাবু?

সতীশ একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, না।

কেহই আর কোন কথা কহিল না দেখিয়া সতীশ মনে মনে বিস্মিত হইল। সে ভাবিতে ভাবিতে আসিতেছিল আজ উপস্থিত হওয়ামাত্র অভিযোগ-অনুযোগের অন্ত থাকিবে না। তাই, সে তখন বাড়ির ভিতরের দিকে অগ্রসর হইবার উদ্যোগ করিয়া নিজেই কহিল, কালকের অপরাধের জন্যে আগে মায়ের কাছে মাপ চেয়ে আসি, তার পরে অন্য কাজ।

শশাঙ্ক এতক্ষণ তীব্রদৃষ্টিতে সতীশের পানে চাহিয়া ছিল, সে-ই কথা কহিল। বলিল, মা এখন ঘুমোচ্চেন, তাঁকে জাগিয়ে মাপ চাইবার এত তাড়া কি? একটু বসুন, আপনার সঙ্গে কিছু আলোচনা করবার আছে।
তাহার কথার ধরনে সতীশ অত্যন্ত আশ্চর্য হইয়া কহিল, আমার সঙ্গে আলোচনা?

শশাঙ্ক কহিল, আজ্ঞে হাঁ, দুর্ভাগ্যক্রমে আছে বৈ কি।

জ্যোতিষকে দেখাইয়া কহিল, আপনি নিশ্চয় জানেন, আমি ওঁর একজন পরম বন্ধু—না না, জ্যোতিষবাবু, আপনি উঠবেন না—ও কি, আপনারাই বা পালালে চলবে কেন? আমার যা নালিশ তা আপনাদের সামনেই করতে চাই। দুজনেই বসুন,—বসিয়া সরোজিনীর প্রতি একটা কটাক্ষ করিল। কিন্তু সরোজিনী এমনি ঘাড় হেঁট করিয়া রহিল যে, সে ইহার কিছুই দেখিতে পাইল না।

শশাঙ্ক সুমুখের টেবিলের উপর একটা চড় মারিয়া বলিল, আমার ছেলেবেলা থেকেই এই স্বভাব যে, যাদের ভালবাসি, তাদের সম্বন্ধে কিছুতেই চোখ বুজে উদাসীন থাকতে পারিনে। তাই গতবারে শুনেই মনে মনে বললুম, এ ত ভাল কথা নয়। সতীশবাবুর এই নির্জন-বাসের একটা খবর নেওয়া উচিত। আপনি হয়ত রাগ করবেন সতীশবাবু, কিন্তু আমিও ত আমার নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে যেতে পারিনে। কি বলেন জ্যোতিষবাবু?

জ্যোতিষ নিঃশব্দ নতমুখে বসিয়া রহিল। সতীশও চুপ করিয়া চাহিয়া রহিল। সমস্ত শ্রোতাদের সমবেত নীরবতার মাঝখানে শশাঙ্কর উত্তেজনার বেগ আপনিই ঢিলা হইয়া আসিল। সে অপেক্ষাকৃত সংযত-কণ্ঠে কহিল, জ্যোতিষ আমার পরম বন্ধু বলেই আপনাকে গুটিকয়েক প্রশ্ন করবার আমার অধিকার আছে। আপনি ত জানেন—

কথার মাঝখানেই সতীশ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না, আমি বন্ধুত্বের কথা কিছুই জানিনে, কিন্তু আপনার প্রশ্ন কি শুনি?

শশাঙ্ক একটা ঢোক গিলিয়া বলিল, আমি জানতে চাই আপনি এখানে এসে আছেন কেন?

সতীশ কহিল, আমার ইচ্ছে। আপনার দ্বিতীয় প্রশ্ন?

শশাঙ্ক থতমত খাইয়া জ্যোতিষকে উদ্দেশ করিয়া বলিতে লাগিল, সতীশবাবুর কলকাতার বাসা খুঁজে বার করতে আমাদের অনেক কষ্ট পেতে হয়েচে। রাখালবাবুকে উনি চেনেন, তিনি বললেন—

সতীশের দুই চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল, কহিল, চুলোয় যাক রাখালবাবু। আপনার নিজের কথা বলুন।

এবার জ্যোতিষ মুখ তুলিয়া বলিল, সতীশবাবু, শশাঙ্ক আমার অনুরোধেই আপনাকে জিজ্ঞেসা করচে। আপনি ইচ্ছা করলে জবাব না দিতেও পারেন, কিন্তু ওঁকে অপমান করবেন না। আমাদের সঙ্গে আপনি যে ব্যবহার করেচেন তাতে কোন প্রশ্ন না করাই উচিত ছিল, শুধু আমার মায়ের জন্যই আপনার নিজের মুখ থেকে একবার শোনার প্রয়োজন। বেশ, আমিই না হয় প্রশ্ন করচি, সাবিত্রী কে? এবং তার সঙ্গে আপনার সম্বন্ধই বা কি?

সতীশ ক্ষণকাল চুপ করিয়া চাহিয়া রহিল, পরে কহিল, সাবিত্রী কে তা আমি জানিনে জ্যোতিষবাবু। কিন্তু তার সঙ্গে আমার কি-সম্বন্ধ, সে উত্তর দেওয়া আমি আবশ্যক মনে করিনে।
কেন?

কারণ, বললেও আপনারা বুঝতে পারবেন না।

কিন্তু যেমন করেই হোক, আমাদের বুঝা একান্ত আবশ্যক। ভাল, তাকে কোথায় এনে রেখেচেন, এ সংবাদ দিলে বোধ করি বুঝতে পারব।

সতীশ জ্যোতিষের মুখের উপর তাহার জ্বলন্ত চক্ষু নিবদ্ধ করিয়া শান্তকণ্ঠে কহিল, দেখুন জ্যোতিষবাবু, আমি কোনদিন গায়ে পড়ে আপনাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করবার চেষ্টা করিনি, সুতরাং প্রশ্নোত্তরের ছলে কতকগুলো অপ্রিয় কথা-কাটাকাটির দরকার মনে করিনে। আমি বুঝতে পেরেচি, কি ঘটেচে। অতএব, আপনাদের যতটুকু জানা প্রয়োজন আমি নিজেই জানাচ্চি। সাবিত্রী কোথায় গেছে আমি জানিনে। কেন, কি বৃত্তান্ত, এ-সব সম্পূর্ণ অনাবশ্যক। তবে এ কথা খুব সত্যি, সাবিত্রী যাই হোক, যদি নিজের ইচ্ছায় সে আমাকে ছেড়ে চলে না যেত, আমি যতদিন বাঁচতুম, তাকে মাথায় করে রাখতুম। এ কথা শুধু আপনাদের সাক্ষাতে নয়, সমস্ত পৃথিবীর সামনে স্বীকার করতেও আমি লজ্জা বোধ করিনে। আশা করি, এর পরে আপনাদের আর কোন জিজ্ঞাস্য নেই। থাকলেও আমি জবাব দিতে পারব না।

সতীশের এই সুস্পষ্ট এবং অতিশয় সংক্ষিপ্ত উত্তরে সকলেই যুগপৎ বিস্ফারিতচক্ষে চাহিয়া পাথরের মূর্তির মত বসিয়া রহিল। সরোজিনীর মুখের উপরেই তাহার এই অমানুষিক হৃদয়হীন স্পর্ধা তাহার অসীম নির্লজ্জতাকেও বহুদূরে অতিক্রম করিয়া গেল। বহুক্ষণ স্তম্ভিতের মত বসিয়া থাকিয়া জ্যোতিষ প্রবল চেষ্টায় নিজেকে সচেতন করিয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না, আপনার কাছে আমাদের আর কিছুই জিজ্ঞাস্য নেই। যেটুকু ছিল, উপীনের জবাবে সেটুকু পূর্ণ হয়েচে। এই দেখুন, বলিয়া সে টেলিগ্রামের কাগজখানা সম্মুখে ছুড়িয়া দিল।

উপীনদার টেলিগ্রাম? কৈ দেখি, বলিয়া সতীশ ব্যগ্রহস্তে কাগজখানা তুলিয়া লইল। ভাঁজ খুলিয়া ধীরে ধীরে সমস্তটা পড়িয়া ফিরাইয়া দিয়া, ক্ষণকাল চুপ করিয়া রহিল। তার পরে একটা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, সমস্ত সত্য। আমার উপীনদা কখনও মিথ্যা বলেন না। যথার্থই আমি ভাল নই, যথার্থই আমার সঙ্গে কারও সংস্রব রাখা উচিত নয়। বোধ করি নিজেই এ কথা মনে মনে টের পেয়েছিলাম বলেই এই জঙ্গলের মধ্যে এমন করে একদিন পালিয়ে এসেছিলাম। বলিতে বলিতেই তাহার কণ্ঠস্বর যেন কোন মন্ত্রবলে জলভারাক্রান্তের

ন্যায় গদগদ হইয়া আসিল। কিন্তু কেহই কোন কথা কহিল না এবং সতীশ নিজেও স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। পরক্ষণেই একটা বুকচেরা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে তাহার মনে হইল, একটা বড় জটিল সমস্যার আজ অত্যন্ত অদ্ভুত মীমাংসা হইয়া গেল। কাল সকালেও তাহার জগৎতারিণীর নিমন্ত্রণের সঙ্গে সঙ্গে কত চিন্তাই না মনে উদয় হইয়াছিল! সরোজিনীর হৄদয় পাইবার আকাঙ্ক্ষা হঠাৎ কবে যে তাহার অন্তরে প্রথম জাগিয়া উঠিয়াছিল, এইমাত্র এ কথা সে স্মরণ করিতে পারে নাই সত্য, কিন্তু নিভৄত অন্তরের মধ্যে তাহার আকাঙ্ক্ষা ত ছিলই! না হইলে এমনটি ঘটিয়াছিল কি করিয়া?
এ অমৃত সঞ্জাত হইয়াছিল কোন্‌ সিন্ধু মন্থন করিয়া? সাবিত্রীকে হারাইয়া পর্যন্ত এই সত্যটার সে সাক্ষাৎলাভ করিয়াছিল যে, যুবতী রমণীর মন পাওয়া এক, কিন্তু সে পাওয়া কাজে লাগানো সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তু। কারণ,পাওয়া যখন নর-নারীর নিভৃত হৃদয়ে গোপনে, নিঃশব্দে সম্পূর্ণ হইয়া উঠিতে থাকে, বাহিরের সংসার তাহার সাড়া পায় না, কিন্তু যেদিন এই সংসারের সম্মতি না লইয়া আর এক পদও অগ্রসর হইবার উপায় থাকে না, সেই দিনই দারুণ দুঃখের দিন। এ পাওয়া যে কত কঠিন, এ রত্ন যে কত দুর্লভ, বাহিরের সংসার সে বিচারের দিক দিয়া যায় না—সে কেবল তাহার শাস্ত্র লইয়া, সমাজ লইয়া, লোকাচার লইয়া বিরুদ্ধস্বরে কলরব করে, বাধা দেয়, নিষ্ফল করে—এই শুধু তাহার কাজ। সরোজিনীকে হয়ত সে ভালবাসে। সেদিকেও প্রতিদান যদি এমনি উন্মুখ হইয়াই উঠিয়া থাকে ত তাহাকে প্রতিষ্ঠা করিবে সে কোন্‌খানে! উভয়ের সমাজ যে বিভিন্ন। কালও তাহার বৃদ্ধ পিতার চিন্তিত গম্ভীর মুখ বারংবার মনে পড়িয়াছে, উপীনদাদাদের বাড়ির শুষ্ক ভট্টাচার্যের শুষ্কতর তীব্রস্বর সহস্রবার তাহার কানে আসিয়া বিঁধিয়াছে, পাড়ার শত্রু-মিত্র সমস্ত লোকের তীব্র শিরশ্চালন তাহার হৃৎপিণ্ডের উপর বহুবার ধাক্কা মারিয়া গিয়াছে, তবুও এই বিরুদ্ধ জগতের সমস্ত লোকের সম্মিলিত ‘না’ ‘না’ রবের মাঝখানে শুধু কেবল নিঃশব্দ সরোজিনীর লজ্জাবনত মুখখানিই তাহাকে সবল রাখিতে পারিয়াছিল।

কিন্তু আজ আর কোন ভয় নাই। একদিনে অচিন্তনীয় উপায়ে সমস্ত গ্রন্থি সমস্ত দুশ্চিন্তার শান্তি হইল। বাঁচা গেল!

কথাটা নিজের মনে বলিয়াই সে চমকিয়া মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিল, সবাই ঠিক তেমনি নীরবে অধোবদনে বসিয়া আছে। সরোজিনীর মুখের দিকে সে চাহিয়া দেখিল, কিন্তু, প্রায় কিছুই দেখা গেল না। তখন তাঁহাকেই সম্বোধন করিয়া কহিল, তুমি—আপনি আমার সাবেক বাসায় একদিন যাঁর কাপড় শুকোতে দেখে এসেছিলেন, তাঁর নাম সাবিত্রী। আমি ভেবেছিলুম, একদিন নিজেই সমস্ত কথা আপনাকে জানাব, কিন্তু কোনদিন সে সুযোগ হলো না, সে সাহসও ছিল না। বলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, জ্যোতিষবাবু, দোষ আমার। এ আমি প্রতিদিনই টের পাচ্ছিলাম, তাই, মনে আমার সুখ ছিল না। বলিয়া একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, অথচ, আমি কোন বিষয়ে কাউকে ঠকাই নি, ও-সব আমি জানিও নে। তবু বলবারও আমার কিছু নেই।

জ্যোতিষ মুখ তুলিয়া কি বলিতে গেল, কিন্তু তাহার গলা দিয়া স্বর ফুটিল না।

সতীশ নিজেও বোধ করি যেন একটা কঠিন বাষ্পোচ্ছ্বাস সংবরণ করিয়া ফেলিল।

কহিল, আমি চললাম। আমার একটা অনুরোধ, আমার কথা আলোচনা করে আপনারা মন খারাপ করবেন না। আমি কখনো কোন ছলে আর আপনাদের সুমুখে আসব না—আমাকে আপনারা ভুলে যাবেন। বলিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।
জ্যোতিষ পার্শ্বে চাহিয়া সভয়ে দেখিল, সরোজিনীর মাথাটা একেবারে তাহার জানুর কাছে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে!—ওরে, ও সরো, বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিতে না উঠিতে সরোজিনীর শিথিল মুষ্টি চেয়ারের হাতল হইতে স্খলিত হইয়া সে নীচে কার্পেটের উপর মূর্ছিত হইয়া পড়িয়া গেল। অভিমান ও অপমানের ক্রোধে জ্যোতিষের বুদ্ধি এমনি আচ্ছন্ন হইয়া গিয়াছিল যে, সতীশের বিদায়-পালাটা সরোজিনীর সাক্ষাতে ঘটিলে যে আঘাতটা তাহার কি কঠিন হইয়া বাজিবে এ হিসাবই তাহার মনে ছিল না।

তাই, অনেক শুশ্রূষার পর সরোজিনীর চৈতন্য ফিরিয়া আসিলে সে যখন কাঁপিতে কাঁপিতে টলিতে টলিতে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল, তখন জ্যোতিষের মাথায় একেবারে বাজ ভাঙ্গিয়া পড়িল।

ভগিনীকে শুধু যে সে প্রাণাধিক ভালবাসিত তাই নয়, তাহার সর্বরূপলাবণ্যবতী শিক্ষিতা ভগিনীর দৃপ্ত আত্মমর্যাদাজ্ঞানের উপরেও তাহার অগাধ বিশ্বাস ছিল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে যে এত ভালও বাসিতে পারে যে, এ-সব কিছুই কোনো কাজে লাগিবে না, সমস্ত জানিয়াও সে একটা চরিত্রহীন লম্পটের পরম অন্যায়ের পদতলে সমস্ত বিসর্জন দিয়া চেতনা হারাইয়া শুষ্ক তৃণখণ্ডের মত লুটাইয়া পড়িবে, এ আশঙ্কা সে কল্পনাও করে নাই। তাহার মুখের উপর বেদনার যে ছবি ফুটিয়া উঠিতে সে এইমাত্র স্বচক্ষে দেখিল, সে যে কত বড়, তাহা নিরূপণ করিবার শক্তি এবং অভিজ্ঞতা তাহার ছিল না, তথাপি সে বহুক্ষণ পর্যন্ত অসাড়ের মত বসিয়া থাকিয়া শশাঙ্কমোহনের প্রতি চাহিয়া কহিল, আপনি বোধ হয় আজ রাত্রের ট্রেনেই কলকাতায় ফিরবেন?

শশাঙ্ক বলিল, না, তেমন কিছু জরুরী কাজ নেই সেখানে।

জ্যোতিষ আর কোন প্রশ্ন না করিয়া উঠিয়া ভিতরে চলিয়া গেল এবং নিজের ঘরে গিয়া দোর দিয়া শুইয়া পড়িল। সে রাত্রে ডিনারটা শশাঙ্কমোহনকে একাই সমাধা করিতে হইল, কারণ, জ্যোতিষের একেবারেই সাড়া পাওয়া গেল না।

জগৎতারিণী একটি একটি করিয়া ছেলের মুখে সমস্ত শুনিয়া গভীর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া অনেকক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিলেন, তারপরে বলিলেন, এ-সব আমারই পোড়া কপালের ফল, জ্যোতিষ। পরলোকগত স্বামীকে স্মরণ করিয়া কহিলেন, নিজে ত সারাজীবন এই নিয়ে জ্বলে-পুড়ে মলুম, বাকিটুকু ছেলে-মেয়েদের জন্যেই যদি না জ্বলতে হবে ত ষোল-আনা পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে কিসে! বেশ বাবা, তোমাদের যাকে পছন্দ হয় তার সঙ্গেই বোনের বিয়ে দাও গে, আমি আর কথাটি কব না।

আর একটি দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করিয়া বলিলেন, মন অন্তর্যামী—তাই হঠাৎ ওর আসা শুনেই সেদিন বুক আমার দমে গিয়েছিল জ্যোতিষ।

কিন্তু জ্যোতিষ কোন কথা কহিল না। সে মনে মনে বুঝিতেছিল যে ব্যাপারটা অত সহজ নহে। সুতরাং যাহা হইয়া গেছে, তাহা হইয়া গেছে বলিয়া চোখ বুজিয়া বসিয়া থাকিলেই চলিবে না, হয়ত বা একদিন এই চরিত্রহীনটাকেই নিজে গিয়া সাধিয়া ফিরাইয়া আনিতে হইবে।
কাল সারাদিনের মধ্যে সে সরোজিনীকে একবার ঘরের বাহিরে পর্যন্ত আসিতে দেখে নাই, কিন্তু আজ বিকালে চা খাইতে বাহিরের ঘরে ঢুকিয়াই দেখিল সরোজিনী ইতিপূর্বেই আসিয়াছে এবং শশাঙ্কমোহনের সঙ্গে আস্তে আস্তে গল্প করিতেছে।

জ্যোতিষ কাছে আসিয়া একখানা চেয়ার টানিয়া লইয়া উপবেশন করিল। যদিচ ভগিনীর শ্রীহীন মলিন মুখের পানে চাহিয়া তাহার বুঝিতে কিছুই বাকী রহিল না, তবুও বুকের উপর হইতে একটা ভারী পাথর নামিয়া গেল।

খাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত অনেক কথাবার্তা হইল, কিন্তু সেদিনের কেহই কোন ইঙ্গিত করিল না। সন্ধ্যার পরে অনেকটা স্বচ্ছন্দচিত্তে ভগিনীকে চলিয়া যাইতে দেখিয়া জ্যোতিষ মনে মনে কহিল, দুর্ঘটনাকে সে যত বড় ভাবিয়াছিল, তত বড় নয়। হয়ত বা অনতিকাল মধ্যেই আবার সমস্ত ঠিকঠাক হইয়া যাইবে, তাহার এমন আশাও হইল।

সেইদিন অনেক রাত্রি পর্যন্ত দুই বন্ধুতে আলাপ-আলোচনা চলিল। এমন কি জ্যোতিষ তাহার আশার কথাটাও ইঙ্গিতে ব্যক্ত করিল। বস্তুতঃ সরোজিনী যে তাহার প্রথম ঝঞ্ঝাট সামলাইয়া লইবার পরেও সতীশের এতবড় ঘৃণিত আচরণের সঙ্গে মনে মনে শশাঙ্কমোহনের তুলনা করিয়া দেখিবে না, ইহা একপ্রকার অসম্ভব বলিয়াই উভয়ের বোধ হইল।

পরদিন দ্বিপ্রহরে খাওয়া-দাওয়ার পরে সরোজিনী তাহার উপরের শোবার ঘরের খোলা জানালার সামনে একটা চৌকি টানিয়া লইয়া পথের পানে চাহিয়া বসিয়াছিল, হঠাৎ মনে হইল খানিক দূরে একখানা বোঝাই-দেওয়া গরুর গাড়ির পিছনে পিছনে যে দুটি লোক ছাতা মাথায় ধীরে ধীরে চলিয়াছে, তাহার একজন বেহারী। সরোজিনী সতর্ক হইয়া গরাদে ধরিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। গাড়ি ক্রমশঃ তাহার জানালার কাছে আসিতে একটা লোক মুখ তুলিয়া উপর পানে চাহিতেই স্পষ্ট দেখা গেল সে বেহারী। সরোজিনী হাত নাড়িয়া আহ্বান করিতেই বেহারী তাহার সঙ্গীকে অগ্রসর হইতে বলিয়া ছাতি মুড়িয়া জানালার নীচে আসিয়া দাঁড়াইল। সরোজিনী কহিল, বেহারী, ঢুকেই বাঁ-হাতি সিঁড়ি। ওপরে এসো।

তখন বাড়ির সকলেই দিবানিদ্রায় সুপ্ত, বেহারী অনতিবিলম্বে সিঁড়ি দিয়া সরোজিনীর উপরের ঘরে ঢুকিয়া তাহাকে প্রণাম করিয়া পায়ের ধূলা জিহ্বায়, কণ্ঠে ও মস্তকে ধারণ করিল।

সরোজিনী মনে মনে তাহাকে আশীর্বাদ করিয়া কহিল, তোমাদের গাড়ি ত সেই রাত্রি এগারটার পরে—এখনো তার ঢের সময় আছে। ঠাকুর সঙ্গে আছে, সে জিনিসপত্র মুটে দিয়ে নামিয়ে রাখতে পারবে, তুমি একটু বসো।

জিজ্ঞাসা না করিয়াই বুঝিয়াছিল সতীশ এখানকার বাসা উঠাইয়া অন্যত্র চলিয়াছে।

বেহারী তাহার উড়ুনীর অঞ্চলে কপালের ঘাম মুছিয়া মেঝের উপর উপবেশন করিল।

ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া সরোজিনী এইপ্রকারে ভূমিকা করিল; কহিল, আচ্ছা বেহারী, তুমি ত কখনো বামুনের মেয়ের কাছে মিথ্যা কথা বলো না।
বেহারী জিভ কাটিয়া কহিল, বাপ্‌ রে! তা হলে কি রক্ষে আছে দিদিমণি! সাতজন্ম কাশীবাস করলেও যে এ পাপের মোচন হবে না।

সরোজিনী স্নিগ্ধদৃষ্টিতে এই পল্লীবাসী ধর্মভীরু বৃদ্ধের মুখের পানে চাহিয়া স্নেহহাস্যে কহিল, সে ত জানি বেহারী, তুমি কখনো মিছে বলো না, কিন্তু আমি যা জিজ্ঞাসা করব, সে তুমি কারো কাছে বলতে পাবে না—তোমার মনিবের কাছেও না।

বেহারী কহিল, আমার দরকার কি দিদিমণি, কারো কাছে বলবার!

সরোজিনী একটুখানি মৌন থাকিয়া আসল কথা পাড়িল, জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা, সাবিত্রী মেয়েটি কে বেহারী?

বেহারী সরোজিনীর মুখের পানে চাহিয়া বলিল, আমার সাবিত্রী মায়ের কথা জিজ্ঞেসা কচ্চ দিদিমণি! জানিনে দিদিমণি, মা-জননী আমার কার শাপে পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে এত দুঃখ পাচ্চেন! আহা, মা যেন লক্ষ্মীর প্রতিমে!

অনেকদিন হইয়া গেল বেহারী সাবিত্রীর নামটা পর্যন্ত মুখে উচ্চারণ করিবার সুযোগ পায় নাই। তাহার কণ্ঠস্বর গদগদ এবং চোখের দৃষ্টি অশ্রুজলে ঝাপসা হইয়া উঠিল।

সাবিত্রীর উল্লেখমাত্রই বুড়োর এতখানি ভাবান্তর লক্ষ্য করিয়া সরোজিনী আশ্চর্য হইয়া গেল।

বেহারী হাত দিয়া চোখ মুছিয়া বলিল, মা আমার যেদিন রাখালবাবুর মেসে দাসীবৃত্তি করতে এলেন, তখন মানুষগুলো সব দেখে অবাক হয়ে গেল। মুখে যেন হাসিটি লেগেই রয়েছে। রাখালবাবু ম্যানেজার, আর আমি ত চাকর, কিন্তু মায়ের কাছে সবাই সমান—সবাইকে সমান যত্ন| একাদশীর দিন কাঠফাটা উপোস করেও কখনও মায়ের মুখ বেজার দেখিনি দিদিমণি।

বৃদ্ধ যেন সমস্ত হৃদয় দিয়া কথা কহিতেছিল। তাই এই তাহার অকৃত্রিম ভক্তি-উচ্ছ্বাসে সরোজিনী মুগ্ধ হইয়া গেল এবং তাহার বিদ্বেষের জ্বালাও যেন গলিয়া অর্ধেক ঝরিয়া পড়িল। বেহারী কহিতে লাগিল, দিদিমণি, শাস্তরে লেখা আছে, মা-লক্ষ্মী একবার কি যেন একটা অপরাধ করে নারায়ণের হুকুমে দাসী-বৃত্তি করেছিলেন, আমার মাও যেন ঠিক তেমনি কোন দোষে চাকরি করতে এসে নানান দুঃখ পেয়ে শেষকালে চলে গেলেন। যেদিন চলে গেলেন, সেদিনটা আমার বুকের মাঝে আজও যেন গাঁথা হয়ে আছে দিদিমণি।

সরোজিনী আস্তে আস্তে প্রশ্ন করিল, তিনি এখন কোথায় আছেন বেহারী?

বেহারী এ প্রশ্নের সহসা উত্তর দিল না, মুখপানে চাহিয়া চুপ করিয়া রহিল।

সরোজিনী পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, জান না বেহারী?

বেহারী এবার ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ঠিক জানিনে বটে, কিন্তু তবুও জানি। কিন্তু সে কথা জানাতে যে মায়ের মানা আছে দিদিমণি, আমি ত বলতে পারব না।

সরোজিনী জিজ্ঞাসা করিল, মানা কেন?
মানা যে কেন, তাহা বেহারী নিজেও ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিত না। তথাপি এই নিষেধ চিরদিন মান্য করিয়া চলা, সে কেমন আছে জানিতে না পাওয়া, তাহাকে এ জীবনে আর একবার চক্ষে দেখিতে না পাওয়া, এ-সকল যে বেহারীর পক্ষে কত দুরূহ তাহা সে শুধু নিজেই জানিত। বিশেষ করিয়া যখনই কোন কথাবার্তায় তাহার মায়ের বিরুদ্ধে সতীশের তীব্র কুৎসিত ইঙ্গিত প্রকাশ পাইত, তখন সমস্ত কথা ব্যক্ত করিয়া ফেলিতে তাহার মনের মধ্যে আবেগের ঝড় বহিয়া যাইত, কিন্তু তবুও বুড়া আজ পর্যন্ত তাহার শপথ ভঙ্গ করে নাই। যদি কোনদিন অসহ্য হইয়াছে, তখনই সে এই কথাই স্মরণ করিয়াছে যে, সাবিত্রী যখন নিজে এতবড় কলঙ্ক নীরবে বহন করিতেছে, তখন নিশ্চয়ই ভিতরে এমন কিছু একটা আছে, যাহা তাহার বুদ্ধির অগোচর। সাবিত্রীর প্রতি তাহার বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার অন্ত ছিল না।

কিন্তু, এখন আর একজন যখন সে কথা জানিবার জন্য ঔৎসুক্য প্রকাশ করিতে লাগিল, তখন সমস্ত ব্যাপারটা বলিয়া ফেলিতে তাহার প্রাণটাও আকুলি-বিকুলি করিয়া উঠিল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, বলতে পারি দিদিমণি, তুমি যদি আমার বাবুকে না বল।

সরোজিনী মনে মনে ভারী আশ্চর্য হইল। বেহারী জানে অথচ সতীশ জানে না এবং তাহাকেই জানাইতে বিশেষ করিয়া সাবিত্রীর নিষেধ—ইহার কি কারণ সে ভাবিয়া পাইল না। কহিল, না বেহারী, আমি কাউকে বলব না, তুমি বল।

বেহারী মিনিট-দুই সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ থাকিয়া বোধ করি চিন্তা করিয়া দেখিল, ইহাতে অসত্যের পাপ তাহাকে স্পর্শ করিবে কিনা, তাহার পরে ধীরে ধীরে সমস্ত ইতিহাস সে একটি একটি করিয়া বিবৃত করিয়া বলিল।

সাবিত্রী যে সতীশকে প্রাণাধিক ভালবাসিত এবং এইজন্যই যে রাখালবাবু গায়ের জ্বালায় ঝগড়া করিয়া বাবুকে বাসা হইতে বিদায় লইতে বাধ্য করিয়াছিল এবং সতীশবাবু মাঝে মাঝে মদও খাইতেন, ইত্যাদি কোন কথাই সে গোপন করিল না।

সমস্তক্ষণ সরোজিনী মন্ত্রমুগ্ধের মত বসিয়া শুনিল। বোধ করি এমন একাগ্রচিত্তে, এত মনোযোগ দিয়া আর কেহ কখনও কাহারও কথা শুনে নাই। যে রাখালবাবুর কাছে শশাঙ্কমোহন খবর সংগ্রহ করিয়াছিলেন, দৈবাৎ সে লোকটির ইতিহাসও আজ সরোজিনীর অপরিজ্ঞাত রহিল না।

সাবিত্রীর কোথায় বাড়ি, কিংবা তাহার পিতৃকুল বা শ্বশুরকুলের পরিচয় কি, সকল সন্ধান বেহারী না দিতে পারিলেও সে যে ব্রাহ্মণের মেয়ে, বিধবা, সুরূপা, লেখাপড়া জানে—শুধু অদৃষ্টের বিড়ম্বনায় দাসীবৃত্তি করিতে আসিয়াছিল, এ কথা সে বার বার করিয়া কহিয়া বলিল, এত ত ভালবাসতেন, কিন্তু তবুও বাবু মাকে যেন বাঘের মত ভয় করতেন দিদিমণি! মদ খেয়ে বাসায় ঢোকবার পর্যন্ত তাঁর সাহস ছিল না। বিপিনবাবু বলে বাবুর একজন বজ্জাত বন্ধু ছিল, তার সঙ্গে মিশে গান-বাজনা করতে বাবু একটা কুস্থানে যাতায়াত করতেন, মায়ের কানে যাওয়ামাত্রই সেখানে যাওয়া তাঁর একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। এমন ক্ষমতা হলো না যে, আমার সাবিত্রী মাকে তুচ্ছ করে আর সেখানে যান! বলিয়া বেহারী সগর্বে সরোজিনীর মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করিল।
সতীশের উপর আর একজন নারীর এতবড় অধিকারের সংবাদ সরোজিনীর বুকে শেলের মত বিঁধিল, তথাপি সে ধীরে ধীরে প্রশ্ন করিল, আচ্ছা বেহারী, তাঁকে এত ভয় করবার সতীশবাবুর দরকার কি ছিল?

বেহারী যেমন বুঝিয়াছিল তেমনি বলিল, আমার মা যে ভয়ানক রাশভারী লোক ছিলেন দিদিমণি! শুধু আমাদের বাবুই নয়, বাসাসুদ্ধ লোক তাকে মনে মনে ভয় করত যে। একটা দিনের কথা বলি। সেদিন অনেক রাত্তিরে বাবু কোথা থেকে মদ খেয়ে আর একটা মদের বোতল সঙ্গে নিয়ে বাসায় ফিরলেন। ভেবেছিলেন অত রাত্তিরে সাবিত্রী মা নিশ্চয়ই তার বাসায় চলে গেছে। আমি জেগে ছিলাম, দোর খুলে দিলাম। জিজ্ঞাসা করলেন, সাবিত্রী চলে গেছে না বেহারী? বললাম, না বাবু, আজ তিনি যাননি—এখানেই আছেন। যেই শোনা, অমনি মদের বোতল রাস্তায় ফেলে দিয়ে আস্তে আস্তে চোরের মত বাসায় ঢুকলেন। ৩৫৮

ভয়ে নেশাটেশা চোখের পলকে উবে গেল। বল ত দিদিমণি, তিনি ছাড়া বাবুকে কি আর কেউ কোনদিন শাসন করতে পারবে!

সরোজিনী নিঃশব্দে কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিয়া কহিল, সতীশবাবু কি এখনো মদ খান বেহারী?

বেহারী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না। কিন্তু আবার শুরু করতে কতক্ষণ দিদিমণি? তাইতে ত আজ দু’দিন ধরে কেবলি ভাবচি এই দুঃসময়ে আমার সাবিত্রী মা যদি একবার আসতেন।

সরোজিনী উৎসুক হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন বেহারী?

বেহারী কহিল, আমি বরাবর দেখি, বাবু মন খারাপ হলেই মদ খেতে আরম্ভ করেন। এক উপীনবাবুকে ভয় করেন, তা তাঁর সঙ্গেও কি জানি কি হয়ে গেছে। সে রাত্রিতে তিনি বাসায় উঠে হঠাৎ সাবিত্রী মাকে চোখে দেখতে পেয়েই সেই যে চলে গেলেন, তার পর থেকে কেউ আর কারও নাম করেন না। তবে বল দিকি দিদিমণি, মা ছাড়া বাবুকে আর কে সামলাতে পারে?

একটুখানি থামিয়া বলিতে লাগিল, অসুখের খবর পাওয়া পর্যন্ত এই পাঁচ-ছ’টা দিন বাবুর যে কি করে কেটেচে, সে তো আমি চোখের ওপরেই দেখলুম। পরশু ঘুম থেকে উঠে তারের খবর পেয়ে সেই যে মুখ থুবড়ে পড়লেন, সারাদিন আর উঠলেন না। তার পরে রাত্তিরের গাড়িতে বাড়ি চলে গেলেন।আমাকে শুধু এই কথাটি বলে গেলেন, বেহারী, তোরা সব নিয়ে-থুয়ে বাড়ি চলে আয়।

সরোজিনী ব্যগ্র হইয়া কহিল, কার অসুখ বেহারী?

বেহারী আশ্চর্য হইয়া কহিল, যাবার পথে বাবু তোমাদের বলে যাননি দিদিমণি?

সরোজিনী মাথা নাড়িয়া বলিল, না। কার অসুখ?

বেহারী নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, তা হলে মনের ভুলে অমনি সোজা চলে গেছেন, এ বাড়িতে ঢোকেন নি। যেদিন সকালে এখানে নেমন্তন্ন খেতে আসবেন, সেইদিনই চিঠি এলো বুড়োবাবুর অসুখ। তাই আর খেতে আসতে পারলেন না। টেলিগ্রাফ করে নিজেই সারাদিন পোস্টাফিসে দাঁড়িয়ে কাটালেন। কিন্তু কোন খবর এলো না। তার পরে পরশু সকালে একেবারে শেষ খবর এলো। রাত্তিরের গাড়িতে বাবু বাড়ি চলে গেলেন।
সরোজিনী চমকিয়া উঠিল, সতীশবাবুর বাবা মারা গেলেন?

বেহারী বলিল, হাঁ দিদিমণি।

কি হয়েছিল?

অনেক বয়স হয়েছিল, শুধু একটা উপলক্ষ করে প্রাণটা বেরিয়ে গেল, বলিয়া বেহারী আর্দ্রচক্ষু মার্জনা করিয়া কহিল, অন্য কিছুর জন্যে দুঃখ করিনে, কিন্তু, এই বুড়োটা ছাড়া বাবুর আপনার বলতে আর কেউ রইল না। তাই এই দুটো দিন এই শুধু ভাবচি, এখন থেকে কি যে করতে থাকবেন, তা মা দুর্গাই জানেন। বলিয়া বৃদ্ধ চাদরের প্রান্তে তাহার সিক্ত চোখ দুটো একবার ভাল করিয়া মুছিয়া লইল।

সরোজিনীর নিজের চোখেও জল আসিয়া পড়িতে লাগিল। কহিল, এবার থেকে সতীশবাবু ভাল হয়েও যেতে পারেন। মন্দই যে হবেন, এ ভয় তোমার কেন হচ্চে বেহারী?

বেহারী অন্যমনস্কের মত বলিল, কি জানি! তার পরে মুখ তুলিয়া কহিল, তোমার মুখে

ফুল-চন্দন পড়ুক দিদিমণি, বাবু ভালই হোন—আর যেন সেদিকে মতিগতি না হয়।কিন্তু যাবার সময় গাড়িতে উঠে নাকি বললেন, যাক, এক রকমে বাঁচা গেল বেহারী, সংসারে আর কারো জন্যে ভাবনা-চিন্তা করতে হবে না। তোমাকে সত্যি বলচি দিদিমণি, সেই থেকে যখনই মনে পড়চে তখনই বুকের ভিতর হুহু করে উঠচে।হাতে কত টাকাই ত এবার পড়বে—সঙ্গী-সাথীও বাবুর সব ভাল নয়—মন্দ পথে গেলে এখন কে ঠেকাবে? শুধু পারে আমার মা। বলিয়া বেহারী অজ্ঞাতসারে আর একবার তাহার শ্রোতার বক্ষে তপ্ত শেল হানিয়া হাত-দুটো জোড় করিয়া মাথায় ঠেকাইল।

সরোজিনী আঘাত সহ্য করিয়া লইয়া মৃদুকণ্ঠে কহিল, বেশ ত বেহারী, তাঁকেই কেন আসতে চিঠি লিখে দাও না?

বেহারী বলিল, ঠিকানা ত জানিনে। নিজে যদি একবার কাশী যেতে পারতাম, যেমন করে হোক খুঁজে-পেতে ফিরিয়ে আনতে পারতাম, কিন্তু আমার ত সে জো নেই; বাবুকে একলা ফেলে রেখে যেতেও ত মন সরে না। তা ছাড়া, আমি ত কখনো কাশী যাইনি,—সে দেশ ত চিনিনে, বলিয়া সে নিরুপায়ের মত সরোজিনীর মুখের প্রতি চাহিল। স্পষ্ট বুঝা গেল সতীশের এই পরম হিতৈষী বৃদ্ধ ভৃত্য প্রভুর অবশ্যম্ভাবী অমঙ্গলের আশঙ্কায় ব্যাকুল হইয়া তাহার কাছে নীরবে আশ্বাসের প্রতীক্ষা করিতেছে। কিন্তু সরোজিনী তাহাকে কোন ভরসাই দিল না, শুধু নীরবে চাহিয়া রহিল।

আজ তা হলে আসি দিদিমণি, বলিয়া বেহারী উঠিয়া আসিয়া পায়ের কাছে গড় হইয়া প্রণাম করিল এবং পুনরায় পদধূলি গ্রহণ করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। কিন্তু পরক্ষণেই অকস্মাৎ ফিরিয়া আসিয়া হাতজোড় করিয়া সম্মুখে দাঁড়াইল।

কি বেহারী?

একটা কথা নিবেদন করব দিদিমণি?

সরোজিনী অনেক কষ্টে একটুখানি ম্লান হাসি টানিয়া আনিয়া কহিল, কি কথা?
বেহারী তেমনি যুক্তকরে করুণ-কণ্ঠে কহিল, আমি গোয়ালা চাষা, তাতে বুড়োমানুষ। কি বলতে যদি কি বলে ফেলি, অপরাধ নেবেন না?

সরোজিনীর চোখ ফাটিয়া জল আসিয়া পড়িল। কিন্তু প্রাণপণে তাহা নিরোধ করিয়া ঘাড় নাড়িয়া শুধু বলিল,না।

তাহার মুখের এই একটিমাত্র ‘না’ শব্দ শুনিয়াই বেহারীর যেন চমক ভাঙ্গিয়া গেল। সে নিজেকে চাষা প্রভৃতি বলিয়া নিজের বুদ্ধিহীনতার সহস্র পরিচয় দিলেও সে আসলে নির্বোধ ছিল না। সুতরাং কেন যে সরোজিনী সাবিত্রীর কথা জিজ্ঞাসা করিতে তাহাকে পথ হইতে ডাকিয়া আনিয়াছিল, কেন যে সে এমন গভীর মনোনিবেশপূর্বক তাহার কাহিনী শুনিতেছিল, সমস্ত ব্যাপারটা তাহার কাছে অকস্মাৎ সূর্যের আলোর মত নির্মল হইয়া উঠিল। এবং না জানিয়া সে যে তরুণীকে এতক্ষণ ধরিয়া বিঁধিয়া এত বেদনা দিয়াছে, সেজন্য তাহার মনস্তাপের অবধি রহিল না। তখন বেহারী নিরতিশয় করুণ-কণ্ঠে কহিল, আমি জানি তোমার কথা কখনো ঠেলতে পারবেন না—তুমিও ইচ্ছে করলে বাবুকে অসময়ে রক্ষে করতে পার। কিন্তু আমার মন বলে,তুমি যেন তাঁকে ত্যাগ করেছ মা। বেহারী এই প্রথম সরোজিনীকে মাতৃ-সম্বোধন করিল। ‘মা’ বলিয়া কাজ আদায় করিবার ফন্দিটা বুড়া বেশ জানিত।

সরোজিনীর অশ্রু আর মানা মানিল না, দুই চক্ষু প্লাবিয়া বড় বড় ফোঁটা ঝরঝর করিয়া বুড়ার সাক্ষাতেই ঝরিয়া পড়িল। কিন্তু তাড়াতাড়ি মুছিয়া ফেলিয়া কহিল, না বেহারী, আমার দ্বারা কিছু হবে না—আমি আর তাঁর কোন কথায় নেই।

বেহারী ঘাড় নাড়িয়া কহিল, মা বলে ডেকেচি, আমি তোমার ছেলের মত। দোষ-ঘাট তাঁর যাই হয়ে থাক, আমি ঘাট মানচি, বলিয়া বেহারী ঝুঁকিয়া পড়িয়া সরোজিনীর পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া বলিল, কিন্তু তুমি ত আমার বাবুকে চেনো? এই বিপদের দিনে অভিমান করে তাঁকে মেরে ফেলতে তোমাকে ত আমি কিছুতেই দেব না মা!

সরোজিনীর নিদারুণ অভিমান গলিয়া গিয়া সতীশকে ক্ষমা করিবার জন্য একবার উন্মুখ হইয়া উঠিল বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই বুড়ার মুখের সাবিত্রীর সমস্ত প্রসঙ্গ মনে পড়িয়া তাহার বিগলিত চিত্ত চক্ষের পলকে পুনরায় শুকাইয়া কাঠ হইয়া উঠিল। সে ঘাড় নাড়িয়া শান্ত কঠোর-স্বরে কহিল, না বেহারী, তুমি ভয় করো না, সাবিত্রী এসে পড়লেই আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু, আমাকে দিয়ে তোমাদের কোন উপকার হবে না।

এই নিষ্ঠুর প্রত্যুত্তরের জন্য বেহারী একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। তাহার নিজের সর্বজয়ী ভালবাসার কাছে এই শুষ্ক কণ্ঠস্বর এমন কঠিন হইয়া বাজিল যে, সে কিছুক্ষণের জন্য বিহ্বলের মত শুধু চাহিয়া রহিল। তার পরে আর একটি কথাও না বলিয়া আর একবার প্রণাম করিয়া বাহির হইয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *