৫.১০ পাণিহাটির মহোৎসব

পঞ্চম খণ্ড – দশম অধ্যায় : পাণিহাটির মহোৎসব

নরেন্দ্রের শিক্ষকের পদ গ্রহণ

পরিবারবর্গের গ্রাসাচ্ছাদনের কষ্ট নিবারণের জন্য কিরূপে নরেন্দ্রনাথ অবশেষে ঠাকুরের শরণাপন্ন হইয়া ‘মোটা ভাত মোটা কাপড়ের অভাব থাকিবে না’-রূপ বরলাভ করিয়াছিলেন, তাহা আমরা ইতিপূর্বে বলিয়াছি। উহার পর হইতে তাহার অবস্থা ক্রমশঃ পরিবর্তিত হইয়াছিল এবং সচ্ছল না হইলেও পূর্বের ন্যায় দারুণ অভাব সংসারে আর কখন হয় নাই। ঐ ঘটনার স্বল্পকাল পরে কলিকাতার চাঁপাতলা নামক পল্লীতে মেট্রোপলিটান্ বিদ্যালয়ের একটি শাখা স্থাপিত হয় এবং পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনুগ্রহে তিনি উহাতে প্রধান শিক্ষকের পদে নিযুক্ত হয়েন। সম্ভবত ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দের মে মাস হইতে আরম্ভ করিয়া তিন-চারি মাস কাল তিনি ঐস্থানে শিক্ষকতা কার্যে নিযুক্ত ছিলেন।

জ্ঞাতিগণের শত্রুতা, ঠাকুরের রোহিণী রোগ, শিক্ষকতা পরিত্যাগ

সাংসারিক অবস্থার সামান্য উন্নতি হইলেও জ্ঞাতিবর্গের শত্রুতা চরণে নরেন্দ্রনাথকে এই সময়ে ব্যতিব্যস্ত হইতে হইয়াছিল। সময় বুঝিয়া তাহার পৈতৃক ভিটার উত্তম উত্তম গৃহ এবং স্থানগুলি ছলে বলে কৌশলে দখল করিয়াছিল। তজ্জন্য তাহাকে এখন কিছুকালের জন্য ঐ বাটী ত্যাগপূর্বক রামতনু বসুর লেনস্থ তাহার মাতামহীর ভবনে বাস করিতে হইয়াছিল এবং ন্যায্য অধিকারলাভের জন্য তাঁহাদিগের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে অভিযোগ আনয়নপূর্বক সকল বিষয়ের বন্দোবস্ত করিতে হইয়াছিল। তাঁহার পিতৃবন্ধু এটর্নী নিমাইচরণ বসু মহাশয় তাহাকে ঐ বিষয়ে বিশেষ সহায়তা করিয়াছিলেন। মোকদ্দমার তদ্বিরে অনেক সময় অতিবাহিত করিতে হইবে বুঝিয়া এবং ওকালতি (বি,এল) পরীক্ষা প্রদানের কাল নিকটবর্তী জানিয়া তিনি ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে শিক্ষকতা কৰ্ম্ম পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। ঐ বিষয়ের অন্য একটি গুরুতর কারণও বিদ্যমান ছিল—ঠাকুর এখন রোহিণী (গলরোগ) রোগে আক্রান্ত হইয়াছিলেন এবং উহা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় নরেন্দ্র স্বয়ং উপস্থিত থাকিয়া তাহার চিকিৎসা ও সেবাদির বন্দোবস্ত করার প্রয়োজন অনুভব করিয়াছিলেন।

অধিক বরফ ব্যবহারে ঠাকুরের অসুস্থতা

১৮৮৫ খৃষ্টাব্দের গ্রীষ্মাতিশয়ে ঠাকুরকে বিশেষ কষ্ট পাইতে দেখিয়া ভক্তগণ তাহাকে বরফ ব্যবহার করিতে অনুরোধ করিয়াছিল। বরফ খাইয়া তাহাকে স্বচ্ছন্দ বোধ করিতে দেখিয়া অনেকে এই সময়ে দক্ষিণেশ্বরে বরফ লইয়া যাইতে লাগিল এবং সরবত পানীয়াদির সহিত উহা সর্বদা ব্যবহার করিয়া তিনি বালকের ন্যায় আনন্দ করিতে লাগিলেন। কিন্তু দুই-এক মাস ঐরূপ করিবার পরে তাহার গলদেশে বেদনা উপস্থিত হইল। বোধ হয় চৈত্র মাসের শেষ অথবা বৈশাখের প্রারম্ভে তিনি ঐরূপ বেদনা প্রথম অঙ্কুভব করিয়াছিলেন।

অধিক কথা কহার ও ভাবাবেশে রোগবৃদ্ধি

মাসাবধিকাল অতীত হইলেও ঐ বেদনার উপশম হইল না এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের অর্ধেক যাইতে না যাইতে উহা এক নূতন আকার ধারণ করিল-অধিক কথা কহিলে এবং সমাধিস্থ হইবার পরে উহার বৃদ্ধি হইতে লাগিল। ঠাণ্ডা লাগিয়া তাহার কন্ঠতালুদেশ ঈষৎ স্ফীত হইয়াছে ভাবিয়া প্রথমে সামান্য প্রলেপের ব্যবস্থা হইল। কিন্তু কয়েক দিবস ঔষধ প্রয়োগেও ফল পাওয়া গেল না দেখিয়া জনৈক ভক্ত বহুবাজারের রাখাল ডাক্তারের ঐরূপ ব্যাধি আরোগ্য করিবার দক্ষতার কথা শুনিয়া তাহাকে ডাকিয়া আনিল। ডাক্তার রোগনির্ণয় করিয়া গলার ভিতরে এবং বাহিরে লাগাইবার অন্য ঔষধ ও মালিসের বন্দোবস্ত করিলেন এবং ঠাকুর যাহাতে কয়েক দিন অধিক কথা না বলেন ও বারম্বার সমাধিস্থ না হয়েন, তদ্বিষয়ে আমাদিগকে যথাসম্ভব লক্ষ্য রাখিতে বলিলেন।

পাণিহাটির মহোৎসবের ইতিহাস

ক্রমে জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী আগতপ্রায় হইল। কলিকাতার কয়েক মাইল উত্তরে অবস্থিত গঙ্গাতীরবর্তী পাণিহাটি গ্রামে প্রতি বৎসর ঐ দিবসে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের বিশেষ মেলা হইয়া থাকে। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রধান পার্ষদগণের অন্যতম শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামীর জ্বলন্ত ত্যাগ বৈরাগ্যের কথা বলে চিরস্মরণীয় হইয়া রহিয়াছে। পরমা সুন্দরী স্ত্রী ও অতুল বৈভব ত্যাগপূৰ্ব্বক পিতার একমাত্র পুত্র রঘুনাথ শ্রীচৈতন্যদেবের চরণাশ্রয়-মানসে যখন প্রথম শান্তিপুরে আসিয়া উপস্থিত হয়েন, তখন তিনি তাহাকে ‘মর্কট বৈরাগ্য’(১) পরিত্যাগ করিয়া কিছুকালের নিমিত্ত গৃহে অবস্থান করিতে আদেশ করিয়াছিলেন। রঘুনাথ, মহাপ্রভুর ঐ আদেশ শিরোধার্য্য করিয়া গৃহে ফিরিয়া আসেন এবং সংসার ত্যাগ করিবার প্রবল বাসনা অন্তরে লুক্কায়িত রাখিয়া ইতর-সাধারণের ন্যায় বিষয় কার্য্যের পরিচালনা প্রভৃতি সাংসারিক সকল বিষয়ে পিতা ও পিতৃব্যকে সাহায্য করিতে থাকেন। ঐরূপে অবস্থান করিলেও তিনি মধ্যে মধ্যে শ্রীচৈতন্য-পার্ষদগণকে না দেখিয়া থাকিতে পারিতেন না এবং পিতার অনুমতি গ্রহণপূর্বক কখন কখন তাহাদিগের নিকট উপস্থিত হইয়া কয়েক দিবস তাহাদিগের পূতসঙ্গে অতিবাহিত করিয়া বাটীতে ফিরিয়া যাইতেন। ঐরূপে দিন যাইতে লাগিল এবং ত্যাগের অবসর অন্বেষণ করিয়া রঘুনাথ সংসারে কাল কাটাইতে লাগিলেন। ক্রমে শ্রীগৌরাঙ্গ সন্ন্যাস লইয়া নীলাচলে বাস করিলেন এবং নিত্যানন্দ বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের ভার প্রাপ্ত হইয়া গঙ্গাতীরবর্তী খড়দহ গ্রামকে প্রধান কেন্দ্রস্বরূপ করিয়া বঙ্গের নানা স্থানে পরিভ্রমণ ও নামসংকীৰ্ত্তনাদি দ্বারা বহু ব্যক্তিকে উক্ত ধর্মে দীক্ষিত করিতে লাগিলেন।

সাঙ্গোপাঙ্গ-পরিবৃত শ্রীনিত্যানন্দ ধর্মপ্রচারকল্পে এক সময়ে পাণিহাটি গ্রামে অবস্থান করিবার কালে রঘুনাথ তাঁহাকে দর্শন করিতে উপস্থিত হয়েন এবং চিড়া, দধি, দুগ্ধ, শর্করা, কদলী প্রভৃতি দেবতাকে নিবেদনপূর্বক ভক্তমণ্ডলীসহ তাহাকে ভোজন করাইতে আদিষ্ট হয়েন। রঘুনাথ উহা সানন্দে স্বীকার করিয়া শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুকে দর্শন করিতে সমাগত শত শত ব্যক্তিকে সেইদিন ভাগীরথী তীরে ভোজনদানে পরিতৃপ্ত করেন। উৎসবান্তে নিত্যানন্দ প্রভুকে প্রণামপূর্বক বিদায় গ্রহণ করিতে যাইলে তিনি ভাবাবেশে রঘুনাথকে আলিঙ্গনপূর্বক বলিয়াছিলেন, ‘কাল পূর্ণ হইয়াছে, সংসার পরিত্যাগপূর্বক নীলাচলে শ্রীমহাপ্রভুর নিকট গমন করিলে তিনি তোমাকে এখন আশ্রয় প্রদান করিবেন এবং ধৰ্ম্মজীবন সম্পূর্ণ করিবার জন্য সনাতন গোস্বামীর হস্তে তোমার শিক্ষার ভার অর্পণ করিবেন’। নিত্যানন্দ প্রভুপাদের ঐরূপ আদেশে রঘুনাথের উল্লাসের অবধি রহিল না এবং বাটীতে ফিরিবার অনতিকাল পরে তিনি চিরকালের মত সংসার ত্যাগ করিয়া নীলাচলে গমন করিলেন। রঘুনাথ চলিয়া যাইলেন কিন্তু বৈষ্ণব ভক্তগণ তাহার কথা চিরকাল স্মরণ রাখিয়া তদবধি প্রতি বৎসর ঐ দিবস পাণিহাটি গ্রামে গঙ্গাতীরে সমাগত হইয়া তাহার ন্যায় ভগবৎপ্রসন্নতা লাভের জন্য শ্রীগৌরাঙ্গ ও শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুপাদের উদ্দেশ্যে ঐরূপ উৎসব সম্পন্ন করিতে লাগিলেন। কালে উহা পাণিহাটির ‘চিড়ার মহোৎসব’ নামে ভক্ত-সমাজে খ্যাতি লাভ করিল।

———–

(১) অর্থাৎ লোক-দেখান

ঠাকুরের উক্ত মহোৎসব দেখিতে যাইবার সংকল্প

ঠাকুর ইতিপূৰ্বে পাণিহাটির মহোৎসবে অনেকবার যোগদান করিয়াছিলেন বলিয়া আমরা অন্যত্র উল্লেখ করিয়াছি। কিন্তু তাহার ইংরাজী শিক্ষিত ভক্তগণের আগমনের কাল হইতে ঠাকুরের উক্ত, নানা কারণে তিনি কয়েক বৎসর উহা করিতে পারেন নাই। নিজ ভক্তগণের সহিত ঐ উৎসব দর্শনে যাইতে তিনি এই বৎসর অভিলাষ প্রকাশ পূৰ্ব্বক আমাদিগকে বলিলেন, “সেখানে ঐ দিন আনন্দের মেলা, হরিনামের হাট-বাজার বসে–তোরা সব ‘ইয়ং বেঙ্গল’ কখন ঐরূপ দেখিস নাই, চল দেখিয়া আসিবি।” রামচন্দ্র দত্ত প্রমুখ ভক্ত দিগের মধ্যে একদল ঐ কথায় বিশেষ আনন্দিত হইলেও কেহ কেহ তাঁহার গলদেশে বেদনার কথা ভাবিয়া তাহাকে ঐ বিষয়ে নিরস্ত করিবার চেষ্টা করিল। তাহাদিগের সন্তোষের জন্য তিনি বলিলেন, “এখান হইতে সকাল সকাল দুইটি খাইয়া যাইব এবং দুই-এক ঘণ্টা কাল তথায় থাকিয়া ফিরিব, তাহাতে বিশেষ ক্ষতি হইবে না; ভাবসমাধি অধিক হইলে গলার ব্যথাটা বাড়িতে পারে বটে, ঐ বিষয়ে একটু সামলাইয়া চলিলেই হইবে।” তাহার ঐরূপ কথায় সকল ওজর-আপত্তি ভাসিয়া গেল এবং ভক্তগণ তাঁহার পাণিহাটি যাইবার বন্দোবস্ত করিতে লাগিল।

উৎসব দিবসে যাত্রার পূর্বে

জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী–আজ পাণিহাটির মহোৎসব। প্রায় পঁচিশ জন ভক্ত দুইখানি নৌকা ভাড়া করিয়া প্রাতে নয় ঘটিকার ভিতরে দক্ষিণেশ্বরে সমাগত হইল। কেহ কেহ পদব্রজে আসিয়া উপস্থিত হইল। ঠাকুরের নিমিত্ত একখানি পৃথক নৌকা ভাড়া হইয়া ঘাটে বাঁধা রহিয়াছে দেখা গেল। কয়েকজন স্ত্রীভক্ত অতি প্রত্যুষে আসিয়াছিলেন—শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীর সহিত মিলিত হইয়া তাহারা ঠাকুরের ও ভক্তগণের আহারের বন্দোবস্ত করিলেন। বেলা দশটার ভিতরে সকলে ভোজন করিয়া যাইবার জন্য প্রস্তুত হইল।

শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীর না যাইবার কারণ

ঠাকুরের ভোজনান্তে শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণী জনৈকা স্ত্রীভক্তের দ্বারা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইলেন, তিনি (মা) যাইবেন কি না। ঠাকুর তাহাকে বলিলেন, “তোমরা ত যাইতেছ, যদি ওর (মা’র) ইচ্ছা হয় ত চলুক।” শ্ৰীশ্রীমা ঐ কথা শুনিয়া বলিলেন, “অনেক লোক সঙ্গে যাইতেছে, সেখানেও অত্যন্ত ভিড় হইবে, অত ভিড়ে নৌকা হইতে নামিয়া উৎসব দর্শন করা আমার পক্ষে দুষ্কর হইবে, আমি যাইব না।” শ্ৰীশ্ৰীমা যাইবার সঙ্কল্প ত্যাগ করিলেন এবং দুই-তিন জন স্ত্রীভক্ত যাহারা যাইবেন বলিয়া স্থির করিয়াছিলেন, তাহাদিগকে ভোজন করাইয়া ঠাকুরের নৌকায় গমন করিতে আদেশ করিলেন।

যাত্রাকালে ও উৎসবস্থলে পৌঁছিয়া যাহা দেখা গেল

বেলা দ্বিতীয় প্রহর আন্দাজ পাণিহাটিতে পৌঁছিয়া দেখা গেল গঙ্গাতীরে প্রাচীন বটগাছের চতুঃপার্শ্বে অনেক লোক সমাগত হইয়াছে এবং বৈষ্ণব ভক্তগণ স্থানে স্থানে সঙ্কীর্তনে আনন্দ করিতেছেন। ঐরূপ করিলেও কিন্তু তাহাদিগের মধ্যে অনেকে ভগবৎনামগানে যথার্থ মগ্ন হইয়াছেন বলিয়া বোধ হইল না। সর্বত্র একটা অভাব ও প্রাণহীনতা চক্ষে পড়িতে লাগিল। নৌকায় যাইবার কালে এবং তথায় উপস্থিত হইয়া নরেন্দ্রনাথ, বলরাম, গিরিশচন্দ্র, রামচন্দ্র, মহেন্দ্রনাথ প্রভৃতি প্রধান ভক্তসকলে ঠাকুরকে বিশেষ করিয়া অনুরোধ করিয়াছিলেন যাহাতে তিনি কোনও কীর্তনসম্প্রদায়ের সহিত মিলিত হইয়া মাতামাতি না করেন। কারণ, কীর্তনে মাতিলে তাহার ভাবাবেশ হওয়া অনিবাৰ্য্য হইবে এবং উহাতে গলদেশের বেদনা বৃদ্ধি পাইবে।

মণি সেনের বাটী

নৌকা হইতে নামিয়া ঠাকুর ভক্তসঙ্গে বরাবর শ্রীযুক্ত মণি সেনের বাটীতে যাইয়া উঠিলেন। তাহার আগমনে আনন্দিত হইয়া মণি বাবুর বাটীর সকলে তাহাকে প্রণাম পুরঃসর বৈঠকখানায় লইয়া যাইয়া বসাইলেন। ঘরখানি টেবিল, চেয়ার, সোফা, কার্পেটাদি দ্বারা ইংরাজী ধরণে সুসজ্জিত। এখানে দশ-পনর মিনিট বিশ্রাম করিয়াই তিনি সকলকে সঙ্গে লইয়া ইহাদিগের ঠাকুরবাটীতে রাধাকান্তজীকে দর্শন করিবার মানসে উঠিলেন।

মণি বাবুর ঠাকুরবাটী

বৈঠকখানাগৃহের পার্শ্বে ই ঠাকুরবাটী। পার্শ্বের দরজা দিয়া আমরা একেবারে মন্দিরসংলগ্ন নাটমন্দিরের উপরে উপস্থিত হইয়া যুগলবিগ্রহ মূর্তির দর্শন-লাভ করিলাম। মূর্তি দুইটি সুন্দর। কিছুক্ষণ দর্শনান্তে ঠাকুর অর্ধবাহ্য অবস্থায় প্রণাম করিতে লাগিলেন। নাটমন্দিরের মধ্যভাগ হইতে পাঁচ-সাতটি ধাপ নামিয়া ঠাকুরবাটীর চক্‌মিলান প্রশস্ত উঠান ও সদর ফটক। ফটকটি এমন স্থানে বিদ্যমান যে ঠাকুর বাটীতে প্রবেশমাত্র বিগ্রহমূর্তির দর্শন লাভ হয়। ঠাকুর যখন প্রণাম করিতেছিলেন তখন একদল কীৰ্ত্তন উক্ত ফটক দিয়া উঠানে প্রবেশপূর্বক গান আরম্ভ করিল। বুঝা গেল মেলাস্থলে যত কীৰ্ত্তনসম্প্রদায় আসিতেছে তাহাদিগের প্রত্যেকে প্রথমে এখানে আসিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া পরে গঙ্গাতীরে আনন্দ করিতে যাইতেছে। শিখা-সূত্ৰধারী, তিলকচক্রাঙ্কিত দীর্ঘ স্থূলবপু, গৌরবর্ণ, প্রৌঢ়বয়স্ক এক পুরুষ ঝুলিতে মালা জপিতে জপিতে ঐ সময়ে উঠানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাহার স্কন্ধে উত্তরীয়, পরিধানে ধোপদস্ত রেলির উনপঞ্চাশের থান ধুতি, সুন্দরভাবে গুছাইয়া পরা এবং ট্যাঁকে একগোছা পয়সা—দেখিলেই মনে হয় কোন গোস্বামিপুঙ্গব মেলার সুযোগে দুই পয়সা আদায়ের জন্য সাজিয়া-গুজিয়া বাহির হইয়াছেন। কীৰ্ত্তনসম্প্রদায়কে উত্তেজিত করিবার জন্য এবং বোধ হয় সমাগত ব্যক্তিবর্গকে নিজ মহত্বে মুগ্ধ করিতে তিনি আসিয়াই কীৰ্ত্তনদলের সহিত মিলিত হইয়া ভাবাবিষ্টের ন্যায় অঙ্গভঙ্গী, হুঙ্কার ও নৃত্য করিতে লাগিলেন।

ঠাকুরের ভাবাবেশ ও নৃত্য

প্রণামান্তে ঠাকুর নাটমন্দিরের একপার্শ্বে দণ্ডায়মান হইয়া কীর্তন শুনিতেছিলেন। গোস্বামীজীর বেশভূষার পারিপাট্য ও ভাবাবেশের ভান দেখিয়া ঈষৎ হাসিয়া তিনি নরেন্দ্রপ্রমুখ পার্শ্বস্থ ঠাকুরের ভক্তগণকে মৃদুস্বরে বলিলেন, “ঢং দ্যাখ!” তাঁহার ঐরূপ পরিহাসে সকলের মুখে হাস্যের রেখা দেখা দিল এবং তিনি কিছুমাত্র ভাবাবিষ্ট না হইয়া আপনাকে বেশ সামলাইয়া চলিতেছেন ভাবিয়া তাহারা নিশ্চিত হইল। কিন্তু পরক্ষণেই দেখা গেল, ঠাকুর কেমন করিয়া তাহারা বুঝিবার পূর্বে চক্ষের নিমেষে তাহাদিগের মধ্য হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া এক লম্ফে কীৰ্ত্তনদলের মধ্যভাগে সহসা অবতীর্ণ হইয়াছেন এবং ভাবাবেশে তাঁহার বাহ্যসংজ্ঞার লোপ হইয়াছে। ভক্তগণ তখন শশব্যন্তে নাটমন্দির হইতে নামিয়া তাহাকে বেষ্টন করিয়া দাঁড়াইল এবং তিনি কখন অর্ধ-বাহ্যদশা লাভপূর্বক সিংহ-বিক্রমে নৃত্য করিতে এবং কখন সংজ্ঞা হারাইয়া স্থির হইয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। ভাবাবেশে নৃত্য করিতে করিতে যখন তিনি দ্রুতপদে তালে তালে কখন অগ্রসর এবং কখন পশ্চাতে পিছাইয়া আসিতে লাগিলেন, তখন মনে হইতে লাগিল তিনি যেন ‘সুখময় সায়রে’ মীনের ন্যায় মহানন্দে সন্তরণ ও ছুটাছুটি করিতেছেন। প্রতি অঙ্গের গতি ও চালনাতে ঐ ভাব পরিস্ফুট হইয়া তাহাতে যে অদৃষ্টপূর্ব কোমলতা ও মাধুৰ্য-মিশ্রিত উদ্দাম উল্লাসময় শক্তির প্রকাশ উপস্থিত করিল, তাহা বর্ণনা করা অসম্ভব। স্ত্রীপুরুষের হাবভাবময় মনোমুগ্ধকারী নৃত্য অনেক দেখিয়াছি, কিন্তু দিব্য ভাবাবেশে আত্মহারা হইয়া তাণ্ডবনৃত্য করিবার কালে ঠাকুরের দেহে যেরূপ রুদ্র-মধুর সৌন্দর্য ফুটিয়া উঠিত, তাহার আংশিক ছায়াপাতও ঐ সকলে আমাদিগের নয়নগোচর হয় নাই। প্রবল ভাবোল্লাসে উদ্বেলিত হইয়া তাহার দেহ যখন হেলিতে দুলিতে ছুটিতে থাকিত তখন ভ্রম হইত, উহা বুঝি কঠিন জড় উপাদানে নির্মিত নহে, বুঝি আনন্দসাগরে উত্তাল তরঙ্গ উঠিয়া প্রচণ্ডবেগে সম্মুখস্থ সকল পদার্থকে ভাসাইয়া অগ্রসর হইতেছে—এখনই আবার গলিয়া তরল হইয়া উহার ঐ আকার লোকদৃষ্টির অগোচর হইবে। আসল ও নকল পদার্থের মধ্যে কত প্রভেদ কাহাকেও বুঝাইতে হইল না, কীৰ্ত্তন সম্প্রদায় গোস্বামীজীর দিকে আর দৃষ্টিপাত না করিয়া ঠাকুরকে বেষ্টনপূর্বক শতগুণ উৎসাহ-আনন্দে গান গাহিতে লাগিল।

রাঘব পন্ডিতের বাটীতে যাইবার পথে        

প্রায় অর্ধঘণ্টাকাল এইরূপে অতীত হইলে ঠাকুরকে কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ দেখিয়া ভক্তগণ তাঁহাকে কীৰ্ত্তনসম্প্রদায়ের মধ্য হইতে সরাইয়া লইয়া যাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। স্থির হইল, এখন হইতে অল্প দূরে অবস্থিত মহাপ্রভুর পার্ষদ রাঘব পন্ডিতের বাটীতে যাইয়া তিনি যে যুগলবিগ্রহ ও শালগ্রামশিলার নিত্য সেবা করিতেন তাহা দর্শনপূর্বক নৌকায় ফিরা যাইবে। ঠাকুর ঐ কথায় সম্মত হইয়া ভক্তবৃন্দ সঙ্গে মণি সেনের ঠাকুরবাটী হইতে বহির্গত হইলেন। কীর্তনসম্প্রদায় কিন্তু তাহার সঙ্গ ছাড়িল না, মহোৎসাহে নামগান করিতে করিতে পশ্চাতে আসিতে লাগিল। ঠাকুর উহাতে দুই-চারি পদ অগ্রসর হইয়াই ভাবাবেশে স্থির হইয়া রহিলেন। অর্ধবাহ্যদশা প্রাপ্ত হইলে ভক্তগণ তাহাকে অগ্রসর হইতে অনুরোধ করিল, তিনিও দুই-চারি পদ চলিয়া পুনরায় ভাবাবিষ্ট হইলেন। পুনঃ পুনঃ ঐরূপ হওয়াতে ভক্তগণ অতি ধীরে অগ্রসর হইতে বাধ্য হইল।

ভাবাবিষ্ট ঠাকুরের অপূর্ব শ্রী

ভাবাবিষ্ট ঠাকুরের শরীরে সেই দিন যে দিব্যোজ্জল সৌন্দর্য্য দর্শন করিয়াছি সেইরূপ আর কখনও নয়নগোচর হইয়াছে বলিয়া স্মরণ হয় না। দেব-দেহের সেই অপূর্ব শ্রী যথাযথ বর্ণনা করা মনুষ্যশক্তির পক্ষে অসম্ভব। ভাবাবেশে দেহের অতদুর পরিবর্তন নিমেষে উপস্থিত হইতে পারে এ কথা আমরা ইতিপূর্বে কখনও কল্পনা করি নাই। তাহার উন্নত বপু প্রতিদিন যেমন দেখিয়াছি তদপেক্ষা অনেক দীর্ঘ এবং স্বপ্নদৃষ্ট শরীরের ন্যায় লঘু বলিয়া প্রতীত হইতেছিল, শ্যামবর্ণ উজ্জ্বল হইয়া গৌরবর্ণে পরিণত হইয়াছিল; ভাবপ্রদীপ্ত মুখমণ্ডল অপূর্ব জ্যোতি বিকীর্ণ করিয়া চতুঃপার্শ্ব আলোকিত করিয়াছিল, এবং মহিমা করুণা শান্তি ও আনন্দপূর্ণ মুখের সেই অনুপম হাসি দৃষ্টিপথে পতিত হইবা মাত্র মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় জনসাধারণকে কিছুক্ষণের জন্য সকল কথা ভুলাইয়া তাঁহার পদানুসরণ করাইয়াছিল! উজ্জ্বল গৈরিক বর্ণের পরিধেয় গরদখানি ঐ অপূর্ব অঙ্গকান্তির সহিত পূর্ণ সামঞ্জস্যে মিলিত হইয়া তাহাকে অগ্নিশিখাপরিব্যাপ্ত বলিয়া ভ্রম জন্মাইতেছিল।

ঠাকুরের দিব্যদর্শনে কীর্তন-সম্প্রদায়ের উৎসাহ ও উল্লাস

মণি বাবুর ঠাকুরবাটী হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া রাজপথে আসিবামাত্ৰ কীৰ্ত্তনসম্প্রদায় তাহার দিব্যোজ্জ্বল শ্ৰী, মনোহর নৃত্য ও পুনঃ পুনঃ গভীর ভাবাবেশ দর্শনে নবীন উৎসাহে পূর্ণ হইয়া গান ধরিল—

সুরধুনীর তীরে হরি বলে কে রে,
বুঝি প্রেমদাতা নিতাই এসেছে।
ওরে হরি বলে কে রে,
জয় রাধে বলে কে রে,
বুঝি প্রেমদাতা নিতাই এসেছে—
(আমাদের) প্রেমদাতা নিতাই এসেছে।
নিতাই নইলে প্রাণ জুড়াবে কিসে–
(এই আমাদের) প্রেমদাতা নিতাই এসেছে।

জনসাধারণের আকৃষ্ট হওয়া

শেষ ছত্রটি গাহিবার কালে তাহারা ঠাকুরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশপূর্বক বারংবার ‘এই আমাদের প্রেমদাতা’ বলিয়া মহানন্দে নৃত্য করিতে লাগিল। তাহাদিগের ঐ উৎসাহ উৎসবস্থলে সমাগত জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক তাহাদিগকে তথায় আনয়ন করিতে লাগিল এবং যাহারা আসিয়া একবার ঠাকুরকে দর্শন করিল তাহারা মোহিত হইয়া মহোল্লাসে কীৰ্ত্তনে যোগদান করিল অথবা প্রাণে অনির্বচনীয় দিব্য ভাবোদয়ে স্তব্ধ হইয়া নীরবে ঠাকুরকে অনিমেষে দেখিতে দেখিতে সঙ্গে যাইতে লাগিল। জনসাধারণের উৎসাহ ক্রমে সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় চতুর্দিকে বিস্তৃত হইয়া পড়িল এবং অন্য কয়েকটি কীৰ্ত্তনসম্প্রদায় আসিয়া পূর্বোক্ত দলের সহিত যোগদান করিল। ঐরূপে এক বিরাট জনসঙ্ঘ ভাবাবিষ্ট ঠাকুরকে বেষ্টন করিয়া রাঘব পণ্ডিতের কুটীরাভিমুখে ধীরপদে অগ্রসর হইতে লাগিল।

মালসা ভোগ

গঙ্গাতীরবর্তী বটবৃক্ষের নিম্নে শ্রীগৌরাঙ্গ ও নিত্যানন্দ প্রভুদ্বয়ের উদ্দেশে কয়েক মালসা ফলাহার উৎসর্গ করাইয়া স্ত্রীভক্তেরা ঠাকুরের নিমিত্ত আনয়ন করিতেছিলেন। রাঘব পণ্ডিতের বাটীতে উপস্থিত হইবার কিছু পূর্বে একজন ভেকধারী কুৎসিত কদাকার বাবাজী সহসা কোথা হইতে আসিয়া এক মালসা প্রসাদ জনৈকা স্ত্রীভক্তের হস্ত হইতে কাড়িয়া লইল এবং যেন ভাবে প্রেমে গদগদ হইয়া উহার কিয়দংশ ঠাকুয়ের মুখে স্বহস্তে প্রদান করিল। ঠাকুর তখন ভাবাবেশে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, বাবাজী স্পর্শ করিবামাত্র তাহার সর্বাঙ্গ সহসা শিহরিয়া উঠিয়া ভাবভঙ্গ হইল এবং মুখে প্রদত্ত খাদ্যদ্রব্য থু থু করিয়া নিক্ষেপপূর্বক মুখ ধৌত করিলেন। ঐ ঘটনায় বাবাজীকে ভণ্ড বলিয়া বুঝিতে কাহারও বিলম্ব হইল না এবং সকলে তাহার উপর বিরক্তি ও বিদ্রুপের সহিত কটাক্ষ করিতেছে দেখিয়া সে দূরে পলায়ন করিল। ঠাকুর তখন অন্য এক ভক্তের নিকট হইতে প্রসাদকণিকা গ্রহণপূর্বক ভক্তগণকে অবশিষ্টাংশ খাইতে দিলেন।

নৌকায় প্রত্যাবর্তন ও নবচৈতন্যকে কৃপা

ঐরূপে ঐ পথ অতিক্রম করিয়া রাঘব পণ্ডিতের বাটীতে পৌঁছিতে প্রায় তিন ঘণ্টা কাল লাগিল। এখানে আসিয়া মন্দির মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া দর্শন, স্পর্শন ও বিশ্রামাদি করিতে ঠাকুরের অর্থ ঘণ্টা কাল অতীত হইল এবং সঙ্গে সেই বিরাট জনসঙ্ঘ ধীরে ধীরে ইতস্ততঃ ছড়াইয়া পড়িল। ভিড় কমিয়াছে দেখিয়া ভক্তগণ তাহাকে নৌকায় লইয়া আসিল। কিন্তু এখানেও এক অদ্ভুত ব্যাপার উপস্থিত হইল। কোন্নগরনিবাসী নবচৈতন্য মিত্র উৎসবস্থলে ঠাকুর আসিয়াছেন শুনিয়া দর্শনের জন্য ব্যাকুল হইয়া চারিদিকে অন্বেষণ করিতেছিল। এখন নৌকামধ্যে তাহাকে দেখিতে পাইয়া এবং নৌকা ছাড়িবার উপক্ৰম করিতেছে দেখিয়া সে উন্মত্তের ন্যায় ছুটিয়া আসিয়া তাহার পদপ্রান্তে আছাড় খাইয়া পড়িল এবং ‘কৃপা করুন’ বলিয়া প্রাণের আবেগে ক্রন্দন করিতে লাগিল। ঠাকুর তাহার ব্যাকুলতা ও ভক্তি দর্শনে তাহাকে ভাবাবেশে স্পর্শ করিলেন। উহাতে কি অপূর্ব দর্শন উপস্থিত হইল বলিতে পারি না, কিন্তু তাহার ব্যাকুল ক্রন্দন নিমেষের মধ্যে অসীম উল্লাসে পরিণত হইল এবং বাহ্যজ্ঞানশূন্যের ন্যায় সে নৌকার উপরে তাণ্ডব নৃত্য ও ঠাকুরকে নানারূপে স্তবস্তুতিপূৰ্ব্বক বারংবার সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করিতে লাগিল! ঐরূপে কিছুক্ষণ অতীত হইলে ঠাকুর তাহার পৃষ্ঠদেশে হাত বুলাইয়া নানা প্রকারে উপদেশ প্রদানপূর্বক শান্ত করিলেন। নবচৈতন্য ইতিপূৰ্ব্বে অনেকবার ঠাকুরকে দর্শন করিলেও এতদিন তাহার কৃপালাভ করিতে পারে নাই, অদ্য তল্লাভে কৃতার্থ হইয়া সংসারের ভার পুত্রের উপর অর্পণপূর্বক নিজগ্রামে গঙ্গাতীরে পর্ণকুটীরে জীবনের অবশিষ্ট কাল বানপ্রস্থের ন্যায় সাধন-ভজন ও ঠাকুরের নামগুণগানে অতীত করিয়াছিল। এখন হইতে সংকীৰ্ত্তনকালে বৃদ্ধ নবচৈতন্যের ভাবাবেশ উপস্থিত হইত এবং তাহার ভক্তি ও আনন্দময় মূর্তি দর্শনে অনেকে তাহাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করিত। ঐরূপে নবচৈতন্য ঠাকুরের কৃপায় পরজীবনে বহুব্যক্তির হৃদয়ে ভগবদ্ভক্তি উদ্দীপনে সমর্থ হইয়াছিল।

দক্ষিণেশ্বরে পৌছান—বিদায়কালে জনৈক ভক্তের সহিত ঠাকুরের কথা

নবচৈতন্য বিদায় গ্রহণ করিলে ঠাকুর নৌকা ছাড়িতে আদেশ করিলেন। কিছুদূর আসিতে না আসিতে সন্ধ্যা হইল এবং রাত্রি সাড়ে আটটা আন্দাজ আমরা দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীতে উপস্থিত হইলাম। অনন্তর ঠাকুর গৃহমধ্যে উপবিষ্ট হইলে ভক্তগণ তাহাকে প্রণামপূর্বক কলিকাতায় ফিরিবার জন্য বিদায় গ্রহণ করিল। সকলে নৌকারোহণ করিতেছে এমন সময়ে একব্যক্তির মনে হইল জুতা ভুলিয়া আসিয়াছে এবং উহা আনিবার জন্য সে পুনরায় ঠাকুরের গৃহাভিমুখে ছুটিল। তাহাকে দেখিয়া ঠাকুর ফিরিবার কারণ জিজ্ঞাসাপূর্বক পরিহাস করিয়া বলিলেন, “ভাগ্যে ঐ নৌকা ছাড়িবার পূর্বে মনে হইল, নতুবা আজিকার সমস্ত আনন্দটা ঐ ঘটনায় পণ্ড হইয়া যাইত।” যুবক ঐ কথায় হাসিয়া তাহাকে প্রণাম করিয়া চলিয়া আসিবার উপক্ৰম করিলে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “আজ কেমন দেখিলি বল দেখি? যেন হরিনামের হাটবাজার বসিয়া গিয়াছে-না?” সে ঐ কথায় সায় দিলে তিনি নিজ ভক্তগণের মধ্যে কোন্ কোন্ ব্যক্তির উৎসবস্থলে ভাবাবেশ হইয়াছিল তদ্বিষয়ের উল্লেখপূর্বক ছোট নরেন্দ্রের প্রশংসা করিয়া বলিলেন, “কেলে ছোঁড়াটা অল্পদিন হইল এখানে আসা-যাওয়া করিতেছে, ইহার মধ্যেই তাহার ভাব হইতে আরম্ভ হইয়াছে। সেদিন তাহার ভাব আর ভাঙ্গে না–এক ঘণ্টার উপর বাহ্যসংজ্ঞা ছিল না! সে বলে তাহার মন আজকাল নিরাকারে লীন হইয়া যায়। ছোট নরেন বেশ ছেলে–না? তুই একদিন তাহার বাটীতে যাইয়া আলাপ করিয়া আসিবি–কেমন?” যুবক তাহার সকল কথায় সায় দিয়া বলিল, “কিন্তু মশায়! বড় নরেনকে আমার যেমন ভাল লাগে এমন আর কাহাকেও না, সেজন্য ছোট নরেনের বাটীতে যাইতে ইচ্ছা হইতেছে না।” ঠাকুর উহাতে তাহাকে তিরস্কার করিয়া বলিলেন, “তুই ছোঁড়া ত ভারি একঘেয়ে, একঘেয়ে হওয়াটা হীন বুদ্ধির কাজ, ভগবানের পাঁচ ফুলে সাজি—নানা প্রকারের ভক্ত, তাহাদের সকলের সহিত মিলিত হইয়া আনন্দ করিতে না পারাটা বিষম হীন বুদ্ধির কাজ; তুই ছোট নরেনের নিকটে একদিন নিশ্চয় যাইবি-কেমন, যাইবি ত?” সে অগত্যা সম্মত হইয়া তাহাকে প্রণামপূর্বক বিদায় গ্রহণ করিল। পরে জানা গিয়াছিল, ঐ ব্যক্তি কয়েক দিন পরে ঠাকুরের কথামত ছোট নরেনের সহিত আলাপ করিতে যাইয়া তাহার কথায় জীবনের গুরুতর জটিল এক সমস্যার সমাধান লাভপূর্বক ধন্য হইয়াছিল। নৌকা সেইদিন কলিকাতায় পৌঁছিতে রাত্রি প্রায় দশটা বাজিয়াছিল।

রাত্রে আহারকালে শ্রীশ্রীমার সম্বন্ধে জনৈকা স্ত্রীভক্তের সহিত কথা

স্ত্রীভক্তেরা সেই রাত্রি শ্রীশ্রীমার নিকটে অবস্থান করিলেন এবং স্নানযাত্রার দিবসে দেবীপ্রতিষ্ঠার বাৎসরিক উপলক্ষে কালীবাটীতে বিশেষ সমারোহ হইবে জানিতে পারিয়া ঐ পর্বদর্শনান্তে কলিকাতায় ফিরিবেন বলিয়া স্থির করিলেন। রাত্রে আহার করিতে বসিয়া ঠাকুর পাণিহাটির উৎসবের কথা প্রসঙ্গে তাহাদের একজনকে বলিলেন, “অত ভিড়– তাহার উপর ভাবসমাধির জন্য আমাকে সকলে লক্ষ্য করিতেছিল—ও (শ্রীশ্রীমা) সঙ্গে না যাইয়া ভালই করিয়াছে, ওকে সঙ্গে দেখিলে লোকে বলিত ‘হংস-হংসী এসেছে’। ও খুব বুদ্ধিমতী।” শ্রীশ্রীমার অসামান্য বুদ্ধির দৃষ্টান্ত স্বরূপে পুনরায় বলিতে লাগিলেন, “মাড়োয়ারী ভক্ত(১) যখন দশ হাজার টাকা দিতে চাহিল তখন আমার মাথায় যেন করাত বসাইয়া দিল; মাকে বলিলাম, ‘মা, এতদিন পরে আবার প্রলোভন দেখাইতে আসিলি!’ সেই সময়ে ওর মন বুঝিবার জন্য ডাকাইয়া বলিলাম, ‘ওগো, এই টাকা দিতে চাহিতেছে, আমি লইতে পারিব না বলায় তোমার নামে দিতে চাহিতেছে, তুমি উহা লও না কেন– কি বল’? শুনিয়াই ও বলিল, ‘তা কেমন করিয়া হইবে? টাকা লওয়া হইবে না, আমি লইলে ঐ টাকা তোমারই লওয়া হইবে। কারণ, আমি উহা রাখিলে তোমার সেবা ও অন্যান্য আবশ্যকে উহা ব্যয় না করিয়া থাকিতে পারিব না; সুতরাং ফলে উহা তোমারই গ্রহণ করা হইবে। তোমাকে লোকে শ্রদ্ধা-ভক্তি করে তোমার ত্যাগের জন্য—অতএব টাকা কিছুতেই লওয়া হইবে না’। ওর (শ্ৰীশ্ৰীমার) ঐ কথা শুনিয়া আমি হাঁপ ফেলিয়া বাঁচি!”

———–

(১) ইহার নাম লছমীনারায়ণ ছিল।

শ্রীশ্রীমার সহিত উক্ত ভক্তের কথা

ঠাকুরের ভোজন সাঙ্গ হইলে স্ত্রীভক্তগণ নহবতে মাতাঠাকুরাণীর নিকটে যাইয়া তাহার সম্বন্ধে ঠাকুর যাহা বলিতেছিলেন তাহা শুনাইলে শ্রীশ্রীমা বলিলেন, “প্রাতে উনি (ঠাকুর) আমাকে যে ভাবে যাইতে বলিয়া পাঠাইলেন তাহাতেই বুঝিতে পারিলাম–উনি মন খুলিয়া ঐ বিষয়ে অনুমতি দিতেছেন না। তাহা হইলে বলিতেন-হাঁ, যাবে বৈ কি। ঐরূপ না করিয়া উনি ঐ বিষয়ের মীমাংসার ভার যখন আমার উপরে ফেলিয়া বলিলেন, ‘ওর ইচ্ছা হয় ত চলুক,’ তখন স্থির করিলাম যাইবার সংকল্প ত্যাগ করাই ভাল।”

 স্নানযাত্রার দিবসে নানা লোকের সংসর্গে ঠাকুরের ভাবভঙ্গ ও বিরক্তি

গাত্রদাহ উপস্থিত হইয়া সে রাত্রে ঠাকুরের নিদ্রা হইল না। উৎসবস্থলে নানাপ্রকার চরিত্রের লোক তাঁহার দেব-অঙ্গ স্পর্শ করিয়াছিল বলিয়াই বোধ হয় ঐরূপ হইয়াছিল। কারণ দেখা যাইত, অপবিত্র অশুদ্ধমনা ব্যক্তিগণ ব্যাধির হস্ত হইতে মুক্ত হইবার উদ্দেশ্যে অথবা অন্যপ্রকার সকামভাবে তাহার অঙ্গস্পর্শপূর্বক পদধূলি গ্রহণ করিলে ঐরূপ দাহে তিনি অনেক সময়ে প্রপীড়িত হইতেন। পাণিহাটি উৎসবের একদিন পরে স্নানযাত্রার পৰ্ব উপস্থিত হইল। ঐ দিবসে আমরা দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হইতে পারি নাই। স্ত্রীভক্তদিগের নিকটে শুনিয়াছি ঐ দিবসে অনেকগুলি স্ত্রী-পুরুষ ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসিয়াছিল। তন্মধ্যে অ-র মা নাম্নী জনৈকা নিজ বিষয়সম্পত্তির বন্দোবস্ত করাইয়া লইবার আশয়ে তাহাকে পীড়াপীড়ি করিয়া ধরিয়া তাহার আনন্দের বিশেষ বিঘ্ন উৎপাদন করিয়াছিল। মধ্যাহ্নে ভোজন করিবার কালে তাহাকে নিকটে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া তিনি বিরক্ত হইয়া কথা কহেন নাই এবং অন্য দিবসের ন্যায় খাইতেও পারেন নাই। পরে ভোজনান্তে আমাদের পরিচিতা জনৈকা তাঁহাকে আচমনার্থ জল দিতে যাইলে তাহাকে একান্তে বলিয়াছিলেন, “এখানে লোক আসে ভক্তি প্রেম হইবে বলিয়া—এখান হইতে ওর বিষয়ের কি বন্দোবস্ত হইবে বল দেখি? মাগী কামনা করিয়া আঁব সন্দেশাদি আনিয়াছে—উহার একটুও মুখে তুলিতে পারিলাম না। আজ স্নানযাত্রার দিন, অন্য বৎসর এই দিনে কত ভাবসমাধি হইত, দুই-তিন দিন ভাবের ঘোর থাকিত, আজ কিছুই হইল না—নানাভাবের লোকের হাওয়া লাগিয়া উচ্চ ভাব আসিতে পারিল না?” অ–র মা সেই রাত্রি দক্ষিণেশ্বরে অবস্থান করায় রাত্রিকালেও ঠাকুরের বিরক্তির ভাব প্রশমিত হইল না। রাত্রিতে আহার করিবার কালে একজন স্ত্রীভক্তকে বলিলেন, “এখানে স্ত্রীলোকদিগের এত ভিড় ভাল নয়, মথুর বাবুর পুত্র ত্রৈলোক্য বাবু এখানে রহিয়াছে—কি মনে করিবে বল দেখি? দুই-এক জন মধ্যে মধ্যে আসিলে, এক-আধ দিন থাকিয়া চলিয়া যাইল—তাহা নহে, একেবারে ভিড় লাগিয়া গিয়াছে! স্ত্রীলোকদিগের অত হাওয়া আমি সইতে পারি না।” ঠাকুরের বিরক্তির কারণ হইয়াছেন ভাবিয়া স্ত্রীভক্তগণ সেদিন বিশেষ বিষণ্ণ হইয়াছিলেন এবং রজনী প্রভাত হইলেই কলিকাতায় ফিরিয়া আসিয়াছিলেন। স্নানযাত্রা উপলক্ষে কালীবাটীতে বিশেষ সমারোহে পূজা এবং যাত্রাদি হইয়াছিল, তাহারা কিন্তু পূর্বোক্ত কারণে সেদিন কিছুমাত্র আনন্দ লাভ করিতে পারেন নাই। নিরন্তর উচ্চ ভাবভূমিতে থাকিলেও ঠাকুরের দৈনন্দিন প্রত্যেক ব্যাপারে কতদূর লক্ষ্য ছিল এবং ভক্তদিগের কল্যাণের জন্য তিনি তাহাদিগকে কিরূপে শাসন ও পরিচালনা করিতেন, তাহা পূর্বোক্ত বিবরণ হইতে পাঠক কতকটা বুঝিতে পারিবেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *