৩.৫ যৌবনে গুরুভাব

তৃতীয় খণ্ড – পঞ্চম অধ্যায়: যৌবনে গুরুভাব

গুরু ও নেতা হওয়া মানবের ইচ্ছাধীন নহে

নাহং প্রকাশঃ সর্বস্য যোগমায়াসমাবৃতঃ।
মূঢ়োঽয়ং নাভিজানাতি লোকো মামজমব্যয়ম্॥
– গীতা, ৭/২৫

ঠাকুরের জীবনে গুরুভাবের বিশেষ বিকাশ আরম্ভ হয় – যেদিন হইতে তিনি দক্ষিণেশ্বরে শ্রীশ্রীজগদম্বার পূজায় ব্রতী হইয়া তথায় অবস্থান করিতে থাকেন। ঠাকুরের তখন সাধনার কাল – ঈশ্বরপ্রেমে উন্মাদাবস্থা। কিন্তু হইলে কি হয়? যিনি গুরু, তিনি চিরকালই গুরু – যিনি নেতা, তিনি বাল্যকাল হইতেই নেতা। লোকে কমিটি করিয়া পরামর্শ আঁটিয়া যে তাঁহাকে গুরু বা নেতার আসন ছাড়িয়া দেয়, তাহা নহে। তিনি যেমন আসিয়া লোকসমাজে দণ্ডায়মান হন, অমনি মানবসাধারণের মন তাঁহার প্রতি ভক্তিপূর্ণ হয়। অমনি নতশিরে তাহারা তাঁহার নিকট শিক্ষাগ্রহণ ও তাঁহার আজ্ঞাপালন করিতে থাকে – ইহাই নিয়ম। স্বামী বিবেকানন্দ বলিতেন, মানুষ মানুষকে যে নেতা বা গুরু করিয়া তোলে, তাহা নহে, যাঁহারা গুরু বা নেতা হন, তাঁহারা ঐ অধিকার লইয়াই জন্মগ্রহণ করেন। ‘A leader is always born and never created’ – সেজন্য দেখা যায়, অপর সাধারণে যেসকল কাজ করিলে সমাজ চটিয়া দণ্ডবিধান করে, লোকগুরুরা সেইসকল কাজ করিলেও অবনতশিরে তাঁহাদের পদানুসরণ করিয়া থাকে। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ঐ সম্বন্ধে বলিয়াছেন –

‘স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে।’

– তিনি যাহা কিছু করেন, তাহাই সৎকার্যের প্রমাণ বা পরিমাপক হইয়া দাঁড়ায় এবং লোকে তদ্রূপ আচরণই তদবধি করিতে থাকে। বড়ই আশ্চর্যের কথা, কিন্তু বাস্তবিকই ঐরূপ চিরকাল হইয়া আসিয়াছে এবং পরেও হইতে থাকিবে। শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন, ‘আজ হইতে ইন্দ্রের পূজা বন্ধ হইয়া গোবর্ধনের পূজা হইতে থাকুক’ – লোকে তাহাই করিতে লাগিল! বুদ্ধ বলিলেন, ‘আজ হইতে পশুহিংসা বন্ধ হউক’ অমনি ‘যজ্ঞে হনন করিবার জন্যই পশুগণের সৃষ্টি’, ‘যজ্ঞার্থে পশবো সৃষ্টাঃ’-রূপ নিয়মটি সমাজ পালটাইয়া বাঁধিল! যীশু মহাপবিত্র উপবাসের দিনে শিষ্যদিগকে ভোজন করিতে অনুমতি দিলেন – তাহাই নিয়ম হইয়া দাঁড়াইল! মহম্মদ বহু বিবাহ করিলেন, তবুও লোকে তাঁহাকে ধর্মবীর, ত্যাগী ও নেতা বলিয়া মান্য করিতে লাগিল! সামান্য বা মহৎ সকল বিষয়েই ঐরূপ – তাঁহারা যাহা বলেন ও করেন, তাহাই সদাচরণের আদর্শ।

লোকগুরুদিগের ভিতরে বিরাট ভাবমুখী আমিত্বের বিকাশ সহজেই আসিয়া উপস্থিত হয়, সাধারণের ঐরূপ হয় না

কেন যে ঐরূপ হয় তাহাও ইতঃপূর্বে আমরা বলিয়াছি – লোকগুরুদিগের ক্ষুদ্র স্বার্থপর ‘আমি’টা চিরকালের মতো একেবারে বিনষ্ট হইয়া তাহার স্থলে বিরাটভাবমুখী ‘আমিত্ব’টার বিকাশ আসিয়া উপস্থিত হয়। সে ‘আমি’টার দশের কল্যাণ খোঁজাই স্বভাব। আর ফুল ফুটিলে ভ্রমর যেমন আপনিই জানিতে পারিয়া মধুলোভে তথায় আসিয়া উপস্থিত হয়, ফুলকে আর ভ্রমরের নিকট সাদর নিমন্ত্রণ পাঠাইতে হয় না, সেইরূপ যেমনি কাহারও ভিতর ঐ বিরাট ‘আমি’টার বিকাশ হয়, অমনি সংসারে তাপিত লোকসকল আপনিই তাহা কেমন করিয়া জানিতে পারিয়া শান্তিলাভের নিমিত্ত ছুটিয়া আসে। সাধারণ মানবের ভিতর ঐ বিরাট ‘আমি’টার একটু-আধটু ছিটে-ফোঁটার মতো বিকাশ অনেক কষ্টে আসিয়া উপস্থিত হয়। কিন্তু লোকগুরুদিগের জীবনে বাল্য হইতেই উহার কিছু না কিছু বিকাশ, যৌবনে অধিকতর প্রকাশ এবং পরিশেষে পূর্ণ প্রকাশের অদ্ভুত লীলাসকল দেখিয়া আমরা স্তম্ভিত হইয়া ঈশ্বরের সহিত তাঁহাদিগকে একেবারে অপৃথকভাবে দেখিতে থাকি। কারণ তখন ঐ অমানুষ-ভাবপ্রকাশ তাঁহাদের এত সহজ হইয়া দাঁড়ায় যে, উহা খাওয়া-পরা, চলা-ফেরা, নিঃশ্বাস-ফেলার মতো একটা সাধারণ নিত্যকর্মের মধ্যে হইয়া দাঁড়ায়। কাজেই সাধারণ মানুষ আর কি করিবে? – দেখে যে, তাহার ক্ষুদ্র স্বার্থের মাপকাঠি দ্বারা তাঁহাদের দেবচরিত্র মাপা চলে না এবং তজ্জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া তাঁহাদের দেবতাজ্ঞানে ভক্তি-বিশ্বাস ও শরণ গ্রহণ করে।

ঠাকুরের জীবনে গুরুভাবের পূর্ণবিকাশ হইয়া উহা সহজ-ভাব হইয়া দাঁড়ায় কখন

ঠাকুরের জীবনালোচনায়ও আমরা ঐরূপ দেখিতে পাই – যৌবনে সাধকাবস্থায় দিনের পর দিন ঐ ভাবের ক্রমে ক্রমে বিকাশ হইতে হইতে দ্বাদশ বৎসর কঠোর সাধনান্তে ঐ ভাবের পূর্ণ প্রকাশ হইয়া উহা একেবারে সহজভাব হইয়া দাঁড়ায়। তখন কখন যে তিনি কোন্ ‘আমি’-বুদ্ধিতে রহিয়াছেন বা কখন যে তাঁহাতে বিরাট ‘আমি’টার সহায়ে গুরুভাবাবেশ হইল, তাহা অনেক সময়ে সাধারণ-মানবমন-বুদ্ধির গোচর হইত না। কিন্তু ওটা ঐ ভাবের পূর্ণ পরিণত অবস্থার কথা এবং যেখানকার কথা সেইখানেই উহার বিশেষ পরিচয় পাওয়া যাইবে। এখন যৌবনে সাধকাবস্থায় ঐ ভাবে আত্মহারা হইয়া তিনি অনেক সময়ে যেরূপ আচরণ করিতেন, তাহারই কিছু পাঠককে অগ্রে বলা আবশ্যক।

সাধনকালে ঐ ভাব – রানী রাসমণি ও তদীয় জামাতা মথুরের সহিত ব্যবহার

যৌবনে ঠাকুরের গুরুভাবের প্রথম বিকাশ দেখিতে পাই, দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীর প্রতিষ্ঠাত্রী, রানী রাসমণি ও তাঁহার জামাতা মথুরানাথ বা মথুরবাবুকে লইয়া। অবশ্য ইঁহাদের দুইজনের কাহাকেও দেখা আমাদের কাহারও ভাগ্যে হয় নাই। তবে ঠাকুরের নিজ মুখ হইতে যাহা শুনিয়াছি, তাহাতে বেশ বুঝা যায় যে, প্রথম দর্শনেই ইঁহাদের মনে ঠাকুরের প্রতি একটা ভালবাসার উদয় হইয়া ক্রমে ক্রমে উহা এতই গভীরভাব ধারণ করে যে, এরূপ আর কুত্রাপি দেখা যায় না। মানুষকে মানুষ যে এতটা ভক্তি-বিশ্বাস করিতে – এতটা ভালবাসিতে পারে, তাহা আমাদের অনেকের মনে বোধ হয় ধারণা না হইয়া একটা রূপকথার মতো মনে হইবে! অথচ উপর উপর দেখিলে ঠাকুর তখন একজন সামান্য নগণ্য পূজক ব্রাহ্মণমাত্র এবং তাঁহারা সমাজে জাত্যংশে বড় না হইলেও, ধনে, মানে, বিদ্যায় ও বুদ্ধিতে সমাজের অগ্রণী বলিলে চলে।

ঠাকুরের অপূর্ব স্বভাব

আবার এদিকে ঠাকুরের স্বভাবও বাল্যাবধি অতি বিচিত্র! ধন, মান, বিদ্যা, বুদ্ধি, নামের শেষে বড় বড় উপাধি প্রভৃতি যেসকল লইয়া লোকে লোককে বড় বলিয়া গণ্য করে, তাঁহার গণনায়, তাঁহার চক্ষে ওগুলো চিরকালই ধর্তব্যের মধ্যে বড় একটা ছিল না। ঠাকুর বলিতেন, “মনুমেন্টে উঠে দেখলে তিনতলা চারতলা বাড়ি, উঁচু উঁচু গাছ ও জমির ঘাস সব এক সমান হয়ে গেছে দেখায়।” আমরাও দেখি, ঠাকুরের নিজের মন বাল্যাবধি, সত্যনিষ্ঠা ও ঈশ্বরানুরাগ-সহায়ে সর্বদা এত উচ্চে উঠিয়া থাকিত যে সেখান হইতে ধন-মান-বিদ্যাদির একটু-আধটু তারতম্য – যাহা লইয়া আমরা একেবারে ফুলিয়া ফাটিয়া যাইবার মতো হই ও ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ করি – সব এক সমান দেখা যাইত! অথবা ঠাকুরের মন, চিরকাল প্রত্যেক কার্যটা কেন করিব ও প্রত্যেক ব্যক্তি ও পদার্থের সহিত সম্বন্ধের চরম পরিণতিতে কি কতদূর দাঁড়াইবে – তাহা ভাবিয়া অপরের ঐ ঐ বিষয়ে কিরূপ বা অবস্থা দাঁড়াইয়াছে তাহা দেখিয়া একটা বদ্ধমূল ধারণায় পূর্ব হইতেই উপস্থিত হইত। কাজেই ঐসকল বিষয় যে উদ্দেশ্য ও চরমপরিণতি লুকাইয়া মধুর ছদ্মবেশে তাঁহাকে ভুলাইয়া অন্ততঃ কিছুকালের জন্যও মিছামিছি ঘুরাইবে, তাহার কোন পথই ছিল না। পাঠক বলিবে, ‘কিন্তু ওরূপ বুদ্ধিতে সকল বিষয়ের দোষগুলিই তো আগে চক্ষে পড়িয়া মানুষকে জড়ভাবাপন্ন করিয়া তুলিবে, জগতের কোন কার্য করিতেই আর অগ্রসর হইতে দিবে না।’ বাস্তবিকই তাহা। মন যদি পূর্ব হইতে বাসনাশূন্য বা পবিত্র না হইয়া থাকে এবং ঈশ্বরলাভরূপ মহৎ উদ্দেশ্য যদি উহার গোড়ায় বাঁধা না থাকে, তাহা হইলে ঐরূপ বুদ্ধি বাস্তবিকই মানবকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করিয়া উদ্যমরহিত এবং কখনো কখনো উচ্ছৃঙ্খল ও যথেচ্ছাচারী করিয়া তোলে। নতুবা পবিত্রতা ও উচ্চ লক্ষ্যে যদি মনের সুর চড়াইয়া বাঁধা থাকে, তাহা হইলে ঐরূপ সকল বিষয়ের অন্তস্তলস্পর্শী দোষদর্শী বুদ্ধিই মানবকে ঈশ্বরদর্শনের পথে দ্রুতপদে অগ্রসর করাইয়া দেয়। গীতাতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ঐজন্য শ্রদ্ধাভক্তিসম্পন্ন মানবকেই সর্বদা সংসারে ‘জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধি-দুঃখ-দোষানুদর্শন’ করিয়া বৈরাগ্যবান হইতে বলিয়াছেন। ঠাকুরের চরিত্রে বাল্যাবধি ঐ দোষদৃষ্টি কতদূর পরিস্ফুট তা দেখ। লেখা-পড়া করিতে গিয়া কোথায় ‘তর্কালঙ্কার’, ‘বিদ্যাবাগীশ’ প্রভৃতি উপাধি ও নাম-যশের দিকে দৃষ্টি পড়িবে, তাহা না হইয়া দেখিতে পাইলেন, বড় বড় ‘তর্কবাগীশ’, ‘ন্যায়চঞ্চু’ মহাশয়দের ন্যায়-বেদান্তের লম্বা লম্বা কথা আওড়াইয়া ধনীর দ্বারে খোশামুদি করিয়া ‘চাল কলা বাঁধা’ বা জীবিকার সংস্থান করা! বিবাহ করিতে যাইয়া কোথায় সংসারের ভোগসুখ আমোদ-প্রমোদের দিকে নজর পড়িবে, তাহা না হইয়া দেখিলেন দুদিনের সুখের নিমিত্ত চিরকালের মতো বন্ধন গলায় পরা, অভাববৃদ্ধি করিয়া টাকার চিন্তায় ছুটাছুটি করিয়া বেড়ানো ও সেই দুই দিনের সুখেরও অনিশ্চয়তা! টাকাতে সংসারে সব করিতে ও সব হইতে পারা যায় দেখিয়া কোথায় কোমর বাঁধিয়া রোজগারে লাগিয়া যাইবেন – না, দেখিলেন, টাকাতে কেবল ভাত, ডাল, কাপড় ও ইট, মাটি, কাঠ লাভই হইতে পারে, কিন্তু ঈশ্বরলাভ হয় না! সংসারে গরিব-দুঃখীর প্রতি দয়া করিয়া পরের দুঃখমোচন করিয়া ‘দাতা’, ‘পরোপকারী’ ইত্যাদি নাম কিনিবেন, না, দেখিলেন, আজীবন চেষ্টার ফলে বড় জোর দুচারটে ফ্রী-স্কুল ও দুচারটে দাতব্য ডাক্তারখানা, না হয় দুচারটে অতিথিশালা স্থাপন করা যায়; তারপর মৃত্যু ও জগতের যেমন অভাব ছিল, তেমনিই থাকিল! – এইরূপ সকল বিষয়ে।

ধনী ও পণ্ডিতদের ঠাকুরকে চিনিতে পারা কঠিন। উহার কারণ

ঐরূপ স্বভাবাপন্ন ঠাকুরকে কাজেই ঠিক ঠিক ধরা বা বুঝা সাধারণ মানবের বড়ই কঠিন, বিশেষতঃ আবার বিদ্যাভিমানী ও ধনীদের; কারণ, স্পষ্ট কথা সংসারে কাহারও নিকট শুনিতে না পাইয়া, লোকমান্য ও ধনমদে শুনিবার ক্ষমতাটি পর্যন্ত তাঁহারা অনেক স্থলে হারাইয়া বসেন। কাজেই তাঁহারা ঠাকুরকে অনেক সময় না বুঝিতে পারিয়া যে অসভ্য, পাগল বা অহঙ্কারী মনে করিবেন, ইহা বিচিত্র নহে। সেজন্যই রানী রাসমণি ও মথুরবাবুর ভক্তি-ভালবাসা দেখিয়া আরও অবাক হইতে হয়! মনে হয়, ঈশ্বরকৃপায় মহাভাগ্যোদয় হইয়াছিল বলিয়াই তাঁহারা ঠাকুরের উপর ভালবাসা শুধু যে অক্ষুণ্ণ রাখিতে পারিয়াছিলেন তাহা নহে, উপরন্তু তাঁহার দিব্য গুরুভাবের পরিচয় দিন দিন প্রাপ্ত হইয়া তাঁহার শ্রীচরণে সর্বতোভাবে আত্মবিক্রয়ে সমর্থ হইয়াছিলেন! নতুবা যে ঠাকুর কালীবাটী-প্রতিষ্ঠার দিনে আপনার অগ্রজ পূজায় ব্রতী হইলে এবং শ্রীশ্রীজগদম্বার প্রসাদ ভোজন করিলেও শূদ্রান্নভোজন করিতে হইবে বলিয়া তথায় উপবাস করিয়াছিলেন এবং পরেও কিছুকাল পর্যন্ত ঐ নিমিত্ত কালীবাটীর গঙ্গাতীরে স্বহস্তে পাক করিয়া খাইয়াছিলেন, যে ঠাকুর মথুরবাবু বার বার ডাকিলেও বিষয়ী লোক বলিয়া তাঁহার সহিত আলাপ করিতে কুণ্ঠিত হইয়াছিলেন এবং পরে মা কালীর পূজায় ব্রতী হইবার জন্য তাঁহার সাদর অনুরোধ বার বার প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন, অভিমান এবং ধনমদ ত্যাগ করিয়া সেই ঠাকুরকে প্রথম হইতে ভালবাসা এবং বরাবর ঐ ভাব ঠিক রাখা রানী রাসমণি ও মথুরবাবুর সহজ হইত না।

বিবাহের পর ঠাকুরের অবস্থা। মথুরের উহা লক্ষ্য করিয়া ক্রমশঃ তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হওয়া। অপর সাধারণের ঠাকুরের বিষয়ে মতামত

ঠাকুরের তখন বিবাহ হইয়া গিয়াছে – পূর্ণ যৌবন। বিবাহ করিয়া দক্ষিণেশ্বরে প্রত্যাগমন করিয়াছেন এবং মা-কালীর পূজায় ব্রতী হইয়াছেন; এবং পূজায় ব্রতী হইয়াই আবার ঈশ্বরপ্রেমে পাগলের মতো হইয়াছেন। ঈশ্বরলাভ হইল না বলিয়া কখনো কখনো ভূমিতে গড়াগড়ি দিয়া মুখ ঘষড়াইয়া ‘মা’ ‘মা’ বলিয়া এত ক্রন্দন করেন যে, লোক দাঁড়াইয়া যায়! লোকে ব্যথিত হইয়া বলাবলি করে, ‘আহা, লোকটির কোন উৎকট রোগ হইয়াছে নিশ্চয়; পেটের শূলব্যথায় মানুষকে অমনি অস্থির করে।’ কখনো বা পূজার সময় যত ফুল নিজের মাথায় চাপাইয়া নিস্পন্দ হইয়া যান। কখনো বা সাধকদিগের পদাবলী উন্মত্তভাবে কতক্ষণ ধরিয়া গাহিতে থাকেন। নতুবা যখন কতকটাও সাধারণভাবে থাকেন তখন যাহার সহিত যেমন ব্যবহার করা উচিত, যাহাকে যেমন মান দেওয়া রীতি, সে সমস্ত পূর্বের ন্যায়ই করেন। কিন্তু জগন্মাতার ধ্যানে যখন ঐরূপ ভাবাবেশ হয় – এবং সে ভাবাবেশ যে দিনের ভিতর এক-আধবার একটু-আধটু হইত, তাহা নহে – তখন ঠাকুরের আর কোন ঠিক-ঠিকানাই থাকে না, কাহারও কোন কথা শোনেন না – বা উত্তর দেন না। কিন্তু তখনো সে দেবচরিত্রে মাধুর্যের অনেক সময় লোকে পরিচয় পায়। তখনো যদি কেহ বলে, ‘মা-র নাম দুটো শোনাও না’ – অমনি ঠাকুর তাহার প্রীতির জন্য মধুর কণ্ঠে গান ধরেন এবং গাহিতে গাহিতে গানের ভাবে নিজে বিভোর হইয়া আত্মহারা হন।

ইতঃপূর্বেই রানী রাসমণি ও মথুরবাবুর কর্ণে হীনবুদ্ধি নিম্নপদস্থ কর্মচারিগণ এবং ঠাকুরবাড়ির প্রধান কর্মচারী খাজাঞ্চী মহাশয়ও পূজার সময় ঠাকুরের অনাচারের অনেক কথা তুলিয়া বলিয়াছেন, ‘ছোট ভট্চাজ্1 সব মাটি করলে; মা-র (কালীর) পূজা, ভোগ, রাগ কিছুই হইতেছে না; ওরূপ অনাচার করলে মা কি কখনো পূজা ভোগ গ্রহণ করেন?’ – ইত্যাদি। কিন্তু বলিয়াও কিছুমাত্র সফলমনোরথ হন নাই; কারণ, মথুরবাবু স্বয়ং মাঝে মাঝে কাহাকেও কোন সংবাদ না দিয়া হঠাৎ মন্দিরে আসিয়া অন্তরালে থাকিয়া ঠাকুরের পূজার সময় ভক্তিবিহ্ব্ল, বালকের ন্যায় ব্যবহার ও শ্রীশ্রীজগদম্বার প্রতি আবদার অনুরোধাদি দেখিয়া চক্ষের জল ফেলিতে ফেলিতে তাঁহাদের আজ্ঞা করিয়াছেন – “ছোট ভট্টাচার্য মহাশয় যেভাবে যাহাই করুন না কেন, তোমরা তাঁহাকে বাধা দিবে না বা কোন কথা বলিবে না। আগে আমাকে জানাইবে, পরে আমি যেমন বলি তেমনি করিবে।”

রানী রাসমণিও মধ্যে মধ্যে আসিয়া মা-র শিঙ্গার (ফুলের সাজ) ইত্যাদি দেখিয়া এবং ঠাকুরের মধুর কণ্ঠে মা-র নাম শুনিয়া এতই মোহিত হইয়াছেন যে, যখনই কালীবাড়িতে আসেন, তখনই ছোট ভট্টাচার্যকে নিকটে ডাকাইয়া মা-র নাম (গান) করিতে অনুরোধ করেন। ঠাকুরও গান করিতে করিতে কাহাকেও যে শুনাইতেছেন এ কথা একেবারে ভুলিয়া যাইয়া ভাবে বিভোর হইয়া শ্রীশ্রীজগদম্বাকেই যেন শুনাইতেছেন, এই ভাবে গান গাহিতে থাকেন। এইরূপে দিনের পর দিন চলিয়া যাইতেছে, জগৎরূপ বৃহৎ সংসারের ন্যায় ঠাকুরবাড়ির ক্ষুদ্র সংসারেও যে যাহার কাজ লইয়াই ব্যস্ত এবং সাংসারিক কাজকর্ম ও স্বার্থচিন্তা বাদে যতটুকু সময় পায় তাহাতে পরনিন্দা পরচর্চাদি রুচিকর বিষয়সকলের আন্দোলন করিয়া নিজ নিজ মনের একদেশিতার অবসাদ দূর করিয়া থাকে। কাজেই ছোট ভট্টাচার্যের ভিতরে ঈশ্বরপ্রেমে যে কি পরিবর্তন হইতেছে, তাহার খবর রাখে কে? ‘ও একটা উন্মাদ, বাবুদের কেমন একটা সুনজরে পড়িয়াছে, তাই এখনো চাকরিটি বজায় আছে; তাই বা কদিন? কোন্ দিন এই একটা কি কাণ্ড করিয়া বসিবে ও তাড়িত হইবে! বড়লোকের মেজাজ – কিছু কি ঠিকঠিকানা আছে? খুশি হইতেও যতক্ষণ, আর গরম হইতেও ততক্ষণ’ – ঠাকুরের সম্বন্ধে এইরূপ কথাবার্তাই কর্মচারীদের ভিতর কখনো কখনো হইয়া থাকে, এই মাত্র। ঠাকুরের ভাগিনেয় ও সেবক হৃদয়ও তৎপূর্বেই ঠাকুরবাটীতে আসিয়া জুটিয়াছে।


1. ঠাকুরের অগ্রজকে ‘বড় ভট্টাচার্য’ বলিয়া ডাকায় ঠাকুর তখন এই নামে নির্দিষ্ট হইতেন।

গুরুভাবে ঠাকুরের রানী রাসমণিকে দণ্ডবিধান

আজ রানী রাসমণি স্বয়ং ঠাকুরবাড়িতে আসিয়াছেন। কর্মচারীরা সকলে শশব্যস্ত। যে ফাঁকিদার সে-ও আজ আপন কর্তব্য অতি যত্নের সহিত করিতেছে। গঙ্গায় স্নানান্তে রানী কালীঘরে দর্শন করিতে যাইলেন। তখন কালীর পূজা ও বেশ হইয়া গিয়াছে। জগন্মাতাকে প্রণাম করিয়া রানী মন্দিরমধ্যে শ্রীমূর্তির নিকট আসনে আহ্নিক-পূজা করিতে বসিলেন এবং ছোট ভট্টাচার্য বা ঠাকুরকে নিকটে দেখিয়া মা-র নামগান করিতে অনুরোধ করিলেন। ঠাকুরও রানীর নিকটে বসিয়া ভাবে বিভোর হইয়া রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত প্রভৃতি সাধকদিগের পদাবলী গাহিতে লাগিলেন; রানী পূজা-জপাদি করিতে করিতে ঐসকল শুনিতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ এইভাবে কাটিলে ঠাকুর হঠাৎ গান থামাইয়া বিরক্ত হইয়া উগ্রভাবে রুক্ষস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “কেবল ঐ ভাবনা, এখানেও ঐ চিন্তা?” – বলিয়াই রানীর কোমল অঙ্গে করতল দ্বারা আঘাত করিলেন! সন্তানের কোনরূপ অন্যায়াচরণ দেখিয়া পিতা যেরূপ কুপিত হইয়া কখনো কখনো দণ্ডবিধান করেন, ঠাকুরেরও এখন ঠিক সেই ভাব! কিন্তু কে-ই বা তাহা বুঝে!

উহার ফল

মন্দিরের কর্মচারী ও রানীর পরিচারিকারা সকলে হইচই করিয়া উঠিল। দ্বারপাল শশব্যস্তে ঠাকুরকে ধরিতে ছুটিল। বাহিরের কর্মচারীরাও মন্দিরমধ্যে এত গোল কিসের ভাবিয়া কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া সেদিকে অগ্রসর হইল। কিন্তু ঐ গোলযোগের প্রধান কারণ যাঁহারা – ঠাকুর ও রানী রাসমণি – তাঁহারা উভয়েই এখন স্থির, গম্ভীর! কর্মচারীদের বকাবকি ছুটাছুটির দিকে লক্ষ্য না করিয়া একেবারে উদাসীন থাকিয়া ঠাকুর আপনাতে আপনি স্থির ও তাঁহার মুখে মৃদু মৃদু হাসি; শ্রীশ্রীজগদম্বার ধ্যান না করিয়া আজ কেবলই একটি বিশেষ মকদ্দমার ফলাফলের বিষয় ধ্যান করিতেছিলেন, রানী রাসমণি নিজের অন্তর পরীক্ষা দ্বারা ইহা দেখিতে পাইয়া ঈষৎ অপ্রতিভ ও অনুতাপে গম্ভীর! আবার ঠাকুর ঐ কথা কি করিয়া জানিতে পারিলেন ভাবিয়া রানীর ঐ ভাবের সহিত কতক বিস্ময়ের ভাবও মনে বর্তমান! পরে কর্মচারীদের গোলযোগে রানীর চমক ভাঙিল ও বুঝিলেন – নিরপরাধ ঠাকুরের প্রতি, এই ঘটনায় হীনবুদ্ধি লোকদিগের বিশেষ অত্যাচার হইবার সম্ভাবনা। বুঝিয়া সকলকে গম্ভীরভাবে আজ্ঞা করিলেন, “ভট্টাচার্য মহাশয়ের কোন দোষ নাই। তোমরা উঁহাকে কেহ কিছু বলিও না।” পরে মথুরবাবুও নিজ শ্বশ্রূঠাকুরানীর নিকট হইতে ঘটনাটির সকল কথা আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিয়া কর্মচারীদিগের উপর পূর্বোক্ত হুকুমই বহাল রাখিলেন। ইহাতে তাহাদের কেহ কেহ বিশেষ দুঃখিত হইল; কিন্তু কি করিবে, ‘বড় লোকের বড় কথায় আমাদের কাজ কি’ ভাবিয়া চুপ করিয়া রহিল।

শ্রীচৈতন্য ও ঈশার জীবনে ঐরূপ ঘটনা

ঘটনাটি শুনিয়া পাঠক হয়তো ভাবিবে – এ আবার কোন্ দেশী গুরুভাব? লোকের অঙ্গে আঘাত করিয়া এ আবার কি প্রকার গুরুভাবের প্রকাশ? আমরা বলি – জগতের ধৰ্মেতিহাস পাঠ কর, দেখিবে লোকগুরু আচার্যদিগের জীবনে এরূপ ঘটনার কথা উল্লিখিত আছে। শ্রীশ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনে কাজিদলন, গুরুভাবে আত্মহারা হইয়া অদ্বৈত প্রভুকে প্রহার করিয়া ভক্তিদান প্রভৃতির কথা স্মরণ কর। ভাবিয়া দেখ, মহামহিম ঈশার জীবনেও ঐরূপ ঘটনার অভাব নাই।

শিষ্যপরিবৃত ঈশা জেরুজালেমের ‘য়াভে’ দেবতার মন্দিরে দর্শনপূজাদি করিবার জন্য আসিয়া উপস্থিত। ৺বারাণসী শ্রীবৃন্দাবনাদি তীর্থে দেবস্থানসকল দর্শন করিতে যাইয়া হিন্দুর মনে যেরূপ অপূর্ব পবিত্র ভাবের উদয় হয়, ইহুদি-মনে জেরুজালেমের মন্দির-দর্শনেও ঠিক তদ্রূপ হইবে – ইহাতে আর সন্দেহ কি? তাহার উপর আবার ভাবমুখে অবস্থিত ঈশার মন! দূর হইতে মন্দির-দর্শনেই ঈশা ভগবৎপ্রেমে বিভোর হইয়া দেবদর্শন করিতে ছুটিলেন। মন্দিরের বাহিরে, দ্বারে, প্রাঙ্গণমধ্যে কত লোক কত প্রকারে দু-পয়সা রোজগার প্রভৃতি দুনিয়াদারিতেই ব্যস্ত। পাণ্ডা পুরোহিতেরা দেবদর্শন হউক আর নাই হউক যাত্রীদিগের নিকট হইতে দু-পয়সা ঠকাইয়া লইতে নিযুক্ত। আর দোকানি পসারিরা পূজায় পশু-পুষ্পাদি দ্রব্যসম্ভার এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি বিক্রয় করিয়া কিসে দু-পয়সা অধিক লাভ করিবে, এই চিন্তাতেই ব্যাপৃত। ভগবানের মন্দির তাহার নিকটে রহিয়াছে – এ কথা ভাবিতে কাহার আর মাথাব্যথা পড়িয়াছে? যাহা হউক, ভাববিভোর ঈশার চক্ষে মন্দিরপ্রবেশকালে এসকল কিছুই পড়িল না। সরাসরি মন্দিরমধ্যে যাইয়া দেবদর্শন করিয়া আনন্দে উৎফুল্ল হইলেন এবং প্রাণের প্রাণ আত্মার আত্মারূপে তিনি অন্তরে রহিয়াছেন দেখিতে পাইয়া আত্মহারা হইলেন। মন্দির ও তন্মধ্যগত সকল বস্তু ও ব্যক্তিকে আপনার হইতেও আপনার বলিয়া বোধ করিতে লাগিলেন; কারণ এখানে আসিয়াই তো তিনি প্রাণারামের দর্শন পাইলেন! পরে মন যখন আবার নিচে নামিয়া ভিতরের ভাবপ্রকাশ বাহিরের ব্যক্তি ও বস্তুর ভিতর দেখিতে যাইল, তখন দেখেন সকলই বিপরীত। কেহই তাঁহার প্রাণারামের সেবায় নিযুক্ত নহে; সকলেই কাম-কাঞ্চনের সেবাতেই ব্যাপৃত! তখন নিরাশা ও দুঃখে তাঁহার হৃদয় পূর্ণ হইল। ভাবিলেন – একি? তোরা বাহিরে, সংসারের ভিতর যাহা করিস কর না, কিন্তু এখানে, যেখানে ঈশ্বরের বিশেষ প্রকাশ – এখানে আবার এসকল দুনিয়াদারি কেন? কোথায় এখানে আসিয়া দুদণ্ড তাঁহার চিন্তা করিয়া সংসারের জ্বালা দূর করিবি, তাহা না হইয়া এখানেও সংসার আনিয়া পুরিয়াছিস! – ভাবিয়া তাঁহার হৃদয় ক্রোধে পূর্ণ হইল এবং বেত্রহস্তে উগ্রমূর্তি ধারণ করিয়া তিনি সকল দোকানি পসারিদের বলপূর্বক মন্দিরের বাহিরে তাড়াইয়া দিলেন। তাহারাও তখন তাঁহার কথায় ক্ষণিক চৈতন্য লাভ করিয়া যথার্থই দুষ্কর্ম করিতেছি ভাবিতে ভাবিতে সুড় সুড় করিয়া বাহিরে গমন করিল; অতি বদ্ধ জীব – যাহার কথায় চৈতন্য হইল না, সে তাঁহার কশাঘাতে ঐ জ্ঞানলাভ করিয়া বহির্গমন করিল। কিন্তু কেহই ক্রোধপূর্ণ হইয়া তাঁহার উপর অত্যাচার করিতে সাহসী হইল না।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনেও এইরূপে আহত ব্যক্তির জ্ঞানলাভ হইয়া তাঁহাকে ভগবদ্বুদ্ধিতে স্তবস্তুতি করার কথা, অতি বদ্ধ জীবকুলের তাঁহার প্রতি অত্যাচার করিতে আসিয়া তাঁহার হাস্যে বা কথায় স্তম্ভিত ও হতবুদ্ধি হইয়া যাইবার কথা প্রভৃতি অনেক ঘটনা দেখিতে পাওয়া যায়। যাক এখন ঐ সকল পৌরাণিকী কথা।

গুরুভাবের প্রেরণায় আত্মহারা ঠাকুরের অদ্ভুতপ্রকারে শিক্ষাপ্রদান ও রানী রাসমণির সৌভাগ্য

গুরুভাবে সম্পূর্ণ আত্মহারা ঠাকুর যে কিভাবে অপরের সহিত ব্যবহার ও শিক্ষাদি প্রদান করিতেন, এই ঘটনাটি উহার একটি জ্বলন্ত নিদর্শন। ঘটনাটি তলাইয়া দেখিলে বড় কম ব্যাপার বলিয়া বোধ হয় না। কোথায় একজন সামান্য বেতনমাত্রভোগী নগণ্য পূজারী ব্রাহ্মণ এবং কোথায় রানী রাসমণি – যাঁহার ধন, মান, বুদ্ধি, ধৈর্য, সাহস ও প্রতাপে কলিকাতার তখনকার মহা মহা বুদ্ধিমানেরাও স্তম্ভিত! এরূপ দরিদ্র ব্রাহ্মণ যে তাঁহার নিকট অগ্রসর হইতেই পারিবে না, ইহাই স্থির সিদ্ধান্ত করিতে হয়। অথবা যদি কখনো কোন কারণে তাঁহার সমীপস্থ হয় তো চাটুকারিতা প্রভৃতি উপায়ে তাঁহার তিলমাত্র সন্তোষ উৎপাদন করিতে পারিলে আপনাকে কৃতার্থ জ্ঞান করিবে এবং তন্নিমিত্তই অবসর অনুসন্ধান করিতে থাকিবে। তাহা না হইয়া একেবারে তদ্বিপরীত! তাঁহার অন্যায় আচরণের খালি প্রতিবাদ নহে, শারীরিক দণ্ডবিধান! ঠাকুরের দিক হইতে দেখিলে ইহা যেমন অল্প বিস্ময়ের কথা মনে হয় না, রানীর দিক হইতে দেখিলে ঐরূপ ব্যবহারে যে তাঁহার মনে ক্রোধ-অভিমান-হিংসাদির উদয় হইল না, ইহাও একটি কম কথা বলিয়া মনে হয় না। তবে পূর্বেই যেমন আমরা বলিয়া আসিয়াছি – স্বার্থগন্ধহীন বিরাট ‘আমি’টার সহায়ে যখন মহাপুরুষদিগের মনে এইরূপে গুরুভাব আসিয়া উপস্থিত হয়, তখন ইচ্ছা না থাকিলেও সাধারণ মানবকে তাঁহার নিকট নতশির হইতে হইবেই হইবে, রানীর ন্যায় ভক্তিমতী সাত্ত্বিকপ্রকৃতির তো কথাই নাই। কারণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থনিবদ্ধদৃষ্টি মানব-মন তখন তাঁহাদের কৃপা ও শক্তিতে উন্নত হইয়া তাঁহারা যাহা করিতে বলিতেছেন তাহাতেই তাহার বাস্তবিক স্বার্থ – এ কথাটি আপনা-আপনি বুঝিতে পারে। কাজেই তখন তদ্রূপ করা ভিন্ন আর উপায়ান্তর থাকে না। আর এক কথা ঠাকুর যেমন বলিতেন – “তাঁহার (ঈশ্বরের) বিশেষ অংশ ভিতরে না থাকিলে কেহ কখনো কোন বিষয়ে বড় হইতে পারে না; বা মান, ক্ষমতা প্রভৃতি হজম1 করিতে পারে না!” সাত্ত্বিক-প্রকৃতি-সম্পন্না রানীর ভিতর ঐরূপ ঐশী শক্তি বিদ্যমান ছিল বলিয়াই তিনি ঐরূপ কঠোরভাবে প্রকাশিত হইলেও ঠাকুরের গুরুভাবে কৃপা গ্রহণ করিতে পারিয়াছিলেন। ঠাকুর বলিতেন, “রানী রাসমণি শ্রীশ্রীজগদম্বার অষ্ট নায়িকার একজন! ধরাধামে তাঁহার পূজা-প্রচারের জন্য আসিয়াছিলেন। জমিদারির দলিল-পত্রাদি অঙ্কিত করিবার তাঁহার যে সীলমোহর ছিল তাহাতেও লেখা ছিল – ‘কালীপদ-অভিলাষী, শ্রীমতী রাসমণি দাসী।’ রানীর প্রতি কার্যেই ঐরূপে জগন্মাতার উপর অচলা ভক্তি প্রকাশ পাইত।”


1. মান প্রভৃতি হজম করা অর্থাৎ ঐসকল লাভ করিয়াও মাথা ঠিক রাখা; অহঙ্কৃত হইয়া ঐসকলের অপব্যবহার না করা।

ঈশ্বরে তন্ময় মনের লক্ষণ-সম্বন্ধে শাস্ত্রমত

আর এক কথা – সর্বতোভাবে ঈশ্বরে তন্ময় মনের নানা ভাবে অবস্থানের কথা শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ আছে। আচার্য শ্রীমৎ শঙ্কর তৎকৃত ‘বিবেকচূড়ামণি’-নামক গ্রন্থে উহা সুন্দরভাবে বর্ণনা করিয়াছেন –

দিগম্বরো বাপি চ সাম্বরো বা ত্বগম্বরো বাপি চিদম্বরস্থঃ।
উন্মত্তবদ্বাপি চ বালবদ্বা পিশাচবদ্বাপি চরত্যবন্যাম্॥ ৫৪১

– ঈশ্বরলাভ বা জ্ঞানলাভে সিদ্ধকাম পুরুষদিগের কেহ বা জ্ঞানরূপ বস্ত্রমাত্র পরিধান করিয়া সম্পূর্ণ উলঙ্গ হইয়া, আবার কেহ বা বল্কল বা সাধারণ লোকের ন্যায় বস্ত্র পরিধান করিয়া, কেহ বা উন্মাদের ন্যায়, আবার কেহ বা বহির্দৃষ্টে কামকাঞ্চনগন্ধহীন বালক, বা শৌচাচারবিবর্জিত পিশাচের ন্যায় পৃথিবীতে বিচরণ করিয়া থাকেন।

লোকগুরুদিগের এবং বিশেষতঃ শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ব্যবহার বুঝা এত কঠিন কেন

‘বিরাট আমি’-টার সহিত তন্ময়ভাবে অনেকক্ষণ অবস্থান করায় সাধারণ লোকের দৃষ্টিতে ইঁহাদের ঐরূপ অবস্থা লক্ষিত হইয়া থাকে। কিন্তু ঈশ্বরের অজ্ঞানান্ধকার দূরীকরণসমর্থ গুরুভাব ইঁহাদের ভিতর দিয়াই বিশেষভাবে প্রকাশিত হয়। কারণ, পূর্বেই বলিয়াছি – ক্ষুদ্র স্বার্থময় ‘আমি’-টার লোপ বা বিনাশেই জগদ্ব্যাপী বিরাট আমিত্ব এবং তৎসহ লোককল্যাণসাধনকারী শ্রীগুরুভাবের প্রকাশ। ঐ সকল জ্ঞানী পুরুষদিগের ভিতর আবার যাঁহারা ঈশ্বরেচ্ছায় সর্বদা গুরু বা ঋষি-পদবীতে অবস্থান করেন, তাঁহাদের আবার অপরের শিক্ষার নিমিত্ত সদ্বিষয়ে তীব্রানুরাগ, অসদ্বিষয়ে তীব্র বিরাগ বা ক্রোধ, আচার, নিষ্ঠা, নিয়ম, তর্ক, যুক্তি, শাস্ত্রজ্ঞান বা পাণ্ডিত্য ইত্যাদি সকল ভাবই অবস্থানুযায়ী সাধারণ পুরুষদিগের ন্যায় দেখাইতে হয়। ‘দেখাইতে হয়’ বলিতেছি এজন্য যে, ভিতরে ‘একমেবাদ্বিতীয়ং’ ব্রহ্মভাবে ভালমন্দ, ধর্মাধর্ম, পাপ-পুণ্যাদি মায়ারাজ্যের অন্তর্গত সকল পদার্থে ও ভাবে একাকার জ্ঞান বা দৃষ্টি পূর্ণভাবে বিদ্যমান থাকিলেও, অপরকে মায়ারাজ্যের পারে যাইবার পথ দেখাইবার জন্য ঐসকল ভাব লইয়া তাঁহারা কালযাপন করিয়া থাকেন। সাধারণ গুরু বা ঋষিদিগেরই যখন ঐরূপে লোককল্যাণের নিমিত্ত অনেক সময় কালযাপন করিতে হয়, তখন ঈশ্বরাবতার বা জগদ্গুরুপদবীস্থ আচার্যকুলের তো কথাই নাই। এজন্য তাঁহাদের বুঝা, ধরা সাধারণ মানবের এত কঠিন হইয়া উঠে; বিশেষতঃ আবার বর্তমান যুগাবতার ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেবের চেষ্টা ও ব্যবহারাদি ধরা ও বুঝা। কারণ অবতারকুলে যেসকল বাহ্যিক ঐশ্বর্য, শক্তি বা বিভূতির প্রকাশ শাস্ত্রে এ পর্যন্ত লিপিবদ্ধ আছে, সেসকল ইঁহাতে এত গুপ্তভাবে প্রকাশিত ছিল যে, যথার্থ তত্ত্বজিজ্ঞাসু হইয়া ইঁহার কৃপালাভ করিয়া ইঁহার সহিত বিশেষ ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে নিবদ্ধ না হইলে, ইঁহাকে দুই-চারি বার ভাসা ভাসা, উপর উপর মাত্র দেখিয়া কাহারও ঐসকলের পরিচয় পাইবার উপায় ছিল না। দেখ না, বাহ্যিক কোন্ গুণ দেখিয়া তুমি তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হইবে? বিদ্যায় – একেবারে নিরক্ষর বলিলেই চলে! শ্রুতিধরত্বগুণে বেদ-বেদান্তাদি সকল শাস্ত্র শুনিয়া যে তিনি সম্পূর্ণ আয়ত্ত করিয়া রাখিয়াছেন, একথা তুমি কেমন করিয়া বুঝিবে? বুদ্ধিতে তাঁহাকে ধরিবে? “আমি কিছু নহি, কিছু জানি না – সব আমার মা জানেন” – সর্বদা এইরূপ বুদ্ধির যাঁহাতে প্রকাশ, তাঁহার নিকট তুমি কোন্ বিষয়ে কি বুদ্ধি লইতে যাইবে? আর লইতে যাইলেও তিনি যখন বলিবেন, “মাকে জিজ্ঞাসা কর, তিনি বলিবেন”, তখন কি তুমি তাঁহার কথায় বিশ্বাস স্থির রাখিয়া ঐরূপ করিতে পারিবে? তুমি ভাবিবে – “কি পরামর্শই দিলেন! ও-কথা তো আমরা সকলে ‘কথামালা’ ‘বোধোদয়’ পড়িবার সময় হইতেই শুনিয়া আসিতেছি – ঈশ্বর সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ, ইচ্ছা করিলে সকল বিষয় জানাইয়া ও বুঝাইয়া দিতে পারেন; কিন্তু ঐ কথা লইয়া কাজ করিতে যাইলে কি চলে?” ধনে, নাম-যশে তাঁহাকে ধরিবে? ঠাকুরের নিজের তো ও-সকল খুবই ছিল! আবার ও-সকল তো ত্যাগ করিতেই প্রথম হইতেই উপদেশ! এইরূপ সকল বিষয়ে। কেবল আকৃষ্ট হইয়া ধরিবার একমাত্র উপায় ছিল – তাঁহার পবিত্রতা, ঈশ্বরানুরাগ ও প্রেম দেখিয়া। ইহাতে তুমি যদি আকৃষ্ট হইলে তো হইল, নতুবা তাঁহাকে ধরা ও বুঝা তোমার পক্ষে বহু দূরে! তাই বলি, রানী রাসমণি যে ঐরূপ কঠোরভাবে প্রকাশিত ঠাকুরের গুরুভাব ধরিতে পারিলেন এবং তিনি ঐরূপে যে শিক্ষাদান করিলেন, তাহা অভিমান-অহঙ্কারে ভাসাইয়া না দিয়া হৃদয়ে ধারণ করিয়া ধন্যা হইলেন – ইহা তাঁহার কম ভাগ্যোদয়ের কথা নহে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *