৩.৪ গুরুভাবের পূর্ববিকাশ

তৃতীয় খণ্ড – চতুর্থ অধ্যায়: গুরুভাবের পূর্ববিকাশ

বাল্যাবস্থা হইতেই গুরুভাবের পরিচয় ঠাকুরের জীবনে পাওয়া যায়

অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্।
পরং ভাবমজানন্তো মম ভূতমহেশ্বরম্॥
– গীতা, ৯।১১

ঠাকুরের ভিতরে গুরুভাবের প্রকাশ বাল্যাবধিই দেখিতে পাওয়া যায়। তবে যৌবনে নির্বিকল্প-সমাধিলাভের পর ঐ ভাবের যে পূর্ণ বিকাশ, তাহাও স্বীকার করিতে হয়। বাল্যাবধি তাঁহাতে ঐ ভাবের প্রকাশ বলাতে কেহ না মনে করেন, আমরা ঠাকুরকে বাড়াইবার জন্য কথাটি অতিরঞ্জিত করিয়া বলিতেছি। যথার্থ নিরপেক্ষভাবে যদি কেহ ঠাকুরের জীবন আলোচনা করেন তাহা হইলে দেখিতে পাইবেন, ঐ দোষে কখনই তাঁহাকে লিপ্ত হইতে হইবে না। এ অদ্ভুত অলৌকিক জীবনের ঘটনাবলী যিনি যতদূর পারেন বিচার করিয়া দেখুন না কেন, দেখিবেন বিচারশক্তিই পরিশেষে হার মানিয়া স্তম্ভিত ও মুগ্ধ হইয়া রহিয়াছে! আমাদের মনও বড় কম সন্দিগ্ধ ছিল না; আমাদের ভিতরের অনেকেই ঠাকুরকে যে ভাবে যাচাইয়া বাজাইয়া লইয়াছেন ঐরূপ করিতে এখনকার কাহারও মন-বুদ্ধিতে উঠিবেই না বলিয়া আমাদের বোধ হয়। ঐরূপে ঠাকুরকে সন্দেহ করা এবং পরীক্ষা করিতে যাইয়া নিজেই পরাজিত হইয়া লজ্জায় অধোবদন হওয়া আমাদের ভিতর কতবার কত লোকেরই ভাগ্যে যে হইয়াছে তাহা বলা যায় না। ‘লীলাপ্রসঙ্গে’ ঐ বিষয়ের আভাস আমরা পূর্বেই পাঠককে কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ দিয়াছি, পরে আরও অনেক দিতে হইবে। পাঠক তখন নিজেই বুঝিয়া লইবেন; এজন্য এ বিষয়ে এখন আর অধিক বলিবার আবশ্যকতা নাই।

“আগে ফল, তারপর ফুল।” সকল অবতারপুরুষের জীবনেই ঐ ভাব

“আগে ফল, তারপর ফুল – যেমন লাউ-কুমড়ার” – ঠাকুর এ কথাটি নিত্যমুক্ত ঈশ্বরকোটিদের জীবনপ্রসঙ্গে সর্বদাই ব্যবহার করিতেন। অর্থ – ঐরূপ পুরুষেরা জগতে আসিয়া কোন বিষয়ে সিদ্ধ হইবার জন্য যাহা কিছু সাধন করেন, তাহা কেবল ইতর-সাধারণকে বুঝাইয়া দিবার জন্য যে, ঐ বিষয়ে ঐরূপ ফললাভ করিতে হইলে এইরূপ চেষ্টা তাহাদের করিতে হইবে। কারণ ঐরূপ পুরুষদিগের জীবনালোচনা করিলে দেখিতে পাওয়া যায় যে, যে জ্ঞানলাভের জন্য তাঁহারা এতটা চেষ্টা জীবনে দেখান, সেই জ্ঞান আজীবন থাকিলে সকল কার্য যেরূপভাবে করা যায়, ঐসকল পুরুষেরা বাল্যাবধি ঠিক তদ্রূপ ব্যবহারই সর্বত্রই সকল বিষয়ে করিয়া আসিয়াছেন। যেন ঐ জ্ঞানলাভ করিবার ফল তাঁহারা পূর্ব হইতেই নিজস্ব করিয়া রাখিয়াছেন। নিত্যমুক্তদিগের সম্বন্ধেই যখন ঐ কথা সত্য, তখন ঈশ্বরাবতারদের তো কথাই নাই। তাঁহাদের জীবনে ঐরূপ জ্ঞানের প্রকাশ আজীবনই দেখিতে পাওয়া যায়। সকল দেশের সকল যুগের ঈশ্বরাবতারদের সম্বন্ধেই শাস্ত্র একথা সত্য বলিয়া লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। আবার ইহাও দেখা যায় যে, ভিন্ন ভিন্ন যুগের ঈশ্বরাবতারদিগের অনেক ব্যবহারের মধ্যে একটা সৌসাদৃশ্য আছে। যথা – স্পর্শদ্বারা ধর্মজীবন-সঞ্চারের কথা যীশু, শ্রীচৈতন্য ও শ্রীরামকৃষ্ণ সকলের জীবনেই দেখিতে পাই। ঐরূপ, তাঁহাদের জন্মগ্রহণকালে বিশেষ বিশেষ ধর্মপরায়ণ ব্যক্তির ঐ বিষয় অলৌকিক উপায়ে জ্ঞাত হইবার কথা, বাল্যাবধি তাঁহাদের ভিতর গুরুভাব প্রকাশিত থাকিবার কথা, তাঁহারা যে মানবসাধারণকে উন্নত করিবার জন্য বিশেষ বিশেষ পথ দেখাইতে কৃপায় অবতীর্ণ, এ বিষয়টি বাল্যাবধি উপলব্ধি করিবার কথা প্রভৃতি অনেক কথাই একরূপ দেখিতে পাওয়া যায়। অতএব ঠাকুরের জীবনে বাল্যাবধি গুরুভাব প্রভৃতির প্রকাশ থাকার কথা শুনিয়া আশ্চর্য হইবার কিছু নাই। কারণ ‘অবতার’-পুরুষদিগের থাক বা শ্রেণীই একটা পৃথক। সাধারণ মানবের জীবনে ঐরূপ ঘটনা কখনও সম্ভবে না বলিয়া অবতারপুরুষদিগের জীবনেও ঐরূপ হওয়া অসম্ভব মনে করিলে বিষম ভ্রমে পড়িতে হইবে।

ঠাকুরের জীবনে গুরুভাবের প্রথমবিকাশ – কামারপুকুরে

ঠাকুরের জীবনে গুরুভাবের প্রথম জ্বলন্ত নিদর্শন দেখিতে পাই তাঁহার জন্মভূমি কামারপুকুরে। তাঁহার তখন উপনয়ন হইয়া গিয়াছে; অতএব বয়স ৯।১০ বৎসর হইবে।

লাহাবাবুদের বাটীতে পণ্ডিত-সভায় শাস্ত্র-বিচার

গ্রামের জমিদার লাহাবাবুদের বাটীতে শ্রাদ্ধোপলক্ষে তদঞ্চলের খ্যাতনামা পণ্ডিতবর্গের নিমন্ত্রণ হয় এবং অনেক পণ্ডিতের একত্র সমাবেশ হইলে যাহা হইয়া থাকে – খুব তর্কের হুড়াহুড়ি পড়িয়া যায়। অনেক তর্কেও শাস্ত্রীয় প্রশ্নবিশেষের কোনরূপ মীমাংসা হইতেছিল না, এমন সময়ে বালক শ্রীরামকৃষ্ণ বা গদাধর পরিচিত জনৈক পণ্ডিতকে বলেন, “কথাটার এই ভাবে মীমাংসা হয় না কি?” সভায় পল্লীর অনেক বালকই কৌতূহলাকৃষ্ট হইয়া আসিয়াছিল এবং নানারূপ অঙ্গভঙ্গি করিয়া পণ্ডিতদিগের উচ্চরবে বাগ্যুদ্ধটার বিন্দুমাত্র অর্থবোধ না হওয়ায় কেহ বা উহাকে একটা রঙ্গরসের মধ্যে ভাবিয়া হাসিতেছিল, কেহ বা বিরক্ত হইয়া পণ্ডিতদিগের অঙ্গভঙ্গির অনুকরণ করিয়া সোরগোল করিতেছিল, আবার কেহ বা একেবারে অন্যমনা হইয়া আপনাদের ক্রীড়াতেই মন দিয়াছিল। কাজেই এ অপূর্ব বালক যে পণ্ডিতদিগের সকল কথা ধৈর্যসহকারে শুনিয়াছে, বুঝিয়াছে এবং মনে ভাবিয়া একটা সুমীমাংসায় উপনীত হইয়াছে, ইহা ভাবিয়া পণ্ডিতটি প্রথম অবাক হইলেন; তাহার পর নিজের পরিচিত পণ্ডিতদের নিকট গদাধরের মীমাংসার কথা বলিতে লাগিলেন; তাহার পর তাঁহারা সকলে উহাই ঐ বিষয়ের একমাত্র মীমাংসা বুঝিয়া অপরাপর সকল পণ্ডিতকে ঐ বিষয় বুঝাইয়া বলিলেন। তখন ঐ প্রশ্নের উহাই যে একমাত্র সমাধান তাহা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিলেন এবং কাহার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ঐ অপূর্ব সমাধান প্রথম দেখিতে পাইল, তাহারই অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন; এবং যখন নিশ্চিত জানিতে পারিলেন, উহা বালক গদাধরই করিয়াছে, তখন কেহ বা স্তম্ভিতপ্রায় হইয়া বালককে দৈবশক্তিসম্পন্ন ভাবিয়া তাহার দিকে চাহিয়া রহিলেন, আবার কেহ বা আনন্দপূরিত হইয়া বালককে ক্রোড়ে তুলিয়া আশীর্বাদ করিতে লাগিলেন!

ঈশার জীবনে ঐরূপ ঘটনা। জেরুজালেমের য়্যাভে-মন্দির

কথাটির আর একটু আলোচনা আবশ্যক। ক্রিশ্চান ধর্ম-প্রবর্তক ভগবদবতার ঈশার জীবনেও ঠিক এইরূপ একটি কথা বাইবেলে1 লিপিবদ্ধ আছে। তাঁহার বয়ঃক্রম তখন দ্বাদশবর্ষ। তাঁহার দরিদ্র ধর্মপরায়ণ পিতামাতা ইয়ুসুফ ও মেরি সে বৎসর তাঁহাকে লইয়া অন্যান্য যাত্রীদের সহিত পদব্রজে নিজেদের বাসভূমি গ্যালিলি প্রদেশস্থ নাজারেথ্ নামক গণ্ডগ্রাম হইতে জেরুজালেম তীর্থের সুবিখ্যাত মন্দিরে দেবদর্শন ও পূজা বলি ইত্যাদি দিবার জন্য যাত্রা করিয়াছেন। ইহুদিদিগের এই তীর্থ হিন্দুদিগের তীর্থসকলের ন্যায়ই ছিল। এখানে সুবর্ণকৌটায় য়াভে দেবতার আবির্ভাব ভক্ত-সাধক প্রত্যক্ষ করিয়া আপনাকে কৃতার্থ জ্ঞান করিত; এবং উহার সম্মুখে একটি বেদীর উপর ধূপ-ধুনা জ্বালাইয়া পত্র-পুষ্প-ফল-মূল ও মেষ পায়রা প্রভৃতি পশু-পক্ষ্যাদি বলি দিয়া উক্ত দেবতার পূজা করিত। হিন্দুদিগের ৺কামাখ্যা পীঠ ও ৺বিন্ধ্যবাসিনী প্রভৃতি তীর্থে অদ্যাপি পায়রা প্রভৃতি পক্ষী বলি দেওয়া এখনো প্রচলিত।


1. লুক্, ২-৪২

সেকালের য়্যাহুদী তীর্থযাত্রী

ইয়ুসুফ ও মেরি শাস্ত্রানুসারে দর্শন, পূজা, বলি ও হোমাদি ক্রিয়া সম্পন্ন করিয়া সঙ্গীদিগের সহিত নিজ গ্রামাভিমুখে ফিরিলেন। সে সময়ে নানা দিগ্দেশ হইতে জেরুজালেমদর্শনে আগত যাত্রীদিগের অবস্থা অনেকটা, রেল হইবার পূর্বে পদব্রজে ৺পুরী প্রভৃতি তীর্থদর্শনে অগ্রসর যাত্রীদিগের মতোই ছিল। সেই মধ্যে মধ্যে বৃক্ষ-কূপ-তড়াগাদিশোভিত একই প্রকার দীর্ঘ পথ, সেই মধ্যে মধ্যে বিশ্রামস্থান, চটী বা সরাই – ধর্মশালারও অভাব ছিল না শুনা যায় – সেই তীর্থযাত্রীর সহচর পাণ্ডা, সেই চাল-ডাল-আটা প্রভৃতি নিতান্ত আবশ্যকীয় খাদ্যাদিদ্রব্য-প্রাপ্তিস্থান মুদির দোকান, সেই ধূলা, সেই ধর্মভাববিস্মরণকারী নিদ্রালস্যের বৈরী যাত্রীদিগের পরমবন্ধু মশককুল, সেই বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের যাত্রিবর্গের দস্যু-তস্করাদি হইতে পরস্পরের সাহায্যলাভ করিতে পারিবে বলিয়া দলবদ্ধ হইয়া গমন এবং পরিশেষে সেই যাত্রীদিগের একান্ত ঈশ্বরনির্ভরতা ও ভগবদ্ভক্তি।

য়্যাভে-মন্দিরে ঈশার শাস্ত্রব্যাখ্যা

ঈশার পিতা-মাতা আপন দলের সহিত প্রত্যাবর্তনের সময় ঈশাকে নিকটে দেখিতে না পাইয়া ভাবিলেন, বোধ হয় অপর কোন যাত্রীবালকের সহিত দলের পশ্চাতে আসিতেছে। কিন্তু অনেক দূর চলিয়া আসিয়াও যখন ঈশাকে দেখিতে পাইলেন না, তখন বিশেষ ভাবিত হইয়া তন্নতন্ন করিয়া দলমধ্যে অন্বেষণ করিয়া দেখিলেন ঈশা তাঁহাদের সঙ্গে নাই। কাজেই ব্যাকুল হইয়া পুনরায় জেরুজালেম-অভিমুখে ফিরিলেন। সেখানে নানা স্থানে অনুসন্ধান করিতে যাইয়া দেখেন বালক ঈশা শাস্ত্রজ্ঞ সাধককুলের ভিতর বসিয়া শাস্ত্রবিচার করিতেছে এবং শাস্ত্রের জটিল প্রশ্নসকলের (যাহা পণ্ডিতেরাও সমাধান করিতে পারিতেছেন না) অপূর্ব ব্যাখ্যা করিয়া সকলকে মোহিত করিতেছে।

পণ্ডিত মোক্ষমূলরের মত খণ্ডন

পণ্ডিত মোক্ষমূলর তৎকৃত শ্রীরামকৃষ্ণজীবনীতে শ্রীরামকৃষ্ণের পূর্বোক্ত বাল্যলীলার সহিত ঈশার বাল্যলীলার সৌসাদৃশ্য পাইয়া ঐ বিষয়ের সত্যতায় বিশেষ সন্দিহান হইয়াছেন। শুধু তাহাই নহে, একটু কটাক্ষ করিয়াও বলিয়াছেন যে, শ্রীরামকৃষ্ণের ইংরাজীবিদ্যাভিজ্ঞ শিষ্যেরা গুরুর মান বাড়াইবার জন্য ঈশার বাল্যলীলার কথাটি শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত ইচ্ছা করিয়াই জুড়িয়া দিয়াছেন। পণ্ডিত ঐরূপে আপন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলেও আমরা নাচার, কারণ শ্রীরামকৃষ্ণের ঐরূপ বাল্যলীলার কথা আমরা ঠাকুরের জন্মভূমি কামারপুকুরের অনেক বৃদ্ধের মুখে শুনিয়াছি এবং ঠাকুরও কখনো কখনো ঐ বিষয় আমাদের কাহারও কাহারও নিকট নিজমুখে বলিয়াছেন। এই পর্যন্ত বলিয়াই এখানে ক্ষান্ত থাকা ভাল।

ঠাকুর বিবাহ করিলেন কেন? আত্মীয়দিগের অনুরোধে? – না

ঠাকুরের জীবনালোচনা করিতে যাইয়া সকলেরই মনে হয় – ঠাকুর বিবাহিত হইলেন কেন? স্ত্রীর সহিত যাঁহার কোনকালেই শরীরসম্বন্ধ রাখিবার সঙ্কল্প ছিল না, তিনি কেন বিবাহ করিলেন, ইহার কারণ বাস্তবিকই খুঁজিয়া পাওয়া ভার। যদি বল, যৌবনে পদার্পণ করিয়াই ঠাকুর ‘ভগবান’ ‘ভগবান’ করিয়া উন্মাদপ্রায় হইলেন বলিয়াই আত্মীয়েরা জোর করিয়া বিবাহ দিলেন, তদুত্তরে আমরা বলি ওটা একটা কথাই নয়। জোর করিয়া একটা ছোট কাজও তাঁহাকে বাল্যাবধি কেহ করাইতে পারে নাই। যখন যাহা করিবেন মনে করিয়াছেন, তাহা কোন না কোনও উপায়ে নিশ্চিত সাধিত করিয়াছেন। উপনয়নকালে ধনী নাম্নী জনৈকা কামারজাতীয়া কন্যাকে ভিক্ষামাতা করাতেই দেখ না। কামারপুকুরে কলিকাতার ন্যায় সমাজবন্ধন শিথিল ছিল না যে, যাহার যাহা ইচ্ছা তাহাই করিবে; ঠাকুরের পিতামাতাও কম স্বধর্মনিষ্ঠ ছিলেন না, বংশগত প্রথাও ছিল – কোন না কোনও ব্রাহ্মণকন্যাকে ভিক্ষামাতারূপে নির্দিষ্ট করা এবং বালক গদাধরের অভিভাবকদিগের সকলেই বালকের কামারকন্যার নিকট হইতে প্রথম ভিক্ষাগ্রহণের বিরোধী ছিলেন। তথাপি কেবলমাত্র গদাধরের নির্বন্ধে ধনীর ভিক্ষামাতা হওয়া সাব্যস্ত হইল – ইহা একটি কম আশ্চর্যের বিষয় নহে! এইরূপে সকল ঘটনায় যখন দেখিতে পাই, ঠাকুরের ইচ্ছা ও কথাই সকল বিষয়ে অপর সকলের বিপরীত ভাব ও ইচ্ছাকে চিরকাল ফিরাইয়া দিয়াছে, তখন কেমন করিয়া বলি তাঁহার জীবনের অত বড় ঘটনাটা আত্মীয়দিগের ইচ্ছা ও অনুরোধের জোরে হইয়াছে?

ভোগবাসনা ছিল বলিয়া? – না

আবার, যদি বল ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগে সর্বস্বত্যাগের ভাবটা যে ঠাকুরের আজীবন ছিল, এ কথাটা স্বীকার করিবার আবশ্যকতা কি? ঐ কথাটা স্বীকার না করিয়া যদি বল যে, মানবসাধারণের ন্যায় ঠাকুরেরও বিবাহাদি করিয়া সংসারসুখভোগ করিবার ইচ্ছাটা প্রথম প্রথম ছিল, কিন্তু যৌবনে পদার্পণ করিয়াই তাঁহার মনের গতির হঠাৎ একটা আমূল পরিবর্তন আসিয়া পড়িল; সংসার-বৈরাগ্য ও ঈশ্বরানুরাগের একটা প্রবল ঝটিকা তাঁহার প্রাণে বহিয়া তাঁহাকে এমন আত্মহারা করিয়া ফেলিল যে, তাঁহার পূর্বেকার বাসনাসমূহ একেবারে চিরকালের মতো কোথায় উড়িয়া যাইল। ঠাকুরের বিবাহটা ঐ বিরাগ-অনুরাগের ঝড়টা বহিবার আগেই হইয়াছিল বলিলেই তো সকল কথা মিটিয়া যায়! আমরা বলি – কথাটি আপাততঃ বেশ যুক্তিযুক্ত বোধ হইলেও তৎসম্বন্ধে কতকগুলি অখণ্ডনীয় আপত্তি আছে। প্রথম – চব্বিশ বৎসর বয়সে ঠাকুরের বিবাহ হয়, তখন বৈরাগ্যের ঝড় তাঁহার প্রাণে তুমুল বহিতেছে। আর, আজীবন যিনি নিজের জন্য কাহাকেও এতটুকু কষ্ট দিতে কুণ্ঠিত হইতেন, তিনি যে কিছুমাত্র না ভাবিয়া একজন পরের মেয়ের চিরকাল দুঃখ-ভোগের সম্ভাবনা বুঝিয়াও ঐ কার্যে অগ্রসর হইলেন, ইহা হইতেই পারে না। দ্বিতীয় – ঠাকুরের জীবনের কোন ঘটনাই যে নিরর্থক হয় নাই, একথা আমরা যতই বিচার করিয়া দেখি ততই বুঝিতে পারি। তৃতীয় – তিনি ইচ্ছা করিয়াই যে বিবাহ করিয়াছিলেন ইহা সুনিশ্চিত; কারণ বিবাহের পাত্রী অনুসন্ধানকালে নিজের ভাগিনেয় হৃদয় ও বাটীর অন্যান্য সকলকে বলিয়া দেন যে, তাঁহার বিবাহ জয়রামবাটীনিবাসী শ্রীযুত রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কন্যার সহিত হইবে – ইহা পূর্ব হইতে স্থির আছে।

বিবাহের পাত্রী-অন্বেষণের সময় ঠাকুরের কথা – “কুটো বেঁধে রাখা আছে, দেখ্ গে যা।” অতএব স্বেচ্ছায় বিবাহ করা

কথাটি শুনিয়া পাঠক অবাক হইবে, অথবা অবিশ্বাস করিয়া বলিবে – “কেবলই অদ্ভুত কথার অবতারণা! বিংশ শতাব্দীতে ও-সকল কথা কি চলে?” তদুত্তরে আমাদের বলিতে হয়, “তুমি বিশ্বাস কর আর নাই কর বাপু, কিন্তু ঘটনা বাস্তবিকই ঐরূপ হইয়াছিল। এখনও অনেকে বাঁচিয়া আছেন যাঁহারা ঐ বিষয়ে সাক্ষ্য দিবেন। অনুসন্ধান করিয়া দেখই না কেন?” পাত্রীর অন্বেষণে যখন কোনটিই আত্মীয়দিগের মনোমতো হইতেছিল না, তখন ঠাকুর স্বয়ং বলিয়া দেন “অমুক গাঁয়ের অমুকের মেয়েটি কুটো বেঁধে1 রাখা আছে, দেখগে যা!” অতএব বুঝাই যাইতেছে ঠাকুর জানিতে পারিয়াছিলেন, তাঁহার বিবাহ হইবে এবং কোথায় কাহার কন্যার সহিত হইবে। তিনি তাহাতে কোন আপত্তিও করেন নাই। অবশ্য ঐরূপ জানিতে পারা তাঁহার ভাবসমাধিকালেই হইয়াছিল।


1. পাড়াগাঁয়ে প্রথা আছে, শশা প্রভৃতি গাছের যে ফলটি ভাল বুঝিয়া ভগবানের ভোগ দিবে বলিয়া কৃষক মনে করে, স্মরণ রাখিবার জন্য সেটিতে একটি কুটো বাঁধিয়া চিহ্নিত করিয়া রাখে। ঐরূপ করায় কৃষক নিজে বা তাহার বাটীর আর কেহ সেটি ভুলক্রমে তুলিয়া বিক্রয় করিয়া ফেলে না। ঠাকুর ঐ প্রথা স্মরণ করিয়াই ঐ কথা বলেন। অর্থ – অমুকের মেয়ের সহিত তাঁহার বিবাহ হইবে একথা পূর্ব হইতে স্থির হইয়া আছে অথবা অমুক কন্যাটি তাঁহার বিবাহের পাত্রীস্বরূপে দৈবকর্তৃক রক্ষিতা আছে।

প্রারব্ধ কর্ম-ভোগের জন্যই কি ঠাকুরের বিবাহ?

তবে ঠাকুরের বিবাহ হইবার অর্থ কি? শাস্ত্রজ্ঞ কোন পাঠক এইবার হয়তো বিরক্ত হইয়া বলিবেন – তুমি তো বড় অর্বাচীন হে! সামান্য কথাটা লইয়া এত গোল করিতেছ? শাস্ত্র-টাস্ত্র একটু-আধটু দেখিয়া সাধু-মহাপুরুষের জীবনের ঘটনা লিখিতে কলম ধরিতে হয়। শাস্ত্র বলেন – ঈশ্বরদর্শন বা পূর্ণজ্ঞান হইলে জীবের সঞ্চিত ও আগামী কর্মের ক্ষয় হয়, কিন্তু প্রারব্ধ কর্মের ভোগ জীবকে জ্ঞানলাভ হইলেও এই দেহে করিতে হয়। একটা ব্যাধের পিঠে-বাঁধা তূণে কতকগুলি তীর রহিয়াছে, হাতে একটি তীর এখনি ছুঁড়িবে বলিয়া লইয়াছে, আর একটি তীর বৃক্ষোপরি একটি পক্ষীকে লক্ষ্য করিয়া সে এইমাত্র ছুঁড়িয়াছে। এমন সময় ধর, ব্যাধের মনে হঠাৎ বৈরাগ্যের উদয় হইয়া সে ভাবিল আর হিংসা করিবে না। হাতের তীরটি সে ফেলিয়া দিল, পিঠের তীরগুলিও ঐরূপে ত্যাগ করিল, কিন্তু যে তীরটি সে পাখিটাকে লক্ষ্য করিয়া ছুঁড়িয়া ফেলিয়াছিল সেটাকে কি আর ফিরাইতে পারে? পিঠের তীরগুলি যেন তাহার জন্মজন্মান্তরের সঞ্চিত কর্ম, আর হাতের তীরটি আগামী কর্ম বা যে কর্মসকলের ফল সে এইবার ভোগ করিবে – ঐ উভয় কর্মগুলি জ্ঞানলাভে নাশ হয়। কিন্তু তাহার প্রারব্ধ কর্মগুলি হইতেছে – যে তীরটি সে ছুঁড়িয়া ফেলিয়াছে তাহার মতো, তাহাদের ফল ভোগ করিতে হইবেই হইবে। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ন্যায় মহাপুরুষেরা কেবল প্রারব্ধ কর্মসকলের ভোগই শরীরে করিয়া থাকেন। ঐ ফলভোগ অবশ্যম্ভাবী; এবং তাঁহারা বুঝিতে বা জানিতেও পারেন যে, তাঁহাদের প্রারব্ধ অনুসারে তাঁহাদের জীবনে কিরূপ ঘটনাবলী আসিয়া উপস্থিত হইবে। কাজেই শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ঐরূপে নিজ বিবাহ কোন্ পাত্রীর সহিত কোথায় হইবে, তাহা বলিয়া দেওয়াটা কিছু বিচিত্র নহে।

না – যথার্থ জ্ঞানী পুরুষের প্রারব্ধ ভোগ করা-না-করা ইচ্ছাধীন

ঐ কথার উত্তরে আমরা বলি – অবশ্য শাস্ত্রজ্ঞান সম্বন্ধে আমরা বাস্তবিকই নিতান্ত অনভিজ্ঞ। কিন্তু যতটুকু দেখিয়াছি, তাহাতে যথার্থজ্ঞানী পুরুষকে প্রারব্ধ কর্মসকলেরও ফলভোগ করিতে হয় না। কারণ সুখ-দুঃখাদি ভোগ করিবে যে মন, সে মন যে তিনি চিরকালের নিমিত্ত ঈশ্বরে অর্পণ করিয়াছেন – তাহাতে আর সুখ-দুঃখাদির স্থান কোথা? তবে যদি বল – তাঁহার শরীরটায় প্রারব্ধ ভোগ হয়, তাহাই বা কিরূপে হইবে? তিনি যদি ইচ্ছা করিয়া অল্পমাত্র আমিত্ব কোন বিশেষ কারণে – যথা, পরোপকারাদির নিমিত্ত – রাখিয়া দেন, তবেই তাঁহার আবার শরীরমনের উপলব্ধি হয় ও সঙ্গে সঙ্গে প্রারব্ধ কর্মের ভোগ হয়। অতএব যথার্থজ্ঞানী পুরুষ ইচ্ছা হইলে প্রারব্ধ ভোগ বা ত্যাগ করিতে পারেন; তাঁহাদের ঐরূপ ক্ষমতা আসিয়া উপস্থিত হয়। সেইজন্যই তাঁহাদিগকে ‘লোকজিৎ’, ‘মৃত্যুঞ্জয়’, ‘সর্বজ্ঞ’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়।

ঠাকুরের তো কথাই নাই; কারণ তাঁহার কথা – “যে রাম, যে কৃষ্ণ, সে-ই ইদানীং রামকৃষ্ণ”

আর এক কথা – শ্রীরামকৃষ্ণদেবের নিজের অনুভব যদি বিশ্বাস করিতে হয় তাহা হইলে তাঁহাকে আর জ্ঞানী পুরুষ বলা চলে না; ঐ শ্রেণীমধ্যেই তাঁহাকে আর স্থান দিতে পারা যায় না। কেন না, তাঁহাকে বার বার বলিতে শুনিয়াছি, “যে রাম, যে কৃষ্ণ, সে-ই ইদানীং রামকৃষ্ণ”, অর্থাৎ যিনি পূর্বে রামরূপে এবং কৃষ্ণরূপে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন, তিনিই বর্তমান যুগে শ্রীরামকৃষ্ণশরীরে বর্তমান থাকিয়া অপূর্ব লীলার বিস্তার করিতেছেন! কথাটি বিশ্বাস করিলে তাঁহাকে নিত্যশুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্তস্বভাব ঈশ্বরাবতার বলিয়াই স্বীকার করিতে হয়। আর ঐরূপ করিলে, তাঁহাকে প্রারব্ধাদি কোন কর্মেরই বশীভূত আর বলা চলে না। অতএব ঠাকুরের বিবাহ সম্বন্ধে অন্যপ্রকার মীমাংসাই আমরা যুক্তিযুক্ত মনে করি এবং তাহাই এখানে বলিব।

বিবাহের কথা লইয়া ঠাকুরের রঙ্গরস

বিবাহের কথা আমাদের নিকট উত্থাপন করিয়া ঠাকুর অনেক সময় রঙ্গরসও করিতেন। উহাও বড় মধুর। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর একদিন মধ্যাহ্নে ভোজন করিতে বসিয়াছেন; নিকটে শ্রীযুত বলরাম বসু ও অন্যান্য কয়েকটি ভক্ত বসিয়া তাঁহার সহিত নানা কথা কহিতেছেন। সেদিন শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানী কামারপুকুরে যাত্রা করিয়াছেন কয়েক মাসের জন্য, কারণ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র রামলালের বিবাহ।

ঠাকুর – (বলরামবাবুকে লক্ষ্য করিয়া) আচ্ছা, আবার বিয়ে কেন হলো বল দেখি? স্ত্রী আবার কিসের জন্য হলো? পরনের কাপড়ের ঠিক নেই – আবার স্ত্রী কেন?

বলরাম ঈষৎ হাসিয়া চুপ করিয়া আছেন।

ঠাকুর – ওঃ বুঝেছি; (থাল হইতে একটু ব্যঞ্জন তুলিয়া ও বলরামকে দেখাইয়া) এই – এর জন্যে হয়েছে। নইলে কে আর এমন করে রেঁধে দিত বল? (বলরামবাবু প্রভৃতি ভক্তগণের হাস্য) হাঁ গো, কে আর এমন করে খাওয়াটা দেখত। ওরা সব আজ চলে গেল – (ভক্তেরা কে চলিয়া গেল বুঝিতে না পারায়) রামলালের খুড়ী গো; রামলালের বিয়ে হবে – তাই সব কামারপুকুরে গেল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলুম, কিছুই মনে হলো না! সত্যি বলছি; যেন কে তো কে গেল! কিন্তু তারপর কে রেঁধে দেবে বলে ভাবনা হলো। কি জান? – সব রকম খাওয়া তো আর পেটে সয় না, আর সব সময় খাওয়ার হুঁশও থাকে না। ও (শ্রীশ্রীমা) বোঝে কি রকম খাওয়া সয়; এটা ওটা করে দেয়; তাই মনে হলো – কে করে দেবে!

দশ-প্রকারের সংস্কার পূর্ণ করিবার জন্যই সাধারণ আচার্যদিগের বিবাহ করা। ঠাকুরের বিবাহও কি সেজন্য? – না

দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর একদিন বিবাহের কথা উত্থাপন করিয়া বলেন, “বিয়ে করতে কেন হয় জানিস? ব্রাহ্মণশরীরের দশ রকম সংস্কার আছে – বিবাহ তারই মধ্যে একটা। ঐ দশ রকম সংস্কার হলে তবে আচার্য হওয়া যায়।” আবার কখনো কখনো বলিতেন, “যে পরমহংস হয়, পূর্ণ জ্ঞানী হয়, সে হাড়ী-মেথরের অবস্থা থেকে রাজা, মহারাজা, সম্রাটের অবস্থা পর্যন্ত সব ভুগে দেখে এসেছে। নইলে ঠিক ঠিক বৈরাগ্য আসবে কেন? যেটা দেখেনি (ভোগ করেনি), মন সেইটে দেখতে চাইবে ও চঞ্চল হবে – বুঝলে? ঘুঁটিটা সব ঘর ঘুরে তবে চিকে ওঠে – খেলার সময় দেখনি? সেই রকম।”

ধর্মাবিরুদ্ধ ভোগসহায়ে ত্যাগে পৌঁছাইবার জন্যই হিন্দুর বিবাহ

সাধারণ গুরুদিগের বিবাহ করিবার ঐরূপ কারণ ঠাকুর নির্দেশ করিলেও, ঠাকুরের নিজের বিবাহের বিশেষ কারণ যাহা আমরা বুঝিতে পারিয়াছি, তাহাই এখন বলিব। বিবাহটা ভোগের জন্য নয় – একথা শাস্ত্র আমাদের প্রতি পদে শিক্ষা দিতেছেন। ঈশ্বরের সৃষ্টিরক্ষারূপ নিয়ম-প্রতিপালন ও গুণবান পুত্র উৎপাদন করিয়া সমাজের কল্যাণসাধন করাই হিন্দুর বিবাহরূপ কর্মটার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত – শাস্ত্র বার বার এই কথাই আমাদের বলিয়া দিতেছেন। তবে কি উহাতে তাহার নিজ স্বার্থ কিছুমাত্র থাকিবে না – শাস্ত্র এইরূপ অসম্ভব কথা বলেন? না, তাহা নহে। শাস্ত্রকার ঋষিগণ দুর্বল মানবচরিত্রের অন্তস্তল পর্যন্ত দেখিয়াই বুঝিয়াছিলেন যে দুর্বল মানব স্বার্থ ভিন্ন এ জগতে আর কোন কথাই বুঝে না; লাভ-লোকসান না খতাইয়া অতি সামান্য কার্যেও অগ্রসর হয় না। শাস্ত্রকার ঐ কথা বুঝিয়াও যে পূর্বোক্ত আদেশ করিয়াছেন তাহার কারণ – তিনি এ কথাও বুঝিয়াছেন যে, ঐ স্বার্থটাকে যদি একটা মহান উদ্দেশ্যের সহিত সর্বদা জড়িত রাখিতে পারে তবেই মঙ্গল; নতুবা মানবকে পুনঃপুনঃ জন্ম-মৃত্যুর বন্ধনে পড়িয়া অশেষ দুঃখভোগ করিতে হইবে। নিজের নিত্য-মুক্ত আত্মস্বরূপ ভুলিয়াই মানব ইন্দ্রিয়দ্বার দিয়া বাহ্যজগতের রূপরসাদি ভোগের নিমিত্ত ছুটিতেছে; আর, মনে করিতেছে – ঐসকল বড়ই মধুর, বড়ই মনোরম!

বিচার-সংযুক্ত ভোগ করিতে করিতে কালে বোধ হয় – ‘দুঃখের মুকুট পরিয়া সুখ আসে’

কিন্তু জগতের প্রত্যেক সুখটাই যে দুঃখের সঙ্গে চিরসংযুক্ত, সুখটা ভোগ করিতে গেলেই যে সঙ্গে সঙ্গে দুঃখটাও লইতে হইবে – এ কথা কয়টা লোক ধরিতে বা বুঝিতে পারে? শ্রীযুত বিবেকানন্দ স্বামীজী বলিতেন, “দুঃখের মুকুট মাথায় পরে সুখ এসে মানুষের কাছে দাঁড়ায়” – মানুষ তখন সুখকে লইয়াই ব্যস্ত! তাহার মাথায় যে দুঃখের মুকুট, উহাকে আপনার বলিয়া গ্রহণ করিলে পরিণামে যে দুঃখটাকেও লইতে হইবে – এ কথা তখন সে আর ভাবিবার অবসর পায় না! শাস্ত্র সেজন্য তাহাকে ঐ কথা স্মরণ করাইয়া দিয়া বলেন, ‘ওরে, সুখলাভটাই নিজের স্বার্থ – এ কথা মনে করিস কেন? সুখ বা দুঃখের একটা লইতে গেলে যে অপরটাকেও লইতে হইবে! স্বার্থটাকে একটু উচ্চ সুরে বাঁধিয়া ভাব না যে, সুখটাও আমার শিক্ষক, দুঃখটাও আমার শিক্ষক; আর যাহাতে ঐ দুয়ের হস্ত হইতে চিরকালের নিমিত্ত পরিত্রাণ পাওয়া যায় – তাহাই আমার স্বার্থ বা জীবনের উদ্দেশ্য’। অতএব বুঝা যাইতেছে – বিবাহিত জীবনে বিচারসংযুক্ত ভোগের দ্বারা এবং সুখদুঃখপূর্ণ নানা অবশ্যম্ভাবী অবস্থার অনুভবের দ্বারা ক্ষণভঙ্গুর সংসারের সকল আপাতসুখের উপর বিরক্ত হইয়া যাহাতে জীব ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগে পূর্ণ হয় এবং তাঁহাকেই সারাৎসার জানিয়া তাঁহার দর্শনলাভের দিকে মহোৎসাহে অগ্রসর হয়, ইহা শিক্ষা দেওয়াই শাস্ত্রকারের উদ্দেশ্য।

ভোগসুখ ত্যাগ করিতে করিতে মনকে কি ভাবে বুঝাইতে হয়, তদ্বিষয়ে ঠাকুরের উপদেশ

বিচার করিতে করিতে সংসারের কোন বিষয়টা ভোগ করিতে যাইলেই যে মন ঐ বিষয় ত্যাগ করিবে এ কথা নিশ্চিত; এজন্যই ঠাকুর বলিতেন, “ওরে, সদসদ্বিচার চাই। সর্বদা বিচার করে মনকে বলতে হয় যে, মন তুমি এই জিনিসটা ভোগ করবে, এটা খাবে, ওটা পরবে বলে ব্যস্ত হচ্ছ – কিন্তু যে পঞ্চভূতে আলু পটল চাল ডাল ইত্যাদি তৈরি হয়েছে, সেই পঞ্চভূতেই আবার সন্দেশ রসগোল্লা ইত্যাদি তৈরি হয়েছে; যে পঞ্চভূতের হাড়-মাংস রক্ত-মজ্জায় নারীর সুন্দর শরীর হয়েছে, তাহাতেই আবার তোমার, সকল মানুষের ও গরু ছাগল ভেড়া ইত্যাদি প্রাণীরও শরীর হয়েছে; তবে কেন ওগুলো পাবার জন্য এত হাঁই-ফাঁই কর? ওতে তো আর সচ্চিদানন্দলাভ হবে না! তাতেও যদি না মানে তো বিচার করতে করতে দু-একবার ভোগ করে সেটাকে ত্যাগ করতে হয়। যেমন ধর, রসগোল্লা খাবে বলে মন ভারি ধরেছে, কিছুতেই আর বাগ মানচে না – যত বিচার করচ সব যেন ভেসে যাচ্চে; তখন কতকগুলো রসগোল্লা এনে এগাল ওগাল করে চিবিয়ে খেতে খেতে মনকে বলবি – মন, এরই নাম রসগোল্লা; এ-ও আলু-পটলের মতো পঞ্চভূতের বিকারে তৈয়ারি হয়েছে; এ-ও খেলে শরীরে গিয়ে রক্ত-মাংস-মল-মূত্র হবে; যতক্ষণ গালে আছে ততক্ষণই এটা মিষ্টি – গলার নিচে নাবলে আর ঐ আস্বাদের কথা মনে থাকবে না, আবার বেশি খাও তো অসুখ হবে; এর জন্য এত লালায়িত হও! ছি ছি! – এই খেলে, আর খেতে চেও না। (সন্ন্যাসী ভক্তদিগকে লক্ষ্য করিয়া) সামান্য সামান্য বিষয়গুলো এই রকম করে বিচারবুদ্ধি নিয়ে ভোগ করে ত্যাগ করা চলে, কিন্তু বড় বড়গুলোতে ও রকম করা চলে না, ভোগ করতে গেলেই বন্ধনে পড়ে যেতে হয়। সেজন্য বড় বড় বাসনাগুলোকে বিচার করে, তাতে দোষ দেখে, মন থেকে তাড়াতে হয়।”

বিবাহিত জীবনে ব্রহ্মচর্যপালন করিবার প্রথার উচ্ছেদ হওয়াতেই হিন্দুর বর্তমান জাতীয় অবনতি

শাস্ত্র বিবাহের ঐরূপ উচ্চ উদ্দেশ্য উপদেশ করিলেও কয়টা লোকের মনে সে কথা আজকাল স্থান পায়? কয়জন বিবাহিত জীবনে যথাসাধ্য ব্রহ্মচর্য পালন করিয়া আপনাদিগকে এবং জনসমাজকে ধন্য করিয়া থাকেন? কয়জন স্ত্রী স্বামীর পার্শ্বে দাঁড়াইয়া তাঁহাকে লোকহিতকর উচ্চব্রতে – ঈশ্বরলাভের কথা দূরে থাকুক – প্রেরণা দিয়া থাকেন? কয়জন পুরুষই বা ‘ত্যাগই জীবনের উদ্দেশ্য’ জানিয়া স্ত্রীকে তাহা শিক্ষা দিয়া থাকেন? হায় ভারত! পাশ্চাত্যের ভোগসর্বস্ব জড়বাদ ধীরে ধীরে তোমার অস্থি-মজ্জায় প্রবিষ্ট হইয়া তোমাকে কি মেরুদণ্ডহীন পশুবিশেষে পরিণত করিয়াছে তাহা একবার ভাবিয়া দেখ দেখি! সাধে কি আর শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁহার সন্ন্যাসি-ভক্তদিগকে বর্তমান বিবাহিত জীবনে দোষ দেখাইয়া বলিতেন, “ওরে, (ভোগটাকে সর্বস্বজ্ঞান বা জীবনের উদ্দেশ্য করাই যদি দোষ হয়, তবে বিবাহের সময়) একটা ফুল ফেলে সেটা করলেই কি শুদ্ধ হয়ে গেল – তার দোষ কেটে গেল?” বাস্তবিক বিবাহিত জীবনে ইন্দ্রিয়পরতা আর কখনো ভারতে এত প্রবল হইয়াছিল কি না সন্দেহ। ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তি ভিন্ন বিবাহের যে অপর একটা মহাপবিত্র, মহোচ্চ উদ্দেশ্য আছে – একথা আমরা আজকাল একপ্রকার ভুলিয়াই গিয়াছি, আর দিন দিন ঐ কারণে পশুরও অধম হইতে বসিয়াছি! নব্য ভারত-ভারতীর ঐ পশুত্ব ঘুচাইবার জন্যই লোকগুরু ঠাকুরের বিবাহ। তাঁহার জীবনের সকল কার্যের ন্যায় বিবাহরূপ কার্যটাও লোককল্যাণের নিমিত্ত অনুষ্ঠিত।

নিজে অনুষ্ঠান করিয়া দেখাইয়া ঐ আদর্শ পুনরায় প্রচলনের জন্যই ঠাকুরের বিবাহ

ঠাকুর বলিতেন, “এখানকার যা কিছু করা সে তোদের জন্য। ওরে, আমি ষোল টাং করলে তবে যদি তোরা এক টাং করিস! আর আমি যদি দাঁড়িয়ে মুতি তো তোরা শালারা পাক দিয়ে দিয়ে তাই করবি।” এই জন্যই ঠাকুরের বিবাহিত জীবনের কর্তব্য ঘাড়ে লইয়া মহোচ্চ আদর্শ সকলের চক্ষুর সম্মুখে অনুষ্ঠান করিয়া দেখান। ঠাকুর যদি স্বয়ং বিবাহ না করিতেন তাহা হইলে গৃহস্থ মানব বলিত, ‘বিবাহ তো করেন নাই, তাই অত ব্রহ্মচর্যের কথা বলা চলিতেছে। স্ত্রীকে আপনার করিয়া এক সঙ্গে একত্র তো বাস কখনো করেন নাই, তাই আমাদের উপর লম্বা লম্বা উপদেশ দেওয়া চলিতেছে।’ সেজন্যই ঠাকুর শুধু যে বিবাহ করিয়াছিলেন মাত্র তাহা নহে, শ্রীশ্রীজগন্মাতার পূর্ণদর্শনলাভের পর যখন দিব্যোন্মাদাবস্থা তাঁহার সহজ হইয়া গেল, তখন পূর্ণযৌবনা বিবাহিতা স্ত্রীকে দক্ষিণেশ্বরে নিজ সমীপে আনাইয়া রাখিলেন, তাঁহাতে জগদম্বার আবির্ভাব সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করিয়া তাঁহাকে শ্রীশ্রীষোড়শী মহাবিদ্যাজ্ঞানে পূজা ও আত্মনিবেদন করিলেন, আটমাস কাল নিরন্তর একত্র বাস ও তাঁহার সহিত এক শয্যায় শয়ন পর্যন্ত করিলেন এবং স্ত্রীর শিক্ষা এবং প্রাণের শান্তি ও আনন্দের জন্য অতঃপর কামারপুকুরে এবং কখনো কখনো শ্বশুরালয় জয়রামবাটীতেও স্বয়ং যাইয়া দুই-এক মাস কাল অতিবাহিত করিতে লাগিলেন!

স্ত্রীর সহিত ঠাকুরের শরীরসম্বন্ধ-রহিত অদৃষ্টপূর্ব প্রেম-সম্বন্ধ। শ্রীশ্রীমার ঐ বিষয়ক কথা

দক্ষিণেশ্বরে যখন ঠাকুর স্ত্রীর সহিত এইরূপে একত্র বাস করেন, তখনকার কথা স্মরণ করিয়া শ্রীশ্রীমা এখনো স্ত্রী-ভক্তদিগকে বলিয়া থাকেন, “সে যে কি অপূর্ব দিব্যভাবে থাকতেন, তা বলে বোঝাবার নয়! কখনো ভাবের ঘোরে কত কি কথা, কখনো হাসি, কখনো কান্না, কখনো একেবারে সমাধিতে স্থির হয়ে যাওয়া – এই রকম, সমস্ত রাত! সে কি এক আবির্ভাব আবেশ, দেখে ভয়ে আমার সর্বশরীর কাঁপত, আর ভাবতুম কখন রাতটা পোহাবে! ভাবসমাধির কথা তখন তো কিছু বুঝি না; এক দিন তাঁর আর সমাধি ভাঙে না দেখে ভয়ে কেঁদেকেটে হৃদয়কে ডেকে পাঠালুম। সে এসে কানে নাম শুনাতে শুনাতে তবে কতক্ষণ পরে তাঁর চৈতন্য হয়! তারপর ঐরূপে ভয়ে কষ্ট পাই দেখে তিনি নিজে শিখিয়ে দিলেন – এই রকম ভাব দেখলে এই নাম শুনাবে, এই রকম ভাব দেখলে এই বীজ শুনাবে। তখন আর তত ভয় হতো না, ঐ সব শুনালেই তাঁর আবার হুঁশ হতো। তারপর অনেকদিন এইরূপে গেলেও, কখন তাঁর কি ভাবসমাধি হবে বলে সারা রাত্তির জেগে থাকি ও ঘুমুতে পারি না – এ কথা একদিন জানতে পেরে, নহবতে আলাদা শুতে বললেন।” পরমারাধ্যা শ্রীশ্রীমা বলেন, এইরূপে প্রদীপে সলতেটি কি ভাবে রাখিতে হইবে, বাড়ির প্রত্যেকে কে কেমন লোক ও কাহার সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করিতে হইবে, অপরের বাড়ি যাইয়া কিরূপ ব্যবহার করিতে হইবে প্রভৃতি সংসারের সকল কথা হইতে ভজন, কীর্তন, ধ্যান, সমাধি ও ব্রহ্মজ্ঞানের কথা পর্যন্ত সকল বিষয় ঠাকুর তাঁহাকে শিক্ষা দিয়াছেন।

গৃহী মানবের শিক্ষার জন্যই ঠাকুরের ঐরূপ প্রেমলীলাভিনয়

হে গৃহী মানব, কয়জন তোমরা এইভাবে নিজ নিজ স্ত্রীকে শিক্ষা দিয়া থাক? তুচ্ছ শরীরসম্বন্ধটা যদি আজ হইতে কোন কারণে উঠিয়া যায়, তাহা হইলে কয় জন তোমরা স্ত্রীকে ঐরূপে মান্য, ভক্তি ও নিঃস্বার্থ ভালবাসা আজীবন দিতে পার? সেইজন্যই বলি, এ অপূর্ব যুগাবতারের বিবাহ করিয়া, একদিনের জন্যও শরীর-সম্বন্ধ না পাতাইয়া, স্ত্রীর সহিত এই অদ্ভুত, অদৃষ্টপূর্ব প্রেমলীলার বিস্তার কেবল তোমারই জন্য। তুমিই শিখিতে পারিবে বলিয়া যে – ইন্দ্রিয়পরতা ভিন্ন বিবাহের অপর মহোচ্চ উদ্দেশ্য আছে এবং এই উচ্চ আদর্শে লক্ষ্য স্থির রাখিয়া যাহাতে তুমিও বিবাহিত জীবনে ব্রহ্মচর্যের যথাসাধ্য অনুষ্ঠান করিয়া স্ত্রী-পুরুষে ধন্য হইতে পার এবং মহামেধাবী, মহাতেজস্বী গুণবান সন্তানের পিতা-মাতা হইয়া ভারতের বর্তমান হীনবীর্য, হতশ্রী, হৃতশক্তিক সমাজকে ধন্য করিতে পার, সেইজন্য। শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধ, যীশু, শ্রীশঙ্কর, শ্রীচৈতন্য প্রভৃতি রূপে পূর্ব পূর্ব যুগে যে লীলা লোকগুরুদিগের জগৎকে দেখাইবার প্রয়োজন হয় নাই, তাহাই এই যুগে তোমার প্রয়োজনের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ-শরীরে প্রদর্শিত হইয়াছে। আজীবনব্যাপী কঠোর তপস্যা ও সাধনাবলে উদ্বাহবন্ধনের অদৃষ্টপূর্ব পবিত্র ‘ছাঁচ’ জগতে এই প্রথম প্রস্তুত হইয়াছে। এখন, ঠাকুর যেমন বলিতেন – তোমরা নিজ নিজ জীবন সেই আদর্শ ছাঁচে ফেল, আর নূতনভাবে গঠিত করিয়া তোল।

ঠাকুরের আদর্শে বিবাহিত জীবন গঠন করিতে এবং অন্ততঃ আংশিকভাবেও ব্রহ্মচর্য পালন করিতে হইবে। নতুবা আমাদের কল্যাণ নাই

‘কিন্তু’ – গৃহমেধিমানব এখনও বলিতেছে – ‘কিন্তু – !’ ওঃ, বুঝিয়াছি; এবং শ্রীস্বামী বিবেকানন্দ আমাদের সাধন-ভজন সম্বন্ধে যেমন বলিতেন, তাহাই তদুত্তরে বলিতেছি, “তোরা মনে করেছিস বুঝি প্রত্যেকে এক একটা রামকৃষ্ণ পরমহংস হবি? সে নয় মণ তেলও পুড়বে না, রাধাও নাচবে না। রামকৃষ্ণ পরমহংস জগতে একটাই হয় – বনে একটা সিঙ্গিই (সিংহ) থাকে।” হে গৃহী-মানব, আমরাও তোমার ‘কিন্তু’র উত্তরে সেইরূপ বলিতেছি – ঠাকুরের ন্যায় স্ত্রীর সহিত বাস করিয়া একেবারে অখণ্ড ব্রহ্মচর্য রাখা তোমার যে সাধ্যাতীত তাহা ঠাকুর বিলক্ষণ জানিতেন এবং জানিয়াও যে ঐরূপ করিয়া তোমায় দেখাইয়া গিয়াছেন, তাহা কেবল তুমি অন্ততঃ ‘এক টাং’ বা আংশিকভাবে উহার অনুষ্ঠান করিবে বলিয়া। কিন্তু, জানিও, ঐ উচ্চ আদর্শের অনুষ্ঠান করিয়া যদি তুমি স্ত্রীজাতিকে জগদম্বার সাক্ষাৎ প্রতিরূপ বলিয়া না দেখিতে এবং হৃদয়ের যথাসাধ্য নিঃস্বার্থ ভালবাসা না দিতে চেষ্টা কর, জগতের মাতৃস্থানীয়া স্ত্রীমূর্তিসকলকে তোমার ভোগমাত্রৈকসহায়া পরাধীনা দাসী বলিয়া ভাবিয়া চিরকাল পশুভাবেই দেখিতে থাক, তবে তোমার আর গতি নাই; তোমার বিনাশ ধ্রুব এবং অতি নিকটে। শ্রীকৃষ্ণের কথা উপেক্ষা করিয়া যদুবংশের কি হইল, তাহা ভাবিও, ঈশার কথা উপেক্ষা করিয়া ইহুদি জাতিটার কি দুর্দশা, তাহা স্মরণ রাখিও। যুগাবতারকে উপেক্ষা করা সর্বকালেই জাতিসকলের ধ্বংসের কারণ হইয়াছে।

বিবাহ করিয়া ঠাকুরের শরীর-সম্বন্ধ সম্পূর্ণ রহিত হইয়া থাকা সম্বন্ধে কয়েকটি আপত্তি ও তাহার খণ্ডন

আর একটি প্রশ্নের এখানে উত্তর দিয়াই আমরা উদ্বাহবন্ধনের ভিতর দিয়া ঠাকুরের গুরুভাবের অদৃষ্টপূর্ব বিকাশের কথা সাঙ্গ করিয়া ঐ বিষয়ের অপর কথাসকল বলিব। রূপ-রসাদি বিষয়ের দাস, বহির্মুখ মানবমনে এখনো নিশ্চিত উদয় হইতেছে যে, ঠাকুর যদি বিবাহই করিলেন, তবে একটিও অন্ততঃ সন্তানোৎপাদন করিয়া স্ত্রীর সহিত শরীর-সম্বন্ধ ত্যাগ করিলে ভাল হইত। ঐরূপ করিলে বোধ হয় ভগবানের সৃষ্টিরক্ষা করাটা যে মানুষমাত্রেরই কর্তব্য, তাহা দেখানো হইত এবং সঙ্গে সঙ্গে শাস্ত্রমর্যাদাটাও রক্ষা পাইত। কারণ, শাস্ত্র বলেন – বিবাহিত পত্নীতে অন্ততঃ একটি সন্তানও উৎপাদন করিতে। উহাতে পিতৃ-ঋণের হস্ত হইতে মানবের নিষ্কৃতি হয়। তদুত্তরে আমরা বলি –

প্রথমতঃ, আমরা যতটুকু দেখি, শুনি বা চিন্তা ও কল্পনা করি, সৃষ্টিটা বাস্তবিক কি ততটুকুই? সৃষ্টির নিয়মই বৈচিত্র্য থাকা। আজ এই মুহূর্ত হইতে যদি আমরা সকলে সকল বিষয়ে এক প্রকার চিন্তা ও কার্যের অনুষ্ঠান করিতে থাকি, তাহা হইলে সৃষ্টি ধ্বংস হইতে আর বড় বিলম্ব হইবে না। তারপর জিজ্ঞাসা করি – সৃষ্টিরক্ষার সকল নিয়মগুলিই কি তুমি জানিয়াছ এবং সৃষ্টিরক্ষা করিতে যাইয়াই কি তুমি আজ ব্রহ্মচর্যবিহীন? বুকে হাত দিয়া উত্তর প্রদান করিও; দেখিও, ঠাকুর যেমন বলিতেন – “ভাবের ঘরে চুরি না থাকে।” আচ্ছা, না হয় ধরিলাম সৃষ্টিরক্ষার ঐ নিয়মটি তুমি পালন করিতেছ। অপরকে ঐরূপ করিতে বলিবার তোমার কি অধিকার আছে? ব্রহ্মচর্য বা উচ্চাঙ্গের মানসিক শক্তিবিকাশের জন্য সাধারণ বিষয়ে শক্তিক্ষয় না করাটাও সৃষ্টি-মধ্যগত একটা নিয়ম। সকলেই যদি তোমার মতো নিম্নাঙ্গের শক্তিবিকাশেই ব্যস্ত থাকিবে, তবে উচ্চাঙ্গের আধ্যাত্মিক শক্তিবিকাশ দেখাইবে কে? ঐরূপ শক্তির বিকাশ তাহা হইলে তো লোপ পাইবে।

দ্বিতীয়তঃ, শাস্ত্রের ভিতর হইতে মনের মতো কথাগুলি বাছিয়া লওয়াই আমাদের স্বভাব। সন্তানোৎপাদনবিষয়ক কথাটিও ঐ ভাবেই বাছিয়া লওয়া হয়। কারণ, শাস্ত্র অধিকারিভেদে আবার বলেন, ‘যদহরেব বিরজেৎ তদহরেব প্রব্রজেৎ’ – যখনি ভগবানে অনুরাগ বাড়িয়া সংসারে বৈরাগ্যের উদয় হইবে, তখনি সংসার ত্যাগ করিবে। অতএব ঠাকুর যদি তোমার মতে চলিতেন, তাহা হইলে এ শাস্ত্রবচনের মর্যাদাটি রক্ষা করিত কে? পিতৃ-ঋণশোধ করা সম্বন্ধেও ঐ কথা। শাস্ত্র বলেন – যথার্থ সন্ন্যাসী তাঁহার ঊর্ধ্বতন সপ্তপুরুষ এবং অধস্তন সপ্তপুরুষকে নিজ পুণ্যবলে উদ্ধার করিয়া থাকেন। অতএব ঠাকুরের পিতৃ-ঋণশোধ হইল না ভাবিয়া আমাদের কাতর হইবার প্রয়োজন নাই।

গুরুভাবের প্রেরণাতেই যে ঠাকুরের বিবাহ, তৎপরিচয় শ্রীশ্রীমার ঠাকুরকে জগদম্বাজ্ঞানে আজীবন পূজা করাতেই বুঝা যায়

অতএব বুঝা যাইতেছে, ঠাকুরের জীবনে উদ্বাহবন্ধন কেবল আমাদের শিক্ষার নিমিত্তই হইয়াছিল। বিবাহিত জীবনের কি উচ্চ, পবিত্র আদর্শ তিনি আমাদের জন্য রাখিয়া গিয়াছেন, তাহার কিঞ্চিৎ পরিচয় শ্রীশ্রীমার আজীবন ঠাকুরকে সাক্ষাৎ জগন্মাতাজ্ঞানে পূজা করার কথাতেই বুঝিতে পারা যায়। মানুষ অপর সকলের নিকট আপন দুর্বলতা আবরিত রাখিতে পারিলেও, স্ত্রীর নিকট কখনই উহা লুক্কায়িত রাখিতে পারে না – ইহাই সংসারের নিয়ম। ঠাকুর ঐ বিষয়ে কখনো কখনো আমাদের বলিতেন, “যত সব দেখিস হোমরা-চোমরা বাবু ভায়া – কেউ জজ, কেউ মেজেস্টর, বাইরের যত বোলবোলাও – স্ত্রীর কাছে সব একেবারে কেঁচো, গোলাম! অন্দর থেকে কোন হুকুম এলে, অন্যায় হলেও সেটা রদ করবার কারও ক্ষমতা নেই!” অতএব কাহারও বিবাহিতা পত্নী যদি তাহার পবিত্র, উচ্চ জীবন দেখিয়া তাহাকে অকপটে হৃদয়ের ভক্তি দেয় এবং আজীবন ঈশ্বরজ্ঞানে পূজা করে, তাহা হইলে নিশ্চয় বুঝা যায়, সে লোকটা বাহিরে যে আদর্শ দেখায় তাহাতে কিছুমাত্র ভেল নাই। ঠাকুরের সম্বন্ধে সেজন্য ঐ কথা যত নিশ্চয় করিয়া আমরা বলিতে পারি, এমন আর কাহারও সম্বন্ধে নহে। পরিণীতা পত্নীর সহিত ঠাকুরের অপূর্ব প্রেমলীলার অনেক কথা বলিবার থাকিলেও, ইহা তাহার স্থান নহে। সেজন্য এখানে ঐ বিষয়ের ভিতর দিয়া ঠাকুরের অদ্ভুত গুরুভাব-বিকাশের কথঞ্চিৎ আভাসমাত্র দিয়াই আমরা ক্ষান্ত রহিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *