১.১ যুগ-প্রয়োজন

প্রথম খণ্ড – প্রথম অধ্যায়: যুগ-প্রয়োজন

মানব বর্তমানকালে কতদূর উন্নত ও শক্তিশালী হইয়াছে

বিদ্যা, সম্পদ ও পুরুষকার-সহায়ে মানবজীবন বর্তমানকালে পৃথিবীর সর্বত্র কতদূর প্রসার লাভ করিতেছে, তাহা অতি স্থূলদর্শী ব্যক্তিরও সহজে হৃদয়ঙ্গম হয়। মানব যেন কোন ক্ষেত্রেই একটা গণ্ডির ভিতর আবদ্ধ হইয়া এখন আর থাকিতে চাহিতেছে না। স্থলে জলে যথেচ্ছ পরিভ্রমণ করিয়া সুখী না হইয়া সে এখন অভিনব যন্ত্রাবিষ্কারপূর্বক গগনচারী হইয়াছে; তমসাবৃত সমুদ্রতলে ও জ্বালাময় আগ্নেয়গিরিগর্ভে অবতীর্ণ হইয়া সে নিজ কৌতূহলনিবৃত্তি করিয়াছে; চিরহিমানীমণ্ডিত পর্বত ও সাগরপারে গমনপূর্বক সে ঐসকল প্রদেশের যথাযথ রহস্য-অবলোকনে সমর্থ হইয়াছে; পৃথিবীস্থ ক্ষুদ্র ও বৃহৎ যাবতীয় লতা, ওষধি ও পাদপের ভিতর সে আপনার ন্যায় প্রাণস্পন্দনের পরিচয় পাইয়াছে এবং সর্বপ্রকার প্রাণিজাতকে নিজ প্রত্যক্ষ ও বিচারচক্ষুর অন্তর্ভুক্ত করিয়া জ্ঞানসিদ্ধিরূপ স্বকীয় উদ্দেশ্যে অগ্রসর হইতেছে। ঐরূপে ক্ষিত্যপ্তেজাদি ভূতপঞ্চের উপর আধিপত্য স্থাপনপূর্বক সে এখন জড়া পৃথিবীর প্রায় সমস্ত কথা জানিয়া লইয়াছে এবং তাহাতেও সন্তুষ্ট না থাকিয়া সুদূরাবস্থিত গ্রহনক্ষত্রাদির সম্যক সংবাদ লইবার জন্য উদ্গ্রীব হইয়া ক্রমে উহাতেও কৃতকার্য হইতেছে। অন্তর্জগৎ-পরিদর্শনেও তাহার উদ্যমের অভাব লক্ষিত হইতেছে না। ভূয়োদর্শন এবং গবেষণা-সহায়ে ঐ ক্ষেত্রেও মানব নূতন তত্ত্বসকল এখন নিত্য আবিষ্কার করিতেছে। জীবনরহস্য অনুশীলন করিতে যাইয়া সে একজাতীয় প্রাণীর অন্য জাতিত্বে পরিণতির বা ক্রমাভিব্যক্তির কথা জানিতে পারিয়াছে; শরীর ও মনের স্বভাব আলোচনাপূর্বক আদ্যন্তবান সূক্ষ্ম জড়োপাদানে মনের গঠনরূপে তত্ত্ব-নির্ণয়ে সক্ষম হইয়াছে; জড়জগতের ন্যায় অন্তর্জগতের প্রত্যেক ঘটনা অলঙ্ঘ্য নিয়মসূত্রে গ্রথিত বলিয়া জানিতে পারিয়াছে এবং আত্মহত্যাদি অসম্বদ্ধ মানসিক ব্যাপারসকলের মধ্যেও সূক্ষ্ম নিয়মশৃঙ্খলের পরিচয় পাইয়াছে। আবার ব্যক্তিগত জীবনের চিরাস্তিত্ব সম্বন্ধে কোনরূপ নিশ্চয় প্রমাণলাভে সমর্থ না হইলেও, ইতিহাসালোচনায় মানব তাহার জাতিগত জীবনের ক্রমোন্নতি প্রত্যক্ষ করিয়াছে। ব্যক্তিগত জীবনের সার্থকতা ঐরূপে জাতিগত জীবনে দেখিতে পাইয়া সে এখন উহার সাফল্যের জন্য বিজ্ঞান ও সংহতচেষ্টা-সহায়ে অজ্ঞানের সহিত চিরসংগ্রামে নিযুক্ত হইয়াছে এবং অনন্ত সংগ্রামে অনন্ত উন্নতি কল্পনাপূর্বক বহিরন্তর-রাজ্যের দুর্লক্ষ্য প্রদেশসমূহে পৌঁছিবার জন্য অনন্ত বাসনাপ্রবাহে আপন জীবনতরী ভাসাইয়া দিয়াছে।

ঐ উন্নতি ও শক্তির কেন্দ্র পাশ্চাত্ত্য হইতে প্রাচ্যে ভাববিস্তার

পাশ্চাত্ত্য মানবকে অবলম্বন করিয়া পূর্বোক্ত জীবন-প্রসার বিশেষভাবে উদিত হইলেও ভারতপ্রমুখ প্রাচ্যদেশসকলেও উহার প্রভাব স্বল্প লক্ষিত হইতেছে না। বিজ্ঞানের অদম্য শক্তিতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য প্রদেশ প্রতিদিন যত নিকট সম্বন্ধে সম্বদ্ধ হইতেছে, প্রাচ্য মানবের প্রাচীন জীবনসংস্কারসমূহ ততই পরিবর্তিত হইয়া পাশ্চাত্ত্য মানবের ভাবে গঠিত হইয়া উঠিতেছে। পারস্য, চীন, জাপান, ভারত প্রভৃতি দেশসমূহের বর্তমান অবস্থার আলোচনায় ঐ কথা বুঝিতে পারা যায়। ফলাফল ভবিষ্যতে যেরূপই হউক না কেন, প্রাচ্যের উপর পাশ্চাত্ত্যের ঐরূপে ভাববিস্তার সম্বন্ধে কোনই সন্দেহ থাকে না, এবং সমগ্র পৃথিবীর কালে পাশ্চাত্ত্যভাবে ভাবিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী বলিয়া বোধ হইয়া থাকে।

পাশ্চাত্ত্য মানবের জীবন দেখিয়া ঐ উন্নতির ভবিষ্যৎ ফলাফল নির্ণয় করিতে হইবে

পূর্বোক্ত প্রসারের ফলাফল নির্ণয় করিতে হইলে আমাদিগকে পাশ্চাত্ত্যকেই প্রধানতঃ অবলম্বন করিতে হইবে। বিচারসহায়ে পাশ্চাত্ত্য মানবের জীবন বিশ্লেষণ করিয়া দেখিতে হইবে – ঐ প্রসারের মূল কোথায় এবং উহা কীদৃশ স্বভাববিশিষ্ট, উহার প্রভাবে পাশ্চাত্ত্য জীবনের পূর্বতন উত্তমাধম ভাবসকলের কতদূর উন্নতি ও বিলোপ সাধিত হইয়াছে এবং উহার ফলে পাশ্চাত্ত্যে ব্যক্তিগত মানবমনে সুখ ও দুঃখ পূর্বাপেক্ষা কত অধিক বা অল্প পরিমাণে উপস্থিত হইয়াছে। ঐরূপে ব্যষ্টি ও সমষ্টিভূত পাশ্চাত্ত্য-জীবনে উহার ফলাফল একবার নির্ণীত হইলে, দেশকালভেদে ঐ বিষয় অন্যত্র নির্ণয় করা কঠিন হইবে না।

পাশ্চাত্ত্য মানবের উন্নতির কারণ ও ইতিহাস

ইতিহাস স্পষ্টাক্ষরে নির্দেশ করিতেছে, দুঃসহ শীতের প্রকোপ অতি প্রাচীনকাল হইতে পাশ্চাত্ত্য মানবমনে দেহবুদ্ধির দৃঢ়তা আনয়ন করিয়া তাহাকে একদিকে যেমন স্বার্থপর করিয়া তুলিয়াছিল, অপরদিকে তেমনি আবার সংহত চেষ্টায় স্বার্থসিদ্ধি – একথা সহজেই বুঝাইয়া উহাতে স্বজাতিপ্রীতির আবির্ভাব করিয়াছিল। ঐ স্বার্থপরতা এবং স্বজাতিপ্রীতিই তাহাকে, কালে অদম্য উৎসাহে অপর জাতিসকলকে পরাজিত করিয়া তাহাদিগের ধনসম্পদে নিজ জীবন ভূষিত করিতে প্ররোচিত করে। উহার ফলে যখন সে নিজ জীবনযাত্রার কতকটা সুসার করিতে পারিল, তখনই তাহাতে ধীরে ধীরে অন্তর্দৃষ্টির আবির্ভাব হইয়া তাহাকে ক্রমে বিদ্যা ও সদ্গুণ-সম্পন্ন হইতে প্রবৃত্ত করিল। ঐরূপে জীবনসংগ্রাম ভিন্ন উচ্চ বিষয়সকলে তাহার দৃষ্টি আকৃষ্ট হইবামাত্র সে দেখিতে পাইল – ঐ লক্ষ্যে অগ্রসর হইবার পথে ধর্মবিশ্বাস এবং পুরোহিতকুলের প্রাধান্য তাহার অন্তরায়স্বরূপে দণ্ডায়মান। দেখিল, বিদ্যাশিক্ষায় শ্রীভগবানের অপ্রসন্নতালাভে অনন্তনিরয়গামী হইতে হইবে, কেবলমাত্র ইহা বলিয়াই পুরোহিতকুল নিশ্চিন্ত নহেন; কিন্তু ছলে বলে কৌশলে তাহাকে ঐ পথে অগ্রসর হইতে বাধা প্রদান করিতে বদ্ধপরিকর। তখন স্বার্থসাধন-তৎপর পাশ্চাত্ত্য মানবের কর্তব্য-নির্ধারণে বিলম্ব হইল না। সবলহস্তে পুরোহিতকে দূরে নিক্ষেপ করিয়া সে আপন গন্তব্যপথে অগ্রসর হইল। ঐরূপে ধর্মযাজকের সহিত শাস্ত্র ও ধর্মবিশ্বাসকে দূরে পরিহার করিয়া পাশ্চাত্ত্য নবীন পথে নিজ জীবন পরিচালিত করে; এবং পঞ্চেন্দ্রিয়গ্রাহ্যতারূপ নিশ্চিত প্রমাণপ্রয়োগ না করিয়া কোন বিষয় কখন বিশ্বাস বা গ্রহণ করিবে না, ইহাই তাহার নিকট মূলমন্ত্র হইয়া উঠে।

ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষের উপর দণ্ডায়মান হইয়া বিচারানুমানাদিপূর্বক বিষয়-বিশেষের সত্যাসত্য নিরূপণ করিতে হইবে, ইহা নিশ্চয় করিয়া পাশ্চাত্ত্য এখন হইতে যুষ্মদ্প্রত্যয়গোচর বিষয়ের উপাসক হইয়া পড়ে এবং অস্মদ্প্রত্যয়গোচর বিষয়ীকে বিষয়সকলের মধ্যে অন্যতম ভাবিয়া উহার স্বভাবাদিও পূর্বোক্ত প্রমাণপ্রয়োগে জানিতে অগ্রসর হয়। গত চারিশত বৎসর সে ঐরূপে জাগতিক প্রত্যেক ব্যক্তি বা বিষয়কে পঞ্চেন্দ্রিয়সহায়ে পরীক্ষাপূর্বক গ্রহণ করিতে আরম্ভ করিয়াছে এবং ঐ কালের ভিতরেই বর্তমান যুগের জড়বিজ্ঞান শৈশবের জড়তা এবং অসহায়তা হইতে মুক্ত হইয়া যৌবনের উদ্যম, আশা, আনন্দ ও বলোন্মত্ততায় উপস্থিত হইয়াছে।

আত্মবিজ্ঞান সম্বন্ধে পাশ্চাত্ত্য মানবের মূর্খতা উহার কারণ; এবং ঐজন্য তাহার মনের অশান্তি

কিন্তু জড়বিজ্ঞানের সবিশেষ উন্নতিসাধন করিতে পারিলেও, পূর্বোক্ত নীতি আত্মবিজ্ঞানসম্বন্ধে পাশ্চাত্ত্যকে পথ দেখাইতে পারে নাই। কারণ সংযম, স্বার্থহীনতা এবং অন্তর্মুখতাই ঐ বিজ্ঞানলাভের একমাত্র পথ এবং নিরুদ্ধবৃত্তি মনই আত্মোপলব্ধির একমাত্র যন্ত্র। অতএব, বহির্মুখ পাশ্চাত্ত্যের ঐ বিষয়ে পথ হারাইয়া দিন দিন দেহাত্মবাদী নাস্তিক হইয়া উঠায় কিছুমাত্র আশ্চর্য নাই। সেজন্য ঐহিকের ভোগসুখই পাশ্চাত্ত্যের নিকট এখন সর্বস্বরূপে পরিগণিত এবং তল্লাভেই সে সবিশেষ যত্নশীল; এবং তাহার বিজ্ঞানলব্ধ পদার্থজ্ঞান ঐ বিষয়েই প্রধানতঃ প্রযুক্ত হইয়া তাহাকে দিন দিন দাম্ভিক ও স্বার্থপর করিয়া তুলিয়াছে। ঐজন্যই দেখিতে পাওয়া যায়, পাশ্চাত্ত্যে সুবর্ণগত জাতিবিভাগ, প্রলয়বিষাণনাদী করাল কামানবন্দুকাদি, অসামান্য শ্রীর পার্শ্বে দারিদ্র্যজাত অসীম অসন্তোষ এবং ভীষণ ধনপিপাসা, পরদেশাধিকার ও পরজাতি-প্রপীড়নাদি। ঐজন্যই আবার দেখিতে পাওয়া যায়, ভোগসুখের চরমে উপস্থিত হইয়াও পাশ্চাত্ত্য নরনারীর আত্মার অভাব ঘুচিতেছে না এবং মৃত্যুর পারে জাতিগত অস্তিত্বে বিশ্বাসমাত্র-অবলম্বনে তাহারা কিছুতেই সুখী হইতে পারিতেছে না। বিশেষ অনুসন্ধানের ফলে পাশ্চাত্ত্য এখন বুঝিয়াছে যে, পঞ্চেন্দ্রিয়জনিত জ্ঞান তাহাকে দেশকালাতীত বস্তুতত্ত্বাবিষ্কারে কখন সমর্থ করিবে না। বিজ্ঞান তাহাকে ঐ বস্তুর ক্ষণিক আভাসমাত্র প্রদানপূর্বক উহাকে ধরা বুঝা তাহার সাধ্যাতীত বলিয়া নিবৃত্ত হয়। অতএব যে দেবতার বলে সে আপনাকে এতকাল বলীয়ান ভাবিয়াছিল, যাঁহার প্রসাদে তাহার যাবতীয় ভোগশ্রী ও সম্পদ, সেই দেবতার পরাভবে পাশ্চাত্ত্য মানবের আন্তরিক হাহাকার এখন দিন দিন বর্ধিত হইতেছে এবং আপনাকে সে নিতান্ত নিরুপায় ভাবিতেছে।

পাশ্চাত্ত্যের ন্যায় উন্নতিলাভ করিতে হইলে স্বার্থপর ও ভোগলোলুপ হইতে হইবে

পাশ্চাত্ত্য জীবনের পূর্বোক্ত ইতিহাসালোচনায় আমরা দেখিতে পাইতেছি যে, উহার প্রসারভিত্তির মূলে বিষয়প্রবণতা, স্বার্থপরতা এবং ধর্মবিশ্বাসরাহিত্য বিদ্যমান। অতএব ব্যক্তিগত বা জাতিগত জীবনে পাশ্চাত্ত্যের অনুরূপ ফললাভ করিতে হইলে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অপরকে ঐ ভিত্তির উপরেই নিজ জীবন প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। সেজন্য দেখিতে পাওয়া যায়, জাপানী প্রভৃতি যে-সকল প্রাচ্য জাতি পাশ্চাত্ত্যের ভাবে জাতীয় জীবনগঠনে তৎপর হইয়াছে, স্বদেশ ও স্বজাতিপ্রীতির সহিত তাহাদিগের মধ্যে পূর্বোক্ত দোষসকলেরও আবির্ভাব হইতেছে। পাশ্চাত্ত্যভাবে ভাবিত হওয়ার উহাই বিষম দোষ। পাশ্চাত্ত্যসংসর্গে ভারতের জাতীয় জীবনে যে অবস্থার উদয় হইয়াছে, তাহার অনুশীলনে ঐ কথা আমরা স্পষ্ট বুঝিতে পারিব।

ভারতের প্রাচীন জাতীয় জীবনের ভিত্তি

এখানে প্রথমেই প্রশ্ন উঠিবে – পাশ্চাত্ত্যসংসর্গে আসিবার পূর্বে ‘জাতীয় জীবন’ বলিয়া একটা কথা ভারতে বিদ্যমান ছিল কি না। উত্তরে বলিতে হইবে, কথা না থাকিলেও ঐ কথার লক্ষ্য যাহা, তাহা যে একভাবে ছিল তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই। কারণ, তখনও সমগ্র ভারত শ্রীগুরু, গঙ্গা, গায়ত্রী ও গীতায় শ্রদ্ধাপরায়ণ ছিল, তখনও গোকুলের পূজা উহার সর্বত্র লক্ষিত হইত, তখনও ভারতের আবালবৃদ্ধনরনারী রামায়ণ ও মহাভারতাদি ধর্মগ্রন্থসকল হইতে একই ভাবতরঙ্গ হৃদয়ে বহন করিয়া জীবন পরিচালিত করিত এবং উহার বিভিন্ন বিভাগের বুধমণ্ডলী আপন আপন মনোভাব দেবভাষায় পরস্পরের নিকটে ব্যক্ত করিতে সমর্থ হইতেন। ঐরূপ আরও অনেক একতাসূত্রে উল্লেখ করা যাইতে পারে এবং ধর্মভাব ও ধর্মানুষ্ঠান যে ঐ একতার শ্রেষ্ঠ অবলম্বন ছিল, একথা নিঃসংশয়ে বুঝিতে পারা যায়।

উহা ধর্মে প্রতিষ্ঠিত ছিল বলিয়া ভোগ-সাধন লইয়া ভারতের সমাজে কখন বিবাদ উপস্থিত হয় নাই

ভারতের জাতীয় জীবন ঐরূপে ধর্মাবলম্বনে প্রতিষ্ঠিত ছিল বলিয়া উহার সভ্যতা এক অপূর্ব বিভিন্ন উপাদানে গঠিত হইয়াছিল। এক কথায় বলিতে হইলে, সংযমই ঐ সভ্যতার প্রাণস্বরূপ ছিল। ব্যক্তি এবং জাতি উভয়কেই ভারত সংযমসহায়ে নিজ নিজ জীবন নিয়মিত করিতে শিক্ষা প্রদান করিত। ত্যাগের জন্য ভোগের গ্রহণ এবং পরজীবনের জন্য এই জীবনের শিক্ষা – একথা সকলকে সর্বাবস্থায় স্মরণ করাইয়া ব্যক্তি ও জাতির ব্যবহারিক জীবন সে সর্বদা উচ্চতম লক্ষ্যে পরিচালিত করিত। সেজন্যই উহার বর্ণ বা জাতিবিভাগ এতকাল পর্যন্ত কোন শ্রেণীর স্বার্থে আঘাত করিয়া তাহাদিগের বিষম অসন্তোষের কারণ হয় নাই। কারণ, সমাজের যে শ্রেণী বা স্তরে মানব জন্ম গ্রহণ করিয়াছে, সেই স্তরের কর্তব্য নিষ্কামভাবে করিতে পারিলেই সে যখন অন্যের সহিত সমভাবে মানব-জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য জ্ঞান ও মুক্তির অধিকারী হইবে, তখন তাহার অসন্তোষের কারণ আর কি হইতে পারে? শ্রেণীবিশেষের ভোগসুখের তারতম্যকে অধিকার করিয়া পাশ্চাত্ত্যসমাজের ন্যায় ভারতের সমাজে যে প্রাচীনকালে বিরোধ উপস্থিত হয় নাই, তাহার কারণ – জীবনের উচ্চতম লক্ষ্যে সমাজস্থ প্রত্যেক ব্যক্তির সমানাধিকার ছিল বলিয়া। প্রাচীন ভারতের জাতীয় জীবন সম্বন্ধে পূর্বোক্ত কথাগুলি স্মরণে রাখিয়া দেখা যাউক, পাশ্চাত্ত্য-সংসর্গে উহার জীবনে কীদৃশ পরিবর্তনসকল এখন উপস্থিত হইয়াছে।

পাশ্চাত্ত্যের ভারতাধিকার ও তাহার ফল

পাশ্চাত্ত্যের ভারতাধিকারের দিন হইতে ভারতের জাতীয় ধনবিভাগপ্রণালীতে যে একটা বিশেষ পরিবর্তন উপস্থিত হইবে, ইহা স্বাভাবিক এবং অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু ভারতের জাতীয় জীবনের ঐ ভাগ মাত্র পরিবর্তিত করিয়াই পাশ্চাত্ত্যপ্রভাব নিবৃত্ত হয় নাই। প্রাচীনকাল হইতে যে-সকল মূল সংস্কার লইয়া ভারত-ভারতী ব্যক্তি ও জাতিগত জীবন পরিচালিত করিতেছিল, সেই সকলের মধ্যে ঐ প্রভাব এক অপূর্ব ভাবপরিবর্তন উপস্থিত করিল। পাশ্চাত্ত্য বুঝাইল, ত্যাগের জন্য ভোগ – একথা পুরোহিতকুলের স্বার্থ-সিদ্ধির জন্য উদ্ভূত হইয়াছে। পরজীবনের ও আত্মার অস্তিত্বস্বীকার এক প্রকাণ্ড কবিকল্পনা; সমাজের যে স্তরে মানব জন্মগ্রহণ করিয়াছে, সেই স্তরেই সে আমরণ নিবদ্ধ থাকিবে – ইহা অপেক্ষা অযুক্তিকর, অন্যায় নিয়ম আর কি হইতে পারে? ভারতও ক্রমে তাহাই বুঝিল এবং ত্যাগ ও সংযম-প্রধান পূর্ব জীবন-লক্ষ্য পরিত্যাগ করিয়া অধিকতর ভোগলাভের জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিল। ঐরূপে উহাতে পূর্ব শিক্ষাদীক্ষার লোপ হইল এবং নাস্তিক্য, পরানুকরণপ্রিয়তা ও আত্মবিশ্বাসরাহিত্যের উদয় হইয়া উহাকে মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর তুল্য নিতান্ত নির্বীর্য করিয়া তুলিল। ভারত বুঝিল, সে এতকাল ধরিয়া যাহা হৃদয়ে বহন করিয়া যত্নে অনুষ্ঠান করিয়াছে, তাহা নিতান্ত ভ্রমসঙ্কুল; বিজ্ঞানবলে বলীয়ান পাশ্চাত্ত্য তাহার সংস্কারসমূহকে অমার্জিত ও অর্ধবর্বর বলিয়া যেরূপ নির্দেশ করিতেছে, তাহাই বোধ হয় সত্য। ভোগলালসামুগ্ধ ভারত নিজ পূর্বেতিহাস ও পূর্বগৌরব বিস্মৃত হইল। স্মৃতিভ্রংশ হইতে তাহার বুদ্ধিনাশ উপস্থিত হইল এবং উহা তাহার জাতীয় অস্তিত্বের বিলোপসাধন করিবার উপক্রম করিল। আবার ঐহিক ভোগলাভের জন্য তাহাকে এখন হইতে পরমুখাপেক্ষী হইয়া থাকিতে হওয়ায় উহার লাভও তাহার ভাগ্যে দূরপরাহত হইল। ঐরূপে যোগ ও ভোগ উভয় মার্গ হইতে ভ্রষ্ট হইয়া কর্ণধারশূন্য তরণীর ন্যায় সে পরানুকরণ করিয়া বাসনাবাত্যাভিমুখে যথা-ইচ্ছা পরিভ্রমণ করিতে লাগিল।

পাশ্চাত্ত্যভাবসহায়ে নির্জীব ভারতকে সজীব করিবার চেষ্টা ও তাহার ফল

তখন চারিদিক হইতে রব উঠিল, ভারতের জাতীয় জীবন কোনকালেই ছিল না। পাশ্চাত্ত্যের কৃপায় এতদিনে তাহার ঐ জীবনের উন্মেষ হইতেছে, কিন্তু উহার পূর্ণবিকাশের পথে এখনও অনেক অন্তরায় বিদ্যমান। ঐ যে উহার দুর্নিবার্য ধর্মসংস্কার, উহাই উহার সর্বনাশ করিয়াছে। ঐ যে অসংখ্য দেবদেবীর পূজা – ঐ পৌত্তলিকতাই তাহাকে এতদিন উঠিতে দেয় নাই। উহার বিনাশ কর, উচ্ছেদ কর, তবেই ভারত-ভারতী সজীব হইয়া উঠিবে। ঈশাহি ধর্ম এবং তদনুকরণে একেশ্বরবাদ প্রচারিত হইতে লাগিল। পাশ্চাত্ত্যানুকরণে সভা-সমিতি গঠিত হইয়া প্রাণহীন ভারতকে রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, বিধবাবিবাহ ও স্ত্রী-স্বাধীনতার উপকারিতা প্রভৃতি নানা কথা শ্রবণ করান হইল – কিন্তু তাহার অভাববোধ ও হাহাকার নিবৃত্ত না হইয়া প্রতিদিন বর্ধিত হইতে লাগিল। রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ, পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার যত কিছু সাজসরঞ্জাম একে একে ভারতে উপস্থিত করা হইল, কিন্তু বৃথা চেষ্টা – যে ভাবপ্রেরণায় ভারত সজীব ছিল, তাহার অনুসন্ধান এবং পুনঃপ্রবর্তনের চেষ্টা ঐ সকলে কিছুমাত্র হইল না। ঔষধ যথাস্থানে প্রযুক্ত হইল না, রোগের উপশম হইবে কিরূপে? ধর্মপ্রাণ ভারতের ধর্ম সজীব না হইলে সে সজীব হইবে কিরূপে? পাশ্চাত্ত্যের ভাবপ্রসারে তাহাতে যে ধর্মগ্লানি উপস্থিত হইয়াছে, নাস্তিক পাশ্চাত্ত্যের তাহা দূর করিবার সামর্থ্য কোথায়? স্বয়ং অসিদ্ধ হইয়া পাশ্চাত্ত্য অপরকে সিদ্ধ করিবে কিরূপে?

ভারতের প্রাচীন জাতীয় জীবনের দোষগুণ-বিচার

পাশ্চাত্ত্যাধিকারের পূর্বে ভারতের জাতীয় জীবনে যে কিছুমাত্র দোষ ছিল না, একথা বলা যায় না। কিন্তু জাতীয় শরীর সজীব থাকায় ঐ দোষনিবারণের স্বতঃপ্রবৃত্ত চেষ্টাও উহাতে সর্বদা লক্ষিত হইত। জাতি এবং সমাজের ভিতর এখন সেই চেষ্টার বিলোপ দেখিয়া বুঝিতে হইবে, পাশ্চাত্ত্যভাব-প্রসাররূপ ঔষধ-প্রয়োগ রোগের সহিত রোগীকেও সরাইতে বসিয়াছে!

পাশ্চাত্ত্যভাব-বিস্তারে ভারতের বর্তমান ধর্মগ্লানি

অতএব দেখা যাইতেছে, পাশ্চাত্ত্যের ধর্মগ্লানি ভারতেও অধিকার বিস্তার করিয়াছে। বাস্তবিক ঐ গ্লানি বর্তমানকালে পৃথিবীর সর্বত্র কতদূর প্রবল হইয়াছে, তাহা ভাবিলে স্তম্ভিত হইতে হয়। ধর্ম বলিয়া যদি কোন বাস্তব পদার্থ থাকে এবং বিধাতার নির্দেশে তল্লাভ যদি মানবের সাধ্যায়ত্ত হয়, তাহা হইলে বর্তমান যুগের ভোগপরায়ণ মানবজীবন যে উহা হইতে বহুদূরে বিচ্যুত হইয়া পড়িয়াছে, একথা নিঃসন্দেহ। বিজ্ঞান-সহায়ে মানবের বর্তমান জীবন-প্রসার মানবকে বিচিত্র ভোগসাধনলাভে সমর্থ করিলেও, তাহাকে যে শান্তির অধিকারী করিতে পারিতেছে না, তাহা ঐজন্য। কে উহার প্রতিকার করিবে? পৃথিবীর ঐ অশান্তি ও হাহাকার কাহার প্রাণে নিরন্তর ধ্বনিত হইয়া তাহাকে সর্বভোগসাধন উপেক্ষাপূর্বক যুগোপযোগী নূতন ধর্মপথাবিষ্কারে প্রযুক্ত করিবে? প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্যের ধর্মগ্লানি দূর করিয়া শান্তিময় নূতন পথে জীবন পরিচালিত করিতে মানবকে পুনরায় কে শিক্ষা প্রদান করিবে?

ঐ গ্লানি-নিবারণের জন্য ঈশ্বরের পুনরায় অবতীর্ণ হওয়া

গীতামুখে শ্রীভগবান প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, জগতে ধর্মগ্লানি উপস্থিত হইলেই তিনি নিজ মায়াশক্তি অবলম্বনপূর্বক শরীরধারিরূপে প্রকাশিত হইবেন এবং ঐ গ্লানি দূর করিয়া পুনরায় মানবকে শান্তির অধিকারী করিবেন। বর্তমান যুগ-প্রয়োজন কি তাঁহার করুণায় বিষম উত্তেজনা আনয়ন করিবে না? বর্তমান অভাববোধ ও অশান্তি কি তাঁহাকে শরীরপরিগ্রহ করিতে প্রযুক্ত করিবে না?

হে পাঠক! যুগ-প্রয়োজন ঐ কার্য সম্পন্ন করিয়াছে – শ্রীভগবান জগদ্গুরুরূপে সত্য সত্যই পুনরায় আবির্ভূত হইয়াছেন। আশ্বস্তহৃদয়ে শ্রবণ কর, তাঁহার পূত আশীর্বাণী – “যত মত তত পথ”, “সর্বান্তঃকরণে যাহাই অনুষ্ঠান করিবে, তাহা হইতেই তুমি শ্রীভগবানকে লাভ করিবে।” মুগ্ধ হইয়া মনন কর – পরাবিদ্যা পুনরানয়নের জন্য তাঁহার অলৌকিক ত্যাগ ও তপস্যা! – এবং তাঁহার কামগন্ধহীন পুণ্যচরিত্রের যথাসাধ্য আলোচনা ও ধ্যান করিয়া আইস, আমরা উভয়ে পবিত্র হই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *