2 of 11

১০.০৪ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রীরাধার ভাব

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১লা জানুয়ারি

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রীরাধার ভাব

ঠাকুর দক্ষিণ-পূর্ব বারান্দায় আসিয়া বসিয়াছেন। প্রাণকৃষ্ণাদি ভক্তগণও সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছেন। হাজরা মহাশয় বারান্দায় বসিয়া আছেন। ঠাকুর হাসিতে হাসিতে প্রাণকৃষ্ণকে বলিতেছেন —

“হাজরা একটি কম নয়। যদি এখানে বড় দরগা হয়, তবে হাজরা ছোট দরগা।” (সকলের হাস্য)

বারান্দার দরজায় নবকুমার আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। ভক্তদের দেখিয়াই চলিয়া গেলেন। ঠাকুর বলিতেছেন, “অহংকারের মূর্তি”।

বেলা সাড়ে নয়টা হইয়াছে। প্রাণকৃষ্ণ প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন — কলিকাতার বাটীতে ফিরিয়া যাইবেন।

একজন বৈরাগী গোপীযন্ত্রে ঠাকুরের ঘরে গান করিতেছেন:

নিত্যানন্দের জাহাজ এসেছে।
তোরা পারে যাবি তো ধর এসে ৷৷

ছয় মানোয়ারি গোরা, তারা দেয় সদা পারা,
বুক পিঠে তার ঢাল খাঁড়া ঘেরা।

তারা সদর দুয়ার আলগা করে রত্নমাণিক বিলাচ্ছে।

গান —      এই বেলা নে ঘর ছেয়ে।

এবারে বর্ষা ভারি, হও হুঁশিয়ারি, লাগো আদা জল খেয়ে।

যখন আসবে শ্রবণা, দেখতে দেবে না।
বাঁশ বাখারি পচে যাবে, ঘর ছাওয়া হবে না।

যেমন আসবে ঝটকা, উড়বে মটকা, মটকা জাবে ফাঁক হয়ে।

(তুমিও যাবে হাঁ হয়ে)।

গান —      কার ভাবে নদে এসে, কাঙাল বেশে, হরি হয়ে বলছি হরি।

কার ভাবে ধরেছ ভাব, এমন স্বভাব, তাও তো কিছু বুঝতে নারি।

ঠাকুর গান শুনিতেছেন, এমন সময় শ্রীযুক্ত কেদার চাটুজ্যে আসিয়া প্রণাম করিলেন। তিনি আফিসের বেশ পরিয়া আসিয়াছেন, চাপকান, ঘড়ি, ঘড়ির চেন। কিন্তু ঈশ্বরের কথা হইলেই তিনি চক্ষের জলে ভাসিয়া যান। অতি প্রেমিক লোক। অন্তরে গোপীর ভাব।

কেদারকে দেখিয়া ঠাকুরের একেবারে শ্রীবৃন্দাবনলীলা উদ্দীপন হইয়া গেল। প্রেমে মাতোয়ারা হইয়া দণ্ডায়মান হইলেন ও কেদারকে সম্বোধন করিয়া গান গাহিতেছেন:

সখি, সে বন কতদূর।

(যথা আমার শ্যামসুন্দর) (আর চলিতে যে নারি)

শ্রীরাধার ভাবে গান গাইতে গাইতে ঠাকুর সমাধিস্থ। চিত্রার্পিতের ন্যায় দণ্ডায়মান। কেবল চক্ষের দুই কোণ দিয়া আনন্দাশ্রু পড়িতেছে।

কেদার ভূমিষ্ঠ। ঠাকুরের চরণ স্পর্শ করিয়া স্তব করিতেছেন:

হৃদয়কমলমধ্যে নির্বিশেষং নিরীহম্‌।
হরিহরবিধিবেদ্যং যোগিভির্ধ্যানগম্যম্‌ ৷৷
জননমরণভীতিভ্রংশি সচ্চিৎ স্বরূপম্‌।
সকল ভুবনবীজং ব্রহ্মচৈতন্যমীড়ে ৷৷

কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ প্রকৃতিস্থ হইতেছেন। কেদার নিজ বাটী হালিসহর হইতে কলিকাতায় কর্মস্থলে যাইবেন। পথে দক্ষিণেশ্বর কালী-মন্দিরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিয়া যাইতেছেন। একটু বিশ্রাম করিয়া কেদার বিদায় গ্রহণ করিলেন।

এইরূপে ভক্তসঙ্গে কথা কহিতে কহিতে বেলা প্রায় দু-প্রহর হইল। শ্রীযুক্ত রামলাল ঠাকুরের জন্য থালা করিয়া মা-কালীর প্রসাদ আনিয়া দিলেন। ঘরের মধ্যে ঠাকুর দক্ষিণাস্য হইয়া আসনে বসিলেন ও প্রসাদ পাইলেন। আহার বালকের ন্যায় — একটু একটু সব মুখে দিলেন।

আহারান্তে ঠাকুর ছোট খাটটিতে একটু বিশ্রাম করিতেছেন। কিয়ৎক্ষণ পরে মারোয়াড়ী ভক্তেরা আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *