1 of 2

২৮. নবী (সা)-এর মদীনায় প্রবেশ ও তাঁর অবস্থান-স্থল

নবী (সা)-এর মদীনায় প্রবেশ ও তাঁর অবস্থান-স্থল

যুহরী সূত্রে উরওয়া থেকে ইতোপূর্বে বুখারীর বর্ণনা উল্লিখিত হয়েছে যে, নবী করীম (সা) দুপুরে মদীনায় প্রবেশ করেছিলেন। গ্রন্থকার বলেন, : হয়তো এটা দুপুরের পর হয়ে থাকবে।

কারণ, হিজরতের হাদীছ বুখারী-মুসলিমের বর্ণনায় ইসরাঈল সূত্রে আবু বকর (রা)-এর বর্ণনায় আছে : আবু বকর (রা) বলেন :

১. মূল কপিতে ‘নূন” যোগে ৫-১৭< ১ (রকুনা) লিখা হয়েছে, যা ভুল। আর ‘রকুবা মক্কা-মদীনার মধ্যস্থলে

“আল-আরাজ’ নামক স্থানের কাছে “ওয়ারকান’ পর্বতের কাছে একটা ঘাটির নাম।

আমরা রাত্রি-বেলা (মদীনায়) উপস্থিত হই। তখন আনসারদের মধ্যে বিরোধ বাধে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) কার গৃহে অবতরণ করবেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, : আবদুল মুত্তালিবের মাতুলকুল বনু নাজ্জারে অবস্থান করবো তাদের সম্মানার্থে। আল্লাহই ভাল জানেন। এটা হয়তো ছিল তার কুবায় উপস্থিতির দিন দুপুরে যখন তিনি মদীনার কাছাকাছি পৌছেন এবং খেজুর গাছের ছায়ায় অবস্থান করে পরে মুসলমানদেরকে নিয়ে রওনা হন এবং কুবায় রাত্রি যাপন করেন। আর এখানে দুপুরের পরকে রাত্রি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা, দুপুরের পর থেকেই বিকালের সূচনা হয়। অথবা এর অর্থ এই যে, কুবা থেকে রওনা হন দিনের বেলা এবং বনু নাজ্জারে পৌছেন রাত ইশার সময়। এ সম্পর্কে পরে আলোচনা আসছে।

ইমাম বুখারী যুহরী সূত্রে উরওয়া থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) কুবায় বনু আমর ইবন আওফের নিকট অবস্থান করেন। দশ রাত্রির চাইতে কিছু বেশী এবং এ সময় তিনি কুবায় মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। এরপর তিনি সওয়ার হন এবং তাঁর সঙ্গে লোকজনকে নিয়ে রওনা হন। শেষ পর্যন্ত তার মসজিদের স্থানে সওয়ারী বসে পড়ে। এ স্থানটি ছিল সহিল এবং সুহায়ল নামে দু’জন ইয়াতীমের খেজুর শুকাবার স্থান। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের নিকট থেকে স্থানটা ক্রয় করে সেখানে মসজিদ নির্মাণ করান। আর এ ছিল বনী নাজারের মহল্লায়। তাদের সকলের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হোন।

আর মুহাম্মদ ইবন ইসহাক মুহাম্মদ ইবন জাফর সূত্রে নবী করীম (সা)-এর একদল সাহাবীর বরাতে বলেন যে, তারা বলেছেন : আমরা যখন মক্কা থেকে নবী করীম (সা)–এর বের হওয়ার খবর জানতে পারলাম তখন আমরা তাঁর আগমনের অপেক্ষায় থাকলাম। ফজরের নামায আদায় করার পর হাররা র’ বাইরে আমরা নবী করীম (সা)-এর অপেক্ষায় থাকতাম। আল্লাহর কসম, সূৰ্যতাপ আমাদের অসহ্য না হওয়া পর্যন্ত আমরা ছায়ায় বসে থাকতাম। ছায়া না পেলে আমরা ফিরে যেতাম। আর এটা ছিল গ্ৰীষ্মের মওসুম। এমনকি যেদিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) আগমন করেন, সেদিন যখন এলো সেদিনও আমরা অন্যান্য দিনের মত বসে ছিলাম। যখন। কোন ছায়াই আর অবশিষ্ট থাকলো না তখন আমরা নিজ নিজ গৃহে ফিরে গেলাম। আর আমরা যখন ঘরে প্রবেশ করি, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) মদীনায় প্রবেশ করেন। জনৈক ইয়াহুদী ব্যক্তি তাকে সকলের আগে দেখতে পায়। সে উচ্চকণ্ঠে চিৎকার দিয়ে বলে, হে বনু কায়লা (আনসার!) এই যে, তোমাদের কাজ্যিক্ষত ব্যক্তি আগমন করেছেন। আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দিকে ছুটে গেলাম। তিনি তখন খেজুর গাছের ছায়ায় উপবিষ্ট ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আবু বকর (রা)। দু’জনের বয়স প্রায় সমান ছিল। আমাদের অধিকাংশ লোক ইতোপূর্বে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে দেখেনি। তাঁর আশে-পাশে লোকজনের ভিড় হয়ে যায়! আবু বকর আর তার মধ্যে লোকেরা ফারাক করতে পারছিল না। রাসূলুল্লাহ্ (সা) থেকে ছায়া সরে গেলে আবু বকর (রা) তার চাদর দিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে ছায়া দান করেন। এ সময় আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে চিনতে পারি। ইমাম বুখারীর বর্ণনায় ইতোপূর্বে অনুরূপ বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে। মূসা ইবন উকবাও তাঁর মাগাষী গ্রন্থে অনুরূপ উল্লেখ করেছেন।

ইমাম আহমদ হাশিম সূত্রে হযরত আনাস ইবন মালিক-এর রিওয়ায়াত উদধূত করেন : আমি বালকদের মধ্যে ছুটাছুটি করছিলাম। তারা বলছিল— মুহাম্মদ এসেছেন। আমি ছুটে গেলাম। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ্ (সা) আগমন করলেন এবং তাঁর সঙ্গে আবু বকর (রা)। তাঁরা দু’জনে অনাবাদ এলাকায় থেমে যান। এরপর দু’জনে জনৈক বেদুঈনকে প্রেরণ করলেন আনসারকে তাদের আগমনের সংবাদ দেয়ার জন্য। পাচ শতাধিক আনসার ছুটে এসে তাদের দু’জনকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। আনসারগণ তাদের নিকটে এসে বলেন, : আপনারা নিরাপদে এবং আমাদের বরণীয়রূপে চলুন! তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) এবং তাঁর সঙ্গী লোকজনের সাথে এগিয়ে আসেন। মদীনাবাসীরা নিজ নিজ ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। এমনকি কুলশীলা মহিলাগণও ঘরের ছাদে আরোহণ করে তিনি কোন জন? তিনি কোন জন? এমন দৃশ্য আমরা (ইতোপূর্বে) কখনাে দেখিনি। আনাস (রা) বলেন : আমি তাকে দেখি, যেদিন তিনি আমাদের মধ্যে প্রবেশ করেন (অর্থাৎ হিজরতের দিন) এবং তার ইনতিকালের দিনও দেখেছি। এ দু’দিনের অনুরূপ দিন আমি আর কখনো দেখিনি। ইমাম বায়হাকী হাকিম সূত্রে আনাস (রা) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

বুখারী এবং মুসলিম শরীফে ইসরাঈল সূত্রে আবু বকর (রা) থেকে হিজরত প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন :

আমরা মদীনায় আগমন করলে লোকেরা ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসে, গৃহের উপরে উঠে। শিশুরা আর খাদিমরা বলে উঠে :

আল্লাহু আকবার মুহাম্মদ এসেছেন।

আল্লাহু আকবার রাসূলুল্লাহ এসেছেন। সকাল হলে তিনি রওনা করেন— যেমনটি তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ইমাম বায়হাকী আবু আমার আল-আদীিব্য সূত্রে ইবন আইশার বরাতে বলেন :

“আমি ইবন আইশাকে বলতে শুনেছি : রাসূলুল্লাহ্ (সা) মদীনায় আগমন করলে নারী এবং শিশুরা বলে উঠে?

তালা আল বদরু আলাইনা

ওয়াজাবাশ শুকরু। আলাইনা মাদাআ লিল্লাহি দা-ই। “উদিত হয়েছে আমাদের উপর নতুন চাঁদ ওদা পাহাড়ের ঘাটি থেকে,

শোেকর আদায় করা আমাদের কর্তব্য।

যতদিন আহবানকারী আহবান করে (আল্লাহর দিকে)।

ইবন ইসহাক বলেন, : রাসূলুল্লাহ্ (সা) ঐতিহাসিকরা যেমন বর্ণনা করেন, কুবায় কুলছুম ইবন হিন্দম-এর গৃহে অবস্থান করেন। এ কুলছুম। ইবন হিন্দম বনু আমর ইবনু আওফের লোক এবং এটা হচ্ছে বনু উবায়দের শাখা গোত্র। কারো কারো মতে তিনি সাআদ ইবন খায়।ছামার গৃহে অবস্থান করেন। যারা বলেন যে, তিনি কুলছুম। ইবন হিন্দম-এর গৃহে অবস্থান করেন, তারা (এর ব্যাখ্যা হিসাবে এ কথাও) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) কুলছুম। ইবন হিন্দম-এর গৃহ থেকে বের হয়ে লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ দানের জন্য সাআদ ইবন খায়৷ছামার গৃহে বসতেন। আর এটা এজন্যে যে, সাআদ ছিলেন অবিবাহিত। তাঁর পরিবার-পরিজন ছিল না। আর এ কারণে তাঁর গৃহকে বলা হত্যে অবিবাহিতদের নিবাস। আর হযরত আবু বকর (রা) অবস্থান করেন বনু হারিছ ইবন খাযরাজের অন্যতম সদস্য খুবায়ব ইবন ইসাফ-এর গৃহে “সুনহ’ নামক স্থানে। আবার কারো কারো মতে তিনি অবস্থান করেন বনু হারিছ ইবন খাযরাজের খারিজা ইবন যায়দ ইবন আবৃ সুহায়ব-এর গৃহে।।

করেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পক্ষ থেকে যেসব আমানত তাঁর উপর ন্যস্ত ছিল, সে সব ফেরত দেওয়া পর্যন্ত। এরপর তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গে এসে মিলিত হন এবং তাঁর সঙ্গে কুলছুম ইবন হিন্দম এর গৃহে অবস্থান করেন। কাজেই হযরত আলী (রা) কুবায় এক রাত বা দুরাত অবস্থান করেন। হযরত আলী (রা) বলেন যে, কুবায় এক মহিলা ছিল, তার স্বামী ছিল না। মহিলাটি ছিল মুসলমান। আমি দেখতে পাই যে, রাত্ৰিবেলা একজন পুরুষ আগমন করে মহিলার দরজায় আঘাত করতো। পুরুষটির নিকট মহিলাটি বেরিয়ে এলে তাকে কিছু একটা দিতো। আর মহিলা তা গ্রহণ করতো। পুরুষটি সম্পর্কে আমার খারাব ধারণা জন্মে। আমি মহিলাটিকে বললাম, হে আল্লাহর বান্দী। এ লোকটি কে, যে প্রতি রাত্রে তোমার গৃহের দরজায় করাঘাত করে আর তুমি লোকটির নিকট বের হয়ে আস, আর লোকটি তোমাকে কিছু একটা জিনিস দেয়। জানি না, তা কী জিনিস। তুমি তো একজন মুসলিম মহিলা, তোমার স্বামী নেই। মহিলাটি বললো! এ পুরুষটি হলেন সাহল ইবন হানীফ। তিনি জানেন যে, আমি এমন এক নারী যার কেউ নেই। সন্ধ্যায় তিনি গোত্রের মূর্তিগুলোর উপর আঘাত হেনে সেগুলো ভেঙ্গে ফেলেন এবং মূর্তিভাঙ্গা কাষ্ঠগুলো আমার কাছে নিয়ে আসেন, যাতে সে কাষ্ঠগুলো আমি জুলানি রূপে ব্যবহার করতে পারি। হযরত সাহল ইবন হানীফ ইরাকে হযরত আলী (রা)-এর নিকট মৃত্যুবরণ করলে তিনি এ গোপন তথ্যটি প্রকাশ করেন।

ইবন ইসহাক বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্ (সা) কুবায় বনু আমর ইবন আওফ-এর গৃহে সোম মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার— এ চারদিন অবস্থান করেন এবং সেখানে মসজিদ নির্মাণ করেন। এরপর জুমুআর দিন আল্লাহ তাকে তাদের মধ্য থেকে বের করেন। আর বনু আমর ইবন আওফ-এর ধারণা যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের মধ্যে এর চেয়ে বেশী দিন অবস্থান করেছিলেন। মুহাম্মদ ইবন ইসহাকের বরাতে আবদুল্লাহ ইবন ইদরীস বলেন, বনু আমর ইবন আওফ ধারণা করে যে,

রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের মধ্যে আঠারো রাত্রি অবস্থান করেন। গ্রন্থকার বলেন, : ইতোপূর্বে যুহরী সূত্রে উরওয়া থেকে ইমাম বুখারীর বর্ণনা উল্লেখিত হয়েছে যে, তিনি তাদের মধ্যে ১০ রাত্রির

সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) কুবায় বনু আমর ইবন আওফের মধ্যে বাইশ রাত্রি অবস্থান করেন। আর ঐতিহাসিক ওয়াকিদী বলেন, : কথিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের মধ্যে চৌদ্দ রাত্রি অবস্থান করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *