৪.৩ মহাবিশ্বের সৃষ্টি কাহিনী

চতুর্থ অধ্যায় : অধিবিদ্যা : মহাবিশ্বের সৃষ্টি কাহিনী

বাইবেলের পুরাতন নিয়ম মানুষের চিন্তার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এটি প্রাচীনকালের মানুষের সৃষ্টি ও স্রষ্টা সম্পর্কিত সরল ও অপরিপক্ক ধারণাকে প্রদর্শন করে। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী, ঈশ্বর আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেন এবং সপ্তম দিনে বিশ্রাম নেন যা সাবাতের দিন নামে পরিচিত। যেহেতু সৃষ্টির আগে সূর্যের অস্তিত্ব ছিল না বিধায় সূর্যস্ত ও সূর্যোদয় ঘটত না তাই পৃথিবী ও আকাশ সৃষ্টির সময়কে দিন (ছয় দিন) ধরে হিসাব করা স্পষ্টত অবান্তর। এছাড়া প্রশ্ন হল, কেন ঈশ্বর মানুষের তৈরি করা সময়ের মাপদণ্ড দিয়ে তাঁর সৃষ্টির সময়কে হিসাব করবেন? কেন তিনি পৃথিবী নামক গ্রহের সময়কে একক ধরে হিসাব করবেন যেখানে অন্যান্য অনেক দূরবর্তী গ্রহ (যেমন নেপচুন) রয়েছে? ঈশ্বর সূর্য ও পৃথিবী সৃষ্টি করার আগের সময়ে দিন ও রাত কিভাবে সংগঠিত হত?

মহাবিশ্বকে ছয় দিনে সৃষ্টি করার ব্যাপারটি কোরানের অন্তত আটবার উল্লেখ করা হয়েছে। (আরবি সিত্তাতি আইয়্যামমানে সরলভাবে ছয় দিন। আইয়্যাম হচ্ছে আরবি ইয়াওম বা দিন-এর বহুবচন। এছাড়া আরশশব্দের অর্থ রাজসিংহাসন। বিভিন্ন আয়াতে (৭:৫৪, ২৫:৫৯, ১১:৭, ২৩:৮৬-৮৭, ১১৬, ৩২:৪) আল্লাহর আরশে আরোহণের কথা উল্লেখ আছে। প্রশ্ন উঠতে পারে কেন নিরাকার স্রষ্টাকে রাজসিংহাসনে আরোহণ করতে হবে? তবে কি মানব-মানসের ধারণার ওপর ভিত্তি করে স্রষ্টার ধারণা তৈরি হয়েছে? কোরানে স্পষ্টভাবে বলা আছে-আল্লাহর সিংহাসন আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির আগে পানির ওপরে ছিল। উল্লেখ্য আল্লাহর ধারণা ইসলাম-পূর্ব যুগের পৌত্তলিকদের কাছ থেকে এসেছে। আরবের পৌত্তলিকরা আল্লাহকে অন্যতম প্রধান দেবতা মনে করতো। হজরত মুহাম্মদের বাবা যিনি পৌত্তলিক ছিলেন তাঁর নাম ছিল আব্দুল্লাহমানে আল্লাহর দাস’, তাঁর চাচা আবু লাহাবের আসল নাম আব্দুল ওজামানে দেবী ওজার দাস।-অনুবাদক। নিচে এরকম কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করা হলো

১. তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, যিনি আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেন, তারপর তিনি আরশে সমাসীন হন। (সুরা ইউনুস :আয়াত ৩)।

২. তোমাদের প্রতিপালক তো আল্লাহ যিনি আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেন, তারপর তিনি আরশে সমাসীন হন। (সুরা আরাফ ; আয়াত ৫৪)।

৩. যখন তাঁর আরশ পানির ওপর ছিল তখন তিনিই আকাশ ও পৃথিবী ছয়দিনে সৃষ্টি করেন। (সুরা হুদ ; আয়াত ৭)। এ-আয়াত থেকে জানা যায় ছয় দিনে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করার আগে আল্লাহর সিংহাসন পানির ওপরে ছিল অর্থাৎ সিংহাসন ও পানি আসমান ও জমিন সৃষ্টির আগে থেকেই অস্তিত্বশীল ছিল। সুরা ইউনুসের ৩ নম্বর আয়াত এবং সুরা আ’রাফের ৫৪ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির পর তাঁর সিংহাসনে আরোহণ করেছেন। এটা সম্ভবত বাইবেলের বর্ণনার প্রতিধ্বনি যেখানে বলা হয়েছে ঈশ্বর ছয় দিনে সৃষ্টির পর সপ্তম দিনে বিশ্রাম নিয়েছেন। লক্ষণীয় এই আয়াতগুলোর গঠন দেখে মনে হয় তা আল্লাহর বাণী নয় বরং আল্লাহ সম্পর্কে অন্য কোনো ব্যক্তির বক্তব্য। নবির নিজের বক্তব্যও হতে পারে। নিচের আয়াতের বক্তা আল্লাহ :

৪. আমি আকাশ, পৃথিবী এবং দুয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু ছয়দিনে সৃষ্টি করেছি। ক্লান্তি আমাকে স্পর্শ করেনি। (সুরা কাফ ; আয়াত ৩৮)। এই আয়াতটি আগের তিন আয়াতের থেকে কিছুটা ভিন্ন যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে আল্লাহ ছয়দিনে শুধু আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তা নয় বরং এর মধ্যে যা আছে সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন। এবং এ-ধরনের গুরুকাজ সম্পাদনে কোনোভাবে ক্লান্ত হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে। মানুষ বা অন্য প্রাণীরা ক্লান্ত হতে পারে কোনো গুরুকাজ সম্পাদনের ফলে, একজন সর্বশক্তিমান ও চিরঞ্জীব স্রষ্টা ক্লান্ত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাই ক্লান্তি আমাকে স্পর্শ করেনি কথাটি বিসায়ের সঞ্চার করে ও নিরাকার স্রষ্টার এ-ধরনের পরিচয় জ্ঞাপন বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দেয়। অবশ্য এই বিবরণ বাইবেলে বর্ণিত ঈশ্বরের সপ্তম দিনে বিশ্রামের ধারণার বিপরীত।

৫. বলো, তোমরা কি তাঁকে অস্বীকার করবে যিনি দুদিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, আর তোমরা তাঁর সমকক্ষ দাঁড় করাতে চাও?’ (সুরাহা-মিম-সিজদা ; আয়াত ৯)। এখানে বক্তা স্বয়ং আল্লাহ, তিনি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করছেন দুই দিনে পৃথিবী সৃষ্টির কথা। এই বাক্যটি এরকম ইঙ্গিত করছে যে, আরবের মক্কার লোকেরা দুই দিনে পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ার ব্যাপারে অবগত ছিল এবং তাই তাদের উচিত নয় সেই স্রষ্টাকে অস্বীকার করা যিনি মাত্র দুই দিনে এরকম দুষ্কর কার্য সমাধা করেছেন। কিন্তু আরবরা নিশ্চয় এই সৃষ্টির ব্যাপারে জানত না, তা না-হলে তাদেরকে প্রশ্ন করা হত না, কেন তারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করে না। যদিও এখানে আল্লাহ বক্তা বলে মনে হয়, তারপরেও এ ধরনের বাণী আল্লাহর জন্য উপযোগী নয়। অসীম জ্ঞানী পরমেশ্বরের উচিত নয় এটি আশা করা যে, পৃথিবী দুই দিনে সৃষ্টি হয়েছে বললেই লোকে তাঁকে বিশ্বাস করে ফেলবে অথবা কিছু আরব দুই দিনে কেউ একজন পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তা স্বীকার করলেই তাঁকে সবাই বিশ্বাস করে ফেলবে? সুতরাং এ-ধরনের বাক্যও স্ৰষ্টার নয়, অন্য কারো কলপনার ফসল হতে পারে।

৬. তিনি পৃথিবীর উপরিভাগে পর্বতমালা স্থাপন করেছেন ও সেখানে কল্যাণ রেখেছেন, চারদিনের মধ্যে সেখানে মাত্রা অনুযায়ী খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন, সমানভাবে সকলের জন্য, যারা এর সন্ধান করে। (৪১:১০)।

৭. তারপর তিনি আকাশের দিকে মন দিলেন, আর তা ছিল ধোঁয়ার মতো। তারপর তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে বললেন, “তোমরা কি দুজনে স্বেচ্ছায় আসবে নাকি অনিচ্ছায়? তারা বলল, “আমরা স্বেচ্ছায় এলাম। (৪১:১১)। সুরা হা-মিম-সিজদাহ এর আয়াতে আল্লাহর আরশের উল্লেখ নেই। এই সুরার ১০-১১ আয়াতে আকাশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আরবি ভাষা আনুসারে উক্ত আয়াতে উল্লেখিত আকাশ’ ও ‘পৃথিবী স্ত্রীবাচক বিশেষ্য। বললেন ক্রিয়াপদটিও স্ত্রীবাচক বিশেষ্য এবং দ্বিবচন, কিন্তু আয়াতটির শেষে সংযোজিত বিশেষণ ইচ্ছায় পুরুষবাচক এবং বহুবচন। তাই এই বাক্য-সমষ্টি আরবি ব্যাকরণ অনুসারে সিদ্ধ নয়।

৮. তারপর তিনি আকাশকে দুদিনে সাত-আকাশে পরিণত করলেন আর প্রত্যেক আকাশকে তার কাজ বুঝিয়ে দিলেন। (৪১:১২)। এই আয়াতে অতিরিক্ত দুই দিনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা সাত আকাশকে সজ্জিতকরণে ব্যয় হয়েছে। এই দুই দিন ছয় দিনে মহাবিশ্ব সৃষ্টির বিষয়টিকে আট দিনে পরিণত করে এবং কোরানের বিভিন্ন আয়াতে ছয় দিনে সৃষ্টির সাথে বৈপরীত্ব সৃষ্টি করে। এ-ধরনের বিশৃঙ্খলা এসব আয়াতকে আল্লাহর বাণী হিসেবে মেনে নিতে সন্দেহের মধ্যে ফেলে দেয়। আরেকটি উভয়সঙ্কট অবস্থা সৃষ্টি করে সুরা তওবার দিনপঞ্জি সম্পর্কিত আয়াত : ‘আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর কাছে মাসগণনায় মাস বারোটি, তার মধ্যে চারটি মাস (মহরম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ) হারাম। এ-ই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। (৯:৩৬)।

পৃথিবীর মানুষ জানে প্রায় ৩৬৫ দিনে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে আসে। তারা উপলব্ধি করতে পারে বছরে চারটি ঋতু আছে ও সে অনুযায়ী তাদের কাজকর্মকে সাজিয়ে নেয়। প্রাচীন ব্যবিলনীয়, মিশরীয়, চীনা, ইরানীয় ও গ্রিক সভ্যতার লোকজন সৌরবছর অনুযায়ী তাদের দিন গণনা করত, তারা সূর্যের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে চার ঋতুর প্রত্যেকটির তিন ভাগে ভাগ করে নেয়, ফলে বছরে ১২টি মাস হয়ে যায়। সামান্য গাণিতিক জ্ঞানসম্পন্ন প্রাচীন লোকদের কাছে সূর্যের অবস্থানের সঠিক পর্যবেক্ষণ কঠিন ছিল। তাই তারা হিসাব সহজ করার জন্য চাঁদের বিভিন্ন দশাকে পর্যবেক্ষণ করে মাসের হিসাব তৈরি করতে থাকে। চাঁদ ২৭.৩ দিনে একবার পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে আসে এবং ২৯.৫ দিনে পূর্বের দশায় ফিরে আসে। তাই চাঁদের দশা পর্যবেক্ষণ করে মাসের হিসাব করা সূর্যের তুলনায় সহজ ছিল প্রাচীন লোকদের জন্য। এছাড়া মরুময় পরিবেশে চাঁদ পর্যবেক্ষণও সহজতর ছিল।অনুবাদক]। যেহেতু চাঁদের দশার সাথে ঋতু পরিবর্তনের সম্পর্ক নেই তাই চন্দ্রমাস কৃষিকাজের সময় হিসাবের ক্ষেত্রে গুরুত্বহীন যা তখনকার সময় জীবিকা নির্বাহের মূল উৎস ছিল।

আরবের বাসিন্দারা তারিখ হিসাবের ক্ষেত্রে চন্দ্রমাস ব্যবহার করত। যুদ্ধ-কলহ থেকে নিয়মিত বিরতি পাওয়ার উদ্দেশ্যে চারটি মাসকে পবিত্র বলে গণ্য করা হত। এই চার মাস যুদ্ধ নিষিদ্ধ ছিল। কিছু আরবীয় লোক বারোটি চন্দ্রমাসের সমন্বয়ে যে বছর গণনা করত তাকে সৌরবছরের সাথে সমতা বিধানের নিমিত্তে বছর শেষে নতুন বছর গণনা স্থগিত করে পুরনো বছরকে কিছুদিন দীর্ঘায়িত করত। অবশ্য কোরানে দেখা যায়, প্রাচীন আরবরা চন্দ্রবছরকে প্রকৃতির অলঙ্ঘনীয় নিয়ম বলে উল্লেখ রয়েছে। সৌরবছরের সাথে সমতা বিধানের নিমিত্তে বছরের দীর্ঘায়নকে কোরানে নিষিদ্ধ করা হয়েছে : “এই মাস অন্য মাসে পিছিয়ে দিলে তাতে কেবল অবিশ্বাসের মাত্রা বৃদ্ধি করবে। (৯:৩৭)। যে প্রভু প্রাচীন আরবীয় চন্দ্রমাস দ্বারা তারিখ গণনাকে সর্বযুগ ও পৃথিবীর সকল স্থানের জন্য আবশ্যক করে দেন তিনি নিঃসন্দেহে একজন স্থানীয় আরবীয় দেবতা। তিনি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা নন। অথবা তিনি হয়তো স্বয়ং নবি মুহামদ। একইভাবে আরবীয়-প্রথা মক্কায় তীর্থযাত্রাকে মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় কর্তব্যে পরিণত করা হয়েছে। সাফামারওয়ায় দৌড়ানোকে ইসলামি-প্রথায় নিয়ে আসা হয়েছে। মানুষের একটি ধর্মীয় প্রথাকে প্রাকৃতিক ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে কোরানে : ‘লোকে তোমাকে নূতন চাঁদ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। বলো, তা মানুষের সময় ও হজের সময়-নির্দেশ করে। ( ২:১৮৯) ।

তফসির আল-জালালাইন-এ আয়াতের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে এরকম : চাঁদের হ্রাস-বৃদ্ধি এজন্য ঘটে যাতে মানুষ শস্য রোপন ও কাটা, হজ, রোজা রাখা ও রোজা ভঙ্গ করা ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন করতে পারে। চাঁদের বিভিন্ন দশা কৃষিকাজের ক্ষেত্রে কোনোরূপ সাহায্য করতে পারে না। চন্দ্রমাসগুলো হজ ও রোজার সময়কে নির্দেশের ক্ষেত্রে ব্যবহারের আদেশ দেয়া হয়েছে,এটি আরবে নিত্যনৈমিত্তিক কাজে ব্যবহার উপযোগী ছিল না। চাঁদের হ্রাস-বৃদ্ধির মূল কারণ হচ্ছে পৃথিবীর চারপাশে এর নিজ কক্ষপথে ঘূর্ণন এবং পৃথিবীর ঘূর্ণনের সাথে সাথে এর অবস্থান পরিবর্তন ও বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর সাথে সূর্যের অবস্থান। বাঁকা চাঁদ ও পূর্ণ চাঁদ হেজাজ ও নেজদ অঞ্চলে আরবদের বাস শুরু করার হাজার বছর আগে থেকে মানুষের কাছে দৃশ্যমান ছিল। এমন কী, যখন মানবজাতির জন্ম হয়নি তখনও চাঁদের এই হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটত। এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা বলে কেউ থাকলে নিশ্চয়ই তিনি এ-গুলো সম্পর্কে অবগত থাকার কথা। সুতরাং তিনি এমন কোনো বাক্য উচ্চারণ করবেন না, যা কোনো ঘটনার ফলকে (হজ, রোজা) তার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করবে।

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে : অবিশ্বাসীরা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশ ও পৃথিবী ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল? তারপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম। (সুরা আম্বিয়া : ৩০)। শুধু অবিশ্বাসী-কাফেররা নয় বরং অন্য কেউই এ-রকম ঘটনা কখনো প্রত্যক্ষ করেনি বা এ-রকম বিষয় ভেবে দেখারও কোনো কারণ ঘটেনি। যারা কাফের নয় তাদের কাছেও আয়াতটি সহজবোধ্য নয়। আকাশ ও পৃথিবী সংযুক্ত ছিল-এরকম বক্তব্য থেকে কেউ কেউ আজকের যুগে বিগব্যাং থিওরির সাথে মিলিয়ে দিতে চান। এই আয়াতে স্পষ্টভাবে পৃথিবীর কথা হয়েছে, কিন্তু পৃথিবীর উদ্ভব ঘটেছে বিগব্যাং-এর প্রায় হাজার কোটি বছর পরে। তাই এই আয়াত বরং আমাদেরকে পৃথিবী-কেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণার ইঙ্গিত দেয়।-অনুবাদক]

—————————-

পাদটীকা

৭৮. পারস্যের প্রখ্যাত সুফি কবি মাহমুদ শাবেস্তারি। উত্তর-পশ্চিম ইরানের শহর তাবরিজে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১২৮৮ খ্রিস্টাব্দে এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে। আনুমানিক ১৩১১ খ্রিস্টাব্দের দিকে সুফিবাদ নিয়ে তাঁর অনবদ্য কাব্যরচনা গুলশান-ইরাজ ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে লন্ডন থেকে ১৮৮০ foëTo “The Rose-Garden of Mysteries’ শিরোনামে। ইংরেজি SERTT q=I& T°iYT E : Edward Henry Whinfield

৭৯. প্রথম সুরা ফাতিহায় পরম করুণাময় পরম দয়াময় আল্লাহর নামে’বাক্যকে একটি আলাদা আয়াত হিসেবে গণনা করা হয়েছে, অন্য সুরাগুলোর ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। সুরা ফাতিহায় আরও ছয়টি ছোট আয়াত রয়েছে।

৮০. আরবি মারহানিশব্দটিকে পুনরাবৃত্তি হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে। এটা একটা অস্পষ্ট অনুবাদ। শব্দটি কোরানের অন্য দুটি আয়াতেও এসেছে; যথা সুরা হিজরের আয়াত ৮৭ সুরা জুমারের আয়াত ২৩। এই অনুবাদ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। একটি ধারণা মতে, এই শব্দের অর্থ হচ্ছে আয়াতসমূহ দুইবার অবতীর্ণ হয়েছে এবং অন্য ধারণা মতে কিছু আয়াতকে প্রার্থনার সময় বারবার ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। অবশ্য অন্য আরেকটি মতে, এর অর্থ হচ্ছে প্রশংসা করা।

৮১. কুরাইশ বংশের বানু সাহম গোত্রের আমর ইবনে আল-আস মিশর দখল করে প্রথম শাসক হয়েছিলেন। আবু মুসা আলআশারি ছিলেন ইয়েমেনের বাসিন্দা। পরবর্তীতে বসরার গভর্নর নিযুক্ত হন এবং খুজেস্তান দখল করেন। ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে হজরত আলি ও মুয়াবিয়ার মধ্যে সিরিয়ার সিফিফন প্রান্তরে সংঘটিত যুদ্ধ সমাপ্তির জন্য মধ্যস্থতা করেন আমর ও আশারি। আমর ইবনে আল-আস ছিলেন মুয়াবিয়ার পক্ষে এবং আশারি ছিলেন হজরত আলির পক্ষে। দক্ষিণ জর্দানের নিকটবর্তী শহর পেত্রার কাছে আধরুতে বৈঠকে বসেন আমর এবং আশারি। আমর যুদ্ধ বন্ধের জন্য আলি ও মুয়াবিয়া উভয়কে অযোগ্য ঘোষণা করতে আশারিকে প্ররোচিত করেন এবং আশারিও সেই বক্তব্যে সায় দেন। কিন্তু পরে আমর ইবনে আল-আস মুয়াবিয়ার পক্ষ নিয়ে কেবল আলিকে অযোগ্য ঘোষণা করেন।

৮২. বাতিল হওয়া আয়াতের মধ্যে রয়েছে সুরা বাকারার ২৪০ নম্বর আয়াত। এটি কোরানে বিধবাদের উত্তরাধিকার সম্পর্কিত বিধান। এর স্থলে নাজিল হয়েছে সুরা নিসার ১২ নম্বর আয়াতটি। আবার সুরা নিসার ১৯ নম্বরআয়াতটি বাতিল করে নাজিল হয়েছে সুরা নুরের ২ নম্বর আয়াত। এটি নারীদের ব্যভিচারের সম্পর্কিত কোরানের বিধান। মাদক গ্রহণ সম্পর্কিত বিধান সুরা বাকারার ২১৯ নম্বর আয়াত বাতিল করে প্রতিস্থাপিত হয়েছে সুরা মায়িদার ৯১ নম্বর আয়াত।

৮৩. খলিফার দাবি নিয়ে মধ্যস্থতার চুক্তি অনুমোদন করায় আলির পক্ষ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয় খারিজিরা। ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা আলির দল থেকে বেরিয়ে পড়ে। খারিজিদের মতে, একজন কালো ক্রীতদাসও যদি সবচেয়ে ধাৰ্মিক মুসলমান হয়, তবে তাকেই ইমামের (মুসলিম সমাজের নেতা) মর্যাদা দেয়া উচিত। আবার যে মুসলমান গুরুতর অপরাধ করে তার ইমান নষ্ট হয়ে যায়, তাকে কৃতকর্মের জন্য ইহজগতেই শাস্তি পেতে হবে। খারিজিদের কিছু গোষ্ঠী এখনো ওমান ও আলজেরিয়ায় বসবাস করে।

৮৪. মরজিতি সম্প্রদায় বিশ্বাস করতেন একজন মুসলমানের ইমানের নিষ্ঠতা কেবলমাত্র আল্লাহই বিচার করতে পারেন। এমন কী মুসলমান অপরাধীদের সাজার জন্য শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত অথবা আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়া উচিত। মরজিতি গোষ্ঠী উমাইয়া খলিফাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন কেননা তাদের মতে, উমাইয়া খলিফারা পাপী হলেও প্রতিষ্ঠিত শাসক ছিলেন।

৮৫. মুতাজিলারা ইসলামের মধ্যে যুক্তিবাদী ধর্মীয়-সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। মুতাজিলাদের মতে, স্ৰষ্টা বা আল্লাহর কেবল প্রয়োজন রয়েছে বলেই তাঁর অস্তিত্ব রয়েছে। মানুষ স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী এবং কোরান অনাদিকাল থেকে রচিত নয়, মুহাম্মদের জীবনকালে আল্লাহ কর্তৃক কোরান রচিত হয়েছে। আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুন (৭৮৬-৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ), আল-মুতাসিম বিল্লাহ (৭৯৬-৮৪২ খ্রিস্টাব্দ), এবং তাঁর পুত্র আল-ওয়াতিক (৮১৬-৮৪৭ খ্রিস্টাব্দ) তাঁদের শাসনামলে মুতাজিলাদের ধর্মতত্ত্বের পাশাপাশি যুক্তিবিদ্যা, দর্শন চর্চায় উৎসাহ প্রদান করেন এবং মুতাজিলা-বিরোধী বিচারক ও সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে শুদ্ধি-অভিযান পরিচালনা করেন। মুতাজিলাদের মধ্যে সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হিসেবে বিবেচনা করা হয় পারস্যের আল-জামাখশারিকে (১০৭৫-১১৪৪? খ্রিস্টাব্দ)।

৮৬. ইরাকের বসরায় জন্মগ্রহণকারী সুন্নি ধর্মতাত্ত্বিক আবুল হাসান আলি ইবনে ইসমাইল আল-আশারির (৮৭৪-৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ) অনুসারীদের আশারিয়া বলা হয়। ইসমাইল আল-আশারি তরুণ বয়সে মুতাজিলা মতাদর্শের অনুসারী ছিলেন। ছাত্রজীবনে প্রখ্যাত মুতাজিলা শিক্ষক আল-জুব্বায়-এর ছাত্রও ছিলেন। পরর্তীতে তিনি যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করে সুন্নি ইসলামের রক্ষণশীল মতাদর্শ গ্রহণ করেন। তিনি মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ও বৈজ্ঞানিক কার্যকারণে অবিশ্বাসী হয়ে নিয়তিবাদ এবং আল্লাহ কর্তৃক অবিরাম সৃষ্টিতে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। যুক্তি ও দর্শনের চর্চাকে তিনি কুফরি বিদ্যা বলে অভিহিত করেন। তাঁর অনুসারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য

৮৭. কোরানের আয়াত ও ইসলামি আইন-প্রথাসমূহের গৃঢ় অর্থ অনুসন্ধানে নিয়োজিত ব্যক্তিদের হেয় করতে মধ্যযুগে কট্টরপন্থী ইসলামি চিন্তাবিদরা এই পরিভাষাটি ব্যবহার করতেন। যদিও খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর পূর্বে এই শব্দটি আধ্যাত্মিক সাধক সুফিদের জন্য প্রযোজ্য ছিল। পরবর্তীতে ইসমাইলি শিয়া গোষ্ঠী যেমন পূর্ব আরবের কারমাতি গোষ্ঠী, মিশরের ফাতেমি রাজবংশ, সম্বোধন করা হতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *