৩.৬ ইসলামে নারী

তৃতীয় অধ্যায় । রাজনীতি । ইসলামে নারী

‘নারীদের সহৃদয়তার সাথে দেখাশোনা কর! তারা অবরুদ্ধ” এবং তাদের নিজেদের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। হিজরি ৯ সালে (৬৩১ খ্রিস্টাব্দে) মক্কায় নবি মুহাম্মদ বিদায় হজের ভাষণে নারীদের সম্পর্কে এ-উক্তি করেছিলেন। প্রাক-ইসলামি যুগে আরব সমাজে নারীদের স্বাধীন নাগরিকের মর্যাদা ছিল না। পুরুষের অধীন বলে গণ্য করা হত। নারীদের প্রতি প্রায় সব ধরনের অমানবিক আচরণ বৈধ হিসেবে স্বীকৃতি পেত। অন্য যে কোনো অস্থাবর সম্পত্তির (দাস) মতো আরব নারীও কোনো ব্যক্তির উত্তরসূরির হাতে উত্তরাধিকার সূত্রে চলে যেতেন। নতুন মালিক ওই নারীকে কোনো প্রকার দেনমোহর প্রদান করা ছাড়াই নিজের স্ত্রী করে রাখতে পারতো। ওই নারী যদি মালিকের স্ত্রী হতে অস্বীকৃতি জানায় তবে মালিক নারীর সম্পদ দখল নিতে পারতেন। যদি ওই নারী সেটাও না করতেন তবে মালিক আমৃত্যু তাকে আটকে রাখতে পারতো।

সুরা নিসা-এর ১৯ নম্বর আয়াতের মাধ্যমে এই অমানবিক বিধান তুলে দেয়া হয় ; হে বিশ্বাসিগণ! জবরদস্তি করে নারীদেরকে তোমাদের উত্তরাধিকার গণ্য করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়। তোমরা তাদেরকে যা দিয়েছ তা থেকে কিছু আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে তাদের ওপর অত্যাচার করো না। তারা যদি প্রকাশ্যে ব্যভিচার না করে, তবে তোমরা তাদের সাথে সৎভাবে জীবনযাপন করবে। (৪:১৯)। সুরা নিসার ৩৪ নম্বর আয়াতে পুরুষ নারীর রক্ষাকর্তা উক্তিটি সমাজে নারী-পুরুষের অসাম্যের কথা প্রকাশ করে। নারীর তুলনায় পুরুষের উচ্চতর অবস্থানের কথা উক্ত আয়াতের পরের দুই বাক্যে উল্লেখ করেছেন ; কারণ আল্লাহ তাদের এককে অপরের ওপর বিশিষ্টতা দান করেছেন, আর এ এজন্য যে, পুরুষরা তাদের ধনসম্পদ থেকে ব্যয় করে…। তবে ঠিক কোন কারণে আল্লাহ নারী অপেক্ষা পুরুষকে শ্রেয়তর হিসেবে বেছে নিয়েছেন নির্দিষ্ট করে তার ব্যাখ্যা করা হয়নি।

তফসির আল-জালালাইন-এর বক্তব্য অনুযায়ী পুরুষ নারী অপেক্ষা শ্রেয়তর কারণ তাদের বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞানের পরিধি, প্রশাসনিক দক্ষতা। আল-জামাখশারি”, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর আল-বায়দাওয়ি এবং আরও অনেক মুসলিম পণ্ডিত অবশ্য এই বক্তব্যের আরও গভীরে গিয়ে অধিবিদ্যাগত রূপ দিতে চেষ্টা করেছেন। তাঁরা নারীর ওপর পুরুষের কর্তৃত্বকে কোনো বিষয়ের ওপর তার নিয়মের কর্তৃত্বের সাথে তুলনা করেছেন। নবুওতি, ইমামতি, শাসনের অধিকারগুলো একমাত্র পুরুষের জন্য বরাদ্দ রেখেছেন, কারণ তাদের মতে এটা তুলনমূলক বেশি শক্তিশালী, বেশি বুদ্ধিমান ও বেশি বিচক্ষণ। ইসলামি আইনে পুরুষ উত্তরাধিকারসূত্রে নারী অপেক্ষা বেশি সম্পত্তি পায়। একজন পুরুষের সাক্ষ্যও নারীর তুলনায় বেশি গ্রহণযোগ্য। নির্দিষ্ট করে বললে পুরুষের ভাগের প্রাপ্য সম্পত্তি নারীর ভাগের তুলনায় দ্বিগুণ। একইভাবে আদালতেও একজন পুরুষের সাক্ষ্য একজন নারীর সাক্ষ্যের তুলনায় দ্বিগুণ গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করা হয়। জিহাদে অংশগ্রহণ করা বা শুক্রবারের জুমার নামাজে অংশ নেয়াও নারীদের জন্য জায়েজ নয়। তালাক দেয়ার অধিকার শুধুমাত্র স্বামীর রয়েছে; স্ত্রীর এতে কোনো হাত নেই। আরও বিভিন্ন কাজ, যেমন আজান দেয়া, মসজিদে ইমামতি করা, ঘোড়ায় চড়া, তীর-ধনুক চালানো, বড় ধরনের কোনো অপরাধে সাক্ষ্য দেয়া ইত্যাদি শুধু পুরুষদের জন্যই সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।

এই পুরুষতান্ত্রিকতার পক্ষের যুক্তিগুলোর দুর্বলতা পাঠকেরা খুব সহজে ধরতে পারবেন। তৎকালীন সামাজিক পরিবেশই ছিল পুরুষের শাসকসুলভ-মনোভাব এবং নারীর নীচু অবস্থানের প্রধান কারণ। বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানেও নারীকে পুরুষের তুলনায় কম সম্মানের স্থান দেয়া হতো। ইসলামে নারীদের মূল্য উত্তরাধিকার ও সাক্ষ্যে পুরুষের তুলনায় অর্ধেক বলে বিবেচনা করা হয়। এধরনের বৈষম্য শুধুমাত্র ইসলামের জন্য বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। বরং নারীজাতির ক্রমাগত অবমাননার ফলাফল। বিষয়গুলো পুরোপুরি পরিষ্কার। ফলে হালকা চালে সাফাই গেয়ে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ইতিহাসের শুরু থেকে সকল আদিম সমাজে পুরুষ জাতি বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রামের জন্ম দিয়েছে এবং নারীকে দ্বিতীয় আসনে ঠেলে দিয়েছে। জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিৎসের ভাষায় নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ বলে গণ্য করা হয়েছে। প্রাচীন আরবে এই দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রতি বর্বরতা আরও ভয়ঙ্কররূপে ছিল। নবি মুহামদ কোরানের আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নারীদের কিছু অধিকার দিয়ে বর্বরতার ধার অনেকটুকু কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন। সুরা নিসার বেশিরভাগ আয়াতেই নারীদের প্রতি বৈষম্য হ্রাস ও আইনি অধিকার বিষয়ে মন্তব্য রয়েছে।

তবে যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে ইসলাম বিশেষজ্ঞদের তুলে ধরা বিভিন্ন বক্তব্যে যুক্তির পরিমাণ খুবই সামান্য। মূলত তাদের বক্তব্য প্রাচীন আরবীয় নিয়মকেই নতুন রূপে দাঁড় করানোর চেষ্টা। অবশ্য এর জন্য তাদেরকে খুব বেশি দোষ দেয়া যায় না। কারণ তাদের বক্তব্যের একমাত্র উদ্দেশ্যই হচ্ছে, কিভাবে আল্লাহ নারী অপেক্ষা পুরুষকে বেশি পছন্দ করেন, বা নারী অপেক্ষা পুরুষকে বেশি বিশিষ্টতা দান করেছেন সেই কোরানীয় বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেয়া। সুরা নিসার ৩৪নম্বর আয়াতের আরেকটি ব্যাখ্যা আছে, ‘পুরুষ নারীর পিছনে অর্থ ব্যয় করে এটা শুনতে যৌক্তিক মনে হতে পারে। যেহেতু নারীর খরচের দায়িত্ব পুরুষ ঘাড়ে তুলে নিয়েছে, সেহেতু নারী পুরুষের ওপর নির্ভরশীল। এ-কারণে নারী পুরুষের সকল আদেশ-নির্দেশ মানতে বাধ্য। আর এ-কারণে আল-জামাখশারি, আল-বায়দাওয়িসহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞ রায় দেন, পুরুষই হলো প্রভু এবং নারী হলো ভৃত্যস্বরূপ। সুরা নিসার উপরোক্ত আয়াতের এই বাক্য থেকে উপসংহার টানা যায় এভাবে: তাই সাধবী স্ত্রীরা অনুগতা এবং যা লোকচক্ষুর অন্তরালে আল্লাহর হেফাজতে তারা তার হেফাজত করে। অর্থাৎ ভাল স্ত্রী তাকে বলা যায় যে তার স্বামীর কথা মেনে চলেন এবং স্বামীর অনুপস্থিতিতে নিজেকে স্বামীর জন্য গচ্ছিত রাখেন। বোঝা যাচ্ছে স্ত্রীরা সবাই তাদের স্বামীর অধীন এবং এ-কথা ভুলে যাওয়া যাবে না।

এতো কিছুর পরও বলা যায় সুরা নিসা অনেক ক্ষেত্রেই নারীকে বেশ কিছু অধিকার দিয়েছে। প্রাচীন আরবীয় নিময়-কানুনের তুলনায় কোরানের বিধি কিভাবে নারীকে সহায়তা করেছে তা সুরা নিসার আয়াতগুলি থেকে বুঝা যায়। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, সুরা নিসার ২০-২১ আয়াতদ্বয়ে রয়েছে পুরুষের প্রতি নির্দেশ : “যদি তোমরা এক স্ত্রীর জায়গায় অন্য স্ত্রী নেওয়া ঠিক কর আর তাদের একজনকে প্রচুর অর্থও দিয়ে থাক তবুও তার থেকে কিছুই নেবে না। তোমরা কি মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ও জুলুম করে তা নিয়ে নেবে? কেমন করে তোমরা তা নেবে, যখন তোমরা পরস্পর সহবাস করেছ ও তারা তোমাদের কাছ থেকে শক্ত প্রতিশ্রুতি নিয়েছে? (৪:২০-২১)। স্ত্রীসঙ্গ উপভোগের পর বিবাহের সময় ধার্য দেনমোহর পরিশোধ না করে কোনো পুরুষ তালাক দিয়ে পুনরায় বিয়ে করতে পারবে না। দেনমোহর যা ধরা হয়েছিল তা ওই পুরুষকে পরিশোধ করতেই হবে। তবে এই সুরা নিসায় আবার প্রাচীন আরবের কিছু নারী-বিদ্বেষী নিয়মকে মেনে নেয়া হয়েছে। যেমন সুরা নিসার ওই ৩৪নম্বর আয়াতে শেষ বাক্যে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে: স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদেরকে ভালো করে উপদেশ দাও, তারপর তাদের বিছানায় যেয়ো না ও তাদেরকে প্রহার করো। পুরুষেরা তাদের দৈহিক শক্তির কারণে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ও কাপুরুষোচিত কাজ সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই করে আসছে। এমন-কী এই বিংশ শতাব্দীতেও তা সমান তালে চলছে। প্রকৃতপক্ষে কোরানে বর্ণিত এ-বিধান নারীর প্রতি এ নিষ্ঠুরতাকে ধরে রেখেছে।

প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিয়মকানুনগুলো তাদের আচার-আচরণ, নৈতিকতাবোধকে প্রতিফলিত করে। সুরা নিসার ৩৪ নম্বর আয়াতকে আমরা সেভাবেই দেখতে পারি যে, প্রাচীন আরবীয়দের কাছে স্বামী ছিল প্রভুর মতো, স্ত্রীকে শারীরিক-মানসিক আঘাত করার সব রকম অধিকার তাদের ছিল। জুবায়ের বিন আল-আওয়ামের চতুর্থ স্ত্রী এবং হজরত আবু বকরের কন্যা আসমাকে একবার বলতে দেখা যায়, জুবায়ের যখন স্ত্রীদের ওপর রেগে যেতেন তখন লাঠি না ভাঙা পর্যন্ত প্রহার করতে থাকতেন। এ-ব্যাপারে ইসলামি আইনে অন্তত কিছু সীমারেখা এবং স্তরবিন্যাস করে দেয়া হয়েছে। প্রথমত সতর্কবাণী প্রদান করা হয়েছে। যৌনমিলনে বাধা প্রদানের ক্ষেত্রে স্ত্রীকে প্রহার করাকে সর্বশেষ বৈধ অস্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অনেক তফসিরকারক এবং ইসলামি আইন-বিশেষজ্ঞদের মতে স্ত্রীকে প্রহার করা জায়েজ হলেও তা যেন হাড় ভাঙার পর্যায়ে চলে না যায়। তাহলে আবার শারীরিক আঘাতের কারণে ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি উঠতে পারে। ৩৪নম্বর আয়াত প্রসঙ্গে আল-জামাখশারি মন্তব্য করেছেন: ইসলামবিশেষজ্ঞদের অনেকে অবাধ্য স্ত্রীর প্রাপ্য শাস্তির এই স্তরবিন্যাস মেনে নিতে রাজি নন। তাঁরা একই সাথে তিন ধরনের শাস্তি প্রদানকেই অনুমোদন দিয়েছেন। এধরনের ব্যাখ্যা একমাত্র ইবনে হানবল, ইবনে তায়মিয়ার মতো আরবীয় ধর্মীয় নেতাই দিতেন পারেন। তবে এ-সকল বক্তব্যের অর্থ একদম পরিষ্কার এবং পরবর্তী আয়াতে তা নিশ্চিত করে; আর যদি দুজনের (স্বামীস্ত্রীর) মধ্যে বিরোধ আশঙ্কা কর তবে তোমরা তার (স্বামীর) পরিবার থেকে একজন ও ওর (স্ত্রীর) পরিবার হতে একজন সালিশ নিযুক্ত করবে। যদি তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চায় তবে আল্লাহ তাদের মধ্যে ফয়সালার অনুকুল অবস্থা সৃষ্টি করবেন। (৪:৩৫)।

নিকট আত্নীয়ের সাথে বিবাহের নিষেধাজ্ঞা সুরা নিসার ২৩ নম্বর আয়াতে দেখতে পাই। এই বিধানটি ইহুদি আইনেও আছে এবং প্রাচীন আরবের পৌত্তলিক সমাজেও এই নীতি অনুসরণ করা হতো। তবে ব্যতিক্রম হচ্ছে এর পূর্বের আয়াতে, নারীদের মধ্যে তোমাদের পিতৃপুরুষ যাদেরকে বিয়ে করেছে তোমরা তাদেরকে বিয়ে করো না। পূর্বে যা হয়ে গেছে, তা হয়ে গেছে। (৪:২২)। কোরানের এ-রকম বিধান এবং বিশেষ শর্তারোপ থেকে আমরা বুঝতে পারি, ইসলাম-পূর্ব আরবে এমন জঘন্য ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। তবে ২৪ নম্বর আয়াতের বিধান নতুন কিছু নয়। ইসলাম-পূর্ব যুগেও সেটা প্রযোজ্য ছিল। তবে বিস্ময়কর হচ্ছে, এই আয়াতের মাধ্যমে দাসীদেরকেও মালিকদের কাছে হস্তগত করা হয়েছে। অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করা, কিংবা যুদ্ধে বন্দী হওয়া দাসীকে কোনো মানবিকতা ও আইনি বাধ্যবাধকতা ছাড়াই বিবাহের জন্য হস্তান্তর করা যায়। এমন কী ওই দাসীর স্বামী জীবিত থাকলেও। ইবনে সাদের* একটি উক্তি রয়েছে: হুনাইনের নিকট আওতাসের যুদ্ধে কয়েকজন নারী বন্দী আমাদের ভাগে পড়ে। যেহেতু ওই নারীদের স্বামী জীবিত ছিল, তাই তাদের সাথে যৌনমিলনে না গিয়ে নবির সাথে আলোচনা করতে গেলাম। তখন এই সুরা নিসার ২৪ নম্বর আয়াত নাজিল হয়: ‘নারীদের মধ্যে তোমাদের ভান হাতের নারী (যুদ্ধবন্দী) ছাড়া সকল বিবাহিত নারী তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ। (৪:২৪)। এভাবে ওই যুদ্ধবন্দিনীদের কর্তৃত্ব আমরা পেয়ে গেলাম। আবার একই আয়াতে আমরা নবির মনে নারী অধিকার ও তৎকালীন কুপ্রথা নিয়ে সচেতনতা দেখতে পাই। শেষ তিনটি বাক্যে রয়েছে ; তোমাদের জন্য এ আল্লাহর বিধান। উল্লিখিত নারীরা ছাড়া আর সকলকে ধনসম্পদ দিয়ে বিয়ে করা বৈধ করা হলো, ব্যভিচারের জন্য নয়। তাদের মধ্যে যাদেরকে তোমরা উপভোগ করবে তাদেরকে নির্ধারিত মোহর দেবে। মোহর নির্ধারণের পর কোনো বিষয়ে পরস্পর রাজি হলে তাতে তোমাদের কোনো দোষ নেই। যাদেরকে তোমরা উপভোগ করবে তাদেরকে নির্ধারিত মোহর দেবে- এই ধরনের বক্তব্য থেকে প্রশ্ন ওঠে ইসলামে কি অস্থায়ী বিবাহ (মুতাপ বিবাহ জায়েজ? সুন্নি পণ্ডিতরা বলেন, এমনটা জায়েজ নয়। কারণ এই বক্তব্যগুলো মুসলমানদের মক্কা বিজয়ের পর নাজিল হয়েছিল এবং এর মেয়াদ ছিল মাত্র তিনদিন। শিয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, এধরনের বিবাহ ইসলাম অনুযায়ী জায়েজ।

সুরা মুমতাহানা-এর ১০ নম্বর আয়াত থেকে ওই সময়ের নারী-পুরুষের সামাজিক সম্পর্ক বুঝা যায় : হে বিশ্বাসিগণ! বিশ্বাসী নারীরা দেশত্যাগী হয়ে তোমাদের কাছে এলে তোমরা তাদেরকে পরীক্ষা করো। আল্লাহ তাদের বিশ্বাস সম্বন্ধে ভালো করে জানেন। যদি তোমরা জানতে পার যে তারা বিশ্বাসী তবে তাদেরকে অবিশ্বাসীদের কাছে ফেরত পাঠিয়ো না। বিশ্বাসী নারীরা অবিশ্বাসীদের জন্য বৈধ নয়, আর অবিশ্বাসীরা বিশ্বাসী নারীদের জন্য বৈধ নয়। অবিশ্বাসীরা যা খরচ করেছে তা তাদেরকে ফিরিয়ে দিয়ো। তারপর তোমরা তাদেরকে বিয়ে করলে তোমাদের কোনো পাপ হবে না, যদি তোমরা দেনমোহর দাও। তোমরা অবিশ্বাসী নারীদের সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রেখো না। তোমরা যা খরচ করেছ তা ফেরত চাইবে ও অবিশ্বাসীরা ফেরত চাইবে তারা যা খরচ করেছে। (৬০:১০)। অর্থাৎ কোনো বিবাহিত নারী যদি ইসলাম গ্রহণ করে পালিয়ে যায় তবে তার অবিশ্বাসী স্বামী স্ত্রীর ওপর অধিকার হারিয়ে ফেলে। সে অনুরোধ করলেও মুসলমানরা স্ত্রীকে ওই অমুসলমান ব্যক্তির কাছে ফিরিয়ে দিবেন না। তবে মুসলমানরা ওই ব্যক্তির স্ত্রীর প্রতি তার খরচের ক্ষতিপূরণ অবশ্য দিবেন। একইভাবে কোনো মুসলমানের স্ত্রী যদি অবিশ্বাসী হয়ে যান, তবে ওই ব্যক্তি স্ত্রীকে রাখার জন্য জোর করতে পারবেন না এবং ওই নারীকে তার সম্প্রদায়ের কাছে ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে ফেরত পাঠিয়ে দিতে হবে।

স্ত্রীর প্রতি অসুস্থ মানসিকতা থেকে আরবীয়দের পরিবর্তনের জন্য নবির মানবিক চিন্তা চেতনার প্রতিফলন আমরা সুরা বাকারা-এর বিভিন্ন আয়াতে দেখতে পাই। যেমন : যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দাও এবং তারা ইদ্দতকাল পূর্ণ করে, তখন তাদের যথাবিধি রেখে দেবে বা তাদেরকে ভালোভাবে বিদায় দেবে। তাদেরকে অত্যাচার বা তাদের ওপর বাড়াবাড়ির উদ্দেশ্যে আটক করে রাখবে না। (২:২৩১)। অর্থাৎ যখন কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেয়ার কথা উচ্চারণ করে ফেলেন তবে একটি নির্দিষ্ট করতে পারবেন না। আর তাদের বিয়ের পক্ষে বা বিপক্ষের সব সিদ্ধান্তই সমানজনকভাবে এবং দুই পক্ষের আপোসের মাধ্যমে নিতে হবে। দীর্ঘ সময়ের জন্য আটকে রেখে বা কোনো রকম হুমকির মাধ্যমে স্ত্রীর অধিকার খর্ব করা যাবে না। পরবর্তী আয়াতে এমনই নির্দেশ আমরা দেখি তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দাও আর তারা তাদের ইদ্দতকাল পূর্ণ করতে থাকে তখন তারা যদি পরস্পর সম্মত হয়ে তাদের (পূর্বের) স্বামীদের বিধিমতো বিয়ে করতে চায় তবে তাদেরকে বাধা দেবে না। (২:২৩২)। বলা হয়ে থাকে এই আয়াতটি এসেছে, মাকিল বিন ইয়াসিরের একটি আচরণের কারণে। তিনি তার বোনকে তালাকদাতা স্বামীর সাথে বিয়ে দিতে বাধা দিচ্ছিলেন।

সুরা বাকারা’র একটি কম আলোচিত বিষয়ের প্রতি আমরা এখন আলোকপাত করব। এই আয়াত থেকে আমরা নবি মুহাম্মদের সময়কার সমাজ-ব্যবস্থার এক ঝলক দৃশ্য দেখতে পাই: রজঃস্রাবকালে স্ত্রীসঙ্গ বর্জন করবে, আর যতদিন না তারা পবিত্র হয়, তাদের কাছে (সহবাসের জন্য) যেয়ো না। তারপর যখন তারা পরিশুদ্ধ হবে, তখন তাদের কাছে ঠিক সেইভাবে যাবে যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন। (২:২২২)। তফসির আল-জালালাইনের বক্তব্য অনুযায়ী ঠিক সেইভাবে যাবে মানে রজঃস্রাবের পূর্বে যেভাবে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হতেন, সেটাকে বুঝাচ্ছে। কিন্তু পরবর্তী আয়াতেই আমরা পরস্পর-বিরোধী একটি বক্তব্য দেখতে পাই : তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের শস্যক্ষেত্র। অতএব তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা যেতে পার। ’ (২:২২৩)। তফসির আল-জালালাইনে তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা যেতে পার’- কে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে,

‘দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে, সামনে থেকে, পাশ থেকে, অথবা পিছন থেকে যেভাবে ইচ্ছা যৌনমিলনকে বুঝানো হচ্ছে। এই তফসিরে আরও বলা হয়েছে, এই আয়াত নাজিলের উদ্দেশ্য হচ্ছে সে-সময়ের একটি ইহুদি সংস্কারকে সবার মন থেকে দূর করা। ইহুদি সংস্কার অনুযায়ী, পেছন থেকে সঙ্গম করলে সন্তান ট্যারা চোখের, অথবা বাহাতি হয়ে জন্মায়। জালাল উদ্দিন আল-সুয়তি’র মতে ২২২নম্বর আয়াতের ঠিক সেইভাবে যাবে যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন নির্দেশ পরবর্তী আয়াতের মাধ্যমে খারিজ হয়ে গিয়েছে। হজরত ওমরসহ নবির বেশ কয়েকজন সাহাবির আবেদনের ফলে এটি খারিজ হয়েছে। খ্রিস্টান-ইহুদিরা নারীর সাথে পাশ ফিরে মিলনে যেত। মদিনার আনসারেরাও একই প্রথা অবলম্বন করতেন। আর মুহাজিররা কুরাইশ ও অন্যান্য মক্কাবাসীর যৌন-আচরণ অনুসরণ করতেন। তারা নারীদের সাথে বিভিন্নভাবে মিলন করতেন। কখনো নারীদের বুকের ওপর, কখনোবা পিঠের ওপর বসিয়ে। কখনো পেছন থেকে, কখনো সামনে থেকে তাদের সঙ্গিনীর সাথে যৌনমিলন করতেন। কোনো মুহাজির পুরুষ কোনো আনসার নারীকে বিয়ে করলে তার সাথেও এরকম যৌন-আচরণ করতে চাইতেন। কিন্তু আনসার স্ত্রী অস্বীকৃতি জানিয়ে বলতেন, আমরা কেবল পাশ ফিরে শুয়ে থাকি। বিষয়টি নবির কানেও পৌছায় এবং এ-বিষয়ে পুরুষদের করণীয় সম্পর্কে আয়াত নাজিল হয়। আহমদ ইবনে হানবল এবং তিরমিজির মতে আয়াতটির অর্থ হচ্ছে, “সামনে অথবা পিছন থেকে, মাথার উপরে অথবা নিচে রেখে। হজরত ওমর এক সকালে নবির কেমন কাটল?” প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, গতকাল রাতে আমি আমার পদ্ধতি পরিবর্তন করেছিলাম। কিন্তু আনন্দ পাইনি। এরপর এই আয়াতটি নাজিল হয়।

কোরানের আয়াত এবং ইসলামের শিক্ষা থেকে বোঝা যায় প্রাচীন আরবে নারীদের মর্যাদা অত্যন্ত নিচু ছিল। পুরুষেরা নারীকে অত্যন্ত অমানবিক দৃষ্টিতে বিচার করতেন। যেমন সুরা নুর-এর ৩৩নম্বর আয়াতে আর্থিক লাভের জন্য দাসীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করতে নিষেধ করা হয়: তোমাদের দাসীরা সতীত্ব রক্ষা করতে চাইলে, পার্থিব জীবনের টাকাপয়সার লোভে তাদেরকে ব্যভিচারিণী হতে বাধ্য করো না।’ (২৪:৩৩)। প্রচলিত আছে যে, আব্দুল্লাহ বিন উবায় পূর্বে এমন ঘৃণ্য ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন। উবায় শুধু একমাত্র ব্যক্তি নন, আরব সমাজে দাসীদের যৌনব্যবসায় বাধ্য করে মালিকদের পকেট ভারী করা অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা ছিল; ফলে অনেকেই এ-ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। নবির মক্কা বিজয়ের পর মক্কাবাসী নারীদের একটি বড় অংশ ইসলাম গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং নবির কাছে আনুগত্য প্রকাশ করেন। এ-প্রেক্ষিতে সুরা মুমতাহানা-এর ১২নম্বর আয়াত নাজিল হয়। মক্কাবাসী নারীদের বিশ্বাস ও আচরণের ওপর শর্তারোপ করে ইসলামে দীক্ষিত হবার সুযোগ দেয়া হয় : হে নবি! বিশ্বাসী নারীরা যখন তোমার কাছে আনুগত্যের শপথ করতে এসে বলে যে, তারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, নিজেদের সন্তানদের হত্যা করবে না, অপরের সন্তানকে স্বামীর ঔরসে আপন গর্ভজাত সন্তান বলে মিথ্যা দাবি করবে না, এবং সৎকাজে তোমাকে অমান্য করবে না, তখন তাদের আনুগত্য গ্রহণ করো আর তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। (৬০:১২)। এই শর্তাবলীর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ইসলামে দীক্ষিত হওয়া সহজবোধ্য এবং সহজে গ্রহণযোগ্য। শুধু পূর্বে পালন করা কুপ্রথাগুলি ত্যাগ করার কথা এখানে বলা হচ্ছে। এছাড়া ইসলামে নারীদের জোরে শব্দ করার ওপর নিষেধ করা হয়। পোশাকের কলার তুলে রাখা, চুল এলোমেলো রাখা ইত্যাদি অভ্যাসও ত্যাগ করার কথা বলে ইসলাম। মক্কা বিজয়ের পর এধরনের শর্তাবলী প্রকাশের পর কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবা বলেন, আদর্শ ঘরের কোনো স্বাধীন নারীই ব্যভিচার ও দেহব্যবসায় জড়াতে পারেন না। ’

ইসলামি শিক্ষায় নিষিদ্ধ অন্যতম কুপ্রথা হচ্ছে নারী শিশুদের হত্যা করা। সুরা তাকভির-এর ৮-৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : ‘জীবন্ত-কবর দেয়া কন্যাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হবে, কী দোষে ওকে হত্যা করা হয়েছিল?’(৮১৮-৯)। ইসলাম-পূর্ব আরবে পুত্রসন্তানকে মূল্যবান বিবেচনা করা হতো। পুত্রসন্তান জন্ম হলে সবাই অহংকার করত। কিন্তু কন্যাসন্তানকে বোঝা ও অবমাননাকর মনে করতো। তারা এতোটাই নির্বোধ ছিল যে মানব-জাতির ভবিষ্যত রক্ষায় নারীদের যে প্রয়োজনীতা রয়েছে, সেটা তারা আন্দাজ করতে পারতেন না। সূরা নাহল-এর ৫৮-৫৯ নম্বর আয়াতদ্বয়ে বলা হয়েছে: “ওদের কাউকেও যখন কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন ওদের মুখ কালো হয়ে যায় ও মন ছোট হয়ে যায়। আর যে-খবর সে পায় তার লজ্জায় সে নিজের সম্প্রদায় থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। (ভাবে) অপমান সহ্য করে সে ওকে রাখবে? না মাটিতে পুতে ফেলবে? আহ! কী খারাপ ওদের সিদ্ধান্ত (১৬:৫৮-৫৯)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *