৩.৩ একটি সুগঠিত অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা

তৃতীয় অধ্যায় । রাজনীতি । একটি সুগঠিত অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা

ইয়াসরিবে গমনের পর নবি মুহাম্মদ তার স্থানীয় সমর্থক (আনসার) আউস ও খাজরাজ গোত্রের লোক এবং অভিবাসী মুসলমানদের (মুহাজির) সাথে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন। আনসাররা মুহাজিরদের পালক ভ্রাতা হিসেবে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দেন। মুহাজিররা কর্মঠ ছিলেন। তাঁরা ইয়াসরিবে এসে কৃষি-শ্রমিক এবং বাজারে দোকানের কাজ জুটিয়ে নেন। তথাপি এখানে তাদের অবস্থান সহজ কিংবা নিরাপদ, কোনোটাই ছিল না। মক্কায় থাকাকালীন সময়ে কুরাইশদের সাথে পেরে উঠতে না পেরে তাঁরা নির্ভরযোগ্য জীবিকার অন্বেষণ করছিলেন,যা তাদেরকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করতে পারবে। নবি মুহাম্মদ নিজে কোনো পেশা গ্রহণ করেননি। মুহাজির ও আনসারদের অনুদানের ওপর নির্ভর করতেন। তিনি এ-সময় কঠোর সময়কাল অতিক্রম করছিলেন। তাঁকে প্রায়শ রাত্রিকালীন আহার না করে শয্যায় যেতে হতো কিংবা কয়েক দিনের ক্ষুধা এক দিনে উপশম করতে হত। ফলে ইয়াসরিবে এসে সংখ্যালঘু মুসলমান জনগোষ্ঠীকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমূখীন হতে হলো। বেঁচে থাকার জন্য তাদেরকে একটি কম বিপজ্জনক এবং স্বনির্ভর অর্থনৈতিক ভিত্তি খুঁজে নিতে হবে। এ-সমস্যার সমাধানে নবির গৃহীত ব্যবস্থাসমূহ নিচে আলোচনা করা হয়েছে।

ইসলাম-পূর্ব সময় থেকে আরব গোত্রগুলোর সম্পদ বৃদ্ধির একটি ঐতিহ্যগত প্রথা হচ্ছে এক গোত্র কর্তৃক অন্য গোত্রকে আক্রমণ, অপরের গবাদিপশু ও অন্যান্য সম্পদ দখলে নেয়া। কৃষিভিত্তিক স্থায়ী পেশা বা জীবিকা অর্জনের পথ খুব দুরূহ থাকায় তৎকালীন আরবের বেশিরভাগ গোত্র এভাবে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করতেন। ইয়াসরিব-অভিবাসী মুসলমানদেরও নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনের জন্য অন্য কোনো উপায় ছিল না। ফলে তাঁরা বিদেশ যাত্রী, বাণিজ্যিক কাফেলা কিংবা শক্রগোত্রের ওপর হঠাৎ আক্রমণের পন্থা বেছে নিলেন। আরবি গাজওয়া শব্দের অর্থ হচ্ছে আকস্মিক আক্রমণ’। এই শব্দটি ব্যবহৃত হয় কোনো বাণিজ্যিক কাফেলা কিংবা গোত্রের ওপর আকস্মিক আক্রমণ করে তাদের সম্পদ ও নারীদের ছিনিয়ে নেয়া। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করে এভাবে অর্জিত সম্পদ আরব অঞ্চলের শুষ্ক রুক্ষ পরিবেশে জীবনযাপনকে তাৎক্ষণিকভাবে সহজ করে দিত।

একবার নবির কাছে সংবাদ পৌছাল কুরাইশদের একটি বাণিজ্যিক কাফেলা আমর বিন আল-হাদরামির নেতৃত্বে বিশাল মালামালের বহর নিয়ে সিরিয়া থেকে মক্কার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নবি আব্দুল্লাহ বিন জাহেশ এর নেতৃত্বে মুহাজিরদের একটি দলকে ওই কাফেলার সম্পদ দখলের জন্য প্রেরণ করেন। মুহাজিররা নাখলা নামক একটি যাত্রাবিরতির স্থানে আকসিক আক্রমণ এলেন মুহাজিররা। সাথে দুইজনকে জিমি করেও নিয়ে আসা হলো। ইসলামের ইতিহাসে এই সফল অভিযানকে নাখলার অভিযান’নামে অভিহিত করা হয়।

মুহাজিরদের নাখলা-অভিযানের ঘটনা তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে মক্কায় এবং ইয়াসরিবে। কারণ এটি ছিল মুসলমানদের প্রথম আক্রমণ এবং যা রজব মাসের প্রথম দিনে সংঘটিত হয়েছিল। প্রাচীন আরব-রীতি অনুযায়ী চারটি মাসে (মহরম, রজব, জিলকুদ ও জিলহজ) আক্রমণ করা নিষিদ্ধ, যার মধ্যে রজব মাস একটি। স্বাভাবিকভাবে এই আক্রমণের পর কুরাইশরা তীব্র ঘৃণা প্রদর্শন করল মুহাজিরদের প্রতি। অন্যান্য গোত্র থেকেও তেমনি প্রতিক্রিয়া নির্গত হলো। ইতিহাস-পাঠে মনে হয় এই প্রতিকূল প্রেক্ষাপট নবিকেও শঙ্কার মধ্যে ফেলে দেয়। তিনি আব্দুল্লাহ বিন জাহশ ও তার লোকজনের প্রতি শীতল আচরণ করলেন। ভবিষ্যতপন্থা নির্ধারণেও কিছুটা সংশয়ী মনোভাব প্রকাশ করলেন। আব্দুল্লাহ বিন জাহশ দাবি করলেন এই আক্রমণ জুমাদা আস-সানি মাসের শেষ দিনে করা হয়েছে। এক্ষেত্রে একটি সমাধানের পথ পাওয়া গেল। কিন্তু যুদ্ধে লব্ধ মাল নিয়ে সমস্যা রয়ে গেল, যা মুহাজিরদের প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থানে প্রয়োজনীয় ছিল। এ-কারণে কুরাইশদের দাবির মুখে মালগুলো ফিরিয়ে দেবার কোনো সুযোগ ছিল না। হয়তো কয়েকজন সাহাবি নবিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যা ঘটে গেছে তা আর বদলানো যাবে না এবং কোনো প্রকারের অস্বীকারমূলক বক্তব্য মুহাজিরদের অপরাধী এবং শক্রকে নির্দোষ বানাবে। মুহাজিরদের অর্থনৈতিক অবস্থার মুক্তির জন্য গনিমতের মালের প্রয়োজনীয়তার কথা নিশ্চিতভাবে তাদের মনে কাজ করছিল।

একটি সুস্পষ্ট এবং দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী সমাধান আসে সুরা বাকারার এই আয়াতে: পবিত্র মাসে যুদ্ধ করা সম্পর্কে লোকে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, বলো, সেই সময় যুদ্ধ করা ভীষণ অন্যায়। কিন্তু আল্লাহর কাছে তার চেয়েও বড় অন্যায় আল্লাহর পথে বাধা দেয়া, আল্লাহকে অস্বীকার করা, কাবাশরিফে উপাসনায় বাধা দেয়া ও সেখানকার অধিবাসীদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়া। ফিৎনাং হত্যার চেয়েও ভীষণ অন্যায়। পারলে তারা সব সময় তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে যে-পর্যন্ত না তারা তোমাদের ধর্ম থেকে তোমাদেরকে ফিরিযে দেয় (২:২১৭)। নাখলা অভিযানের পর কুরাইশ এবং আরও কয়েকটি শক্রভাবাপন্ন গোত্রের ওপর সফল গাজওয়া পরিচালিত হলে মুহাজিরদের আর্থিক অবস্থানে পরিবর্তন আসে। এ-অভিযানগুলো নবি এবং সাহাবিদের ক্ষমতার শীর্ষে পৌছানোর রাস্ত করে দেয় এবং সমগ্র আরবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ছিল চূড়ান্ত রূপ। তবে তাৎক্ষণিকভাবে যে পদক্ষেপটি মুসলমানদের মর্যাদা ও আর্থিকভিত্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল তা হচ্ছে ইয়াসরিবের ইহুদি সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ।

ইয়াসরিবে তিনটি ইহুদি গোত্র বাস করত। এরা হচ্ছে বানু কায়নোকা, বানু-নাজির ও বানু কুরাইজা। এই ইহুদি গোত্রগুলি ইয়াসরিবে কৃষি ও শিল্পে নিজস্ব দক্ষতা কাজে লাগিয়ে ব্যাপক উন্নতি করেছিল। ধর্মীয় শিক্ষা ও সাহিত্যের চর্চার মাধ্যমে তারা ইয়াসরিবের অন্য দুটি গোত্র আউস ও খাজরাজের চেয়ে উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী হয়ে ওঠে। ইহুদিরা অনেক আউস ও খাজরাজ গোত্রের লোককে কৃষিশ্রমিক ও দোকান-গুদামের বিক্রময়কর্মী ও প্রহরী হিসেবে নিযুক্ত করে। আউস ও খাজরাজ গোত্রের লোকেরা এ-জন্য প্রতিনিয়ত হীনমন্যতায় ভুগতেন এবং ইহুদি গোত্র তিনটির প্রতি ঈর্ষা অনুভব করতেন। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে আউস ও খাজরাজ গোত্রের লোকেরা নবি মুহাম্মদের সাথে আল-আকাবা চুক্তি সম্পাদন করার মূল কারণ ছিল ইয়াসরিবে ইহুদিআধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে নিজেদের হীনমন্যতা থেকে মুক্ত করা। ইয়াসরিবে আগমনের পর নবির মধ্যে প্রথমে একটি বিচক্ষণ পরিণামদৰ্শিতা বজায় ছিল। তিনি ইহুদিদের সাথে যে কোনো প্রকার বিতর্ক এড়িয়ে চলতেন। ইহুদিরা ছিল শক্তিশালী ও বিত্তশালী। তিনি তাদের সাথে অনাক্রমণমূলক একটি চুক্তিও (আহদ আল-মুয়ারা) করেছিলেন, যা উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি করে। চুক্তিতে ঠিক হল মুসলমান ও ইহুদিরা নিজস্ব ধর্মীয় সমাজে বসবাস করবে এবং কুরাইশ ও অন্য যে কোনো গোত্র থেকে আক্রমণ করা হলে উভয় ধর্মাবলম্বী যৌথভাবে ইয়াসরিবকে রক্ষা করবেন। একই সাথে উভয় পক্ষই মধ্যে একটি সাধারণ সম্পর্কের যোগসূত্র হচ্ছে উভয় গোষ্ঠী পৌত্তলিকতা ও মূর্তিপূজা পরিহার করেছিলেন এবং প্রার্থনার সময় উভয় গোষ্ঠীই একই দিকে তাদের মাথা নত করতেন।

ইয়াসরিবে মুসলমানরা যখন দুর্বল ছিলেন তখন উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটেনি। এমন-কি ইয়াসরিবে অভিবাসনের দেড় বছর ধরে নবি প্রার্থনার জন্য কিবলার দিক দূরতম মসজিদকে (জেরুজালেমে অবস্থিত) অনুসরণ করতেন তখনও কোনো বিরোধ বাধেনি। কিন্তু পরে কিবলার দিক পরিবর্তন করে মক্কার কাবাঘরের দিকে করা হয়। এই পদক্ষেপের পর থেকে ইহুদিরা প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন। তাদের প্রশ্নের জবাব আসে সুরা বাকারা-এর এই আয়াতে: পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোতে কোনো পুণ্য নেই; কিন্তু পুণ্য আছে আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, সব কিতাব ও নবিদের ওপর বিশ্বাস করলে করলে…। (২:১৭৭)। এই নির্দেশনাটি আসলে ইহুদিদের জন্য ছিল একটি সতর্কবার্তা। তাদের উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে গেল যখন ছোটোখাট আকসিক অভিযান ও মক্কার বাণিজ্যিক কাফেলার ওপর গাজওয়ার সাফল্য আসতে লাগল। ইহুদিদের উৎকণ্ঠার চূড়ান্ত পরিণতি দেখা গেল বদরের ময়দানে। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে কুরাইশদের বিপক্ষে নবি এবং সাহাবিদের বিজয়ের মাধ্যমে। এবার ইয়াসরিবের ইহুদিরা মুখোমুখি হলেন আউস ও খাজরাজ গোত্রের সাথে। যাদের একদা কিছুই ছিল না, তারপরও ইহুদি মালিকদের অধীনে তাঁরা কাজ করতে উৎসাহী ছিলেন না। ইহুদিরা দেখলেন মুহাজির আর আনসাররা নবি মুহাম্মদের পতাকাতলে মিলিত হয়ে একটি শক্তিশালী জোটবদ্ধ সংগঠন গড়ে তুলেছেন, যার আসল নাম ইসলাম। ইসলামের উত্থানে মক্কায় গিয়ে পরাজিত কুরাইশদের প্রতি সহমর্মিতা জানালেন। কুরাইশদেরকে মুহাম্মদ এবং তার অনুসারীদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য তাগিদ দিলেন। এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় সুরা নিসা-এর এই আয়াতে: তুমি কি তাদেরকে দেখনি যাদেরকে কিতাবের এক অংশ দেয়া হয়েছিল? তারা প্রতিমা ও অসত্য দেবতার ওপর বিশ্বাস করে। তারা অবিশ্বাসীদের সম্বন্ধে বলে যে, বিশ্বাসীদের চেয়ে এদের পথই ভালো।’(৪:৫১)। এই আয়াতে পৌত্তলিকতা ও মূর্তিপূজা নিষেধকারী ধর্মশাস্ত্রের অধিকারী বলে দাবি করা লোকদেরকে তিরস্কার করা হয়েছে যারা কিনা আবার পৌত্তলিকদের সাথেই ঐক্য গড়ে তোলে এবং নবি মুহাম্মদের একেশ্বরবাদী অনুসারীগণের তুলনায় সেই সব পৌত্তলিকদের বড় দেখানোর চেষ্টা করে।

এ-সন্ধিক্ষণে ইয়াসরিবের বাজারে একটি সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে বানু কায়নোকার গোত্রের সাথে সংঘর্ষ বাধে। এর সমাপ্তি ঘটে মুসলমানদের দ্বারা কায়নোকা গোত্রের রাস্তা দখলের মাধ্যমে। ইয়াসরিব নিবাসী একজন আনসার নারী কায়নোকা গোত্রের একজন স্বর্ণকারের দোকানে গিয়েছিলেন। স্বর্ণকার নারীকে দেখে কৃত্রিম ভালোবাসা দেখাতে শুরু করে এবং ওই নারী তা প্রত্যাখ্যান করেন। প্রতিশোধ স্পৃহার বশবর্তী হয়ে স্বর্ণাকার তখন নারীকে হয়রানি করেন এবং চেয়ারের সাথে ওই নারীর ঘাগরা ও ব্লাউজ পিন মেরে আটকে দেয়। নারীটি যখন ওঠে দাঁড়ান তখন পোশাকের নিম্নভাগ উন্মোচিত হয়ে যায় এবং উপস্থিত লোকজন হাসিতে ফেটে পড়ে। ওই নারী উচ্চস্বরে প্রতিবাদ জানালে একজন মুসলমান তার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন। ক্রুদ্ধ মুসলমান ওই স্বর্ণকারকে হত্যা করেন। এ-খবর শোনা মাত্র অন্য ইহুদিরা স্বর্ণাকারের সাহায্যে এগিয়ে আসেন এবং ওই মুসলমান ব্যক্তিকে তারা হত্যা করেন। গোটা ঘটনাটিই দ্রুত দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটায়। মুসলমানরা নবির কাছে বিচারের দাবি জানান। তাঁরা নবির অনুমতিক্রমে বানু কায়নোকা গোত্রের বসতিতে প্রবেশের রাস্তা জোরপূর্বক দখলে নিলেন এবং কায়নোকা গোত্রের খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হল। পনের দিন পর প্রস্তাবিত কিছু শর্ত মেনে বানু কায়নোকা গোত্র আত্মসমর্পণ করে। শর্তগুলো হল তাদের জীবন রক্ষা পাবে তবে ইয়াসরিব ছেড়ে চলে যেতে হবে। যাবার আগে তারা সমস্ত সম্পদ একত্রে জমা করবে, সেখান থেকে ভারবাহী পশু বহনে সক্ষম সম্পদগুলো বাদ দিয়ে বাকিগুলো ওই স্থানে রেখে যাবে যা ইয়াসরিবের গৃহহীন, দরিদ্র মুহাজিরদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।

এ-ঘটনার পর ইয়াসরিবে মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট সুসংহত হয়। আর স্বাভাবিকভাবে ইহুদি গোত্রগুলো আতঙ্কিত মুহাম্মদ বিন মাসলামা। বানু-নাজির গোত্রের কাব বিন আল-আশরাফের রক্তের দাম নির্ণয়ে নবি এবং তার অনুসারীদের সাথে বিতর্ক হয়। এ-সময় সুযোগ বুঝে নবিকে হত্যা করতে গেলে মুসলমানদের সাথে লড়াই বেধে যায় বানু-নাজির গোত্রের। নবির আদেশে যুদ্ধ শুরু হলে মুসলমানরা বানু-নাজির গোত্রের বসতিতে প্রবেশের রাস্তা অবরোধ করে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিলেন। বানু-নাজির পূর্ব থেকেই যুদ্ধের কৌশল কিছুটা আন্দাজ করায় তারা বানু কায়নোকা থেকে তীব্রভাবে পাল্টা আক্রমণ করে। মুসলমানরাও সাহসিকতার সাথে লড়াই করছিলেন। বানু-নাজিরের লড়াকু প্রতিক্রিয়া দেখে নবি আশঙ্কা করলেন মুসলমানরা হয়তো যুদ্ধের ময়দানে টিকে থাকতে পারবেন না, তারা আরবের ঐতিহ্যগত পরিবর্তশীলতায় বশীভূত হয়ে নিজেদের ঘরে ফিরে যাবে। তিনি দ্রুত আদেশ দিলেন বানু-নাজির গোত্রের খেজুরগাছগুলো যেন পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

উট এবং ভেড়ার মতো খেজুরগাছও আরবের অন্যতম খাদ্য ও সম্পদের উৎস। বানু-নাজির এ-ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তারা নবিকে প্রশ্ন করে: কিভাবে এই কাজটি করা সম্ভব হল?”, তাহলে কিভাবে আপনি নিজেকে সতর্ককারী হিসেবে এবং মন্দ ও ধ্বংসের বিরোধী হিসেবে দাবি করেন, যেখানে আপনি নিজেই একটি উৎপাদনশীল উৎসভাণ্ডার ধ্বংস করে দিয়েছেন। এই প্রশ্নবাণে নবি পশ্চাৎপদ হননি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নাজিল হলো সুরা হাশর-এর এই আয়াতগুলো: আল্লাহ ওদেরকে নির্বাসন দেয়ার সিদ্ধান্ত না করলে পৃথিবীতে অন্য শাস্তি দিতেন; আর পরকালে ওদের জন্য রয়েছে আগুনের শাস্তি। উহা এজন্য যে ওরা আল্লাহ ও তার রসুলের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল। আর কেউ আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করলে, আল্লাহ তো শাস্তিদানে কঠোর। তোমরা যে কত খেজুরগাছ কেটেছ আর কতক না-কেটে রেখে দিয়েছ, তা তো আল্লাহরই অনুমতিক্রমে। উহা এজন্য যে, এ দিয়ে আল্লাহ সত্যত্যাগীদেরকে অপদস্থ করবেন।’(৫৯:৩-৫)। এই আয়াতত্ৰয়ের গৃঢ় অর্থ হচ্ছে শেষ পরিণতি দ্বারাই যুদ্ধজয়ের পদক্ষেপগুলো নির্ধারিত হয়। অমানবিক হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধের এই কৌশল তৎকালীন আরব গোত্রগুলোর কাছে গৃহীত হয়েছে। অষ্টম হিজরিতে (৬৩০ খ্রিস্টাব্দ) সাকিফ গোত্রের সাথে লড়াইয়ে এবং তায়েফ দখলের সময়েও নবি এই আয়াতগুলো ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে (৬১ হিজরি) নবির দৌহিত্র এবং হজরত আলির পুত্র হোসেন বিন আলিকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য উমাইয়া সেনারাও প্রাসাদে নারী-শিশুসহ সকলের জন্য খাদ্য-পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। যা হোক, বানু-নাজির গোত্র শেষ পর্যন্ত বিশ দিন পর আত্মসমর্পণ করে। খাজরাজ গোত্রের কয়েকজন নেতার মধ্যস্থতায় এই মতৈক্যে পৌছানো হলো বহনযোগ্য সকল সম্পদ একটি নির্দিষ্ট জায়গায় মুসলমানদের মধ্যে বিতরণের জন্য জমা রেখে তারা নিরাপদে ইয়াসরিব ত্যাগ করবে।

ইয়াসরিবে অবস্থানকারী বাকি একমাত্র ইহুদি গোত্র ছিল বানু কুরাইজা। ৬২৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে (হিজরি ৫ম বর্ষে) তাদের অবস্থা খারাপ হয়। অভিযোগ পাওয়া গেল তারা ইয়াসরিবে থেকে মক্কার কুরাইশদের সাথে যোগাযোগ করছে এবং কুরাইশদেরকে সাহায্য করতেও রাজি হয়েছে। নবি কৌশলে কুরাইজার মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি করেছেন, ফলে তারা শেষ পর্যন্ত আবু সুফিয়ান বাহিনীকে সহায়তা করেনি। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান যখন মদিনা দখলের আশা ত্যাগ করে অবরোধ তুলে নিলেন মুসলমানরা তখন বানু কুরাইজার রাস্তা পচিশ দিন ধরে অবরোধ করে রাখেন। কুরাইজা গোত্র তখন তাৎক্ষণিকভাবে অন্য গোত্রের ন্যায় আত্মসমর্পণের চুক্তি করে সহায়সম্পত্তি জমা দিয়ে নিরাপদে স্থান ত্যাগ করার জন্য রাজি ছিল। কিন্তু আবু সুফিয়ানের সাথে সম্পর্ক রাখার কারণে নবি তাদের উপর খুব রুষ্ট ছিলেন। ফলে তিনি তাদেরকে এই সুযোগ দিলেন না। তিনি হয়তো আরও চিন্তা করেছিলেন ইসলামের গরিমা বৃদ্ধির জন্য এবং প্রতিপক্ষের প্রতি ভীতিপ্রদ সতর্কবার্তার জন্য ধ্বংসও প্রয়োজন আছে। পূর্বের দুইটি ইহুদি গোত্র খাজরাজ গোত্রের নেতাদের হস্তক্ষেপে মুক্তি পেয়েছিল। কুরাইজা গোত্র এবার আউস গোত্রের সাহায্য কামনা করলেন। নবিও মুসলমানদের পক্ষে আউস গোত্রের একজনকে মধ্যস্থতাকার নিয়োগ দিলেন। তার নাম সাদ ইবনে মুয়াজ। তিনি পূর্ব থেকেই কুরাইজা গোত্রের ওপর ক্ষিপ্ত এবং কুরাইজা গোত্রের বিরুদ্ধে অবরোধ চলার সময় তিনি লড়াইয়ে আহত হয়েছিলেন। ক্ষুব্ধ সাদ ইবনে মুয়াজ রায় দিলেন কুরাইজা গোত্রের সকল পুরুষকে হত্যা করা হবে, তাদের নারী-শিশুকে দাস হিসেবে বিক্রি করা হবে এবং তাদের সম্পত্তি মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।

এই সিদ্ধান্ত অন্যায্য হওয়া সত্ত্বেও তা পরিবর্তনের সুযোগ ছিল না। কারণ আউস গোত্রের লোকেরা সাদ ইবনে মুয়াজের রায় মেনে নিয়েছিলেন। একটি টেকসই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক সময় অনেক নির্দয় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কুরাইজা গোত্রের বিরুদ্ধেও তাই এ-রকম সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ইয়াসরিবের বাজারে কিছু পরিখা খনন করা হয়েছিল যাতে যুদ্ধের সময় নিরাপদে স্থান ত্যাগ করা যায়। ওই পরিখাগুলো কুরাইজা গোত্রের আত্মসমর্পণকৃত সাতশজন (ভিন্নসূত্র মতে এক হাজার সংখ্যক) পুরুষ ইহুদির শিরোচ্ছেদকৃত দেহ দাফন করা হয়। অবশ্য সাদ ইবনে মুয়াজের নির্দেশ অমান্য করে একজন ইহুদি নারীকেও হত্যা করা হয়েছিল। তিনি ছিলেন কুরাইজা গোত্রের হাসান আল-কুরাইজির স্ত্রী। তিনি বিবি আয়েশার বান্ধবী ছিলেন। মৃত্যুর আগ মুহুর্তে তিনি বিবি আয়েশার সাথে কথা বলছিলেন। পরে তিনি সহাস্যে এবং উৎফুল্ল চিত্তে শিরোচ্ছেদের স্থানে হেঁটে গেলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল বানু কুরাইজা গোত্রের বিরুদ্ধে অবরোধের সময় তিনি মুসলমানদের ওপর পাথর ছুড়ে মেরেছিলেন। ওই নারী সম্পর্কে বিবি আয়েশার বক্তব্য ছিল: ‘আমি তার মতো সুন্দরী, ভদ্র এবং দয়ালু মহিলা কখনো দেখিনি। তিনি যখন শিরোচ্ছেদের স্থানে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন, আমি তাকে বললাম, আপনাকে নির্ঘাৎ হত্যা করা হবে। তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, বেঁচে থাকাটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *