১.৫ নবুওতি অর্জনের পর

প্রথম অধ্যায় । নবি মুহাম্মদ । নবুওতি অর্জনের পর

মুহাম্মদের বয়স যখন চল্লিশ, তখন এক প্রত্যাদেশ দ্বারা আল্লাহ মুহামদকে প্রেরিত পুরুষ হিসেবে নিয়োজিত করেন। প্রত্যাদেশের এই বাণী সুরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াতে বর্ণিত আছে। কিন্তু ইসলামের প্রচার কবে থেকে শুরু হয়েছে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না, কারণ ওহি নাজিল হওয়াতে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিঘ্ন ঘটেছে একাধিকবার। প্রথম দিকে ইসলামের প্রচার হয়েছে গোপনে এবং সামান্য কয়েকজন ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সুরা আলাকের পরে আরও সাতটি কিংবা দশটি সুরা প্রকাশ পায়। এ-থেকে প্রতীয়মান হয় যে শুরুতে ইসলামের প্রচার মক্কাবাসীর কাছে উপহাস্যবলে পরিগণিত হয় এবং প্রত্যাখাত হয়। মুহামদ তখন বিমর্ষ হয়ে যান, তার মধ্যে দ্বিধাবোধ তৈরি হয়। ইসলামের জন্য এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, কোরান সম্পাদিত হয়েছে অগোছালোভাবে। কোরানের বিষয়বস্তুকে নিতান্ত এলোমেলোভাবে সাজানো হয়েছে। যারা কোরান অধ্যয়ন করবেন তারা বিসিত হবেন যে, কোরানের সংকলকেরা কেন সুরা বা আয়াতের আগমনের ধারা অনুযায়ী কোরানের সুরা ও আয়াতগুলোকে বিন্যস্ত করেননি। মুহাম্মদের চাচাতো ভাই হজরত আলি বিন আবু তালিব সময়ের ক্রমানুযায়ী একটি কোরান সংকলন করেছিলেন; যদিও তা পরবর্তীতে হারিয়ে যায়। সময়কাল অনুযায়ী কোরান সংকলন হলে কোরানের বিষয়বস্তু অনেক অর্থবহ ও বাস্তবসম্মত হত, এবং এর ফলে ভবিষ্যত প্রজন্ম ইসলামের উত্থান এবং এর প্রতিষ্ঠাতার অনুপ্রেরণা ও চিন্তাভাবনার সাথে সহজে পরিচিত হতে পারতো।
কোরান সংকলনের প্রথম পদক্ষেপ নেন হজরত ওমর। আবু বকর খলিফা হবার পর ওমর তাঁর সাথে দেখা করে কোরান সংকলনের পক্ষে যুক্তি দেখান। হজরত ওমর বলেন, নবির মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই কোরানের বিষয়বস্তু ও শব্দের ব্যাখ্যা নিয়ে মুসলমিদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হচ্ছে। বিষয়টি খুব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ কোরানের বাণী যেসব সাহাবি মুখস্ত রাখতেন তাদের কেউ কেউ ইয়ামামার যুদ্ধে মারা গেছেন। এছাড়া তাল গাছের পাতায় লিখিত কোরানের বাণী খেয়ে ফেলেছে পশুরা। ওমরের বক্তব্যে হজরত আবু বকর আপত্তি জানালেন। তিনি বললেন : কোরানের সংকলন যদি আবশ্যিকই হতো তাহলে নবি তাঁর জীবিত থাকাকালেই এ-বিষয়ে পদক্ষেপ নিতেন। এরপরও ওমরের দীর্ঘ অনুরোধের জন্য শেষমেশ মদিনার খাজরাজ গোত্রে জন্মগ্রহণকারী সাহাবি জায়েদ বিন সাবিতকে ডাকা হয়। জায়েদ ছিলেন মুহাম্মদের সর্বশেষ কোরান লেখক। খলিফা আবু বকর জায়েদকে কোরান সংকলনের ভার অর্পণ করেন। আবু বকরের পর ওমর খলিফা হলে কোরান সংকলনের ভার গিয়ে পৌছায় হজরত উসমানের উপর। উসমান তাঁর সহকর্মীদের আদেশ দিলেন কোরানের সুরার দৈর্ঘ্য অনুযায়ী কোরানের সংকলনের জন্য। এতে করে মক্কার অনেক আয়াত মদিনার সুরাতে এবং মদিনার আয়াত মক্কার অনেক সুরাতে ঢুকে পড়ে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ও ইউরোপের গবেষক বিশেষ করে থিওদর নোলদেক কোরানের বিষয়বস্তুর অবিচ্ছন্নতা, ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ ও ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে সুরাগুলির মানে ও মোটামুটি তারিখ অনুযায়ী কোরান বিন্যস্ত করেছেন”। যা-হোক, প্রারম্ভিক মক্কার সুরাগুলিতে ইসলামের প্রথম কয়েক বছরের প্রচুর সংগ্রামের বিবরণ পাওয়া যায়। সুরা দোহার প্রথম দুই আয়াতের পরই আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন :
‘তোমার প্রতিপালক তোমাকে ছেড়ে যাননি ও তোমার ওপর তিনি অসন্তুষ্টও নন।
তোমার জন্য পরকাল ইহকালের চেয়ে ভালো।
তোমার প্রতিপালক তো তোমাকে অনুগ্রহ করবেনই আর তুমিও সন্তুষ্ট হবে।
তিনি কি তোমাকে ভুল পথে পেয়ে পথের হদিস দেননি?
তিনি কি তোমাকে অভাব দেখে অভাবমুক্ত করেননি? ( সুরা দোহা আয়াত ৩-৮)।
মুহাম্মদের কী হয়েছিল যে আল্লাহ তাঁকে সান্তনা দিবেন এবং উৎসাহিত করবেন? সুরা দোহার তৃতীয় আয়াতে আল্লাহ বলছেন : ‘তোমার প্রতিপালক তোমাকে ছেড়ে যাননি ও তোমার ওপর তিনি অসন্তুষ্টও নন -এই আয়াতটা কী প্রত্যাদেশ প্রেরণের যে বিরতিটুকু চলছিলতা শেষ হবার পর নাজিল হয়েছিল! প্রত্যাদেশ প্রেরণের মধ্যবর্তী বিরতিতে মুহাম্মদ কি বা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন এই ভেবে যেতাঁর রব তাঁকে হয়ত ত্যাগ করেছেন? পরে তিনি নিজেকে যা দিয়ে প্রবোধ দেন সেটাই হয়ে দাঁড়ায় সুরা দোহা। ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এ সুরা নিজের সাথে নিজের কথা বলা মাত্র। যদি কোরান অবতরণের উদ্দেশ্য থাকে মানব জাতিকে সঠিক পথে পরিচালনা করা তবে সেক্ষেত্রে এই সুরার কোনো উপযোগিতাই নেই, একই কথা অন্যান্য অনেক সুরা ও আয়াতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য]। তফসির আল-জালালাইনে এভাবেই লেখা হয়েছে। এই ধারণা যদি সঠিক হয় তবে কালানুক্রম অনুযায়ী সুরা দোহা কোরানের দ্বিতীয় সুরা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ধারাবাহিকতার ক্রম হিসেবে ১১তম সুরা ধরা হয় এবং বর্তমান কোরানের সংকলনে এটির অবস্থান ৯৩তম। সুরা দোহা পাঠ করলে বোঝা যায় এই সুরায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মুহামদকে আল্লাহ সান্তনা এবং উৎসাহ দিচ্ছেন। এই ধারণা করা যায় যখন আমরা সুরা দোহার পরবর্তী ৯৪তম সুরা ইনশিরাহ এর প্রথম দুটি আয়াত পাঠ করি। কালানুক্রমিকভাবে ইনশিরাহকে ১২তম বলে ধরা হয়। এই সুরার আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ মুহাম্মদকে বলছেন : ‘আমি কি তোমার বক্ষ উন্মুক্ত করিনি? আমি হালকা করেছি তোমার ভার (৯৪:১-২)। এই দুই আয়াত ও অন্য আয়াতগুলি এবং এর পূর্বের সুরা দোহার বিষয়বস্তু প্রায় একই। তাই বলা যায়, এই দুই সুরায় আল্লাহ মুহাম্মদের দুশ্চিন্তা লাঘব করে তাঁর দৃঢ়সংকল্পকে শক্তিশালী করেছেন। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে বলা যায়, আসলে এই দুইটি সুরা মুহাম্মদের মনের ভেতরে লুকায়িত ইচ্ছা ও আশার প্রতিফলন মাত্র।
ইসলাম প্রচারের শুরুর দিকে মুহামদ গোপনে অল্পসংখ্যক ব্যক্তিদের মধ্যেই তাঁর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখেন। পরে সুরা শোআরার ২১৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ নতুন এক আদেশ দিলেন : “তুমি তোমার আতীয়স্বজনকে সতর্ক করে দাও।”(২৬:২১৪)। এই আয়াত প্রাপ্ত হয়ে মুহাম্মদ (৬১৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে) কুরাইশ নেতাদের সাফা পর্বতে এক সভায় ডাকলেন। তারা সমবেত হলে মুহাম্মদ তাঁদেরকে ইসলাম গ্রহণের জন্য আবেদন জানান। নেতাদের মধ্যে থেকে মুহাম্মদের চাচা আবু লাহাব উঠে দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে ও ক্রুদ্ধস্বরে বললেন : মুহাম্মদ, তুমি ধ্বংস হও! তুমি কী এ-জন্য আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছ? আবু লাহাবের ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণের জবাব আসলো ১১১তম সুরা লাহাব বা আল-মাসাদের মধ্য দিয়ে। এই সুরার প্রথম আয়াতে আবু লাহাবের উচ্চারিত শব্দ অর্থাৎ ধ্বংস হও ব্যবহৃত হয়েছে : “ধ্বংস হোক আবু লাহাবের দুই হাত! আর সে নিজে। (১১১:১) আবু লাহাব তার সম্পদ এবং সন্তানদের জন্য গর্বিত ছিল। তাই আল্লাহ জানিয়ে দিলেন :
তার ধনসম্পদ ও উপজিন তার কোনো কাজে আসবে না।
সে ভুলবে অগ্নিশিখায় ( ১১১: ২-৩) /
মুহাম্মদ যে পথ দিয়ে হাটতেন সে পথে আবু লাহাবের স্ত্রী উমে জামিল কাঁটা বিছিয়ে রাখতেন। তিনিও আল্লাহর শাস্তি থেকে নিস্তার পেলেন না। নাজিল হলো পরবর্তী আয়াত :
‘আর তার জ্বালানিভারাক্রান্ত স্ত্রীও, যার গলায় থাকবে কড়া আঁশের দড়ি।’ (১১১:৪-৫)।
নবি হবার পর তেরো বছরের ঘটনাসমূহ এবং সর্বোপরি মক্কায় নামানো সুরাগুলি পাঠ করলে মনে হয় এ-যেন একজন ব্যক্তির উপাখ্যান যিনি একা তাঁর গোত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন এবং তাদেরকে বোঝানোর জন্য ও তাদের বিরোধিতা অতিক্রম করার জন্য কোনো পদ্ধতিই বাদ দেননি। এমন-কী সাহায্যের জন্য আবিসিনিয়ার সম্রাট নিগাসের নিকট তিনি তাঁর কয়েকজন অনুগতকে পাঠালেন। উপহাস ও বিরোধিতার মুখে মুহাম্মদ কখনো পিছপা হননি। যখন মুহাম্মদের পুত্র কাসেম মারা যায় তখন আলাস বিন ওয়ায়েল মুহাম্মদকে উপহাস করেন উত্তরাধিকারহীন বলে। এজন্য সুরা কাউসারে বলা হলো : যে তোমার দুশমন, সে-ই তো নির্বংশ।’ (১০৮:৩)। হজের সময় অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি তীর্থযাত্রী হতেন। যখন মুহামদ প্রভাবশালী লোকদের ইসলামে দীক্ষিত হবার আমন্ত্রণ জানাতেন তখন তাঁর চাচা আবু লাহাব তাঁকে অনুসরণ করতেন এবং তীর্থযাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলতেন । আমার এই ভ্রাতুষ্পপুত্র এক পাগল। সে কী বলে তার প্রতি আপনারা কর্ণপাত করবেন না। সুরা তুর কোরানের জীবন্ত এবং সুরেলা সুরাগুলোর মধ্যে অন্যতম মক্কি সুরা। মুহাম্মদের সাথে তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও স্বদেশবাসীর বচসার বর্ণনা এই সুরায় পাওয়া যায়। এখানে এই সুরার ২৯-৩১ এবং ৩৩-৩৪ আয়াতের উদ্ধৃতি দেয়া হলো :
অতএব তুমি উপদেশ দিতে থাকো তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহে তুমি ভবিষ্যদ্বক্তা বা পাগল নও।
ওরা কি বলে সে এক কবি আমরা তার অনিশ্চিত দেবের (মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছি2
বলো তোমরা প্রতীক্ষা করে আমিও তোমাদের সঙ্গে প্রতীক্ষা করছি। ”
ওরা কি বলে এ (কোরান) তার নিজের রচনা2 না তারা বিশ্বাস করে না।
তারা যদি সত্যবাদ হয় এর মতো কোনো রচনা নিয়ে আসুক-না/’ (৫২:২৯-৩১, ৩৩-৩৪) /
মুহাম্মদের সাথে তাঁর স্বদেশবাসীদের বাদানুবাদের আরও উদাহরণ পাওয়া যাবে মক্কি সুরা তাহায় (২০)। মুহাম্মদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছিল তার বর্ণনা পাওয়া যায় সুরা ফুরকানে : অবিশ্বাসীরা বলে, “এ মিথ্যা ছাড়া কিছুই নয়। সে (মুহাম্মদ) এ বানিয়েছে ও অন্য সম্প্রদায়ের লোক তাকে এ-ব্যাপারে সাহায্য করেছে। ওরা তো সীমালঙ্ঘন করে ও মিথ্যা বলে। ওরা বলে, “এগুলো তো সেকালের উপকথা যা সে লিখিয়ে নিয়েছে। এগুলো সকাল-সন্ধ্যা তাকে শেখানো হয়। ’ বলো, “এ তিনিই অবতীর্ণ করেছেন, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর সব রহস্য জানেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ওরা বলে, “এ কেমন রসুল যে খাবার খায় ও হাটে-বাজারে চলাফেরা করে! তার কাছে কেন ফেরেশতা পাঠানো হয় না যে তার সঙ্গে থাকবে ও ভয় দেখাবে, বা তাকে ধনভাণ্ডার দেওয়া হয় না কেন, বা তার একটাও বাগানও নেই কেন যেখান থেকে সে তার খাবার যোগাড় করতে পারবে? সীমালঙ্ঘনকারীরা আরও বলে, “তোমরা তো এক জাদুগ্রস্ত লোকের অনুসরণ করছ!’ (সুরা ফুরকান ; আয়াত 8:৮)
মুহাম্মদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিবরণ একাধিক মক্কি সুরাতে রয়েছে। মক্কাবাসীরা তাঁকে বলতো, উন্মাদ, জিনের প্রভাবে আক্রান্ত, একজন জাদুকর, কবি এবং শয়তানের দোসর। কোরানের আয়াতগুলোকে বলা হলো জাদুমন্ত্র। কখনো বলা হলো যে,
মুহাম্মদের মুখনিঃসৃত বাক্য যা নিশ্চিতভাবে অন্যের দ্বারা লিখিত, কেননা তিনি লেখাপড়া জানতেন না। যারা তাঁর সমালোচনায় অপেক্ষাকৃত নরম ছিলেন তারা বলতেন মুহাম্মদ আসলে একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, তিনি অলীক স্বপ্নে আচ্ছন্ন অথবা একজন কবি যিনি তাঁর কল্পনা প্রকাশ করছেন ছন্দযুক্ত গদ্যের মধ্য দিয়ে।
মক্কি সুরাতে অনেক আয়াত রয়েছে যেগুলো সুরার প্রধান বাদানুবাদ থেকে বিচ্যুত। এ-থেকে বোঝা যায় মুহাম্মদ প্রবল বিরোধিতার মুখে কখনো নিরাশ হয়ে যেতেন এবং তাঁর সংকল্প দুর্বল হয়ে যেত। ফলে তাঁর মধ্যে অপোষ করার ভাবনা তৈরি হয়। তিনি মনে করলেন এই আপোষের বিনিময়ে তাঁর বিপক্ষের লোকের থেকে শক্রতা মুক্ত হয়ে বন্ধুত্ব পেতে পারবেন। তিনি পৌত্তলিকদের সাথে সমঝোতায় আসার কথা বিবেচনা করলেন। এই বিষয়ে সুরা বনি-ইসরাইলে বর্ণিত হয়েছে : ‘আমি তোমার কাছে যে প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছি তার থেকে তোমার বিচ্যুতি ঘটানোর জন্য ওরা চেষ্টা করবে যাতে তুমি আমার সম্বন্ধে কিছু মিথ্যা কথা বানাও, তা হলে, ওরা অবশ্যই বন্ধু হিসেবে তোমাকে গ্রহণ করবে। আমি তোমাকে অবিচলিত না রাখলে তুমি ওদের দিকে কিছুটা ঝুঁকেই পড়তে। তুমি ঝুঁকে পড়লে অবশ্যই আমি তোমাকে ইহজীবন ও পরজীবনে দ্বিগুণ শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করাতাম, তখন আমার বিপক্ষে তোমাকে কেউ সাহায্য করত না।’ ( ১৭:৭৩-৭৫)।
উক্ত তিনটি আয়াতের বিশ্লেষণ প্রয়োজন রয়েছে। সত্যি কী একটা সময় ছিল যখন কুরাইশদের প্রবল বিরোধিতার মুখে মুহাম্মদ ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং আপোষ অথবা নিদেনপক্ষে কিছু সৌভ্রাতৃত্ব স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন? হয়তোবা এ-বিষয়টি সত্য হতে পারে। মানব-চরিত্র এমনই যে, সে সমস্যায় পড়লে অথবা যখন জয়ের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে যায় তখন এই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এছাড়াও কোরানের অনেক তফসিরকারক বলেছেন, এই আয়াতগুলোর পরিপ্রেক্ষিত ছিল একটা ঘটনা যাকে সারসের ঘাড় বাঁকানোর ঘটনাবলা হয়ে থাকে। এই ঘটনার বিবরণ মুহাম্মদের অনেক জীবনীকারক বর্ণনা করেছেন।
এই বর্ণনানুযায়ী একদা কাবার নিকটবর্তী এক স্থানে নবি কয়েকজন কুরাইশের কাছে সুরা নজম আবৃত্তি করে শোনান। ছন্দোবদ্ধ এই সুরায় যেমন আছে আধ্যাত্মিক অনুভূতি, তেমনি মন কেড়ে নেবার শক্তি। নবি যখন তাঁর ধর্মের সত্যতা ব্যাখ্যা করছিলেন তখনই ফেরেশতা নিয়ে আসলেন এক নতুন অনুপ্রেরণা। ফলে নবি উচ্চারণ করলেন সেই প্রসিদ্ধ আয়াতদ্বয় ; তোমারা কি ভেবে দেখেছ লাত ও ওজা সম্বন্ধে, আর তৃতীয়টি মানাত সম্বন্ধে? (৫৩:১৯-২০)। আয়াত দুটি উচ্চারণের সময় নবির গলার স্বর ছিল প্রায় ঘৃণাপূর্ণ, অর্থাৎ নবি বোঝাতে চেয়েছিলেন এইসব মূর্তিগুলো আসলে অসার। কিন্তু এরপর নেমে আসলো আরও দুটি আয়াত, যা পরবর্তীতে কোরান থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে যে, আয়াত দুটি নাকি শয়তান নবির মুখে দিয়েছিল, যার জন্য নবি পরে আক্ষেপ করেছেন। আয়াতদ্বয় ছিল : ‘এরা হচ্ছে সেই উড়ন্ত সারস। তাই এদের মধ্যস্ততা আশা করা যেতে পারে। এ-কথা বলে নবি নতজানু হলেন। তা দেখে তাঁর সাথে কুরাইশরাও নতজানু হলেন তিন দেবীকে সম্মান দেখানোর জন্য। তারা ভাবলো এতদিন পরে মুহাম্মদ তিন দেবীর মধ্যস্থতার ক্ষমতা স্বীকার করে নিয়েছেন।
যারা মনে করেন নবি মুহাম্মদ ছিলেন ভুলভ্রান্তির উর্ধ্বে তাঁরা আসলে অস্বীকার করবেন যে, মুহামদ কোনোদিনই এমন কথা বলেননি যা তাঁর নীতির সাথে সামঞ্জস্যহীন। তাই তাঁরা ঐ কাহিনীকে মিথ্যা বলে অভিহিত করেন। এমনকি কোরান থেকে দুটি আয়াত মুছে ফেলতেও দ্বিধা করেননি। এরপরও অনেক প্রামাণ্য দলিল এবং কোরানের তফসিরকারকদের মন্তব্য থেকে বোঝা যায় আসলেই এ-ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। কোরানের বিখ্যাত তফসিরগ্রন্থ তফসির আল-জালালাইনে লেখা হয়েছে ঐ দুই আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হয় আরও একটি আয়াত। সুরা হজের আয়াত ৫১। ধারণা করা হয় সুরা নজমের দুটি আয়াত উচ্চারণের জন্য নবির মনে তীব্র অনুশোচনা সৃষ্টি হয় তা থেকে নিবৃত্তির জন্য এবং নবিকে সান্তনা দেবার জন্য সুরা হজের এই বিশেষ আয়াত নাজিল হয়। নবিকে এই বলে আশ্বস্ত করা হয় ; আমি তোমার পূর্বে যেসব নবি ও রসুল পাঠিয়েছিলাম তারা যখনই কিছু আবৃত্তি করত তখনই শয়তান তাদের আবৃত্তিতে বাইরে থেকে কিছু ছুড়ে ফেলত। কিন্তু শয়তান যা বাইরে থেকে ছুড়ে ফেলে আল্লাহ তা দূর করে দেন। তারপর আল্লাহ তাঁর আয়াতগুলোকে সুসংবদ্ধ করেন। আর আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ তত্ত্বজ্ঞানী। (সুরা হজ, ২২:আয়াত (৫২) |
কোরানের অন্যত্র এই ধরনের আয়াত আরও আছে। এই (শয়তান-সংশ্লিষ্ট) আয়াতগুলি ও সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ থেকে এটা পরিষ্কার যে, নবি আসলে ভুলভ্রান্তির উর্ধ্বে ছিলেন না। ইসলামের প্রাথমিক যুগের অনেক পণ্ডিতেরাও এরকম মনে করেন-নবি শুধুমাত্র তাঁর নবুওতির নীতির ক্ষেত্রে ভুলভ্রান্তির উর্ধ্বে ছিলেন। এখন যদি স্বীকার করে নেয়া হয় যে, নবি মুহামদ আসলে ব্যক্তিগত ভুলভ্রান্তির উর্ধ্বে ছিলেন না, তাহলে উপরে বর্ণিত ঘটনার যৌক্তিক এবং সহজ ব্যাখ্যা দেয়া যায়। প্রবল বিরোধিতার মুখে মুহাম্মদ যখন পর্যুদস্ত, তখন কিছু সহনশীলতা ও বন্ধুত্ব দেখানোর প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করেন। তাই কুরাইশদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য কৌশলী হয়ে মিষ্টি বাক্য বললেন। এতে কুরাইশরা খুশি হলেন এবং মুহাম্মদসহ তাঁরা একসাথে নতজানু হলেন। কিন্তু পরবর্তীতে যখন এই উপাখ্যান শেষ হলো এবং সবাই ঘরে ফিরে গেল, নবি মুহাম্মদের মনের ভেতরে শুরু হলো প্রবল তোলপাড়। তিনি অনুভব করলেন কেউ যেন তাঁকে এই ধরনের সমঝোতা না করার জন্য সতর্ক করে দিচ্ছে। কারণ ত্রিশটি বছর ধরে মুহামদ যে আদর্শ ধারণ করে এসেছেন, একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী হয়ে কুরাইশদের পৌত্তলিকতাকে বিরোধিতা করে গিয়েছেন এর সাথে সাংঘর্ষিক। আজকের এই সমঝোতা তাঁর সারা জীবনের বিশ্বাস, আদর্শ, চিন্তা, দর্শন সবকিছুকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেবে। এরপরে সুরা বনি-ইসরাইলের ৭৩-৭৫ আয়াতগুলি তৈরি হয়। উপরে যে যৌক্তিক বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে তা থেকে এই আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা প্রমাণিত হয়। আর শুধুমাত্র অন্য একটি ব্যাখ্যা হতে পারে যে, এই কাহিনী সম্পূর্ণ মিথ্যা। অর্থাৎ মুহাম্মদ নিজেই চেয়েছেন কুরাইশদের সাথে সমঝোতা ও বন্ধুত্ব করতে তথাপি আল্লাহ তাঁকে নিষেধ করে দেন। কিন্তু যেহেতু নবি তাঁর সততা এবং সত্যবাদিতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন তাই এই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *