১০. ইসলামে ধর্ষণ এবং তার চার সাক্ষী

অধ্যায়-১০
ইসলামে ধর্ষণ এবং তার চার সাক্ষী
লেখক: অবিশ্বাসী ফকহুর

ইসলামে ধর্ষণ সংক্রান্ত উদ্ভট চিন্তা এবং আইনআমার সঙ্গে এক নতুন বান্ধবীর পরিচয় হয়েছে। তিনি ইসলামী বিশ্বে নারীদের দুর্ভোগ সম্পর্কে তার উদ্বেগের কথা বলছিলেন। যে বিষয়টির তিনি তীব্র প্রতিবাদ করছিলেন সেটা হচ্ছে ­ পুরুষ ধর্ষণকারীদের ছেড়ে দেওয়া হয়, পক্ষান্তরে ধর্ষণের জন্য প্রায়ই ধর্ষিতা নারীকে দায়ী করা হয় এবং এমনকি শরিয়া আদালতে সাজা দেওয়া হয়।

ইসলাম ধর্ষণ সম্পর্কে যে সব অযৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করে সেগুলোর শিকড় সন্ধানের আগে আমাদের উচিত ইসলামের নবীর সর্বকনিষ্ঠা কিশোরী স্ত্রী আয়েশার দুর্ভোগ সংক্রান্ত গুজবের বিষয়ে জানা। (ব্যাপক বিশ্লেষণ এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। এতে ভিতরের কিছু তথ্য জানানো হয়েছে মাত্র। আমি নিশ্চিত, বিষয়টি নিয়ে কয়েক খণ্ডের বই লেখা যায়।)

আয়েশাকে নিয়ে কেলেঙ্কারির বিস্তারিত তথ্য ইসলামী গ্রন্থ হাদীস এবং সিরায় রয়েছে (যথা, সহিহ্ মুসলিম, পুস্তক ৩৭, সংখ্যা ৬৬৭৩, সহিহ্ বুখারী, তৃতীয় খণ্ড, পুস্তক ৪৮, সংখ্যা ৮২৯)।

বর্ণিত কাহিনীগুলো দীর্ঘ। সংক্ষেপে বলতে গেলে ­ আয়েশা একদল মুসলমান সৈন্যের সঙ্গে যাচ্ছিলেন। একদিন ভুলক্রমে সেনাবাহিনী তাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায়। একজন মুসলমান সেনাদলটির চেয়ে পিছিয়ে পড়েছিল। সে আয়েশাকে খঁজে পায়। আয়েশা তার সঙ্গে মূল বাহিনীর কাছে ফিরে আসেন।

কতিপয় মুসলমান তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যে, তিনি সৈনিকটির সঙ্গে যৌন সঙ্গম করেছেন। আয়েশা দৃঢ়তার সঙ্গে এ অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং অত্যন্ত মর্মাহত হন। কিন্তু গুজব চলতেই থাকে। এক পর্যায়ে কুরআনের আয়াত নাজিল হয়। তাতে ছড়িয়ে পড়া গুজব প্রসঙ্গে আয়েশাকে নির্দোষ বলে ঘোষণা করা হয়।

কুরআন: ২৪:১৩-১৬ : কেন তারা এর জন্য চার জন সাক্ষী আনে নাই? কিন্তু তারা যেহেতু সাক্ষীগণকে আনে নাই সেহেতু তারা আল্লাহর সম্মুখে মিথ্যাবাদী। এবং এটা কি নয় যে, আল্লাহর মহিমা এবং ইহকাল ও পরকালে তার করুণা তোমাদের উপর না থাকলে, যে কথাবার্তা তোমরা বলছ তার জন্য নিশ্চিত ভাবেই কঠিন শাসন তোমাদের স্পর্শ করবে। যার সম্পর্কে তোমাদের কিছু জানা নাই সেটা তোমরা জিহ্বা দ্বারা গ্রহণ করেছ এবং মুখ দিয়ে উচ্চারণ  করেছ। এবং তোমরা এটাকে সহজ ব্যাপার মনে করেছ। পক্ষান্তরে আল্লাহর কাছে বিষয়টি ছিল গুরুতর। এবং যখন তোমরা এটা শুনলে, কেন তোমরা বল নাই : এটা আমাদের উচিৎ নয় যে আমরা এটা নিয়ে কথা বলি; সমস্ত মর্যাদা আপনার। এটা একটা বিরাট মিথ্যা অপবাদ!

কুরআন: ২৪:৪ বলছে যে, যারা চারজন সাক্ষী আনতে পারবে না তাদের বেত্রাঘাত করা হবে; এবং যারা মুক্ত নারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার পর চারজন সাক্ষী হাজির করে না, তাদের বেত্রাঘাত কর, আশিবার দোররা (মার) এবং কখনো তাদের কাছ থেকে কোন সাক্ষ্য গ্রহণ কর না, এবং তারা আইন ভঙ্গকারী।

এর ভিত্তিতে ইসলামী ধর্মতাত্ত্বিকরা বলেন যে, ব্যভিচার বা অনুরূপ যৌন দুষ্কর্ম প্রমাণের জন্য চারজন পুরুষ প্রত্যক্ষদর্শীকে হজির করতে হবে। একজন নারীর সাক্ষ্য হচ্ছে পুরুষের অর্ধেক, এবং তা আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়ে সীমাবদ্ধ (কুরআন ২:২৮২)।

আমি এ ব্যাপারে যা বুঝি (এবং আমি এটা বুঝে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম), চারজন চাক্ষুস সাক্ষীর নিয়ম চালু করা হয়েছিল মুসলমান নারীদেরকে নিষিদ্ধ যৌন সঙ্গমের (জেনা ) মিথ্যা অপবাদ থেকে রক্ষা করার জন্য। কতিপয় ইসলামী আলেম এই নিয়মকে জটিল পরিস্খিতিতেও টেনে এনেছেন, যাতে বলা হয়েছে : একজন নারী যদি দাবী করে যে সে ধর্ষিতা হয়েছে তবে ধর্ষণকারীর বিরুদ্ধে এ মামলা প্রমাণের জন্য তাকে শরিয়া আদালতে চারজন পুরুষ সাক্ষী হাজির করতে হবে। যদি সে চারজন সাক্ষী হাজির করতে না পারে, তার মামলাটি সতীত্ব সংক্রান্ত অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং সে অনুযায়ী তার সাজা হবে। বিকল্প হিসাবে, মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করায় তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে। ফিকাহ শাস্ত্রের একটি ধারায় গর্ভধারণকেও যৌন দুষ্কর্মের পর্যাপ্ত প্রমাণ হিসাবে গণ্য করা হয়। সুতরাং ধর্ষণের শিকার কোন নারী যদি গর্ভবতী হয় এবং সে যদি ধর্ষণ প্রমাণ করতে না পারে তবে তাকে দোররা মারা হবে অথবা পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা হবে।

উদাহরণ স্বরূপ, পাকিস্তান দুই দশকের বেশী সময় ধরে হদুদ অধ্যাদেশ বলবৎ রেখেছে, এবং এতে ধর্ষিতার ক্ষেত্রে উপরে বর্ণিত শর্তগুলো রয়েছে। মাত্র অতি সম্প্রতি একটি নারী সুরক্ষা বিল পার্লামেন্টে পাস হয়েছে যাতে ধর্ষণের শিকার নারীকে প্রচালিত আইনে ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সদস্যরা এ বিলের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। ইরানে, নাজানীন মাহাবাদ ফাতেহী নিজেকে এবং তার ভাইজিকে ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা করার অপরাধে মৃতদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন । নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে তিনি ধর্ষণের চেষ্টাকারী এক জনকে ছুরির আঘাতে মেরে ফেলেন। চারজন পুরুষ সাক্ষী না থাকায় এ ঘটনায় তাকে মৃতদণ্ড দেওয়া হয়। (ব্যাপক আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ ও মিডিয়ায় প্রচারের কারণে পরে তাকে মুক্তি দেয়া হয়)।

আমি এ বিষয়ে বিবিসিতে একটি চমৎকার নিবন্ধ পেয়েছি : নারী ও শরিয়া নিয়ে বিতর্ক জমে উঠেছে।বিপুল সংখ্যক মুসলমানের মনে এমন একটি ধারণাও রয়েছে যে, যদি কোন নারী ধর্ষিতা হয় তবে সেটা সাধারণত তার দোষ; উদাহরণ স্বরূপ, বোরখা না পরে রাস্তায় তার উপস্খিতি বেচারা পুরুষটিকে প্ররোচিত করেছে তাকে ধর্ষণ করতে। পশ্চিমা মুসলমানদের মধ্যে এই কুখ্যাত মানসিকতার একটা উদাহরণ হচ্ছে বর্তমান যুগে বাসকারী ৭ম শতাব্দীর নারী বিদ্বেষী অস্ট্রেলীয় বর্বর তাজ উল দীন আল হিলালী। এক জুম্মার নামাজে সে ফতোয়া দিয়েছিল, যদি কোন নারী ধর্ষিতা হয় তবে সেটা তার দোষ, কারণ সে নিজের বাড়ীতে ছিল না।সে আরো বলেছিল, “যদি তোমরা মাংস নিয়ে রাস্তায়, অথবা বাগানে, অথবা পার্কে , অথবা বাড়ীর পিছনে ঢাকনা বিহীনভাবে রেখে আস, এবং বিড়াল এসে সেটা খেয়ে যায় …. তবে কার দোষ, বিড়ালের নাকি ঢাকনা বিহীন মাংসের ? ঢাকনা বিহীন মাংসই হচ্ছে সমস্যা।”

গোঁড়ারা আসে এবং যায়। কিন্তু তার ক্ষেত্রে বিপত্তির কারণ হচ্ছে সে অস্ট্রেলিয়ার নেতৃস্খানীয় মুসলমান ইমাম, এবং জুম্মার নামাজে দেওয়া খুতবা জানাজানি হওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ার পাঁচ হাজার মুসলমান এর সমর্থনে উল্লাস প্রকাশ করেছিল। অন্য মুসলমান নেতারাও তাকে সমর্থন করেছিল।

আমার এটা পরিষ্কার করা আবশ্যক যে, মুসলমান নারীদেরকে ধর্ষণ করা ইসলামে একেবারেই নিষিদ্ধ। অবশ্য পশ্চিমা দেশগুলোতে এমন কিছু মুসলমান আছে যারা অমুসলমান নারীদেরকে পাশবিকভাবে ধর্ষণ করে, এবং এর জন্য তারা যুক্তি দেখায় যে “বোরখা ছাড়া রাস্তায় বের হওয়ায় এটা মহিলার দোষ।” তারা কুরআনের ৪:২৪ এবং ২৩:৬ আয়াত থেকেও যুক্তি তুলে ধরে যাতে যুদ্ধের পর অমুসলমান নারীদেরকে গনিমতের মাল হিসাবে ধরে নিয়ে দাসী বানিয়ে রাখার জন্য মুসলমানদেরকে অনুমতি দেয়া হয়েছে। ঐ ধর্ষণকারীরা পাশ্চাত্যের দিকে বন্ধুত্বের দৃষ্টিতে তাকায় না এবং তাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত মনে করে; সুতরাং তাদের নারীদেরকে তারা নিজেদের বৈধ সম্পত্তি ভাবে। যদিও আমি কোন পণ্ডিতকে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিতে শুনিনি। এখানে অভিবাসীদের দ্বারা ধর্ষণের ঘটনা বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে।

যে সব পাঠক আশ্চর্য হচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলি: কখনো একজনের কথা সত্য বলে ধরে নিবেন না। নিজেরা গবেষণা করুন এবং অন্যদের জিজ্ঞাসা করে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি জেনে নিন। আমি শতভাগ সঠিক নই; বোকারাই নিজেদেরকে সব সময় সঠিক মনে করে।

(Infidel Fakhour -এর  Rape in Islam and Its Four Witnesses নামক ইংরাজী নিবন্ধটি ইসলাম ওয়াচ  [www.islam-watch.org]-এ ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১০ তারিখে প্রকাশিত হয়। এটি তার বাংলায় ভাষান্তর। লেখক এখন কানাডার অন্টারিওতে বাস করেন। তিনি কানাডার মুসলিম স্টুডেন্টস এসোসিয়েশনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সদস্য। এটি ইসলামী মৌলবাদী সংগঠন “মুসলিম ব্রাদারহুড”-এর সহযোগী সংগঠন)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *