০১. সমাধিপাদ (সমাধি-পাদ)

সমাধিপাদ (সমাধি পাদ)

হিরণ্যগর্ভ এবং অন্যান্য মহাত্মা কথিত যোগশাস্ত্র বলা যাইতেছে।।১।।

চিত্তবৃত্তি সকলের নিরোধের নাম যোগ।।২।।

চিত্তবৃত্তির নিরোধ হইলে দ্রষ্টা (আত্মা) স্বরূপে অবস্থিত হন।।৩।।

সেই অবস্থিতিকালে আত্মার স্বরূপ অপ্রচ্ছন্ন থাকে। এতদ্ভিন্ন অন্য কোন সময়ে তিনি নানা মনোবৃত্তির সহিত সংযুক্ত থাকায়, তৎস্বরূপ অপ্রকাশিত থাকে।।৪।।

পঞ্চপ্রকার মনোবৃত্তি। সেই পঞ্চপ্রকার আবার দ্বিধা বিভক্ত হইয়াছে। এক প্রকারের নাম ক্লিষ্ট (ক্লেশদায়ক)  এবং অপর প্রকারের নাম অক্লিষ্ট (ক্লেশ বিনাশক)।।৫।।

প্রমাণ, বিপর্য্যয়, বিকল্প, নিদ্রা ও স্মৃতিকেই পঞ্চপ্রকার মনোবৃত্তি বলা যায়।।৬।।

প্রমাণবৃত্তির অন্তর্গত প্রত্যক্ষ, অনুমান ও আগম।।৭।।

যাহা ভ্রমাত্মক মিথ্যাজ্ঞান, ভ্রম অপনীত হইলে, যে জ্ঞান স্থায়ী হয় না, সেই জ্ঞানকে বিপর্য্যয় বলে।।৮।।

বস্তু না থাকিলেও তন্নামত্মক শব্দজনিত যে, এক প্রকার মনোবৃত্তি স্ফূরিত হয়, সেই মনোবৃত্তিকে বিকল্প বলিলে ভুল হয় না*।।৯।।
(* এখন পুষ্প না থাকিলেও উহা বলিবামাত্র তোমার মনে এক প্রকার বৃত্তির উদয় হয়।)

অজ্ঞান অবলম্বিত সপ্রকাশ মনোবৃত্তিই নিদ্রা।।১০।।

প্রত্যেক অনুভূত বিষয়ই চিত্তে অঙ্কিত হইয়া আছে, ঐ প্রকার অঙ্কিত হইয়া থাকারই অপর নাম স্মৃতি।।১১।।

অভ্যাস এবং বৈরাগ্যের সাহায্যে প্রত্যেক মনোবৃত্তিই নিরুদ্ধ হইতে পারে।।১২।।

চিত্ত স্থির করিবার জন্য, রজস্তমোবৃত্তিশূন্য যে যত্ন, তাহাকেই অভ্যাস কহা যায়।।১৩।।

প্রযত্নসহকারে মনোনিবেশপূর্ব্বক দীর্ঘকাল ঐ প্রকার অভ্যাস করিতে করিতে তবে তাহা সুদৃঢ় ও নিশ্চল হয়।।১৪।।

যাঁহার সমস্ত শাস্ত্রীয় অশাস্ত্রীয় বিষয়ে বিতৃষ্ণা জন্মিয়াছে, যিনি সমস্ত দৃষ্টবিষয়ে বীতস্পৃহ হইয়াছেন, তাঁহারই বশ্মীকার সংজ্ঞক বৈরাগ্য জন্মিয়াছে।।১৫।।

পরমবৈরাগ্য স্ফূরিত হইলে, প্রকৃতি পুরুষ যে পরস্পর অভেদ নয়, তৎসম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান জন্মে। সেই জ্ঞান প্রভাবে প্রাকৃতিক গুণনিচয়ের প্রতিও বীতস্পৃহ হইতে হয়।।১৬।।

যে সংশয় বিপর্য্যয় বিরহিত সম্প্রজ্ঞাত সমাধিবলে ভাব্যবস্তুবিষয়ক জ্ঞান বিলুপ্ত হয় না, বিরর্ক বিচার, আনন্দ ও অস্মিতা ক্রমে তাহা চারিভাগে বিভক্ত।।৭।।

প্রবল বৈরাগ্যবশতঃ যখন সমস্ত চিত্তবৃত্তির নিবৃত্তি হয়, তখন চিত্ত প্রত্যেক সংস্কার পরিশূন্য হয়, সেই অবলম্বনরহিত অপূর্ব্ব অবস্থাকেই অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলা যায়।।১৮।।

সম্প্রজ্ঞাত সমাধিমূলক বিদেহলয়, কিম্বা প্রকৃতিলয় উভয়ই মুক্তির কারণ হয় না। যেহেতু উভয়ই অবিদ্যা পরিশূন্য নহে। নিদ্রার পরে জাগরণ হইলে যেমন, নানা কার্য্যে ব্যাপৃত থাকিতে হয়, তদ্রুপ ঐ উভয়বিধ অনাত্মলয়ের পরেও চিত্ত পুনঃপুনঃ সাংসারিক ব্যাপারে আসক্ত হয়।।১৯।।

যিনি যোগ সম্বন্ধীয় শ্রদ্ধা, বীর্য্য, স্মৃতি, সমাধিবলে অতুল প্রজ্ঞা লাভ করিয়াছেন, তিনিই মুক্ত হইয়াছেন। কোন প্রাকৃতিক প্রলোভন আর তাঁহাকে প্রলোভিত করিতে পারে না। তিনিই বিদেহলয় এবং প্রকৃতিলয় বিহীন উপায় প্রত্যযশীল নিত্যমুক্ত যোগী হইয়াছেন। তিনিই চিরকালের জন্য স্ব-স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছেন।।২০।।

তীব্র কার্য্যশক্তিসম্পন্ন সংস্কারের নাম সম্বেগ। তীব্র সম্বেগশালী যোগীরই শীঘ্র সমাধি হয়।।২১।।

মৃদু, মধ্য, ও অধিমাত্র ভেদে তিন প্রকার সম্বেগ আছে। মৃদু সম্বেগশীল যোগীর সমাধি বিলম্বে হয়। মধ্য সম্বেগবিশিষ্ট হইলে তদপেক্ষা শীঘ্র হয়। যাঁহার অধিমাত্র সম্বেগ হইয়াছে, অতি শীঘ্রই তিনি সমাধিমগ্ন হন।।২২।।

শুদ্ধভক্তি সহকারে ঈশ্বরের অর্চ্চনা করিলেও সম্প্রজ্ঞাত সমাধির অধিকারী হওয়া যায়।।২৩।।

যে পরমপুরুষকে, ক্লেশ, কর্ম্ম, বিপাক (কর্ম্মফল) এবং আশয় অধীন করিতে পারে না, যিনি সর্ব্বাত্মা হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, তিনিই ঈশ্বর।।২৪।।
যিনি ঈশ্বর, তিনি সর্ব্বজ্ঞ। তাঁহাতে নিরতিশয় সর্ব্বজ্ঞত্ববীজ নিহিত আছে।।২৫।।

তিনি ব্রহ্মা এবং সমস্ত দেবগণেরও গুরু। তিনি চিরকাল আছে।।২৬।।

তিনি ওঙ্কারের বাচ্য। তাঁহার নাম ওঁ।।২৭।।

ঈশ্বরবাচক প্রণব জপ করিতে করিতে, সেই ঈশ্বরবাচক প্রণবের অর্থ ভাবিতে ভাবিতে একাত্ম হওয়া যায়। সম্যক একাগ্রতার উদরে সমাধি হয়।।২৮।।

নিয়ত প্রণব জপ এবং তদর্থ ভাবনা করিলে, সমস্ত যোগবিঘ্নই অপসারিত হয়। ক্রমে সমলচিত্ত অমল হয়। নিজ দেহের মধ্যে যে আত্মা আছেন, তাঁহাকে জানা যায়, তাঁহাকে জানিলে স্বভাবতঃ সমাধিশক্তির স্ফূরণ হয়।।২৯।।

ব্যাধি, স্ত্যান, (সমাধিস্থ হইবার ইচ্ছার অভাব না থাকিলেও তাহা কার্য্যে পরিণত করিবার ক্ষমতার অভাবের নাম স্ত্যান) সংশয়, প্রমাদর আলস্য (উদাসীন ভাব, নিরুদ্যম ভাব), অবিরতি (অনিবার্য্য বিষয়াসক্তি), ভ্রান্তিদর্শন (ভ্রান্তিমূলক অনিত্যজ্ঞান), অলব্ধভূমিকত্ব এবং অনবস্থিতত্ত্ব (নানা বিঘ্ন বশতঃ যোগশক্তির অপ্রাপ্তি। চিত্ত-চাঞ্চল্য) প্রভৃতি বিষম বিঘ্ননিচয় প্রভাবে সমাধি লাভ করা যায় না। ঐ সকল চিত্ত বিক্ষেপের বিশেষ অন্তরায়।।৩০।।

দুঃখ, শারীরিক কল্প, শ্বাস, প্রশ্বাস এবং ইচ্ছার ব্যাঘাতজনিত ক্ষোভ হইতে যে মনোবিকার উপস্থিত হয়, তাহা সমাধি সম্বন্ধে মহাবিঘ্ন।।৩১।।

ঐ সকল প্রতিবন্ধক হইতে নিষ্কৃতি পাইবার জন্য এক মাত্র ঈশ্বরের ধ্যান করিতে হইবে, একাগ্রভাবে একমাত্র ঈশ্বরের ধ্যানই অভ্যাস করিতে হইবে।।৩২।।

অন্যের সুখে সুখবোধ হইলে, অন্যের দুঃখে দয়া হইলে, অন্যের পূণ্যে হর্ষ হইলে এবং অন্যের পাপে উপেক্ষা করিলে, চিত্তে যে এক অপূর্ব্ব অমল ভাবের আবির্ভাব হয়, তাহার তুলনা নাই। সে ভাব প্রফুল্লতাময় চিত্তপ্রসাদ। সেই ভাবময় চিত্তপ্রসাদই সমাধির জনক।।৩৩।।

পুনঃপুনঃ বহির্বায়ু আকর্ষণপূর্ব্বক সাধ্যানুসারে অন্তরে ধারণ করিয়া পশ্চাৎ পরিত্যাগ করিলেও চিত্তস্থির হইতে পারে। চিত্ত স্থির হইলে একাগ্র হওয়া যায়।।৩৪।।

দিব্যজ্ঞানময়ী সর্ব্ববিষয়বতী প্রবৃত্তি প্রভাবে সর্ব্বতত্ত্ব জ্ঞাত হইয়া। সর্ব্বতত্ত্বময়চিত্ত করিতে পারিলেও তাহা সুস্থির হয়, সেই সুস্থির চিত্ত এরূপ সুনির্ম্মল হয় যে, তৎপ্রভাবে দিব্য গন্ধ আঘ্রাণ করা যায়। দিব্য শব্দ শ্রবণ করা যায়। দিব্য রস আস্বাদন করা যায়। দিব্য রূপ দর্শন করা যায়। দিব্য সুখ অনুভব করা যায়। এই সকল ফল প্রত্যক্ষ করিলে স্বভাবতঃ আরও যোগানুশীলনে চিত্ত সুদৃঢ় হয়।।৩৫।।

মনোস্থিত হইলে এক প্রকার অপরূপজ্যোতিঃ দর্শন হয়। সে জ্যোতির তুলনা নাই। তাহা যিনি প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, তিনি চিরকালের জন্য অশোক হইয়াছেন। তিনি সেই জ্যোতিস্মতী সাত্বিকীবুদ্ধিপ্রভাবে সম্প্রজ্ঞাত সমাধির অধিকারী হইয়াছেন।।৩৬।।

পরমবৈরাগীদিগের বৈরাগ্য সম্বন্ধে বিশেষ আলোচনা ও চিন্তা করিলে চিত্ত স্থির হয়। চিত্ত স্থির হইলে সম্প্রজ্ঞাত সমাধির আর বিলম্ব থাকে না।।৩৭।।

নিদ্রিতাবস্থায় স্বপ্নযোগে কোন দিব্যমূর্ত্তি দর্শন, অথবা অপ্রাকৃত সুখানুভব হইলে জাগিবামাত্র যদি সেই দিব্যমূর্ত্তি এবং অনুর্ভূতসুখ চিন্তা করা যায়, তাহা হইলেও একাগ্রচিত্ত হওয়া যায়।।৩৮।।

নিজের অভিমত যে কোন দিব্যবস্তু ধ্যান কর না কেন, তৎপ্রভাবে অবশ্যই একাগ্রশক্তি প্রবল হইবে।।৩৯।।

উক্ত অভ্যাসগুলি দ্বারা সুনির্ম্মল স্থিরচিত্ত হইলে, পরমাণু হইতে পরম মহৎ পরমাত্মাকে পর্য্যন্ত বশে আনা যায়।।৪০।।

অতি স্থূল হইতে যখন অতি সূক্ষ্ম বস্তুতে পর্য্যন্ত মনোস্থির করিবার সামর্থ্য হইবে, তখনি ঈশ্বরে মনোলয় হইবে। তখন কোন বস্তুতে, কোন তত্ত্বে মনোস্থির করিতে হইলেই, বিঘ্ন উপস্থিত হইবে না। তখন সম্যক প্রকারে মনোবশ হইবে। তখন আর একাগ্রতা অভ্যাসের প্রয়োজনও হইবে না। তখন কোন স্থূল কিম্বা সূক্ষ্ম জ্ঞেয় অবলম্বনে মনোস্থির করিবার চেষ্টা করিতে হইবে না, তখন নির্ম্মল স্ফটিক যেমন, যখন যে বর্ণের, যে পদার্থের সন্নিহিত করা হয়, তখন তাহা যেমন সেই বর্ণের সেই পদার্থে রঞ্জিত হইয়া যায়। তদ্রুপ অদ্ভুত একাগ্রতাবলে নিবৃত্তিক নির্ম্মলচিত্তও সর্ব্ববস্তুতে, সর্ব্ববিষয়ে এমন কি ঈশ্বরে পর্য্যন্ত নিবেশিত হইতে পারে। এবং তন্নিবন্ধন ফলভোগও করিতে পারে*।।৪১।।
(* কাষ্ঠ অগ্নির সহিত সংযুক্ত হইলে, অগ্নির ন্যায় কাষ্ঠও দাহ করে। তখন অগ্নি যে সকল ফলভাগী, কাষ্ঠও সেই সকল ফলভাগী হয়।)

ঐ সকল সমাপত্তির (সমাপত্তি অর্থে তন্ময়তা) মধ্যে যে সমাপত্তিশব্দ অথবা যে সমাপত্তির অর্থ ধ্যাতার স্পষ্ট বোধ হয় না, সেই সমাপত্তির নামই সবিতর্ক সমাধি।।৪২।।

ধ্যাতা; ধ্যেয়বস্তুবাচক শব্দার্থ বিস্মৃত হইলে, কেবল মাত্র তাঁহার চিত্তে ধ্যেয় প্রকাশিত থাকে না। সেই কেবল মাত্র ধ্যেয়বস্তুর প্রকাশকেই নির্বিতর্ক সমাধি বলা যায়।।৪৩।।

কথিত সবিতর্ক নির্বিতর্ক সমাধির ব্যাখ্যা দ্বারা সূক্ষ্মবিষয়ক সবিচার নির্বিচার সমাধিও নির্ণয় করা হইয়াছে।।৪৪।।

সূক্ষ্মবিষয়ক সবিচার ও নির্বিচার সমাধি, প্রকৃতি অতিক্রম করিতে পারে না। প্রকৃতি পর্য্যন্তই তাঁহাদের সীমা।।৪৫।।

ঐ সকল সমাধি সবীজসমাধির* অন্তর্গত।।৪৬।।
(* যে সকল সমাধির অবসানে পুনর্ব্বার সংসারাশক্তির বীজ অঙ্কুরিত হয়, তাহারাই সবীজনামে অবিহিত হইয়াছে।)

নির্বিচার সমাধিপ্রভাবে সুবিমলচিত্ত হইলে, সর্ব্ব প্রকাশক অধ্যাত্মপ্রসাদ লাভ হয়। সেই অধ্যাত্মপ্রসাদেরই অপর নাম অধ্যাত্মবিজ্ঞান (অধ্যাত্ম বিজ্ঞান)।।৪৭।।

সেই অধ্যাত্মপ্রসাদবলে ঋতস্তরাপ্রজ্ঞা* স্ফূরিত হয়।।৪৮।।
(* যে প্রজ্ঞাবলে কেবল সত্যই প্রকাশিত হয়। ঋত অর্থে সত্য।)

শ্রুতানুমানজাত,* অথবা অন্য কোন প্রকার প্রজ্ঞাই সর্ব্বজ্ঞানময়ী সর্ব্বতত্ত্বপ্রকাশিকা সর্ব্বশক্তিশালিনী ঋতস্তরাপ্রজ্ঞার সমতুল্য নহে, ঋতস্তরাই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ। তাহার সহিত অন্য কোন প্রজ্ঞারই তুলনা হইতে পারে না।।৪৯।।

তৎপ্রসূত সংস্কার বলে সমস্ত পূর্ব্বসংস্কারই বিনষ্ট হয়।।৫০।।

তৎপ্রভাবে সমস্ত পূর্ব্বসংস্কার বিনষ্ট হইলে, তাহাও নিরুদ্ধ হয়। তাহা নিরুদ্ধ হইলে, সর্ব্বনিরোধক নির্বীজসমাধির আবির্ভাব হয়। নির্বীজ সমাধি* হইলে, চিত্ত সর্ব্ববৃত্তি শূন্য হয়। তখন তাহার কোন গুণ, কোন ক্রিয়া থাকে না, তখন তাহা আপনার প্রসূতি মূল প্রকৃতিতে লয় হয়। তখন আত্মাও নির্গুণ নিষ্ক্রিয় হইয়া কেবল মাত্র হন।।৫১।।
(বীজশূন্য সমাধি। যে সমাধিতে চিত্তের সম্প্রজ্ঞাত বৃত্তিটিরও অভাব হয়।)

।।ইতি সমাধিপাদ।।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *