1 of 3

০১৮. যমযাম কূপ খনন ও সে বিষয়ে সৃষ্ট মতবিরোধ

একদিন আবদুল মুত্তালিব পবিত্র কা’বার হাতীমের [১২. অর্থাৎ কা’বার ভিত্তির যে অংশ হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কর্তৃক স্থাপিত হয়েছিলো। কিন্তু কুরাইশরা তার ওপর আর কোন কিছু নির্মাণ করেনি।]মধ্যে ঘুমিয়ে আছেন এমন সময়ে স্বপ্নে যমযম কূপ খননের আদেশ পেলেন। এ সম্পর্কে স্বয়ং আবদুল মুত্তালিবের বর্নলা নিম্নরূপঃ আমি হাতীমের মধ্যে ঘুমিয়ে আছি। এমতাবস্থায় এক অচেনা আগন্তুক এলেন এবং আমাকে বললেন, পবিত্র কূপ খনন কর। আমি জিজ্ঞেস করলাম : কোন্ পবিত্র কূপ? আগন্তুক এর কোন জবাব না দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন পরদিন আমি নিজের শোয়ার ঘরে গিয়ে ঘুমালাম, এ রাতেও সেই আগন্তুক এসে বললেনঃ সংরক্ষিত কূপ খনন কর। আমি জিজ্ঞেস করলাম : কোন্ সংরক্ষিত কূপ? আগন্তুক কোন জবাব না দিয়ে অর্দশ্য হয়ে গেলেন। পরদিন আম উক্ত স্থানে ঘুমাতে গেলাম, সেই আগন্তুক আবার এলেন এবং বললেন : যমযম খনন কর। আমি বললাম : যমযম কি? তিনি বললেন : “যে কূপের পানি কখনো কমে না বা শুকায় না, যা সর্বোচ্চ সংখ্যক হাজীকে খাবার পানি সরবরাহ করতে পারবে, যা অবস্থিত গোবর ও রক্তের মাঝখানে সাদা ডানাবিশিষ্ট কাকের বাসার নিকটে।” [১৩.কথিত আছে যে, আবদুল মুত্তালিব যখন কূপ খনন করতে উদ্যোগী হলেন তখন তাঁকে খননের যে স্থান নির্দেশ করা হয়েছিল, সেখানে পিঁপড়ের ঢিবি ও কাকের গুহা দেখতে পেলেন। কিস্তু গোবর ও রক্ত দেখতে পেলেন না। ফলে তিনি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় সহসা সেখানে একটি গাভীকে ছুটে আসতে দেখলেন। এক ব্যক্তি গাভীটি জবাই করতে উদ্যত হয়েছিল। কিন্তু গাভীটি ছুটে পালিয়ে আসে। লোকটি পিছু পিছু ছুটে এসেও তাকে ধরতে পারলো না। গাভী শেষ পর্যন্ত মসজিদে হারামের চৌহদ্দির ভেতরে এসে ঢুকে পড়লো। চিহ্নিত স্থানটিতে এসে গাভী দাঁড়ালে লোকটি সেখানেই সেটিকে জবাই করলো। ফলে গাভীর রক্ত ও গোবর বেরিয়ে এল। আবদুল মুত্তালিবের কাছে সমগ্র ব্যাপারটা পরিস্কার হযে গেল এবং তিনি সেখানেই খনন কাজ শুরু করে দিলেন।]

আগন্তুক তাঁর কাছে যখন যমযম কূপের বৈশিষ্ঠ স্পষ্ট করে দিল ও স্থান নির্দিষ্ঠ হলো এবং স্বপ্নের সত্যতা সম্পর্কে আর কোন সন্দেহ রইলো না, তখন পরদিন সকালে পুত্র হারেসকে সাথে করে কোদাল নিয়ে সেখানে গেলেন। হারেস ছাড়া তখন তাঁর আর কোন পুত্র জন্মগ্রহণ করেনি। যমযম কূপ [প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আবদুল মুত্তালিব প্রকৃতপক্ষে যমযম কূপ পুনঃখনন করেন। এই কূপের আবির্ভাব ঘটে সর্বপ্রথম খৃস্টপূর্বে ১৯১০ সালে, হযরত ইসমাঈলের জন্মের বছরে। হিজরী সাল অনুযায়ী রাসূল (সা) এর জন্মের ২৫৭২ বছর আগে এটির আবির্ভাব ঘটে। পরে এক পর্যায়ে যমযম কূপ শুকিয়ে যায় ও মাটির নীচে চাপা পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত এর কোন চিহ্নই আর অবশিষ্ট থাকেনি। আবদুল মুত্তালিবের হাওত পুনঃখনন না হওয়া পর্যন্ত এর সন্ধান কেউ পায়নি। (মক্কা শরীফের ইতিকথা, পৃঃ২২,২৩ ও ২৪) ] খননের কাজ এগিয়ে চললো। যখন আবদুল মুত্তালিব সেই প্রস্তরটি দেখতে পেলেন যা থেকে কূপ উৎসারিত হয়েছে তখন আনন্দের আতিশয্যে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে চিৎকার করে উঠলেন। কুরাইশরা ঐ ধ্বনি শুনে বুঝতে পারলো যে, আবদুল মুত্তালিব যা খুঁজছেন তা পেয়ে গেছেন। সবাই তাঁর কাছে এসে বললো, “হে আদুল মুত্তালিব, ওটা তো আমাদের পিতা ইসমাঈলের কূপ। এতে আমাদেরও হক আছে। আপনি আমাদের কে এই কূপের অংশীদার করুন!” আবদুল মুত্তালিব বললেন, “আমি তা পারবো না। এ জিনিসটা শুধু আমাকে দেয়া হয়েছে, তোমাদেরকে নয়।” তারা বললো, “আমাদের সাথে ন্যায় সঙ্গতভাবে ফায়সালা করুন। তা না হলে আমরা চূড়ান্ত বুঝাপড়া না করে আপনাকে ছাড়বো না।” আবদুল মুত্তালিব বললেন, “বেশ, তাহলে তোমাদের ও আমার মধ্যে এই বিরোধ মীমাংসার জন্য যাকে খুশী সালিশ মানো। আমি তার ফায়সালা মেনে নিতে প্রস্তুত।” তারা বললো, “বনু সা’দ গোত্রে হুযাইম নামে এক জ্যোতিষিণী আছে। সে-ই আমাদের সালিশ।” আবদুল মুত্তালিব বনু আবদ মানাফ গোত্রের কিছু লোককে সাথে নিয়ে সেখানে রওনা দিলেন। প্রতিটি কুরাইশ গোত্রের একজন করে লোক গেল তাঁর সাথে। সমগ্র যাত্রাপথটা ছিল মরু অঞ্চণের ভেতর দিয়ে। হিজাজ ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী এক মরুভুমিতে পৌঁছেতেই আবদুল মুত্তালব ও তাঁর দলের লোকদের পানি ফুরিয়ে গেল। পিপাসায় তাদের এমন শোচনীয় দশা হলো যে, বাঁচার আর কোন আশাই রইলো না। সহগামী কুরাইশ গোত্রগুলোর কাছে তাঁরা খাবার পানি চাইলে তারা দিতে রাজী হলোনা। তারা বললো, “আমরাও মরুভূমিতে আছি। আশংকা হয় আমাদের অবস্থাও তোমাদের মত হতে পারে।”

আবদুল মুত্তালিব কুরাইশদের নিষ্ঠুর আচরনে মর্মাহত হয়ে এবং নিজেদের সম্ভাব্য শোচনীয় পরিনতির কথা চিন্তা করে সহযাত্রীদের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, “এখন আমাদের কি করা উচিত বলে তোমরা মনে কর?” সহযাত্রীরা এক বাক্যে বললো, “আমরা শুধু আপনার মতানুসারে কাজ করবো। আপনি যা ভালো মনে করেন নির্দেশ দিন।” তিনি বললেন, “আমি মনে করি, আমাদের গায়ে এখনো যেটুকু শক্তি আছে তা দিয়ে প্রত্যেকে নিজের কবর খুঁড়ে রাখি। অতঃপর যখন একজন মারা যাবে, তখন আমরা যারা জীবিত থাকবো তারা তাকে ঐ কবরে নিক্ষেপ করবো এবং মাটি ঢেকে দেবো। সবার শেষে মাত্র একব্যক্তি অবশিষ্ট থাকবে। গোটা কাফিলার লাশ নষ্ট হওয়ার চেয়ে একটিমাত্র লোকের লাশ নষ্ট হোক, তাও ভালো সবাই একবাক্যে আবদুল মুত্তালিবের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করলো এবং সবাই নিজ নিজ কবর খুঁড়লো। অতঃপর পিপাসার দরুন অবধারিত মৃত্যুর অপেক্ষঅয় সবাই বসে প্রহর গুনতে লাগলো। কিছুক্ষন পর আবদুল মুত্তালিব তাঁর সঙ্গীদেরকে বললেন, “আল্লাহর কসম, একবারেই নিশ্চেষ্ট বসে বসে কোথাও না গিয়ে এবং জীবন বাঁচানোর কোন অবলম্বন না খুঁজে অসহায়ভাবে মৃত্যুর কবলে নিজেদেরকে এভাবে সঁপে দেয় ভীষণ কাপুরুষতা। এমনও তো হতে পারে যে, আল্লাহ কোন স্থানে আমাদের জন্য পানির ব্যবস্থা করে দেবেন। অতএব, চল, যাত্র শুরু করা যাক।” যাত্রার প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো। সফরের সহযাত্রী অন্যান্য কুরাইশরা (যারা পানি দিতে অস্বীকার করেছিল) এতক্ষণ তাদের সমস্ত তৎপরতা নিরীক্ষণ করছিল। আবদুল মুত্তালিব সওয়ারীতে আরোহণ করলেন। যেই সওয়ারী চলতে আরম্ভ করেছ, অমনি তার পায়ের খুরের নীচ থেকে সুপেয় পানির একটি ঝর্ণা নির্গত হলো। তা দেখে আবদুল মুত্তালিব ও তাঁর সঙ্গীরা ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে উঠলেন অতঃপর আবদুল মুত্তালিব ও তাঁর সঙ্গীরা সওয়ারী থেকে নেমে পানি পান করলেন এবং মশকগুলো পূর্ণ করে পানি ভরে নিলেন। এরপর আবদুল মুত্তালিব কুরাইশদেরকে ডেকে বললেন, “এসো, আল্লাহ আমাদের পানি পান করিয়েছেন।তোমরাও পানি পান করে যাও ও মশক ভরে নিয়ে যাও।” তারা এলো এবং পানি পান করে ও মশক ভরে নিয়ে গেল। অতঃপর তারা বললো, “হে আবদুল মুত্তালিব, আল্লাহর কসম, আমাদের ওপর তোমার প্রাধান্য চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয়ে গেছে। আমরা যমযমের ব্যাপারে আর কখনো তোমার সাথে কলহ করবো না। আমরা বুঝতে পেরেছি, যিনি আজ তোমাকে এই মরুভূমিতে পানি পান করিয়েছেন, তিনিই তোমাকে যমযমের পানি পান করিয়েছেন। অতএব তুমি পুনরায় তোমার পানি পান করানোর মহান কাজে দ্বিধাহীনভাবে নিয়োজিত হও।”

আবদুল মুত্তালিব ফিরে চললেন এবং সেই কাফিলার অন্য সবাই ফিরে চললো। জ্যোতিষিণীর নিকট কেউ গেল না এবং আবদুল মুত্তালিবকেও তার কাছে যাওয়া থেকে সবাই অব্যহতি দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *