৬. সারাংশ

ষষ্ঠ অধ্যায় : সারাংশ

বিশ্ব-ইতিহাসে ইসলামের উত্থান এবং বিস্তার এক অদ্বিতীয় ঘটনা। অতীত পর্যালোচনা করা অনেক ক্ষেত্রেই খুব দুরূহ বিষয়, কেননা প্রকৃত বিষয় জানতে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন, যা সহজে প্রাপ্ত নাও হতে পারে। তাই প্রতিটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রয়োজন ব্যাপক গবেষণার। সে- তুলনায় ইসলামের ইতিহাস জানা অনেক সহজ কারণ এই ইতিহাসের সমর্থনে পাওয়া যায় অনেক নির্ভরযোগ্য তথ্য। সচেতন এবং পক্ষপাতমুক্ত ঐতিহাসিকদের পক্ষে ইসলামের ইতিহাস তুলে ধরা অনেক সহজ। ভবিষ্যত গবেষকদেরও উচিত ইসলাম নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী হলে তাঁদের মনে কোনো ধরনের পূর্বধারণা, অন্ধবিশ্বাস বা বিদ্বেষ থাকলে সেগুলি থেকে আগে মুক্ত হতে হবে। আমার এই ছোট বইটি সুগভীর গবেষণার ফসল নয়। তথাপি যথাসম্ভব যে কোনো ধরনের অন্ধআবেগ থেকে নির্মোহ থেকে অতিসংক্ষেপে এই বইয়ে তুলে ধরা হয়েছে হজরত মুহাম্মদের তেইশ বছরের নবুওতি জীবন। এই অধ্যায়ে সে বিষয়গুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :

(এক) মুহাম্মদ ছিলেন একজন অনাথ শিশু। ছয় বছরের পিতৃমাতৃহীন অসহায় শিশু লালিত-পালিত হন আত্নীয়ের গৃহে। ওই বয়সের শিশুরা সাধারণত যেসব সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে লালিত-পালিত হত, মুহামদ তা থেকে বঞ্চিতই ছিলেন। খুব ছোট বয়স থেকেই মুহাম্মদ মক্কার নিকটস্থ উষর মরুভূমিতে উটের চারণ করে সময় কাটাতেন। তাঁর দৃষ্টি ছিল তীক্ষ এবং মন ছিল কল্পনাপ্রবণ। পাঁচ থেকে ছয় বছর তিনি মরুভূমিতে অতিবাহিত করেন। মরুভূমির নিজস্ব নির্জনতা ও একাকীত্ব মুহাম্মদের মনে জন্ম দেয় ভাবাবেগ এবং দূরদর্শিতা। প্রতিবেশিদের ধনদৌলতের সাথে নিজের কর্পদকশূন্য অবস্থার তুলনা করে মুহাম্মদের মনে ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয় এক মানবিক বিরাগ। এই জটিল মানসিকতার প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাঁর শিশুকালের খেলার সার্থীদের সাথে এবং নিকট আত্মীয়দের সাথে। তারপর ধনী পরিবারের সদস্যদের সাথে এবং সবশেষে ওই সমস্ত ধনদৌলতের উৎসের উপর। সে উৎস ছিল কাবা ঘরের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন। মুহাম্মদের জন্মের বহুপূর্ব থেকেই কাবা ছিল মূর্তিপূজার এক বিশাল মন্দির এবং আরব সমাজের ধর্মীয় কেন্দ্রভূমি। বাল্যকালে মুহাম্মদ কাবায় অনেক প্রার্থনা-অৰ্চনা করেছেন, পরবর্তীতে তাঁর কাছে এগুলো সব বৃথা মনে হয়, একেশ্বরবাদে একনিষ্ঠ হওয়ায়। সেজন্য বোধ করি তাঁর মনে মূর্তিপূজার প্রতি অগাধ ঘৃণা এসে যায়। [ একটি হাদিসের বর্ণনানুযায়ী : (৫৯৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে) নবি মুহামদ তখন পৌত্তলিক দেবদেবীর উপাসনা করতেন, একদা কাবা ঘরের দেবতাকে উৎসর্গ করা কোরবানির মাংস রান্না করে একেশ্বরবাদী হানিফ দলের প্রতিষ্ঠাতা ও বিশিষ্ট আরবি কবি জায়েদ বিন ওমরের ( খলিফা ওমরের চাচা) জন্য নিয়ে যান তাঁর সাথে খাওয়ার জন্য, তখন জায়েদ মুহামদকে তিরষ্কার করেন এবং পৌত্তলিকতা থেকে বিরত থেকে একেশ্বরবাদ চর্চার পরামর্শ দেন। দ্রষ্টব্য ; বুখারি শরিফ, ভলিউম ৭, বুক ৬৭, নম্বর ৪০৭। – অনুবাদক । মূর্তিপূজা-বিরোধী চিন্তা কেবল মুহাম্মদের একার ছিল না। এ- সময় মক্কার অনেক বাসিন্দার কাছে খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মপুস্তক ছিল। এছাড়াও অনেক চিন্তাশীল মক্কাবাসী ছিলেন যারা নিম্প্রাণ মূর্তিগুলো পূজা করাকে অসার মনে করতেন। তাঁদের কেউ কেউ হানিফ’ নামে পরিচিত ছিলেন। এই ব্যক্তিগুলোর সংস্পর্শে আসায় মুহাম্মদের চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। এ-সময় তিনি একবার সিরিয়ায় বাণিজ্য ভ্রমণে যান। বাইরের জগতের সাথে নিজের অঞ্চলের লোকজনের সংস্কার-কুসংস্কার-প্রথা-নিয়ম-নীতি পালনে বিশাল পার্থক্য মুহাম্মদের কাছে দৃশ্যমান হয় এই সফরের সময়। ধর্মপুস্তকপ্রাপ্ত (ইহুদি ও খ্রিস্টান) লোকদের উপাসনালয় দেখে এবং যাজক- পুরোহিতদের সাথে আলাপ করে মুহাম্মদ তাঁদের নবি এবং ধর্ম সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারেন। এরপর মুহামদ নিজের ধারণায় প্রত্যয়ী হন।

(দুই) যখন একেশ্বরবাদ এবং ইহুদি ও খ্রিস্টানদের কাছ থেকে পাওয়া মতবাদ মুহাম্মদের জীবনের প্রধান চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছিল, ঠিক সে- সময় তিনি মক্কার এক ধনী নারীকে ( খাদিজা) বিয়ে করেন। ফলে মুহাম্মদ বস্তুজীবনের বিড়ম্বনা থেকে নিকৃতি পেয়ে যান। মুহাম্মদের স্ত্রী খাদিজার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা বিন- নওফল ছিলেন একেশ্বরবাদী। তাঁর সাথে ঘন-ঘন সাক্ষাত মুহাম্মদের আসক্তিতে পরিণত হয়। মুহাম্মদের মন সর্বদা আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো এক সর্বশক্তিমান এবং ঈর্ষাপরায়ণ স্রষ্টার উপর। তাঁর মনে গভীর বিশ্বাস হলো যে, এই স্রষ্টা নিশ্চয়ই চান না, হেজাজের লোকজন অন্য দেবদেবীর পূজা করুক। ইহুদি- খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থে এবং লোককাহিনিতে বর্ণিত, পৌত্তলিকতা উপাসনার অপরাধে সর্বশক্তিমান এক ঈশ্বর আদ ও সামুদ জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দিয়েছেন – এই বর্ণনা পাঠে মুহাম্মদের মনে আশংকার সৃষ্টি করে। তিনি চিন্তা করলেন যে তাঁর নিজের লোকজনও একইভাবে দেবদেবীর উপাসনায় নিয়োজিত। এ- অপরাধে তাই স্রষ্টা হয়তো খুব শীঘ্ৰ তাদের এক ঘোরতর সাজা দিবেন। এ- অবস্থায় তাঁর নিজের জরুরি কর্তব্য লোকজনদের পথ দেখানো। মুহাম্মদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তাঁর আশংকা মিলে যায়। তিনি দাবি করতে শুরু করেন যে স্রষ্টা ( পরে আল্লাহ হিসেবে সম্বোধন করেন) তাঁকে দৈববাণী পাঠাচ্ছেন মক্কাবাসীকে হুশিয়ার করতে। বিবি খাদিজা এবং ওয়ারাকা বিন- নওফল মুহাম্মদের ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশের দাবির সত্যতা মেনে নেন। তাঁরা জানালেন আল্লাহ-ই মুহামদকে অনুপ্রাণিত করেছেন। নিজের ঘর থেকে সমর্থন পেয়ে মুহাম্মদ উৎসাহী হয়ে উঠলেন। তাঁর মনে গভীর বিশ্বাস জন্ম নিল যে আল্লাহ তাঁকেই মনোনীত করেছেন হেজাজের জনগণকে সাবধান বাণী জানানোর জন্য। যেমন করে স্রষ্টা হুদ এবং সালেহকে নবি হিসেবে পাঠিয়েছিলেন যথাক্রমে আদ ও সামুদ জনগোষ্ঠীকে সাবধান করার জন্য। মুহাম্মদ আরও বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে, নবি শুধুমাত্র ইহুদিদের মধ্য থেকেই আবির্ভূত হবেন তা নয়। আরব এবং ইহুদিরা একই বংশের লোক। তাই নবি আরবদের মধ্য থেকেও আসবে। এই বিশ্বাস আর আধ্যাতিক সন্ধিক্ষণে আচ্ছন্ন অবস্থায় মুহাম্মদ চল্লিশ বছরে পদার্পণ করলেন এবং নিজের আত্মীয়-স্বজনদের নিকট তাঁর নতুন মতবাদ প্রচার শুরু করেন।

(তিন) মুহাম্মদ ওই সময়ের যতো চিন্তাশীল ব্যক্তিদের সাথে আলাপ করেছিলেন তাঁরা প্রায় সবাই একমত ছিলেন যে, মানুষের হাতে তৈরি প্রস্তর- মূর্তির উপাসনা করা আসলে অকার্যকর। তিনি আশান্বিত হয়ে গেলেন যে, অতি মতবাদ মেনে নিলেন। ফলে হতাশ হবার কোনো কারণ থাকল না। মুহামদ জোরেশোরে চালাতে থাকলেন তাঁর প্রচার কাজ। এ-সময় ওহি আসে ; তুমি তোমার আত্মীয়স্বজনকে সতর্ক করে দাও। (সুরা শোআল্লারা ; আয়াত ২১৪) । কিন্তু এবার মুহাম্মদের ভাবনার সাথে পরিস্থিতি অনুকূল হলো না। তাঁর লোকজন তাঁকে উপহাস আর অবজ্ঞা করল। মুহাম্মদ ছিলেন সরল মনের ব্যক্তি। তিনি ভেবেছিলেন উপকারী বক্তব্য এবং যুক্তিপূর্ণ বাণী দিয়ে অতি সহজে তাঁদের মনে রেখাপাত করতে পারবেন। কিন্তু তা হলো না। আরবেরা যে তাদের সনাতন ধর্মের প্রতি এতোই অনুরক্ত থাকবে, মুহামদ তা শুরুতে ধরতে পারেননি। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর নতুন ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে পুরানো ধর্মকে উৎখাত করতে। কিন্তু পুরনো ধর্মব্যবস্থা ছিল কুরাইশ নেতাদের প্রচুর ধনসম্পদ এবং খ্যাতি ও যশের ভিত্তি। তাই মুহাম্মদের মতাদর্শ শুনে তারা প্রমাদ গুণলেন এবং নিজেদের অবস্থান বজায় রাখতে মুহাম্মদের চরম বিরোধিতায় নামলেন। মুহামদের চাচা আবু লাহাব ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি তাঁর সাথে প্রকাশ্যে বৈরিতা ঘোষণা করেন। একদা কুরাইশ প্রধানদের সভায় আবু লাহাব ক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠেন : “তুমি ধ্বংস হও, মুহাম্মদ! আমাদের কি এইসব আবোল-তাবোল শোনানোর জন্য ডেকেছ?”

(চার) ওই সময় মাখজুম গোত্র এবং আবদে মনাফের বংশধরদের মধ্যে বিরোধ বাধে। আল আখনাস বিন আবু শারিকের কাছে মাখজুম গোত্রের ভবিষ্যত নেতা আবু জেহলের এক উক্তি থেকে তৎকালীন নেতাদের মনোবৃত্তির স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। মাখজুম গোত্র তখন অবস্থা- প্রতিপত্তি- সহায়- সম্পদে বেশ ভালো অবস্থায় ছিল। তাই আবু জেহেল নবি হিসেবে সাজিয়েছে। এই ঘটনার প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া হোসেন বিন আলিকে উদ্দেশ্য করে এক কবিতা রচনা করেন। এই কবিতায়ও একই মনোভাব প্রকাশ পায়। ইয়াজিদ তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন : হাশেমিরা ক্ষমতার জুয়া খেলে। কিন্তু কোনো বার্তা আসেনি, কোনো দৈববাণীও আসেনি। কী উদ্দেশ্যে কুরাইশরা মুহাম্মদের বিরোধিতা করেছে তা আল আখনাস বিন আবু শারিকের কাছে আবু জেহেলের উক্তি থেকে পরিষ্কার। মুহাম্মদ ছিলেন গরীব অনাথ। জীবনযাত্রার জন্য নির্ভরশীল ছিলেন স্ত্রীর সম্পদের উপর। এহেন দুঃস্থ ও নির্ভরশীল ব্যক্তির সাথে সামাজিক এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে উন্নীত পদমর্যাদার অধিকারী ও ধনী কুরাইশ নেতাদের কোনো তুলনা হবার নয়। মুহাম্মদের ধর্মপ্রচার সফল হলে এই নেতাদের অবস্থান হয়ে পড়বে দুর্বল। এমনও হতে পারে যে, তাঁরা নিজেদের এতোদিনের সমানের আসন থেকে পড়ে যেতে পারেন। সত্য হচ্ছে যে, আবদুল মোতালেবের গোষ্ঠী কখনো মুহাম্মদের সমর্থক ছিলেন না। এমন কি আবু তালেব ও নবির অন্য চাচারা চান নাই কুরাইশ বংশের উপগোত্রের মধ্যে ফাটল ধরুক। নবুওতির দাবির পর মুহাম্মদ তের বছর মক্কায় বসবাস করেন। ক্রমে তিনি দূরদর্শিতার মাধ্যমে বুঝতে পারেন কুরাইশরা তাঁকে অবজ্ঞা করবে এবং তাঁর বিরোধিতা করে যাবে। শেষমেশ তাই-ই হল। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে মুহাম্মদ ভাবলেন, প্রস্তুতি না নিয়ে তাঁর হয়তো উচিত ছিল না নবুওতির দাবিতে আত্মোৎসর্গ করা। ওয়ারাকা বিন- নওফল, ওমায়া বিন আবু-সালাত, এবং কাস বিন সায়েদার মতো একেশ্বরবাদীরা নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেই চুপচাপ থাকতেন। পরে তাঁরা নিজ নিজ পথে চলে যান। মুহামদ একবার চিন্তা করলেন যে তাঁরও হয়তো এ- রকম করা উচিত। মুহাম্মদের নবুওতির কর্মজীবন পর্যালোচনা করে বুঝা যায় যে, তিনি তাঁর বিশ্বাসে শেষমেশ এতোই অটল হলেন যে কোনো কিছুতেই তিনি আর ভীত বা নিরুৎসাহ হতেন না। কাজেই তাঁর লক্ষ থেকে তিনি পিছপা হলেন না। সকল বাধা সত্ত্বেও একবিশ্বাসে নিবিষ্ট হয়ে এগিয়ে যেতে থাকলেন। হেজাজের জনগণকে নিজের বিশ্বাসে চালিত করার দায়িত্ব তিনি পালন করে গেলেন প্রায় ত্রিশটি বছর। শুধু বিশ্বাসের শক্তি নয়, মুহাম্মদের বাকপটুতা ছিল অসাধারণ। একজন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা- বঞ্চিত ব্যক্তির পক্ষে এই গুণ থাকা সত্যি ভীষণ আশ্চর্যের ব্যাপার। তিনি আবেগপূর্ণ ভাষায় জনতাকে সুনীতিসম্পন্ন, সৎ এবং দয়াশীল হতে বলতেন। শোভন ব্যবহার, ন্যায়পরায়ণতা, এবং কর্তব্যনিষ্ঠতা যে মুক্তির পথ, তা প্রমাণের জন্য জন্য ভুরিভুরি উদাহরণ দিলেন অতীতের নবিদের কাহিনী থেকে।

(পাঁচ) অতীত ইতিহাস গবেষণা থেকে এটা এখন প্রমাণিত যে, মক্কার আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। মূর্তি পূজার বিরোধিতাকারী হানিফসহ বিভিন্ন একেশ্বরবাদীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়তির দিকে ছিল। মক্কায় ধনী এবং ক্ষমতাশালী লোকদের চেয়ে অভাবী-দরিদ্র, বিত্তহীন লোকের সংখ্যা বেশি ছিল। ইসলাম প্রচারের শুরু থেকেই এই অভাবী-নিঃস্ব মানুষের পক্ষ হয়ে কথা বলতে লাগলেন তিনি। পৃথিবীর যাবতীয় বিপ্লবের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সকল বিপ্লবের আসল সৈনিক হচ্ছে বঞ্চিত এবং অত্যাচারিত জনগণ। স্বাভাবিকভাবে মক্কার ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা অলস হয়ে বসে ছিলেন না। অসহায়, গরীব মানুষ যারা মুহাম্মদের বাণীতে আকৃষ্ট হয়ে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন, তাদেরকে নিয়ত নির্যাতন এবং হয়রানি করা হতে লাগল। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা মুহাম্মদ এবং সদ্য ধর্মান্তরিত মুসলিম, মক্কার প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য যেমন আবু বকর, ওমর, হামজাকে কোনো প্রকার উৎপীড়ন করতেন না। নিঃস্ব মুসলমানদের প্রায়শ ভয়ভীতির সম্মুখীন হতে হতো। তারাই ছিল নতুন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভিত্তি, যেমন করে পিরামিডের ভিত্তি থাকে। এ- অবস্থায় তের বছর ধরে মুহামদ তাঁর প্রচারণা চালিয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁর ভক্তের সংখ্যা একশ’র বেশি হলো না। আশ্চর্যের ব্যাপার হলেও এখান থেকে একমাত্র উপসংহার টানা যায় : মুহামদের সব নির্ভুল প্রচার, বাকপটুতা, কঠোর সংযম, এবং দোজখের ভয় দেখানো কোনোটাই কাজে আসল না। মক্কায় ইসলাম প্রচারে মুহাম্মদের যে নিরলস পরিশ্রম ছিল, তার প্রাপ্য তিনি পেলেন না।

(ছয়) শেষ পর্যন্ত নবিকে অস্ত্র তুলে নিতে হলো ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য। এছাড়া তাঁর আর কোনো গত্যন্তর ছিল না। তাঁর লক্ষ্য অর্জন করতে তিনি অস্ত্রের ব্যবহার, যুদ্ধ, বলপ্রয়োগ সবই তিনি করলেন। এখানে একটি বিষয় আমাদের সারণে রাখা উচিৎ, কার্য সম্পাদনের জন্য শক্তি প্রয়োগ শুধু নবি একাই করেননি। শক্তি প্রয়োগ আরব জাতির এক পুরনো অভ্যাস। হেজাজ এবং নেজদের মরুভূমির কঠোর পরিবেশে আরবদের কৃষিকাজের তেমন কোনো সুযোগ ছিল। তাঁরা তখন মনুষ্য- রচিত বা ঈশ্বর- প্রদত্ত দাবিকারী কোনো আইনের অধীনে বাস করত না। সাধারণত আরব বেদুইনদের জীবন চলত অন্য দলের উপর লুটতরাজ এবং হানাহানি করে। এই অবিরাম হানাহানি থেকে কিছুসময় বিশ্রাম নেবার জন্য তাঁরা বছরের চারটি মাস নির্ধারণ করেছিলেন যখন কেউ কারো উপর আক্রমণ করবেন না। এই চারটি মাসকে তাঁরা পবিত্র মাস হিসাবে গণ্য করতেন। বছরের অন্য সময়ে এক গোত্রের সাথে অন্য গোত্রের এই লুটতরাজ, খুনোখুনি এবং নারীদের অপহরণের হাত থেকে দূরে থাকার একটি উপায় ছিল সদা সতর্ক থাকা এবং নিজেদের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করা। যখন মদিনায় বসবাসকারী আউস এবং খাজরাজ গোত্রের লোকেরা মুহামদের জীবন-রক্ষার আশ্বাস প্রদান করেন তখন তিনি মদিনাতে গমন করেন। মদিনায় তখন মুহাম্মদের মাতা আমিনার বংশের লোকেরা বসবাস করতেন। মদিনায় গিয়ে মুহাম্মদ হাতে তুলে নিলেন অস্ত্র। মুহাম্মদ জীবনে যতো যুদ্ধ, সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন বা বাধ্য হয়েছিলেন তার প্রায় সবই হয়েছে মদিনাতে আসার পর। এখানে নবির প্রধান লক্ষ ছিল মদিনা এবং এর আশেপাশে বসবাসকারী ইহুদি সম্প্রদায়গুলো। ইহুদি গোত্রগুলোর সাথে সংঘর্ষ থেকে নবি তাঁর ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গতি পেলেন। এই ইসলামি রাষ্ট্রের আইনকর্তা রাষ্ট্রের প্রধান কার্যনির্বাহক এবং সামরিক প্রধান হলেন মুহামদ নিজেই। এবার নতুন এই রাষ্ট্রের উন্নতি এবং পরিসরে বিস্তৃতিতে মুহামদ পূর্ণমাত্রায় মনোনিবেশ করতে পারলেন।

(সাত) প্রাক-ইসলামি যুগে আরববাসী ছিল একইসাথে বাস্তববাদী এবং আবেগপ্রবণ। একটি আবেগময় কবিতা শুনে তাঁদের মন হয়ে যেত আন্দোলিত আবার কোনো কদৰ্য কবিতা শুনলে তাঁরা হত্যা করতেও উদ্যত হয়ে যেত। তাঁদের চিন্তাভাবনা ছিল সবসময় বৈষয়িক বিষয়াবলী এবং দৈনিক অভিজ্ঞতার উপরে। কোনো রকম আধ্যাতিক, অতীন্দ্রিয় বা অলৌকিক বিষয় তাঁদের ধর্তব্যের বাইরে ছিল। সহিংসতা তাদের জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আইন ও বিচারের প্রতি তাঁদের কোনো ভ্রক্ষেপ থাকত না। লুটের মাল হস্তগত করতে যা কিছু করা প্রয়োজন তার সবই করতে প্রস্তুত ছিল তাঁরা। একজন ইউরোপীয় পণ্ডিত বলেছেন, আরব বেদুইন কোনো সময়ে ভিন্ন দলের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হলে সে শক্রদলে যোগদান করতে দ্বিধা করত না। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আরব বেদুইনদের এই ব্যবহার ছিল ব্যতিক্রমী। যে সমাজে কোনো সংগঠিত সরকার ছিল না, ছিল না কোনো শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা, সেই সমাজকে সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতে হতো ক্ষমতার ভারসাম্য এবং ভীতির উপর।

আরবরা দম্ভ এবং আত্মপ্রশংসা করতে ভালবাসে। তাঁরা যে শুধুমাত্র নিজেদের ব্যক্তিগত ও গোত্রগত গুণাবলী অতিরঞ্জিত করত তা নয়, তাঁরা তাদের দোষক্রটির জন্য পর্যন্ত গর্বিত থাকত। আত্মসমালোচনা করা তাঁদের অভ্যাসে ছিল না। ভোরবেলায় অপহরণ করা নারীকে ধর্ষণ করার পর তাঁরা কবিতা রচনা করত। এ- কবিতায় নিজেরা নিজেদের হিমতের বড়াই এবং সাহস প্রকাশ করত আবার ভুক্তভোগী নারীকে অশ্লীল ভাষায় গালি দিত। যেভাবে বেদুইন কবিরা তাঁদের আদিম সহজাত মনোবৃত্তি প্রকাশ করত তা সভ্যতার কোনো পর্যায়েই তা পড়ে না। বেদুইনদের আধ্যাত্মিক এবং অলৌকিক ধারণা বলতে যা কিছু ছিল তা মূলত পার্থিব জগত থেকে নেয়া কোনো মনগড়া চিত্র। একই রকম মানসিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখি ইসলামি-যুগেও, বিশেষ করে হানবলিদের মধ্যে। হানবলিরা যে কোনো রকমের যৌক্তিক এবং বিশ্লেষণী চিন্তাভাবনাকে ধর্মবিরোধী বলে মনে করে। [ সুন্নি ধর্মতাত্ত্বিক আহমদ ইবনে হানবলের (৭৮০-৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ) অনুসারীদের হানবলি বলা হয়। হানবলিরা ধর্মীয় বিষয়াবলীতে চরমপন্থা এবং মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। সৌদি আরব, কাতার, আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ সিরিয়া এবং ইরাকে হানবলিদের প্রভাবশালী অবস্থান রয়েছে। আধুনিক ইসলাম-গবেষকরা হানবলিদের কট্টরপন্থী ওয়াহাবিবাদ, সালাফি মতাদর্শের পূর্বসূরি বলে অভিহিত করে থাকেন। -অনুবাদক ।]

(আট) হিজরি সনের প্রথম দশ বছরের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি মুহাম্মদ আরবদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলীর সুযোগ নিয়েছিলেন ইসলামের সাফল্য এবং শক্তি প্রয়োগের জন্য। অনেক ক্ষেত্রে নবি পরাজয়ের ভারসাম্য রক্ষার জন্য অন্য দুর্বল গোত্রকে আক্রমণ করতেন। ফলে আরবের সাধারণ জনগণ সর্বদা আতঙ্কে থাকত। কোনো দুর্বল গোত্রের পরাজয় ইসলামের জন্য এনে দিত সফলতা নয়ত, আক্রমণ না- করার চুক্তি। ইসলামের বিস্তারের পিছনে রয়েছে আরবদের গনিমতের মালের প্রতি আকর্ষণ। গনিমতের মালের অংশ পাবার জন্য অনেকে জিহাদে যোগদানের আগ্রহ দেখায়। যারা জিহাদে যাবে তাদেরকে আল্লাহ গনিমতের মালের প্রতিশ্রুতি দিলেন। হুদায়বিয়ার শান্তিচুক্তির পর আল্লাহ বললেন : ‘আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তোমরা যুদ্ধে লভ্য বিপুল সম্পদের অধিকারী হবে। তিনি তোমাদের জন্য এ ত্বরান্বিত করবেন। তিনি তোমাদেরকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন যেন বিশ্বাসীদের জন্য এ হয় এক নিদর্শন আর আল্লাহ তোমাদেরকে এ দিয়ে সরল পথে পরিচালনা করেন। (সুরা ফাতহ ; আয়াত ২০) । এছাড়া বেহেশতের অশেষ সুখের উৎসাহ দিয়ে বলা হলো : যারা বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে তাদের জন্য আছে জান্নাত, যার নিচে নদী বইবে। এ-ই মহাসাফল্য। (সুরা বুরুজ ; আয়াত ১১) । নবির অনুসারীদের মধ্যে কতজন সুযোগ-সন্ধানী ছিলেন তাঁর কোনো বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যান আজ পর্যন্ত কেউ সংকলন করেন নাই। তথাপি অনুমান করা যায় যে, নবির মৃত্যু অদি যত ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাদের একটা বেশ বড় অংশই ভীতি অথবা সুবিধা আদায়ের কৌশল হিসেবে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। এর প্রমাণ হিসেবে আমরা দেখতে পাই যে, নবির মৃত্যুর পরপরই বিপুল সংখ্যক আরব ইসলাম ত্যাগ করে আবার পূর্বের ধর্মে ফিরে যায়, যার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধও চালাতে হয় খলিফাদের।

মদিনা ছিল ইসলামি রাষ্ট্রের রাজধানী এবং ইসলামের প্রাণকেন্দ্র। এখানেও হজরত আলি বিন আবু তালেব, আমার বিন ইয়াসির এবং আবু বকর আস-সিদিকদের মতো ত্যাগী ও সৎ লোকের সংখ্যা ছিল অতি-নগণ্য। বেশির ভাগই ইসলাম গ্রহণ করেছিল গভীর বিশ্বাস থেকে নয়। বরং বিভিন্ন সুবিধা পাবার আশায়। নবির মৃত্যুর পরে ক্ষমতা দখল নিয়ে সংঘটিত ঘটনাবলী এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। নবির মৃত্যুর পরে মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে বিরোধ লাগে ক্ষমতা দখল নিয়ে। এই বিরোধ- হাঙ্গামার জন্য নবির শবদেহ সৎকারে বিলম্ব ঘটে যায় তিন দিন পর্যন্ত। হজরত আলি, তালহা এবং জুবায়ের থেকে গেলেন ফাতেমার ঘরে। তাঁরা প্রতিদ্বন্দীদের নিয়ে যে ঝগড়া চলছিল তার সম্বন্ধে কিছুই জানলেন না। আবু বকর, ওমর, আবু উবায়দাসহ আরও কয়েকজন সাহাবি বিবি আয়েশার ঘরে ছিলেন। এ- সময় মদিনার আনসাররা খাজরাজ গোত্রের নেতা সাদ বিন ওবায়দার নেতৃত্বে এক গৃহে সমবেত হন। একজন ব্যক্তি বিবি আয়েশার গৃহে এসে আবু বকর এবং ওমরকে জানালেন, ক্ষমতা আনসারদের হাতে চলে যাচ্ছে। এটা থামাতে হবে। আনসাররা কী করছিলেন তা জানার জন্য সাথে সাথে হজরত আবু বকর এবং ওমর সেখানে উপস্থিত হলেন। তখন সাদ বিন ওবায়দা তাঁদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “আমরা হচ্ছি আনসার। আমরাই ইসলামের আসল সৈনিক। আমরা ছিলাম নবির সমর্থক। আমাদের পেশিবহুল বাহুর জন্য ইসলামের শক্তি এসেছে। আর মক্কাবাসী তোমরা হচ্ছ মুহাজির। তোমরাও সাহায্য করেছ। তাই এসো, তোমরা আমাদের সাথে যোগদান কর। একথা শোনার সাথে সাথে ওমর ক্ষুব্ধ হয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। কিন্তু আবু বকর ওমরের হাত ধরে তাঁকে থামালেন। এরপর আবু বকর তাঁর স্বাভাবিক শান্ত কণ্ঠস্বরে সাদ বিন ওবায়দাকে বললেন : ‘আনসারদের সম্পর্কে আপনি যা বলেছেন তা আমি স্বীকার করে নিচ্ছি। কিন্তু ক্ষমতার আইনসমত অধিকার আছে শুধুমাত্র কুরাইশদের। কারণ কুরাইশরা অন্যান্য আরব গোত্রের উর্ধ্বে। তারপর আবু বকর করমর্দন করলেন ওমর এবং আবু উবায়দার সাথে এবং আনসারদের উদ্দেশ্যে বললেন : আপনারা তাঁদের যে কোনো একজনের প্রতি আনুগত্য প্রদান করুন।”

ওমর ছিলেন বাস্তব ও দূরদর্শী ব্যক্তি। তিনি এই আকস্মিক সিদ্ধান্তে গা ভাসাতে চাননি। ওমর বুঝলেন ক্ষমতা দখলের এই যে পরিস্থিতি, তার একমাত্র সমাধান হচ্ছে আবু বকরকে সবাই নেতা হিসাবে গ্রহণ করে নেয়া। কারণ আবু বকরই ছিলেন সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ মুহাজির এবং তিনি নবির সাথে একই গুহায় বিপদসংকুল অবস্থায় বাস করেছিলেন। নবি যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন নবি আবু বকরকে নামাজের ইমামতি করতে আদেশ দিয়েছিলেন। এসব কারণ চিন্তা করে ওমর উঠে দাঁড়ালেন এবং আবু বকরের সাথে করমর্দন করে তাঁর প্রতি নিজের আনুগত্যের ঘোষণা জানালেন। এভাবে ওমর এক ধাক্কায় নেতৃত্বের সমস্যার সমাধান করে ফেললেন। ওমরের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ তর্ক করার অবকাশ পেলেন না। স্বাভাবিকভাবেই মুহাজিররা ওমরের আদেশ অনুসরণ করলেন তবে আনসাররা তাৎক্ষণিকভাবে কিংকতর্ব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। কিছু সময় পরে তাঁরাও আবু বকরের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। কথিত আছে যে, ওমর মদিনার খাজরাজ গোত্রের বয়োবৃদ্ধ ও রোগাক্রান্ত নেতা সাদ বিন ওবায়দার ক্ষমতা দখলের ইচ্ছা দেখে এতোই ক্রোধান্বিত হন যে, তিনি তাঁকে সভাকক্ষের বাইরে টেনে নিয়ে আসেন এবং কয়েকজনের সাহায্যে বেদম প্রহার করেন। কথিত আছে, এ- প্রহারেই সাদ বিন ওবায়দা” ঘটনাস্থলেই মারা যান। হজরত আলি বিন আবু তালিব প্রথমে আবু বকরের খেলাফতের প্রতি আনুগত্য জানালেন না। কিন্তু ওমর ভালোভাবেই জানতেন, আলি সমর্থন না দিলে অচিরে হাশেমি গোত্রের অনেকেই আলির পথ অনুসরণ করবেন। অর্থাৎ আবু বকর হাশেমি গোত্রের পূর্ণসমর্থন হারিয়ে ফেলবেন। ফলে আবু বকরের খেলাফত নিরাপদ থাকবে না। সে- জন্য ওমর প্রতিনিয়ত আলির সাথে দেখা করতে লাগলেন, আলাপ-আলোচনা, তর্ক চালালেন। শেষ পর্যন্ত ছয় মাস পরে আলি আবু বকরের প্রতি তাঁর আনুগত্য ঘোষণা দেন।

(নয়) মক্কার তের বছর বাদ দিলে ইসলামের ইতিহাসে বিশাল স্থান জুড়ে রয়েছে যুদ্ধ এবং ক্ষমতার লড়াই। নবি জীবিত থাকাকালীন সময়ে শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছিল ইসলামের প্রসারের জন্য। পৌত্তলিকদের ইসলাম মেনে নিতে বল প্রয়োগও হয়েছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। কিন্তু নবির মৃত্যুর পর যে বারংবার বিরোধ আর সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তার কারণ ছিল ক্ষমতা আর নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দিতা। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে আবু বকরের ক্ষমতা দখল সম্ভব হয়েছে ওমরের দক্ষতার জন্য। মৃত্যুকালীন সময়ে আবু বকর ইচ্ছা প্রকাশ করেন ওমর হবেন তাঁর স্থলাভিষিক্ত। কোনো সমস্যা ছাড়াই আবু বকরের মৃত্যুর পর ওমর খলিফা হয়ে যান। কেউ তাঁর বিরোধিতা করেননি। দশ বছর পর ওমর তাঁর জীবনের শেষ মুহুর্তে ছয় সদস্য বিশিষ্ট এক পরিষদ গঠন করেন তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচন করার জন্য। এই পরিষদের সদস্যরা ছিলেন: আলি, উসমান, আব্দুর রহমান বিন আউফ, তালহা, জুবায়ের এবং সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস। এই পরিষদ যখন বৈঠকে বসে তখন কেউই খলিফার পদের জন্য কারো নাম প্রস্তাব করেননি। কারণ প্রত্যেকেই চেয়েছিলেন খলিফা হতে। আব্দুর রহমান বিন আউফ খলিফা পদের প্রার্থী হওয়া থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিলেন। কেউ কোনো মন্তব্য করলেন না। তখন আব্দুর রহমানের প্রস্তাবে পরিষদের বৈঠক তিনদিনের জন্য মুলতুবি রাখা হল। এমনটি করা হলো মুহাজির ও আনসারদের মনোভাব বোঝার জন্য। এই তিনদিন আব্দুর রহমান ব্যক্তিগতভাবে পরিষদের প্রত্যেক সদস্যদেরকে প্রশ্ন করে জেনে নিলেন তাদের কী ধারণা অন্যদের সম্পর্কে। শোনা যায় আব্দুর রহমান হজরত উসমানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন উসমান যদি খলিফা মনোনীত না হন, তবে তিনি কাকে প্রস্তাব করবেন খলিফা হবার জন্য। উসমান জবাব দিলেন, খলিফা পদের জন্য আলিই হচ্ছেন সবচেয়ে যোগ্যতম ব্যক্তি। আব্দুর রহমান তখন আলিকে একই প্রশ্ন করলেন। আলিও উত্তর দিলেন খলিফা পদের জন্য উসমানই হবেন যোগ্যতম ব্যক্তি। এ- থেকে সবাই বুঝতে পারলেন, পরবর্তী খলিফা হবেন আলি অথবা উসমান।

এই দুজনের (আলি এবং উসমানের) চরিত্রে অনেক পার্থক্য ছিল। উসমান ছিলেন আয়েশি, বিনয়ী, নিরহঙ্কার এবং উদার। আলি প্রসিদ্ধ ছিলেন তাঁর সাহস, অনুরক্ততা এবং ধর্মীয় ব্যাপারে কঠোরতার জন্য। ওমর ছিলেন ভীষণ কঠোর এবং প্রচণ্ড মিতব্যয়ী। তাই ওমরের দশ বছরের শাসন ছিল অনেকের কাছে অসহনীয়। ভোগবাদী ব্যক্তিদের কাছে ওমরের শাসন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তাই তাঁরা চাচ্ছিলেন না আলির শাসন আসুক। কারণ তাঁরা জানতো আলির শাসনও হবে ওমরের মতোই কঠোর এবং আত্মসংযমী। কোরানের বিশিষ্ট সুন্নি তফসিরকারক এবং পারস্যের মুসলিম পণ্ডিত আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জরির আল-তাবারির (৮৩৮- ৯২৩ খ্রিস্টাব্দ) মতে, এই ব্যক্তিরা কুরাইশ বংশের বানু সাহম গোত্রের আমর ইবনে আল-আসকে নিয়োগ করলেন মধ্যস্থতার জন্য। একদিন আমর আলির সাথে দেখা করলেন এবং তাঁকে জানালেন যে আব্দুর রহমান বিন আউফ প্রথমে আলিকে খলিফার পদ নিতে প্রস্তাব করবেন। কিন্তু আলির মতো উচ্চাসনের ব্যক্তির উচিত হবে না, সাথে সাথে আব্দুর রহমানের প্রস্তাবে রাজি হওয়া। খলিফার পদের মর্যাদা এবং সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য দ্বিতীয়বার যেন আব্দুর রহমান আলিকে এই পদ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। যে দিন পরিষদের বৈঠক বসার কথা ছিল, সেদিন আব্দুর রহমান মসজিদের প্রচারবেদিতে দাঁড়িয়ে আলির দিকে মুখ করে বললেন : তিনিই (আলি) হচ্ছেন একত্রে নবির চাচাতো ভাই এবং জামাতা, প্রথম মুসলিম এবং ইসলামের জন্য নিবেদিত সৈনিক। আলি যদি প্রতিজ্ঞা করেন যে, তিনি আল্লাহর কিতাব মেনে চলবেন, নবির আদর্শ পালন করবেন, এবং আগের দুই খলিফাদের (আবু বকর ও ওমর) উদাহরণ অনুকরণ করবেন তবে তিনি (আব্দুর রহমান বিন আউফ) আলিকে খলিফা মেনে আলির প্রতি তাঁর আনুগত্য ঘোষণা করবেন। আলি উত্তর দিলেন, তিনি আল্লাহর কিতাব মেনে চলবেন, নবির রীতি-নীতিতে থাকবেন এবং যা উত্তম মনে করবেন তাই করবেন। এরপর আব্দুর রহমান উসমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আলির পর তিনিই হচ্ছেন খলিফা পদের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি। উসমান যদি অঙ্গীকার করেন, তিনি আল্লাহর কিতাব মেনে চলবেন, নবির আদর্শকে অনুসরণ করবেন এবং পূর্ববর্তী দুই খলিফার উদাহরণ গ্রহণ করবেন তবে তিনি (আব্দুর রহমান বিন আউফ) উসমানের প্রতি তাঁর আনুগত্য জানাবেন। উসমান একইভাবে অঙ্গীকার করলেন এবং আলিকে বাদ দিয়ে আব্দুর রহমান বিন আউফ উসমানের প্রতি আনুগত্য জানালে উসমান খলিফা হয়ে গেলেন। এটা হচ্ছে তাবারির বক্তব্যের সারাংশ। যদিও এখানে পুনরাবৃত্তি দেখাবে তবুও তাবারির বই থেকে বালামির” ফার্সি অনুবাদ তুলে দেয়া হলো। এখানে আমরা দেখতে পাই, ওমরের খেলাফতে জনগণ বিরক্ত হয়ে উঠলে নবির কয়েকজন সাহাবির মনে প্রাধান্য পায় ক্ষমতার প্রতি আকাঙ্ক্ষা আর উচ্চাভিলাষ।

হিজরত ওমর মারা গেলে মরুভূমির বেদুইনরা ওমরের জন্য শোক-বিলাপ করতে মদিনায় আসেন। আব্দুর রহমান তাঁদের সাথে আলাপ করলেন। তাঁদের প্রত্যেকে বললেন, উসমান হবেন খলিফার জন্য সর্বোৎকৃষ্ট ব্যক্তি। এক সন্ধ্যায় আবু সুফিয়ান আমর ইবনে আল- আসের সাথে দেখা করলেন। আবু সুফিয়ান আমরকে জানালেন যে, ওই সন্ধ্যায় আব্দুর রহমান তাঁর সাথে দেখা করে বলেছেন, যে খলিফা পদের জন্য দুজন প্রতিদ্বন্দী রয়েছেন, তাঁরা হলেন উসমান এবং আলি। আবু সুফিয়ান বললেন, তিনি উসমানকে পছন্দ করেন। আমর ইবনে আল-আস বললেন, ইতিমধ্যে আব্দুর রহমান তাঁর সাথেও এই ব্যাপারে দেখা করেছেন। এরপর আমর বললেন, আবু সুফিয়ানের মতো তিনিও উসমানকে খলিফা হিসাবে পছন্দ করবেন। এরপর আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাসা করলেন: আমরা কি করতে পারি? উসমান হচ্ছেন আয়েশি; তাই হয়ত অনেক ব্যাপারে অমনোযোগী হয়ে তাঁর কর্তব্য অন্যের উপর বর্তে দিতে পারেন। কারো অনুপস্থিতে হয়তো আলি খলিফা হয়ে যেতে পারেন। আবু সুফিয়ান আমরের গৃহে সেই রাত কাটালেন এবং আমরকে বারবার জিজ্ঞাসা করলেন কী উপায়ে উসমানকে খলিফা নিশ্চিত করা যায়। সে রাত্রে আমর আলির গৃহে গেলেন এবং আলিকে বললেন : আপনি জানেন যে আমি আপনার বন্ধু। সেই পুরনো দিন থেকেই আপনি আমার কাছে প্রিয়। খলিফা পদের প্রার্থীর জন্য অন্য সবাই সরে গেছেন। এখন শুধু আপনি আর উসমান রয়েছেন এই পদের জন্য। আজ সন্ধ্যায় আব্দুর রহমান সব বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন। অনেকে আপনাকে চায়, আবার অনেকে উসমানকে চায়। এখন আব্দুর রহমান আমার সাথে আলাপ করলেন। আমি তাঁকে জানিয়েছি, আমি আপনাকে খলিফা হিসাবে দেখতে চাই। আপনি যদি আমার কথায় মত দেন তবে আমি বলতে পারি, আগামীকালই আপনি খলিফার পদ পেয়ে যাবেন। আলি উত্তর দিলেন : ‘আপনি যা বলবেন আমি তা মানব।” আমর বললেন : “প্রথমে আপনাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে আমাদের এই কথোপকথন আপনি কাউকে জানাবেন না। আলি এই ব্যাপারে আমরকে অঙ্গীকার দিলেন। আমর বললেন : আব্দুর রহমান একজন বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি আপনাকে চাইবেন যখন তিনি দেখবেন যে আপনি সংশয়ী এবং খলিফার পদ নিতে বিলম্ব করছেন। তিনি যদি দেখেন যে আপনি খলিফার পদের জন্য অধীর এবং পদটা পেলে সাথে সাথে নিয়ে নিবেন তখন তিনি আপনার বিরুদ্ধে চলে যাবেন । আলি উত্তর দিলেন ; আমি আপনার কথামত চলব। পরে, ওই রাতে আমর উসমানের গৃহে গিয়ে উসমানকে বললেন : আগামী কালই আপনি খলিফা হয়ে যাবেন যদি আপনি আমার কথা শোনেন। আর আপনি যদি আমার কথায় মন না দেন তবে আলি আপনার কাছ হতে খলিফার পদ কেড়ে নিবেন। উসমান বললেন : ‘আমি আপনার কথায় কান দিচ্ছি, আপনি বলুন। এরপর আমর বললেন: আব্দুর রহমান একজন সৎ এবং অকপট ব্যক্তি। কেউ কিছু সতর্কভাবেই বলুক বা স্পষ্টভাবেই বলুক, আব্দুর রহমান তার কোনো তোয়াক্কা করেন না। তাই আগামীকাল আপনাকে খলিফার পদের জন্য আহ্বান করা হলে আপনি অনিচ্ছা দেখাবেন না। কোনো শর্ত দেয়া হলে তাতেও অসমতি জানাবেন না। তিনি যা বলবেন আপনি সাথে সাথে তার সাথে রাজি হয়ে যাবেন । উসমান উত্তর দিলেন: আপনি যে পরামর্শ দিলেন আমি তা মেনে চলব। এরপর আমর উঠলেন এবং নিজের গৃহে ফিরে গেলেন।

পরের দিন আমর মসজিদে গেলেন। ভোরের নামাজে আব্দুর রহমান ইমামতি করলেন। তারপর আব্দুর রহমান প্রচারবেদিতে দাঁড়িয়ে বললেন: ‘আল্লাহ ওমরকে আশীৰ্বাদ করুন। আপনারা সবাই জানেন যে ওমর তাঁর উত্তরাধিকারীর নাম বলে যাননি। তাঁর স্থলাভিষিক্তের নাম বলে গেলে তিনি যে পাপ বা পুণ্যের মালিক হতেন তার প্রতি তাঁর কোনো আকর্ষণ ছিল না। তাই তিনি তা না করে আমাদের পাঁচ জনের উপর এই দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে গেছেন। এদের মধ্যে সাদ এবং জুবায়ের তাদের মতামতের ভার আমার উপর ন্যস্ত করে দিয়েছেন। আর আমি খলিফা পদের প্রার্থী থেকে আমার নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছি। এখন পছন্দের জন্য দুইজন রয়েছেন, আলি এবং উসমান। আপনারা কাকে চান? আমি কার প্রতি আমার আনুগত্য দেখাব? আপনারা এই নামাজের পর গৃহে ফেরার আগে আমাকে জানান কে হবে বিশ্বাসীদের শাহজাদা? কেউ কেউ চাইলেন আলিকে, আবার কেউ চাইলেন উসমানকে। এই নিয়ে উভয় পক্ষে চলল হট্টগোল। সাদ বিন জিয়াদ তখন আব্দুর রহমানকে বললেন: আমরা আপনাকে সবচেয়ে পছন্দ করি। আপনি নিজেই আপনার উপর আনুগত্য জানান, কেউই তাতে আপত্তি জানাবে না। আব্দুর রহমান বললেন: এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিতর্ক বন্ধ করুন। ভালোভাবে চিন্তা করুন, এই দুজনের মধ্যে কে আপনাদের জন্য সবচেয়ে ভালো হবেন। আমার বিন ইয়াসির বললেন : বিরোধ এড়াতে চাইলে আপনি আলির উপর আনুগত্য দিয়ে দিন। মেকাদা” বললেন ; আমার সঠিক বলেছেন। আপনি আলির প্রতি আনুগত্য দেখালে কেউ তার বিরোধিতা করবেন না। আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবু সারাহ” (তিনি হজরত উসমানের দুধ- ভাই। ইসলাম ত্যাগ করে পরবর্তীতে নবির মক্কা বিজয়ের পর প্রাণভয়ে আবার ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে খলিফা উসমানের আমলে মিশরের গর্ভনর নিযুক্ত হন) জনতার মাঝে উঠে দাঁড়ালেন এবং আব্দুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন : ‘আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে আপনি উসমানের উপর আনুগত্য না দেখালে কিছু লোক আপনার বিপক্ষে যাবে। আব্দুল্লাহকে অভিশাপ দিয়ে আমার বললেন ; ওহে ধৰ্মত্যাগী! তুমি এখানে কেন? আমাদের জন্য কে হবেন বিশ্বাসীদের শাহজাদা তা তোমার মতো মুসলিমের বলার প্রয়োজন নাই। মাখজুম গোত্রের এক ব্যক্তি আমারকে উদ্দেশ্য করে বললেন ; ওহে ক্রীতদাস এবং ক্রীতদাসের সন্তান। তুমি এখানে কুরাইশদের বিষয়ে নাক গলাচ্ছ কেন?

উপস্থিত মুসলমানরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেলেন। তাদের মধ্যে শুরু হল তুমুল বিবাদ। সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস উঠে দাঁড়িয়ে আব্দুর রহমানকে বললেন : ‘এখনি এই বিষয়টি নিষ্পত্তি করুন। নয়তো খুনোখুনি লেগে যাবে। আব্দুর রহমান আবার উঠে দাঁড়ালেন, এবং জনতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন : ‘আপনারা শান্ত হোন। আমি যেভাবে ভাল বুঝি সেভাবে সমাধান করছি। এবার জনতা চুপ হল। আব্দুর রহমান আলিকে ডাকলেন : ‘আলি, আপনি দাঁড়ান। আলি দাঁড়ালেন এবং আব্দুর রহমানের কাছে গেলেন। আব্দুর রহমান তাঁর বাম হাত দিয়ে আলির ডান হাত ধরলেন। নিজের ডান হাত উত্তোলন করে আলির ডান হাত করমর্দনের প্রস্তুতি নিলেন এবং আলিকে জিজ্ঞেস করলেন: আপনি কি আল্লাহর নামে শপথ নিবেন যে আপনি মুসলমানদের জন্য কোরান, নবির সুন্নাহ এবং আগের দুই খলিফার উদাহরণ মেনে নিম্পত্তি করবেন? আলি সারণ করলেন রাত্রে আমরের দেয়া উপদেশ। আলি উত্তর দিলেন : “এই সব শর্তে কাজ করা দুরূহ হবে। আল্লাহ যেসব আদেশ দিয়েছেন তার সবগুলো আদেশ কেউ কি জানেন? আর নবির সকল সুন্নাহ কি কেউ জানেন? তবে আমার জ্ঞান, সাধ্য, এবং শক্তি অনুযায়ী আমি আমার দায়িত্ব পালন করে যাব। আমি আল্লাহর কাছে সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করছি। আব্দুর রহমান তাঁর বাম হাত থেকে আলির হাত ছেড়ে দিলেন, এবং তখনও তাঁর নিজের হাত উত্তোলিত রেখে আলিকে বললেন : “আপনার শর্তে চললে শিথিলতা ও দুর্বলতা এসে যাবে। তারপর আব্দুর রহমান উসমানকে বললেন : আপনি এখানে আসুন। উসমান দাঁড়ালেন এবং আব্দুর রহমানের কাছ গেলেন। আব্দুর রহমান আগের মতো তাঁর বাম হাত দিয়ে উসমানের ডান হাত ধরলেন এবং বললেন : আপনি কি আল্লাহর নামে শপথ নিবেন যে আপনি মুসলমানদের জন্য কোরান, নবির সুন্নাহ এবং আগের দুই খলিফার উদাহরণ মেনে নিম্পত্তি করবেন? উসমান উত্তর দিলেন: হ্যাঁ, আমি তা করব। আব্দুর রহমান এবার তাঁর ডান হাত দিয়ে আলির বাম হাত ধরে উসমানের হাতের উপর রাখলেন; এবং আব্দুর রহমান উসমানের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে বললেন: আল্লাহ আপনাকে যে কাজের ভার দিয়েছেন তার জন্য আল্লাহ আপনাকে আশীৰ্বাদ করুন। উপস্থিত সবাই তখন উসমানের নিকটে গিয়ে উসমানের প্রতি তাঁদের আনুগত্য জানাল। আলি বিসিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আব্দুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে আলি বললেন : ‘আপনি আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আলি ভাবলেন আমর ইবনে আল- আস তাঁকে যে পরামর্শ দিয়েছিলেন তা আব্দুর রহমান, উসমান, জুবায়ের এবং সাদের সাথে যোগসাজশ করেই দিয়েছেন।

হতাশ হয়ে আলি ঘুরে দাঁড়ালেন এবং চলে যাবার প্রস্তুতি নিলেন। আব্দুর রহমান আলিকে বললেন : আপনি কি আনুগত্য দেখাতে নারাজ? আল্লাহ বলেছেন : “যারা তোমার কাছে আনুগত্যের শপথ নেয় তারা তো আল্লাহর আনুগত্যের শপথ নেয়। আল্লাহ ওদের শপথের সাক্ষী। সুতরাং যে তা ভাঙে ভাঙার প্রতিফল তারই, (সুরা ফাতহ ; আয়াত ১০) । আপনি কি জানেন না, আমি নিজেই এই প্রতিদ্বন্দিতা থেকে সরে গিয়েছিলাম যেহেতু আমার ধারণা ছিল আমি যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না কেন আপনি তা মেনে নিবেন? ওমর কি বলেননি যে আব্দুর রহমানের সিদ্ধান্ত মেনে নিবে না, তাঁকে মেরে ফেলতে হবে?’ এ- কথা শোনার পর আলি ফিরে গেলেন এবং উসমানের প্রতি তাঁর আনুগত্য দিয়ে দিলেন। শপথ অনুষ্ঠান শেষ হলো ওই দিনেরই অপরাহ্নের নামাজের আগে। এরপর উসমান ইমাম হলেন।

এ- হল তাবারির পূর্ণ বিবরণ। বিবরণ থেকে বুঝা যায় আলি খলিফা হলে কী হবে তা নিয়ে আৰু সুফিয়ান উৎকণ্ঠিত ছিলেন। তাই উসমানের খলিফা হওয়া নিশ্চিত করতে আবু সুফিয়ান আমর ইবনে আল- আসের সাথে যোগসাজশ করছিলেন। ১২ বছর আগে যখন আবু বকর খলিফা হন তখন আবু সুফিয়ান এতোই ক্রুদ্ধ ছিলেন যে, তিনি আলিকে প্ররোচিত করেছিলেন যেন আলি আবু বকরের প্রতি আনুগত্য না দেখান। এছাড়াও আবু সুফিয়ান বলেছিলেন প্রয়োজন পড়লে তিনি মদিনা ভরে দিবেন কুরাইশ সৈন্য দিয়ে। কিন্তু যখন সময় আসল আলি এবং উসমানের মধ্যে পছন্দের তখন আবু সুফিয়ান নিলেন উসমানের পক্ষ। তার কারণ ছিল আবু সুফিয়ান জানতেন উসমানের শাসন তাঁর জন্যে ভালো হবে। আবু সুফিয়ান আলিকে ভয় করতেন কারণ আলি ছিলেন অতিশয় ধর্মপ্রাণ, যা আবু সুফিয়ানের জন্য বিপদসংকুল।

এটা এখন বলা যায়, ওমরের পর যদি আলি খলিফা হতেন তবে ইসলামের উজ্জ্বল দিনগুলি আরও অনেক দিন থাকত এবং ইসলামের প্রধান নীতিগুলো থেকে বিচ্যুত হবার সম্ভাবনা থাকত না। উসমানের স্বার্থপর আত্মীয়স্বজনেরা সুযোগ পেতেন না প্রধান প্রধান সরকারি পদগুলো কুক্ষিগত করতে। এছাড়া যেসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মুয়াবিয়া এবং উমাইয়া বংশের উত্থান হয় সেগুলোও এড়িয়ে যাওয়া যেত।

(দশ) নবির মৃত্যুর পর তাঁর সহচরেরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যান। এক দল তাঁকে সত্যি সত্যি আল্লাহর নবি’ হিসাবে গ্রহণ করেন আর আরেক দল তাঁকে গ্রহণ করেন এক নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে। এই দ্বিতীয় দলের সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে ইসলামি রাষ্ট্রের উত্থানে অবদান রাখেন। তাঁরা মনে করতেন যে, তাঁরাই হচ্ছেন এই রাষ্ট্রের উত্তরাধিকারী এবং এর সংরক্ষণ ও প্রতিরক্ষার জন্য তাঁরা বাধ্য। কিন্তু উভয় দলই নবির প্রতি ভীষণ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। দ্বিতীয় দলে যারা ছিলেন তাঁদের মধ্যে ওমর ছিলেন সবচেয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তি। রাষ্ট্রের সংরক্ষণের প্রতি উদ্বেগ থেকে ওমরকে শক্তভাবে তরবারি ধরতে হয়। এই তরবারি উচিয়েই তিনি নবির গৃহের দরজা থেকে বের হয়ে নবির মসজিদে আসেন এবং জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন : নবি মুহাম্মদ মরেননি, নবি মুসার মতো তিনি চল্লিশ দিন অনুপস্থিত থাকবেন। আবু বকর ওমরকে সারণ করিয়ে দিলেন কোরানের বাণী : তোমার মৃত্যু হবে, এবং তাদেরও। (সুরা জুমার ; আয়াত ৩১) । এরপর আবু বকর মসজিদের প্রচারবেদিতে দাঁড়িয়ে বললেন : তোমরা যদি ব্যক্তি মুহামদকে উপাসনা করে থাকো তবে সেই মুহাম্মদ মৃত। কিন্তু তোমরা যদি আল্লাহর উপাসনা করো তবে জেনে রাখো আল্লাহ কোনোদিন মারা যান না। তারপর আবু বকর এই আয়াত আবৃত্তি করলেন : মুহাম্মদ রসুল ছাড়া আর কিছুই নয়, তার পূর্বে বহু রসুল গত হয়েছে। সুতরাং সে যদি মারা যায় বা নিহত হয় তবে কি তোমরা পিঠ ফিরিয়ে পিছু হটবে? আর যে পিঠ ফিরিয়ে সরে পড়ে সে কখনও আল্লাহর ক্ষতি করতে পারবে না। আর আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কৃত করবেন। (সূরা আল-ইমরান ; আয়াত ১৪৪) । নবির মৃত্যুর পর মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দিতা দেখা দেয় শেষ পর্যন্ত তা ওমরের বিচক্ষণতা, দক্ষতা এবং কুশলতার জন্যই এড়ানো গেল। সে- জন্য ওমরের প্রশংসা অবশ্যই করতে হয়। ওমরের প্রচেষ্টার জন্যই আবু বকর খলিফা হয়ে যান। আর ওমরের নির্দেশেই আবু বকর ইসলামত্যাগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং কঠোর হস্তে বিদ্রোহী গোত্রদের দমন করেন।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে যে ওমরের মনে কোন বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে, ইসলাম ধর্ম না ইসলামি রাষ্ট্র? যাহোক, একটি ইসলামি রাষ্ট্র যখন গঠিত হয়েছে তখন তাকে রক্ষা করতেই হবে। মুহাম্মদের প্রতিষ্ঠিত নতুন সরকার আরবদের মাঝে বিরাজমান অজ্ঞানতা এবং বর্বরতার অবসান ঘটায়। এই অবস্থানকে সুদৃঢ় করা অতীব প্রয়োজন ছিল। বেদুইনদের মধ্যে যে অনন্তকাল ধরে যুদ্ধ-বিগ্রহ বিরাজমান ছিল তা নির্বাপিত করে ইসলামের ছায়ায় এক নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন ছিল। ওমর ছিলেন খুবই বাস্তববাদী ব্যক্তি। তিনি আরবদের চরিত্র ভালো করে জানতেন। ইসলামত্যাগীদের বিরুদ্ধে (রিদা যুদ্ধ) যুদ্ধের পর যে সৈন্যরা ফিরে এলো ওমর তাদেরকে রোম এবং ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাঠিয়ে দিলেন। এই ধরনের যুদ্ধের কথা আগে কেউ চিন্তাই করতে পারতেন না। ওমর জানতেন যে মরুভূমির বেদুইনরা কোনো দিন কৃষি কাজ অথবা শিল্পে মন দিবে না। কারণ এইসব বিষয়ে বেদুইনরা একেবারে অজ্ঞ। তাদের মধ্যে যে সুপ্তশক্তি আছে তার বহিঃপ্রকাশ দরকার। আরবের সীমান্তের বাইরে যে বিপুল ধনসম্ভার আছে তা দখল নেবার জন্য এই অশান্ত টগবগে বেদুইনদের প্রস্তুত করার চেয়ে আর ভালো কাজ কি হতে পারে? ইতিহাস প্রমাণ করে, হজরত ওমরের এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।

(এগারো) ইরান এবং রোমানদের মধ্যে যুদ্ধ চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। [ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেমস ডগলাস হওয়ার্ড জনসনের মতো ঐতিহাসিকদের মতে গ্রিক-রোমান বনাম পারস্য সাম্রাজ্যের ধারাবাহিক যুদ্ধ খ্রিস্ট পূর্ব ৯২ অব্দ থেকে শুরু হয়ে ৬২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। -অনুবাদক । কয়েক শতাব্দী ব্যাপী চলমান যুদ্ধে দুই সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক-সামাজিক কাঠামো এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়ে। এছাড়া একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল, ওই দুই সাম্রাজ্যের সীমান্ত অঞ্চলে প্রচুর আরব বসবাস করতো। দুই থেকে তিন শতাব্দী ধরে উত্তর আরব অঞ্চল থেকে আগত আরবেরা জর্দানের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল এবং সিরিয়া ও ইরাকে অনুপ্রবেশ করেছিল। রোমান ও ইরানের কর্তৃত্বতায় তারা একাধিক রাজ্য গঠন করেছিল। তারা (আরব সম্প্রদায়) অথবা তাদের চাইতে নিচু- সম্প্রদায়ের লোকেরা আরব খলিফার সৈন্যদের সাথে ভ্রাতৃত্ববোধ করত। ফলে এদের সহায়তা নিয়ে ওমরের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ছিটিয়ে থাকা আরবেরাই ওমরকে প্রেরণা দেয় সৈন্য-সামন্ত নিয়ে অগ্রসর হতে; কারণ তখন ইসলাম আরব জাতীয়তাবাদকে একটি সুসংঘটিত শক্তিতে পরিণত করেছে। এই যুদ্ধগুলি জয় ছিল একেবারে মহাকাব্যের কাহিনীর মতো, বিজয়ী হওয়ায় লব্ধ গনিমতের মাল আরবদের প্রভাব বিস্তার করতে সহায়তা করে। একে একে সামরিক বিজয় তাদের মনে দীর্ঘদিনের বিদেশিদের বশ্যতার যে কলঙ্ক ছিল তা দূর করে দিল।

(বারো) এটা সত্যি যে অনেকে আন্তরিক বিশ্বাস নিয়েই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। সিরিয়া এবং ইরাকে যখন আক্রমণ চালানো হয় তখনো অনেকেই ইসলামের আদেশ মান্য করে এই ধর্মযুদ্ধে (জিহাদ) যোগ দেন। কিন্তু ইতিহাস থেকে এটাও পাওয়া যায় যে গনিমতের মালের লোভেও অনেকে এই আক্রমণে শরিক হয়েছিলেন। কঠোর সংযম, তপস্যা, এবং পার্থিব ধনদৌলতের প্রতি অনীহা সীমিত সংখ্যক মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। নবির অনেক সাহাবিও যুদ্ধ থেকে প্রাপ্ত গনিমতের মাল থেকে প্রচুর ধনদৌলতের অধিকারী হন। এরকম দুজন হচ্ছেন হজরত তালহা এবং হজরত জুবায়ের। নবি একসময় তাদেরকে বেহেশত গমনের নিশ্চয়তাও দিয়েছিলেন। খলিফা ওমর তাঁর উত্তরাধিকারী নির্ণয়ের জন্য যে পরিষদ গঠন করেছিলেন তার সদস্যও ছিলেন তাঁরা উভয়ে। তাঁরা উভয়ে মৃত্যুর সময়ে মক্কা, মদিনা, ইরাক, এবং মিশরে বিশাল ধনসম্পদ রেখে যান যার পরিমাণ ছিলো তিন থেকে চার কোটি দিরহাম। উসমানের হত্যার পর এরা দুজনেই আলির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। কিন্তু তাঁরা যখন দেখলেন যে আলি পূর্বের খলিফা উসমানের মতো অপচয়ের পথ ধরবেন না এবং সরকারি তহবিলে অবৈধ হস্তক্ষেপ করবেন না, তখন আলির উপর থেকে তাঁরা আনুগত্য প্রত্যাহার করে নিলেন।

নবির স্ত্রী আয়েশা হলেন ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম সমানিত নারী। নবি তাঁর স্ত্রী আয়েশাকে গভীর ভালোবাসতেন। কোরানে আয়েশার ছিল অগাধ জ্ঞান এবং নবির উক্তি ও কর্ম সম্পর্কে তিনি অনেক নির্ভরযোগ্য হাদিস বলেছেন। আলি যখন খলিফা মনোনীত তখন আয়েশা হজরত উসমানের হত্যাকাণ্ডের বিষয় ধরে জনতার রায়ের প্রতি ভ্রক্ষেপ দেখালেন। বিবি আয়েশা মুসলমানদেরকে প্ররোচিত করলেন আলির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে। এটি জামালের যুদ্ধ (উটের যুদ্ধ) নামে পরিচিত। কিন্তু আয়েশার এরকম পদক্ষেপের পিছনে প্রধান কারণ ছিল খলিফা উসমান সরকারি কোষাগার থেকে তাঁকে যে ভাতা দিতেন আলি খলিফা হবার পর সেই ভাতা বন্ধ করে দেন। আর একটি কারণ হতে পারে, যখন আয়েশার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করা হয়েছিল তখন হজরত আলি বিবি আয়েশার বিরুদ্ধে অপ্রীতিকর মন্তব্য করেছিলেন। যদিও হজরত আলির এই মন্তব্য পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল। জামালের যুদ্ধ, সিফিফনের যুদ্ধ, নাহরাবানের যুদ্ধ, এসব যুদ্ধের মূল কারণ ছিল, খলিফা উসমানের আমলে যে শিথিলতা চলছিল, আলি তা আর চলতে দিলেন না। খলিফা ওমরের শাসনামলে যারা কঠোর সীমাবদ্ধতার মাঝে ছিলেন, তাঁরা উসমানের সময় বিলাসিতা ও আরামের সাথে জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। আলি খলিফা হবার পর কৃচ্ছতা সাধনের নীতি অবলম্বন করলেন। আলির এই নীতিতে অনেকেই বিরাগ হলেন। মুয়াবিয়াসহ অনেকেই নিজেদের ব্যক্তিগত অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য উঠেপড়ে লেগে গেলেন।

(তের) নবি জীবিত থাকাকালে আত্মিক-বিষয়ে উদাসীন, যোদ্ধা বেদুইন গোত্রের মধ্যে ইসলাম প্রচার করেছিলেন। কিন্তু তিনি তা করেছিলেন প্রথমত কোরানের বাণী ও কূটনৈতিক দক্ষতা দিয়ে। শক্তি ব্যবহার করেছেন একেবারে শেষ অস্ত্র হিসেবে। নবির মৃত্যুর পর খলিফারা এই অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। খলিফারা নবির নাম ভাঙ্গিয়ে আরব জাতীয়তাবাদী সাম্রাজ্য কায়েমে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এ- সময়েই নবিকে “অতিমানব’ হিসেবে পরিচিত করানো শুরু হয়। অনেক অবাস্তব বর্ণনাকে নবির অলৌকিক ঘটনা দাবি করে তাঁকে এক রহস্যময় অতিমানবে পরিণত করা হয়। যে নবি জীবিতকালে নিজেকে সাধারণ আল্লাহর দাস বলে পরিচিত করেছিলেন মৃত্যুর পরে তাঁকে মানুষের স্তর থেকে উঠিয়ে ফেরেশতা- রূপ দেয়া হয়। একজন মহামানবের মৃত্যুর পর তাঁর চরিত্রকে কেন্দ্র করে এ-ধরনের গুজব বা অবাস্তব- বর্ণনা রচনা করা একটা বহুল প্রচলিত অভ্যাস। সত্য এই যে, দুনিয়ার সব মহামানবের তাঁদের মহানুভবতা, তাঁদের যুগান্তকারী ভূমিকা, তাঁদের অনন্যসাধারণ কর্ম থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষদের মতোই তাদেরও নানা দুর্বলতা ছিল। তাঁরাও বিভিন্ন সময় ভুল করেছিলেন। তাঁদের ক্ষুধা পেয়েছে, পিপাসার্ত হয়েছেন, শীত-গ্রীষ্মে কষ্ট পেয়েছেন। তাঁদেরও যৌন- কামনা ছিল, যা হয়তো সাধারণ আচরণের বাইরে চলে যেত। তাঁরা পথ চলতে গিয়ে হোচট খেয়েছেন। তাঁরা বিরোধিতা সহ্য করেননি। এমনকি অনেক সময় তাঁরা পরশ্রীকাতর হয়েছেন। যা- হোক মহামানবদের মৃত্যুর পর অন্যান্যদের সাথে যে তাঁদের বিরোধ, তাঁদের ব্যর্থতা, তাঁদের দুর্বলতা জনসাধারণ ভুলে যায়। দেখা যায় যে জনতা কেবল মহামানবদের উৎকৃষ্ট কাজগুলিকেই মনে রাখে। এ- জন্য আমরা আবু আলি সিনা (হিজরি ৩৭০ বা ৯৮০ খ্রিস্টাব্দ- হিজরি ৪২৮ বা ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর রচিত “আল কানুন ( আরবিতে) এবং দর্শন ও বিজ্ঞান বিষয়ের উপর লেখা আশ শেফা (আরবিতে) ও দানেশনামা-ই আলাই (ফার্সিতে) বইগুলির কথা মনে রেখেছি। এছাড়াও আমরা মনে রেখেছি তাঁর ঝুঁকিপূর্ণ কর্মজীবনের কথা। কিন্তু তাঁর জীবনের ব্যর্থতাকে আমরা গোপন রেখেছি অথবা কৌশলে ঢেকে রেখেছি। দুনিয়ার কোটি কোটি লোক গভীর বিশ্বাস নিয়ে ধর্ম পালন করে থাকেন। ফলে ধর্মের প্রতিষ্ঠাতাদের নিয়ে “অতিমানবীয় চরিত্র দাঁড় করানো খুব প্রচলিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।

পরিখা যুদ্ধের (আহজাবের যুদ্ধ) সময় কুরাইশ প্রধান ওয়ায়না বিন হোসেন নামের গাতাফান গোত্রের এক ব্যক্তিকে তাদের প্রতিনিধি করে নবির কাছে পাঠাল। সে নবিকে প্রস্তাব দিল, নবি যদি মদিনার সে বছরের সমস্ত খেজুর দিতে রাজি হন, তবে তারা তাদের সমিলিত অবরোধকারী সৈন্য সরিয়ে নিবে। নবি রাজি হলেন না। তখন সেই প্রতিনিধি বলল, তারা মদিনার এক-তৃতীয়াংশ খেজুরে রাজি আছে। অর্থাৎ এ-পরিমাণ খেজুর পেলে তারা তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিবে। এর আগে নবি মদিনা রক্ষার জন্য পরিখা খনন করেছিলেন। তিনি জানতেন, এই সব গোত্রের সাথে মৈত্রীর বন্ধন স্থাপন করা তাঁর জন্য এক বিরাট বিপদ। তথাপি নবি গাতাফান গোত্রের প্রতিনিধির প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। যুদ্ধ-বিরতির চুক্তি লেখার সময় সাদ বিন মুয়াজ (আউস গোত্রের একজন নেতা) নবির কাছে জানতে চাইলেন তাঁর এই সিদ্ধান্ত আল্লাহ প্রদত্ত কি না? নবি বললেন, “এ আল্লাহ প্রদত্ত নয়; কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নিলে অবরোধকারীদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এবং তাদের ও ইহুদিদের সাথে যোগসাজশের যে ঝুঁকি আছে, তাও ভেঙে দেয়া যাবে, পরবর্তীতে ইহুদিদেরকে দেখে নেয়া যাবে। সাদ বিরক্তিভরে উত্তর দিলেন তাঁদের পৌত্তলিক আমলে কেউ সাহস করত না, একটা খেজুরও তাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক আদায় করতে। এখন তারা মুসলিম হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তারা মৈত্রীচুক্তি করার নামে অপমানিত হতে চায় না। গাতাফান গোত্রের অপমানের একমাত্র সঠিক জবাব হবে তরবারি। এ- বক্তব্য শোনার পর নবি তাঁর ভাবনা পরিবর্তন করলেন। তিনি সাদের কথা মেনে নিয়ে গাতাফান গোত্রের সাথে চুক্তি সই করা থেকে সরে আসলেন। এ-ধরনের অনেক ঘটনা নবির তেইশ বছরের নবুওতির সময়কালে ঘটেছিল। অনেক সময় নবির কোনো সহচর তাঁর সাথে কোনো বিষয়ে আলাপ করে পরামর্শ নিতেন, আবার অনেক সময় নবিও তাঁর সহচরদের উপদেশ গ্রহণ করতেন। সহচররা অনেক উপর ছেড়ে দিতেন। যা- হোক নবির মৃত্যুর পর তাঁর মানুষসুলভ চরিত্রের কথা সবাই ভুলে যান। নবির প্রত্যেকটি কর্ম আদর্শ এবং পূর্ণাঙ্গ বলে বিবেচিত হতে লাগল। তাঁর প্রত্যেক কাজকেই আল্লাহর ইচ্ছা মনে করা হতে লাগল। সরকারি এবং বিচারবিভাগীয় কর্তারা নবির প্রত্যেক কাজকে অতীতের উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার করতে লাগলেন। তখনকার দিনের সরল মনের সাধারণ নবি যা ছিলেন তারচেয়েও অনেক উচু আসনে বসিয়ে দিলেন। যে কেউ দাবি করত, সে নিজে নবির মুখ হতে কিছু শুনেছে তখন সে পেয়ে যেত অশেষ মর্যাদা ও কদর। কোরানে যে- সব আদেশ এবং আইনের কথা বলা হয়েছে তা পরিষ্কার এবং পূর্ণাঙ্গ নয়। সে- জন্য বিশ্বাসীদেরকে খুঁজতে হতো নবির উদাহরণ। যেমন কোরানে মুসলমানদের দৈনিক নামাজের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কিভাবে এই নামাজ পালন করতে

হবে তার বিশদ কিছু নেই। তাই নামাজ পড়ার নিয়ম ও পদ্ধতি নবির উদাহরণ থেকে নিতে হলো। এ- জন্যে প্রয়োজন পড়ল নবির জীবনকালের কাজ-কর্মের রীতিনীতি সঙ্কলনের। একে সুন্নাহ বলা হয়। তাঁর বাণীগুলিকে হাদিস হিসাবে সঙ্কলন করা হতে লাগল। ফলে হিজরি ৩- ৪ (খ্রিস্টাব্দ ৯-১০) শতাব্দীর মধ্যে সুন্নাহ ও হাদিসের সংখ্যা হাজার হাজার হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, শতশত অনুসন্ধান হতে লাগল সমগ্র মুসলিম বিশ্বজুড়ে। ফলে এক শ্রেণীর পেশাদার হাদিস- সংকলকের আবির্ভাব হতে লাগল যারা প্রচুর সম্মানের অধিকারী হলেন। তাঁরা হাজার হাজার হাদিস এবং সুন্নাহ মুখস্ত করে ফেললেন। তাঁদের একজন হলেন ইবনে ওকদা (মৃত হিজরি ৩৩২ বা খ্রিস্টাব্দ ৯৪৩) । বলা হয়ে থাকে তিনি আড়াই লক্ষ হাদিস জানতেন। সেইসাথে হাদিস বর্ণনাকারীদের ধারা।

পারস্যের এক প্রবাদে বলা হয় ; ‘কেউ যদি একটি বিশাল প্রস্তর হাতে নেয়, তবে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, সে কখনো ওই প্রস্তর নিক্ষেপ করবে না। সাধারণ জ্ঞান থেকে আমরা বলতে পারি এই যে, বিশাল হাদিস সঙ্কলন করা হল সেগুলোর সবই নির্ভরযোগ্য নয়। এর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এইসব হাদিস সংকলনে যারা সারা জীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন তাঁদের উদ্দেশ্য কী ছিল? ইবনে তায়মিয়া (হিজরি ৬৬১ বা খ্রিস্টাব্দ ১২৬৩ – হিজরি ৭২৮ বা খ্রিস্টাব্দ ১৩২৮) বলেছেন : নবি মুহাম্মদের কাছ থেকে আসা ব্যতীত আর কিছুই সত্য নয়।’ শোনা যায় যে হাসান বিন মুহাম্মদ আল-আরবিলি (মৃত হিজরি ৬৬০ বা খ্রিস্টাব্দ ১২৬১) নামে আর একজন মুসলিম পণ্ডিত বলেছেন : আল্লাহ আমাদেরকে সত্য জানিয়েছেন কিন্তু ইবনে সিনা আমাদেরকে মিথ্যা বলেছেন।”

(চৌদ্দ) নবির মৃত্যুর পর যতই দিন যেতে লাগল এবং হেজাজ থেকে দূরত্ব যত বেশি হলো নবিকে নিয়ে অলৌকিক দাবি ততোই বেশি হতে লাগল। এভাবেই একজন মানুষ যিনি ইতিহাসের বিশাল মোড় ঘুরিয়ে ছিলেন নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা, স্বকীয়তা, ধৈর্য, সাহস, কৌশলের সাথে, তাঁকে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে এক উপকথার নায়কে রূপান্তরিত করা হলো।

(পনের) আরবদের আক্রমণে ইরান সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়। হিজরি ১৫-১৬ সালে (৬৩৬-৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ) কাদেসিয়ার যুদ্ধে বারবার পরাজয় এবং হিজরি ২১ সালে (৬৪২ খ্রিস্টাব্দ) নেহাবন্দে পরাজয়ের গ্লানি আলেকজান্ডার এবং মঙ্গোলদের কাছে পরাজয়ের গ্লানির চাইতে বেশি ছিল। ইরানের দীর্ঘ দুৰ্দশার ইতিহাস থেকে দেখা যায়, এই জাতি করুণভাবে পরাজিত হয়, কারণ এখানে কোনো যোগ্য নৃপতি অথবা নেতা অথবা রাষ্ট্রনায়ক, অথবা সেনাপতি ছিলেন না। ইরান পরাজিত হয় স্বল্পসংখ্যক, অদক্ষ আরব সেনাবাহিনীর হাতে। শহরের পর শহর, প্রদেশের পর প্রদেশ আরব সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তারপর এসব স্থানের বাসিন্দারা আরবদের ধার্য করা শর্ত যেমন ইসলাম গ্রহণ অথবা জিজিয়া কর প্রদান করতে বাধ্য হয়। যারা জিজিয়া করের আশ্রয় নিল তারা পেল অতি নিম্নমর্যাদা। জিজিয়া কর এড়ানোর জন্য অনেকে ইসলাম গ্রহণ করে। আবার অনেকে অগ্নিউপাসক জরথুস্ত্র পুরোহিত মবেদের হাত থেকে মুক্তির জন্য ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণ খুব সহজ। শুধু দরকার আল্লাহর একত্ববাদকে স্বীকার করা এবং মুহাম্মদের নবুওতি মেনে নেওয়া। ধীরে ধীরে ইসলাম জনসাধারণের মাঝে বিস্তার লাভ করে। সেই অতীতে ইরানিদের জাতীয় চরিত্র ছিল এই রকম, যখন কেউ তাদেরকে যুদ্ধে পরাজিত করত তখন ইরানিরা বিজয়ী শাসকের অনুগ্রহভাজন হবার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে যেত। তারা নতুন শাসকদের আজ্ঞাপালন, সেবা পরিচর্যায় নিয়োজিত হতো। এছাড়া কৃপা পাবার জন্য ইরানিরা তাদের জ্ঞান ও বুদ্ধি নতুন প্রভুদের হাতে সমর্পণ করে দিত। তাই আরবরা যখন ইরান দখল নেয়, তখন ইরানিরা আরবি ভাষা রপ্ত করে নেয়। আরবদের আদব-কায়দা অনুকরণ করা শুরু করে। অবশ্য ইরানিরাই আরবি ব্যাকরণ এবং বাক্যগঠনবিধি নিয়মাবদ্ধ করে। ইরানিরা তাদের নতুন প্রভুদের অধীনে চাকুরি পাবার জন্য যে কোনোভাবে আজ্ঞানুবর্তী হতে কুষ্ঠা বোধ করত না। ক্ষেত্রবিশেষে ইরানিরা ইসলামি রীতিনীতি পালনে আরব শাসকদেরও ছাড়িয়ে যায়। আর নিজেদের হাজার বছরের পারস্য সংস্কৃতি, ধর্ম, রীতিনীতি, প্রথা, কৃষ্টির প্রতি অবজ্ঞা আর অবহেলা প্রদর্শন করে। আরব জাতি এবং আরব বীরদের উচ্চপ্রশংসায় তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শুধু তাই-ই নয় ইরানিরা প্রমাণ করতে চাইল বীরত্ব, বদান্যতা, এবং নেতৃত্ব শুধুমাত্র আরবদের মধ্যেই আছে। প্রাক-ইসলামি যুগের আরবের বেদুইন কবিদের কবিতাগাঁথা আর সাধারণ উক্তিকে পাণ্ডিত্যের রত্নভাণ্ডার এবং আচার আচরণের আদর্শ হিসাবে গণ্য করল ইরানিরা। তারা আরব গোত্রের আশ্রিত ব্যক্তি এবং আরব নেতাদের (আমির) ভৃত্য হয়ে নিজেদের ধন্য মনে করত। বিবাহের জন্য তাদের কন্যাদেরকে আরবদের হাতে তুলে দিলে যারপরনাই খুশি হতো। আরও খুশি হতো যখন তারা আরবি ভাষার নাম দিয়ে নিজেদের ভূষিত করত। স্বকীয়তা, সাহিত্য, কৃষ্টি ত্যাগ করে পরাজিত জাতি হিসেবে ইরানিরা শীঘ্রই আরবি সাহিত্য, হাদিস সংকলন, ইসলামি আইনের পেছনে নিজেদের মেধা- শ্রম- সময় ব্যয় করে। ইসলামি সাহিত্য নিয়ে যত মুখ্য কাজ হয়েছে, তার বেশির ভাগই করেছেন ইরানের জনগণ। যদিও প্রথমদিকে ইরানে ইসলাম গৃহীত হয়েছে ভীতি থেকে এবং আরব শাসকদের প্রচারণায়। তবে দুই-তিন প্রজন্ম পর চিত্র পাল্টে যায়। খোদ আরব-মুসলমানদের চেয়ে ইরানে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি হয়ে যায়।

তোষামোদ এবং মিষ্টিকথা দিয়ে নতুন শাসকদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে ইরানিরা এতোই সুদক্ষ হয়ে উঠে যে, কথিত আছে একজন প্রসিদ্ধ উজির আয়নায় কখনো নিজের চেহারা দেখতেন না, পাছে তিনি এক ইরানির চেহারা দেখে ফেলেন এই লজ্জায়। প্রথমদিকে ইরানিরা তাদের নতুন শাসকদের আজ্ঞাবহ হয়ে সেবা করত, মনোরঞ্জনের যথাসাধ্য চেষ্টা করত, কারণ তারা মনে করেছিলেন আরবরা ফিরে গেলে তারা নিজেরা শাসক হয়ে যাবে এবং গনিমতের মালের ভাগ পাবেন। কিন্তু সময় যতই যেতে লাগল তারা নিজেদের পরিচয় নিয়ে দ্বন্দুের মধ্যে পড়ে গেল। হিজরি তৃতীয়- চতুর্থ শতাব্দীর (নবম-দশম খ্রিস্টাব্দ) দিকে ইরানে প্রচুর লোক ছিল, যারা নিজেদের ভূখণ্ড ছেড়ে হেজাজকেই মানবজাতির জন্য স্রষ্টার আশীর্বাদ হিসেবে মনে করতো। ইরানের এই জাতীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে বুঝা যায়, কেমন করে এ ভূখণ্ডে কুসংস্কার আর অতিলৌকিক বিশ্বাস মানুষের মনে বিস্তার লাভ করেছিল। নবির নবুওতি লাভের পর প্রথম তের বছরের মক্কা জীবন আর পরের দশ বছরের মদিনা জীবনে যে ভয়াবহ বিপদসংকুল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন হেজাজে, সে-সম্পর্কে বাস্তব তথ্য জানা থাকলে ইরানের জনগণ এতো সহজে আরবের বশ্যতা স্বীকার করে নিত না। ধর্মও প্রতিষ্ঠা পেত না।

এ- প্রসঙ্গে মুহাম্মদ বাকের মাজলেসির’ (হিজরি ১০৩৭ বা খ্রিস্টাব্দ ১৬২৭ – হিজরি ১১১০ বা খ্রিস্টাব্দ ১৬৯৯) লেখা বেহার আল- আনোয়ার’ বইয়ের কথা আবার উল্লেখ করা যেতে পারে। পারস্যের সাফাবিদ শাসনকালের শেষের দিকের এই লেখক ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ মুজতাহিদ (শিয়া ধর্মতত্ত্ব ও ইসলামি আইনবিশারদ) । তিনি তাঁর বইয়ে লিখেছেন : “কথিত আছে একদা ইমাম হাসান এবং হোসেন তাঁদের পিতামহের (নবি মুহাম্মদ) কাছে রোজা ভাঙার দিনে নতুন পোশাক উপহার চাইলেন। এ- সময় জিবরাইল ফেরেশতা এসে গেলেন এবং প্রত্যেকের জন্য একটি করে সাদা পোশাক দিয়ে দিলেন। নবি বললেন, এই দুই বালক রঙিন পোশাক পরতে পছন্দ করে, কিন্তু জিবরাইল নিয়ে আসলেন সাদা পোশাক। নবির কথা শুনে জিবরাইল বেহেশত থেকে একটি টব এবং একটি জগ নিয়ে আসলেন। এরপর জিবরাইল বালকদের বললেন, তিনি টবটি এক বিশেষ ধরনের তরল পদার্থ দিয়ে পূর্ণ করে দিবেন। তারপর বালকেরা তাদের নিজস্ব পোশাক ওই টবে ডুবিয়ে দিলে তাঁরা যে রং চাইবেন তাই পাবেন। ইমাম

হাসান সবুজ রং চাইলেন এবং ইমাম হোসেন চাইলেন লাল রং। যখন পোশাকদ্বয় রঞ্জিত হচ্ছিল তখন জিবরাইল কেঁদে উঠলেন। নবি জিবরাইলকে তাঁর কাঁদার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন, কেননা বালকেরা তাদের পোশাকে রং পেয়ে খুশি হয়েছে। জিবরাইল বললেন, ‘হাসানের সবুজ রঙ পছন্দের অর্থ হলো তিনি বিষপানে শহীদ হবেন, এতে তাঁর দেহ সবুজ হয়ে যাবে। আর হোসেনের লাল রং পছন্দের অর্থ হল তিনি শহীদ হবেন যখন তাঁর রক্তে তাঁর পোশাক ভিজে যাবে। উল্লেখ্য এই কাল্পনিক বক্তব্য বাহাই মতাবলম্বী লেখক মির্জা জানি তাঁর “নক্তাত আল- কাফ-১৫২ বইয়েও উদ্ধৃতি দিয়েছেন। বাহাইরা নিজেদের শিয়া ইসলামের সংস্কারক এবং এক নতুন শিয়া- ধর্মের প্রবক্তা হিসেবে দাবি করে থাকেন। কিন্তু তাদের এই অযৌক্তিক ক্রিয়াকলাপে মনে হয়, মুখে দাবি করলেও কুসংস্কার এই সংস্কারবাদী শিয়াদের মন থেকে বিদায় হয়নি।

মদিনায় হিজরত করার পর প্রথম বছর নবি মুহাম্মদ এবং সাহাবিরা নিদারুণ আর্থিক অনটন আর অসহায় অবস্থার মধ্যে দিন যাপন করেন। নাখলাতে যুদ্ধের পর এই পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়। নবির সাহাবির মধ্যে আব্দুর রহমান বিন আউফ ছাড়া আর কারো ব্যবসা-বাণিজ্য করার মতো তেমন অভিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা ছিল না। মদিনায় আসার পর আব্দুর রহমান আউফ মদিনার বাজারে একটি ব্যবসা স্থাপন করেন। এই ব্যবসায়ে তাঁর কিছু মুনাফা আসে। নবির আরও কয়েকজন সাহাবি মদিনার ইহুদি বাসিন্দাদের তালবাগানে চাষাবাদ এবং কূপখননের কাজ পান। অবশ্য এই সাহাবিরা খেজুর বাগানের রক্ষণাবেক্ষণ বা চাষের কোনো কিছুই জানতেন না। ফলে বাগান রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া তাঁদের অন্যকিছু করার সুযোগ ছিল না। নবির ক্ষুধা তৃষ্ণা সহ্য করার মানসিকতা অসম্ভব রকমের দৃঢ় ছিল। মদিনায় গিয়ে তিনি যখন অসহায় অবস্থায় পড়েন তখন ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য প্রায়ই দুই- একটি খেজুর খেয়ে বিছানায় যেতেন। অনেক সময় তাঁর কপালে রাতের আহারও জুটতো না। নবির প্রতি অসমান না দেখানোর জন্য এই সত্য প্রকাশ করা হয় না। এর পরিবর্তে শুধু নবির কীর্তি ও অবদানের কথা প্রকাশ করা হয়। নবির লক্ষ্য ছিল সমগ্র আরবে তাঁর নেতৃত্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। তিনি দরিদ্রতা এবং অসঙ্গতিকে কোনো সময়ই তাঁর লক্ষের অন্তরায় হিসাবে দেখেননি। ইতিহাসে এই ধরনের মানসিক শক্তিতে বলীয়ান পুরুষের উদাহরণ পাওয়া বিরল।

মুহাম্মদের ঘটনাবহুল জীবন থেকে বোঝা যায়, তিনি মনুষ্য সমাজেরই একজন মানুষ ছিলেন। তিনি কোনো অতিমানব বা আলৌকিক শক্তির অধিকারী ছিলেন না। অলৌকিক শক্তির সাহায্যও তিনি কখনো লাভ করেননি। বদর যুদ্ধে মুসলমানরা জয়ী হয়েছিলেন, তার কারণ যে তাঁরা সাহসী এবং অবিচল থেকে লড়াই অব্যহত রেখেছিলেন। আর কুরাইশদের মাঝে দেখা দিয়েছিল অবহেলা আর শিথিলতা। ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের কারণ ছিল, তাঁরা নবির যুদ্ধ-কৌশলের প্রতি অনুগত ছিলেন না। সৃষ্টিকর্তা যদি সর্বদাই মুসলমানদের সাহায্য করতে প্রস্তুত থাকতেন তবে মুসলমানদের শক্রর সাথে ভয়ঙ্কর লড়াই, যুদ্ধ, হানাহানি, সংঘর্ষে লিপ্ত হবার প্রয়োজন পড়ত না, কিংবা মদিনার রক্ষার জন্য পরিখা খননেরও দরকার ছিল না। এমন-কী বানু কুরাইজা গোত্রকে হত্যার প্রয়োজন পড়ত না। কোরানে রয়েছে : ‘আমি ইচ্ছা করলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারতাম। (সুরা সিজদা : আয়াত ১৩) । বুঝা যায়, এটা অনেক যৌক্তিক যে আল্লাহ ইচ্ছা করলেই দুনিয়ার সকল অবিশ্বাসী ও ভণ্ডদের হৃদয় ইসলাম দিয়ে পরিপূর্ণ করে দিতে পারতেন। কিন্তু আল্লাহ চান নাই বলে এমনটা হয়নি।

নবি একপক্ষ কালব্যাপী মদিনার ইহুদি গোত্র বানু কায়নোকার বাসস্থানে সামরিক অবরোধ দেন এবং তাদের খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে কায়নোকা গোত্রের ইহুদিরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। নবি তাঁদেরকে হত্যা করতে চাইলে তাদের পুরানো বন্ধু আব্দুল্লাহ বিন উবায় এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ করেন।

তিনি সতর্ক করে দেন, যদি ইহুদি বানু কায়নোকা গোত্রকে হত্যা করা হয়, তবে তিনি এর বিরোধিতায় নেমে পড়বেন এবং নবির সঙ্গ ছেড়ে দিবেন। আব্দুল্লাহ বিন উবায়ের এ- বক্তব্যে নবির মুখ ক্রোধে কালো হয়ে যায়। তথাপি তিনি চিন্তাভাবনা করে তাঁর পূর্বের সিদ্ধান্ত বদল করেন। হত্যার বদলে তিনদিনের সময় দেয়া হলো মদিনা ত্যাগ করার জন্য। এই ধরনের আরও ভজন- খানেক ঘটনা থেকে আমরা নবি মুহাম্মদের জীবনী এবং ইসলামের উত্থানের ইতিহাস জানতে পারি। এই ঘটনাগুলি চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে, নবির জন্য কোনো অলৌকিক শক্তি আসলে কাজ করেনি। ইতিহাসের অন্যান্য ঘটনার মতোই মুহাম্মদের জীবনে যা ঘটেছিল তার পিছনে ছিল প্রাকৃতিক কারণ। কোনো দৈবের হাত নয়। এই বিশ্লেষণ বা দৃষ্টিভঙ্গি নবি মুহাম্মদকে কোনোভাবেই হীন বা দুর্বল করে না। বরং ইতিহাসের একজন অনন্যসাধারণ ব্যক্তি হিসেবে নবি মুহামদের দক্ষতা, বিচক্ষণতা, সাহস, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি চারিত্রিক গুণাবলীকে আরও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তোলে।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে মানুষ অনেক সময় সবকিছুর বিশদ অনুসন্ধান বা বিশ্লেষণ করে যাচাই করতে অভ্যস্ত নয়। মানুষের কাল্পনিক মন সবকিছুর পিছনে অলৌকিক ঈশ্বরের হাত দেখে। আদিমযুগের লোকেরা বজ্রপাত এবং বিদ্যুতকে স্রষ্টার কণ্ঠস্বর এবং ঝলক বলে মনে করত। তারা বিশ্বাস করত ওই নৃপতি মানুষের অবাধ্যতার জন্য ক্ষেপে গিয়ে এই ধরনের কার্যকলাপ প্রদর্শন করেন। আমাদের চারপাশের অতি বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাও অনেক সময় ভুলে যান যে প্রত্যেক ঘটনার পিছনে কার্যকারণ রয়েছে। ফলে তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে তুচ্ছ ঘটনার পিছনেও স্বগীয় হস্তক্ষেপ আবিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁরা মনে করেন ওই সর্বশক্তিমান নৃপতি তাদেরই মতো। যেসব ব্যক্তি এই ধরনের চিন্তা করেন তাঁরা বিশ্বাস করতে পারেন যে, এই মহাবিশ্বের পালনকর্তা আল্লাহ বেহেশত থেকে নবির দৌহিত্র হাসান এবং হোসেনের জন্য পোশাক পাঠিয়ে দেন এবং স্রষ্টার বার্তাবাহক পোশাক দুটিকে সবুজ এবং লাল রঙে রঞ্জিত করে দেন।

এটা সত্য যে মাজলেসির লেখা বেহার আল আনোয়ার কোনো ব্যতিক্রমী বই নয়। আর এটাই একমাত্র বই নয় যে, কারকারা নামে এক মাছ যে সারসারার পুত্র, যে সারসারা আবার ঘারঘারার পুত্র, সে আলি বিন আবু যেতে পারেন। এই ধরনের শতশত বই ইরানের বাজারে পাওয়া যায়। যেমন কয়েকটা বইয়ের নাম হচ্ছে : হেলায়াল আল- মোল্লাকিন”, জান্নাল আল-কলুব, আনোয়ার-ই নোমানি, মেরসাদ আল- ইবাদ*। এছাড়াও রয়েছে নবি ও ওলামাদের কাহিনি সংকলন করে লেখা প্রচুর বই। একটা জাতির মানসিকতাকে বাস্তব-বুদ্ধি-চিন্তাশক্তি এবং যুক্তিবোধকে বর্জন করে কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে ফেলতে এই ধরনের যে কোনো একটি বই- ই যথেষ্ট। অলৌকিক গল্প ছড়িয়ে দেয়া আসলে মাদকদ্রব্য ব্যবসার পর্যায়েই পড়ে। এই মাদকে আসক্ত নারী-পুরুষ উভয়েই যুক্তি-চিন্তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।

মুহাম্মদ তাঁর নবি জীবনে যা আয়ত্ত করেছেন, যা প্রচার করেছেন, যা প্রয়োগ করেছেন তার সবই লোকেরা জানে। লোকেরা আরও জানে যে তাঁর ক্ষুধা পেত, তিনি খাবার খেতেন, এবং সাধারণ জনগণ যেভাবে তাদের সহজাত প্রবৃত্তির বশে চলে নবিও সেইভাবে চলেছেন। তাঁর চরিত্রকে অতিমানব হিসাবে দেখিয়ে, জনতাকে বিভ্রান্ত করা কোনো মতেই মানবজাতির জন্য মঙ্গলকর নয়।

 

——————

পাদটীকা

৯৬. আবু উবায়দা বিন আব্দুল্লাহ বিন আল জারাহ নবির ইসলাম প্রচারের শুরু দিকেই ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি সাময়িকভাবে আবিসিনিয়ায় দেশান্তরী হন। যে দশজনকে বেহেশত গমনের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন আবু উবায়দা তাঁদের একজন। তিনি সিরিয়ার শাসনকর্তা ছিলেন হিজরি ১৫ (৬৩৬ খ্রিস্টাব্দ) থেকে হিজরি ১৮ (৬৩৯ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত। প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান হিজরি ১৮ সালে। তিনি হম, আলেপ্পো এবং আন্তিওক (Antioch) দখল করেন।

৯৭. ভিন্নমতে আহত সাদ বিন ওবায়দা অসুস্থ অবস্থায় মারা যান চার-পাঁচ বছর পর।

৯৮. আবু আলি মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ বালামি (মৃত্যু হিজরি ৩৬৩ বা ৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ) । সামানিদ বংশের শাসনামলে (আমির আবদুল মালেক- ১ এবং মানসুর- ১- এর আমলে) তিনি বোখারার উজির ছিলেন। (উল্লেখ্য পারস্যে সামানিদ বংশের শাসনকাল ধরা হয় ৮১৯-৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।) আমিরদের অনুরোধে তিনি আল-তাবারির লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘History of the Prophets and Kings’ ফারসিতে অনুবাদ করেন ‘Tarikh-e Bal’ami নামে। নব্যফার্সি গদ্য লেখার মধ্যে এই লেখা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এই অনুবাদ তাবারির মৌলিক আরবি গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত ভাষ্য। অনুবাদটিতে অনেক সম্পূরক বিষয় স্থান পেয়েছে। এগুলো হচ্ছে প্রধানত ইরানের বিষয়াবলী। এই গ্রন্থের ফরাসি সংকলন হচ্ছে : H. Zotenberg, Chronique de… Tabari traduite sur la version persane de… Belami, 4 vols. Paris 1876 1874, reprinted 1948.

৯৯. আমার বিন ইয়াসির এবং আল মিকদাদ বিন আমর ছিলেন ইসলাম প্রচারের শুরুর দিকের মুসলমান। নবির উল্লেখযোগ্য সাহাবি এবং আলির বিশিষ্ট সমর্থক। আমারের মাতা ছিলেন একজন ক্রীতদাসী, যার মালিক ছিলেন কুরাইশ গোত্রের মাখজুম বংশের এক ব্যক্তি। ওমরের আমলে আমার কুফার শাসক নিয়োজিত হন এবং খুজেস্তান জয় করেন। হিজরি ৩৭ (৬৫৭ খ্রিস্টাব্দ) সালে আলির পক্ষ নিয়ে সিফিফনের যুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আমার প্রাণ হারান। আমার, মিকদাদ, আবুজর গিফারি এবং সালমান আল-ফার্সিদেরকে প্রথম শিয়া মতাবলম্বী হিসাবে ধরা হয়।

১০০ দ্রষ্টব্য : তৃতীয় অধ্যায়ে আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবু সারাহ সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে।

১০১. বেহার আল- আনোয়ার’ হচ্ছে আরবি ভাষায় রচিত ১০২ খণ্ডের হাদিসের এক বিশাল সংকলন। মুহামদ বাকের মাজলেসি ফার্সি ভাষায় আরও জনপ্রিয় গ্রন্থও রচনা করেছেন। এর মধ্যে আছে নবি এবং বারো ইমামের জীবনী। তিনি ক্ষমতায় এসে ইরানের সুন্নি, সুফি, ইহুদি এবং অগ্নিউপাসক জরথুস্ত্রপন্থীদের উপর নিপীড়ন চালান। এর ফলে পারস্যের সাফাবিদ রাজতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। পরিণতিতে হিজরি ১১৩৫ (১৭২২ খ্রিস্টাব্দ) সালে আফগান সুন্নিরা এই রাজত্বের অবসান ঘটায়।

১০২. দ্রষ্টব্য ; পাদটীকা ৩।

১০৩. মুহামদ বাকের মাজলেসি লিখিত ফার্সি গ্রন্থ।

১০৪. শায়খ নাজিম উদ্দিন দায়ার (মৃত হিজরি ৬৫৪ বা ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দ) লিখিত পুস্তক। তিনি সুফিবাদের বিশিষ্ট প্রবক্তা। তাঁর লেখা মেরশাদ আল ইবাদ গ্রন্থে ওমর খৈয়ামের প্রথম উল্লেখ দেখা যায়, যেখানে খৈয়ামকে দার্শনিক এবং নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে ভৎসনা করা হয়েছে।

 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *