11 of 11

৬৩.০১ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতে উল্লিখিত ব্যক্তিবৃন্দের পরিচয় (ক – ঞ)

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতে উল্লিখিত ব্যক্তিবৃন্দের পরিচয়

অক্ষয়কুমার সেন (১৮৫৮ – ১৯২৩) — বাঁকুড়া জেলার ময়নাপুর গ্রামে জন্ম। পিতা হলধর সেন। মাতা বিধুমুখী দেবী।

ঘণ কৃষ্ণবর্ণ, রুগ্ন শরীর এবং মন্দ আকৃতির জন্য স্বামী বিবেকানন্দ রহস্যচ্ছলে তাঁহাকে ‘শাঁকচুন্নী’ বলিয়া ডাকিতেন। প্রথম জীবনে অক্ষয়কুমার কলিকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে ছেলেদের পড়াইতেন বলিয়া তাঁহাকে ‘অক্ষয় মাস্টার’ বলিয়া ডাকিতেন। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় বার বিবাহ করেন। তিনি তাঁহার পরবর্তী জীবনে বসুমতী পত্রিকার অফিসে চাকুরী গ্রহণ করেন। অক্ষয়কুমার ঠাকুরের গৃহী ভক্ত, দেবেন্দ্রনাথ মজুমদার সহ কাশীপুরে ঠাকুরের অপর ভক্ত মহিমাচরণ চক্রবর্তীর বাড়িতে প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করেন এবং তঁহার কৃপাদৃষ্টি লাভ করেন। অতঃপর তিনি দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত শুরু করেন এবং বহুবার ঠাকুরের পবিত্রসঙ্গ লাভ করেন। কাশীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণের কল্পতরু হওয়ার দিনও অক্ষয়কুমার উপস্থিত ছিলেন। ঠাকুর সেদিন অক্ষয়কুমারকে নিজের কাছে ডাকিয়া তাঁহার বক্ষ স্পর্শ করিয়া কানে ‘মহামন্ত্র’ দান করিয়াছিলেন। পরবর্তী কালে দেবেন্দ্রনাথ মজুমদারের পরামর্শে, স্বামী বিবেকানন্দের উৎসাহে এবং সর্বোপরি শ্রীশ্রীমায়ের আশীর্বাদে ঠাকুরের লীলা সম্বলিত ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথি’ পদ্যাকারে রচনা করেন। এইটি তাঁহার জীবনের ক্ষয়কীর্তি। তাঁহার প্রণীত অপর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘শ্রীরামকৃষ্ণ মহিমা’। এই দুইখানি গ্রন্থের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ পরিমণ্ডলে তিনি বিশেষ সুপরিচিত। শ্রীশ্রীঠাকুরের মহাসমাধির মুহূর্তে অক্ষয় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অক্ষয়কুমারের শেষ জীবন স্বগ্রামে অতিবাহিত হয়।

অঘোড় ভাদুড়ী — শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহীভক্ত। তাঁহার পিতা ডা: বিহারীভাদুড়ী। কলিকাতা সিমলা অঞ্চলে ১১, মধু রায় লেনে ঠাকুরের সহিত প্রথম সাক্ষাৎ হয়। রামচন্দ্র দত্তের গৃহে শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শনলাভে তিনি ধন্য হন। ঠাকুরের কণ্ঠে গান এবং ধর্মপ্রসঙ্গ শুনিয়া তিনি অভিভূত হইয়া যাইতেন। নরেন্দ্রনাথের সহিত তাঁহার পরিচয় ছিল।

অচলানন্দ তীর্থাবধূত — তান্ত্রিক বীরভাবের সাধক। পূর্বনাম রামকুমার, মতান্তরে — রাজকুমার। বাড়ি হুগলী জেলার কোতরং। ঠাকুরের সহিত তাঁহার প্রথম সাক্ষাৎ দক্ষিণেশ্বরে। মাঝে মাঝে তিনি দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া বাস করিতেন। কখনো কখনো সশিষ্য পঞ্চবটীতে সাধনায় বসিতেন। কারণবারি পান করিয়া স্ত্রীলোকসহ বীরভাবের সাধনা করিতেন। এই বীরভাবের সাধনা বিষয়ে ঠাকুরের সহিত তাঁহার বিতর্ক হইত। ঠাকুর তাঁহার বীরভাবের সাধনা সমর্থন করিতেন না। ঠাকুর বলিতেন — সব স্ত্রীলোক-ই তাঁহার নিকট মায়ের বিভিন্ন রূপ। অচলানন্দ বিবাহ করিয়াছিলেন — স্ত্রী পুত্র ছিল, কিন্তু তাহাদের খবর রাখিতেন না। বলিতেন — ঈশ্বর দেখিবেন। কিন্তু নাম, যশ, অর্থের প্রতি তাঁহার আকর্ষণ ছিল।

অতুলচন্দ্র ঘোষ — নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের কনিষ্ঠ ভ্রাতা। কলিকাতা হাইকোর্টের উকিল। কলিকাতা বাগবাজার অঞ্চলের অধিবাসী। ঠাকুরের ভক্ত। প্রথম দর্শন বাগবাজার দীননাথ বসুর বাড়িতে। প্রথম দিকে তিনি ঠাকুরের কাছ হইতে দূরে থাকিতেন এবং পরিহাস করিয়া ঠাকুরকে রাজহংস বলিতেন। ঠাকুর সেকথা শুনিয়া সস্নেহে তাঁহার এই উক্তির সমর্থন করেন অতুল তাহাতে অভিভূত হন এবং ঠাকুরের কৃপালাভে ধন্য হন। কল্পতরু অবস্থায় ঠাকুরকে দর্শন করিবার সৌভাগ্য তাঁহার হইয়াছিল।

অধরলাল সেন (১৮৫৫ – ৮৫) — শ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয় গৃহীভক্তদের অন্যতম। ঠাকুরের সহিত প্রথম সাক্ষাৎ দক্ষিণেশ্বরে, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দে। পিতা রামগোপাল সেন পরম বৈষ্ণব ভক্ত। তিনি ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন । পূর্বপুরুষের আদি নিবাস হুগলী জেলার সিঙ্গুর গ্রামে। অধরের জন্মস্থান — ২৯, শঙ্কর হালদার লেন, আহিরীটোলা, কলিকাতা। বাসস্থান — কলিকাতার বেনিয়াটোলা। প্রতিভাবান, কৃতীছাত্র অধর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের fellow এবং Faculty of Arts-এর সদস্য। পাঁচখানি বাংলা কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা। প্রথম জীবনে নাস্তিক অধর, আঠাস বৎসর বয়সে প্রথম ঠাকুরকে দর্শন করিয়া ঠাকুরের প্রমভক্ত হন। প্রথম সাক্ষাতেই ঠাকুর অধরকে কাছে টানিয়া নেন। একদিন ঠাকুর অধরের জিহ্বায় ইষ্টমন্ত্র লিখিয়া দেন এবং ভাবাবিষ্ট অবস্থায় অধরের বক্ষ ও মস্তক স্পর্শ করিয়া আশীর্বাদ করেন। ধীরে ধীরে অধর দিব্যানন্দে ও আধ্যাত্মিক অনুভূতিতে পূর্ণ হইতে থাকেন। ঠাকুর বহুবার অধরের বাড়িতে শুভাগমন করিয়া কীর্তনানন্দে সমাধিস্থ হইয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ অধরকে নারায়ণ জ্ঞান করিতেন। অধর নানাবিধ কাজের সহিত যুক্ত ছিলেন। প্রায় প্রতিদিনই কঠোর পরিশ্রমের পর দিনান্তে দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া যাইতেন। অধরের বাড়িতেই শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্রের সাক্ষাৎ হয়। সরকারী কাজে অধরকে ঘোড়ায় চড়িতে হইত। এই ব্যাপারে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাকে একাধিকবার সাবধান করিয়াছিলেন। কিন্তু ত্রিশ বৎসর বয়সে হঠাৎ একদিন ঘোড়ার পিঠ হইতে পড়িয়া যাওয়াতেই তাঁহার মৃত্যু হয়। সেই সময়েও শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাকে দেখিতে আসিয়া অশ্রুপূর্ণ নেত্রে তাঁহাকে স্পর্শ করেন।

অন্নদা গুহ — নরেন্দ্রনাথের বিশেষ বন্ধু। তিনি বরাহনগর নিবাসী ছিলেন। প্রথম জীবনে অন্নদা অসৎসঙ্গে কাটাইতেন। একদা নরেন্দ্রনাথের উপরেও অন্নদার প্রভাব পড়ে। অন্নদা শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শনলাভে ধন্য হন। পরবর্তীকালে শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশ অনুসরণ করিয়া নিজের জীবনধারাকে পরিচালিত করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। কেহ কেহ অন্নদাকে অহঙ্কারী মনে করিলেও ঠাকুর তাহা অস্বীকার করিয়াছিলেন।

অন্নদা বাগচী — (১৮৪৯ – ১৯০৫) — ২৪ পরগণার অন্তর্গত শিখরবালি গ্রামে জন্ম। পিতা চন্দ্রকান্ত বাগচী। শৈশব হইতেই অন্নদাপ্রসাদের শিল্পচর্চার প্রতি আকর্ষণ ছিল। ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে নব প্রতিষ্ঠিত স্কুল অব ইণ্ডাস্ট্রিয়াল আর্টস-এর এনগ্রেভিং ক্লাশে ভর্তি হন। পরে তিনি পাশ্চাত্য রীতির চিত্রাঙ্কন বিদ্যা শিক্ষা করেন। কর্মজীবনে প্রবেশ করিয়াও তিনি পূর্বোক্ত স্কুলের শিক্ষকও পরে প্রধান শিক্ষকের পদলাভ করেন। পাশ্চাত্য রীতিতে প্রতিকৃতি অঙ্কন করিয়া ইনি প্রভূত যশোলাভ করেন। শিল্পবিষয়ক প্রথম বাংলা পত্রিকা “শিল্পপুষ্পাঞ্জলি” (১২৯২) প্রকাশনার ব্যাপারে তিনি একজন উদ্যোক্তা ছিলেন। তঁহার অন্যতম প্রধান কীর্তি ‘আর্ট স্টুডিও’, প্রতিষ্ঠা (১৮৭৮)। এই আর্ট স্টুডিও হইতে লিথোগ্রাফি পদ্ধতিতে ছাপা বহু পৌরাণিক বিষয়ক চিত্র সেকালে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছিল। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে ঠাকুরের বিষয়ক চিত্র সেকালে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছিল। পরে শ্যামপুকুরে শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত সাক্ষাতের সময় তিনি তাঁহার অঙ্কিত কিছু চিত্র শ্রীরামকৃষ্ণকে উপহার দিয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ অত্যন্ত আনন্দের সহিত এই চিত্রগুলি দেখিয়াছিলেন। ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতার বঙ্গীয় কলাসংসদ স্থাপিত হইলে অন্নদাপ্রসাদ তাহার সভাপতি নির্বাচিত হন। রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র রচিত ‘The Antiquities of Orissa’ এবং ‘বুদ্ধগয়া’ নামক গ্রন্থ দুইটিতে অন্নদাপ্রসাদের অঙ্কিত ছবিগুলি বিশেষ প্রশংসা লাভ করে।

অমৃতলাল বসু (১৮৩৯ – ১৯১৩) — কেশব সেনের অনুগামী। শ্রীরামকৃষ্ণের অনুরাগী গৃহী ব্রাহ্মভক্ত। জন্মস্থান কলিকাতার হাটখোলায়। স্ত্রী বিধুমুখী দেবী। শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে আসিয়া অমৃতলালের জীবনধারার উন্নতি ঘটে। শ্রীরামকৃষ্ণের চারিত্রিক মহত্ত্ব, বৈশিষ্ট্য এবং উদারমনোভাব অমৃতকে মুগ্ধ করে। ঠাকুর অমৃতকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন। ১৮৮৩ সালে ঠাকুর যখন অসুস্থ কেশব সেনকে দেখিতে আসেন তখন অমৃতলাল তথায় উপস্থিত ছিলেন। কাশীপুরে থাকাকালে ঠাকুর অমৃতকে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করিলে অমৃত ঠাকুরকে দেখিতে আসেন। সেই সময়ে অমৃতলালের সহিত ঠাকুরের দীর্ঘসময় ধরিয়া কথাবার্তা হয়। পরবর্তী কালে ঠাকুরের প্রতি অমৃতলালের শ্রদ্ধাভক্তির পরিচয় পাইয়া স্বামীজীও খুব আনন্দিত হইয়াছিলেন।

অমৃতলাল সরকার — কলকাতায় ১৮৬০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ডা: মহেন্দ্রলাল সরকার শ্রীরামকৃষ্ণের চিকিৎসক এবং বিশেষ অনুরাগী। অমৃতলালও চিকিৎসক হন। পিতার মৃত্যুর পর তাঁহারই প্রতিষ্ঠিত The Indian Association for Cultivation of Science-এর সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং শেষ পর্যন্ত সেই দায়িত্ব পালন করেন। অমৃত ঠাকুরের স্নেহলাভে ধন্য হন। অমৃতলাল ঈশ্বরের অবতারে বিশ্বাসী ছিলেন না। ঠাকুর কথা প্রসঙ্গে মহেন্দ্রলালের নিকট সস্নেহে ইহা উল্লেখ করেন। তিনি অমৃতলালের সরলাতার প্রশংসা করেন। উত্তরে মহেন্দ্রলাল ঠাকুরের প্রতি অমৃতের শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের কথা বলেন এবং অমৃত যে শ্রীরামকৃষ্ণের অনুরাগী সেকথাও জানান।

অলকট, কর্ণেল — প্রসিদ্ধ থিয়োসফিস্ট নেতা। কলিকাতা থিয়োসফিক্যাল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আমেরিকার একজন শিক্ষাবিদ ছিলেন। আধুনিক শিক্ষাপ্রচারের উদ্দেশ্য তিনি একটিবিদ্যালয়ের স্থাপনের চেষ্টা করেন। পরে কনকর্ড স্কুলের সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত হন। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতে অলকটের উল্লেখ আছে।

অশ্বিণীকুমার দত্ত (১৮৫৬ – ১৯২৩) — ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের বিখ্যাত দেশনেতা ও মনীষী। জন্ম অবিভক্ত বাংলার বরিশাল শহরে। তাঁহার প্রণীত বিখ্যাত গ্রন্থ ভক্তিযোগ, কর্মযোগ ও প্রেম। ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রথম দর্শন করেন। এরপর আরও কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়। অশ্বিনীকুমার যেদিন দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যান, সেদিনকেশব সেনেরও সেখানে আসিবার কথা ছিল। কেশব ভক্তবৃন্দের সাথে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেদিন অনেক ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ হয় এবং ঠাকুর — সমাধিস্থ হন। অশ্বিনীকুমার এইভাবে প্রথম দর্শনেই উপলব্ধি করেন যে শ্রীরামকৃষ্ণদেব, ‘প্রকৃত পরমহংস’। ঠাকুরের সহিত তাঁহার চার-পাঁচবার সাক্ষাৎ হইয়াছিল। কিন্তু এই অল্পসময়ের মধ্যে তিনি ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ হইয়া উঠেন। এই কয়েকবারের সাক্ষাতের অনুভূতি তাঁহার জীবনকে মধুর করিয়া তোলে। অশ্বিনীকুমারের পিতাও ঠাকুরকে দর্শন করিয়াছিলেন। ঠাকুরের ইচ্ছা ছিল নরেন্দ্রের সহিত যেন অশ্বিনীকুমারের পরিচয় হয়। ঠাকুরের এই ইচ্ছা বারো বৎসর পর আলমোড়ায় পূর্ণ হইয়াছিল। কলিকাতাতে তিনি দেহত্যাগ করেন।

আন্দি — মথুরবাবুর জানবাজারের বাড়ির এক মহিলা। সখিভাবে সাধনকালে জানবাজারের বাড়ির মহিলাবৃন্দ শ্রীশ্রীঠাকুরের সহিত কিরূপ অসঙ্কোচ ব্যবহার করিতেন তাহার দৃষ্টান্তরূপে তিনি ইঁহার উল্লেখ করিয়াছেন।

আশু — শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় আগরপাড়ার অধিবাসী ছিলেন। ২২ বৎসর বয়সে ঠাকুরের সহিত তাঁহার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। দক্ষিণেশ্বরে গিয়া তিনি একান্তে ঠাকুরের কাছে নিজের মনের ভাব ব্যক্ত করিতেন। আশুতোষ বৃদ্ধ বয়সে মাস্টারমহাশয়ের কাছে যাইতেন এবং ঠাকুরের সহিত নিজ সাক্ষাতের বিষয়ে আলোচনা করিতেন। আশুতোষ ঠাকুরের ভাবাবিষ্ট অবস্থা দেখিয়া বিশেষ আকৃষ্ট হইতেন। তিনি ধীরে ধীরে শ্রীরামকৃষ্ণের চরণে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করেন।

ঈশ্বর ঘোষাল — ডেপুটি। শ্রীশ্রীঠাকুর ছেলেবেলায় কামারপুকুরে তাঁহাকে দেখিয়াছিলেন। তাঁহার সাজ-পোশাকে ও ব্যক্তিত্বে সাধারণ লোকে ভীত হইত। অধরের সহিত কথাপ্রসঙ্গে ঠাকুর তাঁহার সম্পর্কে বলিয়াছিলেন।

ঈশ্বর চক্রবর্তী — হুগলী জেলার ময়াল-ইছাপুর গ্রামের রাজচন্দ্র চক্রবর্তীর পুত্র ঈশ্বরচন্দ্র চক্রবর্তী অতি উন্নত তান্ত্রিক সাধক ছিলেন। ইঁহার পুত্র শশী শ্রীরামকৃষ্ণের ১৬ জন ত্যাগী সন্তানদের মধ্যে একজন। পুত্র শশী পরবর্তী কালে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ নামে শ্রীরামকৃষ্ণ সংঘে পরিচিত। ঈশ্বরচন্দ্র পাইকপাড়ার রাজা ইন্দ্রনারায়ণ সিংহের সভাপণ্ডিত ছিলেন। তিনি বিভিন্ন শ্মশানে পঞ্চমুন্ডীর আসনে বসিয়া দীর্ঘকাল দর্শন লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার গৃহে শক্তিরূপী দেবীর নিত্য পূজার্চনা হইত। পরবর্তী কালে বেলুড় মঠে প্রথমবার দুর্গাপূজার সময় তিনি তন্ত্রধারক ছিলেন। মঠের সহিত তাঁহার আন্তরিক যোগ ছিল।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০ – ১৮৯১) — মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্ম। পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতা ভগবতী দেবী। অত্যন্ত দারিদ্রের মধ্যে তাঁহার বাল্যজীবন অতিবাহিত হয়। কিন্তু দরিদ্রতা তাঁহার বিদ্যর্জনের পক্ষে বাধাস্বরূপ হয় নাই। বাল্যকাল হইতেই তিনি অসাধারণ মেধাবী হিসাবে পরিগণিত হন। কাব্য, ব্যাকরণ, অলঙ্কার, বেদান্ত, সমৃতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তাঁহার গভীর জ্ঞান ছিল। অসাধারণ পাণ্ডিত্যের জন্য সংস্কৃত বলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁহাকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ঈশ্বরচন্দ্রের কর্মজীবন বহুধাবিস্তৃত। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণের ইতিহাসে তাঁহার অবদান অবিস্মরণীয়। পিতামাতার প্রতি ভক্তি, জনগণের প্রতি অসীম দয়া, মনুষ্যত্ববোধ, অজেয় পৌরুষ, অগাধ-পাণ্ডিত্য প্রভৃতি বহুবিধ গুণাবলীর জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয় বাংলার ইতিহাসে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। তাঁহাকে আধুনিক বাংলা গদ্যসাহিত্যের জনক আখ্যা দেওয়া হয়। সীতার বনবাস, কথামালা, বর্ণপরিচয় প্রভৃতি নানা সংস্কারমূলক কার্যে তাঁহার অবদান অনস্বীকার্য। সংস্কৃত কলেজের প্রধান অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন ছাড়াও শিক্ষাজগতের বিভিন্ন ধারার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। শিক্ষার শ্রীবৃদ্ধি কল্পে তিনি “মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন” প্রতিষ্ঠা করেন। পরে উক্ত বিদ্যালয়কে তিনি কলেজে পরিণত করেন। ঠাকুরের ইচ্ছানুসারে ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দের ৫ই আগস্ট কথামৃত প্রণেতা শ্রীমহেন্দ্রনাথ গুপ্তের সহায়তা বিদ্যাসাগরের সহিত ঠাকুরের যোগাযোগ ঘটে। ঠাকুর স্বয়ং বিদ্যাসাগরের বাড়ি যাইয়া তাঁহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কথামৃতে এই সাক্ষাতের বিবরণ বিস্তৃতভাবে লিপিবদ্ধ আছে। এই প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক যে বিদ্যাসাগর শ্রীরামকৃষ্ণকে শ্রদ্ধা করিতেন এবং ঠাকুরও বিদ্যাসাগরকে দয়ার সাগর হিসাবে জ্ঞান করিতেন। বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত “মেট্রোপলিটান স্কুলের” বউবাজার শাখায় শ্রীনরেন্দ্রনাথ দত্ত (পরবর্তী কালে স্বামী বিবেকানন্দ) কিছুকাল প্রধান শিক্ষকের পদ অলঙ্কৃত করিয়াছিলেন।

ঈশান কবিরাজ (ঈশানচন্দ্র মজুমদার) — শ্রীরামকৃষ্ণের অনুরাগীভক্ত। বরাহনগরে বাড়ি। শ্রী-মর বড়দিদির বিবাহ হয় এই বাড়িতে। মাস্টারমহাশয় এই বাড়ি হইতে দক্ষিণেশ্বরে যাইয়া ঠাকুরকে প্রথম দর্শন করেন। কবিরাজ মহাশয় ঠাকুরের পূর্বপরিচিত ছিলেন। তিনি কবিরাজীমতে ঠাকুরকে চিকিৎসা করিতেন। ঠাকুরের সহিত ঈশানচন্দ্রের হৃদ্যতা থাকায় ঠাকুর বরাহনগরে তাঁহার বাড়িতেও শুভাগমন করিয়াছিলেন।

ঈশানচন্দ্র মুখোপাধ্যায় — শ্রীরামকৃষ্ণের বিশেষ কৃপাপ্রাপ্ত গৃহী ভক্ত। বর্তমান ১৯ নং কেশবচন্দ্র স্ট্রীটে তাঁহার বাড়ি ছিল। আদি নিবাস ২৪ পরগণা জেলার হরিনাভি গ্রাম। A. G. Bengal-এর সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে ঈশানচন্দ্র পরম দয়ালু, দানবীর এবং ভক্ত হিসাবে সুপ্রসিদ্ধ। দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে নিয়মিত যাতায়াতের ফলে ঈশানচন্দ্র ঠাকুরের আশ্রিতরূপে পরিগণিত হন। ঠাকুর পরম ভক্তি-পরায়ণ ঈশানচন্দ্রের বাড়িতে কয়েকবার শুভাগমন করিয়া তাঁহার সেবা গ্রহণ করিয়াছিলেন। ঈশানচন্দ্রের শেষ জীবন ভাটপাড়াতে সাধন-ভজনে অতিবাহিত হয়। ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দে ৭৩ বৎসর বয়সে তিনি ভাটপাড়াতেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইঁহার পুত্রগণ শ্রীশচন্দ্র, সতীশচন্দ্র প্রভৃতি সকলেই কৃতী ছিলেন। শ্রীশচন্দ্র শ্রীমর সহপাঠী, বন্ধু ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র ছিলেন। সতীশচন্দ্ সহপাঠী ও বন্ধু ছিলেন। পরিব্রাজক অবস্থায় স্বামীজী গাজিপুরে সতীশচন্দ্রের গৃহে কিছুকাল অবস্থান করিয়াছিলেন।

উপেন — (উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়) (১৮৬৮ – ১৯১৯) — জন্ম কলিকতার আহিরীটোলায়। পিতা পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। উপেন্দ্রনাথ ‘সাপ্তাহিক বসুমতী’ এবং ‘দৈনিক বসুমতী’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা। তাঁহার প্রধান কৃতিত্ব ‘বসুমতী সাহিত্য মন্দির’ এর প্রতিষ্ঠা এবং সেই সংস্থার মাধ্যমে প্রসিদ্ধ গ্রন্থকারগণের গ্রন্থাবলীর সুলভ সংস্করণের প্রকাশনা। তিনি ‘সাহিত্য পত্রিকা’র সহিত যুক্ত ছিলেন। রাজভাষা, পাতঞ্জল দর্শন, কালিদাসের গ্রন্থাবলী প্রভৃতি পুস্তকসমূহের সম্পাদক। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে অধর সেনের বাড়িতে ঠাকুরকে প্রথম দর্শন করেন। প্রথম জীবনে তিনি অত্যন্ত দরিদ্র ছিলেন, তবে পরবর্তী কালে তিনি প্রভূত সম্পত্তির অধিকারী হন। ঠাকুরের দেহত্যাগের পর তিনি নানাভাবে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠের সন্ন্যাসীদের সেবা করিয়াছিলেন। কৃপাধন্য উপেন্দ্রনাথ জীবনের অধিকাংশ সময়ই শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁর অনুরাগীদের সেবায় অতিবাহিত করেন।

উপেন ডাক্তার — কলিকাতার জনৈক চিকিৎসক। ঠাকুরের চিকিৎসার জন্য তিনি ঠাকুরের কাছে আসিবার সুযোগ লাভ করিয়াছিলেন। কাশীপুরে একবার ঠাকুরের অসুখ বাড়াবাড়ি হওয়ার সংবাদ শোনামাত্রই ঠাকুরের পরমভক্ত নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ সেদিন গভীর রাত্রে উপেন ডাক্তারকে সঙ্গে লইয়া ঠাকুরের কাছে উপস্থিত হন এবং উপেন ডাক্তার সেদিন ঠাকুরের সাময়িক চিকিৎসার ভার গ্রহণ করেন।

উমানাথ গুপ্ত (১৫.১১.১৮৩৯ — ১.১২.১৯১৮) — চব্বিশ-পরগণার হালিশহরে জন্ম। তিনি সাংবাদিক ছিলেন। উমানাথ গুপ্ত কেশবচন্দ্র সেনের অনুগামী ব্রাহ্মভক্ত এবং তাঁর একজন বিশিষ্ট বন্ধুও ছিলেন। ১৮৮৩ সালের ২৮শে নভেম্বর কেশবচন্দ্র সেনের বাড়ি ‘কমল-কুটীর’-এ শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন লাভ করেন। অসুস্থ কেশবচন্দ্র সেনকে দেখিবার উদ্দেশ্যে ঠাকুর একদা ‘কমল-কুটীর’-এ আসেন। সেদিনও উমানাথ গুপ্ত সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

উলোর বামনদাস (শ্রীবামনদাস মুখোপাধ্যায়) — নিবাস নদীয়া জেলার বীরনগর বা উলোতে। উত্তর কলিকাতার কাশীপুরে তিনি মা-কালীর এক বৃহৎ মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। একদা দক্ষিণেশ্বরে জনৈক বিশ্বাসদের বাড়িতে অবস্থানকালে ঠাকুর হৃদয়কে সঙ্গেলইয়া তাঁহার সহিত দেখা করিতে যান। সেদিন ঠাকুরের কণ্ঠে শ্যামাসংগীত শুনিয়া বামনদাস মুগ্ধ হন এবং অপ্রত্যাশিতভাবে ঠাকুরের দর্শন লাভ হওয়াতে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করেন।

কাপ্তেন (বিশ্বনাথ উপাধ্যায়) — শ্রীরামকৃষ্ণের নেপালী গৃহীশিষ্য। নৈতিক শাস্ত্রজ্ঞ, সুপণ্ডিত কর্মযোগী ব্রাহ্মণ। পিতা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সুবাদার এবং নৈষ্ঠিক শৈব। ধর্মপরায়ণ, সাহসী এবং দেশপ্রেমিক বলিয়া তাঁহার পূর্বপু রুষগণের খ্যাতি ছিল। তাঁহার স্ত্রী ‘গোপাল’-এর উপাসক এবং ভক্তিমতী মহিলা ছিলেন। বিশ্বনাথ শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত মিলিত হইবার পূর্বেই স্বপ্নে তাঁহাকে দর্শন করিয়াছিলেন। সেইহেতু তাঁহাকে দর্শন করা মাত্রই তিনি চিনিতে পারেন। কর্মজীবনে বিশ্বনাথ কলিকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নেপাল রাজ সরকারের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী ছিলেন। পরবর্তী কালে কর্মকুশলতা এবং সততার জোরে তিনি অধিকতর উচ্চপদে উন্নীত হইয়াছিলেন। নেপাল সরকার তাঁহাকে ‘ক্যাপ্টেন’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এই কারণে ঠাকুর সস্নেহে তাঁহাকে ‘কাপ্তেন’ বলিয়া উল্লেখ করিতেন এবগ তাঁহার একনিষ্ঠ ভক্তিমত্তার প্রশংসা করিতেন। ঠাকুরের সহিত বেদ-বেদান্ত, ভাগবত-গীতা প্রভৃতি বিষয়ে তাঁহার গূঢ় আলোচনা হইত। প্রায়ঃশই তিনি ঠাকুরকে স্বগৃহে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইতেন। ঠাকুরের প্রতি তাঁহার গভীর শ্রদ্ধা এবং নিশ্চল বিশ্বাস ছিল। কিন্তু গোঁড়ামির জন্য তিনি কেশবচন্দ্র সেনের নিকট ঠাকুরের যাতায়াত পছন্দ করিতেন না। কর্ম এবং ধর্ম তাঁহার জীবনে সমান্তরাল ভাবে চলিয়াছিল।

কালিদাস সরকার — ইনি জনৈক ব্রাহ্মভক্ত এবং কেশবচন্দ্র সেনের অনুগামী ছিলেন। ইনি ব্রাহ্মসমাজে ঠাকুরকে দর্শন করেন।

কালী [কালীপ্রসাদ চন্দ্র] (২.১০.১৮৬৬ — ৮.৯.১৯৩৯) — কালীপ্রসাদ পরবর্তী কালে স্বামী অভেদানন্দ হিসাবে পরিচিত। শ্রীরামকৃষ্ণের ত্যাগী সন্ন্যাসীদের মধ্যে কালীপ্রসাদ অন্যতম। জন্ম উত্তর কলিকাতার নিমু গোস্বামী লেনে, মাতা নয়নতারা দেবী। পিতা রসিকলাল চন্দ্র “ওরিয়েন্টাল সেমিনারী” স্কুলের ইংরাজীর শিক্ষক ছিলেন। কালীপ্রসাদ রচিত কয়েকটি গ্রন্থ: আমার জীবনকথা, কাশ্মীর ও তিব্বতে, পুনর্জন্মবাদ, বেদান্তবাণী, ব্রহ্মবিজ্ঞান, মরণের পারে, যোগশিক্ষা, সমাজ ও ধর্ম, হিন্দু ধর্মে নারীর স্থান, শ্রীরামকৃষ্ণ স্তোত্র রত্নাকর ইত্যাদি। কালীপ্রসাদ মেধাবী ছাত্র ছিলেন। বাল্যকাল হইতেই ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগ থাকাতে এন্ট্রান্স ক্লাশ অবধি পড়াশোনা করিয়া আধ্যাত্মিক প্রেরণায় লেখাপড়া ত্যাগ করেন। যৌবনের প্রারম্ভেই হিন্দু শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করেন এবং প্রকৃত গুরুর সন্ধান করিতে থাকেন। ১৮৮৪ সালের মাঝামাঝি এক বন্ধুর পরামর্শে তিনি দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ সকাশে যান। ইহার পর কালীপ্রসাদ বহুবার রামকৃষ্ণ সংস্পর্শে আসেন। নিজ অভিপ্রায় অনুযায়ী যোগচর্চা, ধ্যানধারণা প্রভৃতিতে আত্মনিয়োগ করেন এবং ঠাকুরের শেষদিন পর্যন্ত সেবা করেন। ঠাকুরের দেহত্যাগের পর যে সকল ব্যক্তি স্বামী বিবেকানন্দের নেতৃত্বে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন, তিনি তাঁহাদের মধ্যে একজন। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠা এবং কঠোরতার সহিত ধ্যান এবং আধ্যাত্মিক পঠন-পাঠনে নিমগ্ন থাকিতেন। গুরুভ্রাতাগণের নিকট তিনি ছিলেন ‘কালী তপস্বী’। কালীপ্রসাদ ভারতের সমস্ত তীর্থক্ষেত্র পদব্রজে পরিদর্শন করেন। ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দে তিনি ইংল্যাণ্ডের Christo-Theosophical Society-তে ধর্মবিষয়ে বক্তৃতা দেন। ১৮৯৭ খ্রীস্টাব্দে তিনি আমেরিকায় ‘বেদান্ত সোসাইটি’ স্থাপন করেন এবং ১৯২১ সাল পর্যন্ত সেখানে বেদান্ত প্রচার করিতে থাকেন। এইসময় তিনি পাশ্চাত্যের বহুদেশে যান এবং বহু খ্যাতিমান লোকের সহিত মতবিনিময় করেন। প্রেততত্ত্ববিদ হিসাবেও তিনি বিদেশে খ্যাতিলাভ করেন। ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতায় ফিরিয়া তিনি ‘রামকৃষ্ণ বেদান্ত সোসাইটি’ স্থাপন করেন। এই ‘সোসাইটি’র মাধ্যমে এবং তাঁহার প্রকাশিত “বিশ্ববাণী” পত্রিকার মাধ্যমে শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী ও ভাবদারাকে দিকে দিকে প্রচার করেন । ১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি দার্জিলিঙ-এ ‘রামকৃষ্ণ বেদান্ত আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন । ১৯৩৭ সালে ঠাকুরের জন্মশতবার্শিকী উপলক্ষে কলিকাতা টাউন হলে আয়োজিত ধর্মসভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দে ৭৩ বৎসর বয়সে কলিকাতার বেদান্ত আশ্রমে তাঁর দেহান্ত হয়।

কালীকিঙ্কর — ইনি একজন তান্ত্রিক সাধক ছিলেন। অচলানন্দের প্রসঙ্গে (৯-৯-৮৩) শ্রীশ্রীঠাকুর ইঁহাদের সাধনার কথা উল্লেখ করিয়াছেন।

কালীকৃষ্ণ — ভবনাথের বন্ধু। দক্ষিণেশ্বরে শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্মমহোৎসব দিবসে গান গাহিয়াছিলেন (১১-৩-৮৩)।

কালীকৃষ্ণ ভট্টাচার্য — কথামৃত-প্রণেতা মাস্টারমশাই — মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের বিশেষ বন্ধু। বিদ্যাসাগর কলেজের সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের প্রধান অধ্যাপক। ঠাকুরের সহিত প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৮৮২-তে দক্ষিণেশ্বরে। মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত তাঁহাকে শুঁড়ির দো কান দেখাইবার অছিলায় দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে হাজির করেন এবং ঠাকুরকে বন্ধুটির বিষয়ে উপরোক্ত ঘটনা জানান। ঠাকুর সহাস্যে কালীকৃষ্ণকে ভজনানন্দ ও ব্রহ্মানন্দের সুরার বিষয়ে কিছু উপদেশ দেন। কালীকৃষ্ণের সেইদিন ঠাকুরের মুখে একটি গান শুনিবার সৌভাগ্য হইয়াছিল।

কালীপদ ঘোষ (১৮৪৯ – ১৯০৫) — ‘দানা-কালী’ নামে শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘে পরিচিত । ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বিশেষ কৃপাপ্রাপ্ত গৃহীশিষ্য। উত্তর কলিকাতার শ্যামপুকুরে প্রসিদ্ধ ঘোষ কোম্পানীতে চাকুরী করিতেন। প্রথম দর্শন ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণেশ্বরে। ন্যাট্যাচার্য গিরিশচ ন্দ্র ঘোষের সহিত তাঁহার খুব হৃদ্যতা ছিল। ভক্তগণ ইঁহাদের দুইজনকে একত্রে জগাই মাধাই বলিতেন। তিনি বহু গান লিখিয়াছিলেন যাহা “রামকৃষ্ণ সঙ্গীত” নামে প্রকাশিত হয়। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁহাকে ‘দানা’ বলিয়া সম্বোধন করিয়াছিলেন। ভাগ্যবান কালীপদর জিহ্বায় ঠাকুর “কালী” নাম লিখিয়া দিয়াছিলেন এবং ঠাকুর তঁহাকে বিশেষ কৃপাদান করেন। সেইদিনই অযাচিতভাবে কালীপদর শ্যামপুকুরের বাড়িতে ঠাকুর প্রথম শুভাগমন করিয়া পুনরায় দক্ষিণেশ্বরে ফিরিয়া আসেন। কালীপদর বাড়িতে ঠাকুর আরও কয়েকবার শুভাগমন করেন এবং কাশীপুরে “কল্পতরু” হওয়ার দিনেও কালীপদর বক্ষঃস্পর্শ করিয়া তাঁহাকে আশীর্বাদ করেন। সুগায়ক, বেহালা ও বংশীবাদক কালীপদর বাঁশী শুনিয়া একদা ঠাকুর সমাধিস্থ হইয়াছিলেন। পরবর্তী কালে বোম্বাইতে অবস্থানকালে শ্রীরামকৃষ্ণের ত্যাগী সন্তানগণ তাঁহার গৃহে অতিথি হইতেন । ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের একনিষ্ঠ ভক্ত কালীপদ ঘোষ কলিকাতাতেই দেহত্যাগ করেন।

‘কিরণ্ময়ী’ লেখক — রাজকৃষ্ণ রায়, নরেন্দ্রনাথের বন্ধু। শ্যামপুকুরে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সহিত রাধাকৃষ্ণ বিষয়ে আলোচনা করেন।

কিশোরী (১৮৫৯ – ১৯৩১) — [কিশোরীমোহন গুপ্ত] শ্রীম’র ছোট ভাই, কলিকাতায় জন্ম। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহীভক্ত। ঠাকুরের সহিত প্রথম সাক্ষাৎ দক্ষিণেশ্বরে (১৮৮২-৮৩)। বাসস্থান ১৩, গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেন, কলিকাতা-৬। ঠাকুরের প্রতি বিশেষ অনুরাগবশতঃ নিয়মিত দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করিতেন এবং সুযোগ পাইলেই ঠাকুরের সেবা করিতেন। সুগায়ক এবং সুকণ্ঠের অধিকারী। ঠাকুরের সম্মুখে গান করিতেন। ঠাকুরও তাঁহার গান পছন্দ করিতেন। ব্রাহ্মসমাজের সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠতা ছিল। কলিকাতাস্থ দর্জিপাড়ার ডাক্তার বিশ্বনাথ গুপ্তের কন্যা রাধারাণীকে তিনি বিবাহ করিয়াছিলেন। কিশোরী আজীবন ঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। শেষ বয়সে তিনি একাকী কলিকাতার বাড়িতে বাস করিতেন এবং তপস্যায় নিযুক্ত থাকিতেন। সেইখানেই তিনি দেহত্যাগ করেন।

কুইন [মহারানী ভিক্টোরিয়া] (১৮১৯ – ১৯০১) — ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা এড্‌ওয়ার্ড ইংল্যাণ্ডের রাজা তৃতীয় জর্জের চতুর্থ পুত্র ডিউক অব কেন্ট নামে পরিচিত এবং মাতা স্যাকস্‌ কোবার্গের ডিউক তনয়া মেরিয়া লুইসা। ১৮৩৭ খ্রীষ্টাব্দে ২৮শে জুন “গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ার্ল্যাণ্ডের রানী” উপাধি লইয়া তিনি ইংল্যাণ্ডের সিংহাসনে আরোহন করেন। তাঁহার রাজত্বকালে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপিত হইয়া গ্রেট ব্রিটেন ক্ষমতার সর্ব্বোচ্চ শিখরে উন্নীত হয়। এই সময় ইংলণ্ডে শিল্পবিপ্লব সম্পন্ন হয় এবং সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটে। শিল্প, বিজ্ঞান ও সাহিত্য প্রভূত উন্নতি হওয়ায় ১৮৮০-র দশক ইতিহাস ও সাহিত্যে ‘ভিক্টোরিয়ান যুগ’ নামে অভিহিত হয়। ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে রানী ভিক্টোরিয়ার ঘোষণানুসারে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির নিকট হইতে ভারতে শাসনভার ইংলণ্ডেশ্বীর হস্তে হস্তান্তরিত হয়। ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে ভিক্টোরিয়া ‘ভারতসম্রাজ্ঞী’ উপাধিতে ভূষিত হন। কেশবচন্দ্র সেন মহারানীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহার সমাদর লাভ করেন — শ্রীশ্রীঠাকুর কথামৃতে ইহা উল্লেখ করিয়াছেন ।

কুক সাহেব [রেভারেণ্ড জোসেফ কোক] (১৮৩৮-১৯০১) — আমেরিকার নিউ ইংল্যাণ্ডের প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের ধর্ম প্রচারক। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আমেরিকায় যে উদারপন্থী ধর্মমত প্রচলিত ছিল তিনি সেই ধর্মমতের প্রচারক। তিনি ইয়েল, হারভার্ড এবং জার্মানীতে শিক্ষাপ্রাপ্ত হন। কর্মসূত্রে অধ্যাপক ছিলেন। বাগ্মী হিসাবেও পরিচিত। ‘ওরিয়েন্ট’ নামক পুস্তক প্রণেতা। তিনি ‘ট্রিমন্ট টেম্পল’ (Tremont Temple) এবং ‘ওল্ড সাউথ মিটিং হাউস’ (Old South Meeting House) এ দীর্ঘ পঁচিশ বৎসর কাল যে বক্তৃতা দেন তা পরবর্তী কালে Monday Lectures নামে ১১ খণ্ডে প্রকাশিত হয়। ভারতবর্ষ ভ্রমণের সময় ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেনের সহিত পরিচয় ঘটে। ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে বিবেকানন্দ আমেরিকা ভ্রমণকালে যে সমস্ত ব্যক্তিদের সহিত পরিচিত হইয়াছিলেন জোসেফ কুক তাঁহাদের মধ্যে অন্যতম। একমাত্র জোসেফ কুকুই স্বামীজীর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণদেবের দর্শন লাভ করেন। কিন্তু তঁহারা পরস্পর কেহই কাহাকেও একথা বলেন নাই। ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে জোসেফ কুক প্রাচ্য পরিভ্রমণে আসেন। ভারতবর্ষ ভ্রমণের সময় ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেনের সহিত পরিচয় হয় এবং সেই পরিচয় ক্রমশঃ হৃদ্যতায় পরিণত হয়। কেশবচন্দ্র স্টীমারে করিয়া দক্ষিণেশ্বরে ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে ২৩শে ফেব্রুয়ারি ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসার সময় রেভারেণ্ড কুক এবং আমেরিকার পাদ্রী মিস পিগটকে সঙ্গে লিয়া আসেন। সেদিন ঠাকুরকে স্টীমারে লিয়া গঙ্গাবক্ষে ভ্রমণ করার সময় কুকসাহেবও উপস্থিত ছিলেন। কুকসাহেব সেখানে ঠাকুরের ধর্মবিষয়ক প্রসঙ্গের এবং তাঁহার সমাধিস্থ হওয়ার স্বর্গীয় দৃশ্যের সাক্ষী ছিলেন। খ্রীষ্টমতাবলম্বী যুবক জোসেফ কুকের কাছে এই মহাপুরুষের সমাধি দর্শন অভাবনীয় ছিল। রেভারেণ্ড কুক ইহাতে যারপরনাই অভিভূত ও বিস্মিত হইয়াছিলেন। তাঁহার এই অপূর্ব অনুভূতির কথা ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘দি ইণ্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকাতে লিপিবদ্ধ আছে। শিকাগো ধর্মমহাসভায় কুকসাহেবের বক্তৃতার মধ্যে প্রসঙ্গক্রমে লেডি ম্যাকবেথের জঘন্য পাপ ক্ষালন একমাত্র খ্রীষ্ট ধর্মেই সম্ভব — এই কথার উত্তরস্বরূপ স্বামিজীর বিখ্যাত উক্তি: — “Ye are the children of God …. Sinners! It is a sin to call a man so.”

কুঞ্জবাবু — ইনি একজন সৌখীন অভিনেতা ছিলেন। ‘নববৃন্দাবন’ নাটকে ঠাকুর ইঁহার পাপপুরুষের অভিনয় দেখিয়াছিলেন এবং পাপের অভিনয় করা ভাল নয় — ইহাও মন্তব্য করিয়াছিলেন।

কুমার গজেন্দ্রনারায়ণ (কুমার গজেন্দ্রনারায়ণ ভূপ) — ইনি কুচবিহার-রাজপরিবারের সন্তান। কেশবচন্দ্র সেনের জামাতা কুমার নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভূপের আত্মীয়। পরবর্তী কালে কেশবচন্দ্র সেনের দ্বিতিয়া কন্যা সাবিত্রী দেবীর সহিত বিবাহ হয়। ১১৮১ খ্রীষ্টাব্দে নৃপেন্দ্রনারায়ণের জাহাজে করিয়া তিনি কেশবচন্দ্র এবং তঁহার সঙ্গীদের সহিত দক্ষিণেশ্বরে যান এবং ঠাকুরের পূতসঙ্গ লাভ করেন। তাঁহার সাহেবী পোষাক শ্রীরামকৃষ্ণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল।

কুমার সিং (কুঁয়ার সিং) — শ্রীরামকৃষ্ণের বিশেষ অনুরাগী নানকপন্থী শিখভক্ত। দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়ির উত্তর পাশে সরকারী বারুদখানায় শিখসৈন্যগণের হাবিলদার ছিলেন। কুঁয়ার সিং শ্রীরামকৃষ্ণকে ‘গুরু নানাক’ জ্ঞানে ভক্তি করিতেন এবং প্রায়ই ঠাকুরের পূতসঙ্গ লাভ করিতে আসিতেন। ঠাকুরও তাঁহাকে বিশেষ স্নেহ করিতেন। কুঁয়ার সিং সাধুভোজন করাইবার সময় ঠাকুরকে নিমন্ত্রণ করিতেন, ঠাকুরও সানন্দে তাহা স্বীকার করিতেন।

কৃষ্ণকিশোর (কৃষ্ণকিশোর ভট্টাচার্য) — ইনি আড়িয়াদেহ নিবাসী সদাচারনিষ্ঠ রামভক্ত সাধক ও শ্রীশ্রীঠাকুরের গৃহীভক্ত ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তঁহার বাড়িতে অধ্যাত্মনারায়ণ পাঠ শুনিতে যাইতেন। তাঁহার “রামনাম ও শিবনামে” গভীর বিশ্বাস ছিল। বৃদ্ধবয়সে পুত্রশোকে কাতর হইলেও তাঁহার ভগবৎ বিশ্বাস অটুট ছিল ।

কৃষ্ণদাস পাল (১৮৩৮ – ১৮৮৪) — ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার সম্পাদক, খ্যাতনামা বাগ্মী এবং রাজনীতিবিদ। জন্ম কলিকতার কাঁসারীপাড়ায়। পিতা ঈশ্বরচন্দ্র পাল। কৃষ্ণদাস দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়িতে ঠাকুরকে দর্শন করিয়াছিলেন।

কৃষ্ণধন — ইনি একজন রসিক ব্রাহ্মণ ছিলেন। ইনি বলরাম-মন্দিরে ঠাকুরের সংস্পর্শে আসিলে ঠাকুর ইঁহাকে রসিকতা ছাড়িয়া ঈশ্বরের পথে অগ্রসর হইতে উপদেশ দেন।

কৃষ্ণময়ী (কৃষ্ণময়ী বসু) — বলরাম বসুর বালিকা কন্যা । সাধনার সময়ে পাপপুরুষ শ্রীশ্রীঠাকুরকে নানাপ্রকার প্রলোভন দেখাইয়াছিল। শ্রীশ্রীঠাকুর মাকে ডাকিতে থাকায় মা ভুবনমোহিনীরূপে দেখা দেন। তাঁহার রূপ কৃষ্ণময়ীর রূপের মতো বলিয়া ঠাকুর উল্লখ করিয়াছেন। কৃষ্ণময়ী পিতৃগৃহে বহুবার শ্রীরামকৃষ্ণের শুভাগমন হওয়াতে কৃষ্ণময়ীর ঠাকুরের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য হয়। ঠাকুর কৃষ্ণময়ীকে বিশেষ স্নেহ করিতেন।

কেদার (কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়) — ঠাকুরের বিশেষ কৃপাপ্রাপ্ত গৃহীশিষ্য। হালিশহর বাসী কেদারনাথের আদি নিবাস ঢাকায়। তিনি ঢা কাতে সরকারী অফিসে অ্যাকাউটেন্টের কাজ করিতেন। ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দে ঠাকুরের দর্শন লাভ করেন। কেদারনাথ প্রথমজীবনে ব্রাহ্মসমাজ, কর্তাভজা, নবসরিক প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ে যোগদান করেন এবং অবশেষে দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের শরণাগত হন। ঢাকায় থাকাকালে শ্রীশ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সহিত শ্রীরামকৃষ্ণ বিষয়ে তঁহার আলোচলা হইত। কর্মস্থল ঢাকা হইতে কলিকাতায় আসিলেই তিনি দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকট যাইতেন। ঠাকুর নরেন্দ্রনাথের সহিত কেদারনাথের নানাবিষয়ে তর্ক বাধাইয়া বেশ আনন্দ উপভোগ করিতেন।

কেশব কীর্তনীয়া — ঈশান মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সহিত ইঁহার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। এইদিন শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে কীর্তন শুনাইয়াছিলেন।

কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮ – ১৮৮৪) — কলিকাতার কলুটোলায় সেনবংশে জন্ম। পিতা প্যারীমোহন সেন। মাতা সারদাসুন্দরী দেবী। ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের নিকট দীক্ষাগ্রহণ, পরবর্তীকালে ব্রাহ্মসমাজের নেতা এবং নববিধান ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা। কেশবচন্দ্র সেন প্রণিত গ্রন্থ — সত্যবিশ্বাস, জীবনবেদ, সাধু-সমাগম, দৈনিক প্রার্থনা, মাঘোৎসব, ইংলণ্ডে কেশবচন্দ্র সেন, নবসংহিতা ইত্যাদি। ‘পরমহংসের উক্তি’ নামক গ্রন্থের সংকলক। শ্রীরামকৃষ্ণের বিশেষ স্নেহধন্য। কেশব সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বিখ্যাত উক্তি: একমাত্র কেশবেরই ফাতনা ডুবিয়াছে। ঠাকুরের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দে জয়গোপাল সেনের বাগান বাড়িতে। এই সময় হইতে উভয়ের মধ্যে গভীর অন্তরঙ্গতার সূচনা। ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দে ‘ইণ্ডিয়ান মিরার’ পত্রিকাতে তিনি প্রথম ঠাকুরের কথা প্রকাশ করেন। ইহাই জনসাধারণের নিকট শ্রীরামকৃষ্ণদেব সম্বন্ধে প্রথম প্রচার। কেশবের “কমল-কুটীর” নামক বাটীতে (বর্তমানে ভিক্টোরিয়া ইন্‌স্‌টিটিউশন) ঠাকুর কয়েকবার শুভাগমন করিয়াছিলেন এবং এইখানেই শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম ফোটো তোলা হয়। অত্যধিক পরিশ্রমে তিনি ভগ্নস্বাস্থ্য হন। তাঁহার অসুস্থতার সংবাদ পাইয়া ঠাকুর তাঁহার বাড়িতে গিয়াছিলেন। কেশবচন্দ্রের মৃত্যুসংবাদ শুনিয়া ঠাকুর মর্মাহত হইয়াছিলেন।

কেশব সেনের মা [শ্রীমতি সারদাসুন্দরী দেবী (সেন)] — ১৮০৯ সালে গরিফায় জন্ম। বাসস্থান কলিকাতার কলুটোলায়, ১৮৮৩ সালে সারকুলার রোডে অবস্থিত “কমল-কুটীর”-এ (বর্তমানে ভিক্টোরিয়া ইন্‌স্টিটিউশন) ঠাকুরের দর্শন লাভ করেন। পরবর্তী কালে তিনি দক্ষিণেশ্বরে কয়েকবার ঠাকুরকে দর্শন করিয়াছিলেন। কেশবের মৃত্যুর শোকাতুরা সারদাসুন্দরীকে ঠাকুর নানা উপদেশ দানে এবং সঙ্গীতাদিতে সান্ত্বনা দিতেন। সারদাসুন্দরী দেবী ঠাকুরকে অতিশয় ভক্তি করিতেন এবং ঠাকুরও তাঁর ভক্তির প্রশংসা করিতেন।

কোন্নগরের গায়ক — হুগলী জেলার কোন্নগর নিবাসী জনৈক উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের গায়ক। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরকে নানাপ্রকার কালোয়াতি গান শুনাইয়া মুগ্ধ করিয়াছিলেন।

ক্ষীরোদ (ক্ষীরোদচন্দ্র মিত্র) — শ্রীরামকৃষ্ণের বালক ভক্ত। কথামৃত প্রণেতা মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের ছাত্র। ঠাকুরের ত্যাগী সন্তান স্বামী সুবোধানন্দের সহপাঠী। ক্ষীরোদ সম্পর্কে ঠাকুর খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করিতেন এবং তাঁহাকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন। ক্ষীরোদের প্রতি যত্ন নেওয়ার জন্য তিনি মাস্টারমশাইকে নির্দেশও দিতেন। ক্ষীরোদ বরাবরই ঠাকুরের বিশেষ অনুরাগী ভক্ত ছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় ঠাকুর যখন কাশীপুরে অবস্থান করেন সেই সময়ও ক্ষীরোদ ঠাকুরের কাছে নিয়মিত যাতায়াত করিতেন।

ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় (১৭৭৫ – ১৮৪৩) — ইনি শ্রীযুক্ত মাণিকরাম চট্টোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র; এবং শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পিতা। বাসস্থান দেরে গ্রাম। ক্ষুদিরামের স্ত্রী চন্দ্রমণি দেবী। ক্ষুদিরাম অতিশয় ধর্মপরায়ণ, নির্ভীক সত্যপ্রিয় ছিলেন। শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম বয়ঃপ্রাপ্তির সহিত অর্থকারী কোনরূপ বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করিয়াছিলেন কিনা জানা যায় না। কিন্তু সত্যনিষ্ঠা, সন্তোষ, ক্ষমা, ত্যাগ প্রভৃতি যে গুণসমূহ সদ্‌ব্রাহ্মণের স্বভাবসিদ্ধ হওয়া কর্তব্য বলিয়া কথিত আছে, তিনি ওই সকল গুণের অধিকারী ছিলেন। শ্রীরামচন্দ্রের প্রতি ভক্তি তাঁহাতে বিশেষ প্রকাশ ছিল এবং তিনি নিত্যকৃত্য সন্ধ্যাবন্দনাদি সমাপন করিয়া প্রতিদিন পুষ্পচয়নপূর্বক রঘুবীরের পূজান্তে জলগ্রহণ করিতেন। নিষ্ঠা ও সদাচারের জন্য গ্রামবাসীরা তাঁহাকে বিশেষ ভক্তি ও সম্মান করিত। কথিত আছে যে, সত্যনিষ্ঠার জন্য প্রজাপীড়ক জমিদার ক্ষুদিরামকে সর্বস্বান্ত করিয়া স্বগ্রাম হইতে বিতাড়িত করেন। সত্যরক্ষার জন্য ক্ষতি স্বীকার করিয়াও এই অত্যাচার অবিচার ক্ষুদিরাম স্বীকার করেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্মের পূর্বে ১২৮১ সালে, গয়াক্ষেত্রে পিতৃপুরুষদের পিণ্ডদানের পরে ক্ষুদিরাম নবদূর্বাদল শ্যাম জ্যোতির্ময়তনু এক পুরুষকে স্বপ্নে দর্শন করেন এবং পুত্ররূপে ক্ষুদিরামের গৃহে তাঁহার জন্মগ্রহণপূর্বক তাঁহার সেবা গ্রহণ করার কথা জানিতে পারেন। ক্ষুদিরামের জীবনের বহু ঘটনায় তাঁহার গভীর ধর্মবিশ্বাস ও ভগবৎ পরিচয় পাওয়া যায়। একবার অভীষ্টদেব শ্রীরামচন্দ্ররূপে তাঁহাকে দেখা দেন এবং তাঁহার সেবাগ্রহণের অভিলাষ জানান। স্বপ্নের নির্দেশ অনুযায়ী ক্ষুদিরাম ‘রঘুবীর’ শালগ্রামশিলা লাভ করেন এবং গৃহদেবতারূপে প্রতিষ্ঠাপূর্বক নিত্যপূজা করিতে লাগিলেন। ক্রমশঃ ক্ষুদিরামের হৃদয়ে শান্তি, সন্তোষ ও ঈশ্বর নির্ভরতা নিরন্তর প্রবাহিত হইতে থাকে এবং তাঁহার সৌম্য শান্ত মুখদর্শনে গ্রামবাসীরা ঋষির ন্যায় তাঁহাকে ভক্তি শ্রদ্ধা করিতে থাকেন। তাঁহার দেবভক্তি এত গভীর ছিল যে একবার তিনি বহুদূর পথ অতিক্রম করার পর অসময়ে নূতন বিল্বপত্র দর্শনে গন্তব্যস্থলে যাওয়া স্থগিত রাখিয়া গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন এবং বিল্বপত্র দিয়া শিবপূজা করিয়া পরম তৃপ্তি লাভ করেন। বালক গদাধর যখন সাতবৎসরের তখন বিজয়া দশমীর দিন ক্ষুদিরাম দেহত্যাগ করেন। পরিণত বয়সেও ঠাকুর ভক্তদের নিকট মাঝে মাঝে পিতা ক্ষুদিরামের ধর্মনিষ্ঠার কথা স্ম রণ করিতেন।

খড়দহের নিত্যানন্দবংশীয় গোস্বামী — স্টার থিয়েটারে চৈতন্যলীলা দর্শনকালে তিনি ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করিয়াছিলেন। ঠাকুর তঁহার সহিত সস্নেহ ব্যবহার করিয়াছিলেন। ইনি খুব বড় পণ্ডিত এবং ইঁহার পিতাও বড় ভক্ত ছিলেন। পিতা শ্যামসুন্দরের প্রসাদ দিয়া ঠাকুরের সেবা করিয়াছিলেন।

খেলাৎচন্দ্র ঘোষ (রামখেলাৎ ঘোষ) — জন্ম কলিকাতার পাথুরিয়াঘাটায়। বিশিষ্ট দানশীল জমিদার। দীর্ঘদিন কলিকতার অবৈতনিক বিচারক, জাস্টিস অফ দি পিস এবং সনাতন ধর্মরক্ষিণী সভার বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন। কলিকাতার ধর্মতলা অঞ্চলে তাঁর নামে একটি উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয় আছে। খেলাৎ ঘোষের সম্বন্ধীর আমন্ত্রণে ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দের ২১শে জুলাই ঠাকুর কয়েকজন ভক্তসহ খেলাৎ ঘোষের বাড়িতে পদার্পণ করেন এবং ভগবৎ প্রসঙ্গ করেন।

গঙ্গাধর [গঙ্গাধর গঙ্গোপাধ্যায়] (৩০।৯।১৮৬৪ — ৭।২।১৯৩৭) — গঙ্গাধরের জন্ম কলিকতার আহিরীটোলায়। পিতা শ্রীমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়। গঙ্গাধর পরবর্তী-জীবনে স্বামী অখণ্ডানন্দ নামে শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘে সুপরিচিত। শ্রীরামকৃষ্ণের ত্যাগীশিষ্যদের অনত্যম। সম্ভবত ১৮৭৭ খ্রী: বাগবাজারে দীননাথ বসুর গৃহে তিনি প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করেন । সঙ্গে বাল্যবন্ধু হরিনাথ ছিলেন। এই হরিনাথ পরবর্তী কালে শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘে স্বামী তুরীয়ানন্দ নামে রিচিত। ইহার পরে ১৮৮২ অথবা ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণেশ্বরে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসেন। স্বামী অখণ্ডানন্দের রচিত গ্রন্থের মধ্যে ‘তিব্বতের পথে হিমালয়ে’ এবং ‘স্মৃতিকথা’ উল্লেখযোগ্য। তাঁহার লেখা সজীব, সতেজ ও সাবলীল। ১৯২৫ সালে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সহ-অধ্যক্ষ এবং ১৯৩৪ সালে অধ্যক্ষ রূপে গুরু দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই পদে আসীন ছিলেন।

গঙ্গাপ্রসাদ (গঙ্গাপ্রসাদ সেন) (১২৩১-১৩০২ বঙ্গাব্দ) — ঢাকা জেলার উত্তরপাড় কোমরপুকুর গ্রামে গঙ্গাপ্রসাদ সেনের জন্ম। পিতার নাম নীলাম্বর সেন। পিতার নিকট আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া ১২৪৯ বঙ্গাব্দে কলিকাতার কুমারটুলীতে চিকিৎসা আরম্ভ করেন। তৎকালীন ভারতের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের মধ্যে রামকৃষ্ণদেবও তাঁহার চিকিৎসাধীনে ছিলেন। ইনি প্রায় পঞ্চাস বৎসরের উপর আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করিয়া বাংলাদেশে কবিরাজী চিকিৎসার ধারা প্রচলন করেন । ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণকে তিনি প্রথম দেখিতে আসেন। দক্ষিণেশ্বরে সাধনকালের প্রথম অবস্থায় রানীরাসমণির জামাতা মথুরবাবুর আহ্বানে ইনি ঠাকুরের চিকিৎসার ভার গ্রহণ করেন। চিকিৎসাশাস্ত্রের আয়ত্তের বাহিরে ঠাকুরের অলৌকিক লক্ষণগুলি নিরাময় করিতে ব্যর্থ হইয়া ভ্রাতা দুর্গাপ্রসাদের মত অনুযায়ী এই ব্যাধিকে ‘যোগজ ব্যাধি’ বলিয়া অভিহিত করেন। অন্য সময়ে গঙ্গাপ্রসাদ ঠাকুরের রক্ত আমাশয় রোগের চিকিৎসা করিয়াছিলেন এবং গঙ্গাপ্রসাদের বাড়িতেও ঠাকুরের শুভাগমন হইয়াছিল। পরবর্তীকালে, ঠাকুর যখন কঠিন কণ্ঠরোগে পীড়িত হইয়া কলিকাতায় ভক্ত বলরাম বসুর বাড়িতে চিকিৎসার জন্য অবস্থান করিতেছিলেন, তখন ভক্তদের প্রচেষ্টায় পুনরায় গঙ্গাপ্রসাদকে ঠাকুরের চিকিৎসা করিবার জন্য আনা হয়। কিন্তু গঙ্গাপ্রসাদ অন্যান্য অভিজ্ঞ কবিরাজগণের সহিত পরামর্শ করিয়া জানিতে পারেন যে, রোগটি দুরারোগ্য, সারিবার নহে।

গঙ্গামায়ী — ইনি বৃন্দাবনের নিকট বর্ষানা নামক স্থানে তপস্যা করতেন। বিশেষ উচ্চ অবস্থাসম্পন্না সাধিকা ছিলেন। সাধারণে তাঁহাকে শ্রীরাধার সঙ্গিনী ললিতা সখীর অবতার বলিয়া মনে করিতেন। ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দে বৃন্দাবনে ঠাকুরের সহিত প্রথম সাক্ষাৎ হয়। ইনি ঠাকুরকে শ্রীরাধার মত ভাবময়ী দেখিয়া তাঁহাকে ‘দুলালী’ বলিয়া সম্বোধন করিতেন। ঠাকুর গঙ্গামায়ীর সেবাযত্নে মুগ্ধ হইয়া বৃন্দাবনে থাকিতে ইচ্ছাপ্রকাশ করিয়াছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাহা ঘটিয়া ওঠে নাই।

গণুর মা — [যোগীন্দ্রমোহিনী বিশ্বাস] (১৬।১।১৮৫১ — ৪।৬।১৯২৪) — যোগীন্দ্র মোহিনী বিশ্বাস শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘে যোগীন-মা নামে পরিচিত। শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপাধন্যা। পিতা প্রসন্নকুমার মিত্র। ভক্ত বলরাম বসুর বাড়িতে ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দে তিনি প্রথম ঠাকুরকে দর্শন করেন। মেয়ের নাম গণু বলিয়া তাঁহাকে ‘গণুর মা’ বলা হইত। শ্রীসারদা দেবীর সঙ্গিনী, সেবিকা ও অসামান্যা সাধিকা যোগীন-মাকে মায়ের ‘জয়া’ বলা হইয়াছে। ইনি শ্রীশ্রীঠাকুরেরও কিছু সেবা করিয়াছিললেন। শ্রীশ্রীমায়ের পঞ্চতপা ব্রত সাধনাতেও তিনি অংশ গ্রহণ করেন। যোগীন-মা উচ্চস্তরের সাধিকা ছিলেন — একাধিবার তাঁহার সমাধি হয়। যোগীন-মার অবিরাম তপশ্চর্যার বহু দৃষ্টান্ত আছে। বৃদ্ধাবয়সেও তাঁ হার জপধ্যানে প্রবল অনুরাগ ছিল। তাঁহার সূক্ষ্ম বুদ্ধি ও অন্তর্দৃষ্টির প্রমাণ প্রদর্শনের জন্য যেন শ্রীশ্রীমা অনেক সময় তাঁহার সহিত দীক্ষার্থীদের মন্ত্রাদি সম্বন্ধে আলোচনা করিতেন। দীন দুঃখীদের প্রতি তঁহার গভীর মমতা ছিল। জয়রামবাটী প্রভৃতি স্থানে মায়ের জনগণের সেবাদিতেও তিনি যথাসাধ্য অর্থব্যয় করিতেন। শ্রী শ্রীঠাকুরের নিকট তাঁহার ভগবৎ প্রসঙ্গাদি শ্রবণ করার সোভাগ্য হইয়াছিল। তাহার ফলে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী রচনাকালে তিনি স্বামী সারদানন্দজীকে প্রভূত সাহায্য করিয়াছিলেন। স্ত্রীভক্তদের সহিত শ্রীরামকৃষ্ণের আলাপ ও ব্যবহারাদির ইতিহাস তাঁহার স্মৃতিশক্তিবলে অবিকৃতভাবে সংরক্ষিত হইয়াছিল — প্রয়োজনস্থলে হুবুহু পুনরুজ্জীবিত হইত।

গণেশ উকিল — মথুরবাবুদের উকিল। তাঁহাদের বিষয় সংক্রান্ত কাজ উপলক্ষে আসিয়া দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরকে দর্শন করেন।

গিরিধারি দাস — গরাণহাটার (নিমতলা স্ট্রীট) বৈষ্ণব সাধুদের আখড়ার মোহন্ত। ষড়ভুজ মহাপ্রভু দর্শন করিতে ঠাকুর এই আখড়ায় আসিয়াছিলেন।

গিরিশ [গিরিশচন্দ্র ঘোষ] (২৮.২.১৮৪৪ — ১৮.২.১৯১২) — ইনি বঙ্গসমাজে প্রধানতঃ মহাকবি, নাট্যকার ও নট বলিয়া প্রসিদ্ধ; কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্তমণ্ডলীতে তিনি একনিষ্ঠ ভক্তি ও বিশ্বাসের মূর্তি এবং ঠাকুরের অহৈতুকী কৃপার অপূর্ব নিদর্শন। কলিকাতা বাগবাজার নিবাসী গিরিশচন্দ্র ঘোষ বাল্যাবস্থায় পিতৃমাতৃহীন হওয়ায় উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়েন । প্রথমে পাঠশালায়, পরে গৌরমোহন আঢ্যের স্কুলে ও হেয়ার স্কুলে পড়াশুনা করেন। ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দে পাইকপাড়া স্কুল হইতে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেন। বাল্যকাল হইতে পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত অত্যন্ত আগ্রহের সহিত পঠনের ফলে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁহার গভীর অন্তর্দৃষ্টি গড়িয়া ওঠে। পরবর্তী কালে নিজের অদ্যবসায় ও নিষ্ঠার গু ণে প্রখ্যাত নট, নাট্যকার ও কবিরূপে প্রতিষ্ঠিত হন এবং “মহাকবি” উপাধি অর্জন করেন। তিনি দেশপ্রেমিক এবং সমাজসংস্কারক ছিলেন। বাংলা নাট্য আন্দোলনের পুরোধা গিরিশচন্দ্র বাংলা নাটকের এক নূতন দিগন্ত উন্মোচন করেন। সারা জীবনে প্রায় ৮০টি পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক নাটক রচনা করেন। ইহার মধ্যে উল্লখযোগ্য চৈতন্যলীলা, বিল্বমঙ্গল, প্রফুল্ল, দক্ষযজ্ঞ, পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস, পাণ্ডবগৌরব, জনা, সিরাজদ্দৌলা প্রভৃতি। গিরিশচন্দ্র দীননাথ বসুর গৃহে শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রথম দর্শন করেন। প্রথমে তিনি কৌতূহলবশতঃ তাঁহাকে দেখিতে যান। একজন বিপথগামী ব্যক্তি সাধুলোকের সংস্পর্শে আসিয়া কিভাবে পবিত্র হইতে পারে — গিরিশচন্দ্র তাহার জ্বলন্ত উদাহরণ। ঠাকুরের অত্যধিক স্নেহ অশেষ কৃপা এবং সুমধুর প্রশ্রয় তাঁহার ক্লেদাক্ত জীবনের মোড় সম্পূর্ণ ঘুরাইয়া দিয়াছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাকে ‘ভৈরব’ আখ্যা দিয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের অবতারত্বে তাঁহার জ্বলন্ত বিশ্বাস ছিল এবং তিনি যে জীবের মুক্তিকল্পে ধরায় অবতীর্ণ হইয়াছেন একথা প্রচার করিতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেন যে, গিরিশের পাঁচসিকে পাঁচ আনা বিশ্বাস। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার রচিত ‘চৈতন্যলীলা’ নাটক দেখিয়া ভাবাবিষ্ট হন এবং শ্রীচৈতন্যের ভূমিকায় অভিনেত্রী বিনোদিনীকে আশীর্বাদ করেন। ইহা ছাড়া গিরিশের অন্য কয়েকটি নাটকও তিনি দেখেন। জীবনের অন্তিম পর্বে গিরিশ সর্বদা ঠাকুরের নাম গুণকীর্তন করিতেন। তাঁ হার ব্যক্তিত্বের চৌম্বকস্পর্শে সকলেই অভিভূত হইয়া যাইতেন। গিরিশের জীবন বুঝিতে গেলে যেমন শ্রীরামকৃষ্ণকে বাদ দেওয়া চলে না, শ্রীরামকৃষ্ণের অপার করুণা বুঝিতে হইলে গিরিশের জীবনও তেমনি অপরিহার্য।

গিরীন্দ্র (গিরীন্দ্রনাথ মিত্র) — কলিকাতা সিমুলিয়াবাসী গিরীন্দ্র মিত্র শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম গৃহীভক্ত সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের ভ্রাতা। ১৮৮১ সালে ইনি দক্ষিণেশ্বরে প্রথম ঠাকুরকে দর্শন করেন। প্রথম দর্শনেই শ্রী রামকৃষ্ণকে শঙ্কর, বুদ্ধ এবং চৈতন্যদেবের সমকক্ষ হিসাবে অনুভব করেন। তিনি প্রথমে ব্রাহ্মধর্মে এবং নিরাকার সাধনায় বিশ্বাসী ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসিয়া হিন্দু ধর্মের গূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে অবহিত হন। গিরীন্দ্র সুরেন্দ্রনাথের সহিত বহুবার শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে আসেন।

গিরীন্দ্র ঘোষ — পাথুরিয়াঘাটায় বাড়ি। ষড়রিপু দমনের জন্য ওইগুলিকে ভগবৎমুখী করিয়া দেওয়ার কথা গিরীন্দ্র বলিয়াছিলেন। এই প্রসঙ্গে ঠাকুর গিরীন্দ্রের কথা উল্লেখ করিয়াছেন।

গোপাল মিত্র — রামচন্দ্র দত্ত ও মনোমোহন মিত্রের সঙ্গে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে দক্ষিণেশ্বরে প্রথম দর্শন করেন ১৩ই নভেম্বর ১৮৭৯। ঠাকুরের দর্শন পাইয়া তিনি মুগ্ধ হইয়াছিলেন। প্রতি রবিবারে গোপাল ঠাকুরকে দর্শন করিতে যাইতেন।

গোপাল সেন — বরাহনগরবাসী ভগবৎভক্ত যুবক। ঠাকুরের সহিত প্রথম দর্শন ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণেশ্বরে। তিনি দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে যা তায়াত করিতেন এবং ঈশ্বরীয় ভাবে আবিষ্ট হইতেন। ভাবাবস্থায় ইঁহাকে ঠাকুর স্পর্শ করিয়াছিলেন। জীবনমুক্ত অবস্থায় সংসার বিষবৎ মনে হওয়ায় আত্মহত্যা করিয়া দেহত্যাগ করেন। গোপাল সেনের আত্মহত্যার সংবাদে ঠাকুর বলিয়াছিলেন যে, ঈশ্বর দর্শন করিবার পর যদি কেউ স্বেচ্ছায় শরীর ত্যাগ করে, তবে তাহাকে আত্মহত্যা বলে না।

গোপালের মা — [অঘোরমণি দেবী] (১৮২২ – ১৯০৬) — ২৪ পরগণা জেলার কামারহাটিতে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম। পিতার নাম কাশীনাথ ঘোষাল। নয়-দশ বৎসর বয়সে তাঁহার বিবাহ হয়। অল্প বয়সে নিঃসন্তান অবস্থায় বিধবা হইবার পর কুলগুরুর দ্বারা ‘গোপাল মন্ত্রে’ দীক্ষিতা হন। মুণ্ডিত মস্তকে সাধিকা অবস্থায় কামারহাটি গ্রামে দত্তদের ঠাকুর বাড়িতে বাস করিতেন। ১৮৫২ খ্রীষ্টাব্দ হইতে দীর্ঘ ৩০ বৎসর এই সাধিকা জপতপের সাহায্যে সিদ্ধা হন। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সহিত তাঁহার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। একদিন গভীর রাত্রে জপের সময় অঘোরমণি সহসা শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন পান এবং তাঁহার হাতটি ধরিবার সঙ্গে সঙ্গেই তঁহার স্থানে গোপালের ন্যায় বালক মূর্তি দর্শন করেন। ইহার পর তিনি দক্ষিণেশ্বরে বহুবার আসিয়া ঠাকুরকে দর্শন করেন। তিনি ঠাকুরের মধ্যে গোপালের মূর্তি দর্শন করেন । শ্রীশ্রীঠাকুরও তাঁহাকে যশোদাজ্ঞানে সম্মান করিতেন। তখন হইতেই তিনি ‘গোপালের মা’ নামে অভিহিত হন। অঘোরমণি ভগিনী নিবেদিতাকে ‘নরেনের মেয়ে’ বলিয়া ডাকিতেন। অন্তিমাকালে নিবেদিতা তাঁহার অনেক সেবা করিয়াছিলেন।

গোপী দাস — খোল বাদক। শ্রীশ্রীঠাকুরের গানের সঙ্গে সংকীর্তনে খোল বাজাইয়াছিলেন।

গোবিন্দ চাটুয্যে — ঠাকুর প্রথম কলিকাতায় আসিয়া ঝামাপুকুরে ইঁহাদের বাড়িতে ছিলেন।

গোবিন্দ পাল — ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বরাহনগর নিবাসী তরুণ ভক্ত। ঠাকুরের সহিত প্রথম সাক্ষাৎ ১৮৬৪-তে, দক্ষিণেশ্বরে। শ্রীশ্রী ঠাকুরের নিকট দক্ষিণেশ্বরে আসিতেন। ইনি ভগবৎ ভক্ত ছিলেন এবং অল্প বয়সে দেহরক্ষা করেন।

গোবিন্দ মুখোপাধ্যায় — ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের স্নেহধন্য পরমভক্ত। ইনি চব্বিশ পরগণা জেলার বেলঘরিয়ার অধিবাসী। দেওয়ানের পদে নিযুক্ত এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। ভক্তিমান গোবিন্দ ঠাকুরের প্রতি অতীব আকর্ষণে দক্ষিণেশ্বরে আসিতেন। ঠাকুরও তাঁহাকে অতিশয় স্নেহ করিতেন। ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দে ঠাকুর তাঁহার বেলঘরিয়ার বাড়িতে শুভাগমন করেন এবং সংকীর্তনে নৃত্য করিয়া প্রসাদ গ্রহণ করিয়াছিলেন। কীর্তনের সময় ঠাকুর সমাধিস্থ হইয়াছিলেন।

গোবিন্দ রায় — সুফী সম্প্রদায়ভুক্ত গোবিন্দ রায় আরবী পারসী ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। নানাধর্মের বহু শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ করিয়া তিনি অবশেষে ইসলাম ধর্মের উদার মতবাদে আকৃষ্ট হন এবং তাহাতেই আত্মনিয়োগ করেন। তিনি কোরাণ পাঠে নিমগ্ন থাকিতেন এবং কঠোর নিয়মানুবর্তিতার সহিত ধর্মর্চা করিয়া সিদ্ধি লাভের পথে অগ্রসর হইয়াছিলেন। ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সঙ্গে তাঁহার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তিনি একদা দক্ষিণেশ্বরের পঞ্চবটীর নিকট সাধনার স্থান নির্বাচন করেন। সেই সময় ঠাকুর তাঁহার ধর্মনিষ্ঠা এবং ভগবৎপ্রেমে আকৃষ্ট হন। তাঁহার সহিত ধর্মালোচনা করিয়া তিনি মোহিত হন এবং তাঁহার নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিয়া ইসলাম ধর্ম সাধন করিয়া মহম্মদের দর্শন লাভ করেন ।

গোষ্ঠ — খোলবাদক। ইঁহার বাহনা শুনিয়া শ্রীশ্রীঠাকুরের রোমাঞ্চ হইয়াছিল। সুরেন্দ্রের বাড়িতে তিনি খোল বাজাইয়াছিলেন।

গৌরী পণ্ডিত (গৌরীকান্ত ভট্টাচার্য) — বাঁকুড়া জেলার ইন্দাস গ্রামের বাসিন্দা। বীরাচারী তান্ত্রিক সাধক, তাঁহার কিছু সিদ্ধাই ছিল। ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সঙ্গে তাঁহার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। শাস্ত্রীয় প্রমাণের ভিত্তিতে শ্রীশ্রীঠাকুরের আধ্যাত্মিক অবস্থা নির্ধারণের উদ্দেশ্যে মথুরবাবু দক্ষিণেশ্বরে একটি সভা আহ্বান করেন। এই সময়ে গৌরী পণ্ডিত ঠাকুরকে অবতারগণের উৎসস্থল বলিয়া ঘোষণা করেন (১৮৭০)। শ্রীশ্রীঠাকুরের সান্নিধ্যে দিন দিন তাঁহার মন পাণ্ডিত্য, লোকমান্য, সিদ্ধাই প্রভৃতি সকল বস্তুর প্রতি বীতরাগ হইয়া ঈশ্বরের শ্রীপাদপদ্ম অভিমুখী হইতে থাকে। গৌরী দিন দিন ঠাকুরের ভাবে মোহিত হইয়া তাঁহার সম্পূর্ণ অনুরাগী হইয়াছিলেন। ধীরে ধীরে ঠাকুরের দিব্যসঙ্গলাভে তাঁহার তীব্র বৈরাগ্য হয়। একদা তিনি সজল নয়নে শ্রীশ্রীঠাকুরের নিকট বিদায় গ্রহন করিয়া চিরতরে গৃহত্যাগ করেন। বহু অনুসন্ধানেও ইহার পর গৌরী পণ্ডিতের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় নাই।

গৌরী মা (১৮৫৭ – ১৯৩৮) — ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপাধন্যা স্ত্রীভক্ত। প্রকৃত নাম মৃড়ানী বা রুদ্রাণী। পিতা পার্বতীচরণ চট্টোপাধ্যায়। মাতা গিরিবালা দেবী। তঁহার পিতৃগৃহ ছিল হাওড়ার শিবপুর অঞ্চলে। কিন্তু তিনি মাতুলালয় ভবানীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তী জীবনে ‘সন্ন্যাস’ গ্রহণের পর মৃড়ানীর নাম “গৌরীপুরী” হওয়ায় ভক্তসমাজে তিনি ‘গৌরী-মা’ নামে পরিচিতা হন। কিন্তু ঠাকুর ও শ্রীশ্রীমায়ের কাছে তিনি ছিলেন ‘গৌর দাসী’। গৌরী-মার ব্যক্তিত্ব ছিল অতুলনীয়। তাঁহার একনিষ্ঠতা, সাহস এবং শক্তি সকলের শ্রদ্ধার যোগ্য বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই আত্মীয়েরা তাঁহার বিবাহের ব্যবস্থা করায় তিনি ইহাতে প্রবল আপত্তি জানান এবং বিবাহের রাত্রে বাড়ি হইতে পলায়ন করেন। অতঃপর তিনি গলায় দামোদর শিলা লইয়া পাগলিনীর ন্যায় দীর্ঘ উনিশ বৎসর নানাতীর্থস্থানে ঘুরিয়া তপস্যা করিতে থাকেন। নানা তীর্থ ভ্রমণ কালে হরিদ্বারের পথে একদল সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীর সহিত মিলিত হন, এই সাধুসঙ্গেই তিনি “গৌরী-মায়ী” নামে অভিহিতা হন। ১৮৮২ সালে দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত তাঁহার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। ঠাকুরকে দর্শন করিয়া ও তাঁহার কথা শুনিয়া গৌরী-মা অভিভূত হন। পরম ভাগ্যবতী গৌরী-মা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে শ্রীশ্রীঠাকুরের সান্নিধ্যলাভের এবং সেবার অধিকারী হন। কিছুকাল তিনি দক্ষিণেশ্বরে শ্রীমা সারদাদেবীর সঙ্গেও বাস করেন। শ্রীশ্রী ঠাকুর এ দেশের মায়েদের জন্য দুঃখপ্রকাশ করিয়া গৌরী-মাকে তাহাদের সেবাকার্যে আত্মনিয়োগের কথা বলেন। পরবর্তী কালে গৌরী-মা মাতাঠাকুরানীর অনুমতিক্রমে প্রথমে বারাকপুরে গঙ্গাতীরে পরে বাগবাজারে শ্রীশ্রীসারদেশ্বরী আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। গৌরী-মার গান শুনিয়া ঠাকুরের সমাধি হইত। ঠাকুর তাঁহাকে মহাতপস্বিনী ভাগ্যবতী ও পুণ্যবতী বলিয়া নির্দেশ করিতেন। অপরপক্ষে গৌরী-মাও ঠাকুরকে অবতার রূপে ও মাতাঠাকুরানীকে ভগবতীরূপে ভক্তি করিতেন।

চন্দ্র চাটুজ্যে (চন্দ্র চ্যাটার্জী) — ঠাকুরের তন্ত্রসাধনার গুরু ভৈরবী ব্রাহ্মণির নিকট ইনি দীক্ষা গ্রহণ করেন। এইজন্য ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের গুরুভ্রাতা রূপে পরিচিত। ভৈরবীর সহায়তায় চন্দ্র দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সহিত মিলিত হন। তিনি উচ্চদরের সাধক ছিলেন। কিন্তু বিশেষ সিদ্ধাইলাভের ফলে সাধনপথ হইতে ভ্রষ্ট হন। পরে ঠাকুরের পূত সান্নিধ্যে তাঁহার সিদ্ধাইশক্তি নষ্ট হয় এবং ঠাকুরের দিব্যশক্তির প্রভাবে তিনি সঠিক পথে অগ্রসর হন। চন্দ্র ঠাকুরের অনুগত ছিলেন এবং ঠাকুরও তাঁহাকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন। ঠাকুর চন্দ্রকে ঘনিষ্ঠ ঈশ্বর প্রেমী বলিয়া বর্ণনা করিতেন। ঠাকুরের দেহরক্ষার দীর্ঘকাল পরে ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দে চন্দ্র অকস্মাৎ বেলুড়মঠে উপস্থিত হন এবং মাসাধিককাল সেখানে বাস করেন। তিনি নিত্য জপ-ধ্যানে নিরত থাকিতেন।

চন্দ্র হালদার — কালীঘাটের হালদার বংশীয়, মথুরবাবুদের পুরোহিত। মথুরবাবুর উপর রামকৃষ্ণের প্রভাব এবং মথুরবাবুর ঠাকুরের উপর প্রশয়পূর্ণ ব্যবহার ও পক্ষপাতিত্বের জন্য ঠাকুরের প্রতি সে অত্যন্ত ঈর্ষান্বিত ছিল। সে ধূর্ত ও খল প্রকৃতির ছিল। ঠাকুরের ভাবাবিষ্ট অবস্থাকে এবং সরলতাকে ধূর্ততার ভান বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করে। নানা মিথ্যা কথা বলিয়া মথুরবাবুর আস্থাভঞ্জন হইবার চেষ্টা করে কিন্তু তাহাতে বিফল মনোরথ হয়। একদিন সন্ধ্যার সময় ঠাকুর যখন ভাবসমাধির ফলে অর্ধবাহ্যদশা প্রাপ্ত হইয়া মথুরবাবুর জানবাজারের বাড়িতে পড়িয়া আছেন, তখন সে তাঁহাকে পদাঘাত করে এবং অত্যন্ত কটুবাক্য প্রয়োগ করিয়া চলিয়া যায়। কিন্তু তাহার কঠোর শাস্তি বিধানের আশঙ্কায় ঠাকুর এই ঘটনা মধুরবাবুর কর্ণগোচর করেন নাই। পরে অন্য কোন অপরাধের ফলে চন্দ্র হালদার কর্মচ্যুত হইলে ঠাকুর মথুরবাবুর নিকট ওই ঘটনার উল্লেখ করেন।

চন্দ্রমণি (চন্দ্রমণিদেবী) (১৭৯১ – ১৮৭৬ খ্রী:) — ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী এবং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পরম ভাগ্যবতী জননী। চন্দ্রমণিদেবীর জন্ম সরাটি মায়াপুর গ্রামে। তাঁহার সরলতা, দেবদ্বিজে ভক্তি এবং সর্বপরি সততা সকলকে মুগ্ধ করিত। শ্রীমতী চন্দ্রাদেবী ছিলেন স্নেহ ও সরলতার মূর্তি — প্রতিবেশীগণ সম্পদে-বিপদে তাঁহার ন্যায় হৃদয়ের সহানুভূতি আর কোথাও পাইত না। দরিদ্ররা জানিত চন্দ্রাদেবীর নিকট তাহারা যখনই উপস্থিত হইবে, তখনই অন্নের সহিত অকৃত্রিম যত্ন ও ভালবাসায় তাহারা পরিতৃপ্ত হইবে, ভিক্ষুক সাধুদের জন্য তাঁহার দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত ছিল এবং প্রতিবেশী বালক-বালিকাদের সমস্ত আবদার তিনি পূর্ণ করিতেন। চন্দ্রমণি জাগ্রত অবস্থায় অথবা নিদ্রিত অবস্থায় প্রায়ই নানাপ্রকার অলৌকিক ঘটনা দেখিতে পাইতেন। ইহাতে তিনি কখনও কখনও অতিশয় ভীত হইতেন আবার কখনও-বা বিস্মিত হইতেন। একবার কোজাগরী পূর্ণিমার রাত্রে তিনি মা লক্ষ্মীকে দর্শন করিয়াছিলেন। চন্দ্রমণির ৪৫ বৎসর বয়সে গদাধরের আবির্ভাবের পূর্বেও তিনি এইরূপ অলৌকিক এক জ্যোতির দর্শন পাইয়াছিলেন। গদাধর শৈশব হইতেই দেবদ্বিজে ভক্তির ভাব তাঁহার মাতার নিকট হইতে পাইয়াছিলেন। চন্দ্রমণি দেখিয়াছিলেন বাড়ির নিকট যুগীদের মন্দিরের মহাদেবের শ্রীঅঙ্গ হইতে দিব্যজ্যোতি নির্গত হইয়া তরঙ্গাকারে ছুটিয়া আসিয়া তাঁহার ভিতরে প্রবেশ করিতেছে। গদাধরের জন্মের পূর্বে তিনি প্রায় নিত্যই দেবদেবীসকলের দর্শনলাভ করিতেন এবং সকল দেবদেবীর উপরেই এইকালে তাঁহার মাতৃস্নেহ যেন উদ্বেলিত হইয়া উঠিয়াছিল। পরবর্তী কালে শ্রীরামকৃষ্ণ বহুবার এইকথা স্মরণ করিয়াছিলেন। শেষজীবনে প্রায় ১২ বৎসর চন্দ্রমণি দক্ষিণেশ্বরে কাটিয়াছিলেন। প্রথমে মথুরবাবুদের কুঠিবাড়িতে এবং শেষে নহবতের দ্বিতলে তাঁহার থাকিবার ব্যবস্থা হয়। মায়ের কথা মনে হওয়ায় শ্রীরামকৃষ্ণ বৃন্দাবনে গঙ্গামায়ীর নিকট থাকেন নাই। ৮৫ বৎসর বয়সে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। শেষ মুহূর্তে তাঁহার দেহ গঙ্গাতীরে আনা হয় এবং ঠাকুর তাঁহার গর্ভধারিণীর চরণে অঞ্জলি প্রদান করেন।

চিনে শাঁখারি (শ্রীনিবাস শাঁখারি) — শ্রীনিবাস বা চিনু নামে অভিহিত কামারপুকুর নিবাসী ধার্মিক ব্যক্তি। চিনে শাঁখারি খুব উঁচুদরের বৈষ্ণব সাধক ছিলেন। গদাধরের শৈশবেই চিনু তাঁহার দৈবী স্বরূপ বুঝিয়াছিলেন। তাঁহার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে স্বয়ং চৈতন্যদেব গদাধররূপে আবির্ভূত হইয়াছেন। তিনি তাঁহাকে ইষ্টদেবতারূপে পূজা করিতেন ও তাঁহার বাল্যলীলার সঙ্গী ছিলেন। তিনি প্রত্যহ শ্রীমদ্ভগবদ্‌ গীতা ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ পাঠ করিতেন। পরবর্তী কালে শ্রীরামকৃষ্ণরূপে ঠাকুর যখন কামারপুকুরে আসিতেন তখনও তিনি তাঁহার চিনুদাদার সহিত পূর্ববর্তী সম্পর্ক বজায় রাখিতেন। চিনু দীর্ঘজীবী ছিলেন এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ঠাকুরের প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা করিয়া গিয়াছেন।

চুনীলাল [চুনীলাল বসু] (১৮৪৯-১৯৩৬) — চুনীলাল বসু ঠাকুরের কৃপাপ্রাপ্ত গৃহীভক্ত, কলিকতার বাগবাজারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হিন্দুস্কুলের ছাত্র ছিলেনএবং কলিকাতা কর্পোরেশনে চাকুরী করিতেন। চুনীলাল সাধুদর্শনের ইচ্ছায় দক্ষিণেশ্বরে যান এবং ঠাকুরের দর্শনলাভ করিয়া ধন্য হন। পরে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের উপদেশমত চলিয়া ইনি যোগাভ্যাসজনিত হাঁপানি রোগ হইতে মুক্তিলাভ করেন। ঠাকুরের প্রতি তাঁহার প্রগাঢ় ভক্তি বাড়িতে থাকে এবং ক্রমে তিনি ঠাকুরকে অবতার বলিয়া বুঝিতে পারেন। কাশীপুরে “কল্পতরু” দিবসে তিনি ঠাকুরের বিশেষ কৃপালাভ করেন। স্বামী বিবেকানন্দ চুনীলালকে “নারায়ণ” বলিয়া ডাকিতেন। পরবর্তী কালে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠের সন্ন্যাসীদের সহিত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল ও মঠের বিভিন্ন কাজে সাহায্যে করিতেন।

ছোট গোপাল (গোপালচন্দ্র ঘোষ) — বাসস্থান কলিকাতার সিমলা অঞ্চল। ঠাকুরের সহিত প্রথম সাক্ষাৎ দক্ষিণেশ্বরে। মাঝে মাঝে ঠাকুরের সান্নিধ্যলাভ করিয়াছেন। ইনি হঠাৎ হঠাৎ ঠাকুরের নিকট যাইতেন বলিয়া তাঁহাকে ‘হুট্‌কো’ গোপাল বলা হইত। ঠাকুরের গোপাল নামক কয়েকজন ভক্ত থাকায় তাঁহাকে ‘ছোট গোপাল’ নামে অভিহিত করা হয়। তিনি ঠাকুরের নিকট হইতে বিশেষ কৃপালাভ করেন এবং ঠাকুরকে গুরু-রূপে বরণ করেন। তিনি কাশীপুরে অসুস্থ ঠাকুরকে সেবা করিয়াছিলেন। বরাহনগর মঠে তিনি সাধুদের সেবাদি করিয়াছিলেন। পরে তিনি বিবাহ করিয়া সংসারী হন এবং একটি কন্যা রাখিয়া পরলোক গমন করেন।

ছোট নরেন (নরেন্দ্রনাথ মিত্র) — শ্যামপুকুর বাসিন্দা ও শ্রীম-র ছাত্র। শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপাপ্রাপ্ত, শুদ্ধাত্মা ভক্ত। স্বামী বিবেকানন্দের নাম “নরেন” হওয়ায়, ঠাকুর একই নামের এই ভক্তটিকে “ছোট নরেন” বলিতেন। ঠাকুরের প্রতি প্রবল আকর্ষণে সকল বাধা বিপদ তুচ্ছ করিয়া তিনি প্রায়ই দক্ষিণেশ্বরে যাইতেন। ঠাকুরও তাঁহাকে দেখিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া পড়িতেন — এবং তাঁহাকে দেখিয়া প্রায়ই সমাধিস্থ হইতেন। ঠাকুরের সংস্পর্শে ছোট নরেনেরও মাঝে মাঝে ভাব সমাধি হইত। পরবর্তী কালে ইনি হাইকোর্টের এ্যটর্নী হন — রামকৃষ্ণ মিশনের আইন বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাঁহার সাংসারিক জীবন সুখের হয় নাই।

জজ (সদরওয়ালা) — সুরেন্দ্রের মেজোভাই। সুরেন্দ্রের বাড়িতে ঠাকুরের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। (১৯-১১-১৮৮২)

জয়গোপাল সেন — প্রাচীন ব্রাহ্মভক্ত। ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দে বেলঘরিয়ায় (৮ নং বি.টি. রোড) তাঁহার বাগানবাড়িতে কেশব সেনের সহিত শ্রীরামকৃষ্ণ দেখা করিতে গিয়াছিলেন। তাঁহার কলিকাতার বাসা ছিল মাথা ঘষা গলিতে। সেখানেও শ্রীশ্রীঠাকুর পদার্পণ করিয়াছিলেন। জয়গোপাল সেন ঠাকুরের একান্ত অনুগত। জয়গোপালের বাড়িতে ঠাকুর প্রায়ই যাইতেন, ধর্মীয় বিষয়ে বিষয়ে আলোচনা করিতেন এবং ভক্তগণকে উপদেশ দিতেন। জয়গোপাল নিজেও মধ্যে মধ্যে দক্ষিণেশ্বরে আসিতেন। জয়গোপাল সেন ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত ছিলেন এবং ঠাকুরের ব্রাহ্মভক্তদের মধ্যে জয়গোপাল সেন ছিলেন অন্যতম।

জয়নারায়ণ পণ্ডিত [তর্কালঙ্কার] (১৮০৮-১৮৭৩) — দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার মুচাদিপুর গ্রামে জন্ম। পিতা শ্রীহরিশচন্দ্র বিদ্যাসাগর। চৌদ্দ বৎসর বয়সে ব্যাকরণ অমরকোষ ও কাব্যশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করিয়া ভবানীপুরের রামতোষণ বিদ্যালঙ্কার এবং জগন্মোহন তর্কসিদ্ধান্তের নিকট ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। শিক্ষাশেষে হাওড়ায় চতুষ্পাঠী স্থাপন করিয়া অধ্যাপনা শুরু করেন। তিনি সংস্কৃত কলেজে ন্যায়শাস্ত্রের অধ্যাপকের পদেও নিযুক্ত হইয়াছিলেন। তাঁহার রচিত সংস্কৃত শাস্ত্রগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ১১টি। অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি উদার মনোভাবাপন্ন, প্রকৃত নিরহঙ্কার এবং পরম ভক্ত ছিলেন। ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত তাঁহার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। শ্রীশ্রী ঠাকুর স্বয়ং কলিকাতায় জয়নারায়ণকে দেখিতে যান। তিনি ইঁহাকে অতিশয় স্নেহ করিতেন। পণ্ডিত মহাশয়ের কাশীতে দেহত্যাগ হয়।

জয় মুখুজ্জে (জয়নারায়ণ মুখোপাধ্যায়) — বরাহনগরবাসী জয়নারায়ণ মুখোপাধ্যায় শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত। দিব্যোন্মাদ অবস্থায় বিচরণ কালে শ্রীরামকৃষ্ণ একদা বরাহনগরে গঙ্গার ঘাটে ইঁহাকে অন্যমনস্কভাবে জপ করিতে দেখিয়া দুই চাপড় মারিয়াছিলেন।

জানকীনাথ ঘোষাল (১৮০৪ – ১৯১৩) — আদি ব্রাহ্মসমাজের একজন ভক্ত। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের জামাতা। জানকীনাথ ২রা মে ১৮৮৩ সালে নন্দনবাগানে ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করেন। তিনি উপাসনা মন্দিরে ঠাকুরের নিকটেই বসিয়াছিলেন। ঠাকুর সেদিন কৃষ্ণপ্রেমে উন্মত্তা রাধিকার আকুলতার উদাহরণ দিয়াছিলেন। তাহাতে জানকীনাথ এই উন্মত্ততা অভিপ্রেত কিনা জানিতে চাহেন। ঠাকুর তখন প্রেমোন্মাদ জ্ঞানোন্মাদের মতনই ভগবৎপ্রেমেও যে উন্মাদ হওয়া যায় তাহা ব্যক্ত করিয়াছিলেন।

জ্ঞান চৌধুরী — সিমুলিয়া নিবাসী জ্ঞান চৌধুরী ব্রাহ্মভক্ত এবং উচ্চশিক্ষিত সরকারী কর্মচারী ছিলেন। পত্নী বিয়োগের পর সাময়িকভাবে তাঁহার মনে বৈরাগ্য আসে এবং তিনি দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ সকাশে আসেন। তাঁহার একটি তাচ্ছিল্যপূর্ণ উক্তিতে ক্ষুব্ধ হইয়া ঠাকুর তাঁহাকে বিদ্যার অহংকার ত্যাগ করিয়া ভক্তিপথে থাকার নির্দেশ দেন; এবং তিনি পরবর্তী কালে ঠাকুরের নির্দেশ পালন করেন। জ্ঞান চৌধুরীর বাটীতে আয়োজিত ব্রাহ্মসমাজের উৎসব উপলক্ষে ঠাকুর শুভাগমন করিয়াছিলেন এবং জ্ঞান চৌধুরী সেদিন ঠাকুর সহ সকলকে জলযোগে আপ্যায়িত করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *