৫.২ গনিমতের মাল

৫.২ পঞ্চম অধ্যায় : মুহাম্মদের পর : গনিমতের মাল

পাশ্চাত্য অনেক পণ্ডিত ইসলামকে একটি আঞ্চলিক বিষয় বলে মনে করেন। তাঁরা ইসলামের অনেক শাস্ত্রীয় নির্দেশকে আধুনিক বিশ্বের উপযোগী বলে মানতে চান না। এ-নির্দেশের মধ্যে রয়েছে: নামাজের পূর্বে অজু করা, দৈনিক পাঁচবার নামাজ পড়া যা মসজিদে গিয়ে পড়াই উত্তম, চন্দ্রবৰ্ষ অনুযায়ী বার মাস গণনা করা, এবং রমজান মাসে উপবাস করে সূর্যোদয় হতে সূর্যস্ত পর্যন্ত প্রধান কাজকর্ম থেকে বিরত থাকা – তা বিশ্বের যে কোনো স্থানেই হোক। মনে রাখা দরকার, বিশ্বের যেসব স্থান উচ্চ অক্ষাংশে অবস্থিত সেখানে সূর্য অস্ত যায় না এবং সর্বদাই দিবস থাকে। পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা মনে করেন যে সপ্তম শতাব্দীতে রমজান মাসের উপবাসের প্রথা করা হয়েছিল হেজাজের জন্য। কারণ ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বের অন্যান্য স্থান সম্বন্ধে অজ্ঞাত ছিলেন। ইসলামে সুদের ব্যবসা নিষিদ্ধ। এই নিষেধাজ্ঞা পুঁজি বিনিয়োগের এবং অর্থনৈতিক প্রগতির জন্য ক্ষতিকর। ইসলামে দাসত্ব প্রথার মাধ্যমে মানুষকে পশুতুল্য ব্যবহারকে আইনসঙ্গত করা হয়েছে। নারীরা প্রায়শ অর্থনৈতিক কাজকর্মে তেমন অবদান রাখে না। তাই পুরুষদের চেয়ে তাদের বেশি অর্থের প্রয়োজন। ইসলামের উত্তরাধিকার আইনে নারীদের প্রতি অসমতা রয়েছে। নারীরা পুরুষদের থেকে কম পান। তাই ইসলামের অসম উত্তরাধিকার আইনকে পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা অযৌক্তিক মনে করেন। ইসলামে নারীর সাক্ষ্যকে পুরুষদের অর্ধেক ধরা হয়। এই ব্যবস্থা হচ্ছে মানবাধিকারের লঙ্ঘন। কোরানের আদেশ অনুযায়ী একবার চুরির অপরাধে হাতকাটা এবং চুরির পুনরাবৃত্তির জন্য পা কেটে ফেলা একেবারেই অসামাজিক প্রথা। কারণ এরূপ শাস্তির ফলে অপরাধী অক্ষম, বিকলাঙ্গ হয়ে যায়। যার ফলে তার কাজকর্ম করার কোনো ক্ষমতা থাকে না। ইসলাম পুরুষদের জন্য বহুবিবাহ প্রথা অনুমোদন করে। এক স্বামী একক সময়ে চার স্ত্রী নিতে পারে এবং অগুণিত ক্রীতদাসী উপপত্নী হিসাবে রাখতে পারে। আবার যুদ্ধবন্দিনী-এমন কী যাদের স্বামী জীবিত থাকে সেইসব যুদ্ধবন্দিনীদের সাথেও যৌন সঙ্গমের অনুমতি রয়েছে। ব্যভিচারের জন্য ইসলামে রয়েছে পাথর ছুড়ে হত্যার শাস্তি যা ইসলাম ধার করেছে ইহুদিদের শাস্তিব্যবস্থা থেকে। ইসলামে বিদ্যমান এই প্রথাগুলিকে পাশ্চাত্যে অমানবিক বলে নিন্দা করে। ইসলামি নীতিতে বলা হয়েছে: কোনো ব্যক্তির সম্পত্তি ও দেহের উপর তার নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ থাকবে। নিজস্ব সম্পত্তি উইল করার ব্যাপারে যে সীমাবদ্ধতা আছে সেটা ইসলামের নীতির সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। মোদা কথা হল ধর্ম কোনোভাবে সর্বজনীন ও সর্বকালের জন্য নয়।

এটা সত্যি যে, আজকাল বেশিরভাগ মুসলিম দেশে ইসলামি আইন যেমন পাথর ছুড়ে হত্যা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কর্তন করা এবং চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত উত্তোলন করা হয় না। সব মুসলিম দেশে সুদসহ ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এই তথ্যগুলো জানানো হলেও ইসলাম- সমালোচকেরা হজ নিয়ে কটাক্ষ করেন। হেজাজের পৌত্তলিকদের মূর্তিপূজার ঘরকে আল্লাহর ঘর বানানো, পৌত্তলিক- প্রথার মত কাবার কালো পাথরকে (হাজরে আসওয়াদ) চুম্বন করা, এবং হজ সংক্রান্ত অন্য সকল ধর্মীয় আচার। ইসলামের দাবি হচ্ছে, ইসলাম মানব সমাজকে পৌত্তলিকতা এবং কুসংস্কার থেকে মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু হজ সংক্রান্ত রীতিনীতি ইসলামের এ- দাবির সাথে পুরোপুরি খাপ খায় না।

এজন্য ইসলামকে একটি একক জাতির নিজস্ব চিন্তাধারা ও রীতিনীতির প্রকাশ হিসাবে ধরে নিতে হবে। যে ধর্ম কখনো বর্ণবৈষম্য ও অন্ধ গোঁড়ামির উর্ধ্বে উঠেনি এবং সমগ্র মানবসমাজকে ভালোর দিকে পথ নির্দেশ দেয় না সে ধর্ম কখনো সার্বজনীন ও স্থায়ী হতে পারে না।

ইসলাম- সমালোচকেরা একটা বিষয় ভুলে যান, সবচেয়ে উত্তম আইন হবে সেই আইন যা মানুষের প্রয়োজন ও যা সমাজে উপস্থিত সকল ক্ষতিকর অবস্থার মোকাবেলা করে। তৎকালীন আরব সমাজে হত্যা, লুটতরাজ, অন্যের অধিকার ও সমানে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করা ছিল সর্বত্র বিরাজমান। এ- রকম অস্থির সমাজে একমাত্র কঠোর আইনই ফলপ্রসূ হবে। শাস্তি হিসাবে অঙ্গাদি কর্তন করা, পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা এবং রক্তের বদলে রক্ত-একমাত্র এসব বিধান ছাড়া কোনো কিছু ফলপ্রসূ ছিল না। ইসলামের পূর্বে এবং ইসলাম প্রচারের সমসাময়িককালেও দাসপ্রথার প্রচলন ছিল। ইসলামের পূর্বে রোমান, অসিরীয়ান, এবং ক্যালডিয়ান সভ্যতার সময়েও দাসপ্রথা চালু ছিল। ক্রীতদাসের মুক্তির বিনিময়ে অনেক পাপের প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা ইসলামে আছে। এ নিয়ে তৃতীয় অধ্যায়ের ইসলামে নারী পরিচ্ছেদে বেশকিছু মন্তব্য রয়েছে। পৌত্তলিক যুগে আরব- নারীদের অধিকার খুবই কম ছিল। মৃত স্বামীর স্ত্রীকে সম্পত্তি হিসাবে গণ্য করা হত। যে ব্যক্তি মৃত স্বামীর সম্পদের উত্তরাধিকারী হত তার বিধবা স্ত্রীও তার ভাগে পড়ত। কোরানে নারীদের যে অধিকার দেওয়া হয়েছে তা সেই সময়ের নারী অধিকারের জন্য এক বিপ্লবাত্মক অগ্রগতি। কিন্তু সপ্তম শতাব্দীতে মুহাম্মদ যেসব আদেশ দিয়ে গেছেন তা আজকের উনবিংশ এবং বিংশ শতকের সমাজের মানদণ্ডে বিচার করা অযৌক্তিক। আব্রাহাম লিঙ্কন যেভাবে দাস প্রথার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন সেভাবে নবি মুহাম্মদ লড়বেন, এটা আশা করা একেবারে অবাস্তব। ইসলাম- সমালোচকদের আরও অনেক সমালোচনার যথার্থ জবাব দেয়া যায়। ইসলামে চিন্তা এবং বিশ্বাসের স্বাধীনতার প্রসঙ্গে বলা যায় যে মুসলিমরা বিজিত দেশের বাসিন্দাদের উপর দুইটি পছন্দের একটি বেছে নেবার সুযোগ দেবে ইসলাম অথবা জিজিয়া কর।

এটাও সত্য যে, অনেক ক্ষেত্রে তরবারির লড়াইয়ে ইসলাম প্রসারিত হয়েছে। আজকের বিংশ শতাব্দীর মানদণ্ডে যাচাই করলে এভাবে ইসলাম প্রচার করা অনুচিত ও অন্যায় মনে হবে। আধুনিক বিশ্ব কোনোভাবেই এই ধারণা গ্রহণ করবে না যে, আল্লাহ একমাত্র আরবদেরকেই নির্বাচিত করেছেন সমগ্র মানব- সমাজকে পথ দেখাতে। আল্লাহ সত্যিই যদি চাইতেন সিরিয়া, মিশর, এবং ইরানের বাসিন্দারা মুসলিম হবে, তবে তিনি যুদ্ধের আশ্রয় না নিয়ে অনেক মার্জিত ও শান্তিময় ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কারণ কোরানে বলা হয়েছে : . . . তিনি যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন ও যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন। (সুরা নাহল : আয়াত ৯৩)। কোরানে আরও বলা হয়েছে যে তরবারি দ্বারা কাউকে পথ দেখানো যায় না। . . . প্রকৃত প্রমাণ দ্বারাই আল্লাহ যাদেরকে ধ্বংস করার তাদের ধ্বংস করেন, আর প্রকৃত প্রমাণ দ্বারাই যাদেরকে জীবিত রাখা প্রয়োজন তাদেরকে জীবিত রাখেন।’ ( সুরা আনফাল: আয়াত ৪২) । . . . তোমাদের ধর্ম তোমাদের, আমার ধর্ম আমার। (সুরা কাফিরুন ; আয়াত ৬) । এইরকম আরও ডজন খানেক কোরানের আয়াত উদ্ধৃত করা যায়।

এই বিষয়ের গভীরে গেলে বুঝা যায় ইসলাম গ্রহণ অথবা জিজিয়া কর প্রদান করার যে শর্ত ছিল তা করা হয়েছিল আরববাসীর জন্য। মুহাম্মদ এই নীতি অবলম্বন করেন খায়বার দখল করার পর এবং মক্কা বিজয়ের পর যখন কুরাইশরা মুহাম্মদের প্রতি তাদের অধীনতা স্বীকার করে নেয়। নবি মুহাম্মদের উদ্দেশ্য ছিল আরবদেশকে একটি একক রাজনৈতিক ধারায় নিয়ে আসা। হাদিস থেকে জানা যায় যে নবি বলেছেন: আরব উপদ্বীপে একের বেশি ধর্ম থাকবে না। মক্কা বিজয়ের পর আল্লাহ নবিকে পাঠালেন সুরা তওবা । এই সুরায় বলা হল যে, পৌত্তলিকরা অবিশুদ্ধ। তাই তারা আর কাবার মসজিদ প্রাঙ্গণে আসতে পারবে না। এই সুরার অনেক আয়াত থেকে বুঝা যায় যে ইসলামের ছত্রছায়ায় একটি আরব- জাতীয় পরিচয়ের জন্য নবি ছিলেন বদ্ধপরিকর। তাই বেদুইনদের জন্য কঠোর পদক্ষেপ এবং শক্তি প্রয়োগের ব্যবস্থা এই সুরায় রাখা হয়। অবিশ্বাস ও কপটতায় মরুবাসী আরবরা ( বেদুইন) বড় বেশি পোক্ত। আর আল্লাহ তাঁর রসুলের ওপর যা অবতীর্ণ করেছেন তার (ন্যায়নীতির) সীমারেখা না শেখার যোগ্যতা এদের বেশি।’ (সুরা তওবা ; আয়াত ৯৭) । সুরা শোআল্লারাতে আল্লাহ বলেছেন: “যদি এ কোনো অনারবের (ভিন্নবাসী) ওপর অবতীর্ণ করা হত। ( ২৬; ১৯৮) । এ- আয়াত থেকে বুঝা যায় আল্লাহ জানতেন যে আরবদের চাইতে অনারবরা দ্রুত কোরান বোঝে এবং সহজেই কোরানের বাণী মেনে নেয়।

ইউরোপের পণ্ডিতেরা ইসলাম প্রসঙ্গ অনেক মন্তব্য করেছেন। তার মধ্যে দুটি প্রসঙ্গের উত্তর দেয়া যায় না। একটা হচ্ছে আল্লাহ শুধুমাত্র হেজাজের লোকদেরকে নিয়োগ করলেন সমগ্র বিশ্বকে নৈতিকতা শিক্ষা দিতে এবং তরবারি দিয়ে লড়াই করে বিশ্বব্যাপী একেশ্বরবাদ প্রচার করতে। যেহেতু এই বক্তব্যটি বিশ্বাস করা কঠিন তাই এ-নিয়ে এখানে আলোচনা করা যাবে না। দ্বিতীয় হচ্ছে আরবদের অন্য দেশ দখলের পিছনে যে অর্থনৈতিক প্রেরণা ছিল তা নিয়ে।

এ অধ্যায়ের শুরুর দিকে বলা হয়েছে নবির মৃত্যুর পর নেতৃত্ব এবং রাজ্যশাসনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা রাজনৈতিক ইসলামের রূপরেখা তৈরি করেছে। আরব বেদুইন যে অন্যের ধনদৌলত কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জাতিকে পদানত করেছিল তার প্রচুর প্রমাণ আমরা পাই ইতিহাস থেকে। উষর, অনুর্বর, রৌদ্রতপ্ত আরব মরুভূমিতে বসবাস করত অতিশয় রুক্ষ যাযাবর বেদুইনরা। তারা অতিকষ্টে কোনোরকমে জীবিকা নির্বাহ করত। তারা জানতো তাদের সীমান্তের বাইরে আরও অনেক উর্বর, ধনী, এবং উন্নত রাষ্ট্র এবং নগর আছে। সেসব জায়গায় বিলাসিতা আছে প্রচুর এবং জীবিকা অর্জন সহজ। তবে দুঃখের বিষয় ছিল যে ওই জনবসতিপূর্ণ ভূখণ্ডগুলো প্রবল ক্ষমতাধর পারস্য ও রোমের অধীনে। বিছিন্নভাবে নিঃস্ব, সহায়হীন যাযাবরদের দ্বারা এই শক্তিমান রাজত্ব জয় করা সম্ভব ছিল না। যাযাবর আরব বেদুইন গোত্রের মাঝে পরস্পর ধ্বংসাত্মক হানাহানি তখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ইসলাম এই আন্তঃগোত্রীয় হানাহানির অবসান ঘটায়, তাদের মাঝে এনে দেয় দৃষ্টির প্রসারতা। দীর্ঘদিন ধরে বেদুইনদের শক্তি বিচ্ছিন্ন-বিভাজিত অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ইসলাম সে শক্তিকে সুসংহত করে একত্র করে। ফলে আরব ভূখণ্ডে জন্ম হয় এক অতিশয় শক্তিধর জাতির, যা এতদিন অসম্ভব ছিল ইসলাম তাকে সম্ভাবনাময় করে দিল।

ইসলাম- পূর্ব যুগে আরব ভূখণ্ডে দরিদ্র বেদুইনরা তাদের লোভ চরিতার্থ করার জন্য দুর্বল গোত্রের উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে দুশো থেকে তিনশ উট কুক্ষিগত করে নিয়ে যেত। যখন তাদের এই শক্তিকে একত্রিত করা হল তখন তারা দেখল তারা আরও প্রচুর মাল দখল নিতে পারে। দূর-দূরান্তের উর্বর জমি দখল করে নিতে পারে, বিদেশি সুন্দরী শ্বেতাঙ্গ নারীও পেতে পারে। আরব- বেদুইনদের বৈশিষ্ট্য ছিল লড়াই করে অন্যের মাল লুট করতে এবং কাম চরিতার্থ করতে তারা নিজেদের জীবন বিপন্ন করতে কুষ্ঠিত হতো না। ইসলাম তাদের এই উৎসর্গীকৃত জীবনাচরণ ও পেশাদারী বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগাল। আর বেদুইনরাও বুঝল যুদ্ধ জয় হলে অগণিত ধনসম্পদই শুধু হস্তগত হবে তাই নয় শক্রকে হত্যা করলে বেহেশত লাভ হবে কিংবা যুদ্ধের ময়দানে নিহত হলেও বেহেশতে যাবে। ইসলাম আরব বেদুইনদের লড়াকু জীবনাচরণের আধ্যাত্মিক প্রেরণা যোগান দেয়। ইসলাম গ্রহণের পর তামিম গোত্র দ্বারা তাগলিব গোত্রকে আক্রমণ, আউস গোত্র দ্বারা খাজরাজ, সাকিফ গোত্র দ্বারা গাতাফান গোত্রকে পরস্পর আক্রমণ করা সম্ভব হল না। তার বদলে আরব দৃষ্টিপাত করল সিরিয়া ও ইরাকের উপর।

তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে গনিমতের মাল লাভ করা ছিল মুসলিম সম্প্রদায়কে সুদৃঢ় করার অন্যতম হাতিয়ার। দ্বিতীয় হিজরি সালে মুহাম্মদ নাখলাতে কুরাইশদের মালবাহী কাফেলা আক্রমণ করে প্রচুর মালামাল হস্তগত করেন। ফলে মুসলিমরা নিজেদের একত্রিত শক্তি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পেলেন। এরপর বানু কায়নোকা, বানু কুরাইজার ধনসম্পদও হস্তগত হয় তাঁদের। ফলে মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থা শক্ত ভিত্তি লাভ করে। আরবদের যে গনিমতের মালের প্রতি আকর্ষণ রয়েছে তা কোরানেও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: তোমরা যখন যুদ্ধলব্ধ ধনসম্পদ সংগ্রহের জন্য যাবে তখন যারা ঘরে থেকে গিয়েছিল তারা বলবে, আমাদেরকেও তোমাদের সঙ্গে যেতে দাও।. . (সুরা ফাতাহ আয়াত ১৫) । এই আয়াতে এক বেদুইনের কথা বলা হয়েছে। সেই বেদুইন কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে এবং এক বৃক্ষের তলে (হুদাইবিয়ার সফরের সময়) নবির পক্ষে সর্বদা জীবন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকার অঙ্গীকার নিতে অপরাগ ছিল। পরে যখন নবি খায়বারে ইহুদিদের বিরদ্ধে অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন সেই বেদুইন সংবাদ পেল যে আল্লাহ মুসলিমদেরকে অগাধ গনিমতের মাল লাভের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাই সে নবির অভিযানে যোগ দিতে চাইল। এদিকে গাতাফান গোত্র খায়বারের ইহুদিদের সাথে মিত্রতার চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল। নবি যখন খায়বারে সামরিক অভিযান চালান তখন তিনি গাতাফান গোত্রকে খায়বারের গনিমতের মালের কিছু অংশ দেবার অঙ্গীকার করলেন যাতে তারা ইহুদিদের সাহায্যে এগিয়ে না যায়।

গনিমতের মালের প্রতি আরবদের যে কী অপরিসীম আকর্ষণ ছিল তার প্রচুর বিবরণ পাওয়া যায় হিজরির প্রথম দশকে। এর একটা বিশেষ উদাহরণ দেওয়া হয়েছে তৃতীয় অধ্যায়ে। সেখানে বলা হয়েছে যে, মুহাম্মাদ হাওয়াজেন গোত্র থেকে পাওয়া গনিমতের মাল তাঁর কুরাইশ আত্মীয়দের মাঝে বিতরণ করে দিলেও আনসাররা কিছুই পেল না। ফলে আনসাররা নবির উপর গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এই বিবরণগুলি আরবদের বিশেষ মনোবৃত্তির প্রমাণ দেয়। আর এটাও প্রমাণ করে নবি তাঁর সমাজের লোকদের মানসিকতা খুব ভাল করে বুঝতেন। এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। নবি যেসব পন্থা অবলম্বন করেছিলেন যেমন বাণিজ্য কাফেলায় আক্রমণ, ইহুদিদের উৎখাত করা বা তাদেরকে অধীনস্থ করা, এসবের পিছনে নবির এক উচ্চতর উদ্দেশ্য ছিল। যা আরবদের গনিমতের মালের প্রতি আকাঙ্ক্ষার চেয়ে ভিন্ন ছিল। মুহাম্মদ কেবল একজন ধর্মপ্রচারক নয়, একজন রাষ্ট্রনায়কও ছিলেন। রাষ্ট্রনায়কেরা মনে করেন তাঁদের উদ্দেশ্য সফলের জন্য যা দরকার তাই-ই করতে হবে। মুহামদের উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের বীজ রোপণ করা, আরবদেশ থেকে দুনীতিপরায়ণ পৌত্তলিক, কপটাচারীদের নির্মুল করা, এবং ইসলামের পতাকায় এক সংযুক্ত আরব রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি করা। তাই তাঁর এই সুউচ্চ লক্ষ অর্জনে তিনি যে কোনো পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত ছিলেন।

গনিমতের মাল মুহাম্মদ কখনো ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন না। সে- সময় মুসলিম সমাজ ছিল ছোট। তাই নবি গনিমতের মাল ব্যবহার করে এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নয়নে সচেষ্ট হন। মুহামদ তাঁর অতি সাদাসিধা জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। বানু কুরাইজার বিপুল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার পর নবির স্ত্রীগণও তাঁর কাছ থেকে অধিক ভাতা দাবি করলেন। কিন্তু নবি তাঁর স্ত্রীদের দুটির মধ্যে একটি পছন্দ করতে আহবান করলেন -তাদের বর্তমান ভাতা অথবা বিবাহ বিচ্ছেদ। নবির সহচরেরা তাঁর মতই সাদাসিধে জীবন নির্বাহ করতেন। তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন তাঁর কোনো সহচর লোভের বশবর্তী হননি। নবির মৃত্যুর পর মুসলমানরা অনেক দেশ জয় করেন। ফলে প্রচুর পরিমাণ গনিমতের মাল অর্জিত হয়। তখন নেতৃত্বের অনেকেই ধনদৌলতের প্রতি বশীভূত হন।

দ্বিতীয় খলিফা ওমর গনিমতের মাল বণ্টন কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করতেন। শুধু তাই নয় মুহাজির ও আনসার নেতাদের এবং অন্যান্য সুযোগ্য মদিনাবাসীদের বয়স্ক ভাতা ধার্যের সময়ও ন্যায়-নীতি মেনে চলতেন। সবাইকে নবির পথে রাখার জন্য ওমর নিজেও একান্ত অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। মুক্তক্রীতদাস সালেম ( শুরুর দিকের হাদিস বর্ণনাকারী) এক হাদিসে জানিয়েছেন, খলিফা থাকাকালীন সময়ে ওমরের পাগড়িসহ সমস্ত পোশাক, এবং জুতার মূল্য চোদ দিরহামের বেশি ছিল না। অথচ খলিফা হবার আগে এগুলির মূল্য ছিল চল্লিশ দিনার। ঐতিহাসিক এবং কোরানের তফসিরকারক আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জরির আল তাবারি লিখেছেন যে, ওমরের মিতব্যয়িতা এতোই কঠোর ছিল যে তাঁর শাসনের শেষের দিকে প্রচুর অসন্তোষ সৃষ্টি করে। ওমর তা জানতে পেরে মসজিদের প্রচারবেদি থেকে ঘোষণা করলেন: ‘আমি ইসলামের পরিপালনের জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছি। ইসলাম এখন পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছে। কুরাইশরা এখন চাইছে আল্লাহর দান (গনিমতের মাল) তাঁর ইবাদতকারীদের মুখ থেকে কেড়ে নিতে। আমি এই ব্যাপারে সতর্ক আছি। কুরাইশরা সহজ পথ (ইসলাম) থেকে বিচ্যুত হয়ে নরকের পথে পা বাড়ালে আমি তাদেরকে বাধা দিব। তাবারি আরও বলেছেন যে, খলিফা ওমরের অনুমতি ছাড়া নবির বিশিষ্ট সাহাবিদের পর্যন্ত মদিনার বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। ওমর কখনো অনুমতি দিলেও তা সীমাবদ্ধ থাকত শুধুমাত্র স্বল্পসময়ের জন্য, তাও শুধুমাত্র হেজাজ অঞ্চলে ভ্রমণের জন্য। বিশিষ্ট সাহাবিরা বিজিত দেশে ভ্রমণ করলে মুসলমানরা ভাগ হয়ে যেতে পারে -এই চিন্তা নিয়ে ওমর সর্বদা উদ্বিগ্ন থাকতেন। কখনো কোনো বিশিষ্ট কুরাইশ বিদেশিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করতে চাইলে ওমর বলতেন: নবির সময়ে আপনি যে যুদ্ধে গিয়েছিলেন তাই আপনার জন্য যথেষ্ট। আপনি বিদেশ না দেখলেই ভাল, আর বিদেশিরা আপনাকে না দেখলেই ভাল।”

খলিফা ওমরের কঠোরতা প্রসঙ্গে মিশরীয় লেখক তাহা হোসেন তাঁর ‘ফেৎনাত আল কুবরা (২য় খণ্ড, কায়রো ১৯৪৭ এবং ১৯৫৩) বইয়ে লিখেছেন : ‘ক্ষমতা ও মুনাফার উপর কুরাইশদের প্রবল লোলুপতা ছিল। কুরাইশদের এই গোষ্ঠীগত মনোভাব খলিফা ওমর ভাল করে জানতেন। তাই ওমর কুরাইশদেরকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। সে-সময় কাবা ছিল আরবদের মূর্তিপূজা এবং তীর্থযাত্রার প্রধান কেন্দ্র। কুরাইশদের উপর ন্যস্ত ছিল কাবাঘর ও তীর্থযাত্রীদের দেখাশোনার ভার। এটাই একমাত্র কারণ যে, কুরাইশরা তাদের গোত্রের আভিজাত্যের দাবিদার ছিল। অর্থাৎ আরবদের ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় আচার, প্রথা-রীতিনীতির সুযোগ নিয়ে কুরাইশরা গোটা আরবের মধ্যে সবচেয়ে ধনী হয়ে উঠে। কুরাইশদের সৌভাগ্য যে, ধর্মীয় কারণে মক্কা এবং এর প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল নিরাপদ। তাই কুরাইশরা পূর্ণভাবে বাণিজ্যে মনোনিবেশ করতে পারতেন। তারা হেজাজের সবচেয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। কুরাইশরা ছিল ওমরের গোত্রের লোক। তাই ওমরও জানতেন কুরাইশদের সব আভিজাত্য, সমান এবং ধনদৌলত সব কিছুর পিছনে রয়েছে ছিল কাবা ও এর মূর্তিগুলো। তা না হলে কুরাইশরা কোনোদিনই মূর্তি পূজা করত না। ওমর আরও জানতেন কুরাইশরা স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেননি। মক্কা বিজয়ের পর নবি তাদের উপর ইসলাম চাপিয়ে দিয়েছিলেন। কুরাইশরা মুসলমানদের ভয়ে পেত। তাছাড়া কুরাইশরা জানত যে, দীর্ঘদিনের বংশের ঐতিহ্য ভেঙে ইসলাম গ্রহণ তাদের জন্য এক ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল। সেজন্যে ওমর ভাবলেন এই ধনসম্পদ লোলুপ সুযোগ-সন্ধানীদের যথেচ্ছার ভার দেওয়া বিপদজনক হবে।

ওমর যে আসলেই বিচক্ষণ ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর মৃত্যুর পর অনেক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। ওমরের উইলে লিখে গিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পরে যিনি খলিফা হবেন তিনি যেন ওমর নিয়োগকৃত শাসনকর্তাদের এক বছর তাদের পদে বহাল রাখেন। উসমান ওমরের ইচ্ছা পালন করলেন। এক বছর পর উসমান সরকারি পদগুলি থেকে নিয়োগকৃতদের রদবদল করেন। শাসনের শুরু হতেই উসমান মুহাজির ও আনসারদের সরকারি কোষাগার থেকে প্রচুর টাকা পয়সা দেয়া শুরু করেন। একবার উসমান বয়স্ক ভাতা শতকরা একশ ভাগ বাড়িয়ে দিলেন। উসমান ছিলেন তৃতীয় খলিফা। পূর্বগামীদের অনুরূপ ব্যক্তিগতভাবে উসমান সাধারণ জীবন নির্বাহ করতেন। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে উসমান কখনো সরকারি তহবিল তছরুপ করেননি। কিন্তু তিনি অযোগ্য ব্যক্তিদের অনেক দান, উপহার দিয়েছিলেন। এ কারণে অনেকের মাঝে পরশ্রীকাতরতা এবং লোভের জন্ম হয়, বাতিল হয়ে যায় আত্মসংযমী হবার প্রয়াস।

পূর্বেই বলা হয়েছে খলিফা ওমর অতি সাধারণ পোশাক পরিধান করতেন এবং সাধাসিধে জীবনযাপন করতেন। ইসলামের ইতিহাসে ওমর ছিলেন অন্যতম শক্তিশালী খলিফা। তিনি ছিলেন সর্বপ্রথম খলিফা যার উপাধি ছিল বিশ্বাসীদের নৃপতি’। আলিও ছিলেন কঠোর আত্মসংযমী ব্যক্তি। এ-ব্যাপারে আলির শক্রমিত্র উভয়েই একমত। আলির পোশাক ভর্তি ছিল তালিতে। বার বার তাঁর পোশাক সেলাইয়ের জন্যে আলি তাঁর দর্জির কাছে লজ্জিত থাকতেন। একবার আলির ভাই আকিল তাঁর ঋণ পরিশোধের জন্য আলিকে অনুরোধ করলেন সরকারি তহবিল থেকে টাকা দিতে। আলি কঠোরভাবে তিরস্কার করলেন আকিলকে। পরে আকিল চলে যান আলির প্রতিপক্ষ মুয়াবিয়ার কাছে। এ- ঘটনা থেকে বুঝা যায় আরবদের মানসিকতায় আর্থিক বিষয় কত গুরুত্বপূর্ণ।

এ- প্রসঙ্গে নবির অন্যতম প্রসিদ্ধ সাহাবি সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা দরকার। মক্কায় নবুওতির প্রথম দিকে সাদ ইসলাম গ্রহণ করেন। নবি যে দশজনকে বেহেশতের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন সাদ ছিলেন তাঁদের একজন। হিজরি ১৬ সালে (৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ) ওমরের খেলাফতে সাদ কুদসিয়ার যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন এবং ইরানিদের পরাজিত করে তাদের রাজধানী কুটাসফন (অথবা তাসিবন) দখল করে নেন। এই জন্য সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসকে ইসলামের বীর উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এরপর সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস কুফার প্রথম শাসক নিয়োজিত হন। হিজরি ২৩ (৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ) সালে ওমরের মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ওমর নতুন খলিফা মনোনীত করার জন্য যে ছয় সদস্য বিশিষ্ট পরিষদ গঠন করেন তাতে সাদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর ফলে সাদও নতুন খলিফার জন্য একজন প্রার্থী হয়ে যান। হিজরি ৫৫ (৬৭৪-৫ খ্রিস্টাব্দ) সালে সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস মদিনা শহরের নিকটবর্তী আল-আকিক উপত্যকায় অবস্থিত তাঁর বিশাল বাসভবনে মারা যান। মৃত্যুকালে তিনি প্রচুর ধনসম্পত্তি রেখে যান যার পরিমাণ ছিল আনুমানিক দুই থেকে তিন লক্ষ দিরহাম।

সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসের পুত্র ওমর বিন সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসের কথাও বাদ দেয়া যায় না। হিজরি ৬১ সালে (৬৮১ খ্রিস্টাব্দ) ইরাকের শাসনকর্তা ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ, ওমর বিন সাদ বিন ওয়াক্কাসকে এক শর্তে ইরানের রায়ি অঞ্চলের শাসনকর্তা নিয়োগের প্রস্তাব দেন। শর্ত ছিল প্রথমে ওমর বিন সাদকে এক অভিযানের নেতৃত্ব দিতে হবে যাতে তিনি হোসেন বিন আলিকে ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার খেলাফত স্বীকার করাতে বাধ্য করেন। হোসেন এতে রাজি না হলে তার পরিণতি হোসেনকে বহন করতে হবে। অর্থাৎ হোসেনকে মেরে ফেলতে হবে। প্রথমে ওমর বিন সাদ এই শর্ত মানতে রাজি হলেন না। এক রাতে ওমর বিন সাদ তাঁর আত্মীয়দের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর আত্মীয়রা একমত হলেন তাঁর উচিত হবে না নবির দৌহিত্রের সাথে যুদ্ধ করা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ সফল হলেন। ওমর বিন সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস হোসেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাত্রা করলেন। যখন ওমর বিন সাদ হোসেনের সম্মুখীন হলেন তখন তিনি চাইলেন হোসেনের সাথে আপোষ করে নিতে। তিনদিন ধরে ওমর বিন সাদ হোসেনের সাথে কথাবার্তা চালিয়ে বোঝাতে চাইলেন হোসেন যেন আত্মসমর্পণ করে ইয়াজিদের প্রতি তাঁর আনুগত্য ঘোষণা করেন। এই দীর্ঘস্থায়ী আলোচনার কথা শুনে ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ভাবলেন ওমর বিন সাদ হয়ত হোসেনের ইসলামি ভাবাবেগে পড়ে যাবেন এবং তাঁর পক্ষে চলে যাবেন।

সে- জন্য ওবায়দুল্লাহ তাঁর সামরিক কর্মকর্তা শেমর বিন দিল- জোওশানকে বার্তা পাঠালেন যে, ওমর বিন সাদ যদি গড়িমসি চালাতে থাকেন তবে তিনি যেন সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে নেন। এই খবর শোনা মাত্র ওমর বিন সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস ভুলে গেলেন ইসলামের জন্য তাঁর পিতার অবদানের কথা। তিনিই হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি নবির নাতিকে লক্ষ্য করে তীর ছুড়ে মারেন। ধর্ম, সমান এবং নৈতিকতার চেয়ে ওমর বিন সাদের কাছে প্রাধান্য তালহা বিন ওবায়দুল্লাহ ছিলেন নবির অন্যতম সাহাবি। যে দশ জন সহচরকে নবি বেহেশতের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন তালহাও তাঁদের অন্যতম। খলিফা ওমর যে ছয় সদস্যের পরিষদ গঠন করেছিলেন তালহাও তাতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আবার তালহা নিজেই খলিফা পদের প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু তালহা মদিনার বাহিরে থাকায় পরিষদের সভায় যোগ দিতে পারেননি। ফলে তালহার মতামত না জেনেই পরিষদ খলিফার মনোনয়ন দিয়ে দেন। মদিনায় ফিরে আসার পর তালহা খলিফার ব্যাপারে অনীহা দেখালেন এবং উসমানের প্রতি তাঁর আনুগত্য জানাতে অস্বীকার করলেন। শেষে উসমান ব্যক্তিগতভাবে তালহার বাসগৃহে যান এবং খলিফার পদ ছেড়ে দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তালহা বিব্রতবোধ করলেন এবং উসমানকে তাঁর আনুগত্য দিয়ে দিলেন। পুরস্কারস্বরূপ উসমান সরকারি তহবিল থেকে তালহাকে ৫০ হাজার দিরহাম দিয়ে দিলেন এবং জানিয়ে দিলেন এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে না। এরপর থেকে তালহা হয়ে গেলেন উসমানের কাছের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এরপরও তালহা উসমানের সাহায্যে আরও অনেক অর্থের লেনদেন করেন। যেমন একবার তালহা ইরাকের কিছু জমি বিনিময় করতে চাইলেন হেজাজ অথবা মিশরের সাথে। উসমান সাথে সাথে তৈরি হয়ে গেলেন তাঁর শাসিত ইসলামি সাম্রাজ্যের যে কোনো স্থানে উচ্চপদস্থ কর্মচারী পাঠিয়ে দিতে যাতে তালহা যা চান তা পেয়ে যান। এ- ব্যাপারে অনেকে অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। প্রথমে তালহা উসমানকে সমর্থন জানালেন। যখন অসন্তোষের কণ্ঠ উচ্চ হতে লাগল তখন তালহা বিচক্ষণতার পরিচয় দিলেন নিজের জিহবা সংবরণ করে। যখন বিদ্রোহীরা উসমানের গৃহ অবরোধ করে ফেলে তখন তালহা তাড়াতাড়ি বিদ্রোহীদের পক্ষ নিলেন। হিজরি ৩৬ (৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ) সালে জামালের যুদ্ধে (উটের যুদ্ধ) তালহা নিহত হন। একটি তথ্য অনুযায়ী উসমানের চাচাত ভাই মারোয়ান বিন আল-হাকাম এক তীর নিক্ষেপ করে তালহাকে হত্যা করেন। এরপর মারোয়ান বিন আল-হাকাম বলেন, উসমানের খুনের প্রতিশোধের জন্য তালহার রক্তই যথেষ্ট।’ (মারোয়ান ছিলেন আলির বিপক্ষে। হিজরি ৬৪ (৬৮৪-৮৫ খ্রিস্টাব্দ) সালে মারোয়ান উমাইয়া খলিফা নিযুক্ত হন।) উল্লেখ্য তালহা যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তিনি মোটেও অর্থবিত্তের মালিক ছিলেন না। ওমরের সময়ও তালহা মধ্যবিত্ত পর্যায়ের ছিলেন। কিন্তু মৃত্যুকালে তাঁর সম্পত্তির মূল্য ছিল ত্রিশ লক্ষ দিরহাম। এর মধ্যে নগদ ছিল ২ লক্ষ দিনার আর বাকি ছিল দালানকোটা, কৃষিভূমি, ও অস্থাবর সম্পত্তি। ইবনে সাদে তাবাকাত গ্রন্থের বর্ণনায়, তালহার নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ১০০টি চামড়ার বস্তা, প্রত্যেক বস্তায় ছিল ১০০ কিলোগ্রাম বিশুদ্ধ স্বর্ণ।

ওমরের উত্তরাধিকার নিয়োগের জন্য যে ছয়জনকে মনোনীত করা হয়েছিল তাদের মধ্যে আরও একজন ছিলেন জুবায়ের বিন আল- আওয়াম। তিনি নবির ফুফুর পুত্র। এছাড়াও নবির সাথে তাঁর অন্য আত্মীয়তাও ছিল। জুবায়ের বিন আল- আওয়াম ছিলেন প্রথম দিকের ইসলাম গ্রহণকারী। তিনিও সেই দশজনের একজন, যাকে বেহেশতের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল। জুবায়ের নবির সঙ্গে অনেকগুলি যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন। নবি জুবায়েরকে আখ্যা দিয়েছিলেন আমার শিষ্য। তাই তিনি ছিলেন নবির সাহবিদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত। অনেকে বলেন যে ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমান জুবায়েরকে সরকারি তহবিল থেকে ছয় লক্ষ দিরহাম দেন। জুবায়ের ভেবে পেলেন না এত বিপুল অর্থ দিয়ে তিনি কি করবেন? তাঁর বন্ধুরা যা পরামর্শ দিলেন জুবায়ের তাই-ই করলেন। বিভিন্ন নগরীর আশেপাশে তিনি অনেক বাড়ি, কৃষিজমি ক্রয় করেন। তাঁর মৃত্যুকালে ফোসতাত (পরবর্তীকালে কায়রো) , আলেকজান্দ্রিয়া, বসরা, কুফায় প্রচুর ভূ-সম্পত্তির মালিক বনে যান। মদিনাতে জুবায়ের এগারটি বাড়ির মালিক ছিলেন এবং এই বাড়িগুলি ভাড়া দিয়ে দেন। অনুমান করা হয় তাঁর সমগ্র ভূ-সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৩৫, ২০০, ০০০ থেকে ৫২, ০০০, ০০০ দিরহাম। ইবনে সাদ তাঁর তাবাকাত বইয়ে লিখেছেন জুবায়ের অত্যন্ত ধাৰ্মিক ছিলেন। তিনি কারো কাছ থেকে কোনো কিছু গচ্ছিত রাখতে চাইতেন না। তাঁর ভয় ছিল যে কোনো মুহুর্তে তিনি চরম দুর্দশায় পতিত হতে পারেন। ফলে ওইসব গচ্ছিত মাল বা ধনসম্পদ হারিয়ে যেতে পারে অথবা নষ্ট হতে পারে। কিন্তু কেউ তাঁকে ঋণ দিলে তা গ্রহণ করতেন। এবং সেই অর্থ নিজের মনে করে লাভজনক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতেন। তবে শর্ত ছিল তিনি মারা গেলে ওইসব ঋণের অর্থ তাঁর উত্তরাধিকারীরা পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবেন। সত্যি বলতে মৃত্যুকালে তিনি প্রায় বিশ লক্ষ দিরহাম ঋণ রেখে যান যা তাঁর পুত্ররা পরিশোধ করে দেন।

আব্দুর রহমান বিন আউফ নবির আরেকজন নিকটতম সাহাবি। তিনিও দশজনের মধ্যে একজন যে বেহেশতের নিশ্চয়তা পেয়েছিলেন নবির কাছ থেকে। এই সাহাবি অতিশয় বিচক্ষণ, অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী এবং খলিফা আবু বকর ও খলিফা ওমরের বিশ্বস্ত উপদেষ্টা। খলিফা নির্বাচনের জন্য ওমরের ছয় সদস্য বিশিষ্ট কমিটির একজন তিনি। আব্দুর রহমান কখন দারিদ্রতা দেখেননি। তাই বদান্যতায় ছিলেন সর্বাগ্রে। তিনি যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ-সম্পত্তি রেখে যান তা কোনোক্রমেই শুধুমাত্র মদিনার বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্য দ্বারা অর্জন করা সম্ভব ছিল না। মৃত্যুকালে তিনি চারজন স্ত্রী রেখে যান। প্রত্যেক স্ত্রী পান ৫০ হাজার স্বর্ণের দিনার, ১ হাজারটি উট এবং ৩ হাজার মেষ। আব্দুর রহমান উইলে তাঁর স্ত্রীদেরকে এই ধনসম্পদ আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার নির্দেশ দিয়ে যান। খলিফা উসমানের আমলে হাকাম বিন হিজামের মতো গুণসম্পন্ন ব্যক্তি খুব কম ছিলেন। তিনি সরকারি তহবিল থেকে এক কপর্দকও নিতেন না। যখন সরকারি কোষাগার থেকে মুহাজির এবং আনসারদের মাঝে বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করা হলো তখন তিনি সে ভাতা নিতে অস্বীকার করলেন।

আবুজর গিফারি* প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণ করে নবির ঘনিষ্ঠ সাহাবি হয়ে যান। গিফারি অতিশয় ধাৰ্মিক এবং কঠোর আত্মসংযমী বলে পরিচিত ছিলেন। অনেক হাদিসেরও বর্ণনাকারী। তিনি প্রায়ই বলতেন, সুরা তওবার ৩৪ আয়াতে যে বলা হয়েছে: . . . যারা সোনা ও রুপা জমা করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদেরকে মারাত্মক শাস্তির খবর দাও। (৯:৩৪) । এই আদেশ দেয়া হয়েছে সমগ্র মুসলিম সমাজকে যেন তারা সম্পদ কুক্ষিগত না করে তা দান করে দেয়। আবুজর গিফারি সিরিয়াতে থাকাকালীন শাসনকর্তা মুয়াবিয়াকে কোরানের ওই আদেশ লঙ্ঘন করার জন্য ভর্ৎসনা করেন। শাস্তিস্বরূপ মুয়াবিয়া আবুজরকে সিরিয়া থেকে নির্বাসিত করে হেজাজে পাঠিয়ে দেন। মদিনাতে এসে আবুজর একই কথা বললেন। ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমান তা শুনে আবুজরকে প্রহার করলেন এবং মদিনা থেকে বহিষ্কার করে দিলেন।

যাহোক এটা সত্যি যে, নবির কিছুসংখ্যক সাহাবি ধনসম্পত্তির লোভ সংবরণ করতে না পেরে তা হাসিল করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যান। অবস্থা এমন হয়ে উঠে যে, অদক্ষ এবং যারা নবি বা খলিফার সাথে জড়িত ছিল না তারাও পর্যন্ত নানা পন্থা অবলম্বন করে টাকা বানাতে লাগলেন। কথিত আছে জান্নাব নামে একজন দিনমুজুর মক্কায় বার্তাবাহক ভৃত্য হিসেবে কাজ করতেন, তিনিও কুফায় মৃত্যুকালে নগদ ৪০ হাজার দিরহাম রেখে যান।

যুদ্ধে যোগদানকারীরা গনিমতের মালের ভাগ পেয়ে এবং পরে বয়স্ক ভাতা পেয়ে অনেকে ধনী হয়ে যায়। যেসব অশ্বারোহী সৈনিক ইফ্রিকিয়ায় (বর্তমানে তিউনিসিয়া) আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবি সারাহের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছিল তারা প্রত্যেকে ৩ হাজার মিথকাল (১ মিথকাল ৪, ৭ গ্রামের সমান) পরিমাণ বিশুদ্ধ স্বর্ণ পায়। একজন পদাতিক সৈন্য পায় ১ হাজার মিথকাল।

ইসলামের ইতিহাসের প্রাথমিক যুগের এইসব অজস্র নির্ভরযোগ্য উদাহরণে এটা পরিষ্কার হয়ে আসে যে, গনিমতের মালের ভাগ পাওয়া, অন্যের ভূমি জোরপূর্বক দখল করা, এবং অন্যের নারীদের অপহরণ করে তাদের দাসী বানিয়ে রাখা-এসবই ছিল আরব যোদ্ধাদের জন্য বড় আকর্ষণ। এজন্য তাদের সাহসের কোনো অভাব ছিল না। নির্মমতা দেখাতেও তারা কোনোপ্রকার কুষ্ঠা বোধ করতেন না। নবির আদর্শ, আদেশ-নিষেধকে অগ্রাহ্য করে ইসলামের ছত্রছায়ায় থেকে তাঁরা ক্ষমতা, ধনদৌলত, প্রভাবপ্রতিপত্তি হাসিলে ব্যস্ত ছিলেন। তারা ভুলে গেলেন ইসলামের সেই মহান বাণী, কোরানে যেমন বলা হয়েছে : “তোমাদের মধ্যে সে-ই আল্লাহর কাছে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন যে বেশি পরহেজগার। (সুরা হুজুরাত ; আয়াত ১৩)। তবে এই ধরনের অসদাচরণের প্রতিক্রিয়াও অচিরেই শুরু হয়ে যায়। বিদেশিরা, বিশেষ করে ইরানিরা এই ধরনের অনৈতিক আচরণ- অত্যাচার মানতে চাইল না। তারা ইসলামের আধ্যাত্মিক এবং দয়ালু নীতিগুলো গ্রহণ করে। কিন্তু আরবদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের দাবি মানতে অস্বীকার করে। ইরানিরা আরবদের শোষণের স্বীকার হতে চাইল না। আরবদের জাত্যাভিমান আর শ্রেষ্ঠত্বের দাবির উত্তরে ইরানিরা তাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শোবিয়া গড়ে তুলে। এমন কী অনেকে ইসলামের বিরুদ্ধে (জিদিক) গিয়ে ধর্মবিরোধী হয়ে যান।

এই বইয়ের লেখক মিশর থেকে প্রকাশিত Al-zandaga wa-l-suʼubiyya fi-l-ʼasr al-“Abbasi al-awwat শিরোনামের একটি বই পড়েছিলেন। বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। তিনি সেখানে দাবি করেন, ইরানিদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (শোবিয়া) পুরোপুরি ইসলামি নীতি- আর্দশের বিরোধী। এটি ধর্মবিরোধী। কিন্তু বইটিতে দেখানো হয়নি যে আরবেরাও কোরান লঙ্ঘন করেছে। অন্তত এই আয়াতটি : ‘আল্লাহ অবশ্যই ন্যায়পরায়ণতা, সদাচারণ ও আত্মীয়স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন। আর তিনি অশ্লীলতা, অসৎকর্ম ও সীমালঙ্ঘন নিষেধ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।” (সুরা নাহল : আয়াত ৯০) ।

যেসব খলিফাকে বিশ্বাসীদের নৃপতি (আমিরুল মুমেনিন) উপাধি দেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে অনেকেই এতো ভ্রষ্টাচারী ছিলেন যে, কথিত আছে তারা মদের নদী’তে স্নান করতেন। নবি তাঁর মহান আদর্শ সততা এবং উৎকর্ষতাকে মানবতার মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এই খলিফারা নবির সেই মহত্ত্বের প্রতি কোনো ভ্ৰক্ষেপই করেননি। উমাইয়া খলিফারা অনারব মুসলমানদের উপর আরব মুসলমানদের কর্তৃত্ব এবং অন্য আরবদের উপর উমাইয়া গোত্রের আরবদের কর্তৃত্ব বহাল রাখতে সচেষ্ট থাকলেন।

আলি ছিলেন নবির সহচরদের মধ্যে অন্যতম ধর্মপ্রাণ এবং জ্ঞানী ব্যক্তি। তথাপি এই বিশ্বাসীদের শাহজাদা’রা মসজিদের প্রচারবেদি থেকে আলি বিন আবু তালিবের মৃত্যুর পরও তাঁকে নিয়ে গালিগালাজসহ কটুক্তি করতেন। বিশিষ্ট পণ্ডিত আব্দুল্লাহ বিন আল- আব্বাস ছিলেন নবির চাচাতো ভাই। আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসের বংশধর ছিলেন খলিফা মুতাওয়াক্কিল (২৩২- ২৪৭ হিজরি; ৮৪৭- ৮৬১ খ্রিস্টাব্দ) । নিজের দরবারে উপস্থিত গণ্যমান্যদের চিত্তবিনোদনের জন্য তিনি এক ভাঁড়কে নিয়োজিত করলেন যে আলির বেশ ধারণ করে নর্তন- কুর্দন করতো। এছাড়াও খলিফা মুতাওয়াক্কিল নবির নাতি হোসেন বিন আলির সমাধিতে লাঙ্গল চালিয়ে দেন এবং সেচ করতে থাকেন যাতে করে ওই সমাধির কোনো চিহ্ন পাওয়া না যায়; লোকজনের মন থেকে যেন নবির দৌহিত্রের স্মৃতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তাই ইরানিরা সঠিকভাবেই বিবেচনা করেছিল যে যারা এতো অসচ্চরিত্র এবং নবির আদর্শের প্রতি সীমাহীন উদাসীন তারা কোনোক্রমেই বিশ্বাসীদের শাহজাদা বা নৃপতি (আমিরুল মুমেনিন) খেতাবে ভূষিত হতে পারেন না।

 

——————-

পাদটীকা

৮৮. ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমরকে ২৬ জুলহজ হিজরি ২৩ (৩ নভেম্বর ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ) সালে আৰু লুলু ছুরিকাহত করেন। আবু লুলু ছিলেন একজন ইরানি ক্রীতদাস। অনেক ঐতিহাসিক তাকে খ্রিস্টান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে ওমর এক পরিষদ গঠন করেন খলিফা নির্বাচনের জন্য। এই পরিষদ উসমানকে ওমরের পরবর্তী উত্তরাধিকারী মনোনীত করে।

৮৯. আবুজর গিফারি নবি মুহাম্মদের ধর্মপ্রচারের শুরুর দিকে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি একজন কঠোর তপস্বী, সমালোচক এবং হাদিস- বর্ণনাকারী। উসমানের খেলাফতের সময় সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়া তাঁকে সিরিয়া থেকে বহিষ্কার করেন। আবুজর গিফারি হিজরি ৩২ সালে (৬৫২ খ্রিস্টাব্দ) সালে মারা যান। আবুজর গিফারি, আল মিকদাদ বিন আমর, এবং সালমান আল ফার্সিদেরকে প্রথমদিককার শিয়া’ বলা হয়।

৯০. আমার বিন ইয়াসিরও ধর্মপ্রচারের শুরুর দিকেই ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি নবির সাথে অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। খলিফা ওমরের সময় তিনি কুফার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন এবং খুজিস্থান দখলে অনেক অবদান রাখেন। খলিফা উসমান তাঁকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করেন। নবির স্ত্রী আয়েশার বিরুদ্ধে জামালের যুদ্ধে আমার বিন ইয়াসির খলিফা আলির পক্ষে লড়াই করেন। তবে সিফিফনের যুদ্ধে আলির পক্ষ নিয়ে লড়াই করার সময় মৃত্যুবরণ

করেন।

৯১. আরবি ভাষায় প্রাক-ইসলামি যুগ থেকে ইব্রাহিম আল মুয়াসেলির সময়কালের কবিতার সংকলন- গ্রন্থ। আব্বাসিয়া খলিফা হারুন আল-রশিদের আমলে ইব্রাহিম আল মুয়াসেলি ছিলেন রাজসভার সংগীতবিশারদ (হিজরি ১৭০ বা ৭৮৬ খ্রিস্টাব্দ-হিজরি ১৯৩ বা ৮০৯ খ্রিস্টাব্দ) । গ্রন্থটির সংকলক ছিলেন আবুল ফরজ আলি আল-ইসফাহানি (হিজরি ২৮৪ বা ৮৯৭ খ্রিস্টাব্দ-হিজরি ৩৫৬ বা ৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ) উমাইয়া বংশের আরব। বসবাস করতেন পারস্যের ইসফাহানে।

৯২. ফার্সি শব্দ খাসরাও- এর আরবি উচ্চারণ হচ্ছে খসরু। এটি ইরানের এক রূপকথার রাজার নাম ছিল। পরবর্তীতে এই নামের দুজন সাসানিদ সম্রাট পারস্য শাসন করেন। প্রথমজন খসরু- ১ অনুশিরবন (৫৩১- ৫৭৯ খ্রিস্টাব্দ) এবং দ্বিতীয়জন খসরু- ২ পারভেজ (৫৯১-৬২৮ খ্রিস্টাব্দ) ।

৯৩. আব্দুল্লাহ বিন কুতায়বা (হিজরি ২১৩ বা ৮২৮ খ্রিস্টাব্দ-হিজরি ২৭৬ বা ৮৮৯ খ্রিস্টাব্দ) ইরানি বংশোদ্ভূত। তিনি সরকারি কাজে নিয়োজিত ছিলেন বাগদাদে। সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর রচিত আইন আল-আকবর আধ্যাত্মিক সত্য কাহিনির এবং কবিতার সংকলন। এ ছাড়াও এই গ্রন্থে আছে সচিবসংক্রান্ত কলাবিদ্যা ও অন্যান্য আরবি রচনা।

৯৪. তাহা হোসেন (১৮৮৯- ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ) শৈশবকাল থেকে অন্ধ ছিলেন। কোরান অধ্যয়ন করেন মাদ্রাসা থেকে। পরে মিশরের আল-আজহার ধর্মীয় কলেজে পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে ফ্রান্সে পড়াশোনা করতে যান এবং প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর ডক্টরেট গবেষণার শিরোনাম ছিল : “La philosophie Sociale d’Ibn | প্রাক-ইসলামি যুগের কবিতার উপর তাহা হোসেনের পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা কায়রো থেকে প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে নামে। দীর্ঘ বিতর্কের মধ্য দিয়ে কায়রো দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় নবি মুহাম্মদের জীবনী (Ala laimeshes-sira) ১৯৩৩ এবং ১৯৩৮ সালে। এই জীবনীগ্রন্থটিই তাহা হোসেনের অতিগুরুত্বপূর্ণ কাজ। মিশরীয় জাতীয়তাবাদে তিনি উদারনীতির অনুসারী ছিলেন। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত মিশরীয় সংস্কৃতির ভবিষ্যত (Mosaqbal oth-headfa#Mer) নামের বইয়ে তাহা হোসেন মিশরের সাথে ভূমধ্যসাগরীয় অন্যান্য দেশের সহযোগিতার আহ্বান জানান। ১৯৫০ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৫২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি মিশরের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। সর্বোপরি তাঁকে সারণ করা হয় মাদ্রাসায় থাকাকালীন সময়ে কোরান অধ্যয়ন ও আজহার মহাবিদ্যালয়ে তাঁর ছাত্রজীবনের দিনগুলির উপর ভিত্তি করে আল আয়াম গ্রন্থের জন্য। কায়রো থেকে ২ খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯২৯ ও ১৯৩৯ সালে। ইংরেজিতে প্রথম খণ্ডের অনুবাদক E H. Paxon এবং বইটির শিরোনাম An Egyptian Childhood প্রকাশিত হয়েছে ১৯৩২ সালে লন্ডন থেকে। দ্বিতীয় খণ্ডের অনুবাদক H Wayment, প্রকাশিত হয়েছে ১৯৪৮ সালে লন্ডন থেকে। বইটির শিরোনাম The Stream of Days

৯৫. দ্রষ্টব্য ; পাদটীকা ৮৯।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *