৫.১২.২ ঠাকুরের শ্যামপুকুরে অবস্থান ( দ্বিতীয় পাদ)

পঞ্চম খণ্ড – দ্বাদশ অধ্যায় – দ্বিতীয় পাদ: ঠাকুরের শ্যামপুকুরে অবস্থান

গৃহী ভক্তগণের সেবার ভার গ্রহণ ও ঠাকুরের ভিতর মধ্যে মধ্যে অপূর্ব আধ্যাত্মিক প্রকাশ দেখা

        ঔষধ, পথ্য ও দিবারাত্র সেবার পূর্বোক্তভাবে বন্দোবস্ত হইবার পরে ভক্তগণ নিশ্চিন্ত হইয়াছিলেন, একথা বলিতে পারা যায় না। কারণ, কলিকাতার প্রসিদ্ধ চিকিৎসকগণের মতামত গ্রহণপূর্বক তাঁহারা স্পষ্ট হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন, ঠাকুরের কণ্ঠরোগ এককালে চিকিৎসার অসাধ্য না হইলেও বিশেষ কষ্টসাধ্য সন্দেহ নাই এবং তাহার আরোগ্য হওয়া দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ। সুতরাং শেষ পর্যন্ত সেবা চালাইবার ব্যয় কিরূপে নিৰ্বাহ হইবে, ইহাই এখন তাহাদিগের চিন্তার বিষয় হইয়াছিল। ঐরূপ হইবারই কথা—কারণ বলরাম, সুরেন্দ্র, রামচন্দ্র, গিরিশচন্দ্র, মহেন্দ্রনাথ প্রভৃতি যাহারা ঠাকুরকে কলিকাতায় আনিয়া চিকিৎসাদির ভার লইয়াছিলেন, তাহারা কেহই ধনী ছিলেন না। নিজ পরিবারবর্গের ভরণপোষণ নিৰ্বাহপূর্বক সেবকগণের সহিত ঠাকুরের ভার একাকী বহন করেন, এরূপ সামর্থ্য তাহাদিগের কাহারও ছিল না। ঠাকুরের অসাধারণ অলৌকিকত্ব তাহাদিগের প্রাণে যে দিব্য আশা, আলোক, আনন্দ ও শান্তির ধারা প্রবাহিত করিয়াছিল, কেবলমাত্র তাহারই প্রেরণায় তাঁহারা ভবিষ্যতের দিকে কিছুমাত্র দৃষ্টিপাত না করিয়া ঐ কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। কিন্তু ঐ পূতধারা যে সর্বক্ষণ একটানে বহিতে থাকিবে এবং ভবিষ্যতের ভাবনা উহার ভাটার সময়ে তাহাদিগকে বিকল করিবে না, একথা বলিতে যাওয়া নিতান্ত অস্বাভাবিক। ফলে ঐরূপ হয়ও নাই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ঐরূপ সময় উপস্থিত হইলেই তাহারা ঠাকুরের ভিতরে এমন নবীন আধ্যাত্মিক প্রকাশসকল দেখিতে পাইতেন যে, ঐ দুর্ভাবনা কোথায় বিলীন হইয়া যাইত এবং তাহাদিগের অন্তর পুনরায় নূতন উৎসাহ ও বলে পূর্ণ হইয়া উঠিত। তখন আনন্দের উদ্দাম উল্লাসে যেন বিচারবুদ্ধির অতীত ভূমিতে আরোহণপূর্বক তাহারা দিবালোকে দেখিতে পাইতেন যে, যাহাকে তাঁহারা জীবনপথের পরম অবলম্বন স্বরূপে গ্রহণ করিয়াছেন, তিনি কেবলমাত্র অতিমানব নহেন কিন্তু আধ্যাত্মিক জগতের আশ্রয়, জীবকুলের পরমগতি-দেবমানব নারায়ণ! তাহার জন্ম, কৰ্ম্ম, তপস্যা, আহার, বিহার—এমন কি দেহের অসুস্থতা-নিবন্ধন যন্ত্রণাভোগ পর্যন্ত সকলই বিশ্বমানবের কল্যাণের নিমিত্ত। নতুবা জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধি-দুঃখ-দোষাদির অতীত সত্যসঙ্কল্প পুরুষোত্তমের দেহের অসুস্থতা কোথায়? সেবাধিকার প্রদানপূর্বক তাহাদিগকে ধন্য ও কৃতকৃতার্থ করিবেন বলিয়াই তিনি অধুনা ব্যাধিগ্রস্তের ন্যায় অবস্থান করিতেছেন! দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত গমন করিয়া যাহাদিগের তাহাকে দর্শন করিবার অবসর ও সুযোগ নাই, তাঁহাদিগের প্রাণে দিবালোকের উন্মেষ উপস্থিত করিবার জন্যই তিনি সম্প্রতি তাহাদিগের নিকটে আসিয়া অবস্থান করিতেছেন! পাশ্চাত্য শিক্ষাসম্পন্ন জড়বাদী মানব, যে বিজ্ঞানের ছায়ায় দাঁড়াইয়া আপনাকে নিরাপদ ও সর্বজ্ঞপ্রায় ভাবিয়া ভোগবাসনার তৃপ্তিসাধনকেই জীবনের লক্ষ্য করিতেছে, ঈশ্বরসাক্ষাৎকাররূপ দিব্য বিজ্ঞানের উচ্চতর আলোকে উহার অকিঞ্চিৎকর প্রতিপাদনপূর্বক তাহার জীবন ত্যাগের পথে প্রবর্তিত করিবার জন্যই তিনি এখন ঐরূপ হইয়া রহিয়াছেন!–তবে কেন এই আশঙ্কা, অর্থাভাব হইবে বলিয়া কি জন্য দুর্ভাবনা? যিনি সেবাধিকার প্রদান করিয়াছেন, উহা সম্পূর্ণ করিবার সামর্থ্য তিনিই তাহাদিগকে প্রদান করিবেন।

গৃহী ভক্তগণের ঠাকুরের জন্য স্বার্থত্যাগের কথা

ভাবুকতার উচ্ছ্বাসে অতিরঞ্জিত করিয়া আমরা উপরোক্ত কথাগুলি বলিতেছি, পাঠক যেন ইহা মনে না করেন। ঠাকুরের সঙ্গগুণে ভক্তগণকে ঐরূপ অনুভব ও আলোচনা করিতে নিত্য প্রত্যক্ষ করিয়াছি বলিয়াই আমাদিগকে ঐ সকল কথা লিপিবদ্ধ করিতে হইতেছে। দেখিয়াছি, অর্থাভাববশতঃ ঠাকুরের সেবার ত্রুটি হইবার আশঙ্কায় মন্ত্রণা করিতে উপস্থিত হইয়া তাহার পূর্বোক্ত ভাবের প্রেরণায় আশ্বস্ত ও নিশ্চিন্ত হইয়া ফিরিয়া গিয়াছেন। কেহ বা বলিয়াছেন, “ঠাকুর নিজের জোগাড় নিজেই করিয়া লইবেন, যদি করেন তাহাতেই বা ক্ষতি কি? (নিজ বাটী দেখাইয়া) যতক্ষণ ইটের উপরে ইট রহিয়াছে ততক্ষণ ভাবনা কি? বাটী বন্ধক দিয়া তাহার সেবা চালাইব।” কেহ বা বলিয়াছেন, “পুত্রকন্যার বিবাহ বা অসুস্থতা কালে যেরূপে চালাইয়া থাকি সেইরূপে চালাইব, ধীর গাত্রে দুই-চারি খান অলঙ্কার যতক্ষণ আছে ততক্ষণ ভাবনা কি?” আবার কেহ বা মুখে ঐরূপ প্রকাশ না করিলেও আপন সংসারের ব্যয় কমাইয়া অকাতরে ঠাকুরের সেবার ব্যয়ভার গ্রহণ করিয়া ঐ বিষয়ের পরিচয় প্রদান করিয়াছেন। ঐরূপ ভাবের প্রেরণাতেই সুরেন্দ্রনাথ বাটীভাড়ার সমস্ত ব্যয় একাকী বহন করিয়াছিলেন এবং বলরাম, রাম, মহেন্দ্র, গিরিশচন্দ্র প্রভৃতি সকলে মিলিত হইয়া ঠাকুরের ও তাহার সেবকগণের নিমিত্ত এইকালে যাহা কিছু প্রয়োজন হইয়াছিল সেই সমস্ত যোগাইয়া আসিয়াছিলেন।

ভক্তসঙ্ঘ গঠন করাই ঠাকুরের ব্যাধির কারণ

ভক্তগণ ঐরূপে যে দিব্যোল্লাস প্রাণে অনুভব করিতেন, তাহা এখন ঠাকুরকে অবলম্বন করিয়া তাহাদিগকে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট এবং সহানুভূতিসম্পন্ন করিতে বিশেষ সহায়তা করিয়াছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্তসঙ্ঘরূপ মহীরুহ দক্ষিণেশ্বরে অঙ্কুরিত হইয়াছিল বলিয়া নির্দিষ্ট হইলেও শ্যামপুকুরে ও কাশীপুর-উদ্যানে উহা নিজ আকার ধারণপূর্বক এত দ্রুত বদ্ধিত হইয়া উঠিয়াছিল যে, ভক্তগণের অনেকে তখন স্থির করিয়াছিলেন, ঐ বিষয়ের সাফল্য আনয়নই ঠাকুরের শারীরিক ব্যাধির অন্যতম কারণ।

ভক্তগণের ঠাকুরের সম্বন্ধে ধারনার শ্রেণীবিভাগ—যুগাবতার, গুরু, অতিমানব ও দেহমানব

যতই দিন গিয়াছিল ততই ঠাকুরের অসুস্থ হইবার কারণ এবং কতদিনে তাহার আরোগ্য হওয়া সম্ভবপর ইত্যাদি বিষয় লইয়া নানা জল্পনা ও বিশ্বাস ভক্তগণের মধ্যে উপস্থিত হইয়া তাহাদিগকে যেন কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া ফেলিয়াছিল। তাহার অতীত জীবনের অদৃষ্টপূর্ব ঘটনাবলীর আলোচনাই যে উহাদিগের মূলে থাকিয়া ভক্তগণকে অদ্ভুত মীমাংসাসকলে আনয়ন করিয়াছিল, তাহা স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়। একদল ভাবিতেন—শুদ্ধ ভাবনা কেন, সকলের নিকটে প্রকাশও করিতেন–যুগাবতার ঠাকুরের শারীরিক ব্যাধিটা মিথ্যা ভানমাত্র; উদ্দেশ্যবিশেষ সংসাধনের জন্য তিনি উহা জানিয়া বুঝিয়া অবলম্বন করিয়া রহিয়াছেন; যখনই ইচ্ছা হইবে পুনরায় পূর্বের ন্যায় আমাদিগের নিকটে প্রকাশিত হইবেন। বিশাল কল্পনাশক্তি লইয়া শ্ৰীযুক্ত গিরিশচন্দ্রই এই দলের নেতা হইয়া উঠিয়াছিলেন। অন্য একদল বলিতেন, যাহার বিরাট ইচ্ছার সম্পূর্ণ অনুগত হইয়া অবস্থান ও সর্বপ্রকার কৰ্ম্মানুষ্ঠান করিতে ঠাকুর অভ্যস্ত হইয়াছেন, সেই জগদম্বাই জনকল্যাণসাধনকর নিজ গূঢ় অভিপ্রায়-বিশেষ সিদ্ধির নিমিত্ত তাহাকে কিছুকালের জন্য ব্যাধিগ্রস্ত করিয়া রাখিয়াছেন; উহার সম্যক রহস্যভেদ ঠাকুরও স্বয়ং করিতে পারিয়াছেন কি না বলা যায় না; তাহার ঐ উদ্দেশ্য সংসাধিত হইলেই ঠাকুর পুনরায় সুস্থ হইবেন। অপর একদল প্রকাশ করিতেন—জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি এ সকল শরীরের ধর্ম, শরীর থাকিলে ঐ সকল নিশ্চয় উপস্থিত হইবে, ঠাকুরের শারীরিক ব্যাধিও ঐরূপে উপস্থিত হইয়াছে, অতএব উহার একটা অলৌকিক গূঢ় কারণ আছে ভাবিয়া এত জল্পনার প্রয়োজন কি? যত দিন না স্বয়ং প্রত্যক্ষ করিতেছি, তত দিন পর্যন্ত ঠাকুর সম্বন্ধীয় কোন বিষয়ক মীমাংসা আমরা তর্কযুক্তির দ্বারা বিশেষরূপে বিশ্লেষণ না করিয়া গ্রহণ করিতে স্বীকৃত নহি; আমরা তাহাকে আরোগ্য করিবার জন্য প্রাণপণে সেবা করিব এবং তিনি মানবজীবনের যে উচ্চাদর্শ সম্মুখে ধারণ করিয়াছেন, সেই ছাঁচে নিজ নিজ জীবন গঠন করিতে যথাসাধ্য চেষ্টা ও সাধন-ভজনে নিযুক্ত থাকিব। বলা বাহুল্য, শ্ৰীযুত নরেন্দ্রনাথই ঠাকুরের যুবকশিষ্যবর্গের প্রতিনিধিস্বরূপে শেষোক্ত মত প্রচার করিতেন।

ভক্তগণের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা

ঠাকুরের বিভিন্ন প্রকৃতিবিশিষ্ট শিষ্যবর্গ তাহার সম্বন্ধে ঐরূপ নানা ভাব ও মত পোষণ করিলেও, তাহার মহদুদার শিক্ষানুসারে জীবন অতিবাহিত করিলে এবং সর্বান্তঃকরণে তাহার সেবায় নিযুক্ত থাকিয়া তাঁহার প্রসন্নতা লাভ করিতে পারিলে তাহাদিগের পরম মঙ্গল হইবে, একথায় পূর্ণ বিশ্বাসবান ছিল। ঐজন্যই একদল তাহাকে যুগাবতার বলিয়া, অন্যদল গুরু ও অতিমানব বলিয়া এবং অপরদল দেবমানব বলিয়া বিশ্বাস করিলেও তাহাদিগের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধার অভাব কোনদিন উপস্থিত হয় নাই।

ভক্তগণপরিদৃষ্ট ঠাকুরের আধ্যাত্মিক প্রকাশের দৃষ্টান্তসকল

যাহা হউক, কিরূপ আধ্যাত্মিক প্রকাশসকল ঠাকুরকে অবলম্বন করিয়া এখন ভক্তগণের নিত্য প্রত্যক্ষগোচর হইতেছিল, পাঠককে উহা বুঝাইবার জন্য আমরা আধ্যাত্মিক যাহা দেখিয়াছি, এইরূপ কয়েকটি ঘটনার এখানে প্রকাশের উল্লেখ করিব। ঘটনাগুলি ঠাকুরের ভক্তবৃন্দ ভিন্ন অন্য যে-সকল লোক তাহাকে ঐকালে দর্শন করিতে আসিয়াছিলেন, তাহারাও প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন।

ডাক্তার সরকারের ঠাকুরের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া ও আচরণ এবং এক দিবসের কথোপকথন

আমরা ইতিপূর্বে বলিয়াছি, ঠাকুরের চিকিৎসার ভার গ্রহণ করিয়া ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার পরম উৎসাহে তাহাকে আরোগ্য করিবার জন্য যত্ন করিয়াছিলেন। প্রাতে, মধ্যাহ্নে বৈকালে ঠাকুরের শরীর কিরূপ থাকে তাহা উপর্যুপরি কয়েক দিবস আসিয়া দেখিয়া তিনি ঔষধাদির ব্যবস্থা স্থির করিয়াছিলেন এবং চিকিৎসকের কর্তব্য শেষ করিবার পরে ঐসকল দিবসে ধর্মসম্বন্ধীয় নানাপ্রকার প্রসঙ্গে কিছুকাল ঠাকুরের সহিত অতিবাহিত করিয়াছিলেন। ফলে ঠাকুরের উদার আধ্যাত্মিকতায় তিনি বিশেষরূপে আকৃষ্ট হইয়া অবসর পাইলেই এখন হইতে তাহার নিকটে উপস্থিত হইতে ও দুই-চারি ঘণ্টা অতিবাহিত করিয়া যাইতে লাগিলেন। তাঁহার মূল্যবান সময়ের এত অধিক ভাগ এখানে কাটাইবার জন্য ঠাকুর একদিন তাহাকে কৃতজ্ঞতা জানাইবার উপক্রম করিলে তিনি ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “ওহে, তুমি কি ভাব কেবল তোমারই জন্য আমি এখানে এতটা সময় কাটাইয়া যাই? ইহাতে আমারও স্বার্থ রহিয়াছে। তোমার সহিত আলাপে আমি বিশেষ আনন্দ পাইয়া থাকি। পূর্বে তোমাকে দেখিলেও এমন ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হইয়া তোমাকে জানিবার অবসর ত পাই নাই—তখন এটা করিব, ওটা করিব, ইহা লইয়াই ব্যস্ত থাকা গিয়াছিল। কি জান, তোমার সত্যানুরাগের জন্যই তোমায় এত ভাল লাগে; তুমি যেটা সত্য বলিয়া বুঝ তার একচুল এদিক ওদিক করিয়া চলিতে বলিতে পার না ; অন্যস্থলে দেখি তারা বলে এক, করে এক; ঐটে আমি আদৌ সহ্য করিতে পারি না। মনে করিও না, তোমার খোশামুদি করচি, এমন চাষা আমি নই; বাপের কুপুত্র!-বাপ অন্যায় করলে তাকেও স্পষ্ট কথা না বলিয়া থাকিতে পারি না; ঐজন্য আমার দুর্ম্মুখ বলে নামটা খুব রটিয়া গিয়াছে।”

ডাক্তারের সত্যানুরাগে সকল প্রকার অনুষ্ঠান

ঠাকুর হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “তা শুনিয়াছি বটে; কিন্তু এই ত এতদিন এখানে আসচ, আমি ত তার কিছুরই পরিচয় পাইলাম না।” ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন, “সেটা আমাদের উভয়ের সৌভাগ্য! নতুবা অন্যায় বলিয়া কোন বিষয় ঠেকিলে, দেখিতে মহেন্দ্র সরকার চুপ করিয়া থাকবার বান্দা নয়। যাহা হক, সত্যের প্রতি অনুরাগ আমাদের নাই, একথা যেন ভাবিও না। সত্য বলে যেটা বুঝেছি, সেইটা প্রতিষ্ঠা করতেই ত আজীবন ছুটাছুটি করেছি, ঐজন্যই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসারম্ভ, ঐজন্যই বিজ্ঞানচর্চার মন্দিরনির্মাণ– ঐরূপ আমার সকল কাজেই।”

অপরা বিদ্যার সহায়ে পরাবিদ্যালাভ

যতদূর মনে হয়, আমাদিগের মধ্যে কেহ এই সময়ে ইঙ্গিত করিয়াছিল, সত্যানুরাগ থাকিলেও ডাক্তার বাবুর অপরা বিদ্যার শ্রেণীভুক্ত আপেক্ষিক (relative) সত্যাবিষ্কারের দিকেই অনুরাগ -ঠাকুরের কিন্তু পরাবিদ্যার প্রতিই চিরকাল ভালবাসা।

ডাক্তার উহাতে একটু উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, “ঐ তোমাদের এক কথা; বিদ্যার আবার পরা, অপরা কি? যা হ’তে সত্যের প্রকাশ হয়, তার আবার উঁচু নীচু কি? আর যদিই একটা ঐরূপ মনগড়া ভাগ কর, তাহা হইলে এটা ত স্বীকার করিতেই হইবে, অপরা বিদ্যার ভিতর দিয়াই পরাবিদ্যা লাভ করিতে হইবে—বিজ্ঞানের চর্চা দ্বারা আমরা যে সকল সত্য প্রত্যক্ষ করি, তাহা হইতেই জগতের আদি কারণের বা ঈশ্বরের কথা আরও বিশেষভাবে বুঝিতে পারি। আমি নাস্তিক বৈজ্ঞানিক ব্যাটাদের ধরিতেছি না। তাদের কথা বুঝিতেই পারি না—চক্ষু থাকিতেও তারা অন্ধ। তবে একথাও যদি কেহ বলেন যে, অনাদি অনন্ত ঈশ্বরের সবটা তিনি বুঝে ফেলেছেন, তা হলে তিনি মিথ্যাবাদী, জুয়াচোর-তার জন্য পাগলাগারদের ব্যবস্থা করা উচিত।”

ঈশ্বরের ‘ইতি’ করাটা হীন বুদ্ধি

ঠাকুর ডাক্তারের দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিপাতপূর্বক হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “ঠিক বলেছ, ঈশ্বরের ‘ইতি’ যারা করে তারা হীনবুদ্ধি, তাদের কথা সহ্য করতে পারি না।”

মন বুঝে প্রাণ বুঝে না

ঐ বলিয়া ঠাকুর আমাদিগের জনৈককে ভক্তাগ্ৰণী শ্রীরাম প্রসাদের ‘কে জানে মন কালী কেমন, ষড়দর্শনে না পায় দরশন’(১) গীতটি গাহিতে বলিলেন এবং উহা শুনিতে শুনিতে উহার ভাবার্থ মৃদুস্বরে ডাক্তারকে মধ্যে মধ্যে বুঝাইয়া দিতে লাগিলেন। ‘আমার প্রাণ বুঝেছে মন বোঝে না, ধরবে শশী হয়ে বামন’ গীতের এই অংশটি গাহিবার কালে ঠাকুর গায়ককে বাধা দিয়া বলিলেন, “উ হু, উল্টোপাল্টা হচ্ছে; ‘আমার মন বুঝেছে প্রাণ বোঝে না’-এইরূপ হইবে; মন তাকে (ঈশ্বরকে) জানতে গিয়ে সহজেই বুঝে যে, অনাদি অনন্ত ঈশ্বরকে ধরা তার কর্ম নয়, প্রাণ কিন্তু ঐকথা বুঝিতেই চাহে না, সে কেবলি বলে—কি করে আমি তাকে পাব।”

ডাক্তার ঐকথা শুনিয়া মুগ্ধ হইয়া বলিলেন, “ঠিক বলেছ, মন ব্যাটা ছোট লোক, একটুতেই পারব না, হবে না বলে বসে; কিন্তু প্রাণ ঐকথায় সায় দেয় না বলেই ত যত কিছু সত্যের আবিষ্কার হয়েছে ও হচ্ছে।”

(১)     কে জানে মন কালী কেমন। 
         ষড়দর্শনে না পায় দরশন।। 
         কালী পদ্মবনে হংস সনে, হংসীরূপে করে রমণ। 
         তাকে মূলাধারে সহস্রারে সদা যোগী করে মনন।। 
         আত্মারামের আত্মা কালী, প্রমাণ প্রয়োগ লক্ষ এমন। 
         তারা ঘটে ঘটে বিরাজ করে, ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন।। 
         মায়ের উদর ব্রহ্মান্ডভান্ড, প্রকান্ড তা মান কেমন। 
         মহাকাল জেনেছেন কালীর মর্ম, অন্য কেবা জানে তেমন।।
         প্রসাদ ভাবে লোকে হাসে, সন্তরণে সিন্ধুগমন। 
         আমার প্রাণ বুঝেছে মন বোঝে না ধরবে শশী হয়ে বামন।।

ভাবাবিষ্ট যুবকের নাড়ী পরীক্ষা

গান শুনিতে শুনিতে দুই-একজন যুবকভক্তের ভাবাবেশে বাহ্যচৈতন্যের লোপ হইতে দেখিয়া ডাক্তার তাহাদের নিকটে যাইয়া নাড়ী পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, “মুর্চ্ছিতের ন্যায় বাহ্য বিষয়ের জ্ঞান নাই বলিয়া বোধ হইতেছে।” বুকে হাত বুলাইয়া মৃদুস্বরে নাম শুনাইবার পরে তাহাদিগকে পূর্বের ন্যায় প্রকৃতিস্থ হইতে দেখিয়া তিনি ঠাকুরকে লক্ষ্য করিয়া পুনরায় বলিলেন, “এ সব তোমারই খেলা, বোধ হইতেছে।” ঠাকুর হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “আমার নয় গো, এসব তারি (ঈশ্বরের) ইচ্ছায়। ইহাদের মন এখনও স্ত্রী পুত্র, টাকা কড়ি, মান যশাদিতে ছড়াইয়া পড়ে নাই বলিয়াই তাঁর নামগুণ শ্রবণে তন্ময় হইয়া ঐরূপ হইয়া থাকে।”

বিদ্যার গরম

পূর্ব প্রসঙ্গ পুনরায় উঠাইয়া এইবার ডাক্তারকে বলা হইল, তিনি ঈশ্বরকে মানিলেও এবং তাহার ‘ইতি’ না করিলেও যাহারা বিজ্ঞানচর্চায় রত রহিয়াছেন, তাঁহাদিগের মধ্যে একদল ঈশ্বরকে একেবারে উড়াইয়া দেন এবং অপর দল ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করিলেও তিনি এইরূপ ভিন্ন অপর কোনরূপ হইতে বা করিতে পারেন না, এই কথা উচ্চৈস্বরে প্রচার করিয়া থাকেন। ডাক্তার বলিলেন, “হাঁ, ঐ কথা অনেকটা সত্য বটে; কিন্তু ওটা কি জান?-ওটা হচ্চে বিদ্যার গরম বা বদহজম–ঈশ্বরের সৃষ্টির দুই-চারিটা বিষয় বুঝিতে পারিয়াছে বলিয়া তারা মনে করে, দুনিয়ার সব ভেদটাই তারা মেরে দিয়েছে। যারা অধিক পড়েছে দেখেছে, ও দোষটা তাদের হয় না; আমি ত ঐ কথা কখনও মনে আনিতে পারি না।”

পান্ডিত্যের অহঙ্কার

ঠাকুর তাহার কথা শুনিয়া বলিলেন, “ঠিক বলেছ, বিদ্যালাভের সঙ্গে সঙ্গে আমি পণ্ডিত, আমি যা জেনেছি বুঝেছি তাহাই সত্য, অপরের কথা মিথ্যা—এইরূপ একটা অহঙ্কার আসে। মানুষ নানা পাশে আবদ্ধ রয়েছে, বিদ্যাভিমান তাহারই ভিতরের একটা; এত লেখাপড়া শিখেও তোমার ঐরূপ অহঙ্কার নাই, ইহাই তার কৃপা।”

ডাক্তারের নিরভিমানতা

ডাক্তার ঐকথায় উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, “অহঙ্কার হওয়া দূরে থাক্‌, মনে হয় যা জেনেছি বুঝেছি তা যৎসামান্য, কিছু নয় বলিলেই হয়—শিখিবার এত বিষয় পড়িয়া রহিয়াছে, মনে হয়, শুধু মনে কেন, আমি দেখিতে পাই—প্রত্যেক মানুষেই এমন অনেক বিষয় জানে, যাহা আমি জানি না; সেজন্য কাহারও নিকট হইতে কিছু শিখিতে আমার অপমান বোধ হয় না। মনে হয়, ইহাদের নিকটেও (আমাকে দেখাইয়া) আমার শিখিবার মত অনেক জিনিস থাকিতে পারে, এ হিসাবে আমি সকলের পায়ের ধূলা লইতেও প্রস্তুত”।

ভিতরে মাল আছে

        ঠাকুর শুনিয়া বলিলেন, “আমিও ইহাদিগকে বলি, (আমাদিগকে দেখাইয়া) ‘সখি, যতদিন বাঁচি ততদিন শিখি!” পরে ডাক্তারকে দেখাইয়া আমাদিগকে বলিলেন, “কেমন নিরভিমান দেখছিস? ভিতরে মাল (পদার্থ) আছে কিনা, তাই ঐরূপ বুদ্ধি।”

       ঐরূপ নানা কথাবার্তার পরে ডাক্তার সেদিন বিদায় গ্রহণ করিয়াছিলেন।

ঠাকুরের ডাক্তারকে ধর্মপথে অগ্রসর করিয়া দিবার চেষ্টা

ডাক্তার মহেন্দ্রলাল ঐরূপে দিন দিন ঠাকুরের প্রতি যেমন শ্রদ্ধা ও প্রীতিসম্পন্ন হইয়া উঠিতেছিলেন, ঠাকুরও তেমনি তাঁহাকে ধৰ্ম্মপথে অগ্রসর করিয়া দিবার জন্য যত্নপর হইয়াছিলেন। তদ্ভিন্ন গুণী ব্যক্তির সহিত আলাপেই গুণীর সমধিক প্রীতি জানিয়া ঠাকুর তাঁহার শিষ্যবর্গের মধ্যে মহেন্দ্রনাথ, গিরিশচন্দ্র, নরেন্দ্রনাথ প্রমুখ বাছা বাছা লোকসকলকে মধ্যে মধ্যে সুবিদ্বান ডাক্তারের সহিত আলাপ করিতে পাঠাইয়াছিলেন। গিরিশচন্দ্রের সহিত পরিচিত হইবার পরে ডাক্তার একদিন ‘বুদ্ধচরিতে’র অভিনয় দর্শন করিয়া উহার শতমুখে প্রশংসা করিয়া ছিলেন এবং তৎকৃত অন্য কয়েকখানি নাটকেও অভিনয় দেখিতে গিয়াছিলেন। ঐরূপে নরেন্দ্রনাথের সহিত আলাপে মুগ্ধ হইয়া তিনি তাহাকে একদিন নিমন্ত্রণ করিয়া ভোজন করাইয়াছিলেন এবং গীতবিদ্যাতেও তাঁহার অধিকার আছে জানিয়া একদিন ভজন শুনাইবার জন্য অনুরোধ করিয়াছিলেন। উহার কয়েক দিন পরে ডাক্তার একদিবস অপরাহ্নে ঠাকুরকে দেখিতে আসিলে নরেন্দ্রনাথ তাহার প্রতিশ্রুতি রক্ষাপূর্বক দুই-তিন ঘণ্টা কাল তাহাকে ভজন শুনাইয়াছিলেন। ডাক্তার সেইদিন উহাতে এত আনন্দিত হইয়াছিলেন যে, বিদায়গ্রহণের পূর্বে নরেন্দ্রকে পুত্রের ন্যায় স্নেহে আশীৰ্বাদ, আলিঙ্গন ও চুম্বন করিয়া ঠাকুরকে বলিয়াছিলেন, “এর মত ছেলে ধৰ্মলাভ করিতে আসিয়াছে দেখিয়া আমি বিশেষ আনন্দিত; এ একটি রত্ন, যাতে হাত দিবে সেই বিষয়েরই উন্নতিসাধন করিবে।” ঠাকুর উহাতে নরেন্দ্রনাথের প্রতি প্রসন্ন দৃষ্টিপাতপূর্বক বলিয়াছিলেন, “কথায় বলে অদ্বৈতের হুঙ্কারেই গৌর নদীয়ায় আসিয়াছিলেন, সেইরূপ ওঁর (নরেন্দ্রের) জন্যই তো সব গো!” এখন হইতে ঠাকুরকে দেখিতে আসিয়া নরেন্দ্রকে সেখানে উপস্থিত দেখিলেই ডাক্তার তাঁহার নিকট হইতে কয়েকটি ভজন না শুনিয়া ছাড়িতেন না।

ঔষধে সম্যক ফল না পাওয়ায় ডাক্তারের চিন্তা ও আচরনের দৃষ্টান্ত

ঐরূপে ভাদ্র-আশ্বিনের কিয়দংশ অতীত হইয়া ক্রমে দুর্গা পূজার কাল উপস্থিত হইয়াছিল। ঠাকুরের অসুস্থতা ঐ সময়ে কোন কোন দিন কিছু অধিক এবং অন্য সকল দিনে অল্প, এইভাবে চলিয়াছিল। ঔষধে সম্যক ফল পাওয়া যাইতেছিল না। ডাক্তার একদিন আসিয়া রোগ বাড়িয়াছে দেখিয়া বলিয়া বসিলেন, “নিশ্চয় পথ্যের কোন অনিয়ম হইতেছে; আচ্ছা বল দেখি, আজ কি কি খাইয়াছ?”

প্রাতে ভাতের মন্ড, ঝোল ও দুধ এবং সন্ধ্যায় দুখ ও যবের মন্ডাদি তরল খাদ্যই ঠাকুর খাইতেছিলেন, সুতরাং ঐ কথাই বলিলেন। ডাক্তার বলিলেন, “তথাপি নিশ্চয় কোন নিয়মের ব্যতিক্রম হইয়াছিল। আচ্ছা বল ত, কোন্ কোন্ আনাজ দিয়া ঝোল রাধা হইয়াছিল?” ঠাকুর বলিলেন, “আলু, কাচকলা, বেগুন, দুই-এক টুকরা ফুলকপিও ছিল।”

ডাক্তার বলিলেন, “এ্যা-ফুলকপি খেয়েছ? এ ত খাবার অত্যাচার হয়েছে, ফুলকপি বিষম গরম ও দুষ্পাচ্য। কয় টুকরা খেয়েছ?”

ঠাকুর বলিলেন, “এক টুকরাও খাই নাই, তবে ঝোলে উহা ছিল দেখিয়াছি।”

ডাক্তার বলিলেন, “খাও আর নাই খাও, ঝোলে উহার সত্ত্ব ত ছিল—সেইজন্যই তোমার হজমের ব্যাঘাত হইয়া আজ ব্যায়ামের বৃদ্ধি হইয়াছে।”

ঠাকুর বলিলেন, “সে কি গো! কপি খাইলাম না, পেটের অসুখও হয় নাই, ঝোলে কপির একটু রস ছিল বলিয়া ব্যারাম বাড়িয়াছে, এ কথা যে আদৌ মনে নেয় না।”

একটু অত্যাচার অনিয়মে কতটা অপকার হয় তাহার দৃষ্টান্ত

ডাক্তার বলিলেন, “ঐরূপ একটুতে যে কতটা অপকার করিতে পারে তাহা তোমাদের ধারণা নাই। আমার জীবনের একটা ঘটনা বলিতেছি, শুনিলে বুঝিতে পারিবে। আমার হজমশক্তিটা বরাবরই কম; মধ্যে মধ্যে অজীর্ণে খুব ভুগিতে হইত; সেজন্য খাদ্যের সম্বন্ধে বিশেষ সতর্ক হইয়া নিয়ম রক্ষা করিয়া সর্বদা চলি। দোকানের কোন জিনিস খাই না; ঘি, তেল পৰ্যন্ত বাড়ীতে করাইয়া লই। তথাচ এক সময়ে বিষম সর্দি হইয়া ব্রনকাইটিস হইল, কিছুতেই সারিতে চায় না। তখন মনে হইল, নিশ্চিত খাবারে কোন প্রকার দোষ হইতেছে। সন্ধান করিয়া উহাতেও কোন প্রকার দোষ ধরিতে পারিলাম না। উহার পরে সহসা একদিন চোখে পড়িল—যে গোরুটার দুধ খাইয়া থাকি, তাহাকে চাকরটা কতকগুলো মাষকড়াই খাওয়াইতেছে। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, কোনও স্থান হইতে কয়েক মণ ঐ কড়াই পাওয়া গিয়াছিল, সর্দির ভয়ে কেহ খাইতে চাহে না বলিয়া কিছুদিন হইতে উহা গোরুকে খাইতে দেওয়া হইতেছে। মিলাইয়া পাইলাম, যখন হইতে ঐরূপ করা হইয়াছে প্রায় সেই সময় হইতে আমার সর্দি হইয়াছে। তখন গোরুকে ঐ কড়াই খাওয়ান বন্ধ করিলাম, সঙ্গে সঙ্গে আমার সর্দিও অল্পে অল্প কমিতে লাগিল। সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য হইতে সেইবার অনেকদিন লাগিয়াছিল এবং বায়ু পরিবর্তনাদিতে আমার চারি-পাঁচ হাজার টাকা খরচ হইয়া গিয়াছিল।”

ঠাকুর শুনিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “ও বাবা, এ যে তেঁতুলতলা দিয়া গিয়াছিল বলিয়া সর্দি হইল—সেইরূপ!”

সকলে হাসিতে লাগিল। ডাক্তারের ঐরূপ অনুমান করাটা একটু বাড়াবাড়ি বলিয়া বোধ হইলেও, উহাতে তাহার দৃঢ় বিশ্বাস দেখিয়া ঐ বিষয়ে আর কোন কথা কেহ উত্থাপন করিল না এবং তাঁহার নিষেধ মানিয়া লইয়া এখন হইতে ঠাকুরের ঝোলে কপি দেওয়া বন্ধ করা হইল।

ডাক্তারের ঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধার বৃদ্ধি ও ভক্তগণের প্রতি ভালবাসা

ঠাকুরের ভালবাসা, সরল ব্যবহার এবং আধ্যাত্মিকতায় ডাক্তারের মন তাহার প্রতি ক্রমে কতদূর শ্রদ্ধাসম্পন্ন হইয়া উঠিতেছিল, তাহা তাহার এক এক দিনের কথায় ও কাৰ্যে বেশ বুঝা যাইত। শুধু ঠাকুরকে কেন, তদীয় ভক্তগণকেও তিনি এখন ভালবাসার চক্ষে দেখিতেছিলেন এবং ঠাকুরকে লইয়া তাহারা যে একটা মিথ্যা হুজুক করিতে বসে নাই, এবিষয়ে বিশ্বাস হইয়াছিলেন। কিন্তু ঠাকুরকে তাহারা যেরূপ প্রগাঢ় ভক্তি বিশ্বাস করিত তাহা তিনি কি ভাবে দেখিতেন তাহা বলা যায় না। বোধ হয় তাহার নিকটে উহা কিছু বাড়াবাড়ি বলিয়া মনে হইত। অথচ তাহারা যে উহা কোন প্রকার স্বার্থের জন্য অথবা ‘লোক-দেখান’র মত করে না তাহা বেশ বুঝিতে পারিতেন। সুতরাং তাহার নিকটে উহা এক বিচিত্র রহস্যের ন্যায় প্রতিভাত হইত বলিয়া বোধ হয়। ভক্তদিগের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হইয়া তাঁহার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ঐ বিষয়ের সমাধানে নিত্য নিযুক্ত থাকিয়াও ঐ প্রহেলিকাভেদে সমর্থ হয় নাই। কারণ, ঈশ্বরে বিশ্বাসী হইলেও মানবের ভিতর তাহার অসাধারণ শক্তিপ্রকাশ দেখিয়া তাহাকে গুরু ও অবতার বলিয়া শ্রদ্ধা-পূজাদি করাটা তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রভাবে বুঝিতে পারিতেন না এবং বুঝিতে পারিতেন না বলিয়া উহার বিবোধী ছিলেন। বিরোধের কারণ, সংসারে যাহারা অবতার বলিয়া পূজা পাইতেছেন, তাঁহাদের শিষ্য-পরম্পরা তাঁহাদিগের মহিমা প্রচার করিতে যাইয়া বুদ্ধির দোষে কোন কোন বিষয় এমন অতিরঞ্জিত করিয়া ফেলিয়াছেন যে, তাহারা স্বরূপৎ কীদৃশ ছিলেন লোকের তাহা ধরা-বুঝা এখন একপ্রকার অসম্ভব হইয়া উঠিয়াছে। ঐ প্রসঙ্গে ডাক্তার একদিন ঠাকুরের সম্মুখে স্পষ্ট বলিয়াও ছিলেন, “ঈশ্বরকে ভক্তি-পূজাদি যাহা বল তাহা বুঝিতে পারি, কিন্তু সেই অনন্ত ভগবান্ মানুষ হইয়া আসিয়াছেন-এই কথা বলিলেই যত গোল বাধে। তিনি যশোদানন্দন, মেরীনন্দন, শচীনন্দন হইয়া আসিয়াছেন, এই কথা বুঝা কঠিন-ঐ নন্দনের দলই দেশটাকে উচ্ছন্ন দিয়াছে।” ঠাকুর ঐ কথায় হাসিয়া আমা দিগকে বলিয়াছিলেন, “এ বলে কি? তবে হীনবুদ্ধি গোঁড়ারা অনেক সময় তাহাকে বাড়াইতে যাইয়া ঐরূপ করিয়া ফেলে বটে।”

ডাক্তারের অবতার সম্বন্ধীয় মত ও তাহার প্রতিবাদ—দুর্গাপূজাকালে ঠাকুরের ভাবাবেশ দর্শনে ডাক্তারের বিস্ময়

অবতার সম্বন্ধীয় পূর্বোক্ত মত প্রকাশের জন্য ডাক্তারের সঙ্গে গিরিশচন্দ্র ও নরেন্দ্রনাথের সময়ে সময়ে অনেক বাদানুবাদ হইয়া ছিল। ফলে, উহার বিপরীতে অনেক যুক্তিগর্ভ কথা বলা যাইতে পারে, ইহা প্রতিপন্ন হওয়ায় ঐরূপ একান্ত বিরোধী মত সহসা প্রকাশ করিতে তিনি সতর্কতা অবলম্বন করিয়াছিলেন। কিন্তু তর্কে যাহা হয় নাই, ঠাকুরের মনের অলৌকিক মাধুৰ্য ও প্রেম এবং তাহার ভিতর হইতে যে অদৃষ্টপূৰ্ব আধ্যাত্মিক প্রকাশ ডাক্তারের সময়ে সময়ে নয়নগোচর হইতেছিল, তাহা দ্বারা সেই বিষয় সংসিদ্ধ হইয়াছিল। তাঁহার ঐরূপ মত ধীরে ধীরে অনেকটা পরিবর্তিত হইয়াছিল। ঐবৎসর –দুর্গাপূজা সন্ধিক্ষণে যে অলৌকিক বিভূতিপ্রকাশ ঠাকুরের ভিতরে সহসা উপস্থিত হইতে আমরা সকলে প্রত্যক্ষ করিয়াছিলাম, ডাক্তার সরকারও উহা দেখিবার ও পরীক্ষা করিবার অবসর পাইয়াছিলেন। তিনি সেই দিন অপর এক ডাক্তার বন্ধুর সহিত তথায় উপস্থিত থাকিয়া ভাবাবেশকালে ঠাকুরের হৃদয়ের স্পন্দনাদি যন্ত্রসাহায্যে পরীক্ষা করিয়াছিলেন এবং তাহার ডাক্তার বন্ধু ঠাকুরের উন্মীলিত নয়ন সঙ্কুচিত হয় কি না দেখিবার জন্য তন্মধ্যে অঙ্গুলী প্রদান করিতেও ত্রুটি করেন নাই। ফলে হতবুদ্ধি হইয়া তাহাদিগকে স্বীকার করিতে হইয়াছিল, বাহিরে দেখিতে সম্পূর্ণ মৃতের ন্যায় প্রতীয়মান ঠাকুরের এই সমাধি অবস্থা সম্বন্ধে বিজ্ঞান কোনরূপ আলোক এখনও প্রদান করিতে পারে নাই; পাশ্চাত্য দার্শনিক উহাকে চূড়ত্ব বলিয়া নির্দেশ ও ঘৃণা প্রকাশপূর্বক নিজ অজ্ঞতা ও ইহসর্বস্বতারই পরিচয় প্রদান করিয়াছেন; ঈশ্বরের সংসারে এমন অনেক বিষয় বিদ্যমান, যাহাদের রহস্যভেদ দর্শন-বিজ্ঞান কিছুমাত্র করিতে সক্ষম হয় নাই—কোনও কালে পারিবে বলিয়াও বোধ হয় না। বাহিরে মৃতের ন্যায় অবস্থিত হইয়া ঠাকুর সেদিন ঐকালে যাহা দর্শন বা উপলব্ধি করিয়াছিলেন, তাহা কতদূর বর্ণে বর্ণে সত্য বলিয়া ভক্তগণ মিলাইয়া পাইয়াছিল, সে-সকল কথা আমরা অন্যত্র উল্লেখ করায় উহার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন।

রোগবৃদ্ধি

আশ্বিন অতীত হইয়া কার্তিক এবং শ্রীশ্রীকালীপূজার দিন ক্রমে নিকটবর্তী হইল, কিন্তু ঠাকুরের শারীরিক অবস্থার বিশেষ কোন উন্নতি দেখা গেল না। চিকিৎসার প্রথমে যে ফল পাওয়া গিয়াছিল, তাহা দিন দিন নষ্ট হওয়ায় ব্যাধি প্রবলভাব ধারণ করিবে বলিয়া আশঙ্কা হইতে লাগিল। ঠাকুরের মনের আনন্দ ও প্রসন্নতা কিছুমাত্র হ্রাস না হইয়া বরং অধিকতর বলিয়া ভক্তগণের নিকটে প্রতিভাত হইল। ডাক্তার সরকার পূর্বের ন্যায় ঘন ঘন যাতায়াত ও পুনঃ পুনঃ ঔষধ পরিবর্তন করিয়াও আশানুরূপ ফল না পাইয়া ভাবিতে লাগিলেন ঋতু পরিবর্তনের জন্য ঐরূপ হইতেছে, শীতটা একটু চাপিয়া পড়িলেই বোধ হয় ঐ ভাবটা কাটিয়া যাইবে।

কালীপূজা দিবসে ঠাকুরের অদ্ভুত ভাবাবেসগের বিবরণ

দুর্গাপূজার ন্যায় কালীপূজার সময়েও ঠাকুরের ভিতরে অদ্ভুত আধ্যাত্মিক প্রকাশ ভক্তগণের নয়নগোচর হইয়াছিল। দেবেন্দ্রনাথ কোন সময়ে প্রতিমা আনয়নপূর্বক কালীপূজা করিবার সঙ্কল্প করিয়াছিলেন। ঠাকুর ও তাহার ভক্তগণের সম্মুখেই ঐ সঙ্কল্প কাৰ্য্যে বিবরণ পরিণত করিতে পারিলে পরম আনন্দ হইবে ভাবিয়া, তিনি শ্যামপুকুরের বাটীতে উক্ত পূজা করিবার কথা পাড়িলেন। কিন্তু পূজার উৎসাহ, উত্তেজনা ও গোলমালে ঠাকুরের শরীর অধিকতর অবসন্ন হইবে ভাবিয়া ভক্তগণ তাহাকে ঐরূপ কাৰ্য্য হইতে বিরত হইবার পরামর্শ প্রদান করিল। দেবেন্দ্র ভক্তগণের কথা যুক্তিযুক্ত ভাবিয়া ঐ সঙ্কল্প ত্যাগ করিলেন। ঠাকুর কিন্তু পূজার পূর্ব দিবসে কয়েকজন ভক্তকে সহসা বলিয়া বসিলেন, “পূজার উপকরণসকল সংক্ষেপে সংগ্রহ করিয়া রাখি-কাল কালীপূজা করিতে হইবে।” তাহারা তাহার ঐ কথায় আনন্দিত হইয়া অন্য সকলের সহিত ঐ বিষয়ে পরামর্শ করিতে বসিল। কিন্তু পূর্বোক্ত কথাগুলি ভিন্ন পূজার আয়োজন সম্বন্ধে অন্য কোন কথা ঠাকুরের নিকটে না পাওয়ায় কি ভাবে উহা সম্পন্ন করিতে হইবে তদ্বিষয় লইয়া নানা জল্পনা তাহাদিগের মধ্যে উপস্থিত হইল। পূজা, যোড়শোপচারে অথবা পঞ্চোপচারে হইবে, উহাতে অন্নভোগ দেওয়া হইবে কি না, পূজকের পদ কে গ্রহণ করিবে ইত্যাদি বিষয়ের কোন মীমাংসা না করিতে পারিয়া অবশেষে স্থির হইল, গন্ধ-পুষ্প, ধূপ-দীপ, ফলমূল এবং মিষ্টান্নমাত্র সংগ্রহ করিয়া রাখা হউক, পরে ঠাকুর যেরূপ বলেন, করা যাইবে। কিন্তু সেই দিবস এবং পূজার দিনের অর্ধেক অতীত হইলেও ঠাকুর ঐ সম্বন্ধে আর কোন কথা তাহাদিগকে বলিলেন না।

পূজার আয়োজন

ক্রমে সূৰ্যাস্ত হইয়া রাত্রি প্রায় ৭টা বাজিয়া গেল। ঠাকুর তখনও তাহাদিগকে পূজা সম্বন্ধে কিছুই না বলিয়া অন্য দিবসের ন্যায় স্থিরভাবে শয্যায় বসিয়া আছেন দেখিয়া তাহারা তাহার সন্নিকটে পূর্বদিকের কতকটা স্থান মার্জন করিয়া সংগৃহীত দ্রব্যসকল আনিয়া রাখিতে লাগিল। দক্ষিণেশ্বরে অবস্থানকালে গন্ধপুষ্পদি পূজোপকরণ লইয়া ঠাকুর কখন কখন আপনাকে আপনি পূজা করিতেন। ভক্তগণের কেহ কেহ উহা দেখিয়াছিল। অদ্যও সেইরূপে তিনি নিজ দেহমনরূপ প্রতীকাবলম্বনে জগচ্চৈতন্য ও জগচ্ছক্তি-রূপিণীর পূজা করিবেন, অথবা জগদম্বার সহিত অভেদজ্ঞানে শাস্ত্রোক্ত আত্মপূজা সম্পন্ন করিবেন, তাহারা পরিশেষে এই মীমাংসায় উপনীত হইয়াছিল। সুতরাং পূজোপকরণসকল তাহারা এখন ঠাকুরের শয্যাপার্শ্বে পূর্বোক্তরূপে সাজাইয়া রাখিবে, ইহা বিচিত্র নহে। ঠাকুর তাহাদিগকে ঐরূপ করিতে দেখিয়া কোনরূপ অসম্মতি প্রকাশ করিলেন না।

ঠাকুরের নীরবে অবস্থান

ক্রমে সকল উপকরণ আনয়ন করা হইল এবং ধূপ-দীপসকল প্রজালিত হওয়ায় গৃহ আলোকময় ও সৌরভে আমোদিত হইল। ঠাকুর তখনও স্থির হইয়া বসিয়া আছেন দেখিয়া ভক্তগণ এখন তাঁহার নিকটে উপবেশন করিল এবং কেহ বা তাহার আদেশ প্রতীক্ষা করিয়া একমনে তাহাকে দেখিতে এবং কেহ বা জগজ্জননীর চিন্তা করিতে লাগিল। ঐরূপে গৃহ এককালে নীরব এবং ত্রিশ বা ততোধিক ব্যক্তি উহার অন্তরে অবস্থান করিলেও জনশূন্য বলিয়া প্রতীয়মান হইতে লাগিল। কতক্ষণ ঐরূপে অতীত হইল, ঠাকুর কিন্তু তখনও স্বয়ং পূজা করিতে অগ্রসর হওয়া অথবা আমাদিগের কাহাকেও ঐ বিষয়ে আদেশ করা, কিছুই না করিয়া পূর্বের ন্যায় নিশ্চিন্তভাবে বসিয়া রহিলেন।

গিরিশচন্দ্রের মীমাংসা ও ঠাকুরের পাদপদ্মে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান—ঠাকুরের ভাবাবেশ

        যুবক ভক্তগণের সহিত মহেন্দ্রনাথ, রামচন্দ্র, দেবেন্দ্রনাথ, গিরিশচন্দ্র প্রভৃতি প্রবীণ ব্যক্তিসকল উপস্থিত ছিলেন-তন্মধ্যে গিরিশচন্দ্রের ‘পাচসিকে পাঁচ আনা বিশ্বাস(১) বলিয়া-ঠাকুর কখন কখন নির্দেশ করিতেন। পূজা সম্বন্ধে ঠাকুরকে ঐরূপ ব্যবহার করিতে দেখিয়া তাঁহাদিগের অনেকে এখন বিস্মিত হইতে লাগিলেন। ঠাকুরের প্রতি অসীম বিশ্বাসবান্ গিরিশচন্দ্রের প্রাণে কিন্তু উহাতে অন্যভাবের উদয় হইল। তাহার মনে হইল, আপনার জন্য ঠাকুরের কালীপূজা করিবার কোন প্রয়োজন নাই। যদি বল, অহেতুকী ভক্তির প্রেরণায় তাহার পূজা করিবার ইচ্ছা হইয়াছে—তাহা হইলে উহা করিয়া এরূপে স্থির হইয়া বসিয়া আছেন কেন? অতএব তাহা বোধ হইতেছে না; তবে কি তাহার শরীররূপ জীবন্ত প্রতিমায় জগদম্বার পূজা করিয়া ভক্তগণ ধন্য হইবে বলিয়া এই পূজায়োজন? –নিশ্চয় তাহাই। ঐরূপ ভাবিয়া তিনি উল্লাসে অধীর হইলেন এবং সম্মুখস্থ পুষ্পচন্দন সহসা গ্রহণপূর্বক ‘জয় মা’ বলিয়া ঠাকুরের পাদপদ্মে অঞ্জলি প্রদান করিলেন। ঠাকুরের সমস্ত শরীর উহাতে শিহরিয়া উঠিল এবং তিনি গভীর সমাধিমগ্ন হইলেন। তাঁহার মুখমণ্ডল জ্যোতির্ময় এবং দিব্য হাস্যে বিকশিত হইয়া উঠিল এবং হস্তদ্বয় বরাভয়-মুদ্রা ধারণপূর্বক তাহাতে জগদম্বার আবেশের পরিচয় প্রদান করিতে লাগিল! এত অল্পকালের মধ্যে এই সকল ঘটনা উপস্থিত হইল যে, পার্শ্ববর্তী ভক্তগণের অনেকে ভাবিল ঠাকুরকে ঐরূপ ভাবাবিষ্ট হইতে দেখিয়াই গিরিশ তাহার পদে বারম্বার অঞ্জলি প্রদান করিতেছেন এবং যাহারা কিঞ্চিদ্দূরে ছিল তাহারা দেখিল যেন ঠাকুরের শরীরাবলম্বনে জ্যোতির্ময়ী দেবী প্রতিমা সহসা তাহাদিগের সম্মুখে আবির্ভূত হইয়াছেন!

(১) অর্থাৎ-ষোলনার উপর চারি-পাঁচ আনা অধিক বিশ্বাস।

ভাবাবিষ্ট ঠাকুরকে ভক্তগণের পূজা

বলা বাহুল্য, ভক্তগণের প্রাণে এখন উল্লাসের অবধি রহিল না। তাহারা প্রত্যেকে কোনরূপে পুষ্পপাত্র হইতে ফুলচন্দন গ্রহণ করিয়া যাহার যেরূপ ইচ্ছা মন্ত্র উচ্চারণ ও ঠাকুরের শ্রীপাদপদ্ম পূজাপূর্বক ‘জয় জয়’ রবে গৃহ মুখরিত করিয়া তুলিল। কতক্ষণ ঐরূপে গত হইলে ভাবাবেশের উপশম হইয়া ঠাকুরের অর্ধবাহ্য অবস্থা উপস্থিত হইল। তখন পূজার নিমিত্ত সংগৃহীত ফলমূলমিষ্টান্নাদি পদাৰ্থসকল তাহার সম্মুখে আনয়ন করিয়া তাহাকে খাইতে দেওয়া হইল। তিনিও ঐ সকলের কিছু কিছু গ্রহণ করিয়া ভক্তি ও জ্ঞানবৃদ্ধির জন্য ভক্তগণকে আশীর্বাদ করিলেন। অনন্তর তাহার প্রসাদ গ্রহণ করিয়া গভীর রাত্রি পর্যন্ত তাহারা সকলে প্রাণের উল্লাসে দেবীর মহিমা কীর্তন ও নামগুণ-গানে অতিবাহিত করিল।

ঐরূপে ভক্তগণ সেই বৎসর অভিনব প্রণালীতে শ্রীশ্রীজগদম্বার পূজা করিয়া যে অভূতপূর্ব উল্লাস অনুভব করিয়াছিল তাহা চিরকালের নিমিত্ত তাহাদিগের প্রাণে জাগরূক হইয়া রহিয়াছে এবং দুঃখ-দুর্দিন উপস্থিত হইয়া যখনই তাহারা অবসন্ন হইয়া পড়িতেছে তখনই ঠাকুরের সেই দিব্যহাস্যফুল্ল প্রসন্ন আনন ও বরাভয়যুক্ত করদ্বয় তাহাদিগের সম্মুখে উদিত হইয়া তাহাদিগের জীবন সর্বথা ‘দেবরক্ষিত’, এই কথা তাহাদিগকে স্মরণ করাইয়া দিতেছে।

পর্ববিশেষ ভিন্ন অন্য সময়ে ভক্তগণের ঠাকুর সম্বন্ধীয় প্রত্যক্ষের দৃষ্টান্ত

শ্যামপুকুরে অবস্থানকালে ঠাকুরের ভিতরে দিব্যশক্তি ও দেব ভাবের পরিচয় ভক্তগণ পূর্বোক্তরূপে কেবলমাত্র বিশেষ বিশেষ পৰ্বকালেই যে পাইয়াছিল তাহা নহে, কিন্তু সহসা যখন তখন তাহাতে ঐরূপ ভাবের বিকাশ দেখিবার অবসর লাভ করিয়া তাহার প্রতি তাহাদের দেবমানব বলিয়া বিশ্বাস দিন দিন দৃঢ়ীভূত হইয়াছিল। ঐ ভাবের ঘটনাসকল ইতিপূর্বে উল্লিখিত ঘটনাগুলির ন্যায় অনেক সময়ে সকলের সমক্ষে উপস্থিত না হইলেও, ভক্তগণের মধ্যে যাহারা উহাদিগকে প্রত্যক্ষ করিয়াছিল অগ্রে তাহাদিগের প্রাণে এবং পরে তাহাদিগের নিকটে শুনিয়া অপর সকলের প্রাণে পূর্বোক্ত ফলের উদয় করিয়া ছিল, তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই। দৃষ্টান্তস্বরূপে কয়েকটির এখানে উল্লেখ করিলেই পাঠকের ঐ বিষয় বোধগম্য হইবে—

ঠাকুরকে শ্রদ্ধাভক্তি করায় বলরামের আত্মীয়বর্গের অপ্রসন্নতা

        বলরামের সম্বন্ধে কোন কোন কথা আমরা অন্যত্র উল্লেখ করিয়াছি। তিনি এবং তাঁহার পরিবারবর্গ ঠাকুরকে শ্রদ্ধা-ভক্তি করিতেন বলিয়া তাহার আত্মীয়দিগের মধ্যে কেহ কেহ তাহার প্রতি বিরূপ ছিলেন। ঐরূপ হইবার তাঁহাদিগের কারণও যথেষ্ট ছিল। প্রথমত, তাঁহারা বৈষ্ণব বংশে জন্মগ্রহণ করায় প্রচলিত শিক্ষা-দীক্ষানুসারে তাহাদিগের ধর্মমত যে কতকটা একদেশী এবং অতিমাত্রায় বাহ্যাচারনিষ্ঠ হইবে ইহা বিচিত্র নহে। সুতরাং সকল প্রকার ধর্মমতের সত্যতায় স্থির বিশ্বাসসম্পন্ন, বাহ্যচিহ্নমাত্র ধারণে পরাঙ্মুখ ঠাকুরের ভাব তাহারা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিতেন না—ঐরূপ করিবার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করিতেন না। অতএব ঠাকুরের সঙ্গগুণে এবং কৃপালাভে বলরামের দিন দিন উদারভাবসম্পন্ন হওয়াটা তাহারা ধর্মহীনতার পরিচায়ক বলিয়া ধারণা করিয়াছিলেন। দ্বিতীয়তঃ—ধন, মান, আভিজাত্যাদি পার্থিব প্রাধান্য মানবের অন্তরে প্রায় অভিমান অহঙ্কারই পরিপুষ্ট করে। পুণ্যকীৰ্ত্তি কৃষ্ণারাম বসু যে কুল উজ্জ্বল করিয়াছিলেন, সেই কুলে জন্মগ্রহণ করিয়া তাহারাও আপনাদিগকে সমধিক মহিমান্বিত জ্ঞান করিতেন। ঐ বংশমর্যাদা বিস্মৃত হইয়া বলরাম ইতরসাধারণের ন্যায় দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের শ্রীপদপ্রান্তে ধৰ্মলাভের জন্য যখন তখন উপস্থিত হইতেছেন এবং আপন স্ত্রী কন্যা প্রভৃতিকেও তথায় লইয়া যাইতে কুণ্ঠিত হইতেছেন না জানিতে পারিয়া তাঁহাদিগের অভিমান যে বিষম প্রতিহত হইবে, একথা বলা বাহুল্য। অতএব ঐ কাৰ্য্য হইতে তাঁহাকে প্রতিনিবৃত্ত করিতে তাহাদিগের বিষম আগ্রহ এক্ষণে উপস্থিত হইয়াছিল।

বলরামের ঠাকুরের নিকট গমন নিবারণে তাহাদিগের চেষ্টা

সৎ উপায় অবলম্বনে কাৰ্যসিদ্ধি না হইলে অহঙ্কৃত মানবকে অসদুপায় গ্রহণ করিতে অনেক সময় দেখিতে পাওয়া যায়। বলরামের আত্মীয়বর্গের মধ্যে কোন কোন ব্যক্তির প্রায় ঐরূপ অবস্থা হইয়াছিল। কালনার ভগবানদাসপ্রমুখ বৈষ্ণব বাবাজীদিগের নিষ্ঠা ও ভক্তিপ্রেমের আতিশয্য কীৰ্ত্তন করিয়া এবং আপনাদিগের বংশগৌরবের কথা পুনঃ পুনঃ স্মরণ করাইয়া দিয়াও যখন তাহারা বলরামের ঠাকুরের নিকটে গমন নিবারণ করিতে পারিলেন না, তখন ঠাকুরের প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হইয়া তাহারা কখন কখন তাহার অযথা নিন্দাবাদ করিতেও কুণ্ঠাবোধ করিলেন না। অবশ্য, অপরের নিকট হইতে শ্রবণ করিয়াই যে তাহারা ঠাকুরকে নিষ্ঠাপরিশূন্য, সদাচারবিরহিত, খাদ্যাখাদ্য-বিচার বিহীন, কন্ঠী তিলকাদি বৈষ্ণব চিহ্ন ধারণের বিরোধী ইত্যাদি বলিয়া ধারণা করিয়াছিলেন, একথা বলিতে হইবে। যাহা হউক, উহাতেও কোন ফলোদয় হইল না দেখিয়া তাহারা অবশেষে ঠাকুরের ও বলরামের সম্বন্ধে নানা কথার বিকৃত আলোচনা তাঁহার খুল্লতাত ভাতৃদ্বয় নিমাইচরণ ও হরিবল্লভ বসুর কর্ণে উত্থাপিত করিতে লাগিলেন।

বলরামের পূর্বজীবন

আমরা ইতিপূর্বে একস্থলে বলিয়াছি, বলরামের ভিতরে দয়া ও ত্যাগবৈরাগ্যের ভাব বিশেষ প্রবল ছিল। জমিদারী প্রভৃতির তত্বাবধানে অনেক সময় নির্মম হইয়া নানা হাঙ্গামা না করিলে চলে না দেখিয়া, তিনি নিজ বিষয়সম্পত্তির ভার নিমাই বাবুর উপরে সমর্পণপূর্বক তাহার নিকট হইতে প্রতি মাসে আয়স্বরূপে যাহা পাইতেন অনেক সময়ে উহা পৰ্যাপ্ত না হইলেও তাহাতেই কোনরূপে সংসারযাত্রা নির্বাহ করিতেন। তাহার শরীরও ঐ সকল কর্ম করিবার উপযোগী ছিল না। যৌবনে অজীর্ণ রোগে উহা এক সময়ে এতদূর স্বাস্থ্যহীন হইয়াছিল যে, একাদিক্রমে দ্বাদশ বৎসর অন্ন ত্যাগপূর্বক তাহাকে যবের মণ্ড ও দুগ্ধ পান করিয়া কাটাইতে হইয়াছিল। ভগ্ন স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য তিনি ঐ সময়ের অনেক কাল পুরীধামে অতিবাহিত করিয়াছিলেন। শ্রীভগবানের নিত্য দর্শন, পূজা, জপ, ভাগবতাদি শাস্ত্র শ্রবণ এবং সাধুসঙ্গাদি কাৰ্যেই তাহার তখন দিন কাটিত এবং ঐরূপে তিনি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ভিতরে ভাল ও মন্দ যাহা কিছু ছিল সেই সকলের সহিত সুপরিচিত হইবার বিশেষ অবসর ঐকালে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। পরে কাৰ্যানুরোধে কলিকাতায় আসিবার কিছুকাল পরেই ঠাকুরের দর্শন ও পূতসঙ্গে তাহার জীবন কিরূপে দিন দিন পরিবর্তিত হয়, তদ্বিষয়ের আভাস আমরা ইতিপূর্বে প্রদান করিয়াছি।

বলরামের কলিকাতায় আগমন ও ঠাকুরকে দর্শন

প্রথমা কন্যার বিবাহ দানের কালে বলরামকে কয়েক সপ্তাহের জন্য কলিকাতায় আসিতে হইয়াছিল। নতুবা পুরীধামে অতি বাহিত পূর্ণ একাদশ বৎসরের ভিতর তাঁহার জীবনে অন্য কোন প্রকারে শান্তিভঙ্গ হয় নাই। ঐ ঘটনার কিছুকাল পরেই তাঁহার ভ্রাতা হরিবল্লভ বসু রামকান্ত বসু স্ট্রীটস্থ ৫৭ নং ভবন ক্রয় করিয়া ছিলেন এবং সাধুদিগের সহিত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধবশতঃ পাছে বললাম সংসার পরিত্যাগ করেন, এই ভয়ে তাঁহার পিতা ও ভ্রাতৃগণ গোপনে পরামর্শ করিয়া তাহাকে ঐ বাটীতে বাস করিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন। ঐরূপে সাধুদিগের পূতসঙ্গ ও শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের নিত্যদর্শনে বঞ্চিত হইয়া বলরাম ক্ষুণ্ণমনে কলিকাতায় আসিয়া বাস করেন। এখানে কিছুদিন থাকিয়া পুনরায় পুরীধামে কোন প্রকারে চলিয়া যাইবেন, বোধ হয় পূর্বে তাহার এরূপ অভিপ্রায় ছিল, কিন্তু ঠাকুরের দর্শনলাভের পরে ঐ সঙ্কল্প এককালে পরিত্যাগ করিয়া তিনি ঠাকুরের নিকটে কলিকাতায় স্থায়িভাবে বসবাসের বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন। সুতরাং পাছে হরিবল্লভ বাবু তাহাকে উক্ত বাটী খালি করিয়া দিতে বলেন, অথবা নিমাই বাবু বিষয়সম্পত্তি তত্ত্বাবধান করিবার জন্য তাহাকে কোঠারে আহ্বানপূর্বক ঠাকুরের পুণ্যসলে বঞ্চিত করেন, এই ভয়ে তাহার অন্তর এখন সময়ে সময়ে বিশেষ ব্যাকুল হইত।

বলরামের ভ্রাতা হরিবল্লভের কলিকাতা আগমন

অন্তরের চিন্তা সময়ে সময়ে ভবিষ্যৎ ঘটনার সূচনা করে। বলরামেরও এখন ঐরূপ হইয়াছিল। তিনি যাহা ভয় করিতে ছিলেন প্রায় তাহাই উপস্থিত হইল। আত্মীয়বর্গের গুপ্ত প্রেরণায় তাহার উভয় ভ্রাতাই তাহার প্রতি অসন্তুষ্ট হইয়াছেন এইরূপ ইঙ্গিত করিয়া পত্র পাঠাইলেন এবং হরিবল্লভ বাবু তাহার সহিত পরামর্শে বিশেষ প্রয়োজনীয় কোন বিষয় স্থির করিবার অভিপ্রায়ে শীঘ্রই কলিকাতায় আসিয়া তাহার সহিত একত্রে কয়েকদিন অবস্থান করিবেন, এই সংবাদও অবিলম্বে তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইল। অন্যায় কিছুই করেন নাই বলিয়া বলরামের অন্তরাত্মা উহাতে ক্ষুব্ধ না হইলেও ঘটনাচক্র পাছে তাহাকে ঠাকুরের নিকট হইতে দূরে লইয়া যায়, এই ভয়ে অবসন্ন হইল। অনন্তর অশেষ চিন্তার পরে তিনি স্থির করিলেন, ভ্রাতারা অপরের কথা শুনিয়া যদি তাহাকে দোষী বলিয়া সাব্যস্ত করেন তথাপি তিনি ঠাকুরের অসুখের সময়ে তাহাকে ফেলিয়া অন্যত্র যাইবেন না। ইতিমধ্যে হরিবল্লভ বাবুও কলিকাতায় উপস্থিত হইলেন। তাহার সহিত অবস্থানকালে ভ্রাতাকে যাহাতে কোনরূপ কষ্ট বা অসুবিধা ভোগ করিতে না হয়, এইরূপে সকল বিষয়ের সুবন্দোবস্ত করিয়া বলরাম নিজ সঙ্কল্প দৃঢ় রাখিয়া নিশ্চিন্ত মনে অবস্থান করিতে এবং ঠাকুরের নিকটে প্রতিদিন যেভাবে যাতায়াত করিতেন, প্রকাশ্যভাবে তদ্রূপ করিতে লাগিলেন।

বলরামের প্রতি কৃপায় ঠাকুরের হরিবল্লভকে দেখিবার সঙ্কল্প

মুখই মনের প্রকৃষ্ট দর্পণ। হরিবল্লভ বসুর কলিকাতায় আসিবার দিবসে বলরাম ঠাকুরের নিকটে উপস্থিত হইলে তিনি তাহার মুখ দেখিয়াই বুঝিয়া লইলেন তাহার অন্তরে কি একটা সংগ্রাম চলিয়াছে। বলরামকে তিনি বিশেষভাবে আপনার বলিয়া জ্ঞান করিতেন; তাহার বেদনায় ব্যথিত হইয়া তাহাকে নিজ সমীপে ডাকিয়া প্রশ্ন পূৰ্ব্বক সকল বিষয় জানিয়া লইলেন এবং বলিলেন, “সে লোক কেমন? তাহাকে (হরিবল্লভ বসুকে) একদিন এখানে আনিতে পার?” বলরাম বলিলেন, “লোক খুব ভাল, মশায়! বিদ্বান, বুদ্ধিমান, সদাশয়, পরোপকারী, দান যথেষ্ট, ভক্তিমানও বটে-দোষের মধ্যে বড় লোকের যাহা অনেক সময় হইয়া থাকে একটু কান পাতলা’–এ ক্ষেত্রে অপরের কথাতেই কি একটা ঠাওরাইয়াছে। এখানে আসি বলিয়াই আমার উপরে অসন্তোষ, অতএব আমি বলিলে এখানে আসিবে কি?” ঠাকুর বলিলেন, “তবে থাক, তোমার বলিয়া কাজ নাই; একবার গিরিশকে ডাক দেখি।”

গিরিশচন্দ্র আসিয়া সানন্দে ঐ কার্য্যের ভার গ্রহণ করিলেন এবং বলিলেন, “হরিবল্লভ ও আমি যৌবনের প্রারম্ভে কিছুকাল সহপাঠী ছিলাম, সেজন্য কলিকাতায় আসিয়াছে শুনিলেই আমি তাহার সহিত দেখা করিয়া আসি; অতএব এই কাজ আমার পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন নহে, অদ্যই আমি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইব।”

গিরিশচন্দ্রের হরিবল্লভকে আনয়ন ও ঠাকুরের আচরণে তাঁহার সম্পূর্ণ বিপরীত ভাবাপন্ন হওয়া

পরদিন অপরাহ্নে প্রায় ৫টার সময় গিরিশচন্দ্র হরিবল্লভ বাবুকে সঙ্গে লইয়া উপস্থিত হইলেন এবং ঠাকুরের সহিত তাহাকে পরিচিত করিবার মানসে বলিলেন, “ইনি আমার বাল্যবন্ধু, কটকের সরকারী উকীল হরিবল্লভ বসু, আপনাকে দর্শন করিতে আসিয়াছেন।” ঠাকুর ঐকথা শুনিয়া তাহাকে পরম সমাদরে নিজ সমীপে বসাইয়া বলিলেন, “তোমার কথা অনেকের নিকটে তোমাকে দেখিবার ইচ্ছা হইত, আবার মনে ভয়ও হইত—যদি তোমার পাটোয়ারী বুদ্ধি হয়! (গিরিশকে লক্ষ্য করিয়া) কিন্তু এখন দেখিতেছি তাহা ত নয়, (হরিবল্লভ বসুকে নির্দেশ করিয়া) এ যে বালকের ন্যায় সরল! (গিরিশকে) কেমন চক্ষু দেখিয়াছ? ভক্তিপূর্ণ অন্তর না হইলে অমন চক্ষু কখন হয় না! (হরিবল্লভ বাবুকে সহসা স্পর্শ করিয়া) হাঁ গো, ভয় করা দূরে থাকুক, তোমাকে যেন কত আত্মীয় বলিয়া মনে হইতেছে।” হরিবল্পত বাবু প্ৰণাম ও পদধূলী গ্রহণপূর্বক বলিলেন, “সেটা আপনার কৃপা।”

গিরিশচন্দ্র এইবার বলিলেন, যে বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন তাহাতে উহার ত ভক্তিমান হইবারই কথা; কৃষ্ণরাম বসুর ভক্তি তাহাকে প্রাতঃস্মরণীয় করিয়া রাখিয়াছে, তাহার কীর্তিতে দেশ উজ্জ্বল হইয়া রহিয়াছে। তাহার বংশে যাহারা জন্মিয়াছেন তাহারা ভক্তিমান হইবেন না ত হইবে কাহারা।”

ঐরূপে ভগবদ্ভক্তির প্রসঙ্গ উঠিল, এবং ঈশ্বরে বিশ্বাস, ভক্তি ও ঐকান্তিক নির্ভরতাই মানবজীবনের চরম সার্থকতা—ঐ বিষয়ে নানা কথা উপস্থিত সকলকে বলিতে বলিতে ঠাকুরের ভাবাবেশ হইল। অনন্তর অর্ধবাহ্যদশা প্রাপ্ত হইয়া ঠাকুর আমাদিগের একজনকে একটি ভজন সঙ্গীত গাহিতে বলিলেন এবং উহার মৰ্ম্ম হরিবল্লভ বাবুকে মৃদুস্বরে বুঝাইয়া বলিতে বলিতে পুনরায় গভীর ভাবাবিষ্ট হইয়া পড়িলেন। সঙ্গীত সম্পূর্ণ হইলে দেখা গেল, দুই-তিনজন যুবক ভক্তেরও ভাবাবেশ হইয়াছে এবং ঠাকুরের ভাবোল মূর্তি ও মর্মস্পশী বাণীতে এককালে মুগ্ধ হওয়ায় হরিবল্লভ বাবুর নয়নয়ে প্রেমধারা বিগলিত হইতেছে। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া কিছুকাল গত হইবার পরে হরিবল্লভ বাবু সেদিন ঠাকুরের নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়াছিলেন।

আলাপ করিবার কালে ঠাকুরের অপরকে স্পর্শের কারণ ও ফল

দক্ষিণেশ্বরে অবস্থানকালে আমরা অনেক সময়ে দেখিতে পাইতাম, আগন্তুক ফোন ব্যক্তি ঠাকুরের মতের বিরোধী হইয়া তাঁহার সহিত বাদানুবাদ আরম্ভ করিলে অথবা কোন কারণে তাহার প্রতি বিরুদ্ধভাবাপন্ন হইয়া কেহ উপস্থিত হইলে, ঠাকুর কথা কহিতে কহিতে তাহাদিগকে কৌশলে স্পর্শ করিতেন এবং ঐরূপ করিবার পরমুহূৰ্ত্ত হইতে তাহারা তাহার কথা মানিয়া লইতে থাকিত। অবশ্য যাহাদিগকে দেখিয়া তাহার মন প্রসন্ন হইত তাহাদিগের সম্বন্ধেই তিনি ঐরূপ ব্যবহার করিতেন। স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া তিনি এক দিবস আমাদিগের নিকটে ঐ বিষয়ের এইরূপ কারণ নির্দেশ করিয়াছিলেন। ‘অহঙ্কারের বশবর্তী হইয়া অথবা আমি কাহারও অপেক্ষা কোন অংশে ন্যূন নহি, এইরূপ ভাব লইয়াই লোকে কাহারও কথা সহজে মানিয়া লইতে চাহে না। (আপনার শরীর নির্দেশ করিয়া) ইহার ভিতরে যে রহিয়াছে তাহাকে স্পর্শমাত্র তাহার দিব্যশক্তিপ্রভাবে তাহাদিগের ঐ ভাব আর মাথা উঁচু করিতে পারে না। সর্প যেমন ফণা ধরিবার কালে ওষধিস্পৃষ্ট হইয়া মাথা নীচু করে, তাহাদিগের অন্তরের অহঙ্কারের অবস্থাও তখন ঠিক ঐরূপ হয়। ঐজন্যই কথা কহিতে কহিতে কৌশলে তাহাদিগের অঙ্গ স্পর্শ করিয়া থাকি।”

হরিবল্লভ বাবুকে ঐদিন ঠাকুরের নিকট হইতে সম্পূর্ণ বিপরীত ভাব লইয়া সশ্রদ্ধ হৃদয়ে চলিয়া যাইতে দেখিয়া আমাদিগের মনে ঠাকুরের পূর্বোক্ত কথার উদয় হইয়াছিল। বলা বাহুল্য, বলরাম ঠাকুরের নিকটে যাতায়াত করায় অন্যায় করিতেছেন, এইরূপ ভাব তাহার ভ্রাতৃগণের হৃদয়ে এখন হইতে আর কখন দেখা দেয় নাই।

ভক্ত-সংখ্যার বৃদ্ধি; সাধনপথ নির্দেশ—সাকার ও নিরাকার চিন্তার উপযোগী আসন

শ্যামপুকুরে অবস্থানকালে ঠাকুরের শারীরিক ব্যাধি যেমন বৃদ্ধি পাইয়াছিল, তাহার পুণ্যদর্শন ও কৃপালাভে সমাগত জনগণের সংখ্যাও তেমনি দিন দিন বাড়িয়া গিয়াছিল। শ্ৰীযুক্ত হরিশচন্দ্র মুস্তফি প্রমুখ অনেক গৃহস্থভক্তের ন্যায় শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্তসঙ্ঘে যিনি পরে স্বামী ত্রিগুণাতীত নামে সুপরিচিত হইয়াছিলেন– শ্রীযুক্ত সারদাপ্রসন্ন মিত্র(১), মণীন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্ত(২) প্রভৃতি অনেক যুবক ভক্তেরাও এখানে ঠাকুরের প্রথম দর্শন লাভ করিয়াছিলেন। অনেকে আবার ইতিপূর্বে দুই-এক বার দক্ষিণেশ্বরে গতায়াত করিলেও এখানেই ঠাকুরের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হইবার সুযোগ লাভ করিয়াছিলেন। নবাগত এই সকল ব্যক্তিদিগের প্রকৃতি ও সংস্কার লক্ষ্য করিয়া ঠাকুর ইহাদিগের প্রত্যেককে ভক্তিপ্রধান অথবা জ্ঞানমিশ্রা-ভক্তিপ্রধান সাধনমার্গ নির্দেশ করিয়া দিতেন এবং সুযোগ পাইলেই নিভৃতে নানারূপ উপদেশ দিয়া ঐ পথে অগ্রসর করাইতেন। আমাদিগের জানা আছে, জনৈক যুবককে ঐরূপে ঠাকুর একদিন সাকার ও নিরাকার ধ্যানের উপযোগী নানাপ্রকার আসন ও অঙ্গসংস্থান দেখাইতেছিলেন। পদ্মাসনে উপবিষ্ট হইয়া বাম করতলের উপরে দক্ষিণ করপৃষ্ঠ সংস্থাপনপূর্বক ঐভাবে উভয়হস্ত বক্ষে ধারণ ও চক্ষু নিমীলন করিয়া বলিলেন, ইহাই সকল প্রকার সাকার-ধ্যানের প্রশস্ত আসন। পরে ঐ আসনেই উপবিষ্ট থাকিয়া বাম ও দক্ষিণ হস্তদ্বয় বাম ও দক্ষিণ জানুর উপরে রক্ষাপূর্বক প্রত্যেক হস্তের অঙ্গুষ্ঠ ও তর্জনীর অগ্রভাগ সংযুক্ত ও অপর সকল অঙ্গুলী ঋজু রাখিয়া এবং ভ্রূমধ্যে দৃষ্টি স্থির করিয়া বলিলেন, ইহাই নিরাকার ধ্যানের প্রশস্ত আসন। ঐকথা বলিতে না বলিতে ঠাকুর সমাধিস্থ হইয়া পড়িলেন এবং কিছুক্ষণ পরে বলপূর্বক মনকে সাধারণ জ্ঞানভূমিতে নামাইয়া বলিলেন, “আর দেখান হইল না; ঐরূপে উপবিষ্ট হইলেই উদ্দীপনা হইয়া মন তন্ময় ও সমাধিলীন হয় এবং বায়ু উৰ্দ্ধগামী হওয়ায় গলদেশের ক্ষতস্থানে আঘাত লাগে; ডাক্তার ঐজন্য সমাধি যাহাতে না হয় তাহা করিতে বিশেষ করিয়া বলিয়া গিয়াছে।” যুবক তাহাতে কাতর হইয়া বলিল, “আপনি কেন ঐ সকল দেখাইতে যাইলেন, আমি ত দেখিতে চাহি নাই।” তিনি তদুত্তরে বলিলেন, “তা ত বটে, কিন্তু তোদের একটু-আধটু না বলিয়া, না দেখাইয়া থাকিতে পারি কৈ?” যুবক ঐ কথায় বিস্মিত হইয়া ঠাকুরের অপার করুণা এবং তাহার মনের অলৌকিক সমাধিপ্রবণতার কথা ভাবিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিল।

(১) সারদাপ্রসন্ন ১৮৮৪ খৃঃ-এর ডিসেম্বরের মধ্যে আসিয়াছিলেন—‘কথামৃত’ ২য় ভাগ, ২১৫ পৃঃ এবং ১ম ভাগ, ৬ পৃঃ দ্রষ্টব্য।–প্রঃ

(২) শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সহিত মণীন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্ত মহাশয়ের প্রথম পরিচয় হয় এখানে। ইহার ২/৩ বৎসর পূর্বে দক্ষিণেশ্বরে কয়েকবার দর্শন করিয়াছিলেন মাত্র–তাহার লিখিত ‘শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের পুণ্যস্মৃতি’, ‘উদ্বোধন’, ৩৯শ বর্ষ, ভাদ্র-সংখ্যা দ্রষ্টব্য।–প্রঃ

ঠাকুরের প্রতি কার্য্যের মাধুর্য্য ও অসাধারণত্ব দেখিয়া অনেকের আকৃষ্ট হওয়া

ঠাকুরের দৈনন্দিন ব্যবহারসকলের মধ্যেও এমন মাধুৰ্য্য ও অসাধারণত্বের পরিচয় পাওয়া যাইত যে, নবাগত অনেক ব্যক্তি তাহা দেখিয়াই মুগ্ধ হইয়া পড়িত। দৃষ্টান্তস্বরূপে নিয়ে একটি ঘটনার উল্লেখ করিতেছি। ঘটনাটি আমরা মহাকৰি গিরিশচন্দ্রের বন্ধুবৎসল কনিষ্ঠ সহোদর পরলোকগত অতুলচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের নিকটে শ্রবণ করিয়াছিলায়। যথাসম্ভব তাহারই ভাষায় আমরা উহা লিপিবদ্ধ করিতে চেষ্টা কৰিব—“উপেন্দ্র(১) আমার বিশেষ বন্ধু ছিল, বিদেশে ডেপুটিগিরি চাকরি করিত। ঠাকুরের সহিত পরিচিত হইবার পরে তাহাকে চিঠিতে লিখিয়াছিলাম, ‘এবার যখন আসিবে তখন তোমাকে এক অদ্ভুত জিনিস দেখাব’। বড়দিনের ছুটিতে আসিয়া সে সেই কথা স্মরণ করাইয়া দিল। আমি বলিলাম, ‘মনে করেছিলাম তোমায় রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে দেখাব—কিন্তু এখন তার অসুখ, শ্যামপুকুরে আছেন, কথা কহিতে ডাক্তারের বারণ—তুমি নূতন লোক, তোমায় এখন কেমন করিয়া লইয়া যাই?  সে দিন গেল। তাহার পর উপেন্দ্র আর একদিন মেজদাদার (গিরিশচন্দ্রের) সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছে, ঠাকুরের কথা উঠিল এবং মেজদাদা তাহাকে বলিলেন, ‘যা না একদিন অতুলের সঙ্গে, তাঁকে দেখতে’। উপেন বলিল, “উনি তো ছয় মাস (পূর্ব) হইতে বলিতেছিলেন লইয়া যাইব, কিন্তু যখন এখানে আসিয়া সেই কথা বললাম, তখন বলিলেন—এখন হইবে না”। আমি শুনিয়া মেজদাদাকে বলিলাম, ‘আমরাই এখন সব সময়ে ঢুকিতে পাই না, নূতন লোককে কেমন করিয়া লইয়া যাই। মেজদাদা বলিলেন, ‘তাহা হউক, তবু একদিন লইয়া যা, তাহার পরে ওর অদৃষ্টে থাকে তিনি ওকে দর্শন দিবেন, আদর করিবেন’।

(১) শ্রীযুক্ত উপেন্দ্রনাথ ঘোষ, ইনি শ্যামবাজারস্থ সুপ্রসিদ্ধ শ্রীযুক্ত ভুগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয়ের কোন আত্মীয়াকে বিবাহ করেন এবং মুন্সেফ ছিলেন।

উপেন্দ্রের শ্যামপুকুরে আগমন ও ঠাকুরের সপ্রেম ব্যবহারে উপলব্ধি

“তাহার পর একদিন অপরাহ্নে উপেনকে লইয়া যাইলাম। সেদিন ঠাকুরের ঘরে তাহার বিছানার নিকট হইতে দুটি সপ বিছাইয়া একঘর লোক বসিয়া, আর নানারকম আজে-বাজে কথা হইতেছে—যেমন, ছবি আঁকার কথা (কারণ চিত্রবিদ্যাকুশল অনুদা বাগচী সেদিন সেখানে ছিল), সেকরার দোকানে সোনারূপা গলানর কথা(১) ইত্যাদি। অনেকক্ষণ বসিয়া থাকিলাম, (ঐরূপ কথা ভিন্ন) একটিও ভাল কথা হইল না! ভাবিতে লাগিলাম, আজ এই নূতন লোকটিকে লইয়া আসিলাম আর আজই যত আজেবাজে কথা! ও (উপেন) ঠাকুরের সম্বন্ধে কিরূপ ভাব লইয়া যাইবে!–ভাবিয়া আমার মুখ শুষ্ক হইতে লাগিল এবং মধ্যে মধ্যে উপেনের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাইয়া দেখিতে লাগিলাম। কিন্তু যতবার দেখিলাম, দেখিলাম তাহার মুখ বেশ প্ৰসন্ন—যেন ঐ সকল কথায় সে বেশ আনন্দ পাইতেছে। তখন ইসারা করিয়া তাহাকে উঠিতে বলিলাম, সে তাহাতে আর একটু বসিতে ইশারায় জানাইল। ঐরূপে দুই-তিন বার ইসারা করার পরে সে উঠিয়া আসিল। তখন তাহাকে বলিলাম, “কি শুনছিলি এতক্ষণ? ঐসব কথায় শুনিবার কি আছে বল দেখি? সাধে তোকে ‘বাঙাল’ বলি!” তাহার কপালে একটি উলকির টিপ ছিল বলিয়া তাহাকে আমরা ঐরূপ বলিতাম। সে বলিল, “না হে, বেশ শুনিতেছিলাম। পূর্বে universal love (সকলের প্রতি সমান ভালবাসা) কথাটা শুনেছি, কিন্তু কাহাতেও উহার প্রকাশ দেখি নাই। সকল বিষয় লইয়া সকলের সঙ্গে উহাকে (ঠাকুরকে) আনন্দ করিতে দেখিয়া আজ তাহা প্রত্যক্ষ করিলাম। কিন্তু আর একদিন আসিতে হইবে—আমার তিনটি প্রশ্ন আছে, জিজ্ঞাসা করিব”।

“তাহার পর একদিন প্রাতে উপেনকে লইয়া যাইলাম। তখন ঠাকুরের নিকটে বড় একটা কেহ নাই-কেবল, সেবকদিগের দুই-এক জন ও আমার ভগ্নীপতি ‘মল্লিক মহাশয়’ ছিলেন। যাইবার পূৰ্বে উপেনকে পৈ-পৈ করিয়া বলিয়া দিয়াছিলাম, ‘যাহা জিজ্ঞাসা করিবার স্বয়ং করিবি, তাহা হইলে মনের মত উত্তর পাইবি; কাহাকেও দিয়া প্রশ্নগুলি জিজ্ঞাসা করাইবি না’। কিন্তু সে মুখচোরা ছিল, যাহা বারণ করিয়াছিলাম এখানে আসিয়া তাহাই করিয়া বসিল-মল্লিক মহাশয়ের দ্বারা প্রশ্ন করাইল। ঠাকুর উত্তর করিলেন, কিন্তু উপেনের মুখের ভাবে বুঝিলাম উত্তরটি তাহার মনের মত হইল না। তখন আমি তাহাকে পুনরায় চুপি-চুপি বলিলাম, ‘ঐরূপ ত হবেই, আমি যে তোকে বার বার বলে এলাম, যা জিজ্ঞাসা করবার আপনি করবি; নিজে জিজ্ঞাসা কর না, মোক্তার ধরেছিস কেন?’

(১) সেকরাদিগের সোনারূপা চুরি করিবার দক্ষতা সম্বন্ধে ঠাকুর আমাদিগকে একটি মজার গল্প সময়ে সময়ে বলিতেন। অতুল বাবু এখানে এ গল্পটির ইঙ্গিত করিয়াছেন। গল্পটি ইহাই–কয়েকজন বন্ধু সমভিব্যাহারে এক ব্যক্তি একখানি গহনা বিক্রয়ের জন্য এক স্বর্ণকারের দোকানে উপস্থিত হইয়া দেখিল, তিলকাঙ্কিত সর্বাঙ্গ শিখামাল্যধারী বৃদ্ধ স্বর্ণকার সম্মুখে বলিয়া গম্ভীরভাবে হরিনাম করিতেছে এবং তাহার তিন-চার জন সহকারী ঐরূপ তিলকমালাদি ধারণ করিয়া গৃহমধ্যে নানাবিধ অলঙ্কারগঠনে নিযুক্ত আছে। বৃদ্ধ স্বর্ণকার ও তাহার সহকারীদিগের সাত্ত্বিক বেশভূষা দেখিয়া ঐ ব্যক্তি ও তাহার বন্ধুগণ ভাবিল—ইহারা ধার্মিক, আমাদিগকে ঠকাইবে না। পরে যে অলঙ্কারখানি তারা বিক্রয় করিতে আসিয়াছিল তাহা বৃদ্ধের সম্মুখে রাখিয়া উহার প্রকৃত মূল্য নির্ধারণের জন্য অনুরোধ করিল। বৃদ্ধও তাহাদিগকে সাদরে বসাইয়া একজন সহকারীকে তামাকু দিতে বলিল এবং কষ্টিপাথরে কষিয়া অলঙ্কারের স্বর্ণের দাম বলিয়া তাহাদিগের অনুমতি গ্রহণপূর্বক উহাঁ গলাইবার নিমিত্ত গৃহমধ্যস্থ এক সহকারীর হস্তে প্রদান করিল। সেও উহা তৎক্ষণাৎ গলাইতে আরম্ভ করিয়া সহসা দেবতার স্মরণপুর্বক বলিয়া উঠিল, ‘কেশব, কেশব’। ঈশ্বয়ীয় ভাবের উদ্দীপনায় বৃদ্ধও সঙ্গে সঙ্গে বলিয়া উঠিল, ‘গোপাল, গোপাল’। গৃহমধ্যস্থ এক সহকারী উহার পরেই বলিয়া উঠিল, ‘হরি, হরি, হরি’। যে তামাকু আনিয়াছিল সে ইতিমধ্যে কলিকাটি আগন্তুকদিগকে প্রদানপূর্বক গৃহমধ্যে প্রবেশ করিতে করিতে বলিয়া উঠিল, ‘হর, হর, হর’। ঐরূপ বলিবামাত্র প্ৰথমোক্ত সহকারী কতকটা গলিত স্বর্ণ সম্মুখস্থ বারিপূর্ণ পাত্রে দক্ষতার সহিত নিক্ষেপ করিয়া আত্মসাৎ করিল। স্বর্ণকার ও তাহার সহকারিগণ শ্রীভগবানের পূর্বোক্ত নামসকল যে ভিন্নার্থে ব্যবহার করিতেছে, অর্থাৎ ‘কেশব’ না বলিয়া ‘কে সব’—-ইহারা চতুর অথবা নির্বোধ, এই কথা জিজ্ঞাসা করিতেছে এবং ঐ প্রশ্নের উত্তররূপেই ‘গোপাল’ অথবা গরুর পালের ন্যায় নির্বোধ, এই কথা বলিতেছে এবং ‘হরি’ ও ‘হর’ শব্দদ্বয় ‘অপহরণ করি’ ও ‘কর’ এই অর্থে উচ্চারণ করিতেছে—একথা বুঝিতে না পারিয়া আগন্তুক ব্যক্তিগণ ইহাদিগের ভক্তি ও ধর্মনিষ্ঠায় প্রীত হইয়া নিশ্চিন্তমনে তামাকু সেবন করিতে লাগিল। অনন্তর গলিত স্বর্ণ ওজন করাইয়া উহার মূল্য লইয়া তাহারা প্রসন্নমনে গৃহে প্রত্যাবর্তন করিল।

ঠাকুরের পরম ভক্ত অধরচন্দ্র সেনের ভবনে বঙ্গের সুপ্রসিদ্ধ ঔপন্যাসিক শ্ৰীযুত বঙ্কিমচন্দ্রের সহিত যেদিন তাহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল, সেদিন বঙ্কিম বাবু সন্দেহবাদীর পক্ষাবলম্বনপূর্বক ঠাকুরকে ধর্মবিষয়ক নানা কূট প্রশ্ন করিয়াছিলেন। ঠাকুর ঐ সকলের যথাযথ উত্তর দিবার পরে বঙ্কিমচন্দ্রকে পরিহাসপূর্বক বলিয়াছিলেন, “তুমি নামেও বঙ্কিম, কাজেও বঙ্কিম।” প্রশ্নসকলের হৃদয়স্পর্শী উত্তর লাভে প্রীত হইয়া বঙ্কিম বাবু বলিয়াছিলেন, “মহাশয়, আপনাকে একদিন আমাদের কাঁঠালপাড়া বাটীতে যাইতে হইবে, সেখানে ঠাকুরসেবার বন্দোবস্ত আছে এবং আমরা সকলেও হরিনাম করিয়া থাকি।” ঠাকুর তাহাতে রহস্যপূর্বক বলিয়াছিলেন, “কেমনতর হরিনাম গো, সেকরাদের মত নয় ত?”–-বলিয়াই পূর্বোক্ত গল্পটি বঙ্কিমচন্দ্রকে বলিয়াছিলেন এবং সভামধ্যে হাস্যের রোল উঠিয়াছিল।

ঈশ্বর সাকার নিরাকার দুই-ই—যেমন জল আর বরফ

        “সাহস করিয়া সে এইবার স্বয়ং জিজ্ঞাসা করিল, ‘মহাশয়, ঈশ্বর সাকার না নিরাকার? আর যদি দুই-ই হন, তাহা হলে একসঙ্গে ঐরূপ সম্পূর্ণ বিপরীত ভাবের দুই কেমন করিয়া হইতে পারেন? ঠাকুর শুনিয়াই বলিলেন, ‘তিনি (ঈশ্বর) সাকার নিরাকার দুই-ই—যেমন জল, আর বরফ’। উপেন কলেজে বিজ্ঞান (Science course) লইয়াছিল, তজ্জন্য ঠাকুরের পূর্বোক্ত দৃষ্টান্ত তাহার মনের মত হইল এবং উহার সহায়ে সে তাহার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর পাইয়া আনন্দিত হইল। ঐ প্রশ্নটি করিয়াই কিন্তু সে নিরস্ত হইল এবং কিছুক্ষণ পরে ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিল। বাহিরে আসিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “উপেন, তুমি তিনটি প্রশ্নের কথা বলিয়াছিলে, একটি মাত্র জিজ্ঞাসা করিয়াই উঠিয়া আসিলে কেন?” সে তাহাতে বলিল, “তাহা বুঝি বুঝ নাই—ঐ এক উত্তরে আমার তিনটি প্রশ্নেরই মীমাংসা হইয়া গিয়াছে”।

রামদাদার কথায় অতুলের বিরক্তি

“তোমার মনে আছে বোধ হয়, রামদাদা(১) এই সময়ে প্রায়ই বাটীতে সকাল সকাল আহারাদি করিয়া আফিসের কাপড় চোপড় সঙ্গে লইয়া ঠাকুরের নিকটে আসিতেন এবং দুই এক ঘণ্টা এখানে কাটাইয়া বেশপরিবর্তনপূর্বক কর্মস্থলে চলিয়া যাইতেন। ঠাকুর যখন আজ উপেনের প্রশ্নের উত্তর দিতেছেন, তখন তিনি আফিসে যাইবার বেশ পরিতে পরিতে ঐ ঘরে সহসা আসিয়া ঠাকুরের কথাগুলি শুনিয়াছিলেন। আমরা যেমন বাহিরে আসিয়াছি অমনি রামদাদা বলিয়া উঠিলেন, “অতুলদাদা, ওঁকে (উপেনকে) এদিকে নিয়ে এস; ঠাকুর ওঁর প্রশ্নের উত্তরে বড় শক্ত কথা বলিয়াছেন, উনি বুঝিতে পারিবেন না। আমার এই বইখানা ওঁকে পড়িতে হইবে, তবে উনি ঠাকুরের ঐকথা বুঝিতে পারিবেন”। ঐকথা শুনিয়া আমার ভারি রাগ হইল, বলিয়া ফেলিলাম, ‘রামদাদা, তুমি না আমাদের চেয়ে সাত বৎসর আগে ঠাকুরকে দেখেছ ও তার কাছে যাওয়া আসা করছ? উনি (ঠাকুর) যা বললেন তা বুঝতে পারবে না, আর তোমার বই পড়ে উনি যা বোঝাতে পারলেন না তা বুঝতে পারবে! এটা তোমার কেমনতর কথা? তবে উপেনকে তোমার বইখানা পড়তে দেবে দাও-সেটা আলাদা কথা’। রামাদাদা ঐ কথায় একটু অপ্রস্তুত হইয়া পুস্তকখানি উপেনকে দিলেন।”

————
(১) শ্রীরামচন্দ্র দত্ত-প্রণীত ‘তত্ত্বপ্রকাশিকা’। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *