৫.১২.১ ঠাকুরের শ্যামপুকুরে অবস্থান (প্রথম পাদ)

পঞ্চম খণ্ডদ্বাদশ অধ্যায় – প্রথম পাদ : ঠাকুরের শ্যামপুকুরে অবস্থান

শ্যামপুকুরের বাটীর পরিচয়

ঠাকুরের জন্য যে বাটীখানি এখন ভাড়া লওয়া হইল, উহা পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত শ্যামপুকুর ষ্ট্রীটের উত্তরপার্শ্বে অবস্থিত। উত্তরমুখে বাটীতে প্রবেশ করিয়াই বামে ও দক্ষিণে বসিবার চাতাল ও স্বল্পপরিসর ‘রক’ দেখা যাইত। উহা ছাড়াইয়া কয়েক পদ অগ্রসর হইলেই ডাহিনে দ্বিতলে উঠিবার সিঁড়ি ও সম্মুখে উঠান। উঠানের পূর্বদিকে দুই তিনখানি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘর। সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়াই দক্ষিণভাগে উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত একখানি লম্বা ঘর, উহাই সৰ্বসাধারণের জন্য নির্দিষ্ট ছিল এবং বামে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত ঘরগুলিতে যাইবার পথ। উক্ত পথ দিয়া প্রথমেই বৈঠকখানা ঘর নামে অভিহিত সুপ্রশস্ত ঘরখানিতে ঢুকিবার দ্বার—এই ঘরে ঠাকুর থাকিতেন। উহার উত্তরে ও দক্ষিণে বারান্দা, তন্মধ্যে উত্তরের বারাণ্ডা প্রশস্ততর ছিল এবং পশ্চিমে ছোট ছোট দুইখানি ঘর—একখানিতে ভক্ত দিগের কেহ কেহ রাত্রিতে শয়ন করিত এবং অপরখানি শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীর রাত্রিবাসের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। তদ্ভিন্ন সাধারণের নিমিত্ত নির্দিষ্ট ঘরখানির পশ্চিমে স্বল্পপরিসর বারাণ্ডা, ঠাকুরের ঘরে যাইবার পথের পূর্বপার্শ্বে ছাদে উঠিবার সিঁড়ি এবং ছাদে যাইবার দরজার পার্শ্বে চারি হাত আন্দাজ লম্বা ও ঐরূপ প্রশস্ত একটি আচ্ছাদনযুক্ত চাতাল ছিল। শ্রীশ্ৰীমাতাঠাকুরাণী ঐ চাতালটিতেই সমস্ত দিবস অতিবাহিত করিতেন এবং ঐ স্থানেই ঠাকুরের জন্য প্রয়োজনীয় পথ্যাদি রন্ধন করিতেন। ভাদ্র মাসের শেষার্ধের কোন সময়ে ইংরেজী ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরের প্রারম্ভে ঠাকুর বলরামের বাটী হইতে এখানে আসিয়া কিঞ্চিদধিক তিন মাস কাল অতিবাহিত করিয়াছিলেন এবং অগ্রহায়ণ শেষ হইবার দুই-এক দিন থাকিতে কাশীপুরের বাগানবাটীতে উঠিয়া গিয়াছিলেন।

ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের চিকিৎসার ভার গ্রহণ

শ্যামপুকুরের বাটীতে আসিবার কয়েক দিন পরেই ভক্তগণ পূর্বপরামর্শমত ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারকে ঠাকুরের চিকিৎসার্থ আনয়ন করিল। মথুর বাবু জীবিত থাকিবার কালে তাহার পরিবারবর্গের চিকিৎসার জন্য ডাক্তার কয়েকবার দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া ঠাকুরের সহিত সামান্যভাবে পরিচিত হইয়াছিলেন, কিন্তু সে অনেক দিনের কথা, লব্ধপ্রতিষ্ঠ ডাক্তারের উহা মনে না থাকাই সম্ভব, ঐ জন্য কাহাকে দেখিতে আসিতেছেন তাহা না বলিয়াই ভক্তগণ তাহাকে ডাকিয়া আনিয়াছিলেন। দেখিবামাত্র তিনি কিন্তু ঠাকুরকে চিনিতে পারিয়াছিলেন এবং বহু যত্নে পরীক্ষা ও রোগ নির্ণয়পূর্বক ঔষধ-পথ্যের ব্যবস্থা করিবার পরে দক্ষিণেশ্বর-কালীবাটী সম্বন্ধীয় কথা ও ধৰ্মালাপে স্বল্পকাল অতিবাহিত করিয়া তাহার নিকটে সেদিন বিদায় গ্রহণ করিয়াছিলেন। যতদূর স্মরণ আছে, ডাক্তার ঐদিন ভক্তগণকে প্রত্যহ প্রাতে ঠাকুরের শারীরিক অবস্থার সংবাদ তাঁহাকে জানাইয়া আসিতে বলিয়াছিলেন এবং যাইবার কালে তাহারা তাহাকে নিয়মিত পারিশ্রমিক প্রদান করিলে উহা গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় দিবস ঠাকুরকে দেখিতে আসিয়া যখন তিনি কথায় কথায় জানিতে পারিলেন, ভক্তগণই তাহাকে চিকিৎসাৰ্থ কলিকাতায় আনয়নপূর্বক ব্যয় নিৰ্বাহ করিতেছে, তখন তাহাদিগের গুরুভক্তিদর্শনে প্রীত হইয়া আর পারিশ্রমিক গ্রহণ করিলেন না-বলিলেন, “আমি বিনা পারিশ্রমিকে যথাসাধ্য চিকিৎসা করিয়া তোমাদিগের সৎকার্যে সহায়তা করিব।”

পথ্য ও রাত্রে সেবার বন্দোবস্তের পরামর্শ

ঐরূপে সুবিজ্ঞ চিকিৎসকের সহায়তালাভ করিয়াও ভক্তগণ নিশ্চিন্ত হইতে পারিল না। কয়েক দিনের মধ্যেই তাহারা বুঝিতে পারিল বিশেষ সতর্কতার সহিত পথ্য প্রস্তুত করিবার এবং দিবসের ন্যায় রাত্রিকালেও ঠাকুরের আবশ্যক মত সেবা করিবার জন্য লোক নিযুক্ত করা প্রয়োজন। কেবলমাত্র ব্যয়নিৰ্বাহ করিয়া ঐ দুই অভাবের একটিও যথাযথ নিবারিত হইবার নহে ভাবিয়া তাহারা তখন দক্ষিণেশ্বর হইতে শ্ৰীশ্ৰীমাতাঠাকুরাণীকে আনয়নপূর্বক প্রথমটি এবং ঠাকুরের বালক-ভক্তগণের সহায়তায় দ্বিতীয়টি মোচনের পরামর্শ স্থির করিল। ঐ অভাবদ্বয়ের ঐরূপে নিরাকরণের পথে কিন্তু বিষয় অন্তরায় দেখা যাইল। কারণ, বাটীতে স্ত্রীলোকদিগের থাকিবার জন্য নির্দিষ্ট অন্দরমহল না থাকায় শ্রীশ্রীমা এখানে কিরূপে একাকিনী আসিয়া থাকিবেন তদ্বিষয় বুঝিয়া উঠা দুষ্কর হইল এবং স্কুল-কলেজের ছাত্র বালক-ভক্তগণ ঠাকুরের সেবার নিমিত্ত এখানে আসিয়া নিত্য রাত্র-জাগরণাদি কৰিলে অভিভাবকদিগের বিষম অসন্তোষের উদয় হইবে, একথা হৃদয়ঙ্গম করিতে কাহারও বিলম্ব হইল না।

শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীর লজ্জাশীলতার দৃষ্টান্ত

শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীর অপূর্ব লজ্জাশীলতার কথা স্মরণ করিয়াও ভক্তগণের অনেকে তাহার আগমন সম্বন্ধে বিশেষ সন্দিহান হইল। দক্ষিণেশ্বর উদ্যানের উত্তরের নহবতখানায় অবস্থানপূর্বক ঠাকুরের সেবায় নিত্য নিযুক্তা থাকিলেও দুই-চারি জন বালক-ভক্ত ভিন্ন–যাহাদিগের সহিত ঠাকুর স্বয়ং তাঁহাকে পরিচিত করাইয়া দিয়াছিলেন–অপর কেহ এতকাল কখন তাঁহার শ্রীচরণদর্শন অথবা বাক্যালাপ শ্রবণ করে নাই। ঐ স্বল্পপরিসর স্থানে সমস্ত দিবস থাকিয়া ঠাকুরের ও ভক্তগণের নিমিত্ত অন্ন-ব্যঞ্জনাদি খাদ্যদ্রব্যসকল দুই বেলা প্রস্তুত করিয়া দিলেও, ঐ স্থানে কেহ যে ঐরূপ কার্যে নিযুক্ত আছেন তাহা কেহই বুঝিতে পারিত না। রাত্রি ৩টা বাজিবার স্বল্পকাল পরে অন্য কেহ উঠিবার বহু পূর্বে প্রতিদিন শয্যাত্যাগপূৰ্ব্বক শৌচ-স্নানাদি সমাপন করিয়া তিনি সেই যে গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইতেন, সমস্ত দিবস আর বহির্গত হইতেন না—নীরবে, নিঃশব্দে অদ্ভুত ত্রস্ততার সহিত সকল কার্য সম্পন্ন করিয়া পূজা-জপ-ধ্যানে নিযুক্ত থাকিতেন। অন্ধকার রাত্রে নহবতখানার সম্মুখস্থ বকুলতলার ঘাটের সিঁড়ি বাহিয়া গঙ্গায় অবতরণ করিবার কালে তিনি একদিবস এক প্রকাণ্ড কুম্ভীরের গাত্রে প্রায় পদার্পণ করিয়াছিলেন—কুম্ভীর ডাঙ্গায় উঠিয়া সোপানের উপর শয়ন করিয়াছিল, তাহার সাড়া পাইয়া জলে লাফাইয়া পড়িল! তদবধি সঙ্গে আলো না লইয়া তিনি কখন ঘাটে নামিতেন না।

শ্রীশ্রীমাকে শ্যামপুকুরে আনিবার প্রস্তাব

এতকাল ঐস্থানে থাকিয়াও যিনি ঐরূপে কখন কাহারও দৃষ্টি মুখে পতিত হয়েন নাই, সর্বপ্রকার সঙ্কোচ ও লজ্জা সহসা পরিত্যাগপূর্বক তিনি কিরূপে এই বাটীতে পুরুষদিগের মধ্যে আসিয়া সর্বক্ষণ বাস করিবেন-ইহা ভক্তগণের কেহই ভাবিয়া স্থির করিতে পারিল না। অথচ উপায়ান্তর না দেখিয়া তাহারা তাহাকে আনিবার প্রস্তাব ঠাকুরের নিকট উপস্থিত করিতে বাধ্য হইল। ঠাকুর তাহাতে শ্ৰীশ্ৰীমার পূর্বোক্ত প্রকার স্বভাবের কথা স্মরণ করাইয়া বলিলেন, “সে কি এখানে আসিয়া থাকিতে পারিবে? যাহা হউক, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখ, সকল কথা জানিয়া শুনিয়া সে আসিতে চাহে ত আসুক।” দক্ষিণেশ্বরে শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীর নিকটে লোক প্রেরিত হইল।

শ্রীশ্রীমার দেশ-কাল-পাত্রানুযায়ী কার্য্য করিবার শক্তি

‘যখন যেমন তখন তেমন, যেখানে যেমন সেখানে তেমন, যাহাকে যেমন তাহাকে তেমন’-ঠাকুর বলিতেন, ঐরূপে দেশকাল-পাত্র-ভেদ বিবেচনাপূর্বক সংসারে সকল বিষয়ের অনুষ্ঠান করিতে এবং আপনাকে না চালাইতে পারিলে শান্তি লাভে, অথবা নিজ অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছিতে কেহ সমর্থ হয় না। সঙ্কোচ ও লজ্জারূপ আবরণের দুর্ভেদ্য অন্তরালে সৰ্বথা অবস্থান করিলেও শ্রীশ্রীমাতা ঠাকুরাণী ঠাকুরের নিকটে পূর্বোক্ত উপদেশ লাভ করিয়া নিজজীবন নিয়মিত করিতে শিক্ষা করিয়াছিলেন। প্রয়োজন উপস্থিত হইলে তিনি পূর্ব সংস্কার ও অভ্যাসের আবরণসমূহ হইতে আপনাকে নিষ্ক্রান্ত করিয়া নির্ভয়ে যথাযথ আচরণে কতদূর সমৰ্থা ছিলেন, তাহা তাহার দক্ষিণেশ্বরে প্রথমাগমনের বিবরণে(১) এবং নিম্নলিখিত ঘটনা হইতে পাঠকের সম্যক্ হৃদয়ঙ্গম হইবে–

———————
(১) ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ-সাধকভাব’–বিংশ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।

কামারপুকুর হইতে দক্ষিণেশ্বরে আসিবার পথ

স্বল্পব্যয়সাধ্য যানাভাব, অর্থাভাব প্রভৃতি নানা কারণে শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীকে তৎকালে অনেক সময়ে জয়রামবাটী ও কামারপুকুর হইতে দক্ষিণেশ্বরে পদব্রজে আসিতে হইত। ঐরূপে আসিতে হইলে জাহানাবাদ (আরামবাগ) পৰ্য্যন্ত অগ্রসর হইয়া পথিকগণকে চারি-পাঁচ ক্রোশব্যাপী তেলোভেলোর মাঠ উত্তীর্ণ হইয়া তারকেশ্বরে, এবং তথা হইতে কৈকলার মাঠ উত্তীর্ণ হইয়া বৈদ্যবাটীতে আসিয়া গঙ্গা পার হইতে হইত। ঐ বিস্তীর্ণ প্রান্তরদ্বয়ে তখন ডাকাইতগণের ঘাঁটি ছিল। প্রাতে, মধ্যাহ্নে, প্রদোষে অনেক পথিকের এখানে তাহাদিগের হস্তে প্রাণ হারাইবার কথা এখনও শুনিতে পাওয়া যায়। প্রায় পাশাপাশি অবস্থিত তেলো-ভেলো নামক ক্ষুদ্র গ্রামদ্বয়ের এক ক্রোশ আন্দাজ দূরে প্রান্তরের মধ্যভাগে করালবদনা, সুভীষণা এক কালীমূর্তির এখনও দর্শন মিলিয়া থাকে। জনসাধারণের নিকট ইনি তেলোভেলোর ‘ডাকাতে কালী’ ৎনামে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। লোকে বলে, ইহাকে পূজা করিয়া ডাকাতেরা নরহত্যারূপ নৃশংস কার্যে অগ্রসর হইত। ডাকাইতের হস্ত হইতে রক্ষা পাইবার জন্য পথিকেরা ঐসময়ে দলবদ্ধ না হইয়া এই প্রান্তরদ্বয় অতিক্রম করিতে সাহসী হইত না।

শ্রীশ্রীমার পদব্রজে তারকেশ্বরে আগমনকালে ঘটনা

ঠাকুরের মধ্যমাগ্রজ রামেশ্বরের কন্যা ও কনিষ্ঠ পুত্র এবং অপর কয়েকটি স্ত্রী-পুরুষের সহিত শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণী এক সময়ে পদব্রজে কামারপুকুর হইতে দক্ষিণেশ্বরে আগমন করিতেছিলেন। আরামবাগে পৌঁছিয়া তেলোভেলোর প্রান্তর সন্ধ্যার পূর্বে পার হইবার যথেষ্ট সময় আছে ভাবিয়া তাহার সঙ্গিগণ ঐ স্থানে অবস্থান ও রাত্রিযাপনে অনিচ্ছা প্রকাশ করিতে লাগিল। পথশ্রমে ক্লান্তি অনুভব করিলেও শ্রীশ্রীমা তজ্জন্য ঐ বিষয়ে কাহাকেও না বলিয়া তাহাদিগের সহিত অগ্রসর হইলেন। কিন্তু দুই ক্রোশ পথ যাইতে না যাইতেই দেখা গেল, তিনি সঙ্গীদিগের সহিত সমভাবে চলিতে না পারিয়া পিছাইয়া পড়িতেছেন। তখন তাঁহার নিমিত্ত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া এবং তিনি নিকটে আসিলে তাহাকে দ্রুত চলিতে বলিয়া তাহারা পুনরায় গন্তব্য পথে চলিতে লাগিল। অনন্তর প্রান্তর মধ্যে আসিয়া তাহারা দেখিল, তিনি আবার সকলের বহু পশ্চাতে ধীরে ধীরে আগমন করিতেছেন। আবার তাহারা তাহার নিমিত্ত এখানে অপেক্ষা করিয়া রহিল এবং তিনি নিকটে আসিলে বলিল, এইরূপে চলিলে এক প্রহর রাত্রির মধ্যেও প্রান্তর পার হইতে পারা যাইবে না ও সকলকে ডাকাতের হস্তে পড়িতে হইবে। এতগুলি লোকের অসুবিধা ও আশঙ্কার কারণ হইয়াছেন দেখিয়া শ্ৰীশ্ৰীমা তখন তাহাদিগকে তাহার নিমিত্ত পথিমধ্যে অপেক্ষা করিতে নিষেধ করিয়া বলিলেন, “তোমরা একেবারে তারকেশ্বরের চটিতে পৌঁছিয়া বিশ্রাম কর গে, আমি যত শীঘ্র পারি তোমাদিগের সহিত মিলিত হইতেছি।” বেলা অধিক নাই দেখিয়া এবং তাহার ঐকথার উপর নির্ভর করিয়া সঙ্গিগণ আর কালবিলম্ব করিল না, অধিকতর বেগে পথ অতিক্রম পূৰ্ব্বক শীঘ্রই দৃষ্টির বহির্ভূত হইয়া যাইল।

তেলোভেলোর প্রান্তরে

শ্ৰীশ্ৰীমা তখন যথাসাধ্য দ্রুতপদে চলিতে লাগিলেন, কিন্তু শরীর নিতান্ত অবসন্ন হওয়ায় তাহার প্রান্তরমধ্যে পৌঁছিবার কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যা উপস্থিত হইল। বিষম চিন্তিত হইয়া তিনি কি করিবেন ভাবিতেছেন, এমন সময় দেখিলেন দীর্ঘাকার ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ এক পুরুষ যষ্টি স্কন্ধে লইয়া তাহাকে লক্ষ্য করিয়া দ্রুতপদে অগ্রসর হইতেছে। তাহার পশ্চাতে দূরে তাহার সঙ্গীর ন্যায় এক ব্যক্তিও আসিতেছে বলিয়া বোধ হইল। পলায়ন বা চীৎকার করা বৃথা বুঝিয়া শ্ৰীশ্রীমা তখন স্থিরভাবে দণ্ডায়মান থাকিয়া উহাদিগের আগমন সশঙ্কচিত্তে প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।

বাগদি পাইক ও তাহার পত্নী

কয়েক মুহূর্ত মধ্যে ঐ পুরুষ নিকটে আসিয়া তাহাকে কর্কশস্বরে প্রশ্ন করিল, “কে গা এ সময়ে এখানে দাঁড়াইয়া আছ?” শ্ৰীশ্ৰীমা তখন তাহাকে প্রসন্ন করিবার আশয়ে পিতৃসম্বোধনপূৰ্ব্বক একেবারে তাহার শরণাপন্ন হইয়া বলিলেন, “বাবা, আমার সঙ্গিগণ আমাকে ফেলিয়া গিয়াছে, বোধ হয় আমি পথও ভুলিয়াছি, তুমি আমাকে সঙ্গে করিয়া যদি তাহাদিগের নিকটে পৌঁছাইয়া দাও। তোমার জামাই দক্ষিণেশ্বরে রাণী রাসমণির কালীবাটীতে থাকেন, আমি তাহার নিকটেই যাইতেছি, তুমি যদি সেখান পর্যন্ত আমাকে লইয়া যাও তাহা হইলে তিনি তোমাকে বিশেষ সমাদর করিবেন।” ঐ কথাগুলি বলিতে না বলিতে পূর্বোক্ত দ্বিতীয় ব্যক্তিও তথায় উপস্থিত হইল এবং শ্ৰীশ্ৰীমা দেখিলেন সে পুরুষ নহে রমণী, প্রথমাগত পুরুষের পত্নী। ঐ রমণীকে দেখিয়া বিশেষ আশ্বস্ত হইয়া শ্ৰীশ্রীমা তখন তাহার হস্তধারণ ও মাতৃ-সম্বোধনপূর্বক বলিলেন, “মা, আমি তোমার মেয়ে সারদা, সঙ্গীরা ফেলিয়া যাওয়ায় বিষম বিপদে পড়িয়াছিলাম; ভাগ্যে বাবা ও তুমি আসিয়া পড়িলে, নতুবা কি করিতাম বলিতে পারি না।”

তেলোভেলোয় রাত্রিবাস এবং পাইক ও তাহার পত্নীর যত্ন

শ্ৰীশ্ৰীমার ঐরূপ নিঃসঙ্কোচ সরল ব্যবহার, একান্ত বিশ্বাস ও মিষ্ট কথায় বাগদি পাইক ও তাহার পত্নীর প্রাণ এককালে বিগলিত হইল। সামাজিক আচার ও জাতির কথা ভুলিয়া তাহারা সত্যসত্যই আপনাদিগের কন্যার ন্যায় দেখিয়া তাহাকে অশেষ সান্ত্বনা প্রদান করিতে লাগিল! পরে তাহার শারীরিক অবসন্নতার কথা আলোচনা করিয়া তাহারা তাহাকে গন্তব্য পথে অগ্রসর হইতে না দিয়া সমীপবর্তী তেলোভেলো গ্রামের এক ক্ষুদ্র দোকানে লইয়া যাইয়া রাত্রিবাসের বন্দোবস্ত করিল। রমণী নিজ বস্ত্রাদি বিছাইয়া তাঁহার নিমিত্ত শয্যা প্রস্তুত করিল এবং পুরুষ দোকান হইতে মুড়িমুড়কি কিনিয়া তাহাকে ভোজন করিতে দিল। ঐরূপে পিতা মাতার ন্যায় আদর ও স্নেহে তাহাকে ঘুম পাড়াইয়া ও রক্ষা করিয়া তাহারা সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত করিল এবং প্রত্যুষে উঠাইয়া সঙ্গে লইয়া দুই-চারি দণ্ড বেলা হইলে তারকেশ্বরে উপস্থিত হইয়া এক দোকানে আশ্রয় গ্রহণপূর্বক তাহাকে বিশ্রাম করিতে বলিল। অনন্তর রমণী তাহার স্বামীকে সম্বোধন করিয়া বলিল, “আমার মেয়ে কাল কিছুই খাইতে পায় নাই, বাবার (তারকনাথের) পূজাদি শীঘ্রই সারিয়া বাজার হইতে মাছ, তরিতরকারি লইয়া আইস, আজ তাহাকে ভাল করিয়া খাওয়াইতে হইবে।”

তারকেশ্বরে পৌঁছিবার পরে ও পাইকের সহিত বিদায় কালে

পুরুষ ঐসকল কর্ম করিতে চলিয়া যাইলে শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীর সঙ্গী ও সঙ্গিনীগণ তাহাকে অন্বেষণ করিতে করিতে তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল এবং তিনি নিরাপদে পৌঁছিয়াছেন দেখিয়া আনন্দ প্রকাশ করিতে লাগিল। তখন শ্ৰীশ্রীমা তাঁহার রাত্রে আশ্রয়দাতা পিতামাতার সহিত তাহাদিগকে পরিচিত করাইয়া বলিলেন, “ইহারা আসিয়া আমাকে না রক্ষা করিলে কাল রাত্রে কি যে করিতাম তাহা বলিতে পারি না।” অনন্তর পূজা, রন্ধন ও ভোজনাদি শেষ করিয়া কিছুক্ষণ ঐস্থানে বিশ্রামপূর্বক সকলে বৈদ্যবাটী অভিমুখে যাত্রা করিবার জন্য প্রস্তুত হইলে শ্ৰীশ্ৰীমাতা ঠাকুরাণী ঐ পুরুষ ও রমণীকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাইয়া বিদায় প্রার্থনা করিলেন। শ্ৰীশ্ৰীমা বলেন, “এক রাত্রের মধ্যে আমরা পরস্পরকে এতদূর আপনার করিয়া লইয়াছিলাম যে, বিদায় গ্রহণকালে ব্যাকুল হইয়া অজস্র ক্রন্দন করিতে লাগিলাম। অবশেষে সুবিধামত দক্ষিণেশ্বরে আমাকে দেখিতে আসিতে পুনঃ পুনঃ অনুবোধপূর্বক ঐকথা স্বীকার করাইয়া লইয়া অতি কষ্টে তাহাদিগকে ছাড়িয়া আসিলাম। আসিবার কালে তাহারা অনেক দূর পর্যন্ত আমাদিগের সঙ্গে আসিয়াছিল, এবং রমণী পার্শ্ববর্তী ক্ষেত্র হইতে কতকগুলি কলাইশুটি তুলিয়া দিতে দিতে আমার অঞ্চলে বাঁধিয়া কাতরকণ্ঠে বলিয়াছিল, ‘মা সারদা, রাত্রে যখন মুড়ি খাইবি তখন এইগুলি দিয়া খাস’। পূর্বোক্ত অঙ্গীকার তাহারা রক্ষা করিয়াছিল। মিষ্টান্ন প্রভৃতি দ্রব্য লইয়া আমাকে দেখিতে মধ্যে মধ্যে কয়েকবার দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। উনিও (ঠাকুর) আমার নিকট হইতে সকল কথা শুনিয়া ঐ সময়ে তাহাদিগের সহিত জামাতার ন্যায় ব্যবহারে ও আদর-আপ্যায়নে তাহাদিগকে পরিতৃপ্ত করিয়াছিলেন। এখন সরল ও সচ্চরিত্র হইলেও আমার ডাকাত-বাবা পূর্বে কখন কখন ডাকাইতি যে করিয়াছিল একথা কিন্তু আমার মনে হয়।”

শ্রীশ্রীমা শ্যামপুকুরে আগমনপূর্বক যে ভাবে বাস করিয়াছিলেন

ডাক্তারের উপদেশমত সুপথ্য প্ৰস্তুত করিবার লোকাভাবে ঠাকুরের রোগবৃদ্ধির সম্ভাবনা হইয়াছে, শুনিবামাত্র শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণী আপনার থাকিবার সুবিধা অসুবিধার কথা কিছুমাত্র চিন্তা না করিয়া শ্যামপুকুরের বাটীতে আসিয়া ঐ ভার সানন্দে গ্রহণ করিলেন। একমহল বাটীতে, অপরিচিত পুরুষসকলের মধ্যে, সকল প্রকার শারীরিক অসুবিধা সহ্য করিয়া এখানে তিন মাস অবস্থানপূর্বক তিনি যে ভাবে নিজ কর্তব্য পালন করিয়াছিলেন, তাহা ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়। স্নানাদি করিবার একটি মাত্র স্থান সকলের নিমিত্ত নির্দিষ্ট থাকায় রাত্রি ৩টার পূর্বে শয্যাত্যাগপূৰ্ব্বক তিনি কখন যে ঐ সকল কৰ্ম্ম সমাপন করিয়া ত্রিতলে ছাদের সিঁড়ির পার্শ্বস্থ চাতালে উঠিয়া যাইতেন তাহা কেহ জানিতে পারিত না। সমস্ত দিবস তথায় অতিবাহিত করিয়া যথাসময়ে ঠাকুরের নিমিত্ত পথ্যাদি প্রস্তুতপূর্বক তিনি বৃদ্ধ স্বামী অদ্বৈতানন্দ (অধুনা পরলোকগত), অথবা স্বামী অদ্ভুতানন্দের দ্বারা ঐ সংবাদ নিম্নে প্রেরণ করিতেন—তখন সুবিধা হইলে লোক সরাইয়া তাঁহাকে উহা আনয়নপূর্বক ঠাকুরকে খাওয়াইতে বলা হইত, নতুবা আমরাই উহা লইয়া আসিতাম। মধ্যাহ্নে তিনি ঐস্থানে স্বয়ং আহার ও বিশ্রাম করিতেন এবং রাত্রি ১১টার সময় সকলে নিদ্রিত হইলে ঐস্থান হইতে নামিয়া দ্বিতলে তাহার নিমিত্ত নির্দিষ্ট গৃহে আসিয়া রাত্রি দুইটা পর্যন্ত শয়ন করিয়া থাকিতেন। ঠাকুরকে রোগমুক্ত করিবার আশায় বুক বাঁধিয়া তিনি দিনের পর দিন ঐরূপে কাটাইয়া দিতেন এবং এরূপ নীরবে নিঃশব্দে সর্বদা অবস্থান করিতেন যে, যাহারা প্রত্যহ এখানে আসা যাওয়া করিত তাহাদিগের অনেকেও জানিতে পারিত না তিনি এখানে থাকিয়া ঠাকুরের সর্বপ্রধান সেবাকাৰ্য্যের ভারগ্রহণ করিয়া রহিয়াছেন।

বালক ভক্তগণের ঠাকুরের সেবার ভার গ্রহণ

পথ্যের বিষয় ঐরূপে মীমাংসিত হইলে রাত্রিকালে ঠাকুরের সেবা করিবার লোকাভাব দূর করিবার জন্য ভক্তগণ মনোনিবেশ মত জগতের করিল। শ্ৰীযুত নরেন্দ্র তখন ঐ বিষয়ের ভার স্বয়ং গ্রহণপূর্বক রাত্রিকালে এখানে অবস্থান করিতে লাগিলেন এবং নিজ দৃষ্টান্তে উৎসাহিত করিয়া গোপাল (ছোট), কালী, শশী প্রভৃতি কয়েকজন কর্মঠ যুবক ভক্তকে ঐরূপ করিতে আকৃষ্ট করিলেন। ঠাকুরের প্রতি প্রেমে তাঁহার অসীম স্বার্থত্যাগ, প্রবল উত্তেজনাপূর্ণ পূত আলাপ ও পবিত্র সঙ্গে তাহারা সকলেও নিজ নিজ স্বার্থ পরিত্যাগপূর্বক শ্রী গুরুর সেবা এবং ঈশ্বরলাভরূপ উচ্চ উদ্দেশ্যে জীবন নিয়মিত করিতে দৃঢ় সঙ্কল্প করিল। তাহাদিগের অভিভাবকেরা যতদিন ঐকথা বুঝিতে না পারিলেন ততদিন পর্যন্ত শ্যামপুকুরের বাটীতে আসিয়া তাহা দিগের ঠাকুরের সেবা করিবার বিষয়ে আপত্তি করিলেন না। কিন্তু ঠাকুরের রোগবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যখন তাহারা সেবাকাৰ্য্যে সমগ্র প্রাণ ঢালিয়া দিয়া কলেজে অধ্যয়ন এবং নিজ নিজ বাটীতে আহার করিতে যাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করিল, তখন তাহাদিগের প্রাণে প্রথমে সন্দেহ এবং পরে আতঙ্ক উপস্থিত হওয়ায় তাঁহারা তাহাদিগকে ফিরাইবার জন্য ন্যায্য অন্যায্য নানা উপায় অবলম্বন করিতে লাগিলেন। নরেন্দ্রনাথের দৃষ্টান্ত, উত্তেজনা এবং উৎসাহ ভিন্ন তাহারা ঐ সকল বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করিয়া সর্বোচ্চ কর্তব্যপথে কখনই যে অচল অটল হইয়া থাকিতে পারিত না, একথা বলা বাহুল্য। ঐরূপে শ্যামপুকুরের বাটীতে চারি-পাঁচ জন মাত্র জীবনোসর্গ করিয়া এই সেবাব্রত আরম্ভ করিলেও কাশীপুরের উদ্যানে উহার পূর্ণানুষ্ঠানকালে ব্রতধারিগণের সংখ্যা প্রায় চতুর্গুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়াছিল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *