৫.০৭ ঠাকুরের পরীক্ষাপ্রণালী ও নরেন্দ্রনাথ

ঠাকুরের অদ্ভুত লোক-পরীক্ষা

অসাধারণ লক্ষণসমূহ দর্শনে উত্তম অধিকারী স্থির করিয়া প্রথম মিলনের দিবস হইতে ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে নিজ অদৃষ্টপূর্ব অহেতুক ভালবাসায় আবদ্ধ করিয়াছিলেন এবং পরে সময়ে সময়ে পরীক্ষাপূর্বক আধ্যাত্মিক সর্ববিষয়ে শিক্ষাদানে অগ্রসর হইয়াছিলেন, এ কথা আমরা পাঠককে বলিয়াছি। অতএব কিভাবে কতরূপে ঠাকুর নরেন্দ্রকে পরীক্ষা করিয়াছিলেন, তদ্বিষয়ের কিঞ্চিদাভাস এখানে লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন।

কুচবিহার-বিবাহে মতভেদ লইয়া দলভঙ্গ হইবার উপক্রমে ঠাকুর কেশবচন্দ্রকে বলিয়াছিলেন, “তুমি পরীক্ষা না করিয়া যাহাকে তাহাকে লইয়া দলবৃদ্ধি কর, সুতরাং তোমার দল ভাঙিয়া যাইবে ইহাতে আশ্চর্য কি? পরীক্ষা না করিয়া আমি কখনও কাহাকেও গ্রহণ করি না।” বাস্তবিক, সমীপাগত ভক্তগণকে তাহাদিগের জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে ঠাকুর কতরূপে পরীক্ষা করিয়া লইতেন, তাহা ভাবিলে বিস্ময়ের অবধি থাকে না। মনে হয়, নিরক্ষর বলিয়া যিনি জনসমাজে আপনাকে পরিচিত করিয়াছেন, লোকচরিত্র বুঝিবার এই সকল অদৃষ্ট ও অশ্রুতপূর্ব উপায় তিনি কোথা হইতে কেমনে আয়ত্ত করিয়াছিলেন! মনে হয়, উহা কি তাঁহার পূর্বজন্মার্জিত বিদ্যার ইহজন্মে স্বয়ংপ্রকাশ – অথবা, সাধন-প্রভাবে ঋষিকুলের ন্যায় অতীন্দ্রিয়দর্শিত্ব ও সর্বজ্ঞত্বলাভের ফল – অথবা, অন্তরঙ্গ ভক্তদিগের নিকটে তিনি ঈশ্বরাবতার বলিয়া যে নিজ পরিচয় প্রদান করিতেন, সেই বিশেষত্বের কারণেই তাঁহার ঐরূপ জ্ঞানপ্রকাশ উপস্থিত হইয়াছিল? ঐরূপ নানা কথার মনে উদয় হইলেও ঐ বিষয়ের মীমাংসা করিতে আমরা সম্প্রতি অগ্রসর হইতেছি না, কিন্তু ঘটনাবলীর যথাযথ বিবরণ যতদূর সম্ভব প্রদানপূর্বক পাঠকের উপরে ঐ বিষয়ের মীমাংসার ভার অর্পণ করিতেছি।

পরীক্ষা-প্রণালীর সাধারণ বিধি

লোকচরিত্র অবগত হইবার জন্য ঠাকুরকে যে-সকল উপায় অবলম্বন করিতে দেখিয়াছি, তদ্বিষয়ক কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করিলেই উহাদিগের অদ্ভুত অলৌকিকত্ব পাঠকের হৃদয়ঙ্গম হইবে; কিন্তু ঐরূপ করিবার পূর্বে উহাদিগের সম্বন্ধে কয়েকটি কথা জানা বিশেষ প্রয়োজন। আমরা দেখিয়াছি, কোন ব্যক্তি ঠাকুরের নিকটে উপস্থিত হইবামাত্র তিনি তাহার প্রতি একপ্রকার বিশেষভাবে নিরীক্ষণ করিতেন। ঐরূপ করিয়া যদি তাহার প্রতি তাঁহার চিত্ত কিছুমাত্র আকৃষ্ট হইত, তাহা হইলে তাহার সহিত সাধারণভাবে ধর্মালাপে প্রবৃত্ত হইতেন এবং তাহাকে তাঁহার নিকটে যাওয়া-আসা করিতে বলিতেন। যত দিন যাইত এবং ঐ ব্যক্তি তাঁহার নিকটে যত গমনাগমন করিতে থাকিত ততই তিনি তাহার অজ্ঞাতসারে তাহার শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদির গঠনভঙ্গী, মানসিক ভাবসমূহ, কাম-কাঞ্চনাসক্তি ও ভোগতৃষ্ণার পরিমাণ এবং তাঁহার প্রতি তাহার মন কিভাবে কতদূর আকৃষ্ট হইয়াছে ও হইতেছে, চালচলন ও কথাবার্তায় প্রকাশিত এই সকল বিষয়ে তন্ন তন্ন লক্ষ্য রাখিয়া তাহার অন্তর্নিহিত সুপ্ত আধ্যাত্মিকতা প্রভৃতি সম্বন্ধে একটা নিশ্চিত ধারণায় উপস্থিত হইতে প্রবৃত্ত হইতেন। ঐরূপে দুই-চারি দিন দর্শনের ফলেই তিনি ঐ ব্যক্তির চরিত্র সম্বন্ধে এককালে নিঃসন্দেহ হইতেন। পরে ঐ ব্যক্তির অন্তরের নিগূঢ় কোন কথা জানিবার প্রয়োজন হইলে তিনি তাঁহার যোগপ্রসূত সূক্ষ্মদৃষ্টিসহায়ে উহা জানিয়া লইতেন। ঐ সম্বন্ধে তিনি একদিন আমাদিগকে বলিয়াছিলেন, “রাত্রিশেষে একাকী অবস্থানকালে যখন তোদের কল্যাণ চিন্তা করিতে থাকি, তখন মা (জগদম্বা) সব কথা জানাইয়া ও দেখাইয়া দেন – কে কতদূর উন্নতিলাভ করিল, কাহার কিসের জন্য (ধর্মবিষয়ে) উন্নতি হইতেছে না, ইত্যাদি!” ঠাকুরের উক্ত কথায় পাঠক যেন না ভাবিয়া বসেন, তাঁহার যোগদৃষ্টি কেবলমাত্র ঐ সময়েই উন্মীলিত হইত। তাঁহার অন্যান্য কথায় বুঝিতে পারা যায়, ইচ্ছামাত্র তিনি উচ্চ ভাবভূমিতে আরোহণপূর্বক সকল সময়েই ঐরূপ দৃষ্টিলাভে সমর্থ হইতেন; যথা – “কাঁচের আলমারির দিকে দেখিলেই যেমন তাহার ভিতরের পদার্থসমূহ নয়নগোচর হয়, তেমনি মানুষের দিকে তাকাইলেই তাহার অন্তরের চিন্তা, সংস্কারাদি সকল বিষয় দেখিতে পাইয়া থাকি!” – ইত্যাদি।

উচ্চ অধিকারীর সহিত প্রথম সাক্ষাৎকালে ঠাকুরের অনুরূপ ভাবাবেশ

ঠাকুর পূর্বোক্তভাবে লোকচরিত্র অবগত হইতে সাধারণতঃ অগ্রসর হইলেও বিশেষ বিশেষ অন্তরঙ্গ ভক্তদিগের সম্বন্ধে ঐ নিয়মের স্বল্পবিস্তর ব্যতিক্রম হইতে দেখা যায়। দেখা যায়, তাহাদিগের সহিত প্রথম সাক্ষাৎ তিনি দৈবপ্রেরণায় উচ্চ উচ্চতর ভাবভূমিতে অবস্থিত হইয়াই করিয়াছিলেন। ‘লীলাপ্রসঙ্গ’-এর একস্থলে আমরা পাঠককে বলিয়াছি, অদৃষ্টপূর্ব সাধনাবলে ঠাকুরের শরীর-মন, সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক শক্তি ধারণ ও জ্ঞাপনের বিচিত্র যন্ত্রস্বরূপ হইয়া উঠিয়াছিল। ঐ কথা এককালে বর্ণে বর্ণে সত্য। আমরা নিয়ত দেখিতে পাইতাম, যাহার ভিতর যেরূপ আধ্যাত্মিক ভাব বর্তমান থাকিত তাহাকে দেখিবামাত্র তাঁহার অন্তর কোন এক দিব্য প্রেরণায় সহসা অনুরূপ ভাবে রঞ্জিত হইয়া উঠিত; এবং পূর্ব কর্ম ও সংস্কারবশে আধ্যাত্মিক রাজ্যে যে যতদূর আরূঢ় হইয়াছে, তাহার আগমনমাত্রেই তাঁহার অন্তর স্বভাবতঃ ঐ ভূমিতে আরোহণ করিয়া আগন্তুকের অন্তরের কথা তাঁহাকে জানাইয়া দিত। নরেন্দ্রনাথের প্রথম আগমনকালে ঠাকুরের যে-সকল উপলব্ধি আমরা ইতঃপূর্বে লিপিবদ্ধ করিয়াছি, তাহাদিগের সহায়েই পাঠক আমাদিগের ঐ কথা বুঝিতে পারিবেন।

পরীক্ষা-প্রণালীর চারি বিভাগ

ঐরূপ হইলেও লোকচরিত্র-পরিজ্ঞানের জন্য ঠাকুর যে সাধারণ বিধি সর্বদা অবলম্বন করিতেন, তাহা যে তিনি তাঁহার অন্তরঙ্গ ভক্তদিগের সম্বন্ধে প্রয়োগ করিতেন না, তাহা নহে। সাধারণ ভাবভূমিতে অবস্থানকালে তাহাদিগের চালচলন, কথাবার্তাদি তিনি উহার সহায়ে সমভাবে লক্ষ্য করিতেন এবং অন্যে পরে কা কথা, শ্রীযুত নরেন্দ্রনাথকেও তিনি ঐরূপে পরীক্ষা না করিয়া নিশ্চিন্ত হন নাই। অতএব ঐ বিষয়ের সহিত পাঠককে পরিচিত করা যে একান্ত প্রয়োজন, তাহা বলা বাহুল্য। ভক্তদিগকে পরীক্ষা করিবার জন্য ঠাকুর যে উপায়সমূহ অবলম্বন করিতেন, তাহাদিগের মধ্যে চারিটি প্রধান বিভাগ নয়নগোচর হয়। আমরা ইতঃপূর্বেই ঐ বিষয়ের ইঙ্গিত করিয়াছি। অতএব ঐ বিভাগ-চতুষ্টয়ের প্রত্যেকের উল্লেখপূর্বক দৃষ্টান্তসহায়ে উহা পাঠকের হৃদয়ঙ্গম করাইতে এখন প্রবৃত্ত হইতেছি:

(১) শারীরিক লক্ষণসমূহ দর্শনে অন্তরের সংস্কারনির্ণয়

১ম – শারীরিক লক্ষণসমূহ দেখিয়া ঠাকুর সমীপাগত ব্যক্তিগণের অন্তরের প্রবল পূর্বসংস্কারসমূহ নির্ণয় করিতেন।

মনের প্রত্যেক সুব্যক্ত চিন্তা, ক্রিয়ারূপে পরিণত হইবার সহিত আমাদিগের মস্তিষ্কে এবং শরীরের বিশেষ বিশেষ স্থানে এক একটা দাগ অঙ্কিত করিয়া যায় – বর্তমান যুগের শরীর ও মনোবিজ্ঞান ঐ বিষয় অনেকাংশে প্রমাণিত করিয়া আমাদিগকে এখন ঐ কথায় শ্রদ্ধাবান করিতেছে। বেদপ্রমুখ শাস্ত্রসকল কিন্তু ঐ কথা চিরকাল বলিয়া আসিয়াছেন। হিন্দুর শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণ, দর্শনাদি সকল শাস্ত্র সমস্বরে ঘোষণা করিয়াছেন, ‘মন সৃষ্টি করে এ শরীর’ – ব্যক্তিবিশেষের অন্তরের চিন্তাপ্রবাহ কু বা সু পথে চলিবার সঙ্গে সঙ্গে তাহার শরীরও পরিবর্তিত হইয়া অনুরূপ আকার ধারণ করিতে থাকে। সেইজন্য শরীর ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদির গঠন দেখিয়া লোকের চরিত্রনির্ণয় করা সম্বন্ধে অনেক প্রবাদকথা আমাদিগের ভিতর প্রচলিত আছে, এবং বিবাহ, দীক্ষাদান প্রভৃতি স্থলে কন্যা ও শিষ্যের হস্ত-পদ হইতে আরম্ভ করিয়া সকল অবয়বের এবং সর্বশরীরের গঠনপ্রকার দেখা একান্ত কর্তব্য বলিয়া একাল পর্যন্ত পরিগণিত হইয়া রহিয়াছে।

ঐ বিষয়ে ঠাকুরের অদ্ভুত জ্ঞান

সর্বশাস্ত্রে বিশ্বাসবান ঠাকুর যে সুতরাং নিজ শিষ্যবর্গের শরীর ও অবয়বাদির গঠনপ্রকার লক্ষ্য করিবেন, তদ্বিষয়ে আশ্চর্য হইবার কিছুই নাই। কিন্তু কথাচ্ছলে সময়ে সময়ে তিনি ঐ বিষয়ে এত কথা আমাদিগকে বলিতে থাকিতেন যে, নির্বাক হইয়া আমরা চিন্তা করিতাম – ঐ সম্বন্ধে এত অভিজ্ঞতা তিনি কোথা হইতে লাভ করিলেন! ভাবিতাম প্রাচীনকালে ঐ বিষয়ে কোন বৃহৎ গ্রন্থ কি বিদ্যমান ছিল – যাহা পাঠ বা শ্রবণ করিয়া তিনি ঐসকল কথা জানিতে পারিয়াছেন? কিন্তু একাল পর্যন্ত ঐরূপ কোন গ্রন্থ নয়নগোচর করা দূরে থাকুক, উহার নাম পর্যন্ত শুনিতে না পাওয়ায় ঐরূপ চিন্তা দাঁড়াইবার স্থান পায় না। সুতরাং বিস্মিত হইয়া শুনিতে থাকিতাম, ঠাকুর স্ত্রী বা পুরুষ-শরীরের প্রত্যেক অবয়ব ও ইন্দ্রিয়ের গঠনপ্রকার নিত্য পরিদৃষ্ট বিশেষ বিশেষ পদার্থের গঠনের ন্যায় হয় বলিয়া উল্লেখ করিয়া ঐরূপ হইবার ফলাফল বলিয়া যাইতেছেন। যথা, মানবের চক্ষুর কথা তুলিয়া উহা কাহারও পদ্মপত্রের ন্যায়, কাহারও বৃষের ন্যায়, কাহারও যোগীর বা দেবতার ন্যায় ইত্যাদি বলিয়া বলিতেন – “পদ্মপত্রের ন্যায় চক্ষুবিশিষ্ট ব্যক্তির অন্তরে সদ্ভাব ও সাধুভাব থাকে; বৃষের ন্যায় চক্ষু যাহার তাহার কাম প্রবল হয়, যোগীর চক্ষু ঊর্ধ্বদৃষ্টিসম্পন্ন রক্তিমাভ হয়; দেবচক্ষু অধিক বড় হয় না, কিন্তু টানা বা আকর্ণবিস্তৃত হয়। কাহারও সহিত বাক্যালাপ করিবার কালে মধ্যে মধ্যে তাহাকে অপাঙ্গে নিরীক্ষণ করা অথবা চোখের কোণ দিয়া দেখা যাহাদিগের স্বভাব, তাহারা সাধারণ মানব অপেক্ষা অধিক বুদ্ধিমান।” অথবা শরীরের সাধারণ গঠন-প্রকারের কথা তুলিয়া বলিতেন, “ভক্তিমান ব্যক্তির শরীর স্বভাবতঃ কোমল ও তাহার হস্তপদাদির গ্রন্থিসকল শিথিল হয় (অর্থাৎ সহজে ফিরানো-ঘুরানো যায়); কৃশ হইলেও তাহার শরীরে অস্থি, পেশী প্রভৃতি এমনভাবে বিন্যস্ত থাকে যাহাতে অধিক কোণ দেখা যায় না।” বুদ্ধিমান বলিয়া কাহাকেও নির্ণয় করিয়া তাহার বুদ্ধির স্বাভাবিক প্রবণতা সৎ কিংবা অসৎ বিষয়ে – এ কথা স্থির করিতে ঠাকুর ঐ কনুই হইতে অঙ্গুলি পর্যন্ত হস্তখানি নিজহস্তে ধারণপূর্বক তাহাকে উহা শিথিলভাবে রক্ষা করিতে বলিয়া উহার গুরুত্ব বা ভার উপলব্ধি করিতেন এবং মানব-সাধারণের হস্তের ঐ অংশের গুরুত্ব অপেক্ষা যদি উহার ভার অল্প বোধ হইত, তাহা হইলে তাহাকে সুবুদ্ধিবিশিষ্ট বলিয়া সিদ্ধান্ত করিতেন। শ্রীযুত প্রেমানন্দ স্বামীর1 দক্ষিণেশ্বরে প্রথম আগমনদিবসে ঠাকুর তাঁহার হস্তধারণপূর্বক ঐরূপে ওজন করিয়াছিলেন, এ কথা আমরা ইতঃপূর্বে বলিয়াছি। কিন্তু কি জন্য ঐরূপ করিয়াছিলেন তাহা তিনি সেদিন না বলায় আমরাও ঐ স্থানে ঐ বিষয়ে কিছু বলি নাই। ব্যক্তিবিশেষের বুদ্ধি সৎ অথবা অসৎ এ বিষয় জানিবার জন্য যে ঠাকুর ঐরূপ করিতেন, তদ্বিষয়ের পরিচয় আমরা নিম্নলিখিতভাবে অন্য এক দিবস প্রাপ্ত হইয়াছিলাম।


1. পূর্ব নাম – বাবুরাম।

হস্তের ওজনের তারতম্যে সদসৎ বুদ্ধি-নির্ণয়

গলরোগে আক্রান্ত হইয়া ঠাকুর যখন কাশীপুরের বাগানে অবস্থান করিতেছিলেন সেই সময়ে লেখকের পরলোকগত কনিষ্ঠ সহোদর1 একদিন তাঁহাকে দর্শন করিতে তথায় উপস্থিত হইয়াছিল। ঠাকুর তাহাকে দেখিয়া সেদিন বিশেষ প্রসন্ন হইয়াছিলেন এবং নিকটে বসাইয়া তাহাকে নানা কথা জিজ্ঞাসাপূর্বক ধর্মবিষয়ক নানা উপদেশ প্রদান করিয়াছিলেন। ঐ সময়ে লেখক ঐ স্থানে উপস্থিত হইলে ঠাকুর জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “ছেলেটি তোর ভাই?” লেখক ঐ কথা স্বীকার করিলে আবার বলিয়াছিলেন, “বেশ ছেলে, তোর চেয়ে এর বুদ্ধি বেশি; দেখি সদ্বুদ্ধি কি অসদ্বুদ্ধি” – বলিয়াই তাহার দক্ষিণ হস্তের পূর্বোক্ত অংশ ধারণপূর্বক ওজন করিতে করিতে বলিলেন, “সদ্বুদ্ধি”। পরে লেখককে পুনরায় প্রশ্ন করিলেন, (কনিষ্ঠকে দেখাইয়া) “ইহাকেও টানব না কি রে? (ইহার মনকে সংসারের প্রতি উদাসীন করিয়া ঈশ্বরমুখী করিয়া দিব না কি) কি বলিস?” লেখক বলিয়াছিল, “বেশ তো মহাশয়, তাহাই করুন।” ঠাকুর তাহাতে ক্ষণকাল চিন্তাপূর্বক বলিলেন, “না – থাক; একটাকে নিয়েছি, আবার এটাকেও নিলে তোর বাপ-মার বড় কষ্ট হবে – বিশেষতঃ তোর মার; জীবনে অনেক শক্তিকে2 রুষ্টা করেছি, এখন আর কাজ নাই।” এই বলিয়া ঠাকুর তাহাকে সদুপদেশ প্রদান ও কিঞ্চিৎ জলযোগ করাইয়া সেদিন বিদায় করিয়াছিলেন।


1. শ্রীচারুচন্দ্র চক্রবর্তী।
2. জগদম্বার সৃজনী ও পালনী শক্তির মূর্তিমতী-স্বরূপা নারীগণকে।

শারীরিক নিত্যক্রিয়াসকলের বিভিন্নতায় সংস্কার-ভিন্নতার সূচনা

ঠাকুর বলিতেন, শরীরের অবয়বাদির গঠনপ্রকারের ন্যায় নিদ্রা শৌচাদি শারীরিক সামান্য ক্রিয়াসকলও ভিন্ন ভিন্ন সংস্কারসম্পন্ন ব্যক্তিদিগের বিভিন্ন প্রকারের হইয়া থাকে। সেইজন্য বহুদর্শী ব্যক্তিগণ ঐসকল হইতেও ব্যক্তিবিশেষের চরিত্রনির্ণয়ের ইঙ্গিত পাইয়া থাকেন। যথা নিদ্রা যাইবার কালে সকলের নিঃশ্বাস সমভাবে পড়ে না, ভোগীর একভাবে এবং ত্যাগীর অন্যভাবে পড়িয়া থাকে; শৌচাদি গমনকালে ভোগীর মূত্রের ধারা বামে হেলিয়া যায় এবং ত্যাগীর দক্ষিণে হেলিয়া পড়ে। যোগীর মল শূকরে স্পর্শ করে না – ইত্যাদি।

দ্বারবান্ হনুমান সিং

পূর্বোক্ত বিষয়ে একটি ঘটনাও ঠাকুর আমাদিগকে বলিয়াছিলেন। হনুমান সিং নামক এক ব্যক্তি মথুরবাবুর আমলে দক্ষিণেশ্বরে মন্দির-রক্ষার কার্যে নিযুক্ত হইয়াছিল। দ্বারবানদিগের অন্যতম হইলেও হনুমান সিং-এর মর্যাদা অধিক ছিল। কারণ, সে কেবল একজন প্রসিদ্ধ পালোয়ান মাত্র ছিল না, কিন্তু একজন নিষ্ঠাবান ভক্তসাধক ছিল। মহাবীরমন্ত্রের উপাসক হনুমান সিংকে মল্লযুদ্ধে পরাস্ত করিয়া তাহার পদগ্রহণ-মানসে অন্য একজন পালোয়ান একসময়ে দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হইয়াছিল। তাহার প্রকাণ্ড দেহ ও শারীরিক বল প্রভৃতি দেখিয়াও হনুমান তাহার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দণ্ডায়মান হইতে নিরস্ত হইল না। দিন স্থির হইল এবং মথুরবাবুপ্রমুখ ব্যক্তিগণ উভয়ের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ তদ্বিষয় বিচারের ভার প্রাপ্ত হইলেন।

প্রতিযোগিতার দিনের সপ্তাহকাল পূর্ব হইতে নবাগত মল্ল রাশীকৃত পুষ্টিকর খাদ্যভোজনে ও ব্যায়ামাদির অভ্যাসে লাগিয়া রহিল। হনুমান সিং কিন্তু ঐরূপ না করিয়া নিত্য যেমন করিত সেরূপ প্রাতঃস্নানপূর্বক সমস্ত দিন ইষ্টমন্ত্রজপে এবং দিনান্তে একবার মাত্র ভোজন করিয়া কালযাপন করিতে লাগিল। সকলে ভাবিল, হনুমান ভীত হইয়াছে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের আশা পরিত্যাগ করিয়াছে। ঠাকুর তাহাকে ভালবাসিতেন, সেজন্য প্রতিযোগিতার পূর্বদিবসে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি ব্যায়াম ও পুষ্টিকর আহারাদির দ্বারা শরীরকে প্রস্তুত করিয়া লইলে না, নূতন মল্লের সহিত প্রতিযোগিতায় পারিবে কি?” হনুমান ভক্তিভরে প্রণামপূর্বক কহিল, “আপনার কৃপা থাকে তো আমি নিশ্চয় জয়লাভ করিব; কতকগুলা আহার করিলেই শরীরে বলাধান হয় না, উহা হজম করা চাই; আমি গোপনে নবাগত মল্লের মল দেখিয়া বুঝিয়াছি, সে হজমশক্তির অতিরিক্ত আহার করিতেছে।” ঠাকুর বলিতেন, প্রতিযোগিতার দিবসে হনুমান সিং সত্য সত্যই ঐ ব্যক্তিকে মল্লযুদ্ধে পরাস্ত করিয়াছিল!

শারীরিক অবয়বগঠন ও ক্রিয়াদর্শনে বিদ্যা ও অবিদ্যাশক্তির নির্ণয়

পুরুষ-শরীরের ন্যায় স্ত্রী-শরীরের অবয়বসকলের গঠনপ্রকার সম্বন্ধেও ঠাকুর অনেক কথা বলিতেন এবং উহা লক্ষ্য করিয়া রমণীগণের কতকগুলিকে দেবীভাবসম্পন্না বা বিদ্যাশক্তি এবং কতকগুলিকে আসুরীভাবাপন্না বা অবিদ্যাশক্তি বলিয়া নির্দেশ করিতেন। বলিতেন – “ভোজন, নিদ্রা ও ইন্দ্রিয়াসক্তি বিদ্যাশক্তিদিগের স্বভাবতঃ অল্প হইয়া থাকে। স্বামীর সহিত ঈশ্বরীয় কথা শ্রবণ ও আলাপ করিতে তাঁহাদিগের প্রাণে বিশেষ উল্লাস উপস্থিত হয়। উচ্চ আধ্যাত্মিক প্রেরণা প্রদানপূর্বক ইঁহারা নীচ প্রবৃত্তি ও হীন কার্যের হস্ত হইতে পতিকে সর্বদা রক্ষা করিয়া থাকেন এবং পরিণামে ঈশ্বর লাভ করিয়া যাহাতে তিনি নিজ জীবন ধন্য করিতে পারেন, তদ্বিষয়ে তাঁহাকে সর্বপ্রকারে সহায়তা প্রদান করেন। অবিদ্যাশক্তিদিগের স্বভাব ও কার্য সম্পূর্ণ বিপরীত হইয়া থাকে। আহার-নিদ্রাদি শারীরিক সকল ব্যাপার তাহাদিগের অধিক হইতে দেখা যায়, এবং তাহার সুখসম্পাদন ভিন্ন অন্য কোন বিষয়ে পতি যাহাতে মনোনিবেশ না করেন, তদ্বিষয়ই তাহাদিগের প্রধান লক্ষ্য হয়। পতি ইহাদিগের নিকটে পারমার্থিক বিষয়ে আলাপ করিলে ইহারা রুষ্ট ভিন্ন কখনও তুষ্ট হয় না।” যে ইন্দ্রিয়বিশেষের সহায়ে রমণীগণ মাতৃত্বপদ-গৌরব লাভ করিয়া থাকেন, তাহার বাহ্যিক আকার হইতে অন্তরের ভোগাসক্তির পরিচয় পাওয়া গিয়া থাকে বলিয়া ঠাকুর কখনও কখনও নির্দেশ করিতেন। বলিতেন, উহা নানা আকারের হইয়া থাকে। তন্মধ্যে কোন কোন আকার পাশব প্রবৃত্তির স্বল্পতার বিশেষ পরিচায়ক। আবার বলিতেন, যাহাদিগের পশ্চাদ্ভাগ পিপীলিকার ন্যায় উচ্চ তাহাদিগের অন্তরে উক্ত প্রবৃত্তি প্রবল থাকে।

নরেন্দ্রের শারীরিক লক্ষণ সম্বন্ধে ঠাকুরের কথা

এরূপে শরীরের গঠনপ্রকার দেখিয়া মানবের প্রকৃতি নিরূপণ করা সম্বন্ধে কত কথা ঠাকুর আমাদিগকে বলিয়াছিলেন, তাহার ইয়ত্তা হয় না। লোকচরিত্র-পরিজ্ঞানের উপায়সকলের মধ্যে অন্যতম বলিয়া উহা তাঁহার নিকটে সর্বদা পরিগণিত হইত এবং নরেন্দ্রনাথপ্রমুখ সকল ভক্তকেই উহার সহায়ে তিনি অল্পবিস্তর পরীক্ষা করিয়া লইয়াছিলেন। ঐরূপে পরীক্ষাপূর্বক সন্তুষ্ট হইয়া তিনি নরেন্দ্রনাথকে একদিন বলিয়াছিলেন, “তোর শরীরের সকল স্থানই সুলক্ষণাক্রান্ত, কেবল দোষের মধ্যে নিদ্রা যাইবার কালে নিঃশ্বাসটা কিছু জোরে পড়ে। যোগীরা বলেন, অত জোরে নিঃশ্বাস পড়িলে অল্পায়ু হয়।”

(২) সামান্য কার্যে প্রকাশিত মানসিক ভাব দ্বারা এবং (৩) ঐরূপ কার্য দ্বারা প্রকাশিত কামকাঞ্চনাসক্তির তারতম্য বুঝিয়া অন্তরের সংস্কার-নিরূপণ

২য় ও ৩য় – সামান্য সামান্য কার্যে প্রকাশিত মানসিক ভাব ও কামকাঞ্চনাসক্তির প্রতি লক্ষ্য রাখাই ব্যক্তিবিশেষের স্বাভাবিক প্রকৃতি-পরিজ্ঞানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় উপায় বলিয়া ঠাকুরের নিকটে পরিগণিত হইত। ব্যক্তিবিশেষের দক্ষিণেশ্বরে প্রথম আগমন হইতে ঠাকুর তাহার সম্বন্ধে পূর্বোক্ত বিষয়সকল কিছুকাল পর্যন্ত নীরবে লক্ষ্য মাত্র করিয়া যাইতেন। পরে নিজ মণ্ডলীমধ্যে তাহাকে গ্রহণ করিবেন বলিয়া যেদিন হইতে স্থির করিতেন, সেদিন হইতে নানাভাবে উপদেশদানে এবং আবশ্যক হইলে কখনও কখনও মিষ্ট তিরস্কারসহায়ে তাহাকে উক্ত দোষসকল পরিহার করাইতে সচেষ্ট হইতেন। আবার মণ্ডলীমধ্যে গ্রহণপূর্বক সন্ন্যাসী অথবা গৃহস্থ কোন্ ভাবে জীবনগঠন করিতে তাহাকে শিক্ষাপ্রদান করিবেন তদ্বিষয়েও তিনি পূর্ব হইতে স্থির করিয়া লইতেন। সেজন্য সমীপাগত ব্যক্তিকে তিনি প্রথমেই প্রশ্ন করিতেন – সে বিবাহিত কি না, তাহার বাটীতে মোটা ভাতকাপড়ের অভাব আছে কি না, অথবা সে সংসার ত্যাগ করিলে তাহার স্থলাভিষিক্ত হইয়া পরিবারবর্গের ভরণপোষণের ভার লইতে পারিবে এমন কোন নিকট আত্মীয় আছে কি না।

বালকদিগের সম্বন্ধে ঠাকুরের ধারণা

বিদ্যালয়ের ছাত্রদিগের উপর ঠাকুরের বিশেষ কৃপা সর্বদা লক্ষিত হইত। বলিতেন, “ইহাদিগের মন এখনও স্ত্রী-পুত্র মান-যশাদির ভিতর ছড়াইয়া পড়ে নাই, (উপযুক্ত শিক্ষা পাইলে) ইহারা সহজেই ষোল আনা মন ঈশ্বরে দিতে পারিবে।” সেইজন্য ইহাদিগের ভিতরে ধর্মভাব প্রবেশ করাইয়া দিবার তাঁহার বিশেষ প্রযত্ন ছিল। নানা দৃষ্টান্তসহায়ে তিনি তাঁহার পূর্বোক্ত মত প্রকাশ করিতেন। বলিতেন, “মন সরিষার পুঁটুলির মতো, একবার ছড়াইয়া পড়িলে উহার সব দানাগুলি একত্র করা একপ্রকার অসম্ভব”, “কাঁটি উঠিলে পাখিকে ‘রাধাকৃষ্ণ’ নাম বলানো দুঃসাধ্য” – “কাঁচা টালির উপরে গরুর খুরের ছাপ পড়িলে সহজেই মুছিয়া ফেলা যায়, কিন্তু টালি পোড়াইবার পরে ঐ ছাপ আর তুলিয়া ফেলা যায় না” ইত্যাদি। ঐ কারণে সংসারানভিজ্ঞ বিদ্যালয়ের ছাত্রদিগকেই তিনি বিশেষভাবে প্রশ্ন করিয়া তাহাদিগের মনের স্বাভাবিক গতি প্রবৃত্তি অথবা নিবৃত্তির দিকে তাহা বুঝিয়া লইতেন এবং উপযুক্ত বুঝিলে তাহাদিগকে শেষোক্ত পথে পরিচালিত করিতেন।

সমীপাগত ভক্তগণের প্রতিকার্য লক্ষ্য করা

ঐরূপে কথাপ্রসঙ্গে নানাভাবে প্রশ্ন করিয়া ব্যক্তিবিশেষের মনের ভাব অবগত হইয়াই তিনি ক্ষান্ত থাকিতেন না, কিন্তু সে ব্যক্তি কতদূর সরল ও সত্যনিষ্ঠ, মুখে যাহা বলে কার্যে সে তাহার কতদূর অনুষ্ঠান করে, বিচারপূর্বক সে প্রতিকার্যের অনুষ্ঠান করে কিনা এবং উপদিষ্ট বিষয়ের ধারণাই বা সে কতদূর কিরূপ করিয়া থাকে প্রভৃতি নানা বিষয় তাহার প্রতিকার্যে তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিতে থাকিতেন। কয়েকটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিলেই পাঠক পূর্বোক্ত বিষয় বুঝিতে পারিবেন।

ঐ বিষয়ক দৃষ্টান্তনিচয়

কয়েকদিন দক্ষিণেশ্বরে গমনাগমন করিবার পরে জনৈক বালককে তিনি একদিন সহসা বলিয়া বসিলেন, “তুই বিবাহ করিস না কেন?” সে উত্তর করিল, “মহাশয়, মন বশীভূত হয় নাই, এখন বিবাহ করিলে স্ত্রীর প্রতি আসক্তিতে হিতাহিত-বিবেচনাশূন্য হইতে হইবে, যদি কখনও কামজিৎ হইতে পারি তখন বিবাহ করিব।” ঠাকুর বুঝিলেন, অন্তরে আসক্তি প্রবল থাকিলেও বালকের মন নিবৃত্তিমার্গের প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছে – বুঝিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “যখন কামজিৎ হইবি তখন আর বিবাহ করিবার আবশ্যকতা থাকিবে না।”

জনৈক বালকের সহিত একদিন দক্ষিণেশ্বরে নানা বিষয়ের কথা কহিতে কহিতে বলিলেন, “এটা কি বল দেখি? কোমরে কিছুতেই (সর্বদা) কাপড় রাখতে পারি না – থাকে না, কখন খুলে পড়ে গেছে জানতেও পারি না! বুড়ো মিনসে উলঙ্গ হয়ে বেড়াই! কিন্তু লজ্জাও হয় না! পূর্বে পূর্বে কে দেখচে না দেখচে সে কথার এককালে হুঁশ থাকত না – এখন যারা দেখে তাদের কাহারও কাহারও লজ্জা হয় বুঝে কোলের উপর কাপড়খানা ফেলে রাখি। তুই লোকের সামনে আমার মতো (উলঙ্গ) হয়ে বেড়াতে পারিস?” সে বলিল, “মহাশয়, ঠিক বলিতে পারি না, আপনি আদেশ করিলে বস্ত্রত্যাগ করিতে পারি।” তিনি বলিলেন, “কই যা দেখি, মাথায় কাপড়খানা জড়িয়ে ঠাকুরবাড়ির উঠানে একবার ঘুরে আয় দেখি।” বালক বলিল, “তাহা করিতে পারিব না, কিন্তু কেবলমাত্র আপনার সম্মুখে ঐরূপ করিতে পারি।” ঠাকুর তাহার কথা শুনিয়া বলিলেন, “ঐ কথা আরও অনেকে বলে – বলে, ‘তোমার সামনে পরিধানের কাপড় ফেলিয়া দিতে লজ্জা করে না, কিন্তু অপরের সামনে করে’!”

গঙ্গায় বান

ঠাকুরের বসনত্যাগের কথাপ্রসঙ্গে অন্য একদিনের ঘটনা আমাদিগের মনে আসিতেছে। জ্যোৎস্না-বিধৌতা যামিনী, বোধ হয় সেদিন কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয়া বা তৃতীয়া হইবে। রাত্রে শয়ন করিবার অল্পক্ষণ পরেই গঙ্গায় বান আসিয়া উপস্থিত হইল। ঠাকুর শয্যাত্যাগপূর্বক ‘ওরে, বান দেখবি আয়’ বলিয়া সকলকে ডাকিতে ডাকিতে পোস্তার উপরে ছুটিলেন এবং নদীর শান্ত শুভ্র জলরাশি ফেনশীর্ষ উত্তাল তরঙ্গাকারে পরিণত হইয়া উন্মত্তের ন্যায় বিপরীত দিকে প্রচণ্ডবেগে আগমনপূর্বক পোস্তার উপরে লাফাইয়া উঠিতেছে দেখিয়া বালকের ন্যায় আনন্দে নৃত্য করিতে লাগিলেন। ঠাকুর যখন আমাদিগকে ডাকিয়াছিলেন তখন আমাদিগের তন্দ্রা আসিয়াছে, উহার ঘোরে উঠিয়া পরিহিত বস্ত্রাদি সামলাইয়া তাঁহার অনুসরণ করিতে সামান্য বিলম্ব হইয়াছিল। সুতরাং আমরা পোস্তায় আসিয়া উপস্থিত হইতে না হইতে বান চলিয়া যাইল, কেহ উহার সামান্য দর্শন পাইল, কেহ বা তাহাও পাইল না। ঠাকুর এতক্ষণ আপন আনন্দেই বিভোর ছিলেন, বান চলিয়া যাইলে আমাদিগের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “কি রে, কেমন বান দেখলি?” এবং আমরা কাপড় পরিতে বান চলিয়া গিয়াছে শুনিয়া বলিলেন, “দূর শালারা, তোদের কাপড় পরবার জন্য কি বান অপেক্ষা করবে? আমার মতো কাপড় ফেলিয়া চলিয়া আসিলি না কেন?”

ঈশ্বরলাভই জীবনের উদ্দেশ্য বুঝিয়া সকল কর্মের অনুষ্ঠান

‘বিবাহ করিবার ইচ্ছা আছে কি না’, ‘চাকুরি করিবি কি না’ – ঠাকুরের এই সকল প্রশ্নের উত্তরে আমাদিগের কেহ কেহ বলিত, “বিবাহ করিতে ইচ্ছা নাই, মহাশয়, কিন্তু চাকুরি করিতে হইবে।” অশেষ স্বাধীনতাপ্রিয় ঠাকুরের নিকটে কিন্তু ঐ কথা বিষম বিসদৃশ লাগিত। তিনি বলিতেন, “যদি বিবাহ করিয়া সংসারধর্ম পালনই করিবি না, তবে আজীবন অপরের চাকর হইয়া থাকিবি কেন?” ষোল-আনা মনপ্রাণ ঈশ্বরে সমর্পণ করিয়া তাঁহার উপাসনা কর – সংসারে জন্ম পরিগ্রহ করিয়া মানবের তদপেক্ষা মহৎ কার্য অন্য কিছুই আর হইতে পারে না এবং ঐরূপ করা একান্ত অসম্ভব বুঝিলে বিবাহ করিয়া ঈশ্বরলাভকেই জীবনের চরম উদ্দেশ্য স্থিরপূর্বক সৎপথে থাকিয়া সংসারযাত্রা নির্বাহ কর – ইহাই তাঁহার মত ছিল। সেইজন্য আধ্যাত্মিক রাজ্যে উত্তম বা মধ্যম অধিকারী বলিয়া যে-সকল ব্যক্তিকে তিনি বুঝিতে পারিতেন তাহাদিগের কেহ বিবাহ করিয়াছে অথবা বিশেষ কারণ ব্যতীত ইতরসাধারণের ন্যায় অর্থোপার্জনের জন্য চাকুরি স্বীকারপূর্বক বা নাম-যশের প্রত্যাশী হইয়া সংসারের অন্য কোন প্রকার কার্যে নিযুক্ত হইয়া নিজ শক্তি ক্ষয় করিতেছে শুনিলে তিনি প্রাণে বিষম আঘাত প্রাপ্ত হইতেন। তাঁহার বালকভক্তদিগের অন্যতম জনৈক1 চাকুরি স্বীকার করিয়াছে শুনিয়া তিনি তাহাকে একদিন বলিয়াছিলেন, “তুই তোর বৃদ্ধা মাতার ভরণপোষণের জন্য করিতেছিস তাই, নতুবা চাকুরি গ্রহণ করিয়াছিস শুনিলে তোর মুখ দেখিতে পারিতাম না।” অপর জনৈক2 বিবাহ করিয়া কাশীপুরের বাগানে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিলে, তাঁহার যেন পুত্রশোক উপস্থিত হইয়াছে এইরূপভাবে তাহার গ্রীবা ধারণপূর্বক অজস্র রোদন করিতে করিতে বারংবার বলিয়াছিলেন, “ঈশ্বরকে ভুলিয়া যেন একেবারে (সংসারে) ডুবিয়া যাসনি!”


1. স্বামী নিরঞ্জনানন্দ।
2. ছোট নরেন্দ্র।

সরল ঈশ্বরবিশ্বাস ও নির্বুদ্ধিতা ভিন্ন পদার্থ, সদসদ্বিচারসম্পন্ন হইতে হইবে

বিশ্বাস ব্যতিরেকে ধর্মপথে অগ্রসর হওয়া যায় না, নবানুরাগের প্রেরণায় ঐ কথার বিপরীত অর্থ গ্রহণপূর্বক আমাদিগের মধ্যে কেহ কেহ তখন যাহাতে তাহাতে এবং যাহাকে তাহাকে বিশ্বাস করিতে অগ্রসর হইত। ঠাকুরের তীক্ষ্ণদৃষ্টি তাহার উপর পতিত হইবামাত্র তিনি ঐ বিষয় বুঝিয়া তাহাকে সাবধান করিয়া দিতেন। বাস্তবিক, বিশ্বাস-অবলম্বনে ধর্মপথে অগ্রসর হইতে বলিলেও তিনি কাহাকেও কোন দিন সদসৎ বিচার ত্যাগ করিতে বলেন নাই। সদসদ্বিচারসম্পন্ন হইয়া ধর্মপথে অগ্রসর হইবে এবং ইষ্টানিষ্টবিচার না করিয়া সাংসারিক কোন কর্মও করিতে উদ্যত হইবে না, ইহাই তাঁহার মত ছিল বলিয়া আমাদিগের ধারণা। তাঁহার আশ্রিতবর্গের মধ্যে জনৈক1 একদিন দোকানীকে ধর্মভয় দেখাইয়া বাজার হইতে একখানি লোহার কড়া কিনিয়া বাটীতে প্রত্যাগমনপূর্বক দেখিলেন, দোকানী তাঁহাকে ফাটা কড়া দিয়াছে! ঠাকুর ঐ কথা জানিতে পারিয়া তাঁহাকে তিরস্কার করিয়া বলিয়াছিলেন, “(ঈশ্বর-) ভক্ত হইতে হইবে বলিয়া কি নির্বোধ হইতে হইবে? দোকানী কি দোকান ফাঁদিয়া ধর্ম করিতে বসিয়াছে, যে তুই তার কথায় বিশ্বাস করিয়া কড়াখান একবার না দেখিয়াই লইয়া চলিয়া আসিলি? আর কখনও ঐরূপ করিবি না। কোন দ্রব্য কিনিতে হইলে পাঁচ দোকান ঘুরিয়া তাহার উচিত মূল্য জানিবি, দ্রব্যটি লইবার কালে বিশেষ করিয়া পরীক্ষা করিবি, আবার যে-সকল দ্রব্যের ফাউ পাওয়া যায় তাহার ফাউটি পর্যন্ত না গ্রহণ করিয়া চলিয়া আসিবি না।”


1. স্বামী যোগানন্দ, পূর্ব নাম যোগেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী

অধিকারিভেদে ঠাকুরের দয়াবান্ ও নির্মম হইবার উপদেশ

ধর্মলাভ করিতে আসিয়া কোন কোন প্রকৃতিতে দয়ার ভাবটি এত অধিক পরিবর্ধিত হইয়া উঠে যে, পরিণামে উহাই তাহার বন্ধনের এবং কখনও কখনও ধর্মপথ হইতে ভ্রষ্ট হইবার কারণ হইয়া পড়ে। কোমল-হৃদয় নরনারীই অনেক সময় ঐরূপ হইয়া থাকে। ঠাকুর সেইজন্য ঐরূপ নরনারীকে কঠোর হইবার জন্য এবং তদ্বিপরীত প্রকৃতিবিশিষ্টদিগকে কোমল হইতে সর্বদা উপদেশ প্রদান করিতেন। আমাদিগের মধ্যে জনৈকের1 হৃদয় অতি কোমল ছিল। বিশিষ্ট কারণ বিদ্যমান থাকিলেও তাঁহার ক্রোধের উদয় হইতে বা তাঁহাকে রূঢ় বাক্য প্রয়োগ করিতে আমরা কখনও দেখিয়াছি কি না সন্দেহ। সম্পূর্ণ প্রকৃতিবিরুদ্ধ হইলেও এবং বিন্দুমাত্র ইচ্ছা না থাকিলেও মাতার চক্ষে জল দেখিতে না পারিয়া তিনি সহসা একদিন আপনাকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করিয়াছিলেন। ঠাকুরের আশ্রয় এবং আশ্বাসবাক্যই তাঁহাকে উক্ত কর্মনিবন্ধন প্রাণে দারুণ অনুতাপ ও হতাশ ভাবের উদয় হইতে সে যাত্রায় রক্ষা করিয়াছিল। ঐরূপ অযথা কোমলতা ও দয়ার ভাব সংযত করিয়া যাহাতে তিনি প্রতিকার্য বিচারপূর্বক সম্পাদন করেন তদ্বিষয়ে ঠাকুরের বিশেষ দৃষ্টি ছিল। সামান্য সামান্য বিষয়ের সহায়ে ঠাকুর কিরূপে তাঁহাকে শিক্ষাপ্রদান করিতেন, দুই-একটি ঘটনার উল্লেখেই তাহা বুঝিতে পারা যাইবে। ঠাকুরের বস্ত্রাদি যাহাতে রক্ষিত হইত তাহাতে একটি আরসোলা বাসা করিয়াছে, এক দিবস দেখিতে পাওয়া গেল। ঠাকুর বলিলেন, “আরসোলাটাকে ধরিয়া বাহিরে লইয়া গিয়া মারিয়া ফেল।” পূর্বোক্ত ব্যক্তি ঐরূপ আদেশ পাইয়া আরসোলাটাকে ধরিয়া বাহিরে লইয়া যাইলেন, কিন্তু না মারিয়া ছাড়িয়া দিয়া আসিলেন। আসিবামাত্র ঠাকুর তাঁহাকে প্রশ্ন করিলেন, “কি রে, আরসোলাটাকে মারিয়া ফেলিয়াছিস তো?” তিনি অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, “না মহাশয়, ছাড়িয়া দিয়াছি।” ঠাকুর তাহাতে তাঁহাকে ভর্ৎসনা করিয়া বলিলেন, “আমি তোকে মারিয়া ফেলিতে বলিলাম, তুই কি না সেটাকে ছাড়িয়া দিলি! যেমনটি করিতে বলিব ঠিক সেইরূপ করিবি, নতুবা ভবিষ্যতে গুরুতর বিষয়সকলেও নিজের মতে চলিয়া পশ্চাত্তাপ উপস্থিত হইবে।”


1. স্বামী যোগানন্দ।

স্বামী যোগানন্দকে ঐ বিষয়ক শিক্ষা

কলিকাতা হইতে গহনার নৌকায় করিয়া দক্ষিণেশ্বরে আসিবার কালে শ্রীযুত যোগেন একদিন অন্য এক আরোহীর দ্বারা জিজ্ঞাসিত হইয়া বলিয়াছিলেন, তিনি রানী রাসমণির কালীবাটীতে ঠাকুরের নিকট যাইতেছেন। ঐ কথা শুনিয়াই ঐ ব্যক্তি অকারণে ঠাকুরের নিন্দা করিতে করিতে বলিতে লাগিল, “ঐ এক ঢং আর কি; ভাল খাচ্চেন, গদিতে শুচ্চেন আর ধর্মের ভান করে যত সব স্কুলের ছেলের মাথা খাচ্চেন” ইত্যাদি। ঐরূপ কথাসকল শুনিয়া যোগেন মর্মাহত হইলেন; ভাবিলেন, তাহাকে দুই-চারিটি কথা শুনাইয়া দেন। পরক্ষণেই নিজ শান্ত প্রকৃতির প্রেরণায় তাঁহার মনে হইল, ঠাকুরের প্রকৃত পরিচয় পাইবার কিছুমাত্র চেষ্টা না করিয়া কত লোকে কত প্রকার বিপরীত ধারণা ও নিন্দাবাদ করিতেছে, তিনি তাহার কি করিতে পারেন। ঐরূপ ভাবিয়া তিনি ঐ ব্যক্তির কথার কিছুমাত্র প্রতিবাদ না করিয়া মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন এবং ঠাকুরের নিকটে উপস্থিত হইয়া কথাপ্রসঙ্গে ঐ ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা করিলেন। যোগেন ভাবিয়াছিলেন, নিরভিমান ঠাকুর – যাঁহাকে স্তুতি-নিন্দায় কেহ কখনও বিচলিত হইতে দেখে নাই – ঐ কথা শুনিয়া হাসিয়া উড়াইয়া দিবেন। ফল কিন্তু অন্যরূপ হইল। তিনি ঐ ঘটনা ভিন্ন আলোকে দেখিয়া যোগেনের ঐ বিষয়ে আচরণ সম্বন্ধে বলিয়া বসিলেন, “আমার অযথা নিন্দা করিল, আর তুই কি না তাহা চুপ করিয়া শুনিয়া আসিলি! শাস্ত্রে কি আছে জানিস? – গুরুনিন্দাকারীর মাথা কাটিয়া ফেলিবে, অথবা সেই স্থান পরিত্যাগ করিবে। তুই মিথ্যা রটনার একটা প্রতিবাদও করিলি না!”

ঐরূপ ঘটনাস্থলে নিরঞ্জনকে ঠাকুরের অন্যপ্রকার উপদেশ

ঐরূপ অন্য একটি ঘটনার এখানে উল্লেখ করিলেই পাঠক বুঝিতে পারিবেন, ঠাকুরের শিক্ষা ব্যক্তিবিশেষের প্রকৃতি কতদূর অনুসারী হইত। শ্রীযুত নিরঞ্জনের স্বভাবতঃ উগ্র প্রকৃতি ছিল। গহনার নৌকায় করিয়া একদিন দক্ষিণেশ্বরে আসিবার কালে আরোহীসকলকে পূর্বোক্তরূপে ঠাকুরের অযথা নিন্দাবাদ করিতে শুনিয়া তিনি প্রথমে উহার তীব্র প্রতিবাদে নিযুক্ত হইলেন এবং তাহাতে উহারা নিরস্ত না হওয়াতে বিষম ক্রুদ্ধ হইয়া নৌকা ডুবাইয়া দিয়া উহার প্রতিশোধ লইতে অগ্রসর হইলেন। নিরঞ্জনের শরীর বিশেষ দৃঢ় ও বলিষ্ঠ ছিল এবং তিনি বিলক্ষণ সন্তরণপটু ছিলেন। তাঁহার ক্রোধদৃপ্ত মূর্তির সম্মুখে সকলে ভয়ে জড়সড় হইয়া গেল এবং অশেষ অনুনয় বিনয় ও ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া নিন্দাকারীরা তাঁহাকে ঐ কর্ম হইতে নিরস্ত করিল। ঠাকুর ঐ কথা পরে জানিতে পারিয়া তাঁহাকে তিরস্কার করিয়া বলিয়াছিলেন, “ক্রোধ চণ্ডাল, ক্রোধের বশীভূত হইতে আছে? সৎ ব্যক্তির রাগ জলের দাগের মতো, হইয়াই মিলাইয়া যায়। হীনবুদ্ধি লোকে কত কি অন্যায় কথা বলে, তাহা লইয়া বিবাদ-বিসংবাদ করিতে গেলে উহাতেই জীবনটা কাটাইতে হয়! ঐরূপ স্থলে ভাবিবি লোক না পোক্ (কীট) এবং উহাদিগের কথা উপেক্ষা করিবি। ক্রোধের বশে কি অন্যায় করিতে উদ্যত হইয়াছিলি ভাব দেখি! দাঁড়ি-মাঝিরা তোর কি অপরাধ করিয়াছিল যে, সেই গরিবদের উপরেও অত্যাচার করিতে অগ্রসর হইয়াছিলি!”

স্ত্রী-ভক্তদিগকেও ঠাকুরের ঐভাবে শিক্ষাদানের দৃষ্টান্ত

পুরুষদিগের ন্যায় স্ত্রী-ভক্তগণের সম্বন্ধেও ঠাকুর স্বাভাবিক প্রকৃতি বুঝিয়া ঐরূপে উপদেশ প্রদান করিতেন। আমাদিগের স্মরণ হয়, বিশেষ কোমলস্বভাবা কোন রমণীকে একদিন তিনি নিম্নলিখিত কথাগুলি বলিয়া সতর্ক করিয়া দিয়াছিলেন – “যদি বুঝ তোমার পরিচিত কোন ব্যক্তি অশেষ আয়াস স্বীকারপূর্বক তোমাকে সকল বিষয়ে সহায়তা করিলেও নিজ দুর্বল চিত্তকে রূপজ মোহ হইতে সংযত করিতে না পারিয়া তোমার জন্য কষ্টভোগ করিতেছে, সেই স্থলে তোমার কি তাহার প্রতি দয়া প্রকাশ করিতে হইবে, অথবা কঠোরভাবে তাহার বক্ষে পদাঘাতপূর্বক চলিয়া আসিয়া চিরকালের মতো তাহার নিকট হইতে দূরে থাকিতে হইবে? অতএব বুঝ, যখন-তখন যেখানে-সেখানে যাহাকে-তাহাকে দয়া করা চলে না। দয়াপ্রকাশের একটা সীমা আছে, দেশ-কাল-পাত্রভেদে উহা কর্তব্য।”

হরিশের কথা

পূর্বোক্ত প্রসঙ্গে অন্য একটি কথা আমাদিগের মনে আসিতেছে। হরিশ বলিষ্ঠ যুবা পুরুষ। বাটীতে সুন্দরী স্ত্রী, শিশুপুত্র এবং মোটা ভাত-কাপড়ের সংস্থান ছিল। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সমীপে কয়েকবার আসিতে-না-আসিতে তাহার মন বিশেষভাবে বৈরাগ্যপ্রবণ হইয়া উঠিল! তাহার সরল স্বভাব, একনিষ্ঠা এবং শান্তভাব দেখিয়া ঠাকুরও তাহার প্রতি প্রসন্ন হইয়া তাহাকে আশ্রয় দান করিলেন। তদবধি ঠাকুরের সেবা ও ধ্যানজপপরায়ণ হইয়া হরিশ দক্ষিণেশ্বরেই অধিকাংশ কাল কাটাইতে লাগিল। অভিভাবকদিগের তাড়না, শ্বশুরালয়ের সাদরাহ্বান, স্ত্রীর ক্রন্দন কিছুতেই তাহাকে বিচলিত করিতে পারিল না। সে কাহারও কথায় ভ্রূক্ষেপ না করিয়া একপ্রকার মৌনাবলম্বনপূর্বক নিজ গন্তব্য পথে অগ্রসর হইতে লাগিল। ঠাকুর তাহার শান্ত একনিষ্ঠ প্রকৃতির দিকে আমাদিগের চিত্তাকর্ষণের জন্য মধ্যে মধ্যে বলিতেন, “মানুষ যারা, জ্যান্তে মরা – যেমন হরিশ!”

‘দয়াপ্রকাশের স্থান উহা নহে’

একদিন সংবাদ আসিল, সংসারের সকল কর্ম পরিত্যাগপূর্বক সাধনভজন লইয়া থাকাতে হরিশের বাটীর সকলে বিশেষ সন্তপ্ত হইয়াছে এবং তাহার স্ত্রী তাহাকে বহুকাল না দেখিতে পাইয়া শোকে অধীরা হইয়া একপ্রকার অন্নজল ত্যাগ করিয়াছে। হরিশ ঐ কথা শুনিয়া পূর্ববৎ নীরব রহিল। কিন্তু ঠাকুর তাহার মন জানিবার জন্য তাহাকে বিরলে ডাকাইয়া বলিলেন, “তোর স্ত্রী অত কাতর হইয়াছে, তা তুই একবার বাটীতে যাইয়া তাহাকে দেখা দিয়া আয় না কেন? তাহাকে দেখিবার কেহ নাই বলিলেই হয়1, তাহার উপরে একটু দয়া করিলে ক্ষতি কি?” হরিশ সকাতরে বলিল, “মহাশয়, দয়াপ্রকাশের স্থান উহা নহে। ঐ স্থলে দয়া করিতে যাইলে মায়ামোহে অভিভূত হইয়া জীবনের প্রধান কর্তব্য ভুলিয়া যাইবার সম্ভাবনা। আপনি ঐরূপ আদেশ করিবেন না।” ঠাকুর তাহার ঐ কথায় পরম প্রসন্ন হইয়াছিলেন এবং তদবধি হরিশের ঐ কথাগুলি মধ্যে মধ্যে আমাদিগের নিকটে উল্লেখ করিয়া তাহার বৈরাগ্যের প্রশংসা করিতেন।


1. হরিশের মাতা জীবিতা ছিলেন না, বোধ হয় সেইজন্য ঠাকুর ঐরূপ বলিয়াছিলেন।

দৈনিক সামান্য কার্যসকল লক্ষ্য করিয়া বিভিন্ন ব্যক্তিকে উপদেশ প্রদান

ঐরূপে সামান্য সামান্য দৈনিক কার্যসকলের উপর লক্ষ্য রাখিয়া আমাদিগের অন্তরের দোষ-গুণ পরিজ্ঞাত হইবার বিষয়ে ঠাকুরের সম্বন্ধে বহু দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যাইতে পারে। নিরঞ্জনকে অধিক পরিমাণে ঘৃত ভোজন করিতে দেখিয়া বলিয়াছিলেন, “অত ঘি খাওয়া! – শেষে কি লোকের ঝি-বউ বার করবি?” জনৈক অধিক নিদ্রা যাইত বলিয়া কিছুকাল ঠাকুরের অসন্তোষভাজন হইয়াছিল। চিকিৎসাশাস্ত্র-অধ্যয়নের ঝোঁকে পড়িয়া জনৈক তাঁহার নিষেধ অবহেলা করায় বলিয়াছিলেন, “কোথায় একে একে বাসনা ত্যাগ করিবি তাহা নহে, বাসনা-জালের বৃদ্ধি করিতেছিস, তাহা হইলে আধ্যাত্মিক উন্নতিলাভ আর কেমন করিয়া হইবে?” প্রসঙ্গান্তরে ঐরূপ অনেক দৃষ্টান্ত আমরা ইতঃপূর্বে সময়ে সময়ে পাঠকের নয়নগোচর করিয়াছি, সুতরাং ঐ বিষয়ে অধিক কথা এখানে বলা নিষ্প্রয়োজন।

(৪) তাঁহাতে সর্বশ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক প্রকাশ উপলব্ধি করিবার দিকে ব্যক্তিবিশেষ কতদূর অগ্রসর হইতেছে ঠাকুরের তাহা লক্ষ্য করা

আশ্রিত ব্যক্তিগণের স্বাভাবিক প্রকৃতি পূর্বোক্ত উপায়সকলের সহায়ে পরিজ্ঞাত হইয়া উহার দোষভাগ ধীরে ধীরে পরিবর্তনের চেষ্টামাত্র করিয়া ঠাকুর ক্ষান্ত হইতেন না – কিন্তু ঐ উদ্দেশ্য কতদূর সংসিদ্ধ হইল তদ্বিষয় বারংবার অনুসন্ধান করিতেন। তদ্ভিন্ন ঐরূপ কোন ব্যক্তির আধ্যাত্মিক উন্নতির পরিমাণ করিবার জন্য তাঁহাকে এক বিশেষ উপায় সর্বদা অবলম্বন করিতে দেখা যাইত। উপায়টি ইহাই:

৪র্থ – ব্যক্তিবিশেষ তাঁহার নিকটে প্রথম আসিবার কালে যে শ্রদ্ধা বা ভক্তিভাবের প্রেরণায় উপস্থিত হইত, সেই ভাবটি দিন দিন বর্ধিত হইতেছে কি না তদ্বিষয় অনুসন্ধান করা ঠাকুরের রীতি ছিল। ঐ বিষয় জানিবার জন্য তিনি কখনও কখনও নিজ আধ্যাত্মিক অবস্থা বা আচরণবিশেষের সম্বন্ধে ঐ ব্যক্তি কতদূর কিরূপ বুঝিতেছে তাহা জিজ্ঞাসা করিতেন, কখনও বা তাঁহার সকল কথায় সে সম্পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে কি না তাহা লক্ষ্য করিতেন, আবার কখনও বা নিজ সঙ্ঘমধ্যস্থ যে-সকল ব্যক্তির সহিত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে মিলিত হইলে তাহার ভাব গভীরতা প্রাপ্ত হইবে, তাহাদিগের সহিত তাহার পরিচয় করাইয়া দেওয়া প্রভৃতি নানা উপায়ে তাহাকে সহায়তা করিতেন। ঐরূপে যতদিন না ঐ ব্যক্তি অন্তরের স্বাভাবিক প্রেরণায় তাঁহাকে জগতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক আদর্শের প্রকাশ বলিয়া গ্রহণ করিতে সমর্থ হইত ততদিন পর্যন্ত তিনি তাহার ধর্মলাভ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হইতে পারিতেন না।

শেষোক্ত উপায়ের দ্বারা ব্যক্তিবিশেষের আধ্যাত্মিক উন্নতির পরিমাণ নির্ণয় ঠাকুরের পক্ষে স্বাভাবিক কেন

পূর্বোক্ত কথাগুলিতে পাঠক বিস্মিত হইবেন সন্দেহ নাই। কিন্তু স্বল্প চিন্তার ফলে বুঝিতে পারা যায় উহাতে বিস্ময়ের কারণ যে কিছুমাত্র নাই তাহা নহে, কিন্তু ঐরূপ করাই ঠাকুরের পক্ষে নিতান্ত যুক্তিযুক্ত ও স্বাভাবিক ছিল। বুঝিতে পারা যায়, তিনি আপনাতে অদৃষ্টপূর্ব আধ্যাত্মিকতাপ্রকাশের কথা সত্য সত্যই জানিতে পারিয়াছিলেন বলিয়া তাঁহার ঐরূপ আচরণ করা ভিন্ন উপায়ান্তর ছিল না। ‘লীলাপ্রসঙ্গ’-এর অন্যত্র আমরা পাঠককে বুঝাইতে প্রয়াস পাইয়াছি, দীর্ঘকালব্যাপী অলৌকিক তপস্যা ও ধ্যানসমাধি-সহায়ে ঠাকুরের অন্তরে অভিমান-অহঙ্কার সর্বথা বিনষ্ট হইয়া যখন তাঁহাতে ভ্রমপ্রমাদের সম্ভাবনা এককালে তিরোহিত হইয়াছিল তখন অখণ্ড স্মৃতি ও অনন্ত জ্ঞানপ্রকাশ উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে প্রাণে প্রাণে উপলব্ধি করাইয়াছিল – তাঁহার শরীর-মনাশ্রয়ে যেরূপ অভিনব আধ্যাত্মিক আদর্শ প্রকাশিত হইয়াছে, সংসারে ঐরূপ ইতঃপূর্বে আর কখনও কুত্রাপি হয় নাই। সুতরাং, ঐ কথা যথাযথ হৃদয়ঙ্গম করিয়া উক্ত আদর্শের আলোকে যে ব্যক্তি নিজ জীবন গঠন করিতে প্রয়াস পাইবে তাহারই বর্তমান যুগে আধ্যাত্মিক উন্নতিলাভ সুগম ও সহজসাধ্য হইবে এ বিষয়ে তাঁহাকে স্বতঃবিশ্বাস স্থাপন করিতে হইয়াছিল। ঐজন্য সমীপাগত ব্যক্তিগণ তাঁহার সম্বন্ধে পূর্বোক্ত বিষয় বুঝিয়াছে কি না এবং তৎপ্রদর্শিত মহদুদার ভাবাশ্রয়ে নিজ নিজ জীবনগঠনে সচেষ্ট হইয়াছে কি না তদ্বিষয় তিনি বিশেষরূপে অনুসন্ধান করিবেন, ইহা বিচিত্র নহে।

অন্তরের পূর্বোক্ত ধারণা ঠাকুর নানাভাবে আমাদিগের নিকটে প্রকাশ করিতেন। বলিতেন, “নবাবী আমলের মুদ্রা বাদশাহী আমলে চলে না”, “আমি যেরূপে বলিতেছি সেইরূপে যদি চলিয়া যাস, তাহা হইলে সোজাসুজি গন্তব্য স্থলে পৌঁছাইয়া যাইবি”, “যাহার শেষ জন্ম – যাহার সংসারে পুনঃপুনঃ আগমনের ও জন্ম-মরণের শেষ হইয়াছে, সেই ব্যক্তিই এখানে আসিবে এবং এখানকার ভাব গ্রহণ করিতে পারিবে”1, “তোমার ইষ্ট (উপাস্য দেব) (আপনাকে দেখাইয়া) ইহার ভিতরে আছেন, ইহাকে ভাবিলেই তাঁহাকে ভাবা হইবে”। – ইত্যাদি।

আশ্রিতগণের অন্তরে পূর্বোক্ত ভাবের উদয় হইয়া দিন দিন উহা দৃঢ়প্রতিষ্ঠ হইতেছে কি না তদ্বিষয় ঠাকুর কিরূপে অন্বেষণাদি করিতেন, ঐ সম্বন্ধে কয়েকটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিলে পাঠক আমাদিগের কথা বুঝিতে পারিবেন:


1. ঠাকুরের এই কথার বিস্তারিত আলোচনা আমরা ‘গুরুভাব – উত্তরার্ধ’-শীর্ষক গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ে করিয়াছি।

‘আমাকে কি মনে হয়’ – ঠাকুরের এই প্রশ্নে নানা ভক্তের নানা মত প্রকাশ

ঠাকুরের পুণ্যদর্শন ও অহৈতুকী কৃপালাভ করিবার যাঁহাদের সৌভাগ্য হইয়াছিল তাঁহারা প্রত্যেকেই বিদিত আছেন, তিনি তাঁহাদিগকে বিরলে অথবা দুই-চারিজন ভক্তের সম্মুখে সময়ে সময়ে সহসা প্রশ্ন করিয়া বসিতেন, “আচ্ছা, আমাকে তোমার কি মনে হয় বল দেখি?” দক্ষিণেশ্বরে কিছুকাল গমনপূর্বক তাঁহার সহিত সম্বন্ধ কিঞ্চিৎ ঘনিষ্ঠ হইবার পরেই সচরাচর ঐ প্রশ্নের উদয় হইত। তাহা বলিয়া প্রথম দর্শনে অথবা উহার স্বল্পকাল পরে ঐ প্রশ্ন তিনি যে কাহাকেও কখনও করেন নাই, তাহা নহে। যে-সকল ভক্তের আগমনের কথা তিনি তাহাদিগের আসিবার বহু পূর্বে যোগদৃষ্টিসহায়ে জ্ঞাত হইয়াছিলেন, তাহারা কেহ কেহ আসিবামাত্র তিনি ঐরূপ প্রশ্ন করিয়াছেন, আমরা জ্ঞাত আছি। ঐরূপে পৃষ্ট হইয়া তাঁহার আশ্রিতগণের প্রত্যেকে তাঁহাকে কত প্রকার উত্তর প্রদান করিত, তাহা বলিবার নহে। কেহ বলিত, ‘আপনি যথার্থ সাধু’ – কেহ বলিত, ‘যথার্থ ঈশ্বরভক্ত’ – কেহ ‘মহাপুরুষ’ – কেহ ‘সিদ্ধপুরুষ’ – কেহ ‘ঈশ্বরাবতার’ – কেহ ‘স্বয়ং শ্রীচৈতন্য’ – কেহ ‘সাক্ষাৎ শিব’ – কেহ ‘ভগবান’ – ইত্যাদি। ব্রাহ্মসমাজপ্রত্যাগত কেহ কেহ – যাহারা ঈশ্বরের অবতারত্বে বিশ্বাসবান ছিল না – বলিয়াছিল, “আপনি শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধ, ঈশা ও শ্রীচৈতন্যপ্রমুখ ভক্তাগ্রণীদিগের সমতুল্য, ঈশ্বরপ্রেমিক।” আবার খ্রীষ্টান-ধর্মাবলম্বী উইলিয়মস্1 নামক এক ব্যক্তি ঐরূপে জিজ্ঞাসিত হইয়া তাঁহাকে ‘নিত্যচিন্ময়বিগ্রহ ঈশ্বরপুত্র ঈশামসি’ বলিয়া নিজ মত প্রকাশ করিয়াছিলেন। উত্তরদাতাগণ ঠাকুরকে কতদূর বুঝিত বলিতে পারি না, কিন্তু ঐসকল বাক্য দ্বারা তাঁহার সম্বন্ধে এবং সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বর সম্বন্ধে নিজ নিজ মনোভাব যে যথাযথ ব্যক্ত করিত, তাহা বলা বাহুল্য। ঠাকুরও তাহাদিগের ঐ প্রকার উত্তরসকল পূর্বোক্ত আলোকে দেখিয়া যাহার যে প্রকার ভাব তাহার প্রতি সেই প্রকার আচরণ ও উপদেশাদি প্রদান করিতেন। কারণ, ভাবময় ঠাকুর কখনও কাহারও ভাব নষ্ট না করিয়া উহার পরিপুষ্টিতে যাহাতে সেই ব্যক্তি দেশকালাতীত সত্যস্বরূপ শ্রীভগবানের উপলব্ধি করিতে পারে তদ্বিষয়ে সর্বদা সহায়তা করিতেন। তবে উত্তরদাতা তাঁহার প্রশ্নে আপন অন্তরের ধারণা প্রকাশ করিতেছে অথবা অপরের দ্বারা প্রণোদিত হইয়া কথা কহিতেছে এ বিষয়ে তাঁহার বিশেষ লক্ষ্য থাকিত।


1. আমরা বিশ্বস্তসূত্রে শুনিয়াছি, এই ব্যক্তি কয়েকবার ঠাকুরের নিকটে গমনাগমন করিবার পরেই তাঁহাকে ঈশ্বরাবতার বলিয়া স্থির করিয়াছিলেন এবং তাঁহার উপদেশে সংসারত্যাগ করিয়া পাঞ্জাবপ্রদেশের উত্তরে অবস্থিত হিমালয়গিরির কোন স্থলে তপস্যাদিতে নিযুক্ত হইয়া শরীরপাত করিয়াছিলেন।

ঐ বিষয়ক ১ম দৃষ্টান্ত – ভক্ত পূর্ণচন্দ্র ও ‘ছেলেধরা মাস্টার’

পূর্ণ1 যখন ঠাকুরের নিকটে প্রথম আগমন করে তখন তাহাকে নিতান্ত বালক বলিলেই হয়। বোধ হয়, তাহার বয়স তখন সবেমাত্র তের বৎসর উত্তীর্ণ হইয়াছে। তখন ঠাকুরের পরম ভক্ত শ্রীযুক্ত মহেন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বারা সংস্থাপিত শ্যামবাজারের বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদে নিযুক্ত ছিলেন এবং বালকদিগের মধ্যে কাহাকেও স্বভাবত ঈশ্বরানুরাগী দেখিতে পাইলে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকটে লইয়া আসিতেছিলেন। ঐরূপে তেজচন্দ্র, নারায়ণ, হরিপদ, বিনোদ, (ছোট) নরেন, প্রমথ (পলটু) প্রভৃতি বাগবাজার-অঞ্চলের অনেকগুলি বালককে তিনি একে একে ঠাকুরের আশ্রয়ে লইয়া আসিয়াছিলেন। ঐজন্য আমাদিগের মধ্যে কেহ কেহ রহস্য করিয়া তাঁহাকে ‘ছেলেধরা মাস্টার’ বলিয়া নির্দেশ করিত এবং ঠাকুরও উহা শুনিয়া কখনও কখনও হাসিতে হাসিতে বলিতেন, “তাঁহার ঐ নাম উপযুক্ত হইয়াছে!” বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীতে পড়াইবার কালে পূর্ণের সুন্দর স্বভাব ও মধুর আলাপে তাঁহার চিত্ত একদিন আকৃষ্ট হইল এবং উহার অনতিকাল পরেই তিনি ঠাকুরের সহিত বালকের পরিচয় করাইয়া দিবার বন্দোবস্ত করিলেন। বন্দোবস্ত গোপনেই করা হইল। কারণ, পূর্ণের অভিভাবকেরা বিশেষ কড়া মেজাজের লোক ছিলেন – ঐ কথা জানিতে পারিলে শিক্ষক ও ছাত্র উভয় পক্ষেরই লাঞ্ছিত হইবার নিশ্চিত সম্ভাবনা ছিল। অতএব যথাসময়ে বিদ্যালয়ে আসিয়া পূর্ণ গাড়ি ভাড়া করিয়া দক্ষিণেশ্বরে চলিয়া যাইয়া স্কুলের ছুটি হইবার পূর্বেই প্রত্যাগমনপূর্বক অন্যদিনের ন্যায় বাটীতে ফিরিয়া গিয়াছিল।


1. পূর্ণচন্দ্র ঘোষ।

পূর্ণের আগমনে ঠাকুরের প্রীতি ও তাহার উচ্চাধিকার সম্বন্ধে কথা

পূর্ণকে দেখিয়া ঠাকুর সেদিন বিশেষ প্রীতিলাভ করিয়াছিলেন এবং পরম স্নেহে তাহাকে উপদেশপ্রদান ও জলযোগাদি করাইয়া দিয়া ফিরিবার কালে বলিয়া দিয়াছিলেন, “তোর যখনই সুবিধা হইবে চলিয়া আসিবি, গাড়ি করিয়া আসিবি, যাতায়াতের ভাড়া এখান হইতে দিবার বন্দোবস্ত থাকিবে।” পরে আমাদিগকে বলিয়াছিলেন, “পূর্ণ নারায়ণের অংশ, সত্ত্বগুণী আধার – নরেন্দ্রের (স্বামী বিবেকানন্দের) নীচেই পূর্ণের ঐ বিষয়ে স্থান বলা যাইতে পারে! এখানে আসিয়া ধর্মলাভ করিবে বলিয়া যাহাদিগকে বহুপূর্বে দেখিয়াছিলাম, পূর্ণের আগমনে সেই থাকের (শ্রেণীর) ভক্তসকলের আগমন পূর্ণ হইল – অতঃপর ঐরূপ আর কেহ এখানে আসিবে না।”

পূর্ণের সহিত ঠাকুরের সপ্রেম আচরণ

পূর্ণেরও সেদিন অপূর্ব ভাবান্তর উপস্থিত হইয়াছিল। ঠাকুরের সহিত সম্বন্ধবিষয়ক পূর্বস্মৃতি জাগরিত হইয়া তাহাকে এককালে স্থির ও অন্তর্মুখী করিয়া দিয়াছিল এবং তাহার দুনয়নে অজস্র আনন্দধারা বিগলিত হইয়াছিল। অভিভাবকদিগের ভয়ে বহু চেষ্টায় আপনাকে সামলাইয়া তাহাকে সেদিন বাটীতে ফিরিতে হইয়াছিল। তদবধি পূর্ণকে দেখিবার এবং খাওয়াইবার জন্য ঠাকুরের প্রাণে বিষম আগ্রহ উপস্থিত হইয়াছিল। সুবিধা পাইলেই তিনি নানাবিধ খাদ্যদ্রব্য তাহাকে পাঠাইয়া দিতেন এবং যে ব্যক্তি উহা লইয়া যাইত তাহাকে বিশেষ করিয়া বলিয়া দিতেন, সে যেন লুকাইয়া ঐসকল তাহার হস্তে দিয়া আসে – কারণ, বাটীতে ঐ কথা প্রকাশ হইলে তাহার উপর অত্যাচার হইবার সম্ভাবনা।

ঠাকুরের পূর্ণকে দেখিবার আগ্রহ ও তাহার সহিত দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎকালে জিজ্ঞাসা – ‘আমাকে তোর কি মনে হয়?’

পূর্ণের সহিত দেখা করিবার আগ্রহে আমরা ঠাকুরকে সময়ে সময়ে দরদরিত ধারে চক্ষের জল ফেলিতে দেখিয়াছি। তাঁহার ঐরূপ আচরণে আমাদিগকে বিস্মিত হইতে দেখিয়া তিনি একদিন বলিয়াছিলেন, “পূর্ণের উপরে এই টান (আকর্ষণ) দেখিয়াই তোরা অবাক হয়েছিস, নরেন্দ্রের (বিবেকানন্দের) জন্য প্রথম প্রথম প্রাণ যেরূপ ব্যাকুল হইত ও যেরূপ ছটফট করিতাম, তাহা দেখিলে না জানি কি হতিস!” সে যাহা হউক, পূর্ণকে দেখিবার জন্য ব্যাকুল হইলেই ঠাকুর এখন হইতে মধ্যাহ্নে কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইতেন এবং বাগবাজারে বলরাম বসুর ভবনে অথবা তদ্ঞ্চলের অন্য কোন ব্যক্তির বাটীতে উপস্থিত হইয়া সংবাদ প্রেরণপূর্বক তাহাকে বিদ্যালয় হইতে ডাকাইয়া আনিতেন। ঐরূপ কোন স্থলেই পূর্ণ ঠাকুরের পুণ্যদর্শন দ্বিতীয়বার লাভ করিয়াছিল এবং সেদিন সে এককালে আত্মহারা হইয়া পড়িয়াছিল। ঠাকুর সেদিন স্নেহময়ী জননীর ন্যায় তাহাকে স্বহস্তে খাওয়াইয়া দিয়াছিলেন এবং জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “আমাকে তোর কি মনে হয়, বল দেখি?” ভক্তিগদগদ হৃদয়ের অপূর্ব প্রেরণায় অবশ হইয়া পূর্ণ উহাতে বলিয়া উঠিয়াছিল, “আপনি ভগবান – সাক্ষাৎ ঈশ্বর!”

পূর্ণের উত্তরে ঠাকুরের আনন্দ ও তাহাকে উপদেশ

বালক পূর্ণ দর্শনমাত্রেই যে তাঁহাকে সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক আদর্শরূপে গ্রহণ করিতে পারিয়াছে, এ কথা জানিয়া ঠাকুরের সেদিন বিস্ময় ও আনন্দের অবধি ছিল না। তিনি তাহাকে সর্বান্তঃকরণে আশীর্বাদপূর্বক শক্তিপূত মন্ত্রসহিত সাধনরহস্যের উপদেশ করিয়াছিলেন। পরে দক্ষিণেশ্বরে প্রত্যাগমনপূর্বক আমাদিগকে বারংবার বলিয়াছিলেন, “আচ্ছা, পূর্ণ ছেলেমানুষ, বুদ্ধি পরিপক্ব হয় নাই, সে কেমন করিয়া ঐ কথা বুঝিল, বল দেখি? আরও কেহ কেহ দিব্য সংস্কারের প্রেরণায় পূর্ণের মতো ঐ প্রশ্নের ঐরূপ উত্তর দিয়াছে! উহা নিশ্চয় পূর্বজন্মকৃত সংস্কার। ইহাদিগের শুদ্ধ সাত্ত্বিক অন্তরে সত্যের ছবি স্বভাবত পূর্ণপরিস্ফুট হইয়া উঠে!”

সংসারী পূর্ণের মহত্ত্ব

ঘটনাচক্রে পূর্ণকে দারপরিগ্রহ করিয়া সাধারণের ন্যায় সংসারযাত্রা নির্বাহ করিতে হইয়াছিল – কিন্তু তাহার সহিত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে যাহারা সম্বদ্ধ হইয়াছিল, তাহারা সকলেই তাহার অলৌকিক বিশ্বাস, ঈশ্বরনির্ভরতা, সাধনপ্রিয়তা, নিরভিমানিতা ও সর্বপ্রকারে আত্মত্যাগের সম্বন্ধে এক বাক্যে সাক্ষ্যপ্রদান করিয়া থাকে।

দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত – বৈকুণ্ঠনাথকে ঠাকুরের ঐ বিষয়ক প্রশ্ন ও তাহার উত্তর

আশ্রিত ভক্তগণকে পূর্বোক্তভাবে প্রশ্ন করা বিষয়ে আর একটি দৃষ্টান্তের আমরা এখানে উল্লেখ করিব। দক্ষিণেশ্বরে আগমনের স্বল্পকাল পরে আমাদিগের সুপরিচিত জনৈক ব্যক্তিকে ঠাকুর একদিবস নিজ গৃহস্থিত মহাপ্রভুর সঙ্কীর্তনের ছবিখানি দেখাইয়া বলিলেন, “সকলে কেমন ঈশ্বরীয় ভাবে বিভোর হয়েছে দেখছিস?”

ঐ ব্যক্তি – ওরা সব ছোট লোক, মহাশয়।

ঠাকুর – সে কিরে? ও কথা বলতে আছে!

ঐ ব্যক্তি – হাঁ মহাশয়, আমার নদীয়ায় বাড়ি, আমি জানি বষ্টুম ফষ্টুম ছোটলোকে হয়।

ঠাকুর – তোর নদীয়ায় বাড়ি, তবে তোকে আর একটা প্রণাম।1 আচ্ছা, রাম প্রভৃতি (আপনাকে দেখাইয়া) ইহাকে অবতার বলে, তোর কি মনে হয়, বল দেখি?

ঐ ব্যক্তি – তারা তো ভারী ছোট কথা বলে, মহাশয়!

ঠাকুর – সে কিরে? ভগবানের অবতার বলে, আর তুই বলচিস ছোট কথা বলে!

ঐ ব্যক্তি – হাঁ মহাশয়, অবতার তো তাঁর (ঈশ্বরের) অংশ, আমার আপনাকে সাক্ষাৎ শিব বলিয়া মনে হয়।

ঠাকুর – বলিস কিরে?

ঐ ব্যক্তি – ঐরূপ মনে হয়, তা কি করব বলুন? আপনি শিবের ধ্যান করিতে বলিয়াছেন, কিন্তু নিত্য চেষ্টা করিলেও উহা কিছুতেই পারি না! ধ্যান করিতে বসিলেই আপনার প্রসন্ন মুখখানি সম্মুখে জ্বলজ্বল করিতে থাকে, উহাকে সরাইয়া শিবকে কিছুতেই মনে আনিতে পারি না, ইচ্ছাও হয় না! সুতরাং আপনাকে শিব বলিয়া ভাবি।

ঠাকুর – (হাসিতে হাসিতে) বলিস কিরে! আমি কিন্তু জানি, আমি তোর একগাছি ছোট কেশের সমান (উভয়ের হাস্য)। যাহোক, তোর জন্য বড় ভাবনা ছিল, আজ নিশ্চিন্ত হইলাম।

শেষোক্ত কথাগুলি ঠাকুর কেন বলিলেন, তাহা ঐ ব্যক্তি তখন বুঝিয়াছিলেন কি না বলিতে পারি না। আমাদিগের জানা আছে, ঐরূপ স্থলে ঠাকুর প্রসন্ন হইয়াছেন – এই কথা বুঝিয়াই আমাদিগের প্রাণ পূর্ণ হইয়া উঠিত এবং তাঁহার ঐরূপ কথাসকল বুঝিবার প্রবৃত্তি থাকিত না! এখন বুঝিতে পারি, তাঁহাকে সর্বশ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক আদর্শ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে জানিয়াই ঠাকুর ঐ ব্যক্তিকে ঐ দিবস ঐ কথাগুলি বলিয়াছিলেন।


1. কাহারও সহিত সাক্ষাৎ হইবামাত্র তাহাকে প্রণাম করা ঠাকুরের রীতি ছিল। এই ব্যক্তিকে ইতঃপূর্বে ঐরূপ করিয়াছিলেন বলিয়া পুনরায় প্রণাম করিবার সময় তিনি এই কথা বলিয়াছিলেন।

কথায় ও কার্যে যাহার মিল নাই তাহাকে বিশ্বাস করিতে নাই

আশ্রিত ভক্তগণ তদীয় সর্বপ্রকার আচরণ তন্নতন্নভাবে লক্ষ্য করিয়া বুঝিয়া সুঝিয়া যাহাতে তাঁহাকে ঐরূপে গ্রহণ করে তজ্জন্য ঠাকুরের বিশেষ প্রযত্ন ছিল। কারণ, প্রায়ই তিনি আমাদিগকে বলিতেন, “সাধুকে দিনে দেখিবি, রাত্রে দেখিবি, তবে সাধুকে বিশ্বাস করিবি।” সাধু অপরকে যাহা শিক্ষা দেয় স্বয়ং তাহা অনুষ্ঠান করে কি না তদ্বিষয় বিশেষরূপে লক্ষ্য করিতে ঠাকুর আমাদিগকে সর্বদা উৎসাহিত করিতেন। বলিতেন – কথায় এবং কার্যে, মন ও মুখে যাহার মিল নাই, তাহার কথায় কখনও বিশ্বাস করিতে নাই। ঐ প্রসঙ্গে একটি গল্পও তাঁহাকে কখনও কখনও বলিতে শুনিয়াছি।

ঐ বিষয়ে ঠাকুরের গল্প – বৈদ্য ও অসুস্থ বালক

কোন ব্যক্তির স্বল্পবয়স্ক পুত্র সর্বদা অজীর্ণরোগে কষ্ট পাইত। পিতা তাহার চিকিৎসার জন্য তাহাকে গ্রামান্তরে এক বিখ্যাত বৈদ্যের নিকট লইয়া যাইল। বৈদ্য বালককে পরীক্ষাদি করিয়া তাহার রোগনির্ণয় করিলেন, কিন্তু ঔষধের ব্যবস্থা সেদিন না করিয়া তাহাকে পরদিবসে পুনরায় আসিতে বলিলেন।

পিতা পুত্রকে লইয়া ঐদিন উপস্থিত হইলে বৈদ্য বালককে বলিলেন, “তুমি গুড় খাওয়া পরিত্যাগ কর, তাহা হইলেই সারিয়া যাইবে, ঔষধ খাইবার প্রয়োজন নাই।” পিতা ঐ কথা শুনিয়া বলিল, “মহাশয়, ঐ কথা তো কাল বলিলেই পারিতেন; তাহা হইলে এতটা কষ্ট করিয়া আজি এতদূর আসিতে হইত না!” বৈদ্য তাহাতে বলিলেন, ‘কি জান, কল্য আমার এখানে কয়েক কলসি গুড় ছিল – দেখিয়াছিলে বোধ হয়। কাল যদি বালককে গুড় খাইতে নিষেধ করিতাম, তাহা হইলে সে ভাবিত কবিরাজ লোক মন্দ নয়, নিজে এত গুড় খাইতেছে আর আমাকে কি না গুড় খাইতে নিষেধ করিতেছে। ঐরূপ ভাবিয়া সে আমার কথায় শ্রদ্ধা করা দূরে থাকুক কিছুমাত্র বিশ্বাস করিত না। সেজন্য গুড়ের কলসি সরাইবার পূর্বে তাহাকে ঐ কথা বলি নাই।’

ভক্তগণের ঠাকুরকে পরীক্ষা

ঠাকুরের ঐরূপ শিক্ষার প্রেরণায় আমরা সকলে তাঁহার আচরণসমূহ বিশেষভাবে লক্ষ্য করিতাম। কেহ কেহ আবার উহার প্রভাবে তাঁহাকে পরীক্ষা করিতেও পশ্চাৎপদ হইত না! ফলে দেখা গিয়াছে, নিজ নিজ বিশ্বাসভক্তি বৃদ্ধির জন্য সরলান্তঃকরণে আমরা তাঁহার উপরে যে যাহা আবদার-অত্যাচার করিয়াছি, সে সকলই তিনি প্রসন্নমনে সহ্য করিয়াছেন। নিম্নলিখিত দৃষ্টান্তপাঠে পাঠকের ঐ কথা সম্যক হৃদয়ঙ্গম হইবে।

১ম দৃষ্টান্ত – যোগানন্দ স্বামীর কথা

যোগানন্দ স্বামীজীর সম্বন্ধে কোন কথা আমরা ইতঃপূর্বে পাঠককে বলিয়াছি। ঘটনাটি তাঁহাকে লইয়াই হইয়াছিল এবং তাঁহারই নিকটে আমরা পরে শ্রবণ করিয়াছিলাম। শ্রীযুত যোগানন্দের পরিচয় সংক্ষেপে পাঠককে প্রথমে প্রদানপূর্বক আমরা উহা বলিতে প্রবৃত্ত হইব। যোগানন্দের পূর্বনাম যোগীন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী ছিল। সুবিখ্যাত সাবর্ণ চৌধুরীদের বংশে ইনি জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। পিতা নবীনচন্দ্র এককালে ধনাঢ্য জমিদার ছিলেন এবং পুরুষানুক্রমে দক্ষিণেশ্বর গ্রামেই বাস করিতেছিলেন। যোগীন্দ্রের বাল্যকালে এবং তৎপূর্বে তাঁহার বাসভবন ভারত-ভাগবতাদি গ্রন্থপাঠে, পূজা ও কীর্তনাদিতে সর্বদা মুখরিত থাকিত। ঠাকুর বলিতেন, সাধনকালে তিনি বহু বার ঐ ভবনে হরিকথা শুনিতে গিয়াছিলেন এবং কর্তাদিগের কাহারও কাহারও সহিত পরিচিত ছিলেন। কিন্তু যোগীন্দ্র কৈশোরকাল অতিক্রম করিতে না করিতে গৃহবিসংবাদ এবং অন্য নানা কারণে তাঁহাদিগের অধিকাংশ সম্পত্তি নষ্ট হইয়া চৌধুরীবংশীয়েরা দিন দিন নিঃস্ব হইয়াছিলেন।

যোগীন্দ্রের পুণ্য সংস্কারসমূহ ও বুদ্ধিমত্তা

যোগীন্দ্র বাল্যকাল হইতেই ধীর, বিনয়ী ও মধুর প্রকৃতিসম্পন্ন ছিলেন। অসাধারণ শুভ সংস্কারসকল লইয়া তিনি সংসারে জন্মপরিগ্রহ করিয়াছিলেন। জ্ঞানোন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে বাল্যকালে তাঁহার সর্বদা মনে হইত তিনি পৃথিবীর লোক নহেন, এখানে তাঁহার আবাস নহে, অতি দূরের কোন এক নক্ষত্রপুঞ্জে তাঁহার যথার্থ আবাস এবং সেখানেই তাঁহার পূর্বপরিচিত সঙ্গীসকল এখনও রহিয়াছে! আমরা তাঁহাকে কখনও ক্রোধ করিতে দেখি নাই। স্বামী বিবেকানন্দ বলিতেন, ‘আমাদিগের ভিতর যদি কেহ সর্বতোভাবে কামজিৎ থাকে তো সে যোগীন।’ সরলভাবে সকলকে বিশ্বাস করিবার জন্য ঠাকুরের নিকটে কখনও কখনও তিরস্কৃত হইলেও যোগীন্দ্র নির্বোধ ছিলেন না; এবং সর্বদা শান্তভাবে নিজ কার্যে ব্যাপৃত থাকিলেও তাঁহার বিচারশীল মন সকলের সকল কার্য লক্ষ্যপূর্বক তাহাদিগের সম্বন্ধে যে-সকল মতামত স্থির করিত তাহা সত্য ভিন্ন প্রায় মিথ্যা হইত না। সেইজন্য যোগীন্দ্রের বুদ্ধিমান বলিয়া একটু অহঙ্কার ছিল বলিয়া বোধ হয়।

ঠাকুরের কথা – যোগীন্দ্র ঈশ্বরকোটি ভক্ত

দক্ষিণেশ্বরে বসবাস থাকায় যৌবনে পদার্পণ করিতে না করিতে যোগীন ঠাকুরের পুণ্যদর্শনলাভে ধন্য হইয়াছিলেন। প্রথম আগমনদিবসে ঠাকুর ইঁহাকে দেখিয়া ইঁহার পরিচয় পাইয়া বিশেষ প্রীত হইয়াছিলেন এবং বুঝিয়াছিলেন তাঁহার নিকটে ধর্মলাভ করিতে আসিবে বলিয়া যে-সকল ব্যক্তিকে শ্রীশ্রীজগন্মাতা তাঁহাকে বহুপূর্বে দেখাইয়াছিলেন, যোগীন কেবলমাত্র তাঁহাদিগের অন্যতম নহেন, কিন্তু যে ছয়জন বিশেষ ব্যক্তিকে ঈশ্বরকোটি বলিয়া জগদম্বার কৃপায় তিনি পরে জানিতে পারিয়াছিলেন, ইনি তাঁহাদিগেরও অন্যতম।

যোগীন্দ্রের বিবাহ, মনস্তাপ ও ঠাকুরের নিকটে গমনে বিরত হওয়ায় ঠাকুরের কৌশলপূর্বক তাহাকে আনয়ন ও সান্ত্বনা

আমরা অন্যত্র বলিয়াছি মাতার করুণ ক্রন্দনে যোগীন সম্পূর্ণ অনিচ্ছাসত্ত্বেও সহসা বিবাহ করিয়াছিলেন। তিনি বলিতেন, “বিবাহ করিয়াই মনে হইল ঈশ্বরলাভের আশা করা এখন বিড়ম্বনামাত্র; যে ঠাকুরের প্রথম শিক্ষা কামিনীকাঞ্চনত্যাগ তাঁহার কাছে আর কিসের জন্য যাইব; হৃদয়ের কোমলতায় জীবনটা নষ্ট করিয়াছি, উহা আর ফিরিবার নহে; এখন যত শীঘ্র মৃত্যু হয় ততই মঙ্গল। পূর্বে ঠাকুরের নিকটে প্রতিদিন যাইতাম, ঐ ঘটনার পরে এককালে যাওয়া বন্ধ করিলাম এবং দারুণ হতাশা ও মনস্তাপে দিন কাটাইতে লাগিলাম। ঠাকুর কিন্তু ছাড়িলেন না। বারংবার লোক প্রেরণ করিয়া ডাকিয়া পাঠাইতে লাগিলেন এবং তাহাতেও যাইলাম না দেখিয়া অপূর্ব কৌশল অবলম্বন করিলেন। কালীবাটীর এক ব্যক্তি কোন দ্রব্য ক্রয় করিয়া দিবার নিমিত্ত আমাকে বিবাহের পূর্বে কয়েকটি মুদ্রা দিয়াছিলেন। দ্রব্যটির মূল্য প্রদান করিয়া দুই-চারি আনা পয়সা উদ্বৃত্ত হইয়াছিল। দ্রব্যটি লোক মারফত তাঁহাকে পাঠাইয়া বলিয়া দিয়াছিলাম, উদ্বৃত্ত পয়সা শীঘ্র পাঠাইতেছি। ঠাকুর উহা জানিতে পারিয়া একদিন কৃত্রিম কোপ প্রকাশপূর্বক আমাকে বলিয়া পাঠাইলেন, ‘তুই কেমন লোক? লোকে জিনিস কিনিতে দিলে তাহার হিসাব দেওয়া, বাকি পয়সা ফিরাইয়া দেওয়া দূরে থাকুক, কবে দিবি তাহার একটা সংবাদ পাঠানো পর্যন্ত নাই!’ ঐ কথায় আমার হৃদয়ে বিষম অভিমান জাগিয়া উঠিল; ভাবিলাম, ঠাকুর আমাকে এতদিন পরে জুয়াচোর মনে করিলেন! থাক, আজ কোনরূপে যাইয়া এই গণ্ডগোল মিটাইয়া দিয়া আসিব; পরে কালীবাড়ির দিক আর মাড়াইব না। হতাশা, অনুতাপ, অভিমান, অপমানাদি নানা ভাবে মৃতকল্প হইয়া অপরাহ্ণে কালীবাড়িতে যাইলাম। দূর হইতে দেখিতে পাইলাম, ঠাকুর পরিধানের কাপড়খানি বগলে ধারণ করিয়া গৃহের বাহিরে আসিয়া যেন ভাবাবিষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া আছেন। আমাকে দেখিবামাত্র বেগে অগ্রসর হইয়া বলিতে লাগিলেন, ‘বিবাহ করিয়াছিস, তাহাতে ভয় কি? এখানকার কৃপা থাকিলে লাখটা বিবাহ করিলেও কোন ক্ষতি হইবে না; যদি সংসারে থাকিয়া ঈশ্বরলাভ করিতে চাস তাহা হইলে তোর স্ত্রীকে একদিন এখানে লইয়া আসিস – তাহাকে ও তোকে সেইরূপ করিয়া দিব; আর যদি সংসারত্যাগ করিয়া ঈশ্বরলাভ করিতে চাস, তাহা হইলে তাহাই করিয়া দিব!’ অর্ধবাহ্যদশায় অবস্থিত ঠাকুরের ঐ কথাগুলি একেবারে প্রাণের ভিতরে স্পর্শ করিল এবং ইতঃপূর্বের হতাশ অন্ধকার কোথায় অন্তর্হিত হইয়া গেল! অশ্রুপূর্ণনয়নে তাঁহাকে প্রণাম করিলাম। তিনিও সস্নেহে আমার হাত ধরিয়া গৃহে প্রবেশ করিলেন এবং পূর্বোক্ত হিসাব ও উদ্বৃত্ত পয়সার কথা যখন তুলিতে যাইলাম তখন সে কথায় কর্ণপাতও করিলেন না।” গৃহত্যাগী উদাসীনের ভাব লইয়া যোগীন্দ্র সংসারে আসিয়াছিলেন, বিবাহ করিয়াও তাঁহার ঐ ভাব কিছুমাত্র পরিবর্তিত হইল না। পূর্বের ন্যায় ঠাকুরের সেবায় ও আশ্রয়েই তাঁহার দিন কাটিতে লাগিল। পুত্রকে বিষয়কর্ম ও অর্থোপার্জনে উদাসীন দেখিয়া পিতামাতা অনুযোগ করিতে লাগিলেন। যোগীন বলিতেন, “ঐরূপ অনুযোগের কালে মাতা একদিন বলিলেন, ‘যদি উপার্জনে মন দিবি না তবে বিবাহ করিলি কেন?’ বলিলাম, ‘আমি তো ঐ সময়ে তোমাদিগকে বারংবার বলিয়াছিলাম বিবাহ করিব না; তোমার ক্রন্দন সহ্য করিতে না পারিয়াই তো পরিশেষে ঐ কার্যে সম্মত হইলাম।’ মাতা ক্রুদ্ধা হইয়া ঐ কথায় বলিয়া বসিলেন, ‘ওটা কি আবার একটা কথা! – ভিতরে ইচ্ছা না হইলে তুই আমার জন্য বিবাহ করিয়াছিস, ইহা কি সম্ভবে?’ তাঁহার ঐ কথায় এককালে নির্বাক হইয়া ভাবিতে লাগিলাম, হা ভগবান! যাঁহার কষ্ট না দেখিতে পারিয়া তোমাকে ছাড়িতে উদ্যত হইলাম, তিনিই এই কথা বলিলেন! দূর হোক, এই সংসারে মন ও মুখে মিল থাকা একমাত্র ঠাকুর ভিন্ন আর কাহারও নাই। সেইদিন হইতে সংসারে এককালে বীতরাগ উপস্থিত হইল। ঐ ঘটনার পর হইতে ঠাকুরের নিকটে মাঝে মাঝে রাত্রেও থাকিতে লাগিলাম।”

যোগীন্দ্রের দক্ষিণেশ্বরে রাত্রিবাস

ঠাকুরের নিকটে সমস্ত দিবস অতিবাহিত করিয়া যোগীন্দ্র একদিন দেখিলেন, সন্ধ্যার প্রাক্কালে সমাগত ভক্তগণের সকলেই একে একে বিদায় গ্রহণপূর্বক নিজ নিজ ভবনে চলিয়া গেল। কোনরূপ প্রয়োজন উপস্থিত হইলে রাত্রে লোকাভাবে ঠাকুরের কষ্ট হইতে পারে ভাবিয়া তিনি সেদিন বাটীতে ফিরিবার সঙ্কল্প পরিত্যাগ করিলেন। ঠাকুরও যোগীনের ঐরূপ করায় বিশেষ প্রসন্ন হইলেন। ঈশ্বরীয় আলাপে ক্রমে রাত্রি দশটা বাজিয়া গেল। ঠাকুর তখন জলযোগ করিলেন এবং যোগীন্দ্রের ভোজন শেষ হইলে তাঁহাকে গৃহমধ্যেই শয়ন করিতে বলিয়া স্বয়ং শয্যাগ্রহণ করিলেন। রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর অতীত হইলে ঠাকুরের বহির্গমনের ইচ্ছা উপস্থিত হওয়ায় তিনি যোগীনের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, সে অকাতরে নিদ্রা যাইতেছে। কাঁচা ঘুম ভাঙাইলে কষ্ট হইবে ভাবিয়া তাঁহাকে না ডাকিয়া তিনি একাকী পঞ্চবটী-অভিমুখে অগ্রসর হইয়া ঝাউতলায় চলিয়া যাইলেন।

ঠাকুরের প্রতি সন্দেহ

যোগীন্দ্র চিরকাল স্বল্পনিদ্র ছিলেন। ঠাকুর চলিয়া যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হইল। গৃহের দ্বার খোলা রহিয়াছে দেখিয়া তিনি উঠিয়া বসিলেন এবং শয্যায় ঠাকুরকে দেখিতে না পাইয়া ভাবিতে লাগিলেন, তিনি এত রাত্রে কোথায় গমন করিয়াছেন। গাড়ু প্রভৃতি জলপাত্রসকল যথাস্থানে রহিয়াছে দেখিয়া ভাবিলেন, ঠাকুর বুঝি তবে বাহিরে পাদচারণ করিতেছেন। যোগীন্দ্র বাহিরে আসিলেন, জ্যোৎস্নালোকের সাহায্যে চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন, কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। তখন তাঁহার মনে দারুণ সন্দেহ উপস্থিত হইল – তবে কি ঠাকুর নহবতে নিজ পত্নীর নিকটে শয়ন করিতে গিয়াছেন? – তবে কি তিনিও মুখে যাহা বলেন, কার্যে তাহার বিপরীত অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন?

যোগীন্দ্রের সংশয়ের মীমাংসা

যোগীন্দ্র বলিতেন, “ঐ চিন্তার উদয়মাত্র সন্দেহ, ভয় প্রভৃতি নানা ভাবের যুগপৎ সমাবেশে এককালে অভিভূত হইয়া পড়িলাম। পরে স্থির করিলাম, নিতান্ত কঠোর এবং রুচিবিরুদ্ধ হইলেও যাহা সত্য তাহা জানিতে হইবে। অনন্তর নিকটবর্তী এক স্থানে দাঁড়াইয়া নহবতখানার দ্বারদেশ লক্ষ্য করিতে থাকিলাম। কিছুকাল ঐরূপ করিতে না করিতে পঞ্চবটীর দিক হইতে চটিজুতার চটচট শব্দ শুনিতে পাইলাম এবং অবিলম্বে ঠাকুর আসিয়া সম্মুখে দণ্ডায়মান হইলেন। আমাকে দেখিয়া বলিলেন, ‘কি রে, তুই এখানে দাঁড়াইয়া আছিস যে?’ তাঁহার উপরে মিথ্যা সন্দেহ করিয়াছি বলিয়া লজ্জা ও ভয়ে জড়সড় হইয়া অধোবদনে দাঁড়াইয়া থাকিলাম, ঐ কথার কোন উত্তর দিতে পারিলাম না। ঠাকুর আমার মুখ দেখিয়াই সকল কথা বুঝিতে পারিলেন এবং অপরাধ গ্রহণ না করিয়া আশ্বাস প্রদানপূর্বক বলিলেন, ‘বেশ, বেশ, সাধুকে দিনে দেখিবি, রাত্রে দেখিবি, তবে বিশ্বাস করিবি!’ ঐ কথা বলিয়া ঠাকুর আমাকে অনুসরণ করিতে বলিয়া নিজ গৃহের দিকে অগ্রসর হইলেন। সন্দিগ্ধ স্বভাবের প্রেরণায় কি ভয়ানক অপরাধ করিয়া বসিলাম, এ কথা ভাবিয়া সে রাত্রে আমার আর নিদ্রা হইল না।”

যোগীন্দ্রের গুরুপদে আত্ম-সমর্পণ

গুরুপদে সর্বতোভাবে আত্মোৎসর্গ করিয়া প্রথমে তাঁহার, এবং তাঁহার অন্তর্ধানে শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানীর সেবাতে প্রাণপাত করিয়া স্বামী যোগানন্দ পরজীবনে পূর্বোক্ত অপরাধের সম্যক প্রায়শ্চিত্ত করিয়াছিলেন। তাঁহার ন্যায় তীব্র-বৈরাগ্যসম্পন্ন, জ্ঞান ও ভক্তির সমভাবে অধিকারী, সমাধিমান যোগী পুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-সন্ন্যাসিসঙ্ঘে বিরল দেখিতে পাওয়া যায়। ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দের প্রারম্ভে তিনি দেহরক্ষা করিয়া পরমপদে মিলিত হইয়াছিলেন।

নরেন্দ্রের কার্য লক্ষ্য করিয়া ঠাকুর তাঁহার সম্বন্ধে যেরূপ ধারণা করেন

দক্ষিণেশ্বর-আগমনের পর হইতে ঠাকুর যে নরেন্দ্রনাথের প্রতি কার্য তন্ন তন্ন করিয়া নিত্য লক্ষ্য করিয়াছিলেন এ কথা আমরা ইতঃপূর্বেই উল্লেখ করিয়াছি। উহার ফলে তিনি বুঝিয়াছিলেন, ধর্মানুরাগ, সাহস, সংযম, বীর্য ও মহদুদ্দেশ্যে আত্মোৎসর্গ করা প্রভৃতি সদ্গুণসকল নরেন্দ্রের হৃদয়ে স্বভাবত প্রদীপ্ত রহিয়াছে। বুঝিয়াছিলেন, শুভ সংস্কারনিচয় তাঁহার হৃদয়ে এত অধিক বিদ্যমান রহিয়াছে যে, প্রতিকূল অবস্থায় পড়িয়া বিশেষরূপে প্রলুব্ধ হইলেও ইতরসাধারণের ন্যায় হীন কার্যের অনুষ্ঠান তাঁহার দ্বারা কখনও সম্ভবপর হইবে না। আর, সত্যনিষ্ঠা – নরেন্দ্রের কঠোর সত্যপালন দেখিয়া তিনি যে কেবল তাহার সকল কথায় বিশ্বাস করিতেন তাহাই নহে, কিন্তু তাঁহার প্রাণে দৃঢ় ধারণা হইয়াছিল, শীঘ্রই তাহার এমন অবস্থা উপস্থিত হইবে যখন সত্য ভিন্ন মিথ্যা বাক্য প্রমাদকালেও তাহার মুখ দিয়া নির্গত হইবে না – যখন তাহার মনের যদৃচ্ছা-উত্থিত সঙ্কল্পসকলও সর্বদা সত্যে পরিণত হইবে। সেজন্য তিনি তাহাকে ঐ বিষয়ে সর্বদা উৎসাহ প্রদানপূর্বক বলিতেন, “যে কায়মনোবাক্যে সত্যকে ধরিয়া থাকে, সে সত্যস্বরূপ ঈশ্বরের দর্শনলাভে ধন্য হয়”, – “বার বৎসর কায়মনোবাক্যে সত্যপালন করিলে মানব সত্যসঙ্কল্প হয়”।

রহস্যজনক ঘটনা – চামচিকাকে চাতক নির্ণয়

সত্যনিষ্ঠার জন্য নরেন্দ্রনাথের উপর ঠাকুরের দৃঢ় বিশ্বাস সম্বন্ধে একটি রহস্যজনক ঘটনা আমাদিগের মনে উদয় হইতেছে। একদিন কথাপ্রসঙ্গে ঠাকুর ভক্তের স্বভাব চাতক পক্ষীর ন্যায় হইয়া থাকে বলিয়া বুঝাইয়া দিতেছিলেন, “চাতক যেমন নিজ পিপাসা শান্তির জন্য সর্বদা মেঘের দিকে তাকাইয়া থাকে এবং উহার উপর সর্বতোভাবে নির্ভর করে, ভক্তও তদ্রূপ নিজ প্রাণের পিপাসা ও সর্বপ্রকার অভাব মিটাইবার জন্য একমাত্র ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে” – ইত্যাদি। নরেন্দ্রনাথ তখন তথায় উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি সহসা বলিয়া উঠিলেন, “মহাশয়, চাতক বৃষ্টির জল ভিন্ন অন্য কিছু পান করে না – ঐরূপ প্রসিদ্ধ থাকিলেও ঐ কথা সত্য নহে, অন্য পক্ষীসকলের ন্যায় নদী প্রভৃতি জলাশয়েও পিপাসা শান্তি করিয়া থাকে। আমি চাতক পক্ষীকে ঐরূপে জলপান করিতে দেখিয়াছি।” ঠাকুর বলিলেন, “সে কিরে – চাতক অন্য পক্ষীর ন্যায় জলপান করে? তবে তো আমার এতকালের ধারণা মিথ্যা হলো। তুই যখন দেখিয়াছিস তখন তো আর ঐ বিষয়ে সন্দেহ করিতে পারি না।” বালকের ন্যায় স্বভাবসম্পন্ন ঠাকুর ঐরূপ বলিয়াই নিশ্চিন্ত হইলেন না, ভাবিতে লাগিলেন – ঐ ধারণাটা যেমন ভ্রম বলিয়া প্রমাণিত হইল তাঁহার অন্য ধারণাসকলও তো ঐরূপ হইতে পারে। ঐরূপ ভাবিয়া তিনি বিশেষ বিষণ্ণ হইলেন। উহার স্বল্পদিন পরেই নরেন্দ্র এক দিবস ঠাকুরকে সহসা ডাকিয়া বলিলেন, “ঐ দেখুন মহাশয়, চাতক গঙ্গার জল পান করিতেছে।” ঠাকুর ব্যস্ত হইয়া দেখিতে আসিয়া বলিলেন, “কই রে?” নরেন্দ্র দেখাইয়া দিলে তিনি দেখিলেন একটি চামচিকা জলপান করিতেছে এবং হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “ওটা চামচিকা যে! ওরে শালা, তুই চামচিকাকে চাতক জ্ঞান করিয়া আমাকে এতটা ভাবাইয়াছিস! তোর সকল কথায় আর বিশ্বাস করিব না।”

নরেন্দ্রের সংযম

সম্মান, শিষ্টাচার, সৌন্দর্যানুভব প্রভৃতি ভাবসমূহের প্রেরণায় যতদূর কোমল হওয়া সম্ভবপর, রমণীর সম্মুখে সাধারণ মানবের অন্তর অনেক সময়ে তদপেক্ষা অধিকতর মৃদুভাব অবলম্বন করে। হৃদয়ের সুপ্রচ্ছন্ন সংস্কারবিশেষ উহাকে ঐরূপ করিয়া থাকে, এ কথা শাস্ত্রসম্মত। নরেন্দ্রনাথের হৃদয়ে ঐরূপ সংস্কার চিরকাল স্বল্প পরিলক্ষিত হইত! উহা লক্ষ্য করিয়া ঠাকুরের মনে দৃঢ় ধারণা হইয়াছিল, নরেন্দ্র রূপজ মোহে আত্মহারা হইয়া সংযমের পথ হইতে কখনও ভ্রষ্ট হইবে না। ঘন ঘন ভাবসমাধি হওয়ার জন্য আমাদিগের নিকটে এক সময়ে উচ্চসম্মানপ্রাপ্ত জনৈকের1 সহিত নরেন্দ্রনাথের পূর্বোক্ত বিষয়ে তুলনা করিয়া ঠাকুর এক দিবস বলিয়াছিলেন, “রমণীগণের আদরযত্নে ঐ ব্যক্তি যেন এককালে আত্মহারা হইয়া গড়াইয়া পড়ে, নরেন্দ্র কখনও ঐরূপ হয় না; বিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখিয়াছি, ঐরূপ স্থলে সে মুখে কিছু না বলিলেও তাহার ভাব দেখিয়া মনে হয় সে যেন বিরক্ত হইয়া ঘাড় বাঁকাইয়া বলিতেছে, ‘এরা আবার এখানে কেন?'”


1. নৃত্যগোপাল – ইনি পরজীবনে জ্ঞানানন্দ স্বামী নাম গ্রহণ করিয়াছিলেন।

শারীরিক লক্ষণ দেখিয়া নরেন্দ্রের অন্তরের ভক্তির পরিমাণ নির্ণয়

জ্ঞানের প্রকাশ এবং পুরুষোচিত ভাবসমূহ প্রবল থাকিলেও নরেন্দ্রনাথের ভিতরে কোমলতা ও ভক্তিভাবের স্বল্পতা ছিল না, ঠাকুর ঐ কথা আমাদিগকে অনেক সময়ে বলিয়াছেন। সামান্য সামান্য আচরণে প্রকাশিত কেবলমাত্র তাঁহার মনের ভাবসকল লক্ষ্য করিয়াই তিনি যে উক্ত সিদ্ধান্তে উপস্থিত হইয়াছিলেন তাহা নহে, কিন্তু তাঁহার শারীরিক লক্ষণসকল দেখিয়াও তিনি ঐ বিষয়ে স্থির করিয়াছিলেন। আমাদের স্মরণ হয়, একদিন নরেন্দ্রনাথের মুখ-শ্রী দেখিতে দেখিতে তিনি বলিয়াছিলেন, “এইরূপ চক্ষু কি কখনো শুষ্ক জ্ঞানীর হইয়া থাকে? জ্ঞানের সহিত রমণীসুলভ ভক্তির ভাব তোর ভিতরে বিলক্ষণ রহিয়াছে। কেবলমাত্র পুরুষোচিত ভাবসকল যাহার ভিতরে থাকে তাহার স্তনের বোঁটার চারিদিকে ভেলার দাগ (কালবর্ণ) থাকে না – মহাবীর অর্জুনের ঐরূপ ছিল।”

ঠাকুরের উদাসীনতায় নরেন্দ্রের আচরণ

পূর্বোল্লিখিত চারিপ্রকার সাধারণ উপায় ভিন্ন আমাদিগের জ্ঞাত ও অজ্ঞাত অন্য নানা প্রকারে ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে পরীক্ষা করিয়াছিলেন। তন্মধ্যে প্রধান দুই-একটির কথা আমরা পাঠককে অতঃপর বলিব। আমরা ইতঃপূর্বে বলিয়াছি, নরেন্দ্রনাথ দক্ষিণেশ্বরে আসিলে ঠাকুর তাঁহাকে লইয়াই ব্যস্ত হইতেন। তাঁহাকে দূরে দেখিবামাত্র ঠাকুরের সম্পূর্ণ অন্তর যেন প্রবল বেগে শরীর হইতে নির্গত হইয়া তাঁহাকে প্রেমালিঙ্গনে আবদ্ধ করিত! “ঐ ন -, ঐ ন -” বলিতে বলিতে আমরা কতদিন ঠাকুরকে ঐরূপে সমাধিস্থ হইয়া পড়িতে দেখিয়াছি তাহা বলা যায় না। ঐরূপ হইলেও কিন্তু দক্ষিণেশ্বরে কিছুকাল যাতায়াত করিবার পরে এমন একদিন আসিয়াছিল যেদিন নরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিকটে আগমন করিলে তিনি তাঁহার সহিত সর্বপ্রকারে উদাসীনের ন্যায় আচরণ আরম্ভ করিয়াছিলেন। নরেন্দ্র আসিলেন, ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন, সম্মুখে উপবিষ্ট হইয়া কিছুকাল অপেক্ষা করিলেন – ঠাকুর কিন্তু আদরযত্ন করা দূরে থাকুক একবার কুশলপ্রশ্ন পর্যন্ত না করিয়া সম্পূর্ণ অপরিচিতের ন্যায় তাঁহার দিকে একবার দৃষ্টিপাতপূর্বক আপন মনে বসিয়া রহিলেন। নরেন্দ্র ভাবিলেন, ঠাকুর বুঝি ভাবাবিষ্ট রহিয়াছেন। অগত্যা কিছুক্ষণ পরে গৃহের বাহিরে আসিয়া হাজরা মহাশয়ের সহিত বাক্যালাপে ও তামাকুসেবনে নিযুক্ত রহিলেন। ঠাকুর অপরের সহিত কথা কহিতেছেন শুনিতে পাইয়া নরেন্দ্র পুনরায় তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইলেন, তখনো ঠাকুর তাঁহাকে কিছুই না বলিয়া অপর দিকে মুখ ফিরাইয়া শয্যায় শয়ন করিলেন। ঐরূপে সমস্ত দিন অতিবাহিত হইয়া সন্ধ্যা উপস্থিত হইলেও ঠাকুরের ভাবান্তর না দেখিয়া নরেন্দ্র তাঁহাকে প্রণাম করিয়া কলিকাতায় ফিরিলেন।

সপ্তাহকাল অতীত হইতে না হইতে নরেন্দ্রনাথ পুনরায় দক্ষিণেশ্বরে আগমনপূর্বক ঠাকুরকে তদবস্থ দেখিলেন। সেদিনও হাজরা মহাশয় ও অন্যান্য ব্যক্তির সহিত নানাবিধ আলাপে সমস্ত দিন অতিবাহিত করিয়া সন্ধ্যার প্রাক্কালে তিনি বাটীতে ফিরিয়া আসিলেন। ঐরূপে তৃতীয় এবং চতুর্থ দিবস দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হইয়াও নরেন্দ্র ঠাকুরের কিছুমাত্র ভাবান্তর দেখিতে পাইলেন না। কিন্তু উহাতেও তিনি কিছুমাত্র ক্ষুব্ধ বা বিচলিত না হইয়া পূর্বের ন্যায় সমভাবে ঠাকুরের নিকটে গমনাগমন করিতে থাকিলেন। নরেন্দ্র বাটীতে থাকিবার কালে ঠাকুর তাঁহার কুশলসংবাদাদি লইতে মধ্যে মধ্যে কাহাকেও পাঠাইতেন বটে, কিন্তু নিকটে আসিলেই তাঁহার সহিত ঐরূপ ব্যবহার কিছুকাল পর্যন্ত করিয়াছিলেন। একমাসের অধিক কাল ঐরূপে গত হইলে ঠাকুর যখন দেখিতে পাইলেন নরেন্দ্রনাথ দক্ষিণেশ্বরে আগমন করিতে বিরত হইলেন না, তখন একদিন তাঁহাকে নিকটে ডাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আচ্ছা, আমি তো তোর সহিত একটা কথাও কহি না, তবু তুই এখানে কি করিতে আসিস বল দেখি?” নরেন্দ্র বলিলেন, “আমি কি আপনার কথা শুনিতে এখানে আসি? আপনাকে ভালবাসি, দেখিতে ইচ্ছা করে, তাই আসিয়া থাকি।” ঠাকুর ঐ কথায় বিশেষ প্রসন্ন হইয়া বলিলেন, “আমি তোকে বিড়ে (পরীক্ষা করে) দেখছিলাম – আদরযত্ন না পেলে তুই পালাস কি না; তোর মতো আধারই এতটা (অবজ্ঞা ও উদাসীনভাব) সহ্য করিতে পারে – অপরে এতদিন কোন্ কালে পলায়ন করিত, এদিক আর মাড়াইত না।”

ঈশ্বরদর্শনের আগ্রহে নরেন্দ্রের অণিমাদি বিভূতি প্রত্যাহার

আর একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিয়া আমরা বর্তমান প্রসঙ্গের উপসংহার করিব। ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ দর্শনলাভের আগ্রহ নরেন্দ্রনাথের অন্তরে কতদূর প্রবল ছিল, তাহা উহার সহায়ে সবিশেষ হৃদয়ঙ্গম হইবে। এক সময়ে ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে পঞ্চবটীতলে আহ্বানপূর্বক বলিয়াছিলেন, “দ্যাখ, তপস্যাপ্রভাবে আমাতে অণিমাদি বিভূতিসকল অনেক কাল হইল উপস্থিত হইয়াছে। কিন্তু আমার ন্যায় ব্যক্তির, যাহার পরিধানের কাপড় পর্যন্ত ঠিক থাকে না, তাহার ঐসকল যথাযথ ব্যবহার করিবার অবসর কোথায়? তাই ভাবিতেছি, মাকে বলিয়া তোকে ঐসকল প্রদান করি; কারণ, মা জানাইয়া দিয়াছেন, তোকে তাঁর অনেক কাজ করিতে হইবে। ঐসকল শক্তি তোর ভিতরে সঞ্চারিত হইলে কার্যকালে ঐসকল ব্যবহারে লাগাইতে পারিবি – কি বলিস?” ঠাকুরের পুণ্যদর্শন লাভ করিবার দিন হইতে নরেন্দ্র দৈবীশক্তির অশেষ প্রকাশ তাঁহাতে নয়নগোচর করিয়াছিলেন। সুতরাং তাঁহার ঐ কথায় অবিশ্বাস করিবার নরেন্দ্রের কোন কারণ ছিল না। অবিশ্বাস না করিলেও কিন্তু তাঁহার হৃদয়ের স্বাভাবিক ঈশ্বরানুরাগ তাঁহাকে ঐসকল বিভূতি নির্বিচারে গ্রহণ করিতে পরামর্শ দিল না। তিনি চিন্তিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়, ঐসকলের দ্বারা আমার ঈশ্বরলাভ-বিষয়ে সহায়তা হইবে কি?” ঠাকুর বলিলেন, “সে বিষয়ে সহায়তা না হইলেও ঈশ্বরলাভ করিয়া যখন তাঁহার কার্য করিতে প্রবৃত্ত হইবি, তখন উহারা বিশেষ সহায়তা করিতে পারিবে।” নরেন্দ্র ঐ কথা শুনিয়া বলিলেন, “মহাশয়, আমার ঐসকলে প্রয়োজন নাই। আগে ঈশ্বরলাভ হউক, পরে ঐসকল গ্রহণ করা না করা সম্বন্ধে স্থির করা যাইবে। বিচিত্র বিভূতিসকল এখন লাভ করিয়া যদি উদ্দেশ্য ভুলিয়া যাই এবং স্বার্থপরতার প্রেরণায় উহাদিগকে অযথা ব্যবহার করিয়া বসি, তাহা হইলে সর্বনাশ হইবে যে!” ঠাকুর নরেন্দ্রকে অণিমাদি বিভূতিসকল সত্য-সত্য প্রদান করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন, অথবা তাঁহার অন্তর পরীক্ষার জন্য পূর্বোক্তভাবে ব্যবহার করিয়াছিলেন, তাহা নিশ্চয় বলা আমাদিগের সাধ্যাতীত – কিন্তু নরেন্দ্র ঐসকল গ্রহণে অসম্মত হওয়াতে তিনি যে বিশেষ প্রসন্ন হইয়াছিলেন, এ কথা আমাদিগের জানা আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *