11 of 11

৫৯.০৩ নরেন্দ্রের পূর্বকথা

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

নরেন্দ্রের পূর্বকথা

মঠে কালী তপস্বীর ঘরে দুইটি ভক্ত বসিয়া আছেন। একটি ত্যাগী ও একটি গৃহী। উভয়েরই বয়স ২৪।২৫। দুইজনে কথা কহিতেছেন। এমন সময়ে মাস্টার আসিলেন। তিনি মঠে তিন দিন থাকবেন।

আজ গুডফ্রাইডে, ৮ই এপ্রিল, (২৬শে চৈত্র, ১২৯৩, পূর্ণিমা) শুক্রবার। এখন বেলা ৮টা হইবে। মাস্টার আসিয়া ঠাকুরঘরে গিয়া ঠাকুর প্রণাম করিলেন। তৎপরে নরেন্দ্র, রাখাল ইত্যাদি ভক্তদের সহিত দেখা করিয়া ক্রমে এই ঘরে আসিয়া বসিলেন ও দুইটি ভক্তকে সম্ভাষণ করিয়া ক্রমে তাঁহাদের কথা শুনিতে লাগিলেন। গৃহী ভক্তটির ইচ্ছা সংসারত্যাগ করেন। মঠের ভাইটি তাঁহাকে বুঝাচ্ছেন, যাতে সংসারত্যাগ না করে।

ত্যাগী ভক্ত — কিছু কর্ম যা আছে — করে ফেল না। একটু করলেই তারপর শেষ হয়ে যাবে।

“একজন শুনেছিল তার নরক হবে। সে একজন বন্ধুকে বললে, ‘নরক কি রকম গা?’ বন্ধুটি একটু খড়ি নিয়ে নরক আঁকতে লাগল। নরক যেই আঁকা হয়েছে অমনি ওই লোকটি তাতে গড়াগড়ি দিয়ে ফেললে। তার বললে, এইবার আমার নরক ভোগ হয়ে গেল।

গৃহী ভক্ত — আমার সংসার ভাল লাগে না, আহা, তোমরা কেমন আছ!

ত্যাগী ভক্ত — তুই অত বকিস কেন? বেরিয়ে যাবি যাস। — কেন, একবার সখ করে ভোগ করে নে না।

নয়টার পর ঠাকুরঘরে শশী পূজা করিলেন।

প্রায় এগারটা বাজিল। মঠের ভাইরা ক্রমে ক্রমে গঙ্গাস্নান করিয়া আসিলেন। স্নানের পর শুদ্ধবস্ত্র পরিধান করিয়া প্রত্যেকে ঠাকুরঘরে গিয়া ঠাকুরকে প্রণাম ও তৎপরে ধ্যান করিতে লাগিলেন।

ঠাকুরের ভোগের পর মঠের ভাইরা বসিয়া প্রসাদ পাইলেন; মাস্টারও সেই সঙ্গে প্রসাদ পাইলেন।

সন্ধ্যা হইল। ধুনা দিবার পর ক্রমে আরতি হইল। দানাদের ঘরে রাখাল, শশী, বুড়োগোপাল ও হরিশ বসিয়া আছেন। মাস্টারও আছেন। রাখাল ঠাকুরের খাবার খুব সাবধানে রাখিতে বলিতেছেন।

রাখাল (শশী প্রভৃতির প্রতি) — আমি একদিন তাঁর জলখাবার আগে খেয়েছিলাম। তিনি দেখে বললেন, “তোর দিকে চাইতে পারছি না। তুই কেন এ কর্ম করলি!” — আমি কাঁদতে লাগলুম।

বুড়োগোপাল — আমি কাশীপুরে তাঁর খাবারের উপর জোরে নিঃশ্বাস ফেলেছিলুম, তখন তিনি বললেন, “ও খাবার থাক।”

বারান্দার উপর মাস্টার নরেন্দ্রের সহিত বেড়াইতেছেন ও উভয়ে অনেক কথাবার্তা কহিতেছেন।

নরেন্দ্র বলিলেন, আমি তো কিছুই মানতুম না। — জানেন?

মাস্টার — কি, রূপ-টুপ?

নরেন্দ্র — তিনি যা যা বলতেন, প্রথম প্রথম অনেক কথাই মানতুম না। একদিন তিনি বলেছিলেন, ‘তবে আসিস কেন?’

“আমি বললাম, আপনাকে দেখতে আসি, কথা শুনতে নয়।”

মাস্টার — তিনি কি বললেন?

নরেন্দ্র — তিনি খুব খুশি হলেন।

পরদিন — শনিবার। ৯ই এপ্রিল, ১৮৮৭। ঠাকুরের ভোগের পর মঠের ভাইরা আহার করিয়াছেন ও একটু বিশ্রামও করিয়াছেন। নরেন্দ্র ও মাস্টার মঠের পশ্চিমগায়ে যে বাগান আছে, তাহার একটি গাছতলায় বসিয়া নির্জনে কথা কহিতেছেন। নরেন্দ্র ঠাকুরের সহিত সাক্ষাতের পর যত পূর্বকথা বলিতেছেন। নরেন্দ্রের বয়স ২৮, মাস্টারের ৩২ বৎসর।

মাস্টার — প্রথম দেখার দিনটি তোমার বেশ স্মরণ পড়ে?

নরেন্দ্র — সে দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়িতে। তাঁহারই ঘরে। সেইদিনে এই দুটি গান গেয়েছিলাম:

মন চল নিজ নিকেতনে।
সংসার বিদেশে, বিদেশীর বেশে, ভ্রম কেন অকারণে।।
বিষয় পঞ্চক আর ভূতগণ, সব তোর পর কেউ নয় আপন।
পর প্রেমে কেন হইয়ে মগন, ভুলিছ আপন জনে।।
সত্যপথে মন কর আরোহণ, প্রেমের আলো জ্বালি চল অণুক্ষণ।
সঙ্গেতে সম্বল রাখ পুণ্য ধন, গোপনে অতি যতনে।।
লোভ মোহ আদি পথে দস্যুগণ, পথিকের করে সর্বস্ব মোষণ।
পরম যতনে রাখ রে প্রহরী শম দম দুই জনে।।
সাধুসঙ্গ নাম আছে পান্থধাম, শ্রান্ত হলে তথা করিও বিশ্রাম।
পথভ্রান্ত হলে সুধাইও পথ সে পান্থ-নিবাসীহলে।।
যতি দেখ পথে ভয়েরি আকার, প্রাণপণে দিও দোহাই রাজার।
সে পথে রাজার প্রবল প্রতাপ, শমন ডরে যাঁর শাসনে।।

গান – যাবে কি হে দিন আমার বিফলে চলিয়ে।
আছি নাথ দিবানিশি আশাপথ নিরখিয়ে।।
তুমি ত্রিভুবন নাথ, আমি ভিখারি অনাথ।
কেমনে বলিব তোমায় এস হে মম হৃদয়ে।।
হৃদয়-কুটীর-দ্বার, খুলে রাখি আনিবার।
কৃপা করি একবার এসে কি জুড়াবে হিয়ে।।

মাস্টার — গান শুনে কি বললেন?

নরেন্দ্র — তাঁর ভাব হয়ে গিছল। রামবাবুদের জিজ্ঞাসা করলেন, “এ ছেলেটি কে? আহা কি গান!” আমায় আবার আসতে বললেন।

মাস্টার — তারপর কোথায় দেখা হল?

নরেনদ্র — তারপর রাজমোহনের বাড়ি তারপর আবার দক্ষিণেশ্বরে। সেবারে আমায় দেখে ভাবে আমায় স্তব করতে লাগলেন। স্তব করে বলতে লাগলেন, ‘নারায়ণ, তুমি আমার জন্য দেহধারণ করে এসেছ!’

“কিন্তু এ কথাগুলি কাহাকেও বলবেন না।”

মাস্টার — আর কি বললেন?

নরেন্দ্র — তুমি আমার জন্য দেহধারণ করে এসেছ। মাকে বলেছিলাম, ‘মা, আমি কি যেতে পারি! গেলে কার সঙ্গে কথা কব? মা, কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী শুদ্ধভক্ত না পেলে কেমন করে পৃথিবীতে থাকব! বললেন, তুই রাত্রে এসে আমায় তুললি, আর আমায় বললি ‘আমি এসেছি।’ আমি কিন্তু কিছু জানি না, কলিকাতার বাড়িতে তোফা ঘুম মারছি।

মাস্টার — অর্থাৎ, তুমি এক সময় Present-J বটে, Absent-J বটে, যেমন ঈশ্বর সাকারও বটেন, নিরাকারও বটেন!

নরেন্দ্র — কিন্তু এ-কথা কারুকে বলবেন না।

[নরেন্দ্রের প্রতি লোকশিক্ষার আদেশ]

নরেন্দ্র — কাশীপুরে তিনি শক্তিসঞ্চার করে দিলেন।

মাস্টার — যে সময়ে কাশীপুরের বাগানে গাছতলায় ধুনি জ্বেলে বসতে, না?

নরেন্দ্র — হাঁ। কালীকে বললাম, আমার হাত ধর দেখি। কালী বললে, কি একটা Shock তোমার গা ধরাতে আমার গায়ে কাগল।

“এ-কথা (আমাদের মধ্যে) কারুকেও বলবেন না — Promise করুন।”

মাস্টার — তোমার উপর শক্তি সঞ্চার করলেন, বিশেষ উদ্দেশ্য আছে, তোমার দ্বারা অনেক কাজ হবে। একদিন একখানা কাগজে লিখে বলেছিলেন, ‘নরেন শিক্ষে দিবে।’

নরেন্দ্র — আমি কিন্তু বলেছিলাম, ‘আমি ও-সব পারব না।’

“তিনি বললেন, ‘তোর হাড় করবে।’ শরতের ভার আমার উপর দিয়েছেন। ও এখন ব্যাকুল হয়েছে। ওর কুণ্ডলিনী জাগ্রত হয়েছে।”

মাস্টার — এখন পাতা না জমে। ঠাকুর বলতেন, বোধ হয়ে মনে আছে যে, পুকুরের ভিতর মাছের গাড়ি হয় অর্থাৎ গর্ত, যেখানে মাছ এসে বিশ্রাম করে। যে গাড়িতে পাতা এসে জমে যায়, সে গাড়িতে মাছ এসে থাকে না।

[নরেন্দ্রের অখণ্ডের ঘর ]

নরেন্দ্র — নারায়ণ বলতেন।

মাস্টার — তোমায় — “নারায়ণ” বলতেন, — তা জানি।

নরেন্দ্র — তাঁর ব্যামোর সময় শোচাবার জল এগিয়ে দিতে দিতেন না।

“কাশীপুরে বললেন, ‘চাবি আমার কাছে রইল, ও আপনাকে জানতে পারলে দেহত্যাগ করবে’।”

মাস্টার — যখন তোমার একদিন সেই অবস্থা হয়েছিল, না?

নরেন্দ্র — সেই সময়ে বোধ হয়েছিল, যেন আমার শরীর নাই কেবল মুখটি আছে। বাড়িতে আইন পড়ছিলুম, একজামিন দেব বলে। তখন হঠাৎ মনে হল, কি করছি!

মাস্টার — যখন ঠাকুর কাশীপুরে আছেন?

নরেন্দ্র — হাঁ। পাগলের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম! তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুই কি চাস?’ আমি বললাম, ‘আমি সমাধিস্থ হয়ে থাকব।’ তিনি বললেন, ‘তুই তো বড় হীনবুদ্ধি! সমাধির পারে যা! সমাধি তো তুচ্ছ কথা।’

মাস্টার — হাঁ, তিনি বলতেন, জ্ঞানের পর বিজ্ঞান। ছাদে উঠে আবার সিঁড়িতে আনাগোনা করা।

নরেন্দ্র — কালী জ্ঞান জ্ঞান করে। আমি বকি। জ্ঞান কততে হয়? আগে ভক্তি পাকুক।

“আবার তারকবাবুকে দক্ষিণেশ্বরে বলেছিলেন, ‘ভাব-ভক্তি কিছু শেষ নয়’।”

মাস্টার — তোমার বিষয় আর কি কি বলেছেন বল!

নরেন্দ্র — আমার কথায় এতো বিশ্বাস যে যখন বললাম, আপনি রূপ-টুপ যা দেখেন ও সব মনের ভুল। তখন মার কাছে গয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মা, নরেন্দ্র এই সব কথা বলেছে, তবে এ-সব কি ভুল? তারপর আমাকে বললেন, ‘মা বললে, ও-সব সত্য!’

“বলতেন, বোধ হয় মনে আছে, ‘তোর গান শুনলে (বুকে হাত দিয়া দেখাইয়া) এর ভিতর যিনি আছেন তিনি সাপের ন্যায়ে ফোঁস করে যেন ফণা ধরে স্থির হয়ে শুনতে থাকেন!’

“কিন্তু মাস্টার মহাশয়, এত তিনি বললেন, কই আমার কি হল!”

মাস্টার — এখন শিব সেজেছ, পয়সা নেবার জো নাই। ঠাকুরের গল্প তো মনে আছে?

নরেন্দ্র — কি, বলুন না একবার।

মাস্টার — বহুরূপী শিব সেজেছিল। যাদের বাড়ি গিছল, তারা একটা টাকা দিতে এসেছিল; সে নেয় নি! বাড়ি থেকে হাত-পা ধুয়ে এসে টাকা চাইলে। বাড়ির লোকেরা বললে, তখন যে নিলে না? সে বললে, ‘তখন শিব সেজেছিলাম — সন্ন্যাসী — টাকা ছোঁবার জো নাই।’

এই কথা শুনিয়া নরেন্দ্র অনেকক্ষণ ধরিয়া খুব হাসিতে লাগিলেন।

মাস্টার — তুমি এখন রোজা সেজেছ। তোমার উপর সব ভার। তুমি মঠের ভাইদের মানুষ করবে।

নরেন্দ্র — সাধন-টাধন যা আমরা করছি, এ-সব তাঁর কথায়। কিন্তু Strange (আশ্চর্যের বিষয়) এই যে, রামবাবু এই সাধন নিয়ে খোঁটা দেন। রামবাবু বলেন, ‘তাঁকে দর্শন করেছি, আবার সাধন কি?’

মাস্টার — যার যেমন বিশ্বাস সে না হয় তাই করুক।

নরেন্দ্র — আমাদের যে তিনি সাধন করতে বলেছেন।

নরেন্দ্র ঠাকুরের ভালবাসার কথা আবার বলছেন।

নরেন্দ্র — আমার জন্য মার কাছে কত কথা বলেছেন। যখন খেতে পাচ্ছি না — বাবার কাল হয়েছে — বাড়িতে খুব কষ্ট — আখন আমার জন্য মার কাছে টাকা প্রার্থনা করেছিলেন।

মাস্টার — তা জানি; তোমার কাছে শুনেছিলাম।

নরেন্দ্র — টাকা হল না। তিনি বললেন, ‘মা বলেছেন, মোটা ভাত, মোটা কাপড় হতে পারে। ভাত-ডাল হতে পারে।’

“এতো আমাকে ভালবাসা, — কিন্তু যখন কোন অপবিত্র ভাব এসেছে অমনি টের পেয়েছেন! অন্নদার সঙ্গে যখন বেড়াতাম, অসৎ লোকের সঙ্গে কখন কখন গিয়ে পড়েছিলাম। তাঁর কাছে এলে আমার হাতে আর খেলেন না, খানিকটা হাত উঠে আর উঠলো না। তাঁর ব্যামোর সময় তাঁর মুখ পর্যন্ত উঠে আর উঠলো না। বললেন, ‘তোর এখনও হয় নাই।’

“এক-একবার খুব অবিশ্বাস আসে। বাবুরামদের বাড়িতে কিছু নাই বোধ হল। যেন ইশ্বর-টীশ্বর কিছুই নাই।”

মাস্টার — ঠাকুর তো বলতেন, তাঁরও এরূপ অবস্থা এক-একবার হত।

দুজনে চুপ করে আছেন। মাস্টার বলিতেছেন — “ধন্য তোমরা! রাতদিন তাঁকে চিন্তা করছো!” নরেন্দ্র বলিলেন, “কই? তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না বলে শরীরত্যাগ করতে ইচ্ছা হচ্ছে কই?”

রাত্রি হইয়াছে। নিরঞ্জন ৺পুরীধাম হইতে কিয়ৎক্ষণ ফিরিয়াছেন। তাঁহাকে দেখিয়া মঠের ভাইরা ও মাস্টার সকলেই আনন্দ প্রকাশ করিলেন। তিনি পুরী যাত্রার বিবরণ বলিতে লাগিলেন। নিরঞ্জনের বয়স এখন ২৫।২৬ হইবে, সন্ধ্যারতির পর কেহ কেহ ধ্যান করিতেছেন। নিরঞ্জন ফিরিয়াছেন বলিয়া অনেকে বড় ঘরে (দানাদের ঘরে) আসিয়া বসিলেন ও সদালাপ করিতে লাগিলেন। রাত ৯টার পর শশী ৺ঠাকুরের ভোগ দিলেন ও তাঁহাকে শয়ন করাইলেন।

মঠের ভাইরা নিরঞ্জনকে লইয়া রাত্রের আহার করিতে বসিলেন। খাদ্যের মধ্যে রুটি, একটা তরকারি ও একটু গুড়; আর ঠাকুরের যৎকিঞ্চিৎ সুজির পায়সাদি প্রসাদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *