10 of 11

৫৪.০১ নরেন্দ্র

পরিশিষ্ট

শ্রীরামকৃষ্ণ ও নরেন্দ্র (স্বামী বিবেকানন্দ)
[VIVEKANANDA IN AMERICA AND IN EUROPE]

প্রথম পরিচ্ছেদ

৺রথযাত্রার পরদিন (১৫ই জুলাই) ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ, আষাঢ় — সংক্রান্তি শ্রীশ্রীভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে সকালবেলা ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। নরেন্দ্রের (স্বামী বিবেকানন্দের) মহত্ত্ব-কথা বলিতেছেন —

[নরেন্দ্রের মহত্ত্ব — ‘A prince among men’ ]

“নরেন্দ্রের খুব উঁচু ঘর — নিরাকারের ঘর। পুরুষের সত্তা। এত ভক্ত আসছে, ওর মতো একটিও নাই।

“এক-একবার বসে বসে আমি খতাই। তা দেখি, অন্য পদ্ম কারুর দশদল, কারুর ষোড়শদল, কারুর শতদল, কিন্তু পদ্মমধ্যে নরেন্দ্র সহস্রদল।

“অন্যেরা কলসী, ঘটি এ-সব হতে পারে; নরেন্দ্র জালা।

“ডোবা পুষ্করিণির মধ্যে নরেন্দ্র বড় দীঘি। যেমন হালদার-পুকুর।

“মাছের মধ্যে নরেন্দ্র রাঙ্গাচক্ষু বড় রুই, আর সব নানারকম মাছ — পোনা, কাঠি-বাটা এই সব।

“খুব আধার, — অনেক জিনিস ধরে। বড় ফুটোওলা বাঁশ।

“নরেন্দ্র কিছুর বশ নয়। ও আসক্তি, ইন্দ্রিয়সুখের বশ নয়। পুরুষ পায়রা। পুরুষ পায়রা ঠোঁট ধরলে ঠোঁট ছিনিয়ে লয় — মাদী পায়রা চুপ করে থাকে।”

[আগে ঈশ্বরলাভ — আদেশ হলে লোকশিক্ষা ]

তিন বৎসর পূর্বে (১৮৮২ খ্রী:) নরেন্দ্র দু-একটি ব্রাহ্মবন্ধু সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিতে আসিয়াছিলেন। রাত্রিতে ওইখানেই ছিলেন। প্রত্যূষ হইলে ঠাকুর বলিলেন, “যাও পঞ্চবটীতে ধ্যান কর গিয়ে।” কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর গিয়া দেখেন, তিনি বন্ধুসঙ্গে পঞ্চবটীমূলে ধ্যান করিতেছেন। ধ্যানান্তে ঠাকুর তাঁহাকে বলিতেছেন, “দেখ, ঈশ্বরদর্শনই জীবনের উদ্দেশ্য; ব্যাকুল হয়ে নির্জনে গোপনে তাঁর ধ্যান-চিন্তাকরতে হয় ও কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করতে হয়, ‘ঠাকুর আমাকে দেখা দাও’।” ব্রাহ্মসমাজের ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের লোকহিতকর কর্ম যথা স্ত্রীশিক্ষা, স্কুল স্থাপন, বক্তৃতা (lecture) দেওয়া সম্বন্ধে বলিলেন, “আগে ঈশ্বরদর্শন কর। নিরাকার-সাকার দুই দর্শন। বাক্যমনের অতীত যিনি, তিনিই আবার ভক্তের জন্য রূপধারণ করে দর্শন দেন আর কথা কন। দর্শনের পর তাঁর আদেশ লয়ে লোকহিতকর কর্ম করতে হয়। একটা গানে আছে — মন্দিরে ঠাকুর প্রতিষ্ঠা হয় নাই, পোদো কেবল শাঁখ বাজাচ্ছে, যেন আরতি হচ্ছে; একজন তাই তাকে ধিক্কার দিয়ে বলছে:

মন্দিরে তোর নাহিক মাধব।

(ওরে) পোদো, শাঁক ফুঁকে তুই করলি গোল।
তায় চামচিকে এগার জনা,
দিবানিশি দিচ্ছে থানা —

“যদি হৃদয়মন্দিরে মাধব প্রতিষ্ঠা করতে চাও, যদি ভগবানলাভ করতে চাও, তাহলে শুধু ভোঁ ভোঁ করে শাঁখ ফুঁকলে কি হবে। আগে চিত্তশুদ্ধি কর; মন শুদ্ধ হলে ভগবান পবিত্র আসনে এসে বসবেন। চামচিকার বিষ্ঠা থাকলে মাধবকে আনা যায় না। এগার জন চামচিকে অর্থাৎ একাদশ ইন্দ্রিয়।

“আগে ডুব দাও। ডুব দিয়ে রত্ন তোল, তারপর অন্য কাজ। আগে মাধব প্রতিষ্ঠা, তারপর ইচ্ছা হয় বক্তৃতা (lecture) দিও।

“কেউ ডুব দিতে চায় না। সাধন নাই, ভজন নাই, বিবেক-বৈরাগ্য নাই, দুই-চারটে কথা শিখেই অমনি লেকচার।

“লোকশিক্ষা দেওয়া কঠিন। ভগবানকে দর্শনের পর যদি কেউ তাঁর আদেশ পায়, তাহলে লোকশিক্ষা দিতে পারে।”

১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের রথযাত্রার দিন কলিকাতায় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত পণ্ডিত শশধরের দেখা হয়। নরেন্দ্র উপস্থিত ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ পণ্ডিতকে বলিলেন, “তুমি লোকের মঙ্গলের জন্য বক্তৃতা করছ, তা বেশ। কিন্তু বাবা, ভগবানের আদেশ ব্যতিরেকে লোকশিক্ষা হয় না। ওই দুদিন লোক তোমার লেকচার শুনবে তারপর ভুলে যাবে। হালদার-পুকুরের পাড়ে লোক বাহ্যে করত; লোক গালাগাল দিন কিন্তু কিছুই ফল হয় নাই। অবশেষে সরকার যখন একটি নোটিস মেরে দিলে, তখন তা বন্ধ হল। তাই ঈশ্বরের আদেশ না হলে লোকশিক্ষা হয় না।”

তাই নরেন্দ্র গুরুদেবের কথা শিরিধার্য করিয়া সংসারত্যাগ করিয়া নির্জনে গোপনে অনেক তপস্যা করিয়াছিলেন। অতঃপর তাঁহার শক্তিতে শক্তিমান হইয়া এই লোকশিক্ষাব্রত অবলম্বন করিয়া দুরূহ প্রচারকার্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছিলেন।

কাশীপুরে যখন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পীড়িত হইয়া আছেন (১৮৮৬ খ্রী:) একদিন একটি কাগজে লিখিয়াছিলেন — “নরেন্দ্র শিক্ষে দিবে।”

স্বামী বিবেকানন্দ মাদ্রাজীদের নিকট আমেরিকা হইতে পত্র লিখিয়াছিলেন। তাহাতে লিখিয়াছিলেন যে, তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের দাস; তাঁহারই দূত হইয়া তাঁহার মঙ্গলবার্তা তিনি সমগ্র জগৎকে বলিয়াছেন।

“It was your generous apreciation of Him whose message ti India and to the whole world, I, the most unworthy of His servants, had the privilege to bear, it was your innate spiritual instinct which saw in Him and His message the first murmurs of that tidal wave of spirituality which is destined at no distant future to break upon India in all its irresistible powers.” etc.
— Reply to Madras Address

মাদ্রাজে তৃতীয় বক্তৃতায় বলিয়াছেন যে, আমি সারগর্ভ যাহা কিছু বলিয়াছি, সমস্তই পরমহংসদেবের, অসার যদি কিছু বলিয়া থাকি, সে সব আমার —

“Let me conclude by saying that if in my life I have told one word of truth it was his and his alone; and if I have told you many things which were not true, correct and beneficial to the human race, it was all mine and on me is the responsibility.”
— Third lecture, Madras.

কলিকাতায় ৺রাধাআকান্ত দেবের বাড়িতে যখন তাঁহার অভ্যর্থনা হয়, তখনও তিনি বলিয়াছিলেন যে, শ্রীরামকৃষ্ণদেবের শক্তি আজ জগদ্ব্যাপী! হে ভারতবাসিগণ, তোমরা তাঁহাকে চিন্তা কর তাহা হইলে সকল বিষয়ে মহত্ত্ব লাভ করিবে। তিনি বলিলেন —

“If this nation wants to rise, it will have to come enthusiastically round his name. It does not matter who preaches Ramakrishna, whether I or you or anybody. But him I place before you and it is for you to judge, and for the good of our race, for the good of our nation, to judge now that you shall do with this great ideal of life. * *

* * * Within ten years of his passing away this power has encircled the globe. Judge him not through me. I am only a weak instrument. His character was so great that I or any of his disciples, if we spent hundreds of lives, could do no justice to a millionth part of what he really was.”

গুরুদেবের কথা বলিতে বলিতে স্বামী বিবেকান্দ একেবারে পাগল হইয়া যাইতেন। ধন্য গুরুভক্তি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *