9 of 11

৫২.১৩ ডাক্তার সরকারকে উপদেশ — অহংকার ভাল নয় বিদ্যার আমি ভাল — তবে লোকশিক্ষা (Lecture) হয়

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

ডাক্তার সরকারকে উপদেশ — অহংকার ভাল নয়
বিদ্যার আমি ভাল — তবে লোকশিক্ষা (Lecture) হয়

শ্রীরামকৃষ্ণ — অহংকার না গেলে জ্ঞানলাভ করা যায় না। উঁচু ঢিপিতে জল জমে না। খাল জমিতে চারিদিককার জল হুড়হূড় করে আসে।

ডাক্তার — কিন্তু খাল জমিতে যে চারিদিকের জল আসে, তার ভিতর ভাল জলও আছে, খারাপ জলও আছে, — ঘোলো জল, হেগো জল, এ-সবও আছে। পাহাড়ের উপরও খাল জমি আছে। নৈনিতাল, মানস সরোবর — যেখানে কেবল আকাশের শুদ্ধ জল।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কেবল আকাশের জল, — বেশ।

ডাক্তার — আর উঁচু জায়গার জল চারিদিকে দিতে পারবে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — একজন সিদ্ধমন্ত্র পেয়েছিল। সে পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে দিলে — তোমরা এই মন্ত্র জপে ঈশ্বরকে লাভ করবে।

ডাক্তার — হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তবে একটি কথা আছে, যখন ঈশ্বরের জন্য প্রাণ ব্যাকুল হয়, ভাল জল — হেগো জল — এ-সব হিসাব থাকে না। তাঁকে জানবার জন্য কখন ভাল লোকের কাছেও যায় কাঁচা লোকের কাছেও যায়। কিন্তু তাঁর কৃপা হলে ময়লা জলে কিছু হানি করে না। যখন তিনি জ্ঞান দেন, কোন্‌টা ভাল কোন্‌টা মন্দ, সব জানিয়ে দেন।

“পাহাড়ের উপর খাল জমি থাকতে পারে, কিন্তু বজ্জাৎ-আমি-রূপ পাহাড়ে থাকে না। বিদ্যার আমি, ভক্তের আমি, যদি হয়, তবেই আকাশের শুদ্ধ জল এসে জমে।

উঁচু জায়গার জল চারিদিকে দিতে পারা যায় বটে। সে বিদ্যার আমি রূপ পাহাড় থেকে হতে পারে।

“তাঁর আদেশ না হলে লোকশিক্ষা হয় না। শঙ্করাচার্য জ্ঞানের পর ‘বিদ্যার আমি’ রেখেছিলেন — লোকশিক্ষার জন্য। তাঁকে লাভ না করে লেকচার! তাতে লোকের কি উপকার হবে?”

[পূর্বকথা — সামাধ্যায়ীর লেকচার — নন্দনবাগান সমাজ দর্শন ]

“নন্দনবাগান ব্রাহ্মসমাজে গিছলাম। তাদের উপাসনার পর বেদীতে বসে লেকচার দিলে। — লিখে এনেছে। — পড়বার সময় আবার চারদিকে চায়। — ধ্যান কচ্ছে, তা এক-একবার আবার চায়!

“যে ঈশ্বরদর্শন করে নাই, তার উপদেশ ঠিক ঠিক হয় না। একটা কথা ঠিক হল, তো আর-একটা গোলমেলে হয় যায়।

“সামাধ্যায়ী লেকচার দিলে। বলে, — ঈশ্বর বাক্য মনের অতীত — তাঁতে কোন রস নাই — তোমরা প্রেমভক্তিরূপ রস দিয়ে তঁর ভজনা কর। দেখো যিনি রসস্বরূপ, আনন্দস্বরূপ, তাঁকে এইরূপ বলছে। এ-লেকচারে কি হবে? এতে কি লোকশিক্ষা হয়?

“একজন বলেছিল — আমার মামার বাড়িতে এক গোয়াল ঘোড়া আছে। গোয়ালে আবার ঘোড়া! (সকলের হাস্য) তাতে বুঝতে হবে ঘোড়া নাই।”

ডাক্তার (সহাস্যে) — গরুও নাই। (সকলের হাস্য)

ভক্তদের মধ্যে যাহারা ভাবাবিষ্ট হইয়াছিলেন, সকলে প্রকৃতিস্থ হইয়াছেন। ভক্তদের দেখিয়া ডাক্তার আনন্দ করিতেছেন।

মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, ‘ইনি কে’ ‘ইনি কে’। পল্টু, ছোট নরেন, ভূপতি, শরৎ, শশী প্রভৃতি ছোকরা ভক্তদিগকে মাস্টার এক-একটি করিয়া দেখাইয়া ডাক্তারের কাছে পরিচয় দিতেছেন।

শ্রীযুক্ত শশী[1] সম্বন্ধে মাস্টার বলিতেছেন — “ইনি বি. এ. পরীক্ষা দিবেন।”

ডাক্তার একটু অন্যমনস্ক হইয়াছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি) — দেখো গো! ইনি কি বলছেন।

ডাক্তার শশীর পরিচয় শুনিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারকে দেখাইয়া, ডাক্তারের প্রতি) — ইনি সব ইস্কুলের ছেলেদের উপদেশ দেন।

ডাক্তার — তা শুনেছি।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কি আশ্চর্য, আমি মূর্খ! — তবু লেখাপড়াওয়ালারা এখানে আসে, এ কি আশ্চর্য! এতে তো বলতে হবে ঈশ্বরের খেলা!

আজ কোজাগর পূর্ণিমা। রাত প্রায় নয়টা হইবে। ডাক্তার ছয়টা হইতে বসিয়া আছেন ও এই সকল ব্যাপার দেখিতেছেন।

গিরিশ (ডাক্তারের প্রতি) — আচ্ছা, মশায় এরকম কি আপনার হয়? — এখানে আসব না আসব না করছি, — যেন কে টেনে আনে — আমার নাকি হয়েছে, তাই বলছি।

ডাক্তার — তা এমন বোধ হয় না। তবে হার্ট-এর (হৃদয়ের) কথা হার্টই (হৃদয়ই) জানে। (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) আর এ-সব বলাও কিছু নয়।

১ শশী ১৮৮৪ খ্রী: শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রথম দর্শন করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *