9 of 11

৫২.০৮ অবতারকথাপ্রসঙ্গে — অবতার ও জীব

অষ্টম পরিচ্ছেদ

অবতারকথাপ্রসঙ্গে — অবতার ও জীব

শ্রীরামকৃষ্ণ (ঈশানের প্রতি) — তুমি কিছু বল না; এ (ডাক্তার) অবতার মানছে না।

ঈশান — আজ্ঞা, কি আর বিচার করব। বিচার আর ভাল লাগে না।

শ্রীরামকৃষ্ণ (বিরক্ত হইয়া) — কেন? সঙ্গত কথা বলবে না?

ঈশান (ডাক্তারের প্রতি) — অহংকারের দরুন আমাদের বিশ্বাস কম। কাকভূষণ্ডী রামচন্দ্রকে প্রথমে অবতার বলে মানে নাই। শেষে যখন চন্দ্রলোক, দেবলোক, কৈলাস ভ্রমণ করে দেখলে যে রামের হাত থেকে কোনরূপেই নিস্তার নাই, তখন নিজে ধরা দিল, রামের শরণাগত হল। রাম তখন তাকে ধরে মুখের ভিতর নিয়ে গিলে ফেললেন। ভূষণ্ডী তখন দেখে যে, সে তার গাছে বসে রয়েছে। অহংকার চূর্ণ হলে কাকভূষণ্ডী জানতে পারলে যে, রামচন্দ্র দেখতে আমাদের মতো মানুষ বটে, কিন্তু তাঁরই উদরে ব্রহ্মাণ্ড। তাঁরই উদরের ভিতর আকাশ, চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, সমুদ্র, পর্বত, জীব, জন্তু, গাছ ইত্যাদি।

[জীবের ক্ষুদ্র বুদ্ধি — Limited Powers of the conditioned]

শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি) — ওইটুকু বুঝা শক্ত, তিনিই স্বরাট তিনিই বিরাট। যাঁরই নিত্য তাঁরই লীলা। তিনি মানুষ হতে পারেন না, এ-কথা জোর করে আমরা ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে কি বলতে পারি? আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে এ-সব কথা কি ধারণা হতে পারে? একসের ঘটিতে কি চারসের দুধ ধরে?

“তাই সাধু মহাত্মা যাঁরা ঈশ্বরলাভ করেছেন, তাঁদের কথা বিশ্বাস করতে হয়। সাধুরা ঈশ্বরচিন্তা লয়ে থাকেন, যেমন উকিলরা মোকদ্দমা লয়ে থাকে। তোমার কাকভূষণ্ডীর কথা কি বিশ্বাস হয়?”

ডাক্তার — যেটুকু ভাল, বিশ্বাস করলুম। ধরা দিলেই চুকে যায়, কোন গোল থাকে না। রামকে অবতার কেমন করে বলি? প্রথমে দেখ বালীবধ। লুকিয়ে চোরের মত বাণ মেরে তাকে মেরে ফেলা হল। এ তো মানুষের কাজ, ঈশ্বরের নয়।

গিরিশ ঘোষ — মহাশয়, এ-কাজ ঈশ্বরই পারেন।

ডাক্তার — তারপর দেখ সীতাবর্জন।

গিরিশ — মহাশয়, এ-কাজও ঈশ্বরই পারেন, মানুষ পারে না।

[সায়েন্স — না মহাপুরুষের বাক্য? ]

ঈশান (ডাক্তারের প্রতি) — আপনি অবতার মানছেন না কেন? এই বললেন, যিনি আকার করেছেন তিনি সাকার, যিনি মন করেছেন তিনি নিরাকার। এই আপনি বললেন, ঈশ্বরের কাণ্ড হতে পারে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে) — ঈশ্বর অবতার হতে পারেন, এ-কথা যে ওঁর সায়েন্স-এ (ইংরাজী বিজ্ঞানশাস্ত্রে) নাই! তবে কেমন করে বিশ্বাস হয়? (সকলের হাস্য)

“একটা গল্প শোন — একজন এসে বললে, ওহে! ও-পাড়ায় দেখে এলুম অমুকের বাড়ি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে গেছে। যাকে ও-কথা বললে, সে ইংরাজী লেখা-পড়া জানে। সে বললে দাঁড়াও, একবার খপরের কাগজখানা দেখি। খপরের কাগজ পড়ে দেখে যে, বাড়ি ভাঙার কথা কিছুই নাই। তখন সে ব্যক্তি বললে, ওহে তোমার কথায় আমি বিশ্বাস করি না। কই, বাড়ি ভাঙার কথা তো খপরের কাগজে লেখা নাই। ও-সব মিছে কথা।” (সকলের হাস্য)

গিরিশ (ডাক্তারের প্রতি) — আপনার শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর মানতে হবে। আপনাকে মানুষ মানতে দেব না। বলতে হবে Demon or God (হয় শয়তান, নয় ঈশ্বর)।

[সরলতা ও ঈশ্বরে বিশ্বাস ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — সরল না হলে ঈশ্বরে চট করে বিশ্বাস হয় না। বিষয়বুদ্ধি থেকে ঈশ্বর অনেক দূর। বিষয়বুদ্ধি থাকলে নানা সংশয় উপস্থিত হয়, আর নানারকম অহংকার এসে পড়ে — পাণ্ডিত্যের অহংকার, ধনের অহংকার — এই সব। ইনি (ডাক্তার) কিন্তু সরল।

গিরিশ (ডাক্তারের প্রতি) — মহাশয়! কি বলেন? কুরুটের কি জ্ঞান হয়?

ডাক্তার — রাম বলো! তাও কখন হয়!

শ্রীরামকৃষ্ণ — কেশব সেন কি সরল ছিল! একদিন ওখানে (রাসমণির কালীবাড়িতে) গিছিল। অতিথিশালা দেখে বেলা চারটের সময় বলে, হাঁগা অতিথি-কাঙালদের কখন খাওয়া হবে?

“বিশ্বাস যত বাড়বে, জ্ঞানও তত বাড়বে। যে গরু বেছে বেছে খায় সে ছিড়িক ছিড়িক করে দুধ দেয়। যে গরু শাকপাতা, খোসা, ভুষি, যা দাও, গবগব করে খায়, সে গরু হুড়হুড় করে দুধ দেয়। (সকলের হাস্য)

“বালকের মতো বিশ্বাস না হলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। মা বলেছেন, ‘ও তোর দাদা’ বালকের অমনি বিশ্বাস যে, ও আমার ষোল আনা দাদা। মা বলেছেন, ‘জুজু আছে।’ ষোল আনা বিশ্বাস যে, ও-ঘরে জুজু আছে। এইরূপ বালকের ন্যায় বিশ্বাস দেখলে ঈশ্বরের দয়া হয়। সংসার বুদ্ধিতে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না।”

ডাক্তার (ভক্তদের প্রতি) — গরুর কিন্তু যা তা খেয়ে দুধ হওয়া ভাল নয়। আমার একটা গরুকে ওইরকম যা তা খেতে দিত। শেষে আমার ভারী ব্যারাম। তখন ভাবলুম, এর কারণ কি? অনেক অনুসন্ধান করে টের পেলুম, গরু খুদ ও আরও কি কি খেয়েছিল। তখন মহা মুশকিল! লখনউ যেতে হল। শেষে বার হাজার টাকা খরচ! (সকলের হো-হো করিয়া হাস্য)

“কিসে কি হয় বলা যায় না। পাকপাড়ার বাবুদের বাড়িতে সাত মাসের মেয়ের অসুখ করেছিল — ঘুঙরী কাশি (Whooping Cough) — আমি দেখতে গিছিলাম। কিছুতেই অসুখের কারণ ঠিক করতে পারি নাই। শেষে জানতে পারলুম, গাধা ভিজেছিল, যে গাধার দুধ সে মেয়েটি খেত।” (সকলের হাস্য)

শ্রীরামকৃষ্ণ — কি বল গো! তেঁতুলতলায় আমার গাড়ি গিছিল, তাই আমার অম্বল হয়েছে! (ডাক্তার ও সকলের হাস্য)

ডাক্তার (হাসিতে হাসিতে) — জাহাজের ক্যাপ্তেনের বড় মাথা ধরেছিল। তা ডাক্তারেরা পরামর্শ করে জাহজের গায়ে বেলেস্তারা (blister) লাগিয়ে দিল। (সকলের হাস্য)

[সাধুসঙ্গ ও ভোগবিলাস ত্যাগ ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি) — সাধুসঙ্গ সর্বদাই দরকার। রোগ লেগেই আছে। সাধুরা যা বলেন, সেইরূপ করতে হয়। শুধু শুনলে কি হবে? ঔষধ খেতে হবে, আবার আহারের কটকেনা করতে হবে। পথ্যের দরকার।

ডাক্তার — পথ্যতেই সারে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — বৈদ্য তিনপ্রকার — উত্তম বৈদ্য, মধ্যম বৈদ্য, অধম বৈদ্য। যে বৈদ্য এসে নাড়ী টিপে ‘ঔষধ খেও হে’ এই কথা বলে চলে যায়, সে অধম বৈদ্য — রোগী খেলে কিনা, এ-খবর সে লয় না। আর যে বৈদ্য রোগীকে ঔষধ খেতে অনেক করে বুঝায়, মিষ্ট কথাতে বলে। ‘ওহে ঔষধ না খেলে কেমন করে ভাল হবে? লক্ষ্মীটি খাও, আমি নিজে ঔষধ মেড়ে দিচ্ছি খাও’, সে মধ্যম বৈদ্য। আর যে বৈদ্য রোগী কোন মতে খেলে না দেখে, বুকে হাঁটু দিয়ে জোর করে ঔষধ খাইয়ে দেয়, সে উত্তম বৈদ্য।

ডাক্তার — আবার এমন ঔষধ আছে, যাতে বুকে হাঁটু দিতে হয় না। যেমন হোমিওপ্যাথিক।

শ্রীরামকৃষ্ণ — উত্তম বৈদ্য বুকে হাঁটু দিলে কোন ভয় নাই।

“বৈদ্যের মতো আচার্যও তিনপ্রকার। যিনি ধর্ম উপদেশ দিয়ে শিষ্যদের আর কোন খবর লন না, তিনি অধম আচার্য। যিনি শিষ্যদের মঙ্গলের জন্য তাদের বারবার বুঝান, যাতে উপদেশগুলি ধারণা করতে পারে, অনেক অনুনয় বিনয় করেন, ভালবাসা দেখান — তিনি মধ্যম আচার্য। আর যখন শিষ্যেরা কোনও মতে শুনছে না দেখে, কোনও আচার্য জোর পর্যন্ত করেন, তাঁকে বলি উত্তম আচার্য।”

[স্ত্রীলোক ও সন্ন্যাসী — সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম ]

(ডাক্তারের প্রতি) — “সন্ন্যাসীর পক্ষে কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ। স্ত্রীলোকের পট পর্যন্ত সন্ন্যাসী দেখবে না। স্ত্রীলোক কিরূপ জান? যেমন আচার তেঁতুল। মনে করলে, মুখে জল সরে। আচার তেঁতুল সম্মুখে আনতে হয় না।

“কিন্তু এ-কথা আপনাদের পক্ষে নয়, — এ সন্নাসীর পক্ষে। আপনারা যতদূর পার স্ত্রীলোকের সঙ্গে অনাসক্ত হয়ে থাকবে। মাঝে মাঝে নির্জনে গিয়ে ঈশ্বরচিন্তা করবে। সেখানে যেন ওরা কেউ না থাকে। ঈশ্বরেতে বিশ্বাস ভক্তি এলে, অনেকটা অনাসক্ত হয়ে থাকতে পারবে। দুই-একটি ছেলে হলে স্ত্রী-পুরুষ দুইজনে ভাই-বোনের মতো থাকবে, আর ঈশ্বরকে সর্বদা প্রার্থনা করবে, যাতে ইন্দ্রিয় সুখেতে মন না যায়, — ছেলেপুলে আর না হয়।”

গিরিশ (সহাস্যে, ডাক্তারের প্রতি) — আপনি এখানে তিন-চার ঘণ্টা রয়েছেন; কই, রোগীদের চিকিৎসা করতে যাবেন না?

ডাক্তার — আর ডাক্তারী আর রোগী! যে পরমহংস হয়েছে, আমার সব গেল! (সকলের হাস্য)

শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখ কর্মনাশা বলে একটি নদী আছে। সে নদীতে ডুব দেওয়া এক মহাবিপদ। কর্মনাশ হয়ে যায় — সে ব্যক্তি আর কোন কর্ম করতে পারে না। (ডাক্তার ও সকলের হাস্য)

ডাক্তার (মাস্টার, গিরিশ ও অন্যান্য ভক্তদের প্রতি) — দেখ, আমি তোমাদেরই রইলুম। ব্যারামের জন্য যদি মনে কর, তাহলে নয়। তবে আপনার লোক বলে যদি মনে কর, তাহলে আমি তোমাদের।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি) — একটি আছে অহৈতুকী ভক্তি। এটি যদি হয়, তাহলে খুব ভাল। প্রহ্লাদের অহৈতুকী ভক্তি ছিল। সেরূপ ভক্ত বলে, হে ঈশ্বর! আমি ধন, মান, দেহসুখ, এ-সব কিছুই চাই না। এই কর যেন তোমার পাদপদ্মে আমার শুদ্ধাভক্তি হয়।

ডাক্তার — হাঁ, কালীতলায় লোকে প্রণাম করে থাকে দেখেছি; ভিতরে কেবল কামনা — আমার চাকরি করে দাও, আমার রোগ ভাল করে দাও, — এই সব।

(শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — “যে অসুখ তোমার হয়েছে, লোকেদের সঙ্গে কথা কওয়া হবে না। তবে আমি যখন আসব, কেবল আমার সঙ্গে কথা কইবে।” (সকলের হাস্য)

শ্রীরামকৃষ্ণ — এই অসুখটা ভাল করে দাও। তাঁর নামগুণ করতে পাই না।

ডাক্তার — ধ্যান করলেই হল।

শ্রীরামকৃষ্ণ — সে কি কথা! আমি একঘেয়ে কেন হব? আমি পাঁচরকম করে মাছ খাই। কখন ঝোলে, কখন ঝালে অম্বলে, কখন বা ভাজায়। আমি কখন পূজা, কখন জপ, কখন বা ধ্যান, কখন বা তাঁর নামগুণগান করি, কখন তাঁর নাম করে নাচি।

ডাক্তার — আমিও একঘেয়ে নই।

[অবতার না মানিলে কি দোষ আছে? ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার ছেলে অমৃত — অবতার মানে না। তাতে দোষ কি? ঈশ্বরকে নিরাকার বলে বিশ্বাস থাকলেও তাঁকে পাওয়া যায়। আবার সাকার বলে বিশ্বাস থাকলেও তাঁকে পাওয়া যায়। তাঁতে বিশ্বাস থাকা আর শরণাগত হওয়া। এই দুটি দরকার। মানুষ তো অজ্ঞান, ভুল হতেই পারে। একসের ঘটিতে কি চারসের দুধ ধরে? তবে যে পথেই থাকো, ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকা চাই। তিনি তো অন্তর্যামী — সে আন্তরিক ডাক শুনবেনই শুনবেন। ব্যাকুল হয়ে সাকারবাদীর পথেই যাও, আর নিরাকারবাদীর পথেই যাও, তাঁকেই (ঈশ্বরকেই) পাবে।

“মিছরির রুটি সিধে করেই খাও, আর আড় করেই খাও; মিষ্ট লাগবে। তোমার ছেলে অমৃতটি বেশ।”

ডাক্তার — সে তোমার চেলা।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে, ডাক্তারের প্রতি) — আমার কোন শালা চেলা নাই। আমিই সকলের চেলা! সকলেই ঈশ্বরের ছেলে, সকলেই ঈশ্বরের দাস — আমিও ঈশ্বরের ছেলে; আমিও ঈশ্বরের দাস।

“চাঁদা মামা সকলেরই মামা।” (সভাস্থ সকলের আনন্দ ও হাস্য।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *