7 of 11

৪০.০৪ জন্মোৎসব রাত্রে গিরিশ প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে প্রেমানন্দে

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

জন্মোৎসব রাত্রে গিরিশ প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে প্রেমানন্দে

সন্ধ্যা হইল। ক্রমে ঠাকুরদের আরতির শব্দ শুনা যাইতেছে। আজ ফাল্গুনের শুক্লষ্টমী, ৬।৭ দিন পরে পূর্ণিমায় দোল মহোৎসব হইবে।

সন্ধ্যা হইল। ঠাকুরবাড়ির মন্দিরশীর্ষ, প্রাঙ্গণ, উদ্যানভূমি, বৃক্ষশীর্ষ — চন্দ্রালোকে মনোহররূপ ধারণ করিয়াছে। গঙ্গা এক্ষণে উত্তরবাহিনী, জ্যোৎস্নাময়ী, মন্দিরের গা দিয়া যেন আনন্দে উত্তরমুখ হইয়া প্রবাহিত হইতেছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের ঘরের ছোট খাটটিতে বসিয়া নিঃশব্দে জগন্মাতার চিন্তা করিতেছেন।

উৎসবান্তে এখনও দু-একটি ভক্ত রহিয়াছেন। নরেন্দ্র আগেই চলিয়া গিয়াছেন।

আরতি হইয়া গেল। ঠাকুর আবিষ্ট হইয়া দক্ষিণ-পূর্বের লম্বা বারান্দায় পাদচারণ করিতেছেন। মাস্টারও সেইখানে দণ্ডায়মান আছেন ও ঠাকুরকে দর্শন করিতেছেন। ঠাকুর হঠাৎ মাস্টারকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, “আহা, নরেনেদ্রর কি গান!”

[তন্ত্রে মহাকালীর ধ্যান — গভীর মানে ]

মাস্টার — আজ্ঞা, “নিবিড় আঁধারে” ওই গানটি?

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, ও গানের খুব গভীর মানে। আমার মনটা এখনও যেন টেনে রেখেছে।

মাস্টার — আজ্ঞা হাঁ

শ্রীরামকৃষ্ণ — আঁধারে ধ্যান, এইটি তন্ত্রের মত। তখন সূর্যের আলো কোথায়?

শ্রীযুত গিরিশ ঘোষ আসিয়া দাঁড়াইলেন; ঠাকুর গান গাহিতেছেন:

মা কি আমার কালো রে!
কালরূপ দিগম্বরী হৃদিপদ্ম করে আলো রে।

ঠাকুর মাতোয়ারা হইয়া, দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া গিরিশের গায়ে হাত দিয়া গান গাহিতেছেন:

গয়া গঙ্গা প্রভাসাদি কাশী কাঞ্চী কেবা চায় —
কালী কালী বলে আমার অজপা যদি ফুরায়।
ত্রিসন্ধ্যা যে বলে কালী, পূজা সন্ধ্যা সে কি চায়,
সন্ধ্যা তার সন্ধানে ফেরে কভু সন্ধি নাহি পায় ৷৷
দয়া ব্রত দান আদি, আর কিছু না মনে লয়।
মদনেরই যাগযজ্ঞ ব্রহ্মময়ীর রাঙ্গা পায় ৷৷

গান – এবার আমি ভাল ভেবেছি
ভাল ভাবীর কাছে ভাব শিখেছি।
যে দেশে রজনী নাই মা সেই দেশের এক লোক পেয়েছি,
আমি কিবা দিবা কিবা সন্ধ্যা সন্ধ্যারে বন্ধ্যা করেছি।
নূপুরে মিশায়ে তাল সেই তালের এক গীত শিখেছি,
তাধ্রিম তাধ্রিম বাজছে সে তাল নিমিরে ওস্তাদ করেছি।
ঘুম ভেঙেছে আর কি ঘুমাই, যোগে যাগে জেগে আছি,
যোগনিদ্রা তোরে দিয়ে মা, ঘুমেরে ঘুম পাড়ায়েছি।
প্রসাদ বলে ভুক্তি মুক্তি উভয়ে মাথায় রেখেছি,
আমি কালী ব্রহ্ম জেনে মর্ম ধর্মাধর্ম সব ছেড়েছি।

গিরিশকে দেখিতে দেখিতে যেন ঠাকুরের ভাবোল্লাস আরও বাড়িতেছে। তিনি দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া আবার গাহিতেছেন:

অভয় পদে প্রাণ সঁপেছি
আমি আর কি যমের ভয় রেখেছি।
কালীনাম মহামন্ত্র আত্মশির শিখায় বেঁধেছি,
আমি দেহ বেচে ভবের হাটে শ্রীদুর্গানাম কিনে এনেছি।
কালীনাম কল্পতরু হৃদয়ে রোপণ করেছি,
এবার শমন এলে হৃদয় খুলে দেখাব তাই বসে আছি।

ঠাকুর ভাবে মত্ত হইয়া আবার গাহিতেছেন:

আমি দেহ বেচে ভবের হাটে শ্রীদুর্গানাম কিনে এনেছি।

(গিরিশাদি ভক্তের প্রতি) — ‘ভাবেতে ভরল তনু হরল গেঞান।’

“সে জ্ঞান মানে বাহ্যজ্ঞান। তত্ত্বজ্ঞান, ব্রহ্মজ্ঞান এ-সব চাই।”

[শ্রীরামকৃষ্ণ কি অবতার — পরমহংস অবস্থা ]

“ভক্তিই সার। সকাম ভক্তিও আছে, আবার নিষ্কাম ভক্তি, শুদ্ধাভক্তি, অহেতুকী ভক্তি এও আছে। কেশব সেন ওরা অহেতুকী ভক্তি জানত না; কোন কামনা নাই, কেবল ঈশ্বরের পাদপদ্মে ভক্তি।

“আবার আছে, ঊর্জিতা ভক্তি। ভক্তি যেন উথলে পড়ছে। ‘ভাবে হাসে কাঁদে নাচে গায়।’ যেমন চৈতন্যদেবের। রাম বললেন লক্ষ্মণকে, ভাই যেখানে দেখবে ঊর্জিতা ভক্তি, সেইখানে জানবে আমি স্বয়ং বর্তমান।”[1]

ঠাকুর কি ইঙ্গিত করিতেছেন, নিজের অবস্থা? ঠাকুর কি চৈতন্যদেবের ন্যায় অবতার? জীবকে ভক্তি শিখাইতে অবতীর্ণ হইয়াছেন।

গিরিশ — আপনার কৃপা হলেই সব হয়। আমি কি ছিলাম কি হয়েছি।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ওগো, তোমার সংস্কার ছিল তাই হচ্ছে। সময় না হলে হয় না। যখন রোগ ভাল হয়ে এল, তখন কবিরাজ বললে, এই পাতাটি মরিচ দিয়ে বেটে খেও। তারপর রোগ ভাল হল। তা মরিচ দিয়ে ঔষধ খেয়ে ভাল হল, না আপনি ভাল হল, কে বলবে?

“লক্ষ্মণ লবকুশকে বললেন, তোরা ছেলেমানুষ, তোরা রামচন্দ্রকে জানিস না। তাঁর পাদস্পর্শে অহল্যা-পাষাণী মানবী হয়ে গেল। লবকুশ বললে, ঠাকুর সব জানি, সব শুনেছি। পাষাণী যে মানব হল সে মুনিবাক্য ছিল। গৌতমমুনি বলেছিলেন যে ত্রেতাযুগে রামচন্দ্র ওই আশ্রমের কাছ দিয়ে যাবেন; তাঁর পাদস্পর্শে তুমি আবার মানবী হবে। তা এখন রামের গুণে না মুনিবাক্যে, কে বলবে বল।

“সবি ঈশ্বরের ইচ্ছায় হচ্ছে। এখানে যদি তোমার চৈতন্য হয় আমাকে জানবে হেতুমাত্র। চাঁদমামা সকলের মামা। ঈশ্বর ইচ্ছায় সব হচ্ছে।”

গিরিশ (সহাস্য) — ঈশ্বরের ইচ্ছায় তো। আমিও তো তাই বলছি! (সকলের হাস্য)

শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি) — সরল হলে শীঘ্র ঈশ্বরলাভ হয়। কয়জনের জ্ঞান হয় না। ১ম — যার বাঁকা মন, সরল নয়; ২য় — যার শুচিবাই; ৩য় — যারা সংশয়াত্মা।

ঠাকুর নিত্যগোপালের ভাবাবস্থার প্রসংসা করিতেছেন।

এখনও তিন-চারজন ভক্ত ওই দক্ষিণ-পূর্ব লম্বা বারান্দায় ঠাকুরের কাছে দাঁড়াইয়া আছেন ও সমস্ত শুনিতেছেন। পরমহংসের অবস্থা ঠাকুর বর্ণনা করিতেছেন। বলিতেছেন, পরমহংসের সর্বদা এই বোধ — ঈশ্বরই সত্য আর সব অনিত্য। হাঁসেরই শক্তি আছে, দুধকে জল থেকে তফাত করা। দুধে জলে যদি মিশিয়া থাকে, তাদের জিহ্বাতে একরকম টকরস আছে সেই রসের দ্বারা দুধ আলাদা জল আলাদা হয়ে যায়। পরমহংসের মুখেও সেই টকরস আছে, প্রেমাভক্তি। প্রেমাভক্তি থাকলেই নিত্য-অনিত্য বিবেক হয়। ঈশ্বরের অনুভূতি হয়, ঈশ্বরদর্শন হয়।

—————————
১ শ্রদ্ধালুরত্যুর্জিতভক্তিলক্ষণো
যস্তস্য দৃশ্যোঽমর্নিশং হৃদি।। [অধ্যাত্মরামায়ণ, রামগীতা]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *